প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

আকাশের পানে চেয়ে থাকা অসহায় মানুষ

আকাশের পানে চেয়ে থাকা অসহায় মানুষ

এক.

আল্লাহ কত বড় তা ধারণা করার ক্ষমতাও মানুষের নেই। আল্লাহ সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন। যাকে মানুষ মহাকাশ বা সৌরজগৎ বলে, সাত আসমান তারচেয়েও বড়। যত গ্রহ, উপগ্রহ, মিল্কিওয়ে, গ্যালাক্সি ইত্যাদি আছে এসবই প্রথম আসমানের নিচে। একথা পবিত্র কোরআনের সূরা সফ্ফাতে আল্লাহ বলেছেন,

اِنَّا  زَیَّنَّا السَّمَآءَ  الدُّنْیَا بِزِیْنَۃِ     ۣ الْکَوَاکِبِ ۙ﴿۶﴾  وَ حِفْظًا مِّنْ كُلِّ شَیْطٰنٍ مَّارِدٍ ۚ﴿۷﴾

আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্রের বাতি দিয়ে সাজিয়েছি। আর এসব অবাধ্য শয়তানদের প্রতিরোধ করে।

মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সৌরজগতের সামান্যের চেয়ে সামান্য অংশ সম্পর্কে জানতে পেরেছে। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে সুসজ্জিত গ্রহ—তারার কিছু ছবি তুলতে পেরেছে। পৃথিবীর যত ধূলিকণা আছে, সাগরের যত বারিবিন্দু আছে, আসমানের তারার সংখ্যা তারচেয়েও বেশি কি না, এ প্রশ্নই এখন বিজ্ঞানের সামনে। পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোকে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সপ্তাকাশ তৈরি করেছেন। শক্ত কোনো সাপোর্ট ছাড়া এর মধ্যকার অগণিত গ্রহ তারাকে নিজ কুদরত ও হুকুমের দ্বারা মহাশূন্যে সন্তরণ করাচ্ছেন। এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের দূরত্ব পাঁচশ’ বছরের রাস্তা। কোন গতির কেমন বাহনের পাঁচশ’ বছর তা হাদীসে বলা হয়নি। এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের দূরত্ব যত, সেই আকাশটিও সমান আয়তনের পুরো। এমন সাতটি আকাশের পর আল্লাহর আরশ কুরসি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,

وَسِعَ كُرْسِیُّهُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ.

তাঁর ক্ষমতার কুরসি পৃথিবী ও সাত আকাশকে পরিবেষ্টন করে আছে।—সূরা বাকারা (২) :  ২৫৫

اَلرَّحْمٰنُ عَلَی الْعَرْشِ اسْتَوٰی.

আর পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরশের ওপর নিজ ক্ষমতাকে সুসংহত করেছেন।—সূরা ত্বহা (২০) : ৫

যারা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় বা মারেফত লাভ করেছেন তারা আল্লাহর বড়ত্ব, কুদরত ও অকল্পনীয় ক্ষমতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন। স্বভাবতই তারা মহাসৃষ্টির সামনে এই পৃথিবীর ক্ষুদ্রতা এবং মানুষের অসহায়ত্ব সম্পর্কে ঠিকমতো ধারণা রাখেন। খলীফা হযরত ওসমান রাযি. মানুষ হিসাবে নিজের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও বিনয়ের অনুভূতি থেকেই জীবনে কখনো বুকটান করে দাঁড়াননি। গর্বভরে মাটির বুকে চলেননি। বলতেন, আল্লাহর সামনে নিজেকে শক্তিমান বা সক্ষম বলে তুলে ধরতে আমার খুবই লজ্জা হয়। এ জন্যই দুনিয়ার কোনো নবী, রাসুল, পীর, আউলিয়ার জীবনে দম্ভ, গর্ব, কঠোরতা বা দুর্বিনীত ভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। যত অহংকার, বড়ত্ব ও উদ্ধত ভাব দেখা যায় শয়তান ও তার অনুসারীদের মাঝে।

ঈমানদাররাও নিজেদের ক্ষুদ্রতা, অসহায়ত্ব ও আল্লাহনির্ভরতা সম্পর্কে অবগত। আর তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণ তারা আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনায় কাটান। আল্লাহু আকবার তাদের প্রাণের ধ্বনি। জীবনের প্রতিটি শ্বাস তারা আল্লাহর স্মরণে ব্যবহার করেন। আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করেন। সুবহানাল্লাহ বলেন। তাসবীহ পাঠ করেন। সব সময় আল্লাহর প্রশংসা করেন। আলহামদুলিল্লাহ বলেন। নিজেদের অপরাধ ও উদাসীনতা থেকে তাওবা করেন। ইস্তেগফার পড়েন। এ কথা স্বীকার করেন যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের নিজের কোনো সক্ষমতা বা সামর্থ্য নেই। যার আরবী ভাষ্য হচ্ছে, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। যাকে আল্লাহর নবী জান্নাতের একটি ভাণ্ডার বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও মিজানে অধিক ভারী, উচ্চারণে সহজ দুটি বাক্য হচ্ছে, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম’।—সহীহ বুখারী : ৬৬৮২

হাদীস শরীফে এসেছে, আলহামদুলিল্লাহ মিজান নামক পাল্লাকে নেকিতে ভরে দেয়। সুবহানাল্লাহ এবং আলহামদুলিল্লাহ এ দুটি বাক্য পৃথিবী থেকে আকাশের শেষ সীমানা পর্যন্ত মহাশূন্যকে নেকিতে ভরে দেয়।—সহীহ মুসলিম : ৫৫৬

 

দুই.

সময়টি এখন দুর্যোগের। আল্লাহর দেওয়া প্রকৃতি যেন ঘন ঘন বৈরি হয়ে উঠছে। আসলে এসবের জন্য মানুষের অনাচার দায়ী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِی الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا کَسَبَتْ اَیْدِی النَّاسِ لِیُذِیْقَهُمْ بَعْضَ الَّذِیْ عَمِلُوْا  لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ.

স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।—সূরা রূম (৩০) : ৪১

যেসব মানুষ প্রকৃতিকে স্বয়ংক্রিয় একটি ব্যবস্থা বলে মনে করে তারা মূলত মহাসত্যকে অস্বীকার করে। এই অস্বীকারের নাম কুফুরি। কাফের, মুশরিক, নাস্তিক ও বেদীনরা এখানে এসেই অজ্ঞতার পরিচয় দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ। তিনিই স্রষ্টা ও বিধাতা।

২০২২ সালের জুলাই মাস জুড়ে বিশ্বব্যাপী চলছে প্রচণ্ড দাবদাহ। অর্ধেক পৃথিবী এতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। গত প্রায় তিন বছর মানুষ করোনা নিয়ে অস্থির ছিল। বেশ কিছুদিন পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত ছিল। মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছিল। অজানা আশঙ্কায় তারা ছিল চরম সন্ত্রস্ত। বর্তমানে তারা সূর্যের প্রখর তাপে অতিষ্ঠ। এখানে মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারে নিজেদের সামর্থে্যর ভেতর মানুষ কিছু করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতি আল্লাহর হুকুম ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বড় কোনো বিবর্তনে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। বিশ্বাসীরা তখন আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। কোরআন ও হাদীসের নির্দেশিত উপায়ে বিপদমুক্তির চেষ্টা চালায়। পরম করুণাময় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ও রহমত কামনা করে। পরিবেশ ও প্রকৃতি মনুষ্য বসবাসের উপযোগী রাখার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে। আসমানী ও জমিনী বালা থেকে মুক্তি পেতে সঞ্চিত অর্থ—সম্পদ দান করে। আর অবিশ্বাসী নাস্তিকরা এ অসহায়ত্ব কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ পায় না। কেননা তারা আশা, বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভরতার কোনো জায়গা পায় না। ধর্মহীনদের এটাই চরম অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা। কোরআন শরীফে যা বলা হয়েছে, ঈমানদারদের মাওলা আছেন, কাফেরদের মাওলা নেই।

নাসা একটি গ্রাফিক্সচিত্র প্রকাশ করেছে। এতে সারা পৃথিবীর ওপর বয়ে যাওয়া অভিনব ও অস্বাভাবিক দাবদাহের একটি দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে এর মাঝারি একটি প্রবাহ চলছে। বিজ্ঞানীদের মতে গত ৭৪ বছরে বাংলাদেশে এত তাপ দেখা যায়নি। ৩৬ ডিগ্রি থেকে তাপ যেন নামছেই না। মানবদেহে অনুভূত হচ্ছে এরচেয়েও বেশি। পবিত্র হজে এবার গড়ে ৪০ ডিগ্রি গরম ছিল। আমেরিকার অনেকগুলো রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। শীতের দেশ পতুর্গাল ও স্পেনে নজিরবিহীন গরম। তেরো শতাধিক মানুষ এ পর্যন্ত মারা গিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে জনজীবন বিপর্যস্ত। অনেক দেশে দাবানল। এ অবস্থা মূলত সাগরের ভেতরকার ভয়াবহ পরিবর্তনের ফল। যা পবিত্র কোরআনে ইশারায় বলা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের তাপ ও পৃথিবীর উষ্ণতা প্রাকৃতিক বাধা সরে গিয়ে সরাসরি জল ও স্থলে পড়ছে। সমুদ্র স্বাভাবিক যে স্রোতধারা বহন করে তা ধীরে ধীরে গতি হারাচ্ছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে পৃথিবীর জলভাগ প্রকৃতির নিয়মে আন্দোলিত হয়। এই স্রোতধারা সমুদ্রকে জীবন্ত এবং পৃথিবীর বাতাস ও পরিবেশকে সচল রাখে। সাগরের উপরস্থ গরম পানি স্রোত নিচে নিয়ে যায় আবার নিচের ঠাণ্ডা পানি সাগরের উপরি ভাগে টেনে আনে—সে স্রোত যথানিয়মে উঠানামা করছে না। এর ফলেই ভয়াবহ এই বিপর্যয়। এমন দাবদাহ।

বেশ কয়েক বছর আগে ভূমধ্য সাগর থেকে আটলান্টিকে এবং ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত ওপরে নিচে প্রকৃতির যে অদ্ভুত আন্দোলন, তার আবহমান স্রোতধারা বিঘ্নিত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই ওয়েভ বিঘ্নিত হলে পৃথিবী প্রাণী বসবাসের উপযোগী থাকবে না। সম্পূর্ণ থেমে গেলে গোটা বিশ্বপ্রকৃতির হায়াত শেষ হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআন ‘জাহারাল ফাসাদু ফিল বাররি’ এর সাথে ‘ওয়াল বাহরি’ বলার একটি কারণ সমুদ্রের এই স্বভাব পরিবর্তনের প্রতিও ইঙ্গিত হতে পারে। অর্থাৎ মানুষের অত্যাচার অনাচারের ফলেই জমিনে এবং সাগরে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে শেষ জমানা চলছে। কেয়ামতের নানা আলামত দ্রুত প্রকাশ পাচ্ছে। বড় বড় আলামত প্রকাশের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের আগে আগে ভূমিধস, ভূমিকম্প, আগুন, প্রাকৃতিক দুযোর্গ অধিক সংখ্যায় সংঘটিত হতে থাকবে। মানুষের তৈরি উষ্ণতা, বিষাক্ত গ্যাস ও জলবায়ুবিনাশী নানা সীমালঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া পরিবেশে দেখা যায়। এসব থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে বস্তুগত সংশোধনের পাশাপাশি ঈমানী ও আধ্যাত্মিক প্রত্যাবর্তন বিশেষ জরুরি। অতীত যুগের নানা জাতিকে আল্লাহর অবাধ্যতার জন্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নবী—রাসূলের আহ্বান না শোনা, তাওবা করে আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা এবং তাঁর বিধান অনুসরণ না করার ফলেই তারা ধ্বংস হয়ে যায়।

বর্তমানেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পৃথিবীর দুর্বল ও অসহায় মানুষের কর্তব্য সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের আশায় আকাশের পানে তাকানো। তাঁর বড়ত্ব ও উচ্চতার সামনে সেজদায় মাথা নত করা। পবিত্র কোরআনে এ মর্মে আল্লাহ বলেছেন, আকাশ ও পৃথিবী স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে আমার গোলামীতে লেগে আছে। চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সবাই সেজদাবনত। সৃষ্টিজগতে এমন কোনো বস্তু নেই যা আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্রতার তাসবিহ পাঠ করে না।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উদয় অস্তের এই ভ্রমণে সূর্য আরশে আল্লাহকে সেজদা করে।

মানুষের ধারণা ও কল্পনার ক্ষমতার চেয়েও অধিক বড়, ব্যাপক ও রহস্যপূর্ণ সৃষ্টিজগৎ মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও হেদায়েতের জন্য দিশা স্বরূপ। মানুষের ভাগ্য যে তাদের কৌতূহল ও আবিষ্কারের পরিমাপের তুলনায় বহুগুণ স্পষ্ট ও নিখুঁতভাবে মহান আল্লাহ তাদের এসব তথ্য ও জ্ঞান কোরআন—সুন্নাহর মাধ্যমে দান করেছেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও নতুন সব আবিষ্কার মানুষের বিশ্বাস ও শেষ পরিণামের দিব্য জ্ঞানের পক্ষে আরও জোরদার সমর্থন হয়ে দাঁড়াবে।

—মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

    মোঃ মঈন
    30 Aug 2022
     7:05am

    খুবই উপকৃত হচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ

একটি কমেন্ট করুন