একজন মুসলিম নারীর জীবন
ড. মুহাম্মদ আলী আল—হাশেমী
আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক
মুসলিম নারীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি এই গভীর বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যে, পৃথিবীতে যা ঘটে এবং মানুষের যা হয় সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। তা পূর্বনির্ধারিত বিষয়। মানুষের উপর যে বিপদ আসার তা তো আসবেই। যে বিপদ আসার নয় তা কখনো আসবে না। এই জীবনে মানুষের করণীয় কেবল ভালো পথে চলা। তার দ্বীন ও দুনিয়ার বিষয়ে নেক কাজের যত মাধ্যম আছে তা অবলম্বন করা। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর যথাযথ ভরসা করবে। সব বিষয় আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেবে। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে সে সর্বদা আল্লাহর সাহায্য, সমর্থন, সংশোধন ও সন্তুষ্টির ভিখারি।
হাজেরা আ.—এর গল্প মুসলিম নারীর সামনে আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও যথার্থ ভরসার অনুপম দৃষ্টান্ত। যখন ইবরাহীম আ. তাঁকে মক্কায় যমযমের উপর এক টিলার পাশে রেখে যান তখন মক্কায় কেউ ছিল না, পানিও ছিল না। হাজেরার সঙ্গে শুধু তাঁর দুধের শিশু ইসমাঈল আ. ছিল। হাজেরা তখন ইবরাহীম আ.—কে দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে, শান্ত ও স্থিরচিত্তে বললেন, আল্লাহই কি এ ব্যাপারে আপনাকে আদেশ দিয়েছেন?
ইবরাহীম আ. বললেন, হ্যাঁ।
হাজেরা আ.—এর উত্তর ছিল সন্তুষ্টি, তৃপ্তি, আনন্দ ও নিরাপত্তাবোধে পূর্ণ। বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।—সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া। দেখুন, ফাতহুল বারী : ৬/৩৯৬ দারুল মারিফা সংস্করণ।
মুহূর্তটি ছিল খুবই কঠিন। একজন তাঁর স্ত্রী ও দুধের শিশুকে বিজন মরুভূমিতে রেখে যাচ্ছে। যেখানে উদ্ভিদ নেই, পানি নেই, মানুষ নেই। সে সুদূর শাম দেশে চলে যাচ্ছে। তাঁদের জন্য রেখে যাচ্ছে কেবল একটি খেজুরের থলে আর একটি পানির পাত্র।
হাজেরার মন গভীর বিশ্বাসে পূর্ণ না হলে, আল্লাহর প্রতি আন্তরিক ভরসা না থাকলে, যে বিশ^াস ও ভরসা তাঁর অনুভব—অনুভূতিতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, এই ভয়াবহ অবস্থায় ধৈর্য ধরতে পারতেন না। তিনি শুরুতেই ভেঙে পড়তেন। তিনি চিরস্মরণীয় নারী হয়ে থাকতেন না। যাকে হজ ও উমরাকারীগণ রাত—দিন স্মরণ করেন, যখনই তাঁরা পবিত্র যমযমের পানি পান করেন, যখনই তাঁর ওই কঠিন দিনের মতো সাফা—মারওয়া সাঈ করেন।
এই সচেতন ঈমান মুসলিম নর—নারীর জীবনে আশ্চর্য ফল দিয়েছে। কারণ, এই ঘটনা বোধকে জাগ্রত করেছে, অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে এবং অন্তরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্য ও গোপন সবই দেখেন। মানুষ যেখানেই থাকুক আল্লাহ তাঁর সঙ্গে আছেন। জাগ্রত হৃদয়, প্রকাশ্য ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করার বড় উপমা সেই মেয়ের গল্পের চেয়ে আর কোনটি হতে পারে যার কথা, সিফাতুস সাফওয়া, ওয়াফায়াতুল আ’য়ান কিতাবে এসেছে। ইবনুল জাওযী তাঁর কিতাব আহকামুন নিসায় (পৃষ্ঠা : ৪৪১, ৪৪২) বর্ণনা করেছেন :
আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম তাঁর বাবা ও দাদার পরম্পরায় বর্ণনা করেন, আমি ওমর রাযি.—এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি মদীনায় রাতে টহল দিচ্ছিলেন। যখন ক্লান্ত হয়ে রাতের অন্ধকারে একটি দেওয়ালে হেলান দিলেন। তখন এক নারী তার মেয়েকে বলছিল, উঠো। দুধে পানি মেশাও।
মেয়ে বলল, মা, আপনি কি আমীরুল মুমিনীনের আজকের নির্দেশ জানেন না?
মা বলল, কী ছিল তাঁর নির্দেশ?
মেয়ে বলল, তিনি ঘোষণা দিতে বলেছেন, কেউ যেন দুধে পানি না মেশায়।
মা বলল, উঠো, দুধে পানি মেশাও। কারণ, তুমি এমন জায়গায় আছ যেখানে তোমাকে ওমর দেখেন না।
মেয়েটি মাকে বলল, আমি এমন নই যে মানুষের সামনে তাঁর আনুগত্য করব আর নির্জনে অবাধ্যতা করব।
ওমর রাযি. তা শুনছিলেন। তিনি বললেন, হে আসলাম, ওখানে যাও। দেখো কারা কথা বলছে। তাদের গৃহকর্তা আছে কি না?
আসলাম বলেন, আমি সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, মেয়েটি অবিবাহিত। ওই মহিলাটি তার মা। তাদের ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। ওমর রাযি.—কে এসে বিষয়টি জানালাম। তিনি তাঁর ছেলেদের ডেকে বললেন, তোমাদের মধ্যে কার বিয়ের প্রয়োজন আছে, যাকে আমি বিয়ে করাব? তোমাদের বাবার স্ত্রীর প্রয়োজন থাকলে তার আগে এ নারীকে তোমাদের কেউই বিয়ে করতে পারতে না।
আব্দুল্লাহ রাযি. বললেন, আমার স্ত্রী আছে।
আব্দুর রহমান বললেন, আমারও স্ত্রী আছে।
আসেম বললেন, আমার স্ত্রী নেই। আমাকে বিয়ে করিয়ে দেন।
মেয়েটির কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। আসেমের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান হলো। এই কন্যা সন্তানটিই পরবর্তী সময়ে ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ.—কে জন্ম দিয়েছিলেন। এটা সেই জাগ্রত বোধ, যেটা ইসলাম এই মুসলিম নারীর অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই সে প্রকাশ্য ও গোপনে, জনসম্মুখে ও নির্জনে সৎ ও খোদাভীরু। এমনটা হয়েছে তাঁর এই বিশ্বাসের কারণে যে, আল্লাহ তাআলা সব সময় তাঁর সঙ্গে আছেন, তাঁকে দেখছেন ও শুনছেন। এটাই প্রকৃত বিশ্বাস। এটাই সেই মূল্যবান ফলাফল, যা তাঁকে ‘ইহসানে’র মর্যাদায় উন্নীত করেছে। তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নগদ প্রতিদানটি ছিল, আল্লাহ তাঁকে এই শুভবিবাহের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। তারপর তাঁর বংশ থেকেই হয়েছেন পঞ্চম খলীফা ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ.।
সচেতন মুসলিম নারীর বিশ্বাস নির্মল ও পরিচ্ছন্ন। যাতে মূর্খতার কোনো লেশমাত্র থাকে না। যার নির্মলতা কুসংস্কারের অঁাধারে ময়লা হয় না। দুশ্চিন্তার অপচ্ছায়া তার উজ্জ্বলতা মলিন করতে পারে না। এই দৃঢ় বিশ্বাস এক অদ্বিতীয় আল্লাহর উপর যিনি সুউচ্চ ও অমুখাপেক্ষী। যিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, যার হাতেই রয়েছে সবকিছুর লাগাম এবং তাঁর কাছেই সবকিছু একসময় ফিরে যাবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ مَنْۢ بِیَدِهٖ مَلَكُوْتُ كُلِّ شَیْءٍ وَّ هُوَ یُجِیْرُ وَ لَا یُجَارُ عَلَیْهِ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ﴿۸۸﴾ سَیَقُوْلُوْنَ لِلهِ ؕ قُلْ فَاَنّٰی تُسْحَرُوْنَ ﴿۸۹﴾
অর্থ : হে নবী বলুন, তোমাদের জানা থাকলে বলো, কার হাতে সবকিছুর কতৃর্ত্ব, যিনি রক্ষা করেন এবং যার কবল থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না? এখন তারা বলবে, আল্লাহর। বলুন, তাহলে কোথা থেকে তোমাদেরকে জাদু করা হচ্ছে?—সূরা মুমিনূন, (২৩) : ৮৮, ৮৯
এই গভীর ও স্বচ্ছ ঈমান মুসলিম নারীর ব্যক্তিত্বে শক্তি, চেতনা ও পরিপক্বতা বৃদ্ধি করে। তখন সে জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করে যে, এ জীবন বিপদ ও পরীক্ষার জায়গা। যার ফলাফল দেওয়া হবে এমন এক দিনে যেদিন সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلِ اللهُ یُحْیِیْكُمْ ثُمَّ یُمِیْتُكُمْ ثُمَّ یَجْمَعُكُمْ اِلٰی یَوْمِ الْقِیٰمَۃِ لَا رَیْبَ فِیْهٖ وَ لٰکِنَّ اَکْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ ﴿۲۶﴾
অর্থ : আপনি বলুন, আল্লাহই তোমাদেরকে জীবন দান করেন, তারপর মৃত্যু দেন, তারপর তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না।—সূরা জাসিয়া, (৪৫) : ২৬
اَفَحَسِبْتُمْ اَنَّمَا خَلَقْنٰكُمْ عَبَثًا وَّ اَنَّكُمْ اِلَیْنَا لَا تُرْجَعُوْنَ ﴿۱۱۵﴾
অর্থ : তোমরা কি ধারণা করো, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? —সূরা মুমিনূন, ২৩ : ১১৫
تَبٰرَکَ الَّذِیْ بِیَدِهِ الْمُلْكُ ۫ وَ هُوَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرُۨ ۙ﴿۱﴾ الَّذِیْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَ الْحَیٰوۃَ لِیَبْلُوَكُمْ اَیُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا ؕ وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْغَفُوْرُ ۙ﴿۲﴾
অর্থ : পুণ্যময় তিনি, যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে কর্মের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাময়।—সূরা মুলক, ৬৭ : ১, ২
যেদিন মানুষকে তার কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে সেদিন ভালো হলে তো ভালোই। খারাপ হলে তো খারাপ প্রতিদানই দেওয়া হবে। কোনোরূপ অবিচার করা হবে না। খুব শিগ্গিরই দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যথার্থ হিসাব হবে। সে হিসাব কারও জন্য অনুকূল হবে, কারও জন্য প্রতিকূল হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَلْیَوْمَ تُجْزٰی كُلُّ نَفْسٍۭ بِمَا کَسَبَتْ ؕ لَا ظُلْمَ الْیَوْمَ ؕ اِنَّ اللهَ سَرِیْعُ الْحِسَابِ ﴿۱۷﴾
অর্থ : আজ প্রত্যেকেই তার কৃতকর্মের প্রতিদান পাবে। আজ কোনো ধরনের অবিচার নেই। নিশ্চয় আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।—সূরা মুমিন, ৪০ : ১৭
সেদিন মহান রবের কাছে সরষে পরিমাণ দানাও গোপন থাকবে না। কোনো সন্দেহ নেই সুবোধ, বুদ্ধিমতী মুসলিম নারী যখন এসব আয়াতের অর্থ নিয়ে ভাববে, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সে কঠিন দিনের কথা চিন্তা করবে তখন সে প্রভুর অভিমুখী হবে অনুগত, কৃতজ্ঞ ও তওবাকারী হয়ে। দুনিয়াতেই যথাসম্ভব নেক আমল করে আখেরাতের প্রস্তুতি নেবে।
—শাখসিয়াতুল মারআতিল মুসলিমা থেকে অনুবাদ, মায়মুনা