আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ
ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল
প্রায় দেড় হাজার বছর হতে চলেছে। তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন। এই এত এতগুলো বছরে কত কিছুরই—না পরিবর্তন হয়েছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পৃথিবীতে এসেছে এবং নতুন প্রজন্মের হাতে সব দায়—দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেছে। পরিবর্তনশীল এ দুনিয়ায় সবই বদলে যায়। অপরিবর্তিত রয়ে গেছে মুমিনের হৃদয়ে তাঁর ভালোবাসা। এখনো তাঁকে স্মরণ করে গাল বেয়ে পড়ে মুমিনের অশ্রম্ন। তারা প্রতিটি নামাযে তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরণ করে। রাত—দিনের সুন্দর মুহূর্তগুলোতে কিংবা বেদনা ও দুঃসহ মুহূর্তগুলো সুন্দর করতে মুমিনের বিশ্বাসী হৃদয় ও জবান থেকে উচ্চারিত হয় আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ। আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে নিবেদন চলতে থাকে, জীবনে একবার হলেও রওজার পাশে দাঁড়িয়ে যেন সরাসরি সালাম দেওয়া যায়। কখনো সে সুযোগ হয়ে গেলে সৃষ্টি হয় বিরহের পৃথিবী অতিক্রম করে মহা মিলনের জান্নাতে প্রবেশের অপরূপ চিত্র। আনন্দ অশ্রম্ন আর বাষ্পরূদ্ধ বাক্যই বলে দেয় কতটা ভালোবাসে এ উম্মতী তার প্রিয় নবীকে। আরবের এক কবি বলেছেন,
كل القلوب إلي الحبيب تميل
ومعي بذلك شاهد و دليل
أما الدليل إذا ذكرت محمدًا
صارت دموع العاشقين تسيل
প্রেমিকের অন্তর প্রেমাস্পদের কাছেই পড়ে থাকে, এর স্বপক্ষে আমার কাছে দলিল—প্রমাণও আছে
এর প্রমাণ হলো, মুহাম্মদের নাম নিলে তাঁর আশেকানদের চোখে অশ্রম্ন টলমল করে।
উম্মতী পাপী হতে পারে, আপাদমস্তক পাপের সমুদ্রে ডুবে থাকতে পারে, কিন্তু সে পাপের সমুদ্রে ডুবেও নবীর ভালোবাসাকে বিস্মৃত হয় না। সামান্য নাড়া পেলেই সে ভালোবাসা জেগে ওঠে। এ ভালোবাসায় জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারে। একটু খেঁাচাতেই যে এ ভালোবাসা কেমন তাজা হয়ে উঠতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। আখতার শেরানী নামে এক রোমান্টিক কবি ছিলেন। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। লাহোরের এক হোটেলে কিছু কমিউনিস্ট তরুণের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। তাদের চিন্তা—ভাবনা ছিল বিপথগামী। কবি মদ পান করছিলেন। ইতিমধ্যে দুই বোতল গলাধঃকরণ করেছেন। হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সারা শরীর কাঁপছিল। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছিল ভেঙে ভেঙে। আখতার শেরানী আত্মম্ভরী মানুষ ছিলেন। নিজেকে ছাড়া কাউকেই মানতেন না। না জানি কী প্রশ্ন ছিল। বললেন, মুসলমানদের মধ্যে তিনজন এমন ব্যক্তি জন্মেছেন যারা সব দিক দিয়ে জিনিয়াস আবার শাস্ত্রজ্ঞও :
এক. আবুল ফজল।
দুই. আসাদুল্লাহ খান গালিব।
তিন. আবুল কালাম আযাদ।
কবি খুব কমই অন্যকে স্বীকৃতি দিতেন। সমকালীন কবিদের মধ্যে যারা প্রকৃত অর্থেই কবি তাদেরকেও নিজের চেয়ে ছোট মনে করতেন। কমিউনিস্ট তরুণেরা ফয়েজের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে উড়িয়ে দেন। জোশের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে বলেন, সে তো শুধু ছন্দ বানায়। সরদার জাফরী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে, মুচকি হাসেন। ফিরাকের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে, হু হা করে চুপ হয়ে গেলেন। সাহের লুধিয়ানভীর ব্যাপারে প্রশ্ন করলে, তিনি সামনেই বসা ছিলেন, বললেন, অনুশীলন করতে দাও। জহীর কাশ্মীরীর ব্যাপারে বললেন, নাম শুনেছি। আহমদ নাদীম কাসেমী? বললেন, আমার ছাত্র। তরুণেরা যখন দেখল, প্রগতিশীল আন্দোলনই তার অপছন্দ তখন তারা আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বলল, অমুক নবীর ব্যাপারে কী মত?
নেশায় চোখ লাল হয়ে আসছিল, মদে বুঁদ ছিলেন, মুখের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সচকিত হয়ে বললেন, কী বকছ? শিল্প—সাহিত্য, শের—শায়েরীর কথা বলো।
একজন তৎক্ষণাৎ প্লেটোর আলাপ তুলল। তার ব্যাপারে কী মত? এরোস্ট্যাটল ও সক্রেটিসের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলো। তখন তিনি আপন মুডে ছিলেন। বললেন, জিজ্ঞেস করো আমি কে? এরোস্ট্যাটল, প্লেটো অথবা সক্রেটিস থাকলে আমার ক্লাসে বসত। তাদের কাছে আমার এমন কী প্রয়োজন যে তাদের ব্যাপারে আমি মতামত দেব?
তাঁর অসংলগ্ন কথায় ভরসা পেয়ে এক নরাধম কমিউনিস্ট একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে বসে। বলল, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
আল্লাহ আল্লাহ! মদে মত্ত এক মদ্যপ! যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠেছে। কাঁচের গ্লাস হাতে নিলেন এবং সোজা প্রশ্নকর্তার মাথায় মারলেন। বদবখত পাপীর কাছে প্রশ্ন করিস? কালোমুখোর কাছে প্রশ্ন করিস? ফাসেকের কাছে প্রশ্ন করিস? রাগে তাঁর সারা শরীর কাঁপছিল। আচানক কাঁদতে লাগলেন। এমনকি হেচকি আসতে লাগল। এমন অবস্থায় এই নাম কেন নিয়েছিস? এমন দুঃসাহস কী করে হলো গোস্তাখ, বেআদব।
با خدا ديوانہ باش با محمد ہوشيار
খোদার বেলায় দেওয়ানা হতে পারো
মুহাম্মদ—এর বেলায় হুঁশিয়ার থেকো।
এমন অসংলগ্ন প্রশ্নের জন্য তওবা করো। তোমাদের ভেতরকার শয়তানি আমি বুঝি। আপাদমস্তক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। প্রশ্নকারী তরুণ ভয়ে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কথার মোড় ঘুরাতে চাইল কিন্তু কবি কি আর কথা শোনেন, তাকে আসর থেকে বের করে দিলেন। এরপর নিজেও উঠে চলে গেলেন। সারা রাত কেঁদে চলেছেন। বলছিলেন, এরা এত লাগামহীন হয়ে গেছে যে আমাদের শেষ অবলম্বনও ছিনিয়ে নিতে চায়। আমি নিঃসন্দেহে গোনাহগার কিন্তু ও তো আমাকে কাফের বানাতে চাচ্ছে।—মাজামিনে শোরেশ, ইনআমুল বারী
এবার ভারতে বিজেপির দুই মুখপাত্র কতৃর্ক নবী অবমাননার পর স্কুল—কলেজ—ভার্সিটিতে নবী—প্রেমিকদের যে নবজাগরণ বাংলাদেশ দেখেছে তা অভূতপূর্ব। গায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ড্রেস, কাঁধে স্কুলব্যাগ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে এই সময়ে যার যতটুকু সাধ্য ততটুকু দিয়ে তারা নবী প্রেমের নাজরানা পেশ করেছে। সেখান থেকে উম্মাহর মুক্তির অসাধারণ সব স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে, যে স্লোগান মুক্তিকামী জনতাকে আশার আলো দেখায়। তাদের জেগে ওঠা দেখে, নবীর তরে জীবন কোরবানী দেওয়ার প্রেরণা দেখে কত যে আশাবাদী প্রাণ অশ্রম্নসজল হয়েছে। মনে হয় কবি ফররুখের সে আকুতির সাড়া দিতে সবাই জেগে উঠছে—
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি[1]?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
যুগের পর যুগ হিন্দুস্তানে মুসলমানরা নির্যাতিত হয়ে আসছে। হিন্দুস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে যত কিছু দেখানো হয় সবগুলো এক তরফা। সবগুলোতেই মুসলমানরাই মারা পড়েছে। এসব দাঙ্গার দুটি রূপ। এক. বিজেপি—পূর্ব যুগ। দুই. বিজেপি যুগ। বিজেপিপূর্ব যুগে সাধারণ চিত্র হলো, হিন্দুরা মুসলমানদের মারছে, ঘর—বাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করছে আর পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। বর্তমান বিজেপি যুগে দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের সঙ্গে পুলিশও মুসলিম নিধনে যোগ দিচ্ছে। উৎপীড়নের অনেক যন্ত্রের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে বুলডোজার। বেছে বেছে মুসলমানদের বাড়ি—ঘর নানান ছুঁতোয় গুড়িয়ে দিচ্ছে।
একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া কী আরব কী আজম হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ওপর এ নিপীড়নের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো মুখে কুলুপ এটে ছিল। যেমন কুলুপ এটে আছে চীনের কাশগরের মুসলিম নিপীড়নের ব্যাপারে। কিন্তু এবারকার নবী অবমাননার পর মুখে কুলুপ এটে রাখা আরব সরকারগুলোও প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারতকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছে। নবী অবমাননার পর ভারতের মুসলমানরা তীব্র প্রতিবাদ করার পরও সরকার ওসব অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু যখন পেটে লাথি পড়তে শুরু করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের শ্রম ও পণ্যের বিশাল বাজার হুমকির মুখে পড়েছে তখনই টনক নড়েছে। একজনকে সাময়িক বহিষ্কার, আরেকজনকে স্থায়ী বহিষ্কার করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। বিজেপি বারবার বলার চেষ্টা করছে তাদের এ বক্তব্য দলীয় নয়, ব্যক্তিগত। এখানে ভারতের ছাত্রনেতা কানহায়া কুমারের বক্তব্য মনে পড়ে। তিনি বলেন, মোদি একসময় হয়তো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলবে, এ কথা আমি বলিনি, আমার মুখ বলেছে।
দুই মুখপাত্রের কথা যদি দলীয় না হয় তাহলে দলীয় কথা কোনটি। দলের মতাদর্শ যুগ যুগ ধরে পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু না হলে দলীয় মুখপাত্রের মুখ দিয়ে এমন কথা বের হওয়া এবং আরেক মুখপাত্রের এই বক্তব্য টুইট করা হয়ে উঠত না।
এ দেশের সরকারের ভারতের এককালের আধা হিন্দুত্ববাদী এবং বর্তমানের হিন্দুত্ববাদী সরকারের দহরম—মহরমের সম্পর্ক। সরকারের কর্তা—ব্যক্তিরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে কখনো ভাই—বোন, কখনো ভাই—ভাই, কখনো স্বামী—স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছে। একই সম্পর্কের এত ধরন দেখে আমজনতা যদিও মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে যায়, এতেই বোঝা যায় দুই সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের গভীরতার ব্যাপারটি। এ জন্যই তো নবী অবমাননার মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও সরকার পর্যায়ে নীরব। আরবের নির্বাক সরকারগুলো যেখানে সবাক হয়ে উঠেছে, সেখানে প্রতিবেশী হয়ে, মদীনা সনদের দাবি করেও সরকার নীরব। এ অসহনীয় নীরবতা ধর্মপ্রাণ, দেশপ্রেমিক, বিবেকবান মানুষকে মর্মাহত করেছে।
ক্ষমতাসীনদের মনে রাখতে হবে, যদি মুসলমান হয়ে থাকি, যে—কোনো সূত্রেই হোক নিজেকে ঈমানদার দাবি করে থাকি, নিদেনপক্ষে যদি নিজেকে জনপ্রতিনিধি দাবি করি তাহলে ইসলামের, ঈমানের, জনপ্রতিনিধিত্বের ন্যূনতম যে দাবি আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দুনিয়া ও আখেরাতের পরিণতি তো অপেক্ষায় থাকছেই। মনে রাখতে হবে, আমি ইসলামের কাজে আসি বা না আসি ইসলাম এগিয়ে যাবেই। ইসলামের কাজে যুক্ত হতে পারলে আমিই সৌভাগ্যবান। ইহকাল, পরকালে আমিই লাভবান। নবী অবমাননায় আমি যদি প্রতিবাদী, প্রতিরোধী না হই, তাহলে নবীজির কিছু যাবে আসবে না। কারণ মহান আল্লাহ তো বলেছেন,
وَ رَفَعْنَا لَکَ ذِكْرَکَ
আমি তোমার কল্যাণে তোমার চর্চাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।—সূরা ইনশিরাহ, ৯৪ : ৪
আমি যদি নবীজির জন্য এগিয়ে আসি তাহলে আমারই ভাগ্য উজ্জ্বল হবে। নবীর শত্রুকে যদি আমি আমার সাধ্যানুযায়ী প্রতিহত না করি তাহলে আমিই ক্ষতিগ্রস্ত হব। নবীর শত্রুরা যে ধ্বংস ও নির্বংশ হবে সে তো মহান আল্লাহরই প্রতিশ্রম্নতি,
اِنَّ شَانِئَکَ هُوَ الْاَبْتَرُ
নিশ্চয়ই তোমার শত্রুরই শেকড় কাটা।—সূরা কাউসার (১০৮) : ৩
নবীজিকে অপমানের প্রতিশোধ আল্লাহ তাআলা কখনো কখনো প্রাকৃতিক উপায়েও নেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. আদদুরারুল কামিনা : ৪/১৫২ গ্রন্থে এমনই একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন, কোনো এক তাতারি আমীর খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। একদিন তার কাছে খ্রিষ্টান ও মোঘলদের এক দল লোক আগমন করে। উপস্থিতদের একজন নবীজির শানে বিরূপ মন্তব্য করছিল। দরবারেরই এক কোণে একটি কুকুর বাধা ছিল। যখন ওই বেয়াদব সীমা ছাড়িয়ে গেল কুকুর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে খামচে ক্ষত—বিক্ষত করে দিল। উপস্থিত কেউ কেউ বলল, তুমি যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর শানে বেয়াদবি করছ তাই কুকুরটি এমন করেছে!
সে বলল, না, এমন নয়। বরং কুকুরটি বেশ সতর্ক। তার দিকে আমি হাত নাড়তে দেখে মনে করেছে আমি তাকে আক্রমণ করব।
এরপর আবার সে নবীজির শানে গোস্তাখি করতে থাকে। আগের চেয়ে বেশি করতে থাকে। কুকুর পুনরায় আক্রমণ করল। একেবারে তার কণ্ঠনালি কামড়ে ধরল। একটানে ছিঁড়ে ফেলল। এ বেয়াদব তৎক্ষণাৎ মারা গেল। এই ঘটনায় তখন চল্লিশ হাজার তাতারি ইসলাম গ্রহণ করে।
নবীজির প্রতি মহব্বত পোষণ করা, নবীজির আদব বজায় রাখা বড় সংবেদনশীল একটি বিষয়। এ জন্য নবীজিকে যত বেশি জানব, উম্মতের জন্য তাঁর ত্যাগ—তিতিক্ষার ব্যাপার যত উপলব্ধি করতে পারব, ততই তাঁর প্রতি মহব্বত বাড়বে, আদব বজায় রাখার ব্যাপারটি সহজ হবে। নবীজির প্রতি আদব বজায় না রাখার কারণে এক মুসলমানের যে করুণ পরিণতি হয়েছিল সে গল্প বলে এ লেখার ইতি টানছি।
মিশরের বাদশা প্রথম ফুয়াদ জুমার নামায সরকারি ইমাম মুহাম্মদ আল—মাহদীর পেছনে পড়তে পছন্দ করতেন। মুহাম্মদ আল—মাহদী ছিলেন খ্যাতিমান বক্তা। বাদশা তাহা হুসাইনকে ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন উচ্চতর ডিগ্রির জন্য। তাহা হুসাইন বিদেশ থেকে ফিরলে বাদশা তাকে জামেয়া আযহারে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। খতীব সাহেব জুমায় বাদশাহর প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন,
جاءه الأعمى فما عبس في وجهه و ما تولى.
এক অন্ধ আগমন করলে তিনি ভ্রƒকুঞ্চিত করেননি এবং মুখও ফিরিয়ে নেননি।
এখানে অন্ধ বলে তাহা হুসাইনকে বুঝিয়েছেন। কারণ, তাহা হুসাইন ছিলেন অন্ধ।
এ কথা বলে খতীব বোঝাতে চেয়েছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেছেন বাদশাহ তার চেয়ে ভালো করেছেন। ঘটনা হলো, অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম এলে নবীজি তাঁর দিকে মনোযোগী না হয়ে কুরাইশের নেতৃস্থানীয়দের দিকে মনোযোগী ছিলেন।
সে জুমায় আযহারের প্রধান শায়খ মুহাম্মদ শাকের রহ. ছিলেন। নামাযের পর দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, সবাইকে জুমার নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। কারণ খতীব কাফের হয়ে গেছে। শায়খ মুহাম্মদ শাকের স্পষ্ট ভাষায় বললেন, খতীব ইঙ্গিতে নবীজিকে অবমাননা করেছেন। তিনি এ কথা বাদশা পর্যন্ত পেঁৗছালেন। কিছু ফেতনাবাজ মানুষ খতীবকে বাদশাহর কাছে শায়খ মুহাম্মদ শাকেরের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ করতে বলল।
শায়খ মুহাম্মদ শাকের কাজির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার বক্তব্যের সমর্থনে আমি আযহারের উলামায়ে কেরাম কিংবা আরবী ভাষার পণ্ডিতদের আনতে বলি না। যেন কেউ এটা মনে না করে যে আযহারের লোকজন আমার পক্ষপাতিত্ব করছে। বরং প্রাচ্যবিদদের আনুন যারা আল্লাহকে অবিশ্বাস করে কিন্তু আরবী ভাষা জানে। তারা বলুক খতীবের কথায় সেই ইঙ্গিত ও রূপক অর্থ আছে কি না?
আহমদ শাকের বলেন, আল্লাহ ওই খতীবকে এমনি এমনি ছেড়ে দেননি। কয়েক বছর পর তাকে দেখি, কায়রোর এক মসজিদের দরজায় লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়ে মুসল্লীদের জুতা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে। একসময় যে ছিল সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত, যার কাছে উচ্চপদস্থ লোকেরা যাতায়াত করত।
আমি তার মুখোমুখি হলাম না, যদি আমাকে চিনে ফেলে। তার প্রতি কোনো মায়ার কারণে আমি এড়িয়ে যাইনি। কারণ, এটা মায়া করার জায়গা নয়। কিংবা বিদ্বেষের দরুনও নয়। কারণ, ভদ্র মানুষ কখনো বিদ্বেষ পোষণ করতে পারে না। আল্লাহ সত্য বলেছেন,
وَمَنْ یُّهِنِ اللهُ فَمَا لَهٗ مِنْ مُّكْرِمٍ
আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তাকে সম্মানিত করার কেউ নেই।—সূরা হজ (২২) : ১৮
—কালিমাতুল হক, আহমদ শাকের রহ., পৃষ্ঠা : ১৪৯—১৫৩
একজন মুমিন তার মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়—স্বজন, পাড়া—প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তাই প্রাণপ্রিয় এ নবীর মর্যাদায় কেই সামান্য আঘাত হানলে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কবির এ বক্তব্যটি সবার স্মরণে রাখা প্রয়োজন :
جان دے دی میں نےان کے نام پر عشق نے سوچا نہ کچھ انجام پر
তার পবিত্র নামের সম্মান রক্ষায় আমি বিসর্জন দিয়েছি নিজের জীবন / ভালোবাসা এমনই জিনিস, মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েও তা পরিণাম নিয়ে ভাবে না।
- 1. পাঞ্জেরি শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘আলোকবর্তিকা’। সাধারণ অর্থ ‘মাস্তুল—সংলগ্ন বাতি নিয়ে জাহাজের দিক—নির্দেশক’। প্রতিকী অর্থ হচ্ছে, ‘জাতির পথপ্রদর্শক’।