আক্রান্ত ফিলিস্তিন এবং সভ্য পৃথিবীর মুখোশ
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
এক.
ফিলিস্তিন—পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দেড় শ কোটি মুসলমানের এক প্রিয় নাম। মুসলমান মাত্রই এ নামটির প্রতি, এ নামের দেশটির প্রতি হৃদয়ে লালন করে অকৃত্রিম ভালোবাসা, গভীর আবেগ। আমাদের কাছে মককা মুকাররমা এবং মদীনা মুনাওয়ারার পর তৃতীয় পবিত্র নগর জেরুজালেম, যা ফিলিস্তিনের রাজধানী। সঙ্গত কারণেই যখন আক্রান্ত ফিলিস্তিনের কোনো চিত্র কিংবা সংবাদ আমাদের চোখে পড়ে তখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। প্রতিকারের যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নিতে না পেরে ছটফট করে আমাদের দেহ—মন।
একটু পেছনে ফিরে যাই। ফিলিস্তিন সমস্যার সূত্রপাত কোত্থেকে—এ সম্পর্কে মুক্ত বিশ্বকোষ বাংলা উইকিপিডিয়ার বক্তব্য এমন—‘ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেনবিরোধী জোটে। তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন, যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়। কিন্তু এর মাঝে যে মহা ধেঁাকাটি লুকিয়ে ছিল তা তারা বুঝতে পারেনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? উত্তর ছিল—অর্থ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরবশূন্য করার জন্যে ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ—মার্কিন শক্তি।’ [উইকিপিডিয়া, শিরোনাম : ফিলিস্তিন]
এই নিবন্ধেই আরও বলা হয়েছে—‘ব্রিটিশরা একদিকে ফিলিস্তিনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয় ইহুদিদের জন্যে, আবার তাদের সহযোগিতায় ইহুদিরা সেখানে গড়ে তোলে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। উদ্দেশ্য, হাজার বছর ধরে এখানে বাস করে আসা ফিলিস্তিনি মুসলমানদেরকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা। এদের খুন—খারাবির কথা যখন চারদিকে বেশ সমালোচিত হচ্ছিল, তখন বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার জন্যে তারা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দুই দফায় প্রায় হাজার খানেক ইহুদি—ভর্তি দুটি জাহাজ তারা উড়িয়ে দেয়। এভাবে চলতে থাকে ইহুদিদের বসতি স্থাপন আর আরবদের উচ্ছেদকরণ। একপর্যায়ে ফিলিস্তিনের ২০ লাখ বসতির মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৪০ হাজার। এটা ১৯৪৭ সালের কথা। এ বছরের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। ভোটাভুটিতে ৩৩টি রাষ্ট্র এর পক্ষে, ১৩টি বিপক্ষে ভোট দেয়। ১০টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। এভাবেই ইঙ্গ—মার্কিন চক্রান্তের ওপর ভর করে এশিয়ার বুকে জায়গা করে নেয় একটি ইহুদি রাষ্ট্র। শুধু কি তাই, মোট জনসংখ্যার এক—চতুর্থাংশ হলেও ইহুদিদের দেওয়া হয় ৫৭ শতাংশ ভূমি আর মুসলমানদের দেওয়া হয় ৪৩ শতাংশ। আবার ইহুদি রাষ্ট্রটির পশ্চিম সীমা ছিল অনির্ধারিত, ফলে তারা পরবর্তী সময়েও আগ্রাসনের সুযোগ পেয়ে যায়। এভাবেই জাতিসংঘে পাশ হয় একটি অযৌক্তিক প্রস্তাব, প্রতিষ্ঠিত হয় একটি অন্যায় রাষ্ট্র। এরপর এ ইহুদিরা হয়ে ওঠে আরও হিং¯্র। তাদের হিং¯্রতায় বহু আরব বাধ্য হয় বাপ—দাদার ভিটে ছেড়ে চলে যেতে। ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে আমেরিকা একে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়।’ [উইকিপিডিয়া থেকে সংক্ষেপিত]
এই হচ্ছে ফিলিস্তিনের এক টুকরো ইতিহাস। হাজার বছর ধরে যে আরবরা সেখানে বসবাস করছিল, তাদের ধেঁাকায় ফেলে, চক্রান্ত করে, তাদেরকে নিজেদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে, জোরপূর্বক জমি দখল করে ইহুদিদের সেখানে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। অথচ যাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্র পেল স্বাধীনতার স্বীকৃতি, সেই ফিলিস্তিনিরা এখনো লড়াই করে নিজেদের স্বাধীনতার জন্যে! জাতিসংঘ আমেরিকা ব্রিটেনসহ মানবতার ‘ফেরিওয়ালাদের’ মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্যে এই একটি তথ্যই যথেষ্ট।
দুই.
ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের আক্রমণের সংবাদ পড়ায় যেন আমরা অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আগ্রাসি ইসরাইল দিনদিন আগ্রাসনের মাত্রা বাড়িয়েই চলছে। সদ্যসমাপ্ত ১১ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলি হামলায় শহীদ হয়েছেন প্রায় আড়াই শ ফিলিস্তিনি, এর মধ্যে অর্ধশতাধিক শিশুও রয়েছে। অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষেরা সাধ্যমতো এসবের প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধানেরা অনেকেই, কেউ সরবে, কেউ নীরবে ইসরাইলের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। বলেছেন, তাদের নাকি আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে!
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেদিন প্রথম এ মন্তব্য করলেন, সেদিনই ইসরাইলি বাহিনী বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে গাজার এপি আলজাজিরা—সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের যখন যাত্রার সূচনা, সে—সময়েই আমেরিকা আর ব্রিটেনের চাপে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে সেখানে পাশ হয় সম্পূর্ণ অন্যায় অযৌক্তিক অমানবিক একপেশে একটি প্রস্তাব। সেই জাতিসংঘই এখন বছরে একটি দিন পালন করে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ দিবস হিসেবে। ইসরাইল যখন ফিলিস্তিনে হামলা করে তখন জাতিসংঘের মহাসচিব মায়াকান্না করেন। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান কাজের কাজ কিছুই করতে পারে না কিংবা করে না। বছর কয়েক আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জেরুজালেমে আমেরিকার দূতাবাস স্থানান্তর করলেন আর সারা বিশ্ব থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল, জাতিসংঘে ভোটাভুটিও হলো, কিন্তু আমেরিকার এক ভেটোতে আটকে গেল সকল প্রতিবাদ।
ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। টানা এগারো দিন। সামরিক হামলা, বিমান হামলা। ফিলিস্তিনিরা এর জবাব দিয়েছে রকেট ছুড়ে। এসব রকেটের অধিকাংশই ইসরাইল উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। বাহ্যত একে তো আর যুদ্ধ বলা যায় না। এটা মূলত একপক্ষীয় হামলা, আরেক পক্ষের সামান্য প্রতিবাদ। কিন্তু ১১ দিন পর যখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো, বিজয় দাবি করল দুই পক্ষই। দুই পক্ষের বিজয় দাবি করা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিশ্লেষণ হয়েছে প্রচুর। গাজায় ব্যাপক হামলা চালিয়ে যেভাবে শত শত মানুষ খুন করল ইসরাইল, হাজার হাজার মানুষ আহত হলো, উড়িয়ে দেওয়া হলো বহু ভবন, সেখানে তারা তো বিজয় দাবি করতেই পারে। কিন্তু হামাসের বিজয় দাবি কীসের ভিত্তিতে—এ প্রশ্ন স্বভাবতই জাগে। বিশ্লেষকরা বলছেন : ইসরাইলকে যেভাবে অজেয় মনে করা হতো, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যেভাবে সেখানকার নাগরিকদের সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বলে একটি কথা বুঝিয়ে আসছিল, হামাসের ছোড়া রকেটে সেসব ধারণা ও দাবি ভুল প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলও যেখানে বিজয় দাবি করেছে, সেখানে কেন যুদ্ধবিরতির পরপরই সরিয়ে দেওয়া হলো ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান কর্মকর্তাকে? ইসরাইলের পরাজয় প্রমাণের জন্যে আর কিছু লাগে না।
তিন.
ইসলামের অনুসারী যারা, তাদের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র তাদের যূথবদ্ধতা। তারা যে যেখানেই থাকুক, সকলেই যেন ভিন্ন দেহ একটি প্রাণ। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِى تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى.
পরস্পরে ভালোবাসায় আন্তরিকতায় ও কোমলতায় মুমিনরা সকলে একটি দেহের মতো। এর একটি অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয় তখন পুরো দেহটিই অনিদ্রা আর জ্বরে ভুগে থাকে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৬]
আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا.
মুমিন—মুমিনে মিলে যেন একটি ভবন, যার এক অংশ আরেক অংশে শক্তি জোগায়। [সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৫]
এই হচ্ছে মুমিনের একটি বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কোনো একজন মুসলমান আক্রান্ত হলে এ আঘাত এসে লাগে পৃথিবীর তাবৎ মুসলমানের হৃদয়ে। এক মুসলমান আক্রান্ত হলে আরেক মুসলমানের হৃদয় যদি আহত না হয় তবে সে মুমিন কীসের! কোরআনের ভাষায় মুমিনরা পরস্পরে ভাই—ভাই। আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَۃٌ.
মুমিনরা পরস্পরে ভাই—ভাই। [সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০]
ঈমানের সূত্রে গাঁথা ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধন যে কতটা মজবুত, ইতিহাসের পাতা থেকে এর একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করি। সাহাবী আবু জাহম রাযি. বর্ণনা করেন, ইয়ারমুকের যুদ্ধের দিন আমি আমার চাচাতো ভাইয়ের খুঁজে যুদ্ধের মাঠে যাই। আমার সঙ্গে একটি পাত্রে সামান্য পানি ছিল। আমি তাকে খুঁজে বের করি। সে তখন মুমূর্ষু অবস্থায়। তাকে জিজ্ঞেস করি—তোমাকে একটু পানি দিই? ইশারায় সে বলল—ঠিক আছে দাও। এমন সময় তার পাশ থেকে আরেকজন পানি চায়। আমার ভাই তখন ইশারায় বলে, আমি যেন পানি নিয়ে পাশের লোকটির কাছে যাই। তার কাছে গিয়ে আমি পানির কথা জিজ্ঞেস করি। তখন আরেকজন পানি চায়। সেও তখন আমাকে পাশের লোকটির কাছে চলে যেতে বলে। আমি তৃতীয় এ ব্যক্তির কাছে পানি নিয়ে যাই। কিন্তু আমি যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে ফিরে আসি। দেখি, সেও আর এ জগতে নেই। এরপর আসি আমার চাচাতো ভাইয়ের নিকট। ইতোমধ্যে তারও মৃত্যু হয়ে গেছে! [শুআবুল ঈমান, হাদীস ৩২০৮]
এই ছিল মুমিনদের প্রথম কাফেলা সাহাবায়ে কেরামের ভ্রাতৃত্বের নমুনা।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে একবার এক লোক এসে বলল : আমি খুবই ক্ষুধার্ত।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে তাঁর এক স্ত্রীর কাছে খাবারের জন্যে পাঠালেন। কিন্তু তিনি বলে দিলেন : যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই।
এরপর আরেকজনের কাছে পাঠালেন। তিনিও একই উত্তর দিলেন। এভাবে একে একে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সব স্ত্রীই একই কথা বলে দিল—যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, আমার কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই।
এরপর সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগন্তুককে দেখিয়ে ঘোষণা করলেন, আজকের এই রাতে কে তার মেহমানদারি করতে পারবে? আল্লাহ তাকে দয়া করবেন!
এই কথা শুনে এক আনসারি সাহাবী দাঁড়িয়ে গেলেন—আমি পারব! এরপর তিনি তার মেহমানকে নিয়ে বাড়ি চললেন। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন : তিনি আল্লাহর রাসূলের মেহমান, তার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো।
স্ত্রী বলল : আমার কাছে যে আমার বাচ্চাদের জন্যে রাখা সামান্য খাবার ছাড়া আর কিছুই নেই!
সাহাবী বললেন : ঠিক আছে, তুমি ততটুকু খাবারই প্রস্তুত করো। বাতি জ্বালিয়ে দাও আর তোমার বাচ্চারা যখন রাতের খাবার চাইবে তখন তাদের ঘুম পাড়িয়ে দাও। মেহমান ঘরে এলে বাতি নিভিয়ে দেবে আর তার সামনে আমরা খাওয়ার ভান করব। তিনি যখনই খেতে যাবেন, তখনই তুমি বাতিটি ঠিক করার মতো কিছু একটা করতে গিয়ে তা নিভিয়ে দেবে।
এরপর এই পরিকল্পনা মোতাবেকই সবকিছু করা হলো। খাবার প্রস্তুত করা হলো। বাতি জ্বালানো হলো। বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হলো। মেহমান যখন খেতে যাবে এমন সময় ঘরনি গিয়ে কৌশলে বাতিটি নিভিয়ে দিল। আগন্তুক মেহমান দেখলেন, তার মেজবানও খাচ্ছে। তাই নিঃসঙ্কোচে তিনি খেয়ে নিলেন। কিন্তু আসলে তারা শুধু অন্ধকারে মেহমানের সামনে খাওয়ার ভান করছিল। স্বামী—স্ত্রী সে রাতটি ক্ষুধার্তই কাটিয়ে দিল।
পরদিন সকাল বেলা ওই সাহাবী হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে বললেন : তোমাদের দুজনের কাণ্ড দেখে আল্লাহ মুগ্ধ হয়েছেন। তখন নাজিল করা হলো পবিত্র কোরআনের এ আয়াত :
وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۫ؕ وَ مَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.
নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও তারা অন্যকে নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারাই তো সফলকাম। (সূরা হাশর (৫৯ : ৯); সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৯৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৫৪
মুমিন এমনই হয়। ভ্রাতৃত্বের এ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে মুমিনের জীবনের পরতে পরতে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে প্রতিদিনই সে উপস্থিত হয় মসজিদে। ধনী—গরিব আপন—পরের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দৈনিক এভাবে পাঁচবার একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তারা। জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে এই একটি আমলের শিক্ষাই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। একই শিক্ষা পাওয়া যায় ঈদের উৎসবে এবং হজের ময়দানে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান গায়ে দুটি সাদা চাদর জড়িয়ে এক প্রভুর আহ্বানে হাজির। সবার লক্ষ্য এক, মুখেও সবার একই উচ্চারণ—লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…। ঈদুল আযহায় আবার ভ্রাতৃত্ব রক্ষার ধরনটা ভিন্ন। যাদের সামর্থ্য আছে তারাই তো ঈদে পশু কুরবানি করে। ইসলামের শিক্ষা হলো, কুরবানির পুরো অংশটাই চাইলে তুমি ভোগ করতে পারো। তবে এর চেয়েও অনেক বেশি উত্তম ও কাক্সিক্ষত হলো, তোমার নিজের টাকায় কেনা পশু নিজ হাতে কুরবানি করার পর এর কিছু অংশ নিজের ঘরে রেখে দাও, কিছু বিলিয়ে দাও আত্মীয়—স্বজন আর পড়শিদের মাঝে, আর কিছু দাও গরিব ও অসচ্ছলদেরকে, যাদের কুরবানি করার সামর্থ্য ছিল না। ফলে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ঈদ ও কুরবানির উৎসব থেকে বঞ্চিত হয় না তারা। এভাবেই পূর্ণ হয় ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি।
এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তো আছেই, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অকৃত্রিম এক আবেগও। শুরুতেই বলে এসেছি, ফিলিস্তিনের রাজধানী মুসলমানদের নিকট তৃতীয় পবিত্র নগরী। এখানে রয়েছে মসজিদুল আকসা, যা আমাদের তিন শ্রেষ্ঠ মসজিদের একটি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
الصَّلَاة فِي الْمَسْجِد الْحَرَام بِمِائَة ألف صَلَاة، وَالصَّلَاة فِي مَسْجِدي بِأَلف صَلَاة، وَالصَّلَاة فِي بَيت الْمقدس بِخَمْسمِائَة صَلَاة.
মসজিদুল হারামে নামাযের সওয়াব এক লাখ গুণ, মসজিদে নববীতে নামাযের সওয়াব এক হাজার গুণ আর মসজিদুল আকসার নামাযের সওয়াব পাঁচশ গুণ। [মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস : ৫৮৭৩]
এ মসজিদুল আকসার সঙ্গেই মিশে আছে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মেরাজের স্মৃতি। আমাদের নবীজির জীবনে সংঘটিত এক অলৌকিক বিস্ময়কর ঘটনা এ মেরাজ। মেরাজের প্রথম ধাপটি ছিল মককার মসজিদে হারাম থেকে ফিলিস্তিনের এ মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ। এ মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা। মদীনায় হিজরতের ষোলো—সতেরো মাস পর নতুন কিবলা নির্ধারিত হয়—মসজিদুল হারাম। এতসব স্মৃতি যে মসজিদটির সঙ্গে, যে অঞ্চলের সঙ্গে, সেখানকার অধিবাসীদের কোনো বিপদে মুমিনমাত্রই আবেগাপ্লুত হয়। দুআ—মোনাজাতে কান্নাকাটিতে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ। মহান আল্লাহর দরবারে কোনো কিছুই গোপন থাকে না। জাতশত্রু ইহুদিরা তাদের দোসরদের নিয়ে হয়তো তৃপ্তমনে মুসলমানদের, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্বের কথা ভাবছে। দৃশ্যত তারা দুর্বলই। কিন্তু যে আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান, সে আল্লাহ দুর্বল নন। তিনি হালীম—অত্যন্ত সহনশীল। তিনি ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না—পৃথিবীর ইতিহাস এমনটাই বলে।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়লাম আলহামদুলিল্লাহ