ঈসালে সওয়াব ও কবর যিয়ারত
মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আমলের সুযোগ শেষ হয়ে যায়। নতুন কোনো আমল করার সুযোগ থাকে না। অল্প কয়েকটি আমলের সওয়াবের ধারা চালু থাকে। আমলনামায় তা যোগ হতে থাকে। এ ছাড়া নেকি বৃদ্ধি করার অন্য কোনো পথ থাকে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا مات الإنسان انقطع عمله إلا من ثلاثة أشياء : صدقة جارية أوعلم ينتفع به أوولد صالح يدعو له.
অর্থ, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমল চালু থাকে :
১. সদকায়ে জারিয়া।
২. এমন ইলম যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
৩. এমন নেককার সন্তান যে তার জন্য দুআ করে।-সহীহ মুসলিম : ৪২২৩
মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সুখ-শান্তি নেকির ওপর নির্ভরশীল। আমলনামায় যে পরিমাণ নেকি থাকবে সে অনুপাতে সুখ-শান্তি ও নেয়ামত লাভ করবে। আমলনামায় নেকি না থাকলে কিংবা নেকির চেয়ে গোনাহের পরিমাণ বেশি হলে অবর্ণনীয় শাস্তি ও কষ্ট ভোগ করে সে জীবন পার করতে হবে। এ সত্য আমরা সকলেই জানি ও বিশ্বাস করি। তবে গায়েবী বিষয় হওয়ার কারণে এর বাস্তবতা যথাযথ উপলব্ধি করতে পারি না। মৃত্যুর পর যখন বাস্তবতা উপলব্ধি হয় তখন কিছু করার থাকে না। তখন তাওবা-ইস্তেগফার করলে গোনাহ মাফ হবে না। যিকির-আযকার করলেও নেকি হবে না। আত্মীয়-স্বজন, আপনজন ও প্রিয়জন যারা দুনিয়াতে আছে, তাদেরও কিছু করার থাকে না। এমন সংকটময় মুহূর্তে মৃত ব্যক্তির উপকারের জন্য আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে একটি অনন্য উপায় দান করেছেন। তা হলো, মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের ইস্তেগফার করা ও ঈসালে সওয়াব করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
ما الميت في القبر إلا كالغريق المتغوث ينتظر دعوة تلحقه من أب أو أم أو أخ أو صديق فإذا لحقته كانت أحب إليه من الدنيا و ما فيها و إن الله عز وجل ليدخل على أهل القبور من دعاء أهل الأرض أمثال الجبال و إن هدية الأحياء إلى الأموات الاستغفار لهم.
অর্থ, কবরে মৃত ব্যক্তির অবস্থা হলো সমুদ্রে নিমজ্জমান ওই ব্যক্তির মত, যে বাঁচার আকুতি জানিয়ে চিৎকার করছে। সে বাবা, মা, ভাই বা বন্ধুর দুআর অপেক্ষায় থাকে। কারও দুআ পেলে সেটি গোটা দুনিয়া ও তার সমুদয় সম্পদ থেকেও তার কাছে অধিক প্রিয় বিবেচিত হয়। নিশ্চই আল্লাহ তাআলা দুনিয়াবাসীর দুআকে কবরবাসীর কাছে পাহাড়ের আকৃতিতে পৌঁছে দেন। মৃতদের প্রতি জীবিতদের হাদিয়া হলো তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান : ৯২৯৫
এক সাহাবী এসে আরজ করলেন, আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন অনুপস্থিত ছিলাম। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তাহলে কি তার উপকার হবে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ।-সহীহ বুখারী : ২৭৫৬
অন্য হাদীসে আছে,
ما على أحدكم إذا تصدق بصدقة تطوعا أن يجعلها عن أبويه فيكون لهما أجرها ولا ينتقص من أجره شيئا.
অর্থ, তোমাদের কেউ যখন নফল সদকা করে তার সওয়াব পিতা-মাতাকে হাদিয়া দিলে কী অসুবিধা? এর ফলে তারা এর সওয়াব পেয়ে যাবে। আর আমলকারীর সওয়াব বিন্দুমাত্র কমবে না।-মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৪৮৩১
শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. ফাজায়েলে সাদকাত কিতাবে রাওজ নামক কিতাব থেকে একজন নেককার মহিলার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উক্ত মহিলা অনেক ইবাদতগুজার ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নিয়মিত প্রতি জুমার দিন মায়ের কবরে যেত। কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করে ঈসালে সওয়াব করত। মায়ের জন্য ও সমস্ত কবরবাসীর জন্য দুআ করত। একদিন ছেলে মাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করল, আম্মা আপনার কী অবস্থা?
মা উত্তর দিলেন, মওতের কষ্ট অনেক কঠিন। কিন্তু আমি আল্লাহর রহমতে কবরে অনেক আরামে আছি।
ছেলে বলল, আমার করণীয় কোনো খেদমত থাকলে বলুন।
মা বললেন, তুমি প্রতি জুমআর দিন আমার নিকট এসে পড়া চালু রাখবে। এটা কখনো ছাড়বে না। কেননা, তুমি যখন আসো তখন সমস্ত কবরবাসী আনন্দিত হয়ে সুসংবাদ শুনানোর জন্য আমার কাছে এসে বলে, তোমার ছেলে এসে গেছে। তোমার আগমনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হই। তারাও আনন্দিত হয়।
ছেলে বর্ণনা করে, আমি পূর্বের মতো প্রত্যেক জুমুআর দিন গুরুত্ব সহকারে কবরস্থানে হাজির হতাম। একদিন স্বপ্নে দেখি, নারী-পুরুষের বিরাট দল আমার কাছে উপস্থিত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কারা? কেন এসেছ?
তারা বলল, আমরা অমুক কবরস্থানের লোক, তোমার শুকরিয়া আদায় করতে এসেছি। তুমি যে প্রতি জুমুআর দিন আমাদের কাছে আসো এবং আমাদের জন্য মাগফেরাতের দুআ করো, এতে আমরা খুবই আনন্দিত হই। তুমি এটা চালু রাখবে। এরপর থেকে আমি আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে এই কাজ করতে থাকি।-ফাজায়েলে সাদকাত : ১/১৬২ (বাংলা সংস্করণ)
মৃত ব্যক্তির উপকারের জন্য আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে যে সুযোগ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সহজ। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা প্রতিদিন বরং প্রতি মুহূর্তে আমাদের মৃত আত্মীয়স্বজনের উপকার করতে পারি। কিন্তু আমাদের অবস্থা হলো, কেউ তো এ ব্যাপারে একেবারে গাফেল। কেউ কিছু করলেও সঠিক পদ্ধতিতে করে না। যার কারণে মৃত ব্যক্তির উপকার তো হয় না; উল্টো নিজের গোনাহ হয়। তাই এর সহজ সঠিক পদ্ধতি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও ঈসালে সওয়াব কবর যিয়ারত করেও করা যায়, দূরে থেকেও করা যায়। তাই দুটি শিরোনামে উল্লেখ করছি।
ঈসালে সওয়াব
ঈসালে সওয়াব অর্থ হলো, সওয়াব পৌঁছানো। উদ্দেশ্য হলো, জীবিত ব্যক্তি কোনো নেক আমল করে মৃত ব্যক্তিকে এ আমলের সওয়াব হাদিয়া দেওয়া।
প্রত্যেক মুসলমান ঈসালে সওয়াব করতে পারে। পরিচিত অপরিচিত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ঈসালে সওয়াব করা যায়।
নিজের আমলের সওয়াব অন্যকে হাদিয়া দেওয়ার দ্বারা নিজের সওয়াবে কমতি হয় না।-মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৪৮৩১, ফাতাওয়া শামী : ২/২৪৩; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ৫/২৯৭; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৪৪
নামায, রোযা. কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত, যিকির, দান, সদকা, হজ্জ, উমরা ও জনকল্যাণমূলক কাজ ইত্যাদি যে-কোনো নেক আমল করে ঈসালে সওয়াব করা যায়।-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪৩; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৫৫
ঈসালে সওয়াবের পদ্ধতি হলো, আমলের শুরুতেই ঈসালে সওয়াবের নিয়ত করে নেবে। অথবা আমলের পর বলবে, হে আল্লাহ, এই নেক কাজটি কবুল করে নিন এবং এর সওয়াব অমুককে পৌঁছে দিন। আমলকারী নিজেই এ পদ্ধতিতে ঈসালে সওয়াব করতে পারে। অন্যকে দিয়ে বলানোর প্রয়োজন নেই।-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪২-২৪৩; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৪৬
টাকা বা খাবারের বিনিময়ে কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করলে কোনো সওয়াব হয় না। তাই এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির কোনো উপকার হয় না। বরং বিনিময় নিয়ে যারা ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করে এবং যারা এর আয়োজন করে, সবারই গোনাহ হয়।-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪০; কিফায়াতুল মুফতী : ৪/১৩৮; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৫৩; ফাতাওয়া কাসেমিয়া : ১০/২২১-২২৩
ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে খাবারের আয়োজন করলে গরিব-মিসকিনদের খাওয়াবে। ধনীদের জন্য ঈসালে সওয়াবের খাবার খাওয়া মাকরূহ। ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ধনীদের জন্য খাবারের আয়োজন করাও মাকরূহ।-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪০; ফাতাওয়া রশিদিয়া : ২৭৮; কিফায়াতুল মুফতী : ৪/১৩০
ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে গরিব-মিসকিনকে খাবার দিলে মৃত ব্যক্তি সওয়াব পেয়ে যাবে। যারা খাবার গ্রহণ করবে তারা দুআ করার প্রয়োজন নেই। দুআ করিয়ে বিনিময় হিসেবে খাবার খাওয়ানো জায়েয নেই।-ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১৫/১২৭; কিফায়াতুল মুফতী : ৪/১২৯-১৩০; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৮৬; সমকালীন জরুরী মাসায়েল : ১/১১৩
তিন দিন, চল্লিশ দিন ও মৃত্যুবার্ষিকীর প্রথা পালন করা জায়েয নেই। নাজায়েয প্রথা পালন করলে গোনাহ হবে।-ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৫২; কিফায়াতুল মুফতী : ৪/১৩২; ফাতাওয়া কাসেমিয়া : ১০/২৪০
বিশেষ কোনো দিনকে কেন্দ্র না করে যখন যতটুকু সম্ভব নেক আমল করে মৃত আত্মীয়-স্বজনের জন্য নিয়মিত ঈসালে সওয়াব করবে। এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির কবরের আযাব মাফ হবে, জান্নাতের নেয়ামত লাভ হবে। ঈসালে সওয়াবকারী নিজেরও সওয়াব হবে।-কিফায়াতুল মুফতী : ৪/১৩২, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৪৫
কবর যিয়ারত
পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত করা মুস্তাহাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা কবর যিয়ারত করো। এর দ্বারা মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়।-সহীহ মুসলিম : ২২৫৯; ফাতাওয়া শামী : ২/২৪২
যুবতি নারীদের জন্য কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করা মাকরূহ। বৃদ্ধাদের জন্য কিছু শর্তসাপেক্ষে কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করা জায়েয আছে বটে; তবে না যাওয়াই উত্তম। শর্তসমূহ হলো :
১. পর্দা রক্ষা করা।
২. সাজসজ্জা ও সুগন্ধি ব্যবহার না করা।
৩. মাহরাম সঙ্গে থাকা।
৪. কবরের কাছে বিলাপ ও কান্নাকাটি না করা।
-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪২; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ১/৭৫৩; কিফায়াতুল মুফতী : ৪/১৯৪; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১৩/৩২৬, ২২২; ফাতাওয়া কাসেমিয়া : ১০/১৮২-১৮৩
যেকোনো দিন যেকোনো সময় কবর যিয়ারত করা যায়। তবে উত্তম হলো জুমআর দিন। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার, শনিবার ও সোমবারও উত্তম। বছরের বরকতময় দিনসমূহ যেমন, যিলহজের প্রথম দশ দিন, দুই ঈদের দিন ও আশুরার দিনও উত্তম।-ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৪০৫; ফাতাওয়া শামী : ২/২৪২
কবরস্থানে প্রবেশ করে কবরবাসীর উদ্দেশ্যে নি¤েœাক্ত শব্দে সালাম দেবে,
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ لَلاَحِقُونَ أَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ.
-সহীহ মুসলিম : ২২৫৭
অথবা বলবে
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ القُبُوْرِ يَغْفِرُ اللهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ.
-সুনানে তিরমিযী : ১০৭৫
অথবা হাদীসে বর্ণিত অন্য কোনো শব্দে সালাম করবে।
বিশেষভাবে কারও কবর যিয়ারত করা উদ্দেশ্য হলে উত্তম হলো, মাইয়েতের পায়ের দিক থেকে মাথার দিকে অগ্রসর হবে। কবরের দিকে ফিরে, কেবলার দিকে পিঠ দিয়ে মাইয়েতের চেহারা বরাবর দাড়াঁবে।-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪২; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৩/৩৩৪; আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২২২
ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে যতটুকু সম্ভব কোরআন মাজীদ পড়বে। উত্তম হলো, সূরা ফাতেহা, সূরা বাকারার প্রথম পাঁচ আয়াত, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ইয়াসীন, সূরা মুলক, সূরা যিলযাল, সূরা তাকাছুর, সূর কাফিরূন ও সূরা ইখলাস বারো বার অথবা দশ বার কিংবা সাত বার পাঠ করা।-ফাতাওয়া শামী : ২/২৪২; আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২২২
তেলাওয়াত শেষে দুরূদ শরীফ পড়বে অতঃপর বলবে, হে আল্লাহ, যা কিছু পড়লাম মেহেরবানী করে তা কবুল করে নিন এবং এর সওয়াব এই কবরবাসীকে পৌঁছে দিন।
হাত উঠিয়ে দুআ করতে চাইলে কেবলামুখী হয়ে দুআ করবে। কবরকে সামনে রেখে দুআ করবে না।-ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৪০৪; ফাতাওয়া কাসেমিয়া : ১০/ ১৭৬