প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

এক মহীয়সীর জীবনচিত্র

এক মহীয়সীর জীবনচিত্র

মূল : মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ লুধিয়ানুভী রহ.


২৫ মুহাররম ১৪০৬ হিজরী মোতাবেক ১১ অক্টোবর ১৯৮৫ ঈসায়ী শুক্রবার শ্রদ্ধাভাজন জনাব নবাব ইশরত আলী খান কায়সার সাহেবের মুহতারাম আম্মাজান ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জনাব কায়সার সাহেবের আম্মা মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.—এর কাছে বাইআত হয়েছিলেন। মরহুমার তেলাওয়াত ও নফল আমলের গুরুত্ব, দুআ—ওযিফা ও মামুলাতের পাবন্দি, সুন্নাতের অনুসরণ, সার্বক্ষণিক যিকির ও দান—খয়রাতের প্রতি লক্ষ করলে তাকে ‘যুগের রাবেয়া (বসরী)’ বলা যেতে পারে। জনাব কায়সার সাহেবের সঙ্গে অধমের যখনই সাক্ষাৎ হতো, তাঁর আম্মার শারীরিক অবস্থার খোঁজ—খবর নিতাম। তাঁর মাধ্যমে তাঁর আম্মার কাছে সালাম পৌছাতাম এবং দুআ চাইতাম। আফসোস, মরহুমার ইন্তেকালের দরুন নেক দুআর সে ধারা বন্ধ হয়ে গেল। জনাব কায়সার সাহেব (যিদা মাজদুহুম) অধমের আবেদনে তার আম্মার জীবনের কিছু চিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। তার ভাষাতেই নিচে সেই জীবনচিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা মরহুমাকে তাঁর রহমত ও সন্তুষ্টির সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন এবং তাঁর উত্তরসূরিদেরকে সবরে জামীল দান করুন।

কায়সার সাহেব বলেন—আম্মাজান ২৫ মুহাররম ১৪০৬ হিজরী শুক্রবার মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। প্রায় ৯৩ বছর তিনি এই নশ্বর পৃথিবীতে ছিলেন। ভারত ভাগের পর মরহুম আব্বাজানের সঙ্গে কখনো কখনো তিনি পাকিস্তানেও আসতেন। কিন্তু গত ১১ বছর যাবৎ স্থায়ীভাবে করাচিতেই ছিলেন। তাঁর  জীবনে অসুস্থতার এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন মারাত্মক ও কষ্টদায়ক রোগ—যন্ত্রণায় আক্রান্ত ছিলেন। এতৎসত্ত্বেও সর্বদা সবর, শোকর ও সহনশীলতার সাথে সব কষ্ট সহ্য করেছেন। যখনই মনের মধ্যে কোনো পেরেশানী আসত, তখনই তার যবানে আল্লাহ পাকের যিকির জারি হয়ে যেত।

মৃত্যুর ৮ বছর পূর্বে তার ডান পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ডাক্তাররা রডের মাধ্যমে হাড় জোড়া লাগানোর জন্য অপারেশনের পরামর্শ দিলেন। কিন্তু শরীয়তে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঈমানী শক্তিতে তিনি আযীমত ও দৃঢ়তার ওপর আমল করেন। এখানে প্রতিবন্ধক ছিল কেবল তার পর্দার বিষয়টি। তিনি বলতেন—‘বাকিটা জীবন আমি ভাঙা হাড় নিয়ে পার করে দেওয়াকে মেনে নিতে পারব। কিন্তু ডাক্তারের সামনে নিজের শরীর উন্মুক্ত করাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারব না।’

বুঝ হওয়ার পর থেকেই আম্মাজান নিয়মিত নামায, রোযা ও কোরআন তেলাওয়াতে যত্নবান ছিলেন। তাহাজ্জুদ নামাযকে ফরয নামাযের মতো নিয়মিত পড়তেন। শেষ রাতের নফল নামায তার জীবনে কখনো বাদ যায়নি। এমনকি যে রাতে তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা ছিল, সে রাতেও তিনি তাহাজ্জুদের নিয়তে উঠেছিলেন। কিন্তু অযু করার সময় পাত্র হাতে থাকতেই পরে যান। তাকে যখন বিছানায় শোয়ানো হচ্ছিল তখনও তার কেবল এই চিন্তাই ছিল যে, দুই রাকাত নফল পড়ব। কিন্তু ব্যথা ও যন্ত্রণার তীব্রতায় তার মাথার শিরা ফেটে গিয়েছিল। সর্বশেষ তিনি এশার নামায পড়েছিলেন। কিন্তু সুবহে সাদিকের আগেই হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় দেড় দিন বেহুঁশ অবস্থায় ছিলেন। বেহুঁশ থাকাকালে একদিন যখন তাঁর বালিশের পাশে কালিমায়ে তাইয়্যেবা ও কালিমায়ে শাহাদাতের যিকির করা হচ্ছিল, তখন একবার তিনি শাহাদাতের আঙুল উঁচু করেন। তার সর্বশেষ আমল হিসেবে এটিই দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

আম্মাজান হযরত মুজাদ্দিদে মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.—এর কাছে বাইআত ছিলেন। প্রায় ১৫ বছর হযরতের সাথে তার ইসলাহী সম্পর্ক ছিল। হযরত থানভী রহ.—এর মালফুযাত অধিক পরিমাণে পাঠ করতেন। হযরত থানভী রহ.—এর ইন্তেকালের এক বছর পূর্বে আম্মাজান স্বপ্নযোগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর দর্শন লাভ করেন। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত থানভী রহ.—এর ব্যাপারে বলেন—‘সূর্য অস্ত যাচ্ছে’। অনুরূপ হযরত মাওলানা আবদুল গনী ফুলপুরী রহ.—এর ইন্তেকালের তিন মাস পূর্বে আলীগড়ে স্বপ্নে দেখেন, ‘চন্দ্র ডুবে যাচ্ছে’। মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আখতার সাহেব দামাত বারাকাতুহুম তার কিতাব মারেফাতে ইলাহিয়্যা’র মধ্যে এ স্বপ্ন দুটি লিপিবদ্ধ করেছেন। আম্মাজানের কাশ্ফ শেষ জীবনে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। ‘সুসংবাদবাহী স্বপ্ন’—ও অধিক পরিমাণে দেখতেন। তার জীবনে বারবার স্বপ্নযোগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর যিয়ারতের সৌভাগ্য নসীব হয়েছে। হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. তাঁর ব্যাপারে বলতেন—‘কাশফ—কারামাতের অধিকারী নারী’।

হিন্দুস্তানে থাকাকালে তিনি নিজ বাসস্থানে বহুদিন শিশুদেরকে কোরআন শরীফ এবং বেহেশতী যেওর পড়িয়েছেন। কোরআন পাকের তেলাওয়াতের সাথে ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা। রমযানুল মুবারকে তিন দিনে এক খতম কোরআন তেলাওয়াতের নিয়ম ছিল। এত অসুস্থতা, অক্ষমতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও দৈনিক এক মনযিল পরিমাণ কোরআন তেলাওয়াত করতেন। ছয়—সাত দিনে এক খতম কোরআন পড়া হয়ে যেত। এই নিয়ম ইন্তেকালের কয়েক সপ্তাহ পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল। কখনো তো সারা রাত কোরআন তেলাওয়াতেই কাটিয়ে দিতেন। দিন—রাতের প্রতিটি প্রহর তার কোরআন পাকের সান্নিধ্যেই থাকার সৌভাগ্য হতো। ফলাফল এই দাঁড়িয়েছিল যে, নিজের সামনে ও চারপাশে তিনি স্বচক্ষে কোরআনের নূর ও তাজাল্লী দেখতে পেতেন। তিনি বলতেন—যখন শুয়ে থাকি, তখন আমার চারপাশে কোরআন শরীফের আয়াতসমূহ অত্যন্ত মূল্যবান জ্যোতির্ময় চিত্র ও নকশাকারে লেখা দেখতে পাই। এই বিষয়টি এত অধিক পরিমাণে প্রকাশ পেত যে, আদবের কারণে আমাকে দুই পা বিছানার ওপর গুটিয়ে নিতে হয়। ঘরের দরজা, দেয়াল ও ছাদ বিভিন্ন আয়াতে কারীমা দ্বারা সজ্জিত ও আলোকিত হয়ে যেত। ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء (এটা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ, যাকে চান তিনি তা দান করেন)। চোখে ছানি পড়ার কারণে দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি চশমা ছাড়াই কোরআনে কারীম তেলাওয়াত করতেন।

আলহামদুলিল্লাহ, আম্মাজানের জীবনে তিনবার হজ আদায় এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর রওযা যিয়ারতের সৌভাগ্য হয়েছে। রমযানুল মুবারকে উমরা করার সৌভাগ্যও লাভ হয়েছে। অত্যন্ত ব্যাকুলতা ও আগ্রহ নিয়ে তিনি রোযার মাসের আগমনের অপেক্ষায় থাকতেন। শারীরিক অসুস্থতা ও অক্ষমতা সত্ত্বেও গত রমযানে ৫—৬টি ব্যতীত সবকটি রোযাই রেখেছিলেন। এটা তার কারামত ছিল যে, আযীমত ও দৃঢ়তার ওপর তার আমল করার তাওফীক হয়ে যেত। তিনি যথারীতি নিজের যাকাত ও কোরবানীর হিসাব লেখাতেন। মাশাআল্লাহ মন খুলে দান—সদকা করতেন। বারবার তার যবান থেকে এই পঙ্ক্তি শুনেছি :

پھر نکلنا گور سے ہاتوں کا ممکن ہی نہيں

কবর থেকে পুনরায় বের হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

তিনি বলতেন, আল্লাহর রাস্তায় যা কিছু খরচ করার নিজ হাতেই খরচ করে যাও।

আম্মাজানের এক বিধবা খাদেমা ছিল। গত তিন বছর তিনি আম্মার খেদমত করেছেন। ঘরে—বাইরে সব সময় আম্মা তাকে সঙ্গে রাখতেন। নিজে যা খেতেন ও পরতেন, তাকেও সেটাই খাওয়াতেন ও পরাতেন। সেই খাদেমা একবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কিছু দিনের জন্য হৃদরোগের হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আম্মাজান নিজের মাজুরি ও অক্ষমতা সত্ত্বেও তিনবার হুইল চেয়ারে করে তাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। মোটকথা তার সঙ্গে সব সময় অন্যদের মতো এবং উত্তম আচরণ করতেন।

আম্মাজান তাঁর পীর ও মুর্শিদ হযরত হাকীমুল উম্মত রহ.—এর ইন্তেকালের পর হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ হাসান সাহেব রহ.—এর সাথে ইসলাহী সম্পর্ক গড়েন। তার পরে মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ.—এর নিকট যেতেন। হযরত মুফতী সাহেব রহ.—এর অসুস্থতার সময় তাঁর খোঁজ—খবর নেওয়ার জন্য দারুল উলূম কৌরঙ্গীতে যেতেন। আম্মাজানের ওপর হযরত হাকীমুল উম্মত রহ.—এর যে বিশেষ দৃষ্টি ও তাওয়াজ্জুহ ছিল—সে ব্যাপারে হযরতের বড় বড় খলীফাও অবগত ছিলেন। এ কারণে তারাও আম্মাজানকে সম্মান করতেন। তিনি আরেফ বিল্লাহ হযরত ডাক্তার মুহাম্মদ আব্দুল হাই সাহেব দা. বা.—এর জন্য খুব দুআ করতেন। বিশেষ করে এ দুআ করতেন—হে আল্লাহ, হযরতের মাধ্যমে তোমার মাখলুক অনেক উপকৃত হচ্ছে। তাকে সুস্থতা ও নিরাপত্তার সাথে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখো। ইন্তেকালের দুই—তিন দিন পূর্বেও হযরত ডাক্তার সাহেবের কথা কয়েকবার স্মরণ করেছেন।

হযরত মাওলানা ফকীর মুহাম্মদ সাহেব দামাত বারাকাতুহুম যখন করাচি আসতেন এবং আম্মাজানের খোঁজ—খবর নিতে আসতেন, তখন আম্মাজান হযরতকে দিয়ে এ দুআ অবশ্যই করাতেন যে, আল্লাহ তাআলা যেন তাঁকে ঈমানের স্বাদ এবং ঈমানের সাথে মৃত্যু নসীব করেন। আলহামদুলিল্লাহ তাঁর জীবনের শেষ পরিণতি ভালোই হয়েছে। সারাটি জীবন তাঁর দিলের তামান্না ছিল—জুমুআর দিন তিনি দুনিয়া থেকে আখেরাতের সফরে রওনা হবেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই তামান্না পূরণ করেছেন। তিনি জুমুআর আযানের সময় মাওলা পাকের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে গোসল ও কাফনের কাজ সম্পন্ন হয় এবং সূর্যাস্তের পূর্বেই তাঁকে দাফন করা হয়। হাদীস শরীফে জুমুআর দিন মৃৃত্যুবরণ করার যে সুসংবাদ এসেছে, আল্লাহ তাআলা আম্মাজানকে সে সৌভাগ্য দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে চিরসুখের জান্নাত নসীব করুন এবং বিনা হিসেবে মাগফিরাত করে দিন। আমীন।

শাখসিয়্যাত ওয়া তাআসসুরাত (২৭৭—২৮০ পৃষ্ঠা) থেকে অনুবাদ করেছেন, শাব্বীর মুহাম্মদ

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন