প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

অন্যদের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করুন

অন্যদের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করুন

হাকীমুল উম্মতের মজলিস

 

হামদ ও সালাতের পর।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

السعيد من وعظ بغيره

সৌভাগ্যবান সে যে অন্যদের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করে।

এটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বড় একটি হাদীসের টুকরো। এতে আমাদের এমন রোগের চিকিৎসা বাতলানো হয়েছে, যা থেকে কেউ মুক্ত নয়। তাই আমি আলোচনার জন্য এ হাদীস নির্বাচন করেছি। তদুপরি এটিও একটি কারণ যে, এটি ছোট্ট একটা কথা অথচ বড় কাজের কথা। এখনকার মানুষ যেহেতু অলস প্রকৃতির, তাই ছোট বিষয় আলোচনা করাটাই সময়ের দাবি। তবে এ বিষয়টি বাহ্যত ছোট হলেও তা দ্বারা আমাদের বহু বিষয়ের সংশোধন হতে পারে।

 

রোগ দুই প্রকার

এখন বোঝার চেষ্টা করুন, রোগ দুই ধরনের :

এক. এমন রোগ যা রোগী জানেই না।

দুই. এমন রোগ যা রোগী জানে কিন্তু তার প্রতি ভ্রম্নক্ষেপ করে না। এ ধরনের রোগীর অবস্থা বড় বেশি আফসোসের।

তো আমাদের কিছু রোগ অজ্ঞতার কারণে আর কিছু রোগ বেপরোয়া মনোভাবের কারণে।

 

দ্বীনী ব্যাপারে বেপরোয়া মানসিকতার অভিযোগ

কেননা আমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ অজ্ঞ। এদের ব্যাপারে অভিযোগ তত তীব্র নয়। আর কিছুসংখ্যক মানুষ এমনও আছে যারা জানে, তবুও আপন অবস্থা নিয়ে ভাবে না। দুনিয়াবী কাজ যতটা চিন্তা—ভাবনা করে করে, সত্যি বলতে কি দ্বীনী কাজ ততটা চিন্তা—ভাবনা করে করে না। এমনকি আমি তো এ কথা বলি, একেবারেই ভাবে না। দ্বীন যার মধ্যে যতটুকুই আছে তা কেবল অভ্যাসের কারণে, চিন্তা—ভাবনার কারণে নয়। যদিও এটা খুশির বিষয় যে অন্তত দ্বীনের অভ্যাসটুকু তো হয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয় হলো, যেসব বিষয়ের অভ্যাস আছে সেসব তো পালন করে, বাকি অন্যান্য কাজ করে না। সেসব নিয়েও তো ভাবা উচিত। দুনিয়াবী ক্ষেত্রে সামান্যতে তুষ্ট হয় না; বরং বৃদ্ধির জন্য দৌড়ঝাঁপ ও চেষ্টা—তদবীর করতে থাকে। নিজে চিন্তা—ভাবনা করে, অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে। যতদূর সম্ভব চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে না, যদিও অবশেষে কোনো ফল লাভ হোক বা না হোক। কেননা দুনিয়াতে চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে খুব কম উদ্দেশ্য সাধন হয়। নতুবা সবার উদ্দেশ্য চেষ্টা—তদবীরের মাধ্যমে হাসেল হয়ে গেলে, সবাই রাজা বনে যেত। এটা আল্লাহ পাকের বিরাট মাসলেহাত ও কল্যাণ বিবেচনা যে তিনি কারও তদবীর সফল করেন (কারওটা করেন না)। আজ যাদের তদবীর সফল হয়ে যায় তারা তদবীরকেই (সবকিছু মনে করে) যথেষ্ট ভাবতে শুরু করে।

সারকথা হলো—দুনিয়াবী কাজে চেষ্টা—তদবীর অনেক ক্ষেত্রে বিফলে যায়, তবুও মানুষ এর পেছনে লেগে থাকে, চেষ্টা চলতে থাকে। আর আখেরাত লাভের কোনো চেষ্টাই বিফলে যায় না অথচ এর জন্য এ পরিমাণ চেষ্টা করা হয় না। কতটা আশ্চর্যের বিষয়, দুনিয়ার জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা করা হয় আখেরাতের জন্য যদি তার অর্ধেকও করা হতো তবুও বিফলে যেত না।

মোটকথা, নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা—ভাবনা না করার রোগ আমাদের মধ্যে অবশ্যই আছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের কেবল এই একটিমাত্র রোগ; বরং অন্যান্য রোগের সঙ্গে এটিও একটি রোগ। আর এই রোগ প্রায় সবার মাঝে বিদ্যমান। কিন্তু তারপরও তার চিকিৎসার প্রতি কোনো ভ্রম্নক্ষেপ নেই। তো আমরা চিন্তা করলে দেখতে পাব, এই হাদীসে এই রোগের চিকিৎসা বিদ্যমান। কেননা আমাদের রোগ হলো, আমরা ভাবি না, চিন্তা করি না। এ হাদীসে চিন্তা—ভাবনার নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘সৌভাগ্যবান সে যে অন্যের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করে।’ আশ্চর্যের কিছু নেই, যদি এ কথা বহুবার শুনে থাকেন। কেননা এটি একটি প্রসিদ্ধ কথা। এমনকি জনসাধারণের মাঝে বহুল প্রচলিত আছে, ‘বউকে বকে জিকে শেখানো।’ অর্থাৎ মাকে শাসিয়ে মেয়েকে শেখানো। তো এ বাগধারার সারকথাও এই, অন্যদের দেখে শিক্ষাগ্রহণ করা। এর থেকে বোঝা গেল, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কেনো বিষয় শিক্ষা দেননি যা বিবেক—বিরুদ্ধ; বরং এ বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত, তাই এর জন্য দলীলের প্রয়োজন নেই।

 

শরীয়তের প্রতিটি বিষয় স্বভাব মোতাবেক

আমি আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলি, শরীয়ত যেসব বিষয় শিক্ষা দিয়েছে তা এতটাই স্বভাব উপযোগী যে, যদি তা না হতো তাহলে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো। অবশ্য তা বোঝার জন্য স্বভাব—প্রকৃতি সুস্থ থাকা জরুরি। কেননা গোনাহ করতে করতে আমাদের মন—মানসিকতা বিগড়ে গেছে। তাই শরীয়তের শিক্ষা—দীক্ষা থেকে পালিয়ে বেড়ায়। যেমন রোগীরা ‘বাছবিচার’ পরিহার করে চলতেই পছন্দ করে আর যে ওষুধ—পথ্য উপকারী, তা থেকে পালিয়ে বেড়ায়। চিকিৎসকের পরামর্শকে তবিয়ত—বিরুদ্ধ মনে করে। দেখুন, যে সুস্থ সে পরিমাণমতো পানি পান করে আর যে শোথ রোগে আক্রান্ত তার পিপাসা এতটাই সীমাছাড়া যে এক সমুদ্র পানি দিয়েও তার পিপাসা দূর হয় না। চিকিৎসক যদি তাকে মাত্রাতিরিক্ত পানি পান করতে বারণ করে তাহলে সে একে তবিয়ত—বিরুদ্ধ মনে করবে। অথচ খোদ তার স্বভাবই সুস্থতা থেকে যোজন যোজন দূরে। নতুবা এক ঢোকের বেশি পান করলেই অস্বস্থি বোধ হয়।

তদ্রুপ আমি এক ব্যক্তিকে খেতে দেখেছি, সে এক দিক থেকে আহার করছিল অপর দিক থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। এমনটাই লাগাতার চলতে থাকত। তো এ লোকের স্বাস্থ্য কি ঠিক আছে? কিছুতেই না। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, রুচি—স্বভাব ঠিক থাকলে তা শরীয়তের প্রতিই ঝুঁকবে ও আগ্রহী হবে। বিষয়টি যদি পরিষ্কার না হয়ে থাকে তাহলে পরীক্ষা করে নিন। কখনো শরীয়তবিরোধী কাজ হয়ে গেলে তাতে অবশ্যই কষ্ট লাগে যেমন মাত্রাতিরিক্ত আহার করলে কষ্ট হয়। কেননা শুরুতে মনে গোনাহের কামনা সৃষ্টি হয় কিন্তু করার পর খারাপ লাগে। যদি বলেন, আমাদের তো কিছুমাত্র খারাপ লাগে না। তাহলে শুনে রাখুন, এটা গোনাহের দাগে হৃদয় কালো হয়ে যাওয়ার আলামত। এভাবে লক্ষ করুন সর্বপ্রথম যখন গোনাহ করেছিলেন তখন কেমন লেগেছিল। যে ব্যক্তি প্রথমবার ঘুস খায়, তার মনে হয় যেন তার মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়েছে। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হতে থাকে। তদ্রুপ প্রথমবার যিনা করার পর বিবেকের প্রচণ্ড ধিক্কারের সম্মুখীন হতে হয়। নিজের কাছে নিজে হেয় হয়ে যায়। একই অবস্থা হয় অন্যান্য গোনাহের ক্ষেত্রেও। এর দ্বারা বোঝা যায়, প্রতিটি গোনাহই স্বভাব—বিরুদ্ধ এবং শরীয়তের প্রতিটি বিধান স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অবশ্য কিছু গোনাহ এমনও আছে যার প্রতিক্রিয়া তৎক্ষণাৎ প্রত্যেকেই টের পায় না; বরং মৃত্যুর পর টের পাবে।

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর শিক্ষা—দীক্ষা স্বভাবের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ

মোটকথা, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সেসব বিষয়ই করতে বলেছেন, যা স্বভাবের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। এ হাদীসে যে বলা হয়েছে ‘অন্যদের দেখে শিক্ষাগ্রহণ করো’ তা—ও পুরোপুরি স্বভাব মোতাবেক। দেখুন, এক চোরের শাস্তি হলে অন্য চোরদের ফায়দা হলো তারা চুরি ছেড়ে দেবে। আর ক্ষতি হবে অন্যদের শাস্তি হতে দেখেও চুরি অব্যাহত রাখলে। আর এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ওই প্রবাদ বাক্যেরই বাস্তবায়ন ঘটবে যা লোকসমাজে বহুল আলোচিত, ‘চোরের দশ দিন গৃহস্থের এক দিন।’ একদিন না একদিন সে—ও ধরা খাবে।

 

এক চোরের ঘটনা

হযরত উমর রাযি.—এর কাছে এক চোরকে ধরে আনা হলো। তিনি তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন।

চোর : আমীরুল মুমিনীন, আমি এই     প্রথমবার মাত্র চুরি করেছি।

হযরত উমর রাযি. : তুমি ভুল বলছ। প্রথমবারেই পাকড়াও করে ফেলা আল্লাহ পাকের নীতি নয়।

ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানা গেল, সে বড় পাকা ও পুরোনো চোর।

মাওলানা রুমী রহ. বলেন, আল্লাহ পাক আপন দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা আমাদের বহু গোনাহের উপর পর্দা ফেলে রাখেন। তবে কেউ যখন অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘন করতে থাকে তখন তিনি অপদস্থও করে দেন।

সুতরাং যারা অন্যদের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করে না, পরিশেষে তাদের পরিণামও ওই রকমই হয়। মোটকথা, এটুকু তো সাব্যস্ত হয়ে গেল, এই নির্দেশ পুরোপুরি স্বাভাবিক ও কল্যাণকর। এখন দেখতে হবে এই রোগ অন্যদের মাঝে আছে কি না? তো নিজেদের অবস্থা নিয়ে একটু ভাবলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, আমরা এতে বড় গুরুতরভাবে আক্রান্ত। আমাদের অবস্থা হলো এই, কোনো বিষয়ে আমরা অন্যদের দেখে শিক্ষাগ্রহণ করি না। এখন আমি একটি বিশেষ বিষয় আলোচনা করছি। আপনারা শুনে থাকবেন, জায়গায় জায়গায় এখন মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি সংবাদপত্রেও আপনারা পড়ে      থাকবেন।

 

সংবাদপত্রের তত্ত্ব ও হাকীকত এবং সংবাদপত্র পাঠে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি

আপনারা সংবাদপত্র পাঠকেই একটি স্বতন্ত্র ব্যস্ততা বানিয়ে নিয়েছেন। একবার আমি সংবাদপত্র প্রসঙ্গে একটি লেখা লিখেছিলাম। যাতে বলেছিলাম, সংবাদপত্র কখন পড়া জায়েয আর কখন নাজায়েয। কিন্তু পত্রিকাওয়ালারা লেখাটি ভালোভাবে না দেখেই এমন হইচই বাধিয়ে দিলো যে—আল্লাহর পানাহ—তারা প্রচার করল যে,  ‘নাও সংবাদপত্র পড়াও এখন একেবারে হারাম করে দিয়েছে।’    তখন পর্যন্ত সংবাদপত্র পাঠের ব্যাপারে আমার অবস্থান এতটা কঠোর ছিল না। কিন্তু এ ঘটনা আমার হাতে একটি জোরালো দলীল হয়ে এল যে, পত্রিকাওয়ালারা অপবাদও আরোপ করে। প্রকৃতপক্ষে সংবাদপত্রের স্বরূপ আসলে এমনই অর্থাৎ বেশিরভাগ সংবাদই অনুমানের ভিত্তিতে বিনা দলীলে প্রচার করে।

সুধীমণ্ডলী, সংবাদও এক ধরনের ইতিহাস। সংবাদ পরিবেশনে যদি সতর্কতা অবলম্বন করা হয় তাহলে ক্ষতি কী? আর ইতিহাস খুব উপকারী বিষয়। আল্লাহ পাক বলেন,

لَقَدْ کَانَ فِیْ قَصَصِهِمْ عِبْرَۃٌ  لِّاُولِی الْاَلْبَابِ

অর্থাৎ পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলি এজন্য বর্ণনা করা হয় যাতে মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করে।

শিক্ষাগ্রহণের সারকথা হলো—এ কথা চিন্তা করা যে, অমুকে এই কাজ করেছে ফলে পরিণামে এই হয়েছে। আমরা যদি এরূপ করি তাহলে আমাদের পরিণতিও এরূপ হবে। এই হলো শিক্ষাগ্রহণের মর্মার্থ। এ কারণে ইতিহাসবিদ্যা উপকারী।

সুতরাং সংবাদপত্র পড়ে যদি এই শিক্ষা লাভ হয় তাহলে তা উপকারী জিনিস, অন্যথায় তা নিরর্থক। এখন দেখুন, কয়জন এই শিক্ষা অর্জন করে। বেশিরভাগ মানুষ মুসলমানদের মুসিবতের কথা শুনে, কিন্তু তা তাদের মধ্যে বিন্দু পরিমাণও রেখাপাত করে না।

 

প্লেগ মহামারি থেকে আমাদের শিক্ষা লাভ হয় না

এখন দেখুন, বিভিন্ন স্থান থেকে মহামারির খবর আসছে। সংবাদপত্রে পড়ছি কিন্তু একশতে নিরানব্বই ভাগই এমন যাদের হৃদয়ে তা এতটা রেখাপাত করে না যতটা রেখাপাত করত নিজ অঞ্চলে হলে। অন্যদের কষ্টের সংবাদ শুনে যখন আমাদের হৃদয় ব্যথিত হয় না তখন তো আমরা মানুষই নই। বর্তমানে আমরা যে উদ্দেশ্যে সংবাদপত্র পড়ি তার সারকথা হলো ঘরভর্তি তামাশা দেখা অর্থাৎ অন্যের ঘর জ্বলছে, আমরা তালি বাজাচ্ছি। সংবাদপত্র পড়ে অবসর সময় পার করি, নিজের মনোরঞ্জন করি। সংবাদপত্র না পড়লে অন্তত মুসলমানদের বিপদ—আপদকে অবসর সময়ের ব্যস্ততা বানিয়ে রাখা হতো না। আর শিক্ষা অর্জন করলে তাদের সাহায্য করার শিক্ষা অর্জন করতাম। সাহায্যের চিন্তাটা খুব কম মানুষের মাথায় আসে। হ্যাঁ, এ ধরনের শিক্ষা লাভ করি যে, অমুক অঞ্চলের লোকেরা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখেনি তাই সেখানে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এর পেছনে আরও বড় বিষয় আছে, যার হাওয়া—বাতাসও আপনি পাননি।

মাওলানা রুমী রহ. বলেন, আর কত গ্রিকদর্শন ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে থাকবে। এখন ঈমানদারদের বিজ্ঞান ও দর্শন কিছুটা পড়। গ্রিকদর্শন ও বিজ্ঞান শরীর তথা বাহ্যকেন্দ্রিক অর্থাৎ বাহ্যিক সবই তো বুঝেন কিন্তু আত্মদর্শন ও আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান বলেও যে কিছু একটা আছে তা বুঝেন না। এটুকু জেনে বিশ্বাস করে নিয়েছেন যে আবহাওয়া দূষিত হওয়ায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু পারলে এটাও বলুন, আবহাওয়া দূষিত হওয়ার কারণ কী? আপনি মহামারির কারণটা তো দেখলেন তথা বায়ূদূষণ কিন্তু এই কারণের পেছনের কারণটা দেখার গরজ বোধ করলেন না যে বায়ূদূষণ কেন হলো?

 

মহামারির কারণ নির্ণয়ে দুনিয়াদারদের ভুল

আমি ডাক্তার ও চিকিৎসকদের বক্তব্য মিথ্যা আখ্যায়িত করছি না। এটা দেখানোর চেষ্টা করছি যে, তাদের দৃষ্টি আসল কারণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। বিষয়টা একটি দৃষ্টান্তের আলোকে এভাবে বোঝার চেষ্টা করুন, একজন কলম দিয়ে লিখছে। কিছু পিপীলিকা তা দেখছে। দেখে—শুনে পিপীলিকাদের একজন মন্তব্য করল, বর্ণমালাগুলো আপনাআপনি তৈরি হয়ে চলছে।

দ্বিতীয়জন মন্তব্য করল, (যার দৃষ্টি কিছুটা দূর পর্যন্ত দেখেছে) না, তোমার কথা ঠিক নয়; বরং কলম চলছে তাই বর্ণমালা তৈরি হচ্ছে।

তৃতীয়জন (যার দৃষ্টি আরও দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে) সে মন্তব্য করল, কলম আপনাআপনি চলছে না; বরং আঙুল তা পরিচালনা করছে।

চতুর্থজন (যার পূর্ণ অবগতি ছিল) সে মন্তব্য করল, আঙুল আপনাআপনি চলছে না; বরং মানুষের ইরাদা ও ইচ্ছা তা পরিচালনা করছে।

বলুন তো এদের মধ্যে কার মত সঠিক এবং কার দৃষ্টি আসল বিষয়ের উপর। বলাবাহুল্য, যে ইরাদা ও ইচ্ছার বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছে তার দৃষ্টিই আসল বিষয় পর্যন্ত পৌঁছেছে। সে দূরদর্শী, অন্যরা অদূরদর্শী।

জনৈক বুযুর্গ দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতেন, দেয়াল পেরেককে বলে, তুমি কেন আমায় বিদীর্ণ করছ।

পেরেক উত্তর দিলো, আমার কী করার আছে? যে আমাকে পেটাচ্ছে তাকে বলো।

আরেকটি দৃষ্টান্ত নিন, কারও ফাঁসি হলো। কেউ প্রশ্ন করল, কীভাবে ফাঁসি দেওয়া হলো?

একজন উত্তর দিলো, গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়জন : আহমক কোথাকার, বিচারক হুকুম দিয়েছে তাই ফাঁসি হয়েছে।

তৃতীয়জন : সে ডাকাতি করেছিল বলে বিচারক তাকে ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছিল।

তো বলতেই হবে, প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে অবহিত এই তৃতীয়জন যিনি বিচারকের বিচারও দেখেছেন এবং অপরাধীর অপরাধও দেখেছেন। ব্যস এটুকুই পার্থক্য বাহ্যদর্শী ও অন্তর্দশীর্দের মধ্যে। তো এ কথাও সত্য, মৃত্যু হয়েছে ফাঁসির রজ্জু দিয়ে আর মহামারি ছড়িয়েছে বায়ূদূষণ দ্বারা। তবে এটাও দেখতে চেষ্টা করুন বায়ূদূষণ কেন হয়েছিল? একেও বাদ দেওয়া উচিত নয়। আর এক মহামারির কথাই—বা বলছি কেন, যত বিপদ ও বালা—মুসিবত আসে সবই গোনাহের কারণেই আসে। আল্লাহ পাক বলেন,

وَ مَاۤ  اَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِیْبَۃٍ  فَبِمَا کَسَبَتْ اَیْدِیْكُمْ

অর্থাৎ তোমাদের উপর যত বালা—মুসিবত আসে সব তোমাদের গোনাহের কারণে (আসে)।

 

হুযুরমাওলানারা বাহ্যিক কারণ অস্বীকার করেন না

এখান থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকবে, হুযুর—মাওলানাদের ব্যাপারে যে অভিযোগ করা হয় তারা গোনাহকে প্রতিটি মুসিবতের কারণ আখ্যায়িত করে থাকে এবং বাহ্যিক কারণকে অস্বীকার করে—এ অভিযোগ একেবারেই অবান্তর। কারণ ও অনুঘটকের ব্যাপারে তারা বেখবর নন; বরং তারা কারণের সঙ্গে কারণের (পেছনের) কারণকেও দেখেন। তাই তারা বলেন, যত বিপদ আসে সব গোনাহের কারণে আসে। আগুন, পানি, বায়ূ সব আল্লাহ পাকের হুকুমের অধীন। তাদের যখন যেরূপ হুকুম করা হয় তারা তখন সেরূপ আচরণ করে।

 

এক অমুসলিম রাজার ঘটনা

এক অমুসলিম রাজা বহু মুসলমানকে আগুনে নিক্ষেপ করল। কেননা তারা মূর্তিকে সেজদার নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। সবশেষে এক মহিলাকে আনা হলো এবং তাকেও সেজদার নির্দেশ দেওয়া হলো। তো সেও এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করল। তার কোলে একটি শিশু ছিল। রাজা কোলের শিশুটিকে আগুনে নিক্ষেপের হুকুম দিলো। রাজার হুকুমে তাকে আগুনে ফেলে দেওয়া হলো। এখন এই মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে সেজদা করে ফেলবে ফেলবে অবস্থায় শিশুটি ডেকে বলল, মা, সাবধান। এ কাজ করতে যেয়ো না। আমি এখানে বড় আরামে আছি। আপনিও চলে আসুন। এরপর ওই মা আগুনে ঝাঁপ দিলো। এরপর সে অন্যদের দাওয়াত দিতে লাগল, এখানে এসে পড়, এখানে এসে পড়, বড় সুন্দর ও মনোরম বাগান। তারপর অবস্থা এই হলো যে, লোকজন বেচাইন হয়ে আগুনে ঝাঁপ দিতে লাগল। সিপাহিদের বাধা সত্ত্বেও লোকজন একের পর এক ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল। এই অবস্থা দেখে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে আগুনকে বলল, আগুন তুই কি আর আগুন থাকিসনি, না তোর দহনক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে?

আগুন থেকে জবাব এল, আমি সেই আগুনই আছি। আমার দহন ক্ষমতাও বিলোপ হয়নি। তুমি এসে দেখো। দহনের কী জ্বালা ভালোভাবেই ঠাহর করতে পারবে। বাকি এদেরকে কী করে জ্বালাব, কেননা আল্লাহ পাকের হুকুম নেই। আমি তার তরবারি, তরবারি কাটে, কিন্তু যার হাতে থাকে তার চালনার সুবাদে কাটে। চালনা ছাড়া তরবারি কীভাবে কাটবে। তদ্রুপ আবহাওয়াও আল্লাহ পাকের হুকুমেই দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে যায় এবং ধ্বংস ছড়িয়ে পড়ে।

হযরত মাওলানা নেজামী রহ. বলেন, আল্লাহ পাকের হুকুম ছাড়া মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করতে পারে না এবং তাঁর হুকুম ছাড়া ভূমি একটি দানাও উৎপাদন করতে পারে না। তো বালা—মুসিবতের মূল কারণ গোনাহ ও পাপাচার।

মাওলানা রুমী রহ. বলেন, যত বালা—মুসিবত আসে সব আমাদের গোস্তাখি ও ধৃষ্টতার কারণে আসে।

 

দুঃখ ও দুশ্চিন্তার সময় তওবা করুন

তো যখন দুঃখ ও দুশ্চিন্তার বিষয় দেখা দেয় তৎক্ষণাৎ তওবা করুন। দেখুন কী দারুণ শিক্ষা ও কী চমৎকার বিষয়। তদ্রুপ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, তোমরা যদি শাসকদের থেকে বিরূপ আচরণ প্রকাশ পেতে দেখো তাহলে তাদের সমালোচনা করো না। (প্রিয়নবীর শিক্ষার প্রতি উৎসর্গ হওয়া দরকার, কীভাবে অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।)এরপর আল্লাহ পাকের তরফে এর এই ব্যাখ্যা করেন যে, শাসকদের হৃদয় আমার নিয়ন্ত্রণে, যদি শান্তি চাও তাহলে আমার আনুগত্য করো। আমার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখো, আমি তাদের হৃদয় নরম করে দেব।

 

বালামুসিবতের সময় আল্লাহমুখী হওয়াতেই প্রতিকার

একবার কানপুরে মহামারি দেখা দিলো। জনসাধারণ একটি সভার আয়োজন করে। এরপর জেলা প্রশাসকের নিকট মহামারি—সংক্রান্ত নতুন আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার দরখাস্ত করবে, যাতে তা তুলে নেওয়া হয়। উক্ত সভায় আমার অংশগ্রহণও তাদের কাম্য ছিল। আমি অপারগতা প্রকাশ করলাম। কিন্তু লোকজন যখন খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগল তখন আমি বললাম, দেওয়ানে হাফেয থেকে এ ব্যাপারে সুলক্ষণ ও নির্দেশনা খুঁজব। লক্ষণ বা নির্দেশনা খোঁজার অর্থ এই নয় যে আমি শুভ বা অশুভ লক্ষণে বিশ্বাসী কিংবা লক্ষণ আমার ধারণা মোতাবেক হওয়া আবশ্যক। বরং এই কারণে ছিল যে, দেওয়ানে হাফেয খুললে বেশিরভাগ সময় অবস্থা উপযোগী ও উপকারী বিষয় বের হয়ে আসে। তাই আমি তা নিয়ে বসে পড়লাম। খুলতেই এই পঙ্ক্তিটি চোখে পড়ল,

گدائے گوشہ نشینی تو حافظا مخروش

رموز  ومصلحت  ملک خسرواں  دانند

অর্থাৎ আপন রাজত্বের কল্যাণ—অকল্যাণ রাজাই ভালো বোঝেন। তুমি দরবেশ, নির্জনবাসী এসবের কী বুঝ, খামাখা এ নিয়ে নাক গলাতে যাও কেন।

আমি তাদের বললাম, এখন আপনারা আপাতত নীরব থাকুন। আল্লাহর হাওয়ালা করে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকুন। প্রতিদিন বাদ আসর নিয়মিত لَا حَوْلَ وَ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِالله এর আমল করুন। ঘটনাক্রমে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—ইনশাআল্লাহ সপ্তাহ দুই সপ্তাহের মধ্যে সব পেরেশানী দূর হয়ে যাবে। তারা আমার কথামতো আমল করল। জেলা প্রশাসক আপনাতেই রির্পোট করল, এইসব নতুন আইনে লোকদের কষ্ট হচ্ছে তাই প্রত্যাহার করে নেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। ফলে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। লোকজন খুব খুশি হয়ে আমার কাছে বলতে লাগল, জনাব সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।

আমি বললাম, এমনটা কি কখনো হতে পারে যে, নবীজির বাতলানো তদবীর অকার্যকর প্রমাণিত হবে।

 

পার্থিব আরামও শরীয়তের উপর চলার মধ্যে

সুধীমণ্ডলী, আমরা যদি আমল করি তাহলে দেখতে পাব পার্থিব আরামও শরীয়ত মোতাবেক চলার মধ্যে। তো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অহেতুক কাজ থেকে এতদূর বারণ করেছেন যে, শাসকদের সমালোচনা করতে পর্যন্ত নিষেধ করেছেন। মোটকথা সমস্ত বালা—মুসিবতের কারণ হলো এই—আমরা আল্লাহ পাককে নারাজ করে রেখেছি। হাদীস শরীফে আছে, যে জাতির মধ্যে যিনা তথা ব্যভিচার বেড়ে যাবে তাদের মধ্যে মহামারি ছড়িয়ে পড়বে।

 

মহামারির আরেক কারণ সমকামিতা

আর এই মহামারির আরেকটা কারণও আছে, যদিও কিছু বিষয় এমন আছে যা প্রকাশ করার মতো নয়, তবে এজন্য প্রকাশ করছি, যাতে মানুষ নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নেয়। প্রায় তিন—চার বছর পূর্বে থানাভবনের আশপাশের এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল। তো মহামারি শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্বে একবার শেষ রাতে নির্জনে বসেছিলাম। তখন হৃদয়ে এই আয়াত ভেসে ওঠে,

اِنَّا مُنْزِلُوْنَ عَلٰۤی اَهْلِ هٰذِهِ  الْقَرْیَۃِ رِجْزًا مِّنَ السَّمَآءِ بِمَا کَانُوْا یَفْسُقُوْنَ

অর্থ : আমি এই জনপদের অধিবাসীদের উপর আকাশ থেকে আযাব নাযিল করব তাদের পাপাচার ও অপকর্মের কারণে।

এই আয়াত হযরত লূত আ.—এর সম্প্রদায়ের ব্যাপারে অবতীর্ণ। ইঙ্গিত এদিকে ছিল যে, একালেও লোকজন পুরুষে পুরুষে কুসম্পর্ক স্থাপন এবং বালকদের সঙ্গে কুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যে অবস্থা ছিল লূত সম্প্রদায়ের, তাই আযাব নাযিল হবে। আমি তা ওয়াজে আলোচনা করেছি কিন্তু এ কথা বলিনি যে, আমি এমনটা জানতে পেরেছি; বরং এ কথা বলেছি, জনৈক ব্যক্তির ইলহাম হয়েছে। (ইলহাম হলো হৃদয়ে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে কোনো বিষয় উদ্ভাসিত হওয়া।) কিন্তু জনসাধারণ বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি তাই মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। মোটকথা মহামারির আরেকটা কারণ বের হলো, তা হলো ওই অপকর্ম যা ছিল লূত সম্প্রদায়ের মধ্যে।

 

সমকামিতা মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে

একালে লোকদের এ ভয়ংকর রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ তো সরাসরি মূল পাপেই ফেঁসে আছে। কেউ কেউ এসব পাপের উপকরণ ও মাধ্যমসমূহে (ফেঁসে আছে), যেমন সুশ্রী বালক ও পর—নারীদের প্রতি কুদৃষ্টি করা। হাদীস শরীফে আছে, চক্ষুও যিনা করে আর চোখের যিনা হলো দৃষ্টি। হাত যিনা করে আর তার যিনা হলো স্পর্শ করা। জিহ্বা যিনা করে আর তার যিনা হলো যৌন উত্তেজক কথা বলা। মানুষের মন খাহেশ ও কামনা করে। এমনকি নিজের মনোরঞ্জনের জন্য কোনো সুশ্রী ছেলে কিংবা মেয়ের সঙ্গে কথা বললে তা—ও যিনা ও সমকামিতা বলে গণ্য হবে। আর মনের গোনাহ হলো কল্পনা—জল্পনা করা, যা দ্বারা স্বাদ ও মজা অনুভূত হয়। তো যিনা—ব্যভিচারের প্রকার যত, সমকামিতার প্রকারও তত। বেশিরভাগ লোক এই রোগে আক্রান্ত আর এটা খুব আফসোস ও বেদনাদায়ক বিষয়। কেননা সৃষ্টিগতভাবে (পুরুষের) স্বভাব—প্রকৃতি নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয় কিন্তু তারপরও লোকজন বালকদের প্রতি বেশি ঝুঁকার কারণ হলো নারীর সঙ্গে অবাধ মেলামেশায় কলঙ্কের আশঙ্কা থাকে। দ্বিতীয়ত নারীদের সহজে পাওয়াও যায় না। (এটা হযরত থানভী রহ.—এর যুগের কথা। এখন তো উভয় পাপই ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।) পক্ষান্তরে বালকদের সঙ্গে মেলামেশায় ততটা কলঙ্কের আশঙ্কা নেই। আর এরা সহজলভ্যও বটে। বিশেষত দেখা ও জল্পনা—কল্পনা এজন্য সহজ যে তা কেউ টের পায় না। আর এসবই অপকর্মের অন্তভুর্ক্ত।

 

দৃষ্টির গোনাহে পরহেযগাররাও আক্রান্ত

আর অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো—উঁকিঝুঁকি মারার রোগে বহু পরহেযগার লোকও আক্রান্ত। আর এক্ষেত্রে তারা ধোঁকায় পড়ে যাওয়ার কারণ হলো শুরুতে তারা নিজেদের মধ্যে কামনা অনুভব করে না তাই তারা ভাবে, আমাদের দৃষ্টি কামনাতাড়িত নয়। কিন্তু পরে খুব দ্রুতই কামনাতাড়িত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। তাই শুরু থেকেই সতর্ক থাকা কাম্য।

 

ইমাম আবু হানিফা রহ.এর ঘটনা

সুধীবৃন্দ, ইমাম আবু হানিফা রহ.—এর চেয়ে বড় বুযুর্গ ও পরিশুদ্ধ এ কলিকালে আর কে হতে পারবে। কিন্তু তারপরও দেখুন কত সতর্কতা। ইমাম সাহেব যখন সর্বপ্রথম ইমাম মুহাম্মদকে দেখেন তখন লক্ষ করলেন, তার মুখে এখনো দাড়ি গজায়নি। তাই তিনি তাকে নির্দেশ দিলেন, যতদিন দাড়ি না গজাবে ততদিন আমার পিঠের পেছনে বসবে। উভয় পক্ষ দ্বীনদার পরহেযগার অথচ কী পরিমাণ সতর্কতা। দীর্ঘদিন পর ঘটনাক্রমে হযরত ইমাম সাহেবের নজর পড়ে যায় ইমাম মুহাম্মদের উপর। তখন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার আবার কখন দাড়ি উঠল?

তো ইমাম আবু হানিফা রহ.—এর মতো মহামানব যখন এক্ষেত্রে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন তখন একালে এমন কে আছে যে এক্ষেত্রে নিজের উপর আস্থা রাখতে পারে। তো উক্ত আয়াতে এ কথা বলা হয়েছিল যে, লোকদের উপর এই কুকর্মের ফলে আযাব আসা অবশ্যম্ভাবী। আমি বাধা প্রদানের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কে শোনে কার কথা? যখন এ অপকর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখন হীনম্মন্যদের পক্ষে তা বর্জন করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

 

সুশ্রী বালকদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার রোগ সামান্য হিম্মত করলেই ছুটে যেতে পারে

হ্যাঁ, যদি হিম্মত করা হয় এবং পাকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাহলে এ রোগ দূরও হয়ে যায়। কেননা কতক গোনাহ তো এমনও থাকে যে, সেসবে একটা সীমা পর্যন্ত অপরাগতাও থাকতে পারে। যেমন কোনো গরিব লোকের ঘুস গ্রহণ। কেননা সে যদি ঘুস গ্রহণ না করে তাহলে বাহ্যত তার কাজ আটকে থাকে। আর এ কাজে কোনো অপারগতাও নেই যে না করলে কোনো কাজ আটকে থাকবে। সুতরাং এতে সামান্য হিম্মত দরকার। কেননা এক্ষেত্রে বড়জোর নফসের উপর চাপ পড়বে, তার কষ্ট হবে, এ ছাড়া কোনো ক্ষতি হবে না। তো সাহসী ও হিম্মতওয়ালাদের জন্য কাজটা খুব সহজ। সাহসী ও হিম্মতওয়ালারা তো আল্লাহর পথে জান—প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এমন বহু সাহসী ও হিম্মতওয়ালার ঘটনা আমরা শুনেছি, যারা মুরিদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা জীবনের আফিমের নেশার অভ্যাস পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে।

[১৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন