প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

আত্মহত্যা নয়, চাই দৃঢ় আশাবাদ

আত্মহত্যা নয়, চাই দৃঢ় আশাবাদ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

 

দিনে দিনে বাড়ছে আত্মহত্যা। সারা দেশে নয়, বরং গোটা পৃথিবীজুড়েই। হতাশা, ক্ষোভ, দুঃখ, অভাব, অভিমান ইত্যাদি নানা কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করে। এ আত্মহত্যাকে রোধ করার জন্যে, কিংবা বলা যায়, এর ঊর্ধ্বমুখী গতিকে নিম্নমুখী করার জন্যে নানাজনের পক্ষ থেকে নানান রকম গবেষণা হচ্ছে। একেকজন একেকভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন। নতুন নতুন কারণও বেরিয়ে আসছে। চিকিৎসা পদ্ধতিতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। কিন্তু আত্মহত্যার মিছিল দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। একে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ঊর্ধ্বমুখী এ প্রবণতা কমে আসার সম্ভাবনাও তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।

আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটাও বেশ উদ্বেগজনক। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনাকালে একটি জরিপ করেছিল অঁাচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা গেছে, ওই সময় দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। তারা এই তথ্যগুলো নিয়েছে তিনটি জাতীয় দৈনিক, পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে। [দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৪. ২. ২০২২]

একে তো আত্মহত্যাটাই ছিল সমাজের চরম মাথাব্যথার কারণ, এর ওপর যোগ হয়েছে সংকটের নতুন মাত্রা। আত্মহত্যা যেন ধীরে ধীরে একটি ‘শিল্পে’ পরিণত হচ্ছে! আল্লাহ হেফাজত করুন! এ (ফেব্রুয়ারি) মাসের শুরুতে ফেসবুক লাইভে দীর্ঘ সময় কথা বলে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ী। আধুনিক স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে তার ঘটনাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিষয়টি আমাদের সমাজকে বেশ নাড়া দেয়। এ নিয়ে লেখালেখি হয় অনেক। এ ঘটনার পর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় ফেসবুক লাইভে এসে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এক যুবক। এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগাছায় একই কায়দায় লাইভে এসে বিষপান করেন এক যুবক। পরদিন হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মহসিন খানের আত্মহত্যার দুইদিন পর দৈনিক কালের কণ্ঠে একটি রিপোর্ট হয় এ শিরোনামে—আত্মহননের পেছনে প্রবীণদের একাকিত্ব, ছয় মাসে ফেসবুক লাইভে এসে চার আত্মহত্যা। সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে, আত্মহত্যার আগ্রাসন ঠেকাতে চাইলে চারপাশকে জানিয়ে এভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এ প্রবণতা রোধ করতেই হবে। তবে আজকের বিষয় শুধুই আত্মহত্যা; ‘আত্মহত্যা নিয়ে বিনোদন’ নয়।

আত্মহত্যা এ আধুনিক কালের নতুন কোনো সংকট নয়। এ সংকট অনেক পুরোনো। কিন্তু কেন মানুষ নিজেকে এভাবে ধ্বংস করে? কেন আত্মহননের পথ বেছে নেয়? আত্মহত্যার একেকটি ঘটনা যখন সংবাদ আকারে পরিবেশিত হয়, তখন এর নানামুখী কারণও আমাদের সামনে আসে। কেউ পারিবারিক কলহের কারণে আত্মহত্যা করে, কেউ অতিশয় দুঃখ—কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, কেউ বঞ্চনা ও হতাশার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে, কেউ রোগে ভুগে আত্মহত্যা করে, কেউ আকস্মিক কোনো সংকট মোকাবিলা করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, প্রেমে ব্যর্থ হয়েও তরুণেরা আত্মহত্যা করে। এখন তো শোনা যায়, মোবাইলের টাকা বাবার কাছ থেকে পায়নি বলেও ছেলে আত্মহত্যা করে কিংবা পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত হয়নি বলে শিক্ষার্থী ঝুলে পড়ে সিলিং ফ্যানে বাঁধা রশিতে, গামছায়।

আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের সমাজে এত বেশি ঘটে যে, এখন এটা আমাদের কাছে ‘সিরিয়াস’ কোনো সংবাদই মনে হয় না। এগুলো সবই যেন স্বাভাবিক থেকে অতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে! সাধারণ আত্মহত্যার এ কালে ব্যবসায়ী মহসিন খানের আত্মহত্যাটি হয়তো অস্বাভাবিক ছিল। এজন্যেই মনে হয়, আত্মহত্যা নিয়ে নতুন করে নানামুখী গবেষণাও এখন আমাদের সামনে পরিবেশিত হচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলোতে ড. এন এন তরুন নামের একজন গবেষক লিখেছেন, ‘ক্ষুধা প্রতারণা আত্মহত্যা কেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ?’—এ শিরোনামে। ড. তরুন রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। শিরোনাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে—তিনি আত্মহত্যার জন্যে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তার মতে, মানুষ যে হতাশা কিংবা নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যা করে, তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি। তিনি লিখেছেন—‘নিঃসঙ্গতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা হলে কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। কারও এগিয়ে যাওয়া আর কারও পিছিয়ে পড়া মানে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়া। এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা উঁচু শ্রেণিতে উঠে গিয়ে নিচের দিকে আর ফিরে তাকান না। যারা নিচে পড়ে গেলেন, তাদের সঙ্গে তারা আর মেলামেশা করেন না। উঁচুতে ওঠার পরও প্রতিযোগিতা থামে না, বরং আরও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ব্যবধান, আর ব্যবধানই সৃষ্টি করে নিঃসঙ্গতা। আত্মহত্যার আগে মহসিন খান বলেছিলেন—নিঃসঙ্গতার যে কি কষ্ট, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বোঝে।’

জনাব মহসিন খান জীবনের শেষ কথাগুলোতে নিঃসঙ্গতার কথা যেমন উল্লেখ করেছেন, প্রতারিত হওয়ার কথাও বলেছেন। তার ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিই তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সবকিছু মিলিয়ে তিনি যখন জীবন নিয়ে হতাশ, তখনই তিনি আত্মহত্যার পথে অগ্রসর হলেন।

মানুষের গবেষণার যেমন স্থায়িত্ব নেই, তার কোনো শেষও নেই। এ গবেষণা চলতেই থাকে। আবার নানা মুনির নানা মত—এর মতো নানান গবেষকের নানান সিদ্ধান্ত। নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বকে অনেকেই আত্মহত্যার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ তা অস্বীকারও করেছেন। হেলাল মহিউদ্দিন প্রথম আলোতে লিখেছেন : ‘হাজারজনের মধ্যে বাস করেও কিছু কিছু মানুষ একাকিত্ব বোধ করতে পারে। একাকিত্ববোধ নিঃসন্দেহে মানসিক অসন্তুষ্টির কারণ, কিন্তু আত্মহত্যার কারণ হতে পারে না। সম্প্রতি আবু মহসিন খান নামে এক ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার পর সামাজিক মাধ্যমসহ সব মাধ্যমেই ব্যাপক আলোচনা চলছে। … আত্মজ—আত্মজা, বন্ধু ও স্বজন দ্বারা অবহেলার বঞ্চনা ও কৃতঘ্নতার ঘটনা সমাজে একটি—দুটি নয়, কোটি কোটিই আছে। আসলে সেগুলো প্রতিদিনই ঘটছে। সবাই আত্মহত্যা করেন না, বা করবেন এমনটিও ভাবেন না। কারণ জীবন একটিই। যাত্রাও একমুখীই। একবার হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না। সংগ্রামও জীবনেরই অংশ। সবার সেই সংগ্রামের মানসিক ধৈর্য, সহ্য বা জীবনবোধ সমান নয়। কারও কম, কারও বেশি। তাই প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির যোগ না হলেই তাঁরা ‘অ্যানোমি’গ্রস্ত হয়ে ওঠেন। জনাব মহসিন তাঁরই প্রমাণ রাখলেন। পুঁজিবাদী সমাজে প্রত্যেক মানুষেরই নানা রকম বিচিত্র টানাপোড়েন ও অক্ষমতা থাকে। সেসব মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হয়। তিনি চাইলেই তাঁর নিকটজন প্রত্যাশা মেটাতে সক্ষম না—ও হতে পারেন। এটিই বাস্তবতা। তিনি বাস্তব বা ‘সত্যরে লও সহজে’ মনোভঙ্গিটি আয়ত্ত করতে পারেননি, সন্দেহ নেই।’

যাই হোক, আমরা তো আর চারপাশের দেখা বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারি না। তবে তারা যে কথা বলতে চাইছেন—পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণেই মানুষের জীবনে হতাশা তৈরি হয়, নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব তৈরি হয়, তাও আমরা মেনে নিতে পারি এবং আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে একে বিবেচনা করতে পারি, কিন্তু একমাত্র কারণ নয় কখনই।

ইসলাম আত্মহত্যাকে শুরু থেকেই এক গুরুতর পাপ হিসেবে বর্ণনা করেছে। মহান আল্লাহর ঘোষণা—

وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَنْفُسَكُمْ.

তোমরা নিজেদের হত্যা করো না।—সূরা নিসা, আয়াত ২৯

সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরকারক ইমাম কুরতুবী রহ. লিখেছেন, এ আয়াতে একে অন্যকে হত্যা করাটা যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, নিজেকে হত্যা করাও এ নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। এ দুনিয়াতে আল্লাহ দয়াময় যা কিছু আমাদের দিয়েছেন, সবই তার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ এবং আমানত। তাঁর দেয়া নেয়ামত তাঁর নির্দেশিত পথে ব্যয় করতে হবে। ব্যতিক্রম করার সুযোগ নেই। টাকা—পয়সা, ধনদৌলত, সন্তান, এমনকি নিজের জীবন ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—সবই আমাদের কাছে আমানত। এগুলোকে যেমন আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে ব্যবহারের সুযোগ নেই, তেমনি এগুলোকে নষ্ট করে ফেলারও অধিকার নেই আমাদের। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর একটি হাদীস লক্ষ করুন। তিনি জানতে পারলেন, তাঁর এক সাহাবী হযরত উসমান ইবনে মাযউন রাযি. এতটাই ইবাদতে মশগুল থাকেন, যার ফলে তিনি স্ত্রীর খেঁাজখবর ঠিকমতো রাখতে পারছেন না। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকিয়ে আনলেন। বললেন : তুমি কি আমার সুন্নত থেকে বিমুখ থাকতে চাও?

সাহাবী উত্তর দিলেন : না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তো বরং আপনার সুন্নতের তালাশেই রয়েছি।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন স্পষ্টই বলেছেন :

فَإِنِّى أَنَامُ وَأُصَلِّى وَأَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأَنْكِحُ النِّسَاءَ فَاتَّقِ اللَّهَ يَا عُثْمَانُ فَإِنَّ لأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِضَيْفِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا فَصُمْ وَأَفْطِرْ وَصَلِّ وَنَمْ.

আমি তো (রাতে) ঘুমাই, নামাযও পড়ি, রোযা রাখি আবার রোযা ছেড়ে দিই, আমি নারীদের বিয়েও করেছি। উসমান, তুমি আল্লাহকে ভয় করো। তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর হক রয়েছে, তোমার ওপর নিশ্চয় তোমার মেহমানদের হক রয়েছে, তোমার ওপর তোমার নিজেরও হক রয়েছে। তাই কখনো রোযা রেখো, কখনো তা ছেড়ে দিয়ো, (রাতে) নামাযও পড়ো, আবার ঘুমাও।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং : ১৩৭১

অর্থাৎ ইবাদত করতে গিয়েও এতটা কঠোরতা নিজের ওপর আরোপ করা যাবে না, যার পরিণতিতে অন্যদের হক নষ্ট হয় এবং নিজের শরীর ভেঙে যায়। ইবাদতও করতে হবে, আবার শরীরও সুস্থ রাখতে হবে, অন্যদের হক তো রক্ষা করতে হবেই। এ ভারসাম্য রক্ষা করাটাই ইসলামের শিক্ষা। তো যে ইসলাম এভাবে ইবাদত করতে গিয়েও নিজের শরীরের হক বিনষ্ট করার অনুমতি দেয় না, সেখানে নিজেকে হত্যা করে ফেলার সুযোগ কোথায়?

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন আত্মহত্যাকারীর কঠিন পরিণতির কথা—যে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে এভাবেই ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। এভাবেই কাটবে তার চিরকাল। যে বিষপানে আত্মহত্যা করে, (পরকালে) বিষ তার হাতে থাকবে আর চিরকাল জাহান্নামের আগুনে এ বিষ পান করতে থাকবে। আর যে কোনো ধারালো জিনিস দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, তার ধারালো জিনিসটি (কেয়ামতের দিন) তার হাতে থাকবে, তা দিয়ে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল সে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে।Ñসহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৫৭৭৮

মানুষ নিজের চাইতে বেশি আর কাকে ভালোবাসে? এরপরও যখন কেউ নিজ হাতে নিজের জীবনের গতি থামিয়ে দেয়, আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, সন্দেহ নেই, সে চরম সংকটে পড়েই এ পথে এগিয়ে যায়। অন্যদের কাছে তার সংকটটি তেমন কিছু মনে নাও হতে পারে। কিন্তু আত্মহত্যাকারীর কাছে তা বড়ই থাকে। আর এজন্যেই নিজের জীবনের মায়া ভুলে সে খুন করে বসে নিজেকে। কথা কী, মানুষের জীবনে সংকট আসেই। তবে সে সংকটের মুখে নিজেকে এভাবে পরাজিত করার সুযোগ নেই। সমাজের চোখেও নেই, ধর্মের চোখেও নেই। চরম কষ্টে পড়েও আত্মহত্যা তো দূরের কথা, নিজের মৃত্যুর জন্যে দুআ করার অনুমতিও দেননি প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেছেন : কোনো বিপদে পড়ে তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। (অসহনীয় পরিস্থিতিতে) তাকে যদি কিছু বলতেই হয়, তবে সে যেন বলে—আল্লাহ, জীবন যতদিন আমার জন্যে কল্যাণকর থাকবে, ততদিন আপনি আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন, আর যখন মৃত্যুটাই আমার জন্যে কল্যাণকর হবে তখন আপনি আমাকে মৃত্যু দিন।—মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ১৩১৬৫

তাই ‘আমার জান আমি দিয়ে দেব’ জাতীয় কোনো স্লোগানে মুমিন কান দিতে পারে না। মুমিন তো সর্বাবস্থায়ই আশাবাদী। বিপদাপদ, রোগশোক কিংবা অন্য যে—কোনো সংকটে সে ধৈর্য ধরে আশায় বুক বাঁধে। যত সংকটই তাকে ঘিরে ধরুক, সে আশা করে—ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, চিরস্থায়ী নয় এখানকার দুঃখকষ্টও। সে বিশ্বাস করে পরম করুণাময়ের এ বাণী—

فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًاۙ۝۵ اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًاؕ۝۶

নিশ্চয়ই দুঃখ—কষ্টের সঙ্গে রয়েছে সুখ। নিশ্চয়ই দুঃখ—কষ্টের সঙ্গে রয়েছে সুখ।—সূরা ইনশিরাহ, আয়াত ৫—৬

নানামুখী পাপের রঙিন দুনিয়ায় ঘোরাফেরা করেও একপর্যায়ে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। এ হতাশা আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির হতাশা। এরই একপর্যায়ে মানুষ বেছে নেয় আত্মহননের পথ। অথচ আল্লাহ দয়াময় কতটা দয়ার সঙ্গে তাঁর বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেছেন—

یٰعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ ؕ       اِنَّ اللهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا ؕ       اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ.

নিজেদের প্রতি অবিচারকারী আমার বান্দারা, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, মহা দয়ালু।—সূরা যুমার, ৩৯ : ৫৩

হতাশায় আক্রান্ত হয়ে যারা নিজেদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন, নিজেদের দৃষ্টিতে তাদের জীবন হয়তো খুবই তুচ্ছ। তারা হয়তো ভাবেন—আমাকে দিয়ে আর হবে কী! অথচ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর এ নির্দেশনা কতটা আশাব্যঞ্জক লক্ষ করুন,

لاَ يَتَمَنَّ أَحَدُكُمُ الْمَوْتَ ، إِمَّا مُحْسِنٌ فَيَزْدَادَ إِحْسَانًا ، وَإِمَّا مُسِيءٌ فَلَعَلَّهُ أَنْ يَسْتَعْتِبَ.

তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। সে যদি নেককার হয়, তবে তার নেক কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আর যদি সে পাপী হয় তবে হয়তো সে তওবা করার সুযোগ পাবে।—মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ৮০৮৬

ইসলাম এভাবেই একদিকে যেমন আত্মহত্যার জন্যে কঠোর শাস্তির ঘোষণা দিয়েছে, অপরদিকে এ আত্মহত্যাকে প্রতিরোধ করার জন্যে মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। আর আত্মহত্যা নিয়ে যত গবেষণা যত লেখালেখিই হোক না কেন, জীবন নিয়ে হতাশাই সব গবেষণার মূল কথা হিসেবে উপস্থাপিত হয়। ইসলাম এ হতাশাকেই দূর করেছে। হতাশার অন্ধকার দূরে সরিয়ে আশার আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছে মুসলমানদের মন ও জীবন। আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন তাই আত্মহত্যা করতে পারে না।

বাকি রইল আত্মহত্যাকে পুঁজিবাদের ফল বলার সমাজবাদী প্রচারণা। এখানেও ইসলামের বিধান ও শিক্ষা চিরশাশ্বত। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে ইসলাম হরণ করে না। ব্যক্তির মালিকানা এখানে স্বীকৃত। আবার এ মালিকানা ও স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অন্যের ক্ষতিসাধনের সকল পথই এখানে রুদ্ধ। সম্পদ উপার্জনে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। কল্যাণকর যে—কোনো কাজেই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা এখানে কাক্সিক্ষতও। কিন্তু সে প্রতিযোগিতায় ধেঁাকার লেশও থাকতে পারবে না। কেউ কাউকে ঠকাতে পারবে না। প্রতারণার প্রশ্নই এখানে অবান্তর। এরই সঙ্গে রয়েছে যাকাতের বিধান। দরিদ্রদের হাতে নিজের কষ্টার্জিত সম্পদের একটি ভাগ তুলে দেয়ার অবধারিত বিধান। এতে সম্পদ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় ছিটকে গিয়েও কেউ নিঃসঙ্গ হয় না। একাকিত্বের দেয়াল কারও সামনে দাঁড়াতে পারে না। এখানে প্রত্যেকের সম্পদের মালিকানা ভিন্ন ভিন্ন, আবার সকলে মিলে যেন একই পরিবারভুক্ত। নিজেদের যাকাত ও দানের টাকা নিয়ে ধনী হাজির হয় গরিবের দুয়ারে। ধনী—গরিব মিলেমিশে গড়ে তুলে একটি শান্তির সমাজ। অধিকার ভোগে কোনো বৈষম্য তাদের মধ্যে থাকে না। কোনো একজন সংকটে পড়লে দশ জন এসে পাশে দাঁড়ায়। ফলে একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার ভয়ও নেই। আত্মহত্যার অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাইলে ইসলামের এসব শিক্ষা সমাজে ছড়াতেই হবে। চারপাশকে ভরে দিতে হবে আশার আলোয়। মুক্তির এই একটাই পথ।

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন