অন্যদের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করুন
অন্যদের অবস্থা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করুন
কুদৃষ্টির ক্ষতিসমূহ
তো ভালোভাবে মনে রাখবেন, শয়তান প্রথম প্রথম ভালো নিয়তে দেখায়। কিছুদিন পর যখন অভ্যাস হয়ে যায়, হৃদয়ে মহব্বত আসন গেড়ে নেয় তখন দৃষ্টিকে নাপাক ও দূষিত করে দেয়। তো আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হলো মহব্বত হওয়ার সুযোগই না দেওয়া। আর মহব্বত হয়ই দেখাদেখির দ্বারা। সুতরাং দেখাদেখিই বাদ দাও। খুব সম্ভব হাদীস শরীফেরই বাণী—
النظر سهم من سهام ابليس
দৃষ্টি শয়তানের তিরসমূহের মধ্য থেকে এক বিষাক্ত তির।
আর তিরও এমন তির যে তার যখমের চিহ্ন পর্যন্ত ঠাওর করা যায় না, অথচ হৃদয়ে আসন গাড়তে থাকে। আর এ দৃষ্টি এমনই নীরব ঘাতক যে, তার প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও দীর্ঘ দিন পর্যন্ত টেরই পাওয়া যায় না যে, আমি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি; বরং প্রিয়জন যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন হৃদয়ে একধরনের জ্বালা সৃষ্টি হয়। তখন গিয়ে বোঝা যায় প্রেমে পড়ে গেছি। এই জ্বালা যত বাড়তে থাকে আল্লাহ পাকের মহব্বত তত কমতে থাকে। এতে আল্লাহ পাক ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। আর কেনই—বা হবেন না। কেননা, এ ধরনের ক্ষেত্রে দুনিয়ার প্রেয়সীরাও বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে যায়।
এক মিথ্যা প্রেমের দাবিদারের ঘটনা
মসনবী শরীফে মাওলানা রুমী রহ. একটি ঘটনা লিখেছেন। এক যুবক এক সুন্দরী যুবতীর পিছু নিল।
যুবতী : আমার পিছু নিলে কেন?
যুবক : তোমাকে ভালোবাসি বলে।
যুবতী : তাই নাকি? শোনো আমার পেছনে আমার ছোট বোন আসছে, সে আমার চেয়েও সুন্দরী।
রূপের পাগল তো ছিলই তাই বেশি রূপের কথা শুনতেই পড়িমরি দৌড় লাগাল পেছন দিকে। অনেক দূর পেছনে গিয়েও যখন কাউকে দেখতে পেল না তখন পুনরায় ছুটে এসে তাকে ধরল, কেন অযথা হয়রানি করালে?
যুবতী : নরাধম কোথাকার! এই তোমার পিরিতের রং। ভালোবাসার দাবি করো আমাকে আর রূপের কথা শুনে দৌড়াও আরেকজনের দিকে।
মহব্বতের নিদর্শন
মহব্বত ও ভালোবাসা এমন জিনিস যে, গোটা পৃথিবী যদি সুন্দর—সুন্দরী দ্বারা ভরে যায় তবুও প্রেমিক প্রিয়তমকে বাদ দিয়ে কারও দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না। হযরত গাঙ্গুহী রহ. বলেন, কোনো মজলিসে যদি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী ও হযরত হাজী সাহেব রহ. উভয়ে উপস্থিত থাকেন তাহলে আমরা হযরত জুনায়েদ বাগদাদীর দিকে কোনো ভ্রম্নক্ষেপই করব না। হ্যাঁ, হযরত হাজী সাহেব রহ. তাঁর দিকে তাকাতে পারেন, তার থেকে ফয়েজ হাসেল করতে পারেন। কিন্তু আমাদের যা হাসেল করার তা আমরা হযরত হাজী সাহেব থেকেই হাসেল করব।
তো মহব্বত হলো এমন জিনিস। সুতরাং এটা কেমন মহব্বত যে, দাবি করি আল্লাহ পাকের মহব্বতের আর জড়িয়ে পড়ি সুশ্রী বালকদের সঙ্গে কুসম্পর্কে। এ দুইয়ের সম্মিলন কী করে সম্ভব! তদুপরি এই প্রেম হৃদয়ের টানে নয়; বরং তিন বেলা পেট পুরে খেতে পাই বলে এই নষ্টামি। দু—চার দিনের তরে খাবার বন্ধ হয়ে গেলে এই মেকি ভালোবাসা কোথায় যে হারিয়ে যাবে? তো বোঝা গেল এটা প্রবৃত্তির নষ্টামি, ভালোবাসা নয়। এ কারণেই এহেন ভালোবাসায় তারাই আক্রান্ত হয় যাদের হাতে সময় সুযোগ ও অবসর প্রচুর। নতুবা কর্মব্যস্ত মানুষ এহেন নষ্টামির কথা জল্পনা—কল্পনার ফুরসতই পায় না। যেমন কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ।
নকল প্রেমের চিকিৎসা
তাই এর চিকিৎসাও এটাই, নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত করে তুলুন। একেবারে ডুবে যান। যদি দ্বীনি কাজ নাও হয় তবুও অন্তত দুনিয়াবি কোনো বৈধ কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। বিজ্ঞ চিকিৎসকগণ এই রোগের ব্যাপারে এ কথাই লিখেছেন,
يعرض للبطالين
তথা এই রোগে বেকার ও অকর্ম লোকেরা আক্রান্ত হয় বেশি।
বালকদের প্রতি আসক্তির ক্ষতি
আফসোস, আল্লাহ পাক সুযোগ, সময় ও অবসর দিয়েছিল দ্বীনের কাজের জন্য কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই এমন, যারা বঞ্চিত থাকে। সময়—সুযোগ—অবসর আল্লাহ পাকের বিরাট নেয়ামত। আফসোস আমরা তার মূল্যায়ন করি না। আর এই কর্মহীনতায় আমরা নিজেদের এহেন রোগে আক্রান্ত করে ফেলি। আরও বেশি আফসোস হয়েছে যখন দেখেছি কোনো কোনো দরবেশের নিকট একটি একটি বালক পোষা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বলে, এদের রূপ—সৌন্দর্য তো আল্লাহ পাকের রূপ—সৌন্দর্যেরই প্রতিচ্ছবি। শেখ সাদী রহ. লিখেছেন, বিখ্যাত দার্শনিক বাকরাত (হিপোক্রেটিস) এক লোককে নাচতে দেখে বলে, এর কী হয়েছে?
লোকজন বলল, এক সুদর্শন বালক দেখে সে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। কারণ, সে তার মধ্যে আল্লাহ পাকের রূপের ঝলক দেখতে পেয়েছে।
দার্শনিক সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করলেন, বালক দেখে সে তার মাঝে আল্লাহ পাকের রূপের ঝলক দেখতে পেল, আমাকে দেখে আমার মাঝে কেন আল্লাহর রূপের ঝলক দেখতে পেল না?
এ হলো বিখ্যাত দার্শনিকের মন্তব্য। ইচ্ছে হলে তাঁর কথা তো গ্রহণ করতে পারেন। তবে মহাকবি শেখ সাদীর কথা তো আর ফেলতে পারবেন না,
محقق ہماں بنید اندر ابل
کہ در خوبرویاں چین وچگل
অর্থাৎ অন্তদৃর্ষ্টির অধিকারী রূপের বাহারে যেমন মাওলার রূপের ঝলক দেখতে পায় তেমনি উটের মধ্যেও দেখতে পায়।
জনৈক বুযুর্গের ওয়াজদ ভাব—বিহ্বলতার ঘটনা
পাঞ্জাবে এক বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর প্রসঙ্গে এক বন্ধু বলতেন, তাঁর অবস্থা ছিল এই—যখন কোনো সুন্দর ভবন সুন্দর দৃশ্য দেখতেন তখন ভাব—বিহ্বল হয়ে পড়তেন। এমনকি তাঁর সামনে কেউ দরজা পর্যন্ত খুলতে পারত না। দরজা খোলার শব্দ শুনে তিনি ভাব—বিহ্বল হয়ে পড়তেন। তদ্রƒপ পাখার শব্দেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যেত। তাই কেউ তাকে পাখাও করতে পারত না। এ ধরনের মানুষ যদি সুদর্শন কাউকে দেখে ভাব—বিহ্বল হয়ে পড়ে তাহলে এটা তার এক বিশেষ ‘হাল’। পক্ষান্তরে যাদের অন্য কিছুতে আল্লাহ পাকের ঝলক নজরে পড়ে না কেবল সুদর্শন বালকদের মধ্যে আল্লাহ পাকের ঝলক দেখতে পায়, এটা নিরেট বদমাশি। আর এটা এমন রোগ, যাতে দরবেশির দাবিদাররা দীর্ঘদিন যাবৎ আক্রান্ত।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী রহ.—যিনি সপ্তম শতাব্দীর মহামানবদের একজন ছিলেন—এই শ্রেণির লোকদের প্রসঙ্গে বলেন, এ শ্রেণির পাজি ও ধড়িবাজদের কাছে দুর্নীতি, নারীবাজি ও সমকামিতার নাম দরবেশি হয়ে গেছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, এই রোগ অনেক পুরোনো রোগ, যার সূচনা হয়েছিল লূত সম্প্রদায়ের মধ্যে। শয়তানের শয়তানী তাদের ভালোভাবে পেয়ে বসেছিল। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, লূত সম্প্রদায়কে এভাবে আযাব দেওয়া হয় যে, হযরত জিবরাঈল আ. তাদের পাঁচটি বসতিকে নিজ হাতে শূন্যে তুলে উপুড় করে ফেলেন। এর মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন তোমাদের রুচি ও স্বভাব বিকৃত হয়ে উল্টে গেছে তাই তোমাদের উপর ওই প্রকৃতির আযাবই এসেছে তথা ভূমি উল্টে দেওয়া হয়েছে।
মোটকথা একে বর্তমানে তো মূল গোনাহেরই মারাত্মক ছড়াছড়ি, দ্বিতীয়ত যেসব জিনিস এর মাধ্যম ও উপকরণ সেসবও তার হুকুমভুক্ত যেমন মজা নিয়ে কথা বলা কিংবা দেখা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে খুব কম মানুষই এই গোনাহ থেকে বেঁচে আছে।
কোনো নারী—কণ্ঠের কিংবা বালকের কণ্ঠের গান শোনা ব্যভিচারের অন্তর্ভুক্ত
পর—নারীর কিংবা দাড়িবিহীন ছেলেদের কণ্ঠে গান শোনাও একধরনের ব্যভিচার। যদি কোনো বালকের কণ্ঠস্বরে প্রবৃত্তির স্বাদের মিশ্রণ ঘটে, তার কণ্ঠে কোরআন শোনাও জায়েয নয়। বেশির ভাগ মানুষ অল্পবয়সি ছেলেদের হামদ—নাত শেখায়, এ কাজও নাজায়েয। মাসায়েলের কিতাবে এতদূর পর্যন্ত লেখা আছে, দাড়ি—মোচবিহীন ছেলে যদি এমন হয় যে, তার প্রতি প্রবৃত্তির আকর্ষণ জাগে তাহলে তার ইমামতিও মাকরুহ। আর নাবালেগের পেছনে তো নামাযই হয় না অথচ যখন সে ইমামতি করবে তখন তো কেবল কোরআন শরীফই পড়বে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে এর অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। যাতে সেদিকে প্রবৃত্তি আকৃষ্ট না হয়। আরেক কারণ এটিও—ছোট ছেলেদের উপর ভরসাই—বা করা যায় কতটুকু। কারণ, বিনা ওযুতে নামায পড়িয়ে দিলেও তো আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।
এক ছেলে নিজেই আমাকে বলেছে, আমি কখনো কখনো বিনা ওযুতেই নামায পড়িয়ে দিয়েছি। আরেক ঘটনা শুনুন, দুটি ছেলে নামাযে দাঁড়িয়েছে, একজন ইমাম হয়েছে আরেকজন মুক্তাদি। সেজদায় গেলে পেছনের জন সামনের জনের পায়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। যিনি বলেছেন খুব চমৎকার বলেছেন, বাচ্চা তো বাচ্চাই, বাহ্যত হোক না সে আল্লাহর ওলী। সারকথা উলামায়ে কেরাম সুদর্শন ছেলেদের ইমামতিকে নাজায়েয বলেছেন, যুবতী কিংবা মধ্যবয়সি নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করেছেন। অবশ্য বৃদ্ধাদেরকে আমাদের মাযহাবের ইমাম সাহেব অনুমতি না দিলেও অন্যান্য মাযহাবের ইমামগণ অনুমতি দিয়েছেন। কারণ এতে ফেতনার আশঙ্কা নেই। কিন্তু তারা স্বীয় যুগের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই অনুমোদন দিয়েছিলেন। আজকাল মানুষের স্বভাব এত নিচে নেমে গিয়েছে যে, একে বিলকুল নাজায়েযই বলতে হবে, যদিও অতি বৃদ্ধাই হোক না কেন।
জনৈক বাদশাহর গল্প
জনৈক বাদশাহর গল্প শুনেছিলাম। চলার পথে একবার তার চোখে এক বিধবা নারী পড়ল। দেখতে ছিল একেবারে কুৎসিত। তার পরনে এমন ময়লা—নোংরা কাপড় ছিল যে, দেখে গা ঘিন ঘিন করছিল। অথচ সে ছিল গর্ভবতী। বাদশাহ ওযিরকে নির্দেশ দিলেন, এ বিধবা কার দ্বারা গর্ভবতী হয়েছে তাকে খুঁজে বের করো। এহেন নারী কার রুচিতে ধরেছে তা আমি দেখতে চাই। এই পেরেশানী নিয়ে ওযির একদিন রাস্তায় হাঁটছিলেন, হঠাৎ তার নজরে পড়ল জমকালো পোশাক পরা এক লোক! লোকটি ময়লা পানির নালা, যাতে পেশাব ইত্যাদি প্রবাহিত হয় সেখান থেকে কালির দোয়াতে পানি ভরছে!! ওযির এই দৃশ্য দেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে তাকেই আটক করলেন। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর সে স্বীকার করল যে, তার দ্বারাই উক্ত বিধবা গর্ভবতী হয়েছে!! তাই এ যুগে বৃদ্ধাদেরও অনুমতি প্রদানের অবকাশ রয়নি। সকলকেই নিষেধ করা উচিত।
মোটকথা, দ্বীনি বিষয়ে অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ যখন কামনাতাড়িত হয়ে কোরআন তেলাওয়াত শোনা পর্যন্ত বরদাশত করনেনি সে ক্ষেত্রে নাত—গজল শোনার অনুমোদন কীভাবে হতে পারে। আফসোস শরীয়তের ব্যাপারে চরম অবহেলার দরুন এসবের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রম্নক্ষেপ করা হয় না।
মহিলাদের সমাবেশে বক্তাদের সুরেলা কণ্ঠে কবিতা পড়া উচিত নয়
বহু বক্তা এমন আছে যারা এমন সমাবেশেও সুরেলা কণ্ঠে কবিতা পড়ে, যাতে মহিলারাও শরীক হয়। এটা পুরোপুরি দ্বীনি মাসলেহাত পরিপন্থী। আল্লাহ পাকের শোকর, যেখানে মহিলাদের উপস্থিতি থাকে সেখানে এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরকালে একবার এক গোলামকে মহিলাদের সামনে গজল গাইতে বারণ করেছেন। অথচ সে উটের চলার গতি দ্রুত করার জন্য গজল গাইছিল। তাকে বারণ করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
رويدك يا انجشة تكسر القوارير
আনজাশা, থামো। তুমি তো কাঁচগুলো ভেঙে ফেলতে যাচ্ছ।
কাঁচ দ্বারা মহিলাদের বোঝানো হয়েছে। মর্মার্থ এই মহিলাদের হৃদয় কোমল হয়ে থাকে। এমনটা যেন না ঘটে যে সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ শোনে তাদের মনে না আবার কোনো ফাসাদ দেখা দেয়। তো ওই যুগে যখন সবার মধ্যে দ্বীনদারী প্রবল ছিল তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দেননি, তাই একালে এর অনুমোদন কী করে হতে পারে। বিশেষত আবৃত্তিকারী যখন কোনো মেয়ে কিংবা বালক হয় (তখন তো কিছুতেই এর অনুমোদন হতে পারে না)।
ব্যভিচারের বিষময় প্রতিক্রিয়া মহামারি
মোটকথা মহামারি বিস্তারে এই গোনাহের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আর এ পাপের ফলে মহামারি বিপজ্জনক হারে বেড়ে যায়। বাকি প্রতিটি পাপই আল্লাহ পাকের অসন্তুষ্টি ও গজবের কারণ। আর এই পাপ তথা ব্যভিচার মহামারির একেবারে মৌলিকতম কারণ। তো যেখানে মহামারির প্রকোপ দেখা দেবে, বুঝে নিতে হবে সেখানে তা এই ঘৃণ্য পাপের কারণেই দেখা দিয়েছে। অন্যান্য স্থানের মহামারির সংবাদ শুনে তার কারণ উপলব্ধি করে ভেবে দেখুন ওই কারণ আমাদের মধ্যে আছে কি না? যদি থেকে থাকে তাহলে তা বর্জন অবশ্যই করতে হবে। তো এই অন্যদের দেখে শিক্ষা গ্রহণের অর্থ। সুতরাং অন্যদের মহামারি (আক্রান্ত) দেখে তাদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করুন এবং গোনাহ থেকে তওবা করুন।
প্রতিটি বিপদকেই পাপের বিষফল মনে করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত
শিক্ষাগ্রহণ কেবল মহামারির সঙ্গে খাছ নয়; বরং যেকোনো বিপদাপদই আসুক তাকে পাপের বিষফল মনে করা আর যখনই কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখেন, তাকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করুন।
কারও মৃত্যুতেও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত
তদ্রুপ যখন কারও মৃত্যুসংবাদ কানে আসে তখন ভাবুন, আমার মৃত্যুও তো অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এ কালে আমাদের গাফলত ও উদাসীনতা এতই মারাত্মক যে মৃত্যু দেখেও আমাদের মধ্যে সামান্য প্রতিক্রিয়া হয় না। আমি নিজের কথাই বলছি, প্রথম প্রথম তো মৃত্যু দেখে এ ধরনের শিক্ষা লাভ হতো কিন্তু এখন যেন এতে একপ্রকার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ শরীয়ত পরকাল স্মরণের ব্যবস্থা এতদূর করেছে যে যখন সাওয়ারিতে চড়ো তখন এই আয়াত পড়ো,
سُبْحٰنَ الَّذِیْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنِیْنَ
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের মেহেরবানী যে তিনি এই সাওয়ারিকে অনুগত ও নিয়ন্ত্রণাধীন করেছেন। নতুবা তা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের সাধ্যাতীত ছিল। আর আমাদের রবের নিকটই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
তো প্রথমে আল্লাহ পাকের নেয়ামতের শোকর তারপর তাঁর নিকট ফিরে যাওয়ার আলোচনা। বাহ্যত এ দুইয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র বুঝে আসে না। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে এতে এদিকে ইশারা করা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা সাওয়ারিতে চড়ার সময় আরেকটি সাওয়ারির কথা স্মরণ করো এবং মনে রেখো একদিন—না—একদিন তোমাকে লাশের খাটিয়ায় চড়তে হবে যাতে শুইয়ে দিয়ে চার জন মানুষ কাঁধে করে নিয়ে যাবে। আর আসল সাওয়ারি সেটাই, যাতে চড়িয়ে তোমাকে তোমার রবের দরবারে পেঁৗছে দেওয়া হবে। যানবাহনে চড়ার সময়ও যখন তাকে স্মরণের হুকুম দেওয়া হয়েছে তখন মৃত্যুকে দেখে তাকে স্মরণের হুকুম কেন হবে না? তখনো স্মরণ না করা বড় পাষাণ হৃদয় হওয়ার আলামত।
হৃদয়ের কাঠিন্য ও উদাসীনতার ব্যাপকতা
একালের লোকদের গাফলত এতটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, বসে আছে কবরস্থানে অথচ মামলা—মুকাদ্দামার আলোচনায় ব্যস্ত। তদ্রƒপ কাউকে যখন বিপদগ্রস্ত দেখে তখন নিজের ব্যাপারে তদ্রƒপ আশঙ্কা করে না। ভাবে, সেটা তার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। অথচ চিন্তা করার দরকার ছিল যে, তার উপর কেন এ বিপদ আসল। বলাবাহুল্য গোনাহের কারণে এসেছে। (তাই বিপদ থেকে বাঁচতে হলে) আমাকেও গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
বিপদগ্রস্ত দেখলে করণীয়
এ জন্যই হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যখন কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখবে তখন বলবে—
الحمد لله الذى عفانى مما ابتلاك به و فضلنى على كثير ممن خلق تفضيلا
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের শোকর, তিনি আমাকে ওই রোগ থেকে মুক্ত রেখেছেন, যাতে তোমাকে আক্রান্ত করেছেন।
তো এতেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, বিপদের কারণ গোনাহ। এ কারণে তুমিও পাকড়াওয়ের খুব কাছাকাছি ছিলে, তবুও তোমাকে পাকড়াও না করায় তুমি তার শোকর আদায় করো। তবে এ দুআ নীরবে পড়বে যাতে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি মর্মাহত না হয়। যেমনটা অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নিজ ভাইয়ের বিপদে উল্লসিত হয়ো না। কিছু লোক দূর থেকে কোনো বিপদগ্রস্তকে দেখে উল্লসিত হয়ে থাকে অথচ তাদের সন্ত্রস্ত হওয়া উচিত। কেননা, বিপদের কারণ তো আমার মধ্যেও বিদ্যমান, আমার পাপ কি কারও চেয়ে কম, না জানি আমিও বিপদে আক্রান্ত হয়ে পড়ি! কিছু লোক এমনও আছে যারা অন্যের বিপদে আফসোস করে কিন্তু পাশাপাশি সমালোচনাও করে যে ও এরই উপযুক্ত ছিল।
এ প্রসঙ্গে হাদীসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, অন্যের বিপদ দেখে উল্লসিত হয়ো না, অন্যথায় তার পরিবর্তে তুমিই আক্রান্ত হয়ে পড়বে। জনৈক বুযুর্গ বলতেন, যদি ভিক্ষুক কিংবা কোনো প্রার্থী তোমার দরজায় কড়া নাড়ে তাহলে তুমি অন্তত এই শুকরিয়াস্বরূপ তাকে কিছু দিয়ে দাও যে, তার মতো তোমাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে ফিরতে হচ্ছে না। ঠিক তদ্রƒপ বিপদগ্রস্ত দেখে এ জন্য শোকর আদায় করো যে আমিও তো আপন পাপের কারণে তার মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারতাম।
বড় আশ্চর্যজনক এক শিক্ষণীয় ঘটনা
ঠিক এ ধরনেরই একটি আশ্চর্য ঘটনা মহাকবি শেখ সাদী রহ. তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থ বুস্তায় লিখেছেন, জনৈক ব্যক্তি স্ত্রীকে নিয়ে খাবার খাচ্ছিল। ওই সময় এক ফকীর এসে দরজায় দাঁড়াল। লোকটি ফকীরকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল। ঘটনাক্রমে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। এ লোক এমন বিপর্যয়ের শিকার হলো যে, তার সবকিছু ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেল। এমনকি স্ত্রীর খোরপোশ দিতে ব্যর্থ হয়ে তাকে তালাক দিতে বাধ্য হলো। পরবর্তীকালে আরেক ধনবানের সঙ্গে তার স্ত্রীর বিয়ে হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে ওই ধনবানের দরজায় এসে এক ভিক্ষুক দাঁড়াল। লোকটি তার স্ত্রীকে বলল, তাকে ভিক্ষা দিয়ে দাও। স্ত্রী দরজায় গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল। স্বামী কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিল, এই ফকির ছিল আমার পূর্বের স্বামী। আগে সে খুব ধনবান ছিল। একবার সে এক ভিক্ষুককে তার দরজা থেকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে একে একে তার সমস্ত ধন—সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। আর সে এই দুরবস্থায় পতিত হয়। ঘটনা শুনে দ্বিতীয় স্বামী বলল, ওই ভিক্ষুক আমি ছিলাম, যাকে সে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ পাক সেই মন্দ কাজের এই প্রতিদান দিয়েছে যে, তার সব ছিনিয়ে নিয়েছেন আর আমাকে সম্পদও দিয়েছেন এবং তার স্ত্রীও দিয়েছেন। তো এটা আল্লাহ পাকের মহা কুদরতের অসীমতার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং অন্যদের দেখে শিক্ষা গ্রহণ করুন। আর এটাও শিক্ষার অন্তভুর্ক্ত যে, যখন যাকে বিপদে আক্রান্ত দেখতে পাও তখন ভয় করো, সন্ত্রস্ত হও। শরীয়ত সর্বক্ষেত্রে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে অথচ আমরা উদাসীন।
বাহ্যিক কারণ ও অনুঘটকে দৃষ্টি আটকে থাকা আমাদের উদাসীনতার বড় কারণ
এর কারণ হলো আমাদের পাপরাশি, যা মহামারির মূল কারণ তা থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত ও পবিত্র মনে করি। আর কিছু লোক ভাবে, মহামারি আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষবে কী করে, আমাদের কাছে তো তাবিজ—কবজ আছে।
তাকদিরের মোকাবিলায় বাহ্যিক উপায়—উপকরণ কিছুই না
সুধীবৃন্দ, যখন কোনো বিপদ নেমে আসে তখন তাবিজ—কবজ সবই বেকার হয়ে যায়। মহা পরাক্রমশালীর হুকুমের সামনে এসব জিনিসের কী মূল্য থাকতে পারে! কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, বলো দেখি কার সাধ্য আছে মহান আল্লাহ পাকের মোকাবিলায় দাঁড়ানোর, যদি তিনি ঈসা ও তাঁর মা এবং সকল সৃষ্টিজীবকে সমূলে বিনাশ করে ফেলতে চান। তার একচ্ছত্র ক্ষমতার কি কোনো সীমা—পরিসীমা আছে। কার আছে এমন বুকের পাটা যে তার সামনে দাঁড়াতে পারে। তিনি যা ইচ্ছা তা—ই করেন।
(তো এক মহান নবী ও নবীর মায়ের প্রসঙ্গে যখন এমন কঠোর বক্তব্য) তখন এসব ফকির—দরবেশ—যাদের তাবিজ—কবজ নিয়ে আপনাদের এত গরিমা—কোন ছাই! সুতরাং তাদের তাবিজ—কবজ নিয়ে গরিমা দেখানো কিংবা এসবের উপর ভরসা করা একেবারে অনর্থক কাজ।
মহামারি ইত্যাদি দূরীকরণে সঠিক তদবীর
অবশ্য সঠিক তদবীর হলো—আল্লাহ পাককে রাজি—খুশি রাখুন এবং তাঁর হুকুম—আহকামের উপর যত্নের সঙ্গে আমল করুন। বিশেষত খুব দ্রুত নামায ধরুন। আমি এ দাবি করছি না যে, নামায পড়লে কেউ মারা যাবে না। অবশ্যই মারা যাবে কিন্তু আনুগত্যের ফায়দা হবে এই, বিপদে পেরেশানী—অস্থিরতা অনুভূত হবে না।
অনুগতদের উপরও যখন বিপদ আসে তখন আনুগত্য করে কী লাভ? এই সংশয়ের জবাব
বিষয়টি বলার কারণ হলো—কিছু লোকের মনে এই সংশয় জাগে যে, বিপদের আসল কারণ তো পাপীর দল অথচ বিপদ আসে সবার উপর; তাই ফরমাবরদারি ও আনুগত্য বেকার ও নিরর্থক। এর দ্বারা কী লাভ? তো এখন এই সংশয়ের নিরসন হলো। কেননা আনুগত্য ও ফরমাবরদারির সুবাদে ফায়দা এই হয় যে, এ শ্রেণির মানুষজন বিপদে অস্থিরতা ও পেরেশানীর শিকার হয় না। এর দৃষ্টান্ত মায়ের কোলের শিশুর মতো। শিশু যদি মায়ের কোলে থাকে তাহলে তাকে আর কোনো পেরেশানী স্পর্শ করে না।
অনুগত বান্দা বিপদে পেরেশান হয় না
তো আল্লাহ পাক আমাদের রব, আমাদের খালিক—মালিক। সুতরাং আনুগত্যের সুবাদে তাঁর যত বেশি নৈকট্য লাভ হবে আশ্বস্তি ও প্রশান্তি তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। বিপদ যত কঠিনই হোক, মায়ের কোলের শিশুর মতোই নিজেকে নিরাপদ বোধ হবে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ল। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো হযরত মূসা আ. কে প্রশ্ন করেছিল, আকাশ যদি ধনুক হয় আর দুনিয়ার সব বিপদ—আপদ তির হয় আর স্বয়ং আল্লাহ পাক তিরন্দাজ হন তাহলে মানুষের বাঁচার উপায় কী?
হযরত মূসা আ. উত্তর দিলেন, তিরন্দাজের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো, কেননা তির নিক্ষেপ করা হয় দূরে থাকা লোকদের উপর।
উত্তর শুনে প্লেটো অভিভূত হয়ে মন্তব্য করল, নিঃসন্দেহে আপনি নবী। এ ধরনের ইলম নবীদেরই থাকে।
তো যখন আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ হবে তখন প্রকৃতপক্ষে যার নাম বিপদ তা কাছে ঘেঁষতে পারবে না, কষ্ট হবে না। হোক তার সুরত বাহ্যত বিপদের মতো কিন্তু হৃদয় পুরোপুরি প্রফুল্ল থাকবে।
জনৈক বুযুর্গের তওবার বিস্ময়কর ঘটনা
জনৈক বুযুর্গ বলেন, আমার তওবার কারণ হয়েছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা। একবার দুর্ভিক্ষের সময় দেখলাম, বড় জমিদারের এক গোলাম রাস্তা দিয়ে খোশ মেজাজে হেঁটে যাচ্ছে। আমি প্রশ্ন করলাম, দুর্ভিক্ষে মানুষের হাহাকার অবস্থা আর তুমি কিনা এমন খোশ মেজাজে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ!
গোলাম উত্তর দিল, আমি অমুকের গোলাম। আমার খাওয়া—পরার সব দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তার জমিদারি এক গ্রামব্যাপী। সেখান থেকে সময়মতো সকল আয় এসে যায়। তা থেকে তিনি আমাকে দু—বেলা খাবার দেন। তাই আমি একেবারে নিশ্চিন্ত।
এই উত্তর আমার হৃদয়ে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলল। মনকে বললাম, তোর মালিকের জমিদারি তো আসমান—জমিন সর্বব্যাপী। তারপরও তুই এত পেরেশান। বাস্তবিকই যখন মাওলা পাকের নৈকট্য বৃদ্ধি পায় তখন হৃদয় নিশ্চিন্ত ও নির্ভার হয়ে যায়। তো যিনি সমস্ত ধন—ভান্ডারের মালিক তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হলে কীভাবে অন্তরাত্মা নির্ভার না হয়ে থাকতে পারে।
আরেক বুযুর্গের ঘটনা
এক বুযুর্গ দেখলেন, লোকজন এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পালিয়ে যাচ্ছ কেন?
লোকজন উত্তর দিল মহামারি থেকে পালাচ্ছি।
তাদের উত্তর শুনে তিনি বললেন, হে মহামারি আসো! আমার কাছে আসো! আমাকে আমার মাওলার কাছে পেঁৗছে দাও।
দুআ করতেই তিনি মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন আর এতেই তাঁর ইন্তেকাল হয়।
তো যখন আল্লাহ পাকের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর ও মজবুত হয় তখন অবস্থা ঠিক এমনই হয়ে থাকে অর্থাৎ দোস্তের পক্ষ থেকে আগত বিপদও ভালো লাগে। একেই বুঝি কবি তার ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন—
نشود نصیب دشمن کہ شود ہلاک تیغت
سر دوستان سلامت کہ تو خنجر آزمائی
অর্থ : তোমার তরবারির পুষ্পাঘাত যেন দুশমনের ভাগ্যে না জোটে। কেননা বন্ধুদের শির তো সদা সমুপস্থিত। তরবারি পরীক্ষা করতে চাইলে তাদের শিরেই করো। যে শত্রু তোমার মূল্য ও কদর বোঝে না তাকে এই অনুগ্রহ কেন করতে চাও?
তো অনুগত ও ফরমাবরদারদের অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যারা অবাধ্য ও নাফরমান উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও পেরেশানীই তাদের ভাগ্যলিপি। জীবনেও, মরণেও। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ল। দেখুন, সৎ ও অনুগতদের অবস্থা কেমন হয়ে থাকে।
থানাভবনে ১৮/১৯ বছর বয়সি এক তালিবে ইলম ছিল। কয়েকজন তালিবে ইলম যেহেতু মহামারিতে মারা গিয়েছিল তাই সে দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছিল। ইতিমধ্যে সেও মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। অন্যান্য তালিবে ইলমরা ভাবল তার অস্থিরতা ও পেরেশানী হয়তো কিছুটা বেশি হয়ে থাকবে, কারণ সে বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছিল, এরই মধ্যে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ল। তাই তারা তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলল, ভাই বেশি পেরেশান হয়ো না। আল্লাহ চাহে তো দ্রুতই সেরে উঠবে।
সে উত্তর দিল, এমন কথা বোলো না, এখন এই দুআ করো, আল্লাহ পাক যেন ভালোয় ভালোয় তাঁর কাছে ডেকে নেন। এখন তো কেবল আল্লাহ পাকের সঙ্গে মিলনের আশাতেই মন ব্যাকুল হয়ে আছে। ঈমান নিয়ে মরতে পারাটাই এখন একমাত্র চাওয়া—পাওয়া।
আরেকটি ঘটনা শুনুন—আহমদ আলী নামক আমার এক বন্ধু গোরাখপুরে শিক্ষক ছিলেন। সেখানে তার স্ত্রী মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় একদিন হঠাৎ সে শোয়া থেকে উঠে বিছানায় পায়ের দিকে এসে বসল। আর কাউকে শিয়রের কাছে বসতে বলে মন্তব্য করল—রওনার জন্য তো প্রস্তুত কিন্তু এখনো সময় হয়নি! বারোটায় নির্ধারিত সময় তখনই রওনা হব! লোকজন ভাবল, মাথা গরম হয়ে গেছে তাই যা—তা বলছে। কিন্তু বাস্তবে তা—ই হলো, যা সে বলেছিল। ঠিক বারোটায় তার রুহ বেরিয়ে গেল।
সুধীবৃন্দ, এ সবই আনুগত্য ও ফরমাবরদারির বরকত। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, পেরেশানী অনুগতদের ধারে—কাছেও ঘেঁষতে পারে না। সুতরাং এটা হলো আনুগত্যের এক ফায়দা। দ্বিতীয়ত মহামারি তাদের জন্য রহমত। আর রহমত হওয়ার কারণেই তাদের এই অবস্থা হয় যে, তাদের কোনো পেরেশানীই হয় না। হোক না তা মহামারির মতো মহা মসিবত। আর এ দুই কারণই—বা কম কিসে, যা থেকে পাপী ও নাফরমানরা চিরবঞ্চিত।
মোটকথা একে তো আনুগত্যের সুবাদে বিপদই আসবে না আর কোনো কল্যাণ বিবেচনায় এসে গেলেও পেরেশানী থেকে মুক্ত ও নিশ্চিন্ত থাকবে, এই হলো উক্ত সংশয়ের জবাব। (তথা পাপই যদি হয় বিপদের কারণ তাহলে অনুগতদের উপর বিপদ আসে কেন?)
আলোচনার সারকথা
এখন আমি আলোচনার সারকথা নিবেদন করছি।
السعيد من وعظ بغيره
সৌভাগ্যবান সে যে অন্যকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে।
এ হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো—অন্যকে বিপদে আক্রান্ত দেখে ওই পাপ বর্জন করো, যে পাপের ফলে তার উপর এ বিপদ নেমে এসেছে। ব্যস, এখন আমি আলোচনা শেষ করছি এবং আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করি তিনি যেন সকলকে আমলের তৌফিক দান করেন। আমীন।