প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

আল্লাহর উপর ভরসা

হাজী ইমদাদুল্লাহ রহ.। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ। এ উপমহাদেশের বিশেষ করে আকাবিরে দেওবন্দের সকলের তাসাওউফের সিলসিলা গিয়ে মিলিত হয় হাজী সাহেব রহ.—এর সঙ্গে। এ কারণেই হযরতকে সাইয়িদুত তায়েফা তথা আমাদের কাফেলার প্রধান আখ্যায়িত করা হয়। থানাভবনের খানকা থেকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ—বিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। ১৮৫৭ সালে শামেলীর যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর হাজী সাহেব রহ.—এর জন্য হিন্দুস্তানে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। ইংরেজরা হযরতকে বন্দী করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কারণ তাঁকে বন্দী করতে না পারলে মুসলমানদের জিহাদের এ প্রেরণা অবদমিত হবে না। তাই হাজী সাহেব রহ. মক্কা শরীফে হিজরত করার নিয়ত করেন। হিজরতের পর ওখানে থেকেই আন্দোলন—সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তাই তাঁকে মুহাজিরে মক্কী বলা হয়।

হযরত হাজী সাহেব রহ.—এর মক্কা শরীফের প্রথম দিনগুলোর বিবরণ বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন মুহতামিম (প্রায় ৬০ বছর) হযরত কারী তৈয়্যব রহ. এক মজলিসে এ ঘটনা শুনিয়েছেন। কারী তৈয়্যব সাহেব রহ. শুনেছেন তাঁর আব্বা হযরত হাফেয মুহাম্মদ আহমদ রহ. থেকে। হাফেয মুহাম্মদ আহমদ সাহেব হলেন হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ.—এর ছেলে। তিনিও প্রায় ৩৪ বছর দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম ছিলেন। হাজী সাহেব রহ.—এর সঙ্গে হাফেয মুহাম্মদ আহমদ সাহেবের গভীর সম্পর্ক ছিল। আত্মীয়তার সম্বন্ধও ছিল। সে হিসেবে তিনি তাকে খুব স্নেহ করতেন। ‘বেটা’ বলে সম্বোধন করতেন। এ ঘটনা হযরত হাজী সাহেব রহ. নিজে হযরত হাফেয মুহাম্মদ আহমদ সাহেবকে শুনিয়েছেন।

হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. মক্কা শরীফের উদ্দেশে জাহাজে আরোহণ করে আল্লাহর সঙ্গে একটি ওয়াদা করলেন। মনে মনে বললেন, আল্লাহ, আমি আপনার ঘরের উদ্দেশে রওনা করছি। আমি কারও কাছে কিছু চাইব না। কারও কাছে হাত পাতব না। আপনার দরবার থেকে যা আসবে তা—ই আহার করব। আপনি কিছু না দিলে খাব না। হয়তো এতে আমার মৃত্যু হবে। এ মৃত্যুও তো আপনার তরফ থেকেই আসবে। অতএব সে মৃত্যুও আমার জন্য নেয়ামত। তবুও আমি কারও কাছে চাইব না। মহান দাতার দরজায় গিয়ে কেউ অন্যের কাছে হাত পাতলে মহান দাতারই অপমান হয়। অতএব আমি এমন করতে পারি না।

এভাবে আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়েই হযরত মক্কা শরীফ পেঁৗছলেন। হযরতের সঙ্গে অল্প কিছু খাবার ছিল। কয়েক দিনেই তা ফুরিয়ে গেল। এরপর চলল অনাহারের পালা। স্বাভাবিকভাবেই শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তবুও হেরেম শরীফে এসে নামায আদায় করতেন। এভাবে একে একে সাত বেলা অনাহারে কাটল। শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। তবুও হেরেম শরীফের হাজীরি বন্ধ করলেন না।

এ অবস্থায় একদিন তওয়াফ করছিলেন। এমনিতেই হযরত বৃদ্ধ মানুষ। তার উপর আবার কয়েক দিনের ক্ষুধার্ত। শরীর খুবই দুর্বল। তওয়াফ করতে গিয়ে হঠাৎ একজনের লুঙ্গিতে পা পড়ে গেল। লোকটি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে হাজী সাহেবকে জোরে ঘুসি মেরে বসল। হযরত তাল সামলাতে না পেরে আছড়ে পড়লেন। না জানি তখন হাজী সাহেব রহ.—এর হৃদয়ে কী বয়ে যাচ্ছিল।

সবাই যার যার তওয়াফে ব্যস্ত। হাজী সাহেবের দিকে কেউ একটি হাতও বাড়িয়ে দিল না। হাজী সাহেব মাথা তুলে বাইতুল্লাহর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। দেখেন, বাইতুল্লাহর একপাশে হযরত জিবরাঈল আ. ও অপর পাশে হযরত মীকাঈল আ. দাঁড়ানো। স্পষ্ট শুনতে পেলেন, হযরত জিবরাঈল আ. মীকাঈল আ.—কে লক্ষ্য করে বলছেন, এ লোক বড় ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে।

হযরত মীকাঈল আ. বললেন, আরও কিছু ধৈর্যের পরীক্ষা বাকি আছে।

হযরত ওই অবস্থায় আবারও প্রতিজ্ঞা নবায়ন করলেন। হে আল্লাহ, আমি আমার ওয়াদায় অটল আছি। আপনি ছাড়া কারও কাছে কিছু চাইব না। আপনি আমাকে মৃত্যু দিলেও তা আমার জন্য নেয়ামত হবে।

একাধারে অনাহার চলতে লাগল। দীর্ঘ অনাহারে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে হেরেম শরীফে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। ঘরের কাছের মসজিদেই নামায আদায় করতে লাগলেন। একপর্যায়ে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে বসে থাকতেও কষ্ট হয়।

এ সময়ই একদিন এক লোক এসে দরজায় আওয়াজ দিল। হযরত বললেন, ভেতরে চলে আসুন।

অপরিচিত এক লোক ঘরে প্রবেশ করল। হাতে তার কাপড়ে ঢাকা একটি থালা। হযরতের সামনে থালা পেশ করল। কাপড় সরাতে দেখা গেল উন্নত মানের খাবারে পূর্ণ সে থালা। হযরত ভাবলেন, মনের কোনো রকম চাহিদা ছাড়াই যে খাবার উপস্থিত হয়েছে তা নিশ্চয় আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। হযরত আহার করলেন এবং তৃপ্তিভরে আহার করলেন। কিছু খাবার রয়ে গেলে ভাবনা এলো, রাতের জন্য রেখে দিলে কেমন হয়। পরক্ষণেই ভাবলেন, যে আল্লাহ এভাবে আমার খাবার পৌঁছাতে পারেন তিনি কি রাতে আমাকে ভুলে যাবেন? হযরত খাবারের থালা ঢেকে ফেরত দিলেন।

আগন্তুক থালা উঠিয়ে নিল। যাওয়ার সময় বলল, রাতের জন্য রেখে দেননি ভালো হয়েছে। নাহয় জীবনভর ক্ষুধার কষ্টে মৃত্যুযন্ত্রণা ভুগতে হতো।

হযরত হাজী সাহেব রহ. হাফেয মুহাম্মদ আহমদ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, বেটা, আজ সে দিন এসেছে যখন আমার কাছে দুনিয়া আসছে অবনত শিরে প্রাচুর্যের সাথে। নগদ অর্থ। কাপড়—চোপড়। খাবার—দাবার। সবকিছুর স্তূপ হয়ে যাচ্ছে। আমি আল্লাহর বান্দাদের মাঝে বণ্টন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।

—সূত্র মাজালিসে হাকীমুল ইসলাম

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন