প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

আগামী দিনের উদ্যান

আগামী দিনের উদ্যান

সচেতন বাবা

এক ছেলের খেলাধুলায় প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। সে খেলতে খুব ভালোবাসত। কাজ মোটেও পছন্দ করত না। মা অলস ছেলের অবস্থা তার বাবা থেকে গোপন রাখতেন। এটাকে তিনি সন্তানের প্রতি মায়ের মমতা মনে করতেন।

বাবা একদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ছেলে তার সারাবেলা খেলাধুলায় নষ্ট করে। কোনো কাজ করে না।

তিনি ছেলেকে এক কাঠমিস্ত্রির দোকানে কাজ করার জন্য পাঠালেন। দৈনিক এক পিয়াস্টার মজুরির বিনিময়ে তাকে নিয়োগ দেওয়া হলো।

ছেলেটি সকালে বের হয়ে যেত। বোঝাত, সে দোকানে যাচ্ছে। কিন্তু না, সারাদিন খেলাধুলায় কাটিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরত।

মা নিজের কাছ থেকে এক পিয়াস্টার দিতেন। ওটা নিয়ে সে বাবাকে দিত। বাবা ওটা নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করতেন। কারণ, তিনি তার বিচক্ষণতা দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন, এই পিয়াস্টার তার মায়ের দেওয়া। তার কামাই করা নয়।

একদিন মায়ের অর্থ ফুরিয়ে গেল। ছেলেকে ডেকে বললেন, বাবা তুমি আজ দোকানে যাবে। কারণ, তোমাকে দেওয়ার মতো কোনো অর্থ আমার কাছে নেই।

মায়ের কথামতো ছেলে দোকানে গেল। দিন শেষে এক পিয়াস্টার নিয়ে ঘরে ফিরল। অন্য দিনের মতো আজও যখন বাবা ওর কাছ থেকে পিয়াস্টারটি নিয়ে নিক্ষেপ করতে চাইল, সে তার বাবার হাত ধরে চিৎকার করে উঠল, বাবা আজকেরটা নিক্ষেপ কোরো না। সারাদিন খেটে কষ্ট করে ওটা কামিয়েছি আমি। অন্য দিনেরটার মতো আজকেরটা নষ্ট করা যাবে না। আগেরগুলো মা দিয়েছিলেন।

বাবার আর বোঝার বাকি রইল না, আজকের পিয়াস্টারটি তার ছেলের পরিশ্রমে কামাই করা। ছেলে তার পরিশ্রমী হয়ে উঠেছে। অলসতা আর খেলাধুলা ছেড়ে দিয়েছে। বাবা অত্যন্ত খুশি হলেন। আল্লাহ পাকের শোকর করলেন। এরপর থেকে সে মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। আর ছেলেটির ধীরে ধীরে হাত পাকা হয়ে গেল। কাজের প্রতি আন্তরিকতা আর অবিচলতার ফল এই হলো, একদিন সে নিজের পেশায় দক্ষ ও পারঙ্গম সাব্যস্ত হলো। বন্ধু—বান্ধব আর পরিচিতজনদের বিস্ময়ের শেষ থাকল না যে, কীভাবে এই অলস ছেলে কর্মঠ হয়ে গেল। আর দেশ ও জনগণের জন্য উপকারী কারিগরে রূপান্তরিত হলো।

 

এতীম শিশু

এক গাঁয়ে ছিল বিশাল এক বাগান। ফুলে—ফলে ভরা ছিল সেই বাগান। পাশে ছিল নয়নকাড়া এক বাড়ি। বাড়িতে ছিল দুটি ফুটফুটে শিশু। মা শিশুদের অনেক ভালোবাসতেন। বেশ সুখেই কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু ভাগ্য ছিল অন্যরকম। বাবা অসুস্থ হয়ে গেলেন হঠাৎ করে। ভীষণ অসুস্থ। কোনো চিকিৎসাই কাজে এলো না। একদিন মারা গেলেন। সপ্তাহ খানেক পর মাও মারা গেলেন। শিশু দুটি হলো মা—বাবা হারা।

বাবা—মা রেখে গেলেন অনেক সম্পদ। তাদের এক চাচা ছিল দরিদ্র ও নিষ্ঠুর। তার মন ছিল খুবই শক্ত। দয়া মায়া বলতে কিছুই সে জানত না। মৃত্যুর সংবাদ শুনে সে ভাইয়ের বাড়িতে এসে হাজির হলো। বাড়িতে এসে শিশুদেরকে পেল। দেখল তাদের কাছে অনেক সম্পদ। সে সংকল্প করল, অসহায় শিশুদের হত্যা করে একাই সম্পদের মালিক হবে।

কিন্তু কীভাবে হত্যা করবে?

নিষ্ঠুর চাচা হত্যার কৌশল নিয়ে ভাবতে লাগল। দুজন খারাপ লোককে ভাড়া করল। তারা শিশুদের হত্যা করতে একমত হলো।

দুই খুনি একদিন তাদের বাড়ি এল। তাদের বলল, ওই দূরে অনেক সুন্দর বন আছে। সেখানে সাদা সাদা সুন্দর পাখি আছে। গাছের ডালে তাদের বাসা। সেখানে তারা সুন্দর সুন্দর ডিম পারে। জঙ্গলে রঙবেরঙের ফুল আছে। চলো ওখানে বেড়াতে যাই।

তাদের কথায় শিশুরা রাজি হয়ে গেলে। তাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে তারা হাঁটতে পারছিল না। লোক দুটি উৎসাহ দিয়ে দিয়ে তাদের অনেক দূরে বনের গভীরে নিয়ে গেল।

লোক দুটি একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। একজন আরেক জনকে বলল, নিষ্পাপ শিশু হত্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। রাত হয়ে গেছে। ঠাণ্ডাও আছে। তারা বাড়ি থেকে অনেক দূরে এসে গেছে। আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না। আমরা চলে গেলে হিংস্র প্রাণী তাদের খেয়ে ফেলবে।

সাথের লোকটি একমত হলো। তারা অনাথ শিশু দুটিকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেল। শিশুরা পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। তারা অনেক কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে বড় একটি গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল। সাদা পাখিরা তাদের দেখতে পেল। হিংস্র প্রাণীরা ওদের খেয়ে ফেলতে পারে ভেবে পাখিদের মনে অনেক ভয় হলো। তারা অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল নিয়ে এল। শিশুদের গায়ে বিছিয়ে দিল। ফলে তারা শীত থেকে রক্ষা পেল।

ভোর হলো। সূর্য উদিত হলো। পাখিরা কিচির মিচির করতে লাগল। গান গাইতে লাগল। শিশুরা জেগে উঠল। দেখতে পেল  চারপাশে সুন্দর সুন্দর ফুল। অবাক করা সাদা সাদা পাখি।

পাখিরা উড়তে শুরু করল। তারা পাখিদের অনুসরণ করে চলতে লাগল। পাখিদের পেছনে চলতে চলতে তারা গাঁয়ে এসে পৌঁছল। নিজেদের বাড়ি চিনতে পারল। বাড়িতে এসে দেখল তাদের সেই চাচা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। শিশুদেরকে নিরাপদে ফিরতে দেখে তার রোগ আরও বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে তার ব্যথা প্রচন্ড রূপ ধারণ করল। কিছুক্ষণ পর মারা গেল। চাচার মৃত্যুর পর শিশুরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

—অনুবাদ : আব্দুর রহমান

 

আমাদের জীবন

গল্পর মাধ্যমে শিক্ষা নেওয়ার রেওয়াজ অনেক আগ থেকেই মানুষের মধ্যে ছিল। মানুষ গল্প বলে শিক্ষা দিত। উপমার মাধ্যমে কোনো একটি জটিল বিষয়কে সহজ করে তুলে ধরত। আজকে তেমনই একটি গল্প মনে পড়েছে। গল্পটি বলেছিলেন ইমাম গাযযালী রহ.।

একবার এক লোক গভীর জঙ্গল দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ একটি সিংহের ধাওয়া খেয়ে সে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। পথিমধ্যে একটি খালি কূপ দেখতে পেল। প্রাণ বাঁচাতে কোনোকিছু না ভেবেই সে তাতে লাফিয়ে পড়ল। লোকটি কূপে পড়তে পড়তে একটি দড়ির নাগাল পেয়ে আঁকড়ে ধরল। এমন অবস্থায় সে দেখতে পেল, সিংহটি কূপের কাছেই অবস্থান করছে। কূপের নিচে একটি বিশাল সাপ তার অপেক্ষায় আছে। বিপদের উপর বিপদ হিসেবে দেখতে পেল, একটি সাদা ও আরেকটি কালো ইঁদুর রশিটি কাটতে আরম্ভ করেছে। এমন কঠিন মুহূর্তে কী করা উচিত, সে ভেবে পাচ্ছিল না।

হঠাৎ তার সামনে কূয়ার সাথে লাগোয়া গাছে একটি মৌচাক দেখতে পেল। সে কী মনে করে সেই মৌচাকের মধুতে আঙুল ডুবিয়ে চেখে দেখল। সেই মধুর মিষ্টতা এতই বেশি ছিল যে, সে অল্প সময়ের জন্য এমন কঠিন মুহূর্তের কথা নিমিষেই ভুলে গেল।

ইমাম গাযযালী রহ. গল্পটির ব্যাখ্যায় বলেন, গল্পের সিংহটি হচ্ছে আমাদের মৃত্যু। যে সর্বক্ষণ আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সাপটি হচ্ছে কবর। যা আমাদের অপেক্ষায় আছে। দড়িটি হচ্ছে আমাদের জীবন। আর সাদা ইঁদুরটি হলো দিন। কালো ইঁদুরটি হলো রাত। যারা প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই মৌচাক হলো দুনিয়া। যার সামান্য স্বাদে মজে গিয়ে আমরা মৃত্যু, কবর, আখেরাত সবই ভুলে যাই।

 

—মুহাম্মদ সিফাত হাসান

শরহে বেকায়া

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন