অন্যকে খুশি করলে আল্লাহ খুশি হন
সবাই খেতে বসেছে। ছোটরা একসঙ্গে বসল। নুসাইবা বসল আব্দুল্লাহর ডান দিকে। জারির বসল বাম দিকে। ওরা দুজন সবচেয়ে ছোট। সবার দেখাদেখি ওরাও প্লেট নিয়ে বসেছে। ওরাও নাকি আজ নিজ হাতে খাবার খাবে। নুসাইবা বলছে, আমাকে সবার আগে দাও, সবার আগে। জারিরও প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে গেল খাবার নেওয়ার জন্য। ওদের অবস্থা দেখে সবাই হেসে উঠল।
আব্দুল্লাহর আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। ফাতেমা আম্মুকে সাহায্য করছে। আজকে খাবারের দস্তরখান সাজাতে ছোটরা সবাই সাহায্য করেছে। কেউ দস্তরখান আনল। কেউ প্লেট আনল। কেউ গ্লাস। কেউ চামচ আর কেউ বন প্লেট। অবশ্য গরম খাবারের বাটিগুলো আব্দুল্লাহর আম্মু ও দাদু এনেছেন। ভাইয়াও সহযোগিতা করেছেন।
দস্তরখান প্রস্তুত হওয়ার পর সবাই হাত ধুয়ে বসেছে। আব্দুল্লাহ বলল, আম্মু, আজ জারির আর নুসাইবাকে সবার আগে খাবার দেবেন। আগে ছোটরা। পরে বড়রা।
আম্মু তাই করলেন।
খাবার শুরু করার আগে আব্দুল্লাহ বলল, সবাই দুআ পড়ে নাও। নুসাইবা তুমি দুআ পারো? আমার মুখে মুখে পড়ো : বিসমিল্লাহি ওয়াবারাকাতিল্লাহ। বিসমিল্লাহ বলে খাবার না খেলে তোমার সাথে শয়তান খাবার খাবে।
সবাই খাবার শুরু করল। দস্তরখানে আজ অনেক মজার খাবার। সবাই মজা করে খাচ্ছে।
আব্দুল্লাহ বলল, আমার যখন সাত বছর হবে তখনও কিন্তু সবাইকে দাওয়াত করতে হবে।
ভাইয়া বললেন, ঠিক আছে। তবে সাত বছর থেকে কিন্তু নামায পড়তে হয়। রোযা রাখারও চেষ্টা করতে হয়। এ জন্য আগে থেকেই নামায শিখে নিতে হবে। নামাযের দুআ, সূরাগুলো মুখস্থ করতে হবে।
আব্দুল্লাহ বলল, ভাইয়া, আমি এখন দাদা ভাই ও আব্বুর সাথে সব নামাযই পড়ি। শুধু ফজরের সময় উঠতে পারি না। আর সূরাও পারি। দুআও অনেকগুলো শিখেছি। বাকিগুলো শিখে নেব, ইনশাআল্লাহ।
টিং টং… কলিং বেল বেজে উঠল।
এ সময় কে এলো? দাদা বললেন।
আমাকে একটু খাবার দেবেন? আমি আর আমার মেয়েটা সকাল থেইকা কিছুই খাইছি না। ও সাব, একটু ভাত দেবেন? বারান্দা থেকে অপরিচিত এক মহিলা বলল।
সবাই বুঝল, ফকির এসেছে।
নাহিদ বলল, খাবারের সময় ফকির এলো কেন? এই মাফ করেন। যান।
ফাতেমা বলল, না এমন বলতে নেই। কেউ কিছু চাইলে ফিরিয়ে দিতে হয় না। কিছু না কিছু দিতে হয়।
ভাইয়া বললেন, ফাতেমা ঠিকই বলেছে। একটু ভেবে দেখো, আমরা সকালে নাশতা করেছি। ১২টার দিকে আবার শরবত ও ফল—ফ্রুট খেয়েছি। এখন আবার ক্ষুধা লেগে গেছে। তাহলে ওদের কি ক্ষুধা লাগে না? ওরা তো সকালেও কিছু খায়নি।
আব্দুল্লাহর আম্মু বললেন, আমি গিয়ে ওদের খাবার খেতে দিচ্ছি। তোমরা খাও।
ভাইয়া বললেন, শোনো, একটা গল্প বলছি।
গল্প… গল্প… ছোটরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
ভাইয়া বলল, এটা শুধুই গল্প নয়। সত্য ঘটনা। এ ঘটনা শুনে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে।
—ঠিক আছে। ভাইয়া বলেন।
ভাইয়া গল্প বলতে শুরু করলেন।
গল্পটি হযরত ফাতেমা রাযি. ও হযরত হাসান—হুসাইনের। আচ্ছা তোমরা কি জানো, তাঁরা কারা?
আব্দুল্লাহ : ফাতেমা হলেন নবীজির মেয়ে আর হাসান—হুসাইন হলেন নবীজির নাতি।
মাশাআল্লাহ। আচ্ছা ঘটনা শোনো :
হযরত হাসান—হুসাইনের আব্বু হলেন হযরত আলী রাযি.। আম্মু হলেন হযরত ফাতেমা রাযি.। তাঁরা দুজন একবার তিন দিন রোযা রাখবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু সাহরী খাওয়ার মতো কোনো খাবারই ঘরে ছিল না। তাই তারা সাহরী না খেয়েই রোযা রাখলেন।
সকালে হযরত আলী রাযি. বের হলেন কাজের জন্য। একটি কাজ পেলেন। পশম দিয়ে একটি বসার গদি বানানোর কাজ। ঘরে এসে হযরত ফাতেমা রাযি.—কে নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সারা দিনে তিন ভাগের এক ভাগ কাজ হলো। কাজের জন্য মালিকের কাছ থেকে কিছু গম পেলেন।
হযরত ফাতেমা রাযি. গম পিষে পরিবারের চার জনের জন্য চারটি রুটি তৈরি করলেন। সন্ধ্যায় সবাই ইফতার নিয়ে বসলেন। অমনি এক ফকির এলো। বলল, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পরিবার, আমি এক অসহায় ফকির। কিছু খাবার থাকলে আমাকে দান করুন। আল্লাহ পাক জান্নাতে আপনাদের উত্তম খাবার দান করবেন।
ফকিরের কথা শুনে তাঁরা সবগুলো রুটি তাকে দিয়ে দিলেন।
—তাহলে ওরা কী খাবে? ফাতেমা বলল।
তাঁরা সবাই ক্ষুধার্ত থাকলেন। ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন।
হযরত আলী ও ফাতিমা রাযি. পরদিন সাহরী না খেয়েই রোযা রাখলেন।
দ্বিতীয় দিন আরও কিছু কাজ হলো। মালিক কিছু গম দিলেন। হযরত ফাতিমা রাযি. সে গম পিষে প্রথম দিনের মতো চারটি রুটি তৈরি করলেন। সন্ধ্যায় সবাই ইফতার নিয়ে বসলেন। অমনি এক ফকির এলো। বলল, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পরিবার, আমি এক অসহায় ফকির। কিছু খাবার থাকলে আমাকে দান করুন।
আজও তাঁরা সব রুটি ভিক্ষুককে দান করে ক্ষুধার্ত রইলেন।
তৃতীয় দিন তারা আবার সেহরী না খেয়েই রোযা রাখলেন। তৃতীয় দিনও কিছু গম পেলেন। সে গম পিষে চারটি রুটি তৈরি হলো। সন্ধ্যায় সবাই ইফতার নিয়ে বসলেন। তৃতীয় দিনও এক ফকির এলো। এ দিনও ফকিরকে তারা খাবার দিয়ে দিলেন।
—তাহলে তাদের কষ্ট হয়নি ভাইয়া? আব্দুল্লাহ বলল।
—কষ্ট হয়েছে। তাঁরা দুনিয়ার জীবনে কষ্ট করে গেছেন। তাঁরা চেয়েছেন মৃত্যুর পর জান্নাতে যেন সুখে থাকতে পারেন। আল্লাহ যেন তাঁদের প্রতি খুশি হন। অসহায় মানুষকে সাহায্য করলে আল্লাহ খুশি হয়।
ফাতেমা বলল, তাহলে আমরাও আল্লাহকে খুশি করব। ওদেরকে আমাদের খাবার দিয়ে দেব।
ভাইয়া বললেন, ওরা তো খাবার খাচ্ছে। ওদের বাসায় আরও কেউ থাকলে তাদের জন্য আমরা খাবার দিয়ে দিতে পারি।
আম্মু বললেন, মহিলাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি। বলেছে, মেয়েটির এক ভাই, এক বোন ও ওর আব্বু আছে। ওরাও ক্ষুধার্ত।
ভাইয়া বললেন, ওদেরকে আমরা নিজেদের খাবার দেব। এটা বলে ভাইয়া নিজের ভাগের কাবাব ও চিংড়ি তুলে একটি বাটিতে রাখলেন।
ফাতেমা ওর চিকেন ফ্রাই দিয়ে দিলো।
আব্দুল্লাহ বলল, ভাইয়া, আমার তো খাবার শেষ। আমি আমার মিষ্টিটা দিয়ে দিচ্ছি।
এভাবে একে একে সবাই নিজের ভাগের কিছু কিছু খাবার বাটিতে রাখল।
ভাইয়া সে বাটি নিয়ে গেলেন বারান্দায়। ছোট্ট মেয়েটির হাতে তুলে দিলেন। বললেন, এগুলো তোমার আব্বু ও ভাই—বোনকে দেবে।
মেয়েটি খুবই খুশি হলো।
এর মধ্যে নুসাইবা এসে দাঁড়ালো সবার সামনে। তার হাতে আইসক্রিম। মেয়েটিকে আইসক্রিমটি দিয়ে বলল, এতা তুমি খাও।
আব্দুল্লাহ বলল, একটু দাঁড়াও।
এ বলে সে ঘরের ভেতর দৌড়ে গেল। একটু পর দৌড়াতে দৌড়াতে এলো। মেয়েটির হাতে চকচকে একটি একশ টাকার নোট দিলো। বলল, এটা দিয়ে তুমি মজা কিনে খেয়ো।
এরপর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ঈদের দিন আপনি যে নতুন টাকাটা দিয়েছিলেন, সে টাকাটা আমি দিয়েছি।
ভাইয়া, আব্বু—আম্মু, দাদা—দাদু সবাই খুব খুশি হলেন।
আজকে ছোটরা খুব বেশি আনন্দিত হয়েছে ছোট্ট মেয়েটিকে কিছু দিতে পেরে। কাউকে কিছু দেওয়ার মাঝেও যে আনন্দ আছে তা তারা আগে জানত না। আজ বুঝতে পারল। তাদের মনে হচ্ছে, পোলাও, কোর্মা, চকলেট, আইসক্রিম এমনকি খেলাধুলা ও গল্পতেও সে মজা নেই, যে মজা আছে অন্যকে খুশি করার মধ্যে।
অন্যকে খুশি করলে আল্লাহ খুশি হন।