আগুন মৃত্যু ও জুতোর স্মারক
ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল
৮ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সেজান জুসের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কারখানাটি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এ ঘটনায় আগুনে পোড়া বায়ান্নটি লাশ উদ্ধার করা হয়। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশগুলো শনাক্তের কোনো উপায় নেই।
একটা সময় ছিল একটি মৃত্যুই পুরো জাতিকে নাড়া দিত। প্রতিবাদে প্রতিরোধে সাড়া দিত সারা দেশ। এখন সেই দিন গত হয়েছে। প্রতিবাদই নেই, প্রতিরোধ আসবে কোত্থেকে। ব্যতিক্রম কিছু ছাড়া প্রায় সবাই এখন প্রাণে বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট। দেশ—সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার মতো অভিলাস আর মনের মধ্যে কাজ করে না। মানুষগুলো যে আজ রোবট হয়ে গেছে। যে প্রোগ্রাম তার মধ্যে সেট করে দেওয়া আছে ততটুকুই, এর বাইরে আর কিছুই নেই। যেজন্য মানুষ আজ হারানোর বেদনা খুইয়ে ফেলেছে। যন্ত্রের মতো সংবাদ পড়ছে, যন্ত্রের মতো সংবাদ প্রচার করছে। কোনো কিছুরই প্রতিকার নেই।
আহারে মৃত্যু এভাবেও আসে। সংঘবদ্ধভাবে, সর্বাগ্রাসী আগুনের রূপ ধরে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে ফেলে। লেলিহান অগ্নিশিখা থেকে পালাতে গিয়েও উপায় নেই। দৌড়ে দরজার কাছে এসে দেখে দরজায় তালা। প্রাণ বাঁচাতে আবার দৌড়। এবার ছাদে উঠে আত্মরক্ষার চেষ্টা। এখানেও দরজায় তালা। পালানোর আর জায়গা কোথায়? এখন কেবল একটিই পথ খোলা। আগুন আর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।
রাষ্ট্র, দায়িত্বশীল সংস্থা, কারখানার মালিক—কেউই অসহায় এ শ্রমিকদের জন্য আর কোনো পথ খোলা রাখেনি। তাই আগুনকে জড়িয়ে ধরে মৃত্যুকূপে নামার আগে বেঁচে থাকার কিংবা নিজের স্মারক রক্ষার শেষ চেষ্টায় জুতায় নাম লিখে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে নিচে। কে জানে কার জুতা কে পায়? যে জুতা পায় সে কি জুতাওয়ালাকে চেনে? জুতায় লেখা মানুষটির নাম সে জানে? এ উত্তর জুতাওয়ালার কাছে নেই। তবুও শেষ চেষ্টা করে যায়। এ জুতা ছুড়ে মারার মাঝে কি রাষ্ট্রের প্রতি কোনো বার্তা নেই? আমার কাছে মনে হয় এ জুতা তো ছোড়া হয়েছে সরকারের গালে। এ জুতা তো ছোড়া হয়েছে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর গালে। এ জুতা মারা হয়েছে লোভাতুর মালিকপক্ষের গালে। কিন্তু গন্ডারের চামড়া কবেই—বা এত সংবেদনশীল ছিল যে, লেলিহান অগ্নিশিখায় পুড়তে থাকা দুর্বল শিশুশ্রমিকের ছুড়ে মারা জুতা কোনো ধরনের কাজ করবে।
এ জুতা যে কোনো কাজ করেনি তার প্রমাণ তো আমাদের সামনেই। আগুন তখনও জ্বলছে, মালিকপক্ষের একজন সাক্ষাৎকারে বলল, ‘কারখানায় কি আমি আগুন দিয়েছি?’ আহারে শিক্ষিত মানুষের মূর্খতা। আহারে সম্পদশালী মানুষের দম্ভ। আহারে শ্রমিকের রক্ত—ঘামে বিত্তবান হওয়া মানুষ। একজন মালিক কখন বলতে পারে এমন কথা? সব ধরনের নিয়ম মেনে সাধারণ শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই না বলতে পারে এমন কথা। অথচ এ অগ্নিকাণ্ডে মালিকপক্ষের ত্রুটির শেষ নেই।
ফরহাদ মজহার জুতায় নাম লেখা নিয়ে তাঁর ফেইসবুক পেইজে লেখেন,
‘কে জানি দিয়েছিল এই ফেইসবুকেই!, সেজান জুস কারখানা যখন পুড়ছে তখন অনেকে তাদের স্যান্ডেলে নাম লিখে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল বাইরে। আগের অভিজ্ঞতায় তারা জানত পুড়ে যাওয়া কিম্বা জীবন্ত কবর হয়ে যাবার পরে তাদের নাম আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কিম্বা ছাই হয়ে যাওয়া লাশ দেখে শনাক্ত করাও যায় না।
ছাই হয়ে যাচ্ছে বুক! পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কারও নাম লেখা স্যান্ডেল কয়েকটি পড়ে আছে হৃদপিণ্ডে। বৃষ্টিতে বা দমকলের জল জমে আছে গর্তে, তার পাশে। কবিতা এইসব টুকিটাকি তুলে রাখে। যদি কোনোদিন কারও কাজে লাগে!
আহ!! যদি কোনোদিন কারও মনে থাকে।
আ মা র শ হ র
হা হা শহর হু হু শহর ডিস্কো শহর তাই
এই শহরে পোড়া লাশের গন্ধ কিন্তু নাই!!!
বালিকাটি জানত তবু নাম লিখে স্যান্ডেলে
অগ্নিকুণ্ডে পুড়তে পুড়তে চিহ্ন দিল ফেলে।
সেটাই অপদার্থ কবি কুড়িয়ে রাখল বুকে
বুক পুড়ে ছাই হৃদপিণ্ড! রাখি কোথায় ওকে?
রাত্রে খানিক বৃষ্টি হোল লাশের স্তূপের ছাই
ধূয়ে দিল শহর, তাই লাশের গন্ধ নাই!
হা হা শহর হু হু শহর লাশের শহর তাই
এই শহরে পোড়া লাশের গন্ধ কিন্তু নাই!!!’
এর মধ্যে সংবাদ হলো, সজীব গ্রুপের সিইওসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ গ্রেপ্তার কি শুধু অনিয়মের জন্যই করা হয়েছে? নাকি পাবলিক আইওয়াশ? অনিয়মের কারণে গ্রেপ্তার করে থাকলে একই কারণে মিল ফ্যাক্টরি নিরাপত্তা—সংশ্লিষ্ট আরও ২৭টি সংস্থার সংশ্লিষ্ট লোকদেরও গ্রেপ্তার করতে হয়। কারণ, একটি কারখানা করতে ২৭টি সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। কোথায় সেসব সংস্থার কারও তো গ্রেপ্তারের কথা শোনা যায়নি। শোনা গিয়েছে সরকার বাহাদুরের দুয়েকজন উপরস্থ জনের কথা। তা হলো, গৎবাঁধা হুমকি, যে হুমকি আমরা দুর্ঘটনা ঘটলেই শুনে থাকি—‘দোষী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, জনতা আজীবন দোষীদের পার পেয়ে যেতেই দেখেছে। বিচারহীনতার এই দুঃসহ সময় কবে কাটবে কে জানে?
লোভ আর অবহেলার আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো আর ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না বিচার দিতে। তাদের জীবন নিয়ে কত ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। বুকভরা অভিমান আর বেদনা নিয়ে কবর—দেশে ঘুমাবে। কিন্তু কবরেও কি শান্তি আছে? সেখানেও আজকাল বৃষ্টির পানি জমে। ডুবিয়ে দেয় কবরও। যেহেতু ভাষা হারিয়েছে চিরতরে, ধরে নিলাম তারা সুখেই আছে। কিন্তু তাদের স্বজনেরা! তাদের বেদনা লাঘবের ভার কে নেবে?
ইয়াসিনের মাকে তার বাবা ছেড়ে গিয়েছে বহু আগে। স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন নিজে। খেয়ে না খেয়ে ইয়াসিনসহ তার আরও দু—ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। ছেলেদের মানুষ করতে হবে বলে আর বিয়েও করেননি। দয়ালু এক আত্মীয়ের দেওয়া খুপড়ি ঘরে থাকতেন। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে মাকে বলেছিল, ‘মা, তোমার লাইগা সুন্দর ঘর ভাড়া নিমু। দুই রুমের। এক রুমে তুমি আর আমি, আরেক রুমে ভাইয়েরা থাকব।’ ইয়াসিন অবহেলা আর লোভের আগুনে কয়লা হলো। সেই সঙ্গে কয়লা হলো তার স্বপ্নও। ইয়াসিনের মা বিলাপ করে কাঁদে। কান্না ধরে রাখতে পারে না তার প্রতিবেশীরাও। মা এখনো বিশ্বাস করেন ইয়াসিন ফিরে আসবে। কয়লা হয়ে যাওয়া লাশের মধ্যে ইয়াসিন আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা দিতে হবে মাকে। মা নমুনা দিতে রাজি নন। কারণ, মায়ের বিশ্বাস ছেলে তো ফিরে আসবেই।
এদিকে তো ইয়াসিনের মা বিলাপ করছে ইয়াসিন ফিরে আসার। ওদিকে রহিমা বেগমের ছেলে আরিফ বারবার বোনের কাছে আবদার করছে, ‘আমারে মায়ের লাশ আইনা দে, আমি ঘরের লগে মাটি দিমু।’ আরিফের বোন লিপা বলে, ‘মা অনেক পরিশ্রম করত। মালিকেরা তো পরিশ্রমের মূল্য দিল না, মৃত্যুর যন্ত্রণা দিল। তাগোরে বইলেন, আমাগো পাওনা লাগব না, মায়ের লাশটা হইলেই বাড়ি ফিরা যামু।’ বলতে বলতে লিপার চোখ ভিজে যায়। থেমে থাকে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, সবাই কি মারা গেছে? মায়েরে জীবিত পাওয়ার কোনো চান্স নাই?’
এত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও স্বজনেরা যেমন কোনোভাবে প্রাণের মানুষটা ফিরে আসে কি না সেই আশায় আছেন তেমনই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়ার আশাও তারা ছেড়ে দিয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় রাজীব হোসেন তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। চার বছরের সন্তান রাফিনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে অপেক্ষা করছেন। রাফিন এখনো জানে, তার মা দাদাবাড়ি গিয়েছেন। এই তো ফিরে আসবে। সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন রাফিনকে কিছু না বলতে। রাজীব বলেন, ‘তারা কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের সঙ্গে কি পারব? বিচার কি আর হইব? আমার চাওয়ার কিছু নাই, লাশটা যেন পাই।’
‘আমাদের চাওয়ার কিছু নাই’, এটা কেবল রাজীবেরই কথা নয়। আমজনতারও চাওয়ার কিছু নেই। খুন আর গুমের পর লাশটাই চাই। যেন এটুকু নিশ্চিত হতে পারে, পৃথিবীর কারও আর তাকে যন্ত্রণা দেওয়ার সুযোগ নেই। হঁ্যা, আজকাল আমজনতার এটুকুই চাওয়া, হঁ্যা এটুকুই।
হযরতপুর, ঢাকা
২ জিলহজ ১৪৪২ হিজরী