প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

একটি স্বাধীন দেশে ওলামায়ে কেরামের গুরুদায়িত্ব ও প্রত্যাশিত গুণাবলী

একটি স্বাধীন দেশে ওলামায়ে কেরামের গুরুদায়িত্ব ও প্রত্যাশিত গুণাবলী

সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.

অনুবাদ : মাওলানা হেদায়াতুল হক


[আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া আল্লামা বিন্নূরী টাউন করাচির জামে মসজিদে এই বক্তব্য পেশ করেন। মজলিসে মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক, শহরের ফারেগীন ওলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। বক্তৃতায় হযরত নদভী রহ. ওলামায়ে কেরামকে তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে জোরালোভাবে সতর্ক করেন। তাঁদের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলি চিহ্নিত করেন।]

الحمد لله رب العالمين، والصلاة و السلام على سيد الأنبياء و المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين، ومن تبعهم بإحسان ودعا بدعوتهم إلى يوم الدين. أما بعد :

হামদ ও সালাতের পর।

আমার সম্মানিত মুরুব্বী, প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ, এ মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমি নিজ ঘরে আছি। বিশেষভাবে মুফতী ওয়ালী হাসান টুংকি দা. বা.[1] যেভাবে আমার বংশ—পরিচয় তুলে ধরেছেন তাতে আরও কাছের, আরও আপন মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামার ছাত্র, উস্তাদ ও সহকর্মীদের সঙ্গে বসে আছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে আমার প্রিয়জন ও ভাইদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে বা ব্যস্ততার কথা চিন্তা করে তিনি আমাকে দাওয়াত না দেওয়ার কথাও ভাবতে পারতেন। কিন্তু অনেক ভালো হয়েছে যে, তিনি আমাকে এমন সুবর্ণ সুযোগ দান করেছেন। আমি কোনোরূপ আপত্তি বা বিনয় প্রকাশ ছাড়াই আপনাদের সামনে কিছু বাস্তবতা তুলে ধরব। আমি চার দিন ধরে করাচি শহরে অবস্থান করেছি। গভীরভাবে এই শহরকে পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে এই বিষয়গুলো আমি বুঝেছি।

রাজনৈতিক পরিভাষা ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা আপন স্থানে থাকুক। বাস্তবতা হলো, হিন্দুস্তানি ওলামায়ে কেরামের দুটি শাখা। এক ভাগের জন্য আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত ছিল, তাঁরা হিন্দুস্তানে থাকবেন। তাঁরা সেখানে ইসলামের দাওয়াতের কাজ আঞ্জাম দেবেন। হিন্দুস্তানি মুসলমানদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। আরেক ভাগের জন্য আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত ছিল, তাঁরা এই ভূখণ্ডে থাকবেন। যেখানে পূর্ব থেকেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল (অথবা এই পথেই মুসলমানরা ভারতবর্ষে আগমন করেছিল)। এই ভূখণ্ডে থাকা আলেমগণ মুসলিম জাতির শিক্ষা—দীক্ষার গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দেবেন। মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের নমুনা পেশ করতে সচেষ্ট হবেন। জাতিকে সঠিক দিক—নির্দেশনা প্রদান করবেন।

প্রিয় বন্ধুগণ, পৃথিবীতে যত সুস্থ ও সঠিক বিপ্লব এবং দৃঢ়চেতা সংগ্রাম হয়েছে তাতে নবীগণের উত্তরসূরি ও উম্মতের সাধারণ জনগণের মুখনিঃসৃত অনেক কথা তার ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। তবে এই সংগ্রামী সাধকদের বিজয়েতিহাস প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র কোনো বই রচিত হলে, একটি বাক্য হবে অন্যতম, বিশেষ মর্যাদাবান। সে বাক্যটি লেখা হবে স্বর্ণাক্ষরে। একটি বাক্য এমনভাবে কালের গতি পাল্টে দিয়েছে, যার উপমা কোনো ধর্ম ও জাতির ইতিহাসে খেঁাজে পাওয়া দুষ্কর।

আরব উপদ্বীপের একাংশে, কিছু গোত্রে ধর্মত্যাগের ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সময়টি ছিল খুবই নাজুক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে কেবল বিদায় নিয়েছেন। এমন দুঃসময়ে ইসলামের কলিজায় একটি ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছিল। সেটি ছিল অত্যন্ত নাজুক এক পরিস্থিতি। মাত্র ক’মাস আগে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যে আরব জাতি সমগ্র পৃথিবীতে ইসলাম পেঁৗছে দেওয়ার কথা ছিল, বিশ্বময় ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছে দেওয়ার জন্য প্রেরিত আরবরাই ইসলামত্যাগের শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ল। ইসলামের ইতিহাসে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মৃত্যুর পর থেকে তখন পর্যন্ত) এমন নাজুক পরিস্থিতি আর আসেনি। তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.—এর মুখ থেকে সেই ঐতিহাসিক বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল। একটি বাক্য ইতিহাসের পট পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এই বাক্যটি ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। শঙ্কার মেঘ তখন এমনভাবে কেটে গিয়েছিল যেভাবে সূর্যোদয়ের ফলে অন্ধকার কেটে যায়। ইতিহাস তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীটি আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছে। তিনি বলেছিলেন,

أينقص الدين وأنا حي؟

আমি জীবিত থাকতে দ্বীনের মধ্যে কাটছাঁট হবে?

আবু বকর জীবিত থাকবে আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দ্বীনে কাটছাঁট হবে? আবু বকরের জীবদ্দশায় দ্বীনের মধ্যে কোনো বিয়োজন হবে? ইচ্ছেমতো দ্বীনের কোনো রোকন গ্রহণ করবে, কোনোটি বর্জন করবে?

সে ইতিহাস আপনারা জানেন। তখন যাকাত অস্বীকারের ফিতনা দেখা দিয়েছিল। মুসাইলামাতুল কাযযাব মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি করেছিল। চারদিকে ধর্মত্যাগের ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছিল। মদীনা মুনাওয়ারাহ, জুওয়াসা ইত্যাদি কয়েকটি এলাকার নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। সেখানে ধর্মত্যাগের ফিতনা ছড়ায়নি। অন্যথায় পুরো আরব উপদ্বীপ ধর্মত্যাগের ফিতনায় সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তখন আল্লাহ তাআলার এক বান্দা এই কথাটি বলেছিলেন। ছোট্ট একটি কথা। কিন্তু এই শব্দ ও বাক্যে যে দরদ ও জোশ ছিল তা লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটি ছিল তাঁর হৃদয়ের আওয়াজ। তাঁর জযবার চূড়ান্ত রূপ। পানপাত্র পূর্ণ হয়ে গেলে যেমন উপচে পড়ে, ফেঁাটা ফেঁাটা মাটিতে টপকে পড়ে, তেমনই তাঁর জযবা এই বাক্যের রূপে প্রকাশ পেয়েছিল।

প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা, এই সে—ই মিরাস, যা এই উম্মত, বিশেষত রাসূলের ওয়ারিশ হক্কানী ওলামায়ে কেরাম উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছেন। তাঁদেরকে বুঝতে হবে, আমরা থাকতে কোনো দেশে ইসলামের বিলুপ্তি মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, চিন্তাও করা যায় না। আমরা কোনো দেশে থাকব আর সেখান থেকে ইসলাম মিটে যাবে—তা অসম্ভব। সকল ইসলামী বিপ্লব ও দ্বীনি সংগ্রামের ইতিহাসের ভিত্তি হলো এই অনুভূতি।

দাওয়াত ও সংগ্রামের ইতিহাস আপনারা পড়েন। কোরআন মাখলুক হওয়া—সংক্রান্ত আকীদার ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.—এর দৃঢ় অবস্থান জেনেছেন। আপনারা পড়েছেন, মুতাযিলা ফিতনার বিরুদ্ধে ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ. কেমন কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বাতেনীদের ফিতনা ও বস্তুবাদের ফিতনার মোকাবিলায় এবং ইসলামী সমাজের বিভিন্ন স্তরে দ্বীনি সংস্কার সাধনে ইমাম গাযালী রহ.—এর অবদান আপনারা অধ্যয়ন করেছেন। শিয়া রাফেযীদের প্রতিরোধ ও ইলমে কালামের কিছু মাসায়েল পরিমার্জনে শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ.—এর ভূমিকাও আপনারা জেনেছেন। ভারতবর্ষের সে সংস্কারমূলক কীর্তি, যা দীর্ঘ প্রায় চারশ বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং এখনো তা প্রাণবন্ত আছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. যে সমাজ সংশোধন ও সংস্কারধর্মী দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ. ও দেওবন্দের আকাবির ওলামায়ে কেরাম স্ব স্ব যুগে নিজস্ব ধারায় উম্মাহর সংশোধন ও দীক্ষা প্রদানে এবং কোরআন—সুন্নাহ ও বিশুদ্ধ আকীদা প্রচারে যে অমর কীর্তি রেখেছেন—তা সকলের জানা আছে। এই সকল প্রচেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রামের পেছনে সেই অনুভূতি ও চেতনাই কার্যকর ছিল, যা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.—এর নিজ ভাষায় উচ্চারিত হয়েছিল। তিনি মূলত সকল যুগের নায়েবে রাসূলগণকে পথ দেখিয়েছেন। কোরআন মাজীদে আছে,

وَ جَعَلَهَا کَلِمَۃًۢ  بَاقِیَۃً  فِیْ عَقِبِهٖ  لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ

এই কথাটি তিনি অক্ষয় বাণীরূপে তার উত্তরসূরিদের মধ্যে রেখে গেছেন, যেন তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।—সূরা যুখরুফ (৪৩) : ২৮

 

ওলামায়ে কেরাম যেন নিজেদেরকে নিরীক্ষণ করেন

ওলামায়ে কেরাম যেন এই আলোকে নিজেদেরকে নিরীক্ষণ করেন। তাঁরা যেন পরখ করে দেখেন, নিজেদের কর্মকাণ্ডের নীতি ও মূলনীতি হিসেবে এই বাক্যটিকে তাঁরা কতটুকু গ্রহণ করেছেন? তাঁরা যেন পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, তাঁদের উপস্থিতি সত্ত্বেও স্বদেশ থেকে ইসলাম বা ইসলামী জীবনাচার বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কি না? মুসলমানদের অতীত ইতিহাসে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় উপাদান রয়েছে। যেসব দেশে ইসলাম বিলুপ্ত হয়েছে বা ইসলামবিরোধী শক্তি বিজয়ী হয়েছে, অনুসন্ধান করলে আপনি সেখানে এমন অনেক কিছু পাবেন, যা থেকে এ যুগের জন্য শিক্ষা নেওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি বিষয় হলো, ওলামায়ে কেরামের মাত্রাতিরিক্ত মতবিরোধ। দ্বিতীয় বিষয় ছিল, জনগণ থেকে ওলামায়ে কেরামের দূরত্ব। সাধারণ মানুষের মনে দ্বীনের মর্যাদা ও ওলামায়ে কেরামের অবস্থান ধরে রাখার মতো প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্যে ছিল না। যে দেশে একদিন খাজা বাহাউদ্দীন নকশেবন্দী রহ. জন্ম নিয়েছিলেন, যে দেশ এক সময় উবাইদুল্লাহ আহরার রহ.—এর মতো ব্যক্তি জন্ম দিয়েছিল, সে দেশ একসময় শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বশূন্য হয়ে গেল। জীবনমান সেখানে অনেক উঁচুতে চলে গেল এবং বস্তুবাদ সেখানে তুঙ্গে পেঁৗছে গেল।

বুখারা শাসকের মহল আজও অবশিষ্ট আছে। কমিউনিস্ট সরকার বিশ্ববাসীকে বলছে, দেখো, কীভাবে প্রাসাদে সম্পদ জমা করা হয়েছিল, কেমন ছিল তাদের স্বর্ণ—রুপার থালা—বাসন? তারা বলছে, জনগণ ক্ষুধায় মরত, অথচ বুখারার শাসকের মহলে এমন মূল্যবান সামগ্রী ছিল। আপনি স্পেনের ইতিহাস দেখুন। মদীনাতুয যাহরা ও আল হামরা প্রাসাদের বিবরণ পড়–ন। স্বপ্ন, কল্পকথা ও জিন—পরির গল্প মনে হবে। সেখানে বড় দুটি বিষয় ইসলাম বিলুপ্তির কারণ হয়েছে :

এক. জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল হওয়া। আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদের অন্যায় ব্যবহার।

দুই. ইসলাম প্রচার ও ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের পরিবর্তে তারা চারুকলা, কাব্যচর্চা, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদির প্রতি পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে রেখেছিল।

তৃতীয় আরেকটি বিষয় ছিল, শাসক পরিবারে শাসনক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন বহুদলীয় রাজনীতি ছিল না। বর্তমানে রাজনৈতিক দলাদলি তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। স্পেন পতনের এই তিনটি মৌলিক কারণ ছিল (তার সঙ্গে চারিত্রিক অবক্ষয় যোগ করুন)। সুবহে সমরকন্দ বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন, তাদের মধ্যে চারিত্রিক অবক্ষয় ও নৈতিক অধঃপতন ছড়িয়ে পড়েছিল।

 

কয়েকটি আশঙ্কা

আমি কয়েকটি আশঙ্কা চিহ্নিত করছি। অনেক সময় বহিরাগত ব্যক্তি ওই বিষয়গুলো দেখে ও অনুভব করে, যা ঘরের মানুষ অনুভব করে না। আপনি আলোতে আছেন। এমন সময় অন্ধকার থেকে কেউ এলে তার অবস্থা আপনার মতো হবে না। অনেক সময় কোনো জিনিস প্রতিনিয়ত দেখার কারণে এবং শোনার কারণে তা এতটা স্বাভাবিক হয়ে যায় যে, তাতে কোনো নতুনত্ব বা সমস্যা অনুভব হয় না। তার প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভূত হয় না। তবে বহিরাগত ব্যক্তি মুহূর্তেই তা টের পেয়ে যাবে। যেমন, এখানে ব্যাপকভাবে উর্দু ভাষায় সাইনবোর্ড লাগানো আছে। আপনারা হয়তো বিষয়টি একেবারেই অনুভব করেন না। আমরা হিন্দুস্তানিরা সব সময় ইংরেজি বা হিন্দি সাইনবোর্ড দেখে অভ্যস্ত। আমরা উদুর্ সাইনবোর্ড দেখে আনন্দ অনুভব করি। আমরা বলি, মাশাআল্লাহ, এখানে তো সব দিকে শুধু উর্দুই দেখা যায়। এমনইভাবে কেউ কেউ দেয়ালে নেমপ্লেট লাগায়। তাতে লেখা বিষয়গুলো যে প্রথমে দেখে সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে। বারবার দেখার পর পড়া ছেড়ে দেয়।

আমি নিজের ব্যাপারে কোনো দূরদৃষ্টি বা অন্তর্দৃষ্টির দাবি করছি না।

আল্লামা ইকবাল রহ. বলেছেন,

میں نہ عارف نہ مجدد نہ محدث نہ فقیہ

مجھ کو معلوم نہیں کیا ہے نبوت کا مقام

ہاں مگر عالم اسلام پر نظر رکھتا ہوں نظر

فاش ہے مجھ پہ ضمیر فلک نیلی فام

আরেফ, মুজাদ্দেদ, মুহাদ্দিস বা ফকীহ আমি নই / নবুওয়াতের মাকামও আমি জানি না।

হঁ্যা, তবে আমি মুসলিম বিশ্বের দিকে নজর রাখি / নীল আকাশ ও নক্ষত্রের সুপ্ত ভেদ আমার জানা।

তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমি বাইরে থেকে এসেছি। তাই আমার কথা মনোযোগের দাবি রাখে। আমি ইতিহাস অধ্যয়ন করেছি। মুসলিম বিশ্বকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। এর ওপর ভিত্তি করে আমি বলছি, আকীদাগত দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরিণাম এ দেশের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। ধর্মীয় দলগুলো এখানে পরস্পরবিরোধী ও মারমুখী। কিছু বিষয় তাত্ত্বিকভাবে আলোচনা করা যেত, সেগুলো সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এসব কারণে বিবাদমান দল সৃষ্টি হয়েছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত ভয়ংকর বিষয়। আমিও সেই দলেরই লোক যে দলের সঙ্গে আপনারা সম্পৃক্ত। হুবহু আপনাদের মতোই আমার অনুভূতি। শুধু মনমানসিকতার দিক থেকেই নয়, সব দিক থেকে আমরা এক ও অভিন্ন। আমাদের বড়রা এমন পতাকা উত্তোলন করেছেন, যার কারণে আমাদেরকে নতুন নতুন উপাধি দেওয়া হয়েছে। আমরা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলে এই প্রাসাদ কীসের ওপর দাঁড়াবে?

আজ একদল এ কথা প্রমাণে ব্যস্ত, পাকিস্তান আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। অন্য গ্রুপ এ কথা প্রমাণে ব্যস্ত, আমরাই হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা আমাদের হাতেই থাকা চাই। যদি যাচাই করা হয় (ক্ষমা করবেন, আমি কারও প্রতি কোনো হুকুম আরোপ করছি না) তাহলে এই দাবির পেছনে ক্ষমতার লিপ্সা পাওয়া যাবে। দ্বীন রক্ষার জন্য আমাদের বড়রা এ দেশে বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। প্রয়োজনে নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। নিজের মত থেকে সরে এসেছেন। নতি স্বীকার করে নিচে নেমে গেছেন। স্পষ্টভাবে বলেছেন, ভাই, আপনিই ওপরে বসুন। তবুও দ্বীন নিরাপদ থাকুক। আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন, হিন্দুস্তানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.—এর মতাদর্শীদের নীতি এমনই ছিল। দরস প্রদানকালে, ইলমী মজলিসে আপনি মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করুন। এসব বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করুন। তবে দেশকে বাজি ধরবেন না। যখন এমন কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং এমন কোনো আহ্বান করা হয়, যে আহ্বানে আছে বড়ত্ব প্রকাশ, তখনই বিপরীতে আরেকটি দল সৃষ্টি হয়। সেখানে স্লোগান ওঠে, ‘আমরা কি কারও চেয়ে কম’।

আমাদের বুযুর্গদের সকল কাজে বিনয় ছিল। নিজের কাজ ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাঁরা আত্মতৃপ্তির শিকার ছিলেন না। ঈমান ও ইখলাসের সঙ্গে তাঁরা কাজ করেছেন। তাঁরা কখনো নেতৃত্ব কামনা করেননি। কখনো বলেননি, আমার দলই সব করেছে। আমরাই সবকিছুর মূলে ছিলাম।

হযরত মুজাদ্দেদ আলফে সানী রহ.—এর মাকতুবাত পড়ে দেখুন। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.—এর গ্রন্থসমূহ পড়–ন। হিন্দুস্তানে মুসলমানের শাসনক্ষমতার বাতি যখন নিভু নিভু, মোগল সাম্রাজ্য যখন শেষ নিঃশ্বাস গ্রহণ করছিল, সে সময়ে তাঁরা আহমাদ শাহ আবদালী রহ., নাজীবুদ্দৌলা প্রমুখকে চিঠি লিখেছেন। চিঠিগুলো পড়ে দেখুন। কেমন দরদ ছিল সেই চিঠিতে! আহমাদ শাহ আবদালীর উদ্দেশ্যে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এক দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। সে সময় মুসলমানদের অসহায়ত্ব ও নিরুপায় অবস্থা চিঠিতে তুলে ধরেছেন। এমন প্রভাববিস্তারী বাক্য তিনি লিখেছেন, যা থেকে দরদ ও ইখলাস টপকে পড়ে।

(তিনি লিখেছেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুপারিশকারীরূপে গ্রহণ করে বলছি, আল্লাহর জন্য হিন্দুস্তানের মুসলমানের প্রতি দয়া করুন। একবার আপনি এখানে আসুন।) তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েই আহমাদ শাহ আবদালী রহ. হিন্দুস্তান এসেছিলেন। তিনি এমনভাবে মারাঠাদের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন যে, আজও তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি ছিলেন হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ.। এই ছিল তাঁর দরদ ও  ব্যথা। তাঁর দূরদৃষ্টি হিন্দুস্তানের চিত্রই পাল্টে দিয়েছিল। আপনারা তো নিজেদেরকে তাঁদের দিকেই সম্বন্ধ করেন। এই সম্বন্ধের দাবি হলো, দ্বীন ও উম্মাহর জন্য যা কিছু প্রয়োজন বিসর্জন দিতে হবে। স্পষ্টভাবে প্রতিপক্ষকে বলে দিন, হঁ্যা ভাই, তুমিই ঠিক। তোমার কীর্তিই সবার ঊর্ধ্বে। চলো, আমরা সবাই মিলে এই দেশকে রক্ষা করি। চলমান সংকটে ওলামায়ে কেরামের জন্য পরস্পর মতবিরোধের অবকাশ কোথায়?

আলহামদুলিল্লাহ, নিজের আকীদা—বিশ্বাসে অটল থেকে আমি এই কথাটি বলছি। তার একটি অক্ষর থেকেও আমি পিছপা হতে প্রস্তুত নই। ইবাদত—সংক্রান্ত কোনো মাসআলা বা আকীদা—সংক্রান্ত কোনো মূলনীতিতে কোনোরূপ আপস করতে আমি প্রস্তুত নই। একটি হলো, নিজে আমল করা। আরেকটি হলো, কোনো বিষয়কে ঝগড়ার ক্ষেত্র বানানো। সাধারণ মানুুষকে হাতিয়ার বানিয়ে পুরো দেশকে রণক্ষেত্রে পরিণত করা। একটি কনফারেন্স হচ্ছে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ নামে, আরেকটি কনফারেন্স হচ্ছে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ নামে। বেঁচে থাকার অবলম্বন এগুলো নয়। এ প্রসঙ্গে ইকবালের একটি কবিতা আমার মনে পড়েছে,

کسے خبر کہ سفینے ڈبو چکی کتنے

فقیہ و صوفی شاعر کی ناخوش اندیشی

কে খবর রাখে, কত কিশতি ডুবিয়ে দিয়েছে / ফকীহ, সূফী ও কবিদের অদূরদর্শিতা।

 

জনসাধারণের সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের সম্পর্ক

দ্বিতীয় কথা হলো, জনসাধারণের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়া উচিত। জনসাধারণের সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের যে সম্পর্ক থাকার কথা তাতে আমি অপ্রতুলতা অনুভব করছি। বরং আমি বলতে পারি, ইন্ডিয়ায় জনসাধারণের সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের সম্পর্ক এখানের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। সেখানে রাজনৈতিক অঙ্গনে, জ্ঞান, সাহিত্য ও গবেষণার ক্ষেত্রেও ওলামায়ে কেরাম অগ্রগামী। সকল অঙ্গনে তাঁদের অবস্থান সর্বস্বীকৃত। সেখানে জেনারেল উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি ওলামায়ে কেরামের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ নয়। জ্ঞান ও সাহিত্যের বিভিন্ন মজলিসে আমরা উপস্থিত হই। আলহামদুলিল্লাহ, সেখানে আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করা হয়। তাই জনগণের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হওয়া চাই। এমন যেন না হয়, জনগণ আপনাদের আওতার বাইরে চলে গেল।

 

ওলামায়ে কেরামের জীবনাযাত্রা সবার চেয়ে ভিন্ন

তৃতীয় যে কথাটি আমি বলতে চাই তা হলো, আমাদের জীবনাযাত্রা যেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা থেকে ভিন্ন হয়। দৃষ্টিমানরা যেন খোলা চোখে দেখতে পায়, এই লোকগুলো দুনিয়ালোভী নয়। অর্থ—সম্পদ তাঁদের কাছে কোনো মানদণ্ড নয়। পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরামের মতো আমাদের সকল কাজ আল্লাহ তাআলার জন্য হতে হবে। ওলামাশ্রেণির মধ্যে যতদিন এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জিত না হবে, পরার্থপরতার গুণ সৃষ্টি না হবে, ততদিন তাঁদের ব্যক্তিত্ব মানুষের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করবে না। মানুষের কাছে তাঁরা সম্মানের পাত্র হবে না। মন—মগজে দ্বীনের গভীর প্রভাব বিস্তার করবে না। মাদরাসাগুলো বড় হওয়া, ছাত্রসংখ্যা অধিক হওয়া, ওয়াজ—মাহফিল সফল হওয়ার দ্বারা ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে না। তাতে সমাজে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যক্তিগত আদর্শ দ্বারা।

ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা তখন প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সাধারণ মানুষ দেখবে, যে বস্তুর জন্য আমাদের দৃষ্টিতে জীবন বিলানো যায়, ওলামায়ে কেরাম তাতে হাত লাগানোও গোনাহ মনে করেন, তাঁরা এর কোনো পরোয়াই করেন না। আমরা মনে করেছিলাম সম্পদ সবচেয়ে দামি, অথচ এই সম্পদ তাঁদের কাছে একেবারে মূল্যহীন। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ.—কে ঢাকার নবাব সাহেব খবর পাঠিয়েছিলেন, তিনি যেন তার সঙ্গে দেখা করেন। হযরত থানভী রহ. জবাব পাঠিয়েছিলেন, আপনার কাছে যে সম্পদ আছে, আমার কাছে তা প্রয়োজন পরিমাণ আছে। আমার কাছে যা আছে, তা আপনার কাছে প্রয়োজন পরিমাণও নেই। তাই আমার কাছে আপনার আসা উচিত। আপনার কাছে আমার যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

 

একটি ঘটনা

আপনাদেরকে আরও একটি ঘটনা শোনাই। ঘটনাটি হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করে। শায়খ সাঈদ হালবী রহ. একজন আল্লাহওয়ালা আলেম ছিলেন। একদিন তিনি দামেশকের এক মসজিদে দরস দিচ্ছিলেন। সেদিন তাঁর পায়ে ব্যথা ছিল। (আমার মুখ যদিও এই ঘটনা শোনানোর উপযুক্ত নয়, কিন্তু ঘটনা ছাড়া আমাদের মনে প্রভাব পড়ে না। ছোট কেউও যদি ঘটনা শোনায়, হৃদয়ে কিছু না কিছু প্রভাব পড়ে।) শায়খ সাঈদ রহ. দরস দিচ্ছিলেন। আপনারা জানেন, মসজিদে দরস প্রদানের সময় কিবলার দিকে উস্তাদের পিঠ থাকে আর ছাত্ররা সামনে থাকে। তাই সামনে থেকে কেউ এলে উস্তাদ তাকে দেখেন, দরসে বসা ছাত্ররা তাকে দেখে না।

খেদিভ সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আলী খেদিভের ছেলে ইবরাহীম পাশা একজন প্রতাপশালী শাসক ও সিপাহসালার ছিল। সবার মনে তার অপ্রতিহত প্রভাব ছিল। মানুষ তার ভয়ে কাঁপত। সে মসজিদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। শায়খ সাঈদ রহ. পায়ে ব্যথার কারণে দরজার দিকে পা ছড়িয়ে বসে ছিলেন। কাছে আসার পর ছাত্ররা দেখল, এ তো ইবরাহীম পাশা। তার সঙ্গে দেহরক্ষী বাহিনীও আছে। জল্লাদ ও পাহারাদারও আছে। ছাত্ররা মনে করল, হযরতের যত ব্যথাই হোক না কেন, তিনি পা গুটিয়ে নেবেন। শাসকেরও সম্মান করতে হয়। কিন্তু না, শায়খ সামান্যও নড়লেন না। পা ছড়িয়েই বসে রইলেন। ইবরাহীম পাশা সামনে এসে দাঁড়ালো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ছাত্ররা কাপড় গুটিয়ে নিল। তারা মনে করছিল, এখনই জল্লাদকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হবে। উস্তাদের সম্মানিত রক্ত যেন আমাদের কাপড়ে না লাগে। ইবরাহীম পাশা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিল। তার ওপর এমন প্রভাব সৃষ্টি হলো যে, সে কিছু বলতে পারল না। দরস শুনে সে চলে গেল। পরে সে শায়খ সাঈদ হালবী রহ.—এর জন্য থলেভরতি স্বর্ণমুদ্রা প্রেরণ করল। আল্লাহওয়ালাদের প্রভাব এমনই হয়। বার্তাবাহক সালাম জানিয়ে বলল, এটি গ্রহণ করুন।

জবাবে তিনি যা বললেন, ওই বাক্যটি শোনার মতো। আমি তো বলি, এমন একটি বাক্যের জন্য দশটি কাব্যসমগ্র কোরবান করা যেতে পারে। তিনি বললেন, তোমাদের মাননীয় সুলতানকে বলে দেবে,

الذى يمد رجله لا يمد يده.

যে পা প্রসারিত করে সে হাত প্রসারিত করে না।

এই বাক্যটি এভাবেই বর্ণিত আছে। হাত পাতা লাগলে আমি তখন পা ছড়িয়ে বসতাম না। পা গুটিয়ে নিতাম। এটাই আলামত যে, আমি হাত পাতার মানুষ নই। যে ব্যক্তি পা ছড়িয়ে বসে সে হাত পাতে না। এই গুণ ওলামায়ে কেরামের মধ্যে, দ্বীনের খাদেমদের মধ্যে দশ নম্বরে না হোক, পঞ্চাশ নম্বরে হলেও থাকতে হবে। যদি এই গুণ না থাকে তাহলে আমি পরিষ্কার বলতে চাই, আপনাদের সকল ইলমী যোগ্যতা, বক্তৃতা, যে কাজে আপনারা শ্রেষ্ঠ (রাজনৈতিক দলেও এমন বক্তা থাকতে পারে) এই সবই বৃথা। যতদিন আপনারা আমলের মাধ্যমে আদর্শ না হবেন ততদিন এসব কোনো কাজে আসবে না। শাসকগণ যেন এ কথা মনে না করে, আলেমদেরকে কেনা যায়। তারা যেন ওলামায়ে কেরামকে সম্পদের গোলাম ও সম্পদ—পূজারি মনে না করে।

ওলামায়ে কেরাম বিবেকবিরোধী কিছু করতে পারেন না। ওলামায়ে কেরামের জীবন আমাদের চেয়ে সাধারণ ও অনাড়ম্বর। ওলামায়ে কেরাম আমাদের চেয়ে নিম্নমানের বাড়িতে জীবনযাপন করেন। আমাদের চেয়ে সাধারণ খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করেন। এই বিষয়গুলো প্রকাশ হওয়া চাই। আমাদের পূর্বসূরিগণ তা প্রকাশ করেছেন।

আমি আমাদের উস্তাদগণের ঘটনা শোনাই। তখন আমি লাহোর কাসেমুল উলূম মাদরাসায় পড়তাম। সেখানে আমাদের জন্য কখনো কখনো ভালো ভালো খাবার তৈরি করা হতো। মাদরাসার পেছনে হযরত মাওলানা আহমাদ আলী রহ.—এর ঘর ছিল। তাঁর ছেলে মাওলানা হাবীবুল্লাহ রহ.—এর সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। আমি জানতাম কোন বেলা তাদের ঘরে খাবার নেই। অথচ এদিকে মাদরাসায় পোলাও রান্না হচ্ছে। তাঁর ঘরে এক থালা খাবার পেঁৗছে গেলে অসুবিধা কী? (কিন্তু কখনো পেঁৗছত না। এভাবেই কষ্ট করে জীবন পার করেছেন।)

বর্তমানে আল্লাহ তাআলা আমাদের এই জামাত দ্বারা দ্বীনের যে খেদমত নিচ্ছেন, তা ওই সকল গুণাবলির ফল। দুনিয়াবিমুখিতা, পরার্থপরতা, ত্যাগ ও বিসর্জনের স্পৃহা, বিনয়, নিজের সমালোচনা সহ্য করা, অন্যকে নিজের চেয়ে ভালো জ্ঞান করা ইত্যাদি গুণাবলির ফল। ‘আমি কি কারও চেয়ে কম?’ এটা কখনো আমাদের পরিচয় ছিল না। আমরা অনেক বড়দেরকে দেখেছি, তাঁরা নিজেকে তুচ্ছ মনে করতেন। হযরত মাদানী রহ.—এর কাছে কেউ বাইয়াতের আবেদন করলে, তাঁকে কখনো কখনো এই কবিতা পড়তে শুনেছি,

نہ گلم نہ برگ سبزم نہ درخت سایہ دارم

در حیرتم کہ دہقاں بچہ کار کشت مارا

আমি তো ফুল নই। সবুজ ঘাস বা ছায়াদানকারী বৃক্ষ—ও নই / আমি নিজেই অবাক যে, বিধাতা আমাকে কেন সৃষ্টি করেছেন।

আমাদের তো মনে হয়, হযরত নিজের ব্যাপারে নিজে লজ্জিত ছিলেন। এটাই বড় বড় আল্লাহওয়ালার পরিচয়।

গেঁাড়ামি বর্জন

সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত গেঁাড়ামি, আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। এই সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ভাষাগত গেঁাড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের জন্য কোর্স চালু করা উচিত। এ ব্যাপারে ইসলামের বিধান মানুষকে আরও ব্যাপকভাবে জানানো উচিত।

হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ تَعَزَّى بِعَزَاءِ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَعِضُّوهُ بِهِن أَبِيهِ وَلَا تُكَنُّوا.

যে ব্যক্তি কোনো জাহেলী স্লোগান তুলে তোমরা তার পিতাকে নিয়ে স্পষ্ট গালি দাও, অস্পষ্টভাবে গালি দিয়ো না।—সুনানে কুবরা নাসায়ী, হাদীস : ৮৮১৩

নবীজীর মুখ পবিত্র। এই মুখে ওহী পঠিত হতো। এই মুখে বিশ্ববাসী কোরআন মাজীদ শুনেছে। তাঁর ব্যাপারে বলা হয়েছে, এই মুখে তিনি কোনোদিন অশালীন কথা বলেননি। তবে প্রথম ও শেষবারের মতো যে শক্ত কথাটি এই মুখ থেকে বেরিয়েছে তা হলো, কেউ যদি তোমাদের জন্য জাহেলী স্লোগান তুলে, বংশ, গোত্র আর জাতির দোহাই দেয় এবং এই কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে তার বাপকে নিয়ে তোমরা গালি দাও। অস্পষ্টভাবে নয়, স্পষ্ট গালি দাও।

আল্লাহু আকবার। তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর মুখ থেকে সর্বদা ফুল ঝড়ত। এই মুখ থেকে প্রতিনিয়ত মধু নিঃসৃত হতো। এই মুখে কোরআন মাজীদ শোনা যেত। এই মুখের ব্যাপারে কোরআন বলেছে,

وَمَا یَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰی  ؕ﴿۳﴾ اِنْ  هُوَ  اِلَّا  وَحْیٌ  یُّوْحٰی  ۙ﴿۴﴾

তিনি নিজ থেকে কোনো কথা বলেন না। যা বলেন তা প্রেরিত ওহী।—সূরা নাজম, ৫৩ : ২—৩

এই মুখে তিনি কত কঠিন কথা বলেছেন। আমার মনে পড়ে না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কোনো বিষয়ে এমন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাই আপনাদের কর্তব্য, আপনারা পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে সফর করুন। বিশেষভাবে প্রতিটি প্রদেশের ছাত্রদেরকে এখানে এনে দ্বীনি শিক্ষা দিন। তাদেরকে এমন যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তুলুন যে, এসব জাহেলী স্বজনপ্রীতির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। তারপর তাদেরকে ওই সকল এলাকায় প্রেরণ করুন, যেখানে ভাষাগত বা আঞ্চলিক গেঁাড়ামি বিদ্যমান। এই জাহেলী গেঁাড়ামি দেশকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। এই স্বজনপ্রীতি বহু ইসলামী সালতানাতের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে।

আপনার ভাষার যাদু আপনি মানুষের মন—মগজে বসিয়ে দিতে পারবেন। নিজের ইলমী যোগ্যতা মানিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু তার দ্বারা প্রকৃত সম্মান অর্জিত হয় না। আমলী আদর্শ, উত্তম চরিত্র, দুনিয়াবিমুখতা, নির্মুখাপেক্ষিতা, আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই প্রকৃত সম্মান অর্জিত হয়। জ্ঞান—গরিমা ও চিন্তা—গবেষণায় যেমন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন, তেমনই উন্নত চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তৈরি হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের আকাবির এমন ছিলেন, আমাদের আকাবির তেমন ছিলেন—সর্বদা এই তাসবীহ জপে কাজ হবে না। গতবারও আমি এখানে আলোচনা করার সময় বলেছিলাম, কোনো জাতি ও দাওয়াত ইতিহাসের দোহাই দিয়ে চলতে পারে না, তার জন্য চলমান বিপ্লব ও সংগ্রাম প্রয়োজন। পাকিস্তানে আমরা ইতিহাসের দোহাই দিয়ে নিজেদের দাওয়াত ও মতাদর্শ চালাতে চাই। তাহলে তো মানুষ বলবে, মাওলানা সাহেব, শুনেছি শুনেছি, অনেক শুনেছি। এ কথা শুনে শুনে আমরা বিরক্ত হয়ে গেছি, আপনাদের বড়রা এমন ছিল, এমন ছিল।

پدرم سلطان بود پدرم سلطان بود

আমার বাবা বাদশাহ ছিলেন, আমার বাবা বাদশাহ ছিলেন।

এটা তো বলুন, আপনি কী? তাই এখনই কাজ শুরু করুন। ইতিহাস অনেক শোনানো হয়েছে। গ্রন্থ অনেক রচিত হয়েছে। পুরো লাইব্রেরি প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন কাজের প্রয়োজন। চেষ্টা, শ্রম, আত্মত্যাগ, আকর্ষণীয় ও যাদুকরী জীবনাচার গ্রহণ করা প্রয়োজন।

وہی دیرینہ بیماری وہی نا محکمی دل کی

علاج اسکا وہی آب نشاط انگیز ہے ساقی

সেই পুরোনো রোগ, দিলের সেই একই অস্থিরতা / হে সাকী, এই রোগের চিকিৎসা কেবল সেই উদ্দীপক সুরা।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

[1]. মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ.—এর ইন্তেকালের পর তাঁকে মুফতী আযম পাকিস্তান গণ্য করা হতো। তিনি হলেন দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামার শাইখুল হাদীস মাওলানা হায়দার হাসান খান টুংকি রহ.—এর নাতি।—সংকলক

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন