প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামায

ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামায

মাওলানা তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব


কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা মুমিন মুত্তাকীদের পরিচয় দিতে গিয়ে ঈমানের পরেই বলেছেন নামাযের কথা। বলেছেন,

الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِالْغَیْبِ وَیُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوۃَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ.

যারা গাইবের প্রতি ঈমান রাখে। যথাযথভাবে নামায আদায় করে এবং আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি, তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে।—সূরা বাকারা, (২) : ৩

আল্লাহ তাআলা ঈমানের বার্তা দিয়েই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। এরপর নামাযের জন্য তাঁকে আবার নিয়ে গেছেন ঊর্ধ্বলোকে। সাত আসমান পার করে একান্ত কাছে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উপহার ও ইবাদত তাঁকে দান করেছেন, যা অন্য কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে ঘটেনি।

এরপর সফল মুমিনের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন,

قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ  ۙ﴿۱﴾  الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ      ۙ﴿۲﴾

নিশ্চয় সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগণ। যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত।—সূরা মুমিনুন (৩২) : ১—২

এখানে মুমিনের আরও কয়েকটি গুণ ও পরিচয় উল্লেখ করার পর শেষে বলেছেন,

وَالَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ    ۘ﴿۹﴾ اُولٰٓئِکَ هُمُ الْوٰرِثُوْنَ ﴿ۙ۱۰﴾  الَّذِیْنَ یَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ ؕ هُمْ  فِیْهَا خٰلِدُوْنَ ﴿۱۱﴾

তারা নিজেদের নামায সম্পর্কে পরিপূর্ণ যত্নশীল। এরাই হলো সেই ওয়ারিশ। যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকারী হবে। তারা তাতে থাকবে চিরকাল।—সূরা মুমিনূন (৩২) : ৯—১১

সূরা মাআরিজে আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাব, গঠন ও অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন,

اِنَّ  الْاِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوْعًا ﴿ۙ۱۹﴾  اِذَا مَسَّهُ  الشَّرُّ جَزُوْعًا ﴿ۙ۲۰﴾  وَّ اِذَا مَسَّهُ  الْخَیْرُ مَنُوْعًا ﴿ۙ۲۱﴾  اِلَّا  الْمُصَلِّیْنَ ﴿ۙ۲۲﴾  الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَاتِهِمْ  دَآئِمُوْنَ  ﴿۪ۙ۲۳﴾

বস্তুত মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে লঘুচিত্তরূপে। যখন তাকে কোনো কষ্ট স্পর্শ করে, সে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়ে। আর যখন তাকে স্বাচ্ছন্দ্য স্পর্শ করে, তখন সে হয়ে যায় অতি কৃপণ। তবে যারা নামাযী তারা এর মধ্যে গণ্য নয়। যারা তাদের নামায আদায় করে নিয়মিত।—সূরা মাআরিজ (৭০) : ১৯—২৩

এখানেও একজন মানুষ তার সৃষ্টিগত দুর্বলতা কাটিয়ে কী কী গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে উন্নতি অর্জন করতে পারে তার মধ্যে প্রথমেই বলেছেন নামাযের কথা। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি গুণ উল্লেখ করার পর আবার শেষে বলেছেন,

وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَاتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ ﴿ؕ۳۴﴾  اُولٰٓئِکَ فِیْ جَنّٰتٍ مُّكْرَمُوْنَ ﴿ؕ۳۵﴾

তারা তাদের নামাযের ব্যাপারে থাকে যত্নবান। তারাই থাকবে জান্নাতে সম্মানজনকভাবে।—সূরা মাআরিজ (৭০) : ৩৪—৩৫

নামাযের উপকারিতা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاَقِمِ الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ ؕ اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ   ؕ ذٰلِکَ ذِكْرٰی لِلذّٰکِرِیْنَ ﴿۱۱۴﴾

দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে নামায আদায় করো। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ।—সূরা হুদ (১১) : ১১৪

সূরা আনকাবুতে ইরশাদ করেছেন,

وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ       ؕ اِنَّ الصَّلٰوۃَ  تَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ  وَالْمُنْکَرِ.

এবং যথাযথভাবে নামায আদায় করো। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।—সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৫

নামাযীদের প্রশংসা ও সুন্দর অবস্থা প্রসঙ্গে কোরআন মাজীদে অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। সেই সঙ্গে যারা নামাযে উদাসীন ও গাফেল এবং যারা নামায পরিত্যাগ করে, তাদের সম্পর্কেও বিবৃত হয়েছে অনেক হুঁশিয়ারি। যেমন : আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

فَوَیْلٌ  لِّلْمُصَلِّیْنَ ۙ﴿۴﴾  الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ ۙ﴿۵﴾

ধ্বংস রয়েছে সেই নামাযীদের জন্য, যারা তাদের নামাযে গাফলতি করে।—সূরা মাউন (১০৭) : ৪—৫

এমনকি অলসতার সঙ্গে নামায আদায়কে মুনাফিকদের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন,

وَ اِذَا قَامُوْۤا اِلَی الصَّلٰوۃِ قَامُوْا كُسَالٰی.

তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় অলসতার সঙ্গে দাঁড়ায়।—সূরা নিসা (০৪) : ১৪২

সূরা মারইয়ামে আল্লাহ তাআলা তাঁর নেয়ামতপ্রাপ্ত ও নৈকট্যশীল বান্দাদের প্রসঙ্গে কথা বলার পর বলেছেন,

فَخَلَفَ مِنْۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوٰتِ فَسَوْفَ یَلْقَوْنَ غَیًّا ﴿ۙ۵۹﴾

তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এমন লোকেরা, যারা নামায নষ্ট করেছে এবং ইন্দ্রিয় চাহিদার অনুগামী হয়েছে; সুতরাং তারা অচিরেই পথভ্রষ্টতার সম্মুখীন হবে।—সূরা মারইয়াম, ১৯ : ৫৯

এমনইভাবে হাদীস শরীফে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নামাযের কথা বলেছেন। বলেছেন,

رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الجِهَادُ

দীনের প্রধান বিষয় হলো ইসলাম। তার খুঁটি হলো নামায। আর তার উচ্চ চূড়া হলো জিহাদ।—সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ২৬১৬

এমনইভাবে বলেছেন,

إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَلَاتُهُ، فَإِنْ وُجِدَتْ تَامَّةً كُتِبَتْ تَامَّةً، وَإِنْ كَانَ انْتُقِصَ مِنْهَا شَيْءٌ. قَالَ: انْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ لَهُ مِنْ تَطَوُّعٍ يُكَمِّلُ لَهُ مَا ضَيَّعَ مِنْ فَرِيضَةٍ مِنْ تَطَوُّعِهِ، ثُمَّ سَائِرُ الْأَعْمَالِ تَجْرِي عَلَى حَسَبِ ذَلِكَ

কেয়ামতের দিন বান্দার আমলের মাঝে সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার নামাযের। নামায ঠিক থাকলে সে সফল হবে। আর নামায ঠিক না থাকলে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি তার ফরয নামায কম থাকে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে বলবেন, দেখো আমার বান্দার কোনো নফল আছে কি না। তা দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করা হবে। এরপর তার অন্যান্য আমল এ হিসেবেই বিবেচনা  করা হবে।—সুনানে নাসায়ী : ৪৬৬; সুনানে তিরমিযী : ৪১৭

নামায সম্পর্কে চূড়ান্ত সতর্কবাণী উল্লেখ করে বলেছেন,

إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ.

নিশ্চয় একজন মানুষ ও কুফর—শিরকের মাঝে পার্থক্য হলো নামায।—সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮২

আরেকটি হাদীসে বলেন,

مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ كَمَثَلِ نَهْرٍ جَارٍ، غَمْرٍ عَلَى بَابِ أَحَدِكُمْ، يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ.

পাঁচ ওয়াক্ত নামায হলো তোমাদের কারও দরজার সামনে দিয়ে প্রবাহিত বড় নদীর মতো। যাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে।—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৬৬৪

হাদীসটি অন্যত্র আরও বিস্তারিত আছে। তাতে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, এভাবে পাঁচবার গোসল করলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা থাকতে পারে? পারে না। তারপর বলেছেন,

فَإِنَّ الصَّلَاةَ تُذْهِبُ الذُّنُوبَ كَمَا يُذْهِبُ الْمَاءُ الدَّرَنَ.

নিশ্চয় নামায গোনাহসমূহকে তেমনইভাবে দূর করে দেয়, যেমন ওই পানি শরীরের ময়লাকে দূর করে দেয়।—সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ১৩৯৭

আরও বলেছেন,

الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ.

পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমআ থেকে আরেক জুমআ এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান, মধ্যবর্তী সকল গোনাহকে মিটিয়ে দেয়। কবীরা গোনাহ ছাড়া।—সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৩৩

সাহাবী হযরত রাবীআ ইবনে কাব আল—আসলামী রাযি. বলেন, আমি একদিন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রাত্রিযাপন করলাম। তখন আমি তাঁর কাছে অযুর পানি ও প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, আমার কাছে কোনো কিছু চাও।

আমি বললাম, জান্নাতে আপনার সঙ্গ কামনা করছি।

তিনি বললেন, কিংবা অন্য কিছু চাও?

আমি বললাম, এটাই চাই।

তিনি বললেন,

فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُود.

তাহলে অধিক পরিমাণে সিজদা (তথা নামায) আদায়ের মাধ্যমে তোমার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করো।—সহীহ মুসলিম : ৪৮৯

হযরত সাওবান রাযি.—কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ، فَإِنَّكَ لَا تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً، إِلَّا رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً، وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً.

বেশি পরিমাণে আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করো। নিশ্চয় তুমি একবার আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করলে তিনি তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং একটি গোনাহ ক্ষমা করে দেন।—সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৮৮

আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে নামাযের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوۃِ        ؕ اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ ﴿۱۵۳﴾

হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।—সূরা বাকারা, (০২) : ১৫৩

অন্যত্র বলেন,

وَاسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوۃِ        ؕ وَ اِنَّهَا لَکَبِیْرَۃٌ اِلَّا عَلَی الْخٰشِعِیْنَ   ﴿ۙ۴۵﴾

তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। আর নামায অবশ্যই কঠিন মনে হয়। কিন্তু তাদের কাছে নয়, যারা খুশু (অর্থাৎ বিনয় ও মনোযোগ) এর সঙ্গে আদায় করে।—সূরা বাকারা (০২) : ৪৫

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যথাযথভাবে নামায আদায় করার তাওফীক দান করুন। নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সৌভাগ্য নসিব করুন। আমীন।

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন