এমন মানুষ মিলবে না আর
মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. স্মরণে
মাওলানা সালমান মানসুরপুরী
রমযানুল মোবারক ১৪৪১ হিজরীর ২৫ তারিখ, ১৯ মে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ মঙ্গলবার দিনটি আমাদের জন্য এবং আমাদের মতো আরও হাজারো মানুষের জন্য বড়ই বেদনাবিধুর একটি দিন। এই দিনে আমাদের সবার প্রিয় ও মুশফিক উস্তাদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.—এর চেতনার মুখপাত্র, হযরত নানুতবী রহ.—এর ইলমের বিশ্বস্ত ধারক—বাহক, দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীন, মুহাদ্দিসে কাবীর হযরত মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে আপন মালিকের দরবারে পাড়ি জমান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
দুনিয়াতে যে এসেছে একদিন তাকে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু অনেকের বিদায় বহুদিন পর্যন্ত অনুভূত হয়। তাদের স্মৃতিগুলো বছরের পর বছর মন—মস্তিষ্কে অম্লান থেকে যায়। তাদের শূন্যতা অনেক বেশি অনুভূত হয়। বিশেষ করে কোনো আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ আলেমের বিদায় এমন ক্ষতি, কেয়ামত পর্যন্ত যা আর পূরণ হয় না। চতুর্থ খলীফা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী রাযি. বলেন,
اذامات العالم انثلم في الإسلام ثلمة لا يسدها شيء إلا يوم القيامه.(كشف الخفا للعجلوني : ١/٨٧ وله شواهد.(
অর্থাৎ কোনো আলেমের ইন্তেকাল হয়ে গেলে ইসলামে এমন শূন্যতা সৃষ্টি হয়, কেয়ামত পর্যন্ত কোনোকিছুই তা পূরণ করতে পারে না।
এর কারণ হলো, প্রত্যেক আলেমের আলাদা শান থাকে, যা তার সঙ্গে করেই বিদায় নেয়। এমনিতে তো দেখে মনে হয় সব কাজ ঠিকই চলছে, কিন্তু পদে পদে চলে যাওয়া ব্যক্তির অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
এমনই দুর্লভ উলামায়ে রাব্বানীর একজন হযরতুল উস্তাদ মুফতী সাহেব রহিমাহুল্লাহ। তিনি চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৮০ বছর এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৭৮ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। অর্ধ শতাব্দীকাল সফলতার সঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দে দরস দিয়েছেন। প্রাণভরে হাজার হাজার ইলমে নববী পিপাসু শিক্ষার্থীকে তৃপ্ত করেছেন। কেবল শিক্ষকতা নয়, মূল্যবান ও অত্যন্ত উপকারী অনেক মৌলিক রচনা এবং ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখে উম্মতে মুসলিমার উপর বড় ইহসান করেছেন। তাঁর এসব কাজের মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন, ইনশাআল্লাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
মানুষ দুনিয়া থেকে চলে গেলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি বিষয় এমন, যার সওয়াব মৃত্যুর পরও জারি থাকে—
এক : সদকায়ে জারিয়া।
দুই : ইলমে নাফে।
তিন : নেক সন্তান, যারা বাবা—মার জন্য দুআ করে।—সহীহ মুসলিম : ২/৪১, হাদীস নং : ১৬৩১
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুফতী সাহেব রহ.—কে উল্লিখিত তিনো সৌভাগ্য দান করেছিলেন। সদকায়ে জারিয়ার সঙ্গে ইলমে নাফে এবং নেক সন্তান, যারা সবাই মাশাআল্লাহ কুরআনে কারীম ও ইলমে দ্বীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সন্তানরা তাঁর জন্য সওয়াব এবং আখেরাতে মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হতে থাকবেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও ইরশাদ করেন,
اذْكُرُوا مَحَاسِنَ مَوْتَاكُمْ…
তোমরা মৃতদের ভালো বিষয়গুলো আলোচনা করো।—সুনানে আবূ দাউদ : (৪৯০০)
বিশেষ করে যাদের জীবন অন্যদের জন্য পথ চলার মশাল ও আদর্শ, তাঁদের অনুসরণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা আমাদের জন্য অনেক উপকারী। এজন্য হযরতুল উস্তাদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা আমি সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাচ্ছি, যেন আমরাও সেগুলো অর্জন করতে পারি।
তাঁর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য
এক. সময়ের হেফাজত
হযরত মুফতী সাহেবের জীবনের অনেক মূল্যবান ও উজ্জ্বল একটি দিক হলো, তিনি জীবনের সামান্য সময়ও নষ্ট হতে দেননি। এমন—সব কাজ—কর্ম থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন, যা তাঁর ইলমী সফরে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যারা হযরতকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সাক্ষ্য দেবেন, প্রাকৃতিক চাহিদা ও পার্থিব কোনো প্রয়োজন ছাড়া দিনের পুরো সময় কোনো—না—কোনো কল্যাণকর ও উপকারী কাজেই ব্যয় করতেন। মাদরাসার নির্ধারিত সময়ে দরস প্রদান অথবা প্রয়োজন পড়লে শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা—বিষয়ক পরামর্শে ব্যয় করতেন। এদিকে ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত দরসের প্রস্তুতিমূলক মুতালাআ ও রচনার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এর মাঝে সময় পেলে ঘরের বাচ্চাদেরকেও ছোট—বড় কিতাবাদি নিজেই পড়াতেন।
মোটকথা, তিনি পুরো পরিবেশ এমন বানিয়ে নিয়েছিলেন, মুহূর্ত সময় যেন নষ্ট না হয়ে যায়। এর বরকতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে এমন বড় বড় কাজ সম্পন্ন করার তাওফীক দিয়েছেন, যা করতে পুরো একটি একাডেমির প্রয়োজন। হযরতুল উস্তাদের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা পাই, যে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয় এবং প্রাত্যহিক কাজের সময়সূচি নির্ধারণ করে একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করে, সে অবশ্যই সফল হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সময় এবং আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতার কদর করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
দুই. পরিপূর্ণ ইস্তেদাদ—যোগ্যতা
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরতকে অসাধারণ যোগ্যতা ও ঈর্ষণীয় ইলমী দক্ষতা দান করেছিলেন। নাহু, সরফ থেকে শুরু করে ফিকহ, হাদীস, তাফসীর পর্যন্ত সব বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রয়োজন অনুপাতে সেগুলোকে একত্র করার যোগ্যতাও তিনি লাভ করেছিলেন।
এ কথা স্পষ্ট, আসবাব ও উপকরণ—নির্ভর এই দুনিয়ায় হঠাৎ করেই এই ইলমী রুসুখ—গভীরতা অর্জিত হয়ে যায় না। এর জন্য শুরু থেকেই অনেক পরিশ্রম প্রয়োজন। তাঁর ইস্তেদাদ কীভাবে তৈরি হলো? এ সম্পর্কে হযরত নিজেই মাদরাসা শাহী মুরাদাবাদের দস্তারবন্দী মাহফিলে (৪ জুন ২০১৩ মঙ্গলবার) আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেন,
`মাদরাসায় শুধু পড়ার মাধ্যমে ইলম হাসিল হয় না। এখন বলবে, তাহলে আমরা পড়ছি কেন? পরীক্ষা কেন দিচ্ছি?
কথা হলো, পড়া দুই প্রকার। এক পড়া হলো নিজের জন্য। আরেক পড়া হলো বাবার জন্য। বাবার জন্য পড়লে ইলম আসে না। আমি চাহারম পর্যন্ত বাবার জন্য পড়েছি। শরহে জামীর বছর আমি মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুরে ভর্তি হলাম। এরপর সাহারানপুরের এমন কোনো গলি ছিল না, যাতে আমি সাইকেল চালাইনি। একবার আমার টাইফয়েড জ্বর হলো। টেলিগ্রাম করা হলো। বাবা এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। এ কথা জানা থাকা দরকার, আমি খুবই দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলাম। শুনলাম আব্বা তাঁর মায়ের সঙ্গে আমার ব্যাপারে বলছেন, এই ছেলেকে আর পড়াব না। এর অসুখ হয়ে এত টাকা খরচ হলো। আবার দিয়ে আসলে আবার এই পরিমাণ খরচ হবে। ও তো কিছু পড়েও না।
দাদি এর কোনো জবাব দিতে পারলেন না। আমি এসব কথা শুনছিলাম। আমার তখন বুঝে এল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে পড়তে হবে। সারা রাত আমার ঘুম হলো না। সকাল বেলা আম্মার কাছে গিয়ে বললাম, আমার জিনিসপত্র প্রস্তুত করে দিন। আমি মাদরাসায় চলে এলাম। সেদিন থেকে আজ এই ৭২ বছর বয়স পর্যন্ত আমি নিজের জন্য পড়ছি।’—নেদায়েশাহী, জুলাই ২০১৩
তাঁর এ বয়ান থেকে আমরা তাঁর দৃঢ়সংকল্প ও হিম্মত এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত ইলম অন্বেষণের অবিচলতার কথা জানতে পারি। যা আমাদের সবার জন্য এক উত্তম আদর্শ।
এ ছাড়া সময়ের প্রয়োজনে গুজরাটি এবং ইংরেজি ভাষাও তিনি প্রয়োজন পরিমাণ শিখেছিলেন। ছাত্রদেরকেও এর প্রতি উৎসাহ দিতেন। শাহী মুরাদাবাদের সেই দস্তারবন্দী মজলিসে তিনি আরও বলেন,
‘আমি ছোটবেলায় সামান্যও গুজরাটি ভাষা শিখিনি। আমার গুজরাটে থাকার কোনো ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু ভাগ্য আমাকে গুজরাটের একটি এলাকা রানদির পৌঁছে দিল। আমি ভাবলাম, এখন হয়তো সারা জীবন গুজরাটেই কাটাতে হবে। দ্বীনের কাজ করার জন্য গুজরাটি ভাষা শেখা জরুরি। তাই গুজরাটি শিখলাম। এভাবে শিখলাম যে গুজরাটি ভাষায় পাঁচটি কিতাবও রচনা করেছি। ওগুলো এখনো আছে, ছেপেছেও। এরপর আমার মনে হলো ইংলিশ শেখা উচিত। এ ছাড়া দুনিয়াতে কাজ করা যায় না। আমার এক ছাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসী ছিল। ভালো ইংলিশ জানত। তাকে বললাম, আহমদ, তুমি আমাকে ইংরেজি পড়াও।
আমি তাকে হেদায়া আউয়ালাইন পড়াতাম। সে আমাকে আসরের পর ইংরেজি শেখাত। আমি তার কাছে এতটুকু ইংরেজি শিখলাম, আমার আগ্রহ জাগল ডিগ্রির জন্য আলীগড়ে পরীক্ষা দেব। যদিও পরে পরীক্ষার সময় আর এই ভয়ে পরীক্ষা দিইনি, এই ডিগ্রি না আবার আমার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি ইংরেজি ভাষায় নিজের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম। তো আমরা যদি এ পদ্ধতি অবলম্বন করি, আমাদের মাঝে যা কিছুর ঘাটতি অনুভূত হয়, তা দূর করার চেষ্টা করি, তাহলে সমালোচকদের কোনো আপত্তির সুযোগ থাকবে না।’—নেদায়েশাহী, ডিসেম্বর ২০০৩
হযরতের বলে দেওয়া এই কর্মপদ্ধতিতে আমাদের সবার জন্য দিক—নির্দেশনা রয়েছে।
তিন. অন্যকে বোঝানোর অসাধারণ ক্ষমতা
হযরতের বোঝানো এবং পড়ানোর এক অসাধারণ শৈলী ছিল। এই কারণে হযরত ছাত্রদের মাঝে অনেক ভালোবাসা ও মাকবুলিয়াত পেয়েছিলেন। তাঁর দরস নিঃসন্দেহে অতুলনীয় দরস ছিল।
আল্লাহর রহমতে ১৪০৭ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে হযরতুল উস্তাদের তিরমিযী ও তাহাবী শরীফের দরসে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ কথা বলা যায়, ইলমী দিক থেকে ওই সময়টা হযরতের উত্থানের সময় ছিল। স্বাস্থ্য ও শক্তি—সামর্থ্যও ছিল ঈর্ষণীয়। নিয়মিত দরসে উপস্থিতি ছিল উপমা দেওয়ার মতো। সারা বছর হিসাব করলে একদিন কি দুইদিন হবে কোনো কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। আর নাহয় প্রতিদিন নিয়মিত কোনো ক্লান্তি ছাড়াই আড়াই ঘণ্টা অত্যন্ত সারগর্ভ ও আলেমসুলভ দরস দিতেন। জটিল থেকে জটিলতর অধ্যায়গুলোও তিনি সহজ—সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। যেন শ্রোতাদেরকে তা গুলে খাইয়ে দেওয়ার যোগ্যতা আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন। এজন্যই কম মেধাবী ছাত্ররাও তার দরসে বসে আনন্দ পেত। তিনি আসার পূর্বেই পুরো দারুল হাদীস পূর্ণ হয়ে যেত। কারও আসতে দেরি হলে দরজায় বসতে হতো। দরসে তাঁর আলোচনার ভঙ্গি এমন মোহনীয় ছিল যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনত। দরসগাহে নীরবতা ছেয়ে যেত। আইম্মায়ে কেরামের ইখতেলাফসমূহ তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা—ভক্তি রেখে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে, হৃদয় ছুঁয়ে যেত। কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইলম ও মাআরিফের যে প্রবাহ বয়ে যেত, প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয়ের বর্ণনা শুনে মন আনন্দিত হয়ে উঠত। হাদীসের প্রতিটি শব্দের তরজমার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এমন সুন্দর করে উপস্থাপন করতেন, পুরো বিষয়টি খুব সহজেই বুঝে আসত। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে হযরতের দরস অনন্য গুরুত্ব বহন করত। বেশির ভাগ ছাত্র সহজেই তাঁর দরস খাতায় নোট করে নিতে পারত এবং ইলমী মণি—মুক্তাগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করত।
তাঁর দরসে কে ইবারত পড়বে তা বছরের শুরুতেই নির্ধারিত হয়ে যেত। এমন কাউকে নির্ধারণ করা হতো, যে সহীহ ই’রাব, সহীহ উচ্চারণে হাদীস পড়তে পারবে। সঙ্গে হযরতের মেজাযও বুঝবে, কখন পড়তে হবে আর কখন থামতে হবে।
চার. উপকারী ব্যক্তিসত্তা
হযরতুল উস্তায রহ. নিজের জীবনকে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের জন্য, বিশেষ করে তালিবে ইলম এবং উলামায়ে কেরামের জন্য উপকারী করে তোলার অব্যাহত চেষ্টা করেছেন। দরস—তাদরীসের উপকারিতা তো সবার কাছেই স্পষ্ট। এ ছাড়া তিনি অনেক মূল্যবান কিতাব ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। তালিবে ইলম এবং আসাতিযায়ে কেরাম এ কিতাবগুলো থেকে অনেক উপকৃত হচ্ছেন। আখেরাতে নিশ্চয়ই এগুলো তাঁর নেকি বৃদ্ধির কারণ হবে।
হযরত তো ছোট—বড় অনেক কিতাব রচনা করেছেন, কিন্তু এর মাঝে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহর সুবিশাল উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআ স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আহলে ইলম জানেন, এই কিতাবে অনেক উচ্চ পর্যায়ের ইলমী ও ফিকরী আলোচনা থাকায় সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা অনেক বড় বড় আলেমের জন্যেও বোঝা কঠিন হয়ে যায়। যার—তার পক্ষে তো এই কিতাব থেকে যথাযথ ফায়দা হাসিলেরও যোগ্যতাই ছিল না। যেহেতু এ কিতাবের অধিকাংশ বিষয় এমন, যা সমাধা করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক কোনো কিতাবও পাওয়া যেত না। তাই আজ পর্যন্ত কেউ এর শরাহ—ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনার সাহস করেননি। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সৌভাগ্য হযরত মুফতী সাহেব রহ.—এর জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এই অতুলনীয় মহান খেদমত আঞ্জাম দিতে তিনি তাঁর সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যয় করেছেন। এই কিতাবে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ ইলমী রুচিবোধের প্রকাশ ঘটেছে। সন্দেহ নেই এটি এ যুগের অনেক বড় একটি কাজ এবং দারুল উলূমের সন্তানদের গৌরবময় খেদমতসমূহের অন্যতম। হযরত রহ. শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.—এর জ্ঞানভান্ডারের তাসহীল তথা সহজ—সরল সংস্করণ প্রস্তুত ও তাশরীহ তথা ব্যাখ্যা করে উলামায়ে হকের উপর যে ইহসান করেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই যুক্তিপূজার যুগে এমন কিতাব পাঠ করা সবার জন্য অনেক জরুরি। যেন প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হওয়া সন্দেহ ও আপত্তিগুলোর যথাযথ জবাব দেওয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়।
অনুরূপ তাঁর তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআনও একটি মর্যাদাশীল সৃষ্টি। এতে কুরআনের বিষয়বস্তুসমূহ অনেক হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে পেশ করার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়াও তার বুখারী ও তিরমিযী শরীফের দরসের তাকরীর তাঁর তত্ত্বাবধানেই তাঁর ছেলে মাওলানা হোসাইন আহমদ পালনপুরী সাহেব যথাক্রমে তুহফাতুল কারী ও তুহফাতুল আলমায়ী নামে ১১ ও ৮ খণ্ডে সংকলন করেছেন। এটিও তার অনেক মূল্যবান একটি খেদমত, যা থেকে ছাত্র—শিক্ষক সবাই ভরপুর ফায়দা হাসিল করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।
পাঁচ. আলেমসুলভ ভাবগাম্ভীর্য
হযরতুল উস্তাদ রহ. সারা জীবন পরিপূর্ণ আলেমের শান নিয়ে যাপন করেছেন। যে ইলম আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন, তার মর্যাদা তিনি পুরোপুরি রক্ষা করেছেন। একজন সত্যিকারের আলেমের জীবন কেমন হওয়া উচিত, আমরা হযরতের জীবনে তা দেখতে পাই। কয়েক বছর আমরা হযরতের বাড়ির কাছে বেয়রুনী কোটলা এলাকায় ছিলাম। হযরতের সঙ্গে একই মসজিদে নামায পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন হুযুর নিজের ঘর থেকে পায়ে হেঁটে দারুল উলূম যেতেন। অধিকাংশ সময় মাথায় পাগড়ি, উপরে সাদা রুমাল থাকত। নজর থাকত নিচের দিকে। যে—ই সামনে আসত তিনিই তাকে প্রথমে সালাম দিতেন। এটি হযরতের একটি বিশেষ গুণ ছিল। অন্যরা তাঁকে প্রথমে সালাম দেওয়ার সুযোগ খুব কমই পেত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মাঝে এক আশ্চর্য প্রভাব দান করেছিলেন। সবাই তার সামনে সহজে কথা বলার সাহস পেত না। প্রতিদিন আসরের পর হযরতের আম মজলিস হতো, যাতে শুধু ইলমী আলোচনা এবং নসীহতমূলক কথা হতো।
ছাত্রদেরকে নসীহত করার সময় প্রায়ই তাঁর উস্তাদে মুহতারাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ ইবরাহীম বলয়াভী রহ.—এর একটি হেদায়াত বিশেষভাবে উল্লেখ করতেন। একদিন বললেন, আমি যখন উস্তাদ হিসাবে রানদীর যাচ্ছি, তখন হযরতুল উস্তাদ আল্লামা মুহাম্মদ ইবরাহীম বলয়াভীর কাছে কিছু নসীহতের আবেদন করলাম। হযরত বললেন, মৌলভী সাহেব, আমার কাছে সকালে এসো। আমি ভোর চারটায় হাজির হলাম। হযরত দাঁড়িয়ে থেকেই মুআনাকা করলেন এবং তিনটি নসীহত করলেন,
‘এক. কোনো কিতাব পড়ানোর সময় ফনের প্রতি লক্ষ রেখে পড়াবে, তাহলে ইলম আসবে। অর্থাৎ যখন ফিকহ পড়াবে তখন ওই ফনের সব কিতাব দেখবে, বাদায়েউস সানায়ে, ফাতাওয়া শামী থেকে শুরু করে তালীমুল ইসলাম, বেহেশতী জেওর পর্যন্ত। অনেক সময় তালীমুল ইসলাম, বেহেশতী জেওরে মাসআলার এমন উপস্থাপনা পাওয়া যায়, যা আমরা অনেকে খুঁজেও পাব না।
দুই. সুন্নাতের অনুসরণ করো। এতে তোমার সম্মান ও মর্যাদা অনেক বাড়বে।
তিন. ছাত্রদেরকে নিজের সন্তান মনে করবে।’
হযরত মুফতী সাহেব রহ. প্রায়ই বলতেন, এগুলো হযরত বলয়াভী রহ.—এর অনেক মূল্যবান নসীহত। এগুলো মেনে আমি অনেক ফায়দা পেয়েছি। আমি হযরতের ইহসান কখনো ভুলতে পারব না।
নিমুর্খাপেক্ষিতা ও আত্মসম্মানবোধ তাঁর স্বভাবে মিশে ছিল। বারবার বলতেন,
‘কখনো দুনিয়া আর টাকা—পয়সার গোলাম হতে নেই। হাদীসে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা এসেছে।’
তাঁর আকাক্সক্ষা ছিল, মাদরাসার ফুযালাগণ সব সময় ইলমী কাজেই থাকবেন। নিজের পেশা বদলে ফেলবেন না। অনেকবার তাঁর সামনে কিছু প্রতিষ্ঠানের আলোচনা উঠেছে, যেগুলোতে মাদরাসার ফারেগীনদের জন্য সহজে জাগতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হযরত তখন বলতেন,
‘মাদরাসাপড়–য়া মেধাবী ছাত্ররা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি ঝুঁকে পড়লে দ্বীনি প্রয়োজন পূরণ হবে কীভাবে? কারণ, জাগতিক শিক্ষার পর সাধারণ দ্বীনি কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।’
ছয়. মাযহাবের উপর অবিচলতা
হযরতুল উস্তাদ নিজের ফিকহী মাসলাক অর্থাৎ ফিকহে হানাফীর উপর দৃঢ় ছিলেন। কোনো মাসআলায় ফিকহের মূলনীতি ও জুযইয়্যাত—শাখাগত মাসআলা থেকে সরে যাওয়া পছন্দ করতেন না। অনুরূপ আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের চিন্তা—চেতনার ব্যাপারেও তাঁর গভীর দৃষ্টি ছিল। জেনেশুনে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তাঁর কাছে খুবই অপছন্দ ছিল। তিনি কখনোই বাতিল কোনো ফিরকার প্রতি সামান্যও আকৃষ্ট হননি; বরং যখনই এ বিষয়ে আলোচনা করতেন দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলতেন এবং এ ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতির তোয়াক্কা করতেন না। তাঁর ছাত্রদের যেহেনও এভাবে প্রস্তুত করতেন যে, তারা হকের উপর কায়েম থাকবে, আকাবিরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে। এ ব্যাপারে যেখানেই কোনো ত্রুটি দেখতেন সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করতেন।
স্বাধীন চিন্তা বা সালাফে সালেহীনের অনুসৃত পথ ও পন্থা থেকে দূরে সরে যাওয়াকে সব সমস্যার মূল মনে করতেন। এজন্যই মাওলানা মওদুদীর চিন্তা—চেতনা ও গায়রে মুকাল্লিদদের কাজ খুবই অপছন্দ করতেন। এ ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট মত ছিল, এমন বক্র চিন্তার মানুষদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন না। একবার ফিদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানী রহ.—এর সভাপতিত্বে দিল্লিতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তাহাফফুজে সুন্নত শীর্ষক একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে হযরত সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ আলোচনা করেছিলেন এবং তাকলীদ না করার ক্ষতিসমূহ স্পষ্ট করেছিলেন। এই বক্তৃতা এমন প্রভাব ফেলে যে, একে এই কনফারেন্সের সারাংশ বলা হয়েছিল।
সাত. প্রেরণা ও উৎসাহ প্রদান
হযরত মুফতী সাহেব রহ.—এর একটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি নবীন ও উঠতি তরুণদের বক্তৃতা ও রচনায় বিপুল উৎসাহ দিতেন। যার ফলে তারা সামনে অগ্রসর হওয়ার হিম্মত করতে পারত। যখনই তাঁর কোনো ছাত্রের কোনো ইলমী ও দ্বীনি খেদমতের কথা জানতে পারতেন তখনই অনেক আনন্দ প্রকাশ করতেন।
সফরে সাথিদের সঙ্গে খুবই অসংকোচ ও খোলামেলা আচরণ করতেন। এজন্য তাঁর সঙ্গে সফরে কোনো বাড়তি কষ্ট হতো না। অধমেরও হযরতের সঙ্গে কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় সফর করার সৌভাগ্য হয়েছিল। একবার মুম্বাইয়ের মেরাজুল উলূম চিতা ক্যাম্প মাদরাসার মাহফিল ছিল। বক্তাদের মাঝে হযরতের সঙ্গে দারুল উলূমের উস্তাদ হযরত মাওলানা শওকত আলী বস্তাবী এবং অধমের নামও ছিল। যখন আমরা মাদরাসার জলসার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন গাড়িতে বসার আগে হযরত আমাদের দুজনকে একটু দূরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘একদম নিঃসংকোচ বয়ান করবে। আমার কারণে বয়ানে কোনো কমতি রাখবে না।’
এটা স্পষ্ট যে হযরতের সামনে কথা বলা কোনো সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু হযরত যখন সাহস দিলেন, ভয়ে ভয়ে ছোট একটি হাদীসের তরজমা পেশ করলাম। পরে যখন হযরত বয়ান করলেন, তখন তিনি এই কথাগুলোর উদ্ধৃতি দিলেন! এর চাইতে বড় প্রেরণা আর কী হতে পারে!
আমার অনেক রচনার ব্যাপারে হযরত অনেক উৎসাহপ্রদানমূলক কথা লিখেছেন। ایک جامع قرآنی وعظ (একটি সারগর্ভ কুরআনী উপদেশ) শিরোনামে নেদায়ে শাহীতে অধমের একটি প্রবন্ধ ৭২ কিস্তিতে ছেপেছিল। পরে তা কিতাব আকারে প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরে হায়দারাবাদের ফিকহী মজলিস শেষে ফেরার সময় বিমানে আমি এর পাণ্ডুলিপিটি হযরতের কাছে পেশ করলাম। হযরত পুরো কিতাবের উপর একবার নজর বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা শুধু এই এক আয়াত اِنَّ اللهَ یَاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْاِحْسَانِ এর আলোচনা?
বললাম, জি হ্যাঁ।
হুযুর অনেক খুশি হলেন। দেওবন্দে পৌঁছার পর آيات قرآنی پر سلمانی وعظ (কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে সালমানী উপদেশ) শিরোনামে একটি দুআমূলক ভূমিকা লিখে পাঠালেন। হযরতের লেখা পড়ে আমি লজ্জায় শেষ। ফোন করে বললাম, হযরতের এই সুধারণা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য।
হযরত অনেক খুশি হলেন। অনেক দুআ দিলেন।
তিনি নেদায়ে শাহী পত্রিকাটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পড়তেন। সাক্ষাতে পত্রিকার প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা—পর্যালোচনা করতেন। একবার বললেন, আমি নেদায়ে শাহীর মৃত্যুসংবাদের কলামটি অবশ্যই পড়ি। এতে অনেকের মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারি। অনেকের জন্য দুআ করার সুযোগ হয়।
তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত
১৯৮৬ সালে যখন দারুল উলূম দেওবন্দে ‘আলমী মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত’ (বিশ্ব খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ কমিটি) গঠন করা হলো, তাঁকে এর প্রধান কার্যনির্বাহী নাযেমে আ’লা বানানো হলো। আর আমার শ্রদ্ধেয় বাবা হযরত মাওলানা কারী উসমান মানসুরপুরী সাহেবকে নাযেম নির্ধারণ করা হলো। এরপর শ্রদ্ধেয় বাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আগ্রহ এবং হযরত মুফতী সাহেব রহ.—এর পরামর্শে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াতের কাজ আলহামদুলিল্লাহ সারা দেশে অনেক সুন্দরভাবে চলেছে। এ কাজের লোক তৈরি করার জন্য সব জায়গায় তরবিয়তী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সুযোগ হলে হযরত মুফতী সাহেব নিজেই যেতেন। কাদিয়ানী ধর্মের খণ্ডনে তাঁর বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রামাণ্য ও প্রভাববিস্তারী আলোচনা করতেন। এ বিষয়ে হযরতের কিছু বয়ান প্রচারও করা হয়েছে।
ফিকহী সম্মেলনে অংশগ্রহণ
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ইদারাতুল মাবাহিসিল ফিকহিয়ার মজলিসগুলোতেও বেশির ভাগ সময় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। সবগুলো প্রবন্ধ ও আলোচনা শুনতেন এবং পর্যালোচনাও পেশ করতেন। অনেক ইখতেলাফও হতো। অনেক সময় তাঁর ছাত্রগণও তার মতের বিপক্ষে দলীল পেশ করতেন। অধিকাংশ সময় হযরত নিজ মতে অটল থাকতেন। তাঁর সঙ্গে ইখতেলাফ হলেও কিছু মনে করতেন না।
একবার অধম হযরতের ঘরে হাজির হলাম। হযরত তখন আলোচনার মাঝে বললেন, আলেম ও জাহেলের মাঝে পার্থক্য হলো, জাহেল মতভিন্নতার কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আলেম দলীল—নির্ভর ইখতেলাফকে ইখতেলাফ পর্যন্তই রাখে। এর কারণে পুরোনো সম্পর্কে কোনো পার্থক্য হয় না। কোনো সন্দেহ নেই, হযরতের এ কথা একটি সুস্পষ্ট নসীহত, যা আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত।
সাধারণত হযরত মাদরাসা বা অন্য মাহফিলগুলোতে শরীক হতেন না। তবে ছাত্রদের এবং সমবয়সি উলামায়ে কেরামের অনুরোধে কোনো কোনো মাহফিলে উপস্থিত হতেন। কয়েক বছর জমিয়তের মুরাদাবাদ শাখার পক্ষ থেকে আয়োজিত বার্ষিক সীরাতে খাতামুন নাবিয়্যীন কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানে খুবই মূল্যবান বয়ান পেশ করেছেন।
অনেক বছর ধরে শাবানের শেষে দেশের বাইরে লন্ডন, কানাডা, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে দীর্ঘ সময়ের জন্যে সফরে যেতেন। সেখানে বিভিন্ন শহরে অবস্থান করতেন। ইলমী ও ইসলাহী উপকারের ধারা অব্যাহত থাকত। বেশির ভাগ সময় শাওয়ালের শেষের দিকে এ সফর থেকে দেশে ফিরতেন। এভাবে দেশে দেশে তার ফয়েয ছড়িয়ে পড়ত।
অসুস্থতা এবং ইন্তেকাল
হযরতের শারীরিক অবস্থা যদিও এমনিতে ভালোই ছিল। তবে অনেকদিন থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ইনসুলিন নিতে হতো। কয়েক বছর আগে একবার হৃদরোগজনিত কারণে অপারেশন করতে হয়েছিল। এরপর সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কয়েক বছর থেকে শ্রবণশক্তিতে সামান্য সমস্যা ছিল, যা মাঝেমধ্যে দেখা দিত। কখনো কখনো কথাও বলতে পারতেন না। এমন ঘটনা এ বছরও ঘটেছিল। রজব মাসের মাঝামাঝি দারুল হাদীসে খতমে বুখারীর সময় অনেক কষ্ট করেও কথা বলতে পারছিলেন না। শেষে শুধু এইটুকু বলে চলে এলেন, ‘এখন আল্লাহ যা চাইবেন তা—ই হবে।’ এ দৃশ্য দেখে ছাত্রদের মাঝে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। কান্নার রোল পড়ে গেল। পরের দিন চিকিৎসার জন্য মুম্বাই গেলেন। আল্লাহর রহমতে সুস্থ হলেন। এই অবস্থা আর রইল না। কিন্তু ২৪ মার্চ ২০২০ থেকে সারা দেশে লকডাউন শুরু হলে দেওবন্দে ফিরে আসতে পারেননি। এর মাঝেই রমযান মাস এসে গেল। হযরতের ভক্তগণ এ সুযোগকে গনীমত মনে করলেন। হযরতের কাছে ইলমী ইস্তেফাদার দরখাস্ত করলেন। হযরত তাদের আবেদন গ্রহণ করলেন। প্রতিদিন তারাবীর পর অনলাইনে সওয়াল—জওয়াবের সিলসিলা শুরু হয়। ১৫ রমযান ১৪৪১ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এ সময় হযরত অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন, যা এখন ইউটিউবে সংরক্ষিত আছে।
এরপর হযরতের প্রচণ্ড জ¦র উঠল। রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাকে মালাডে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে অবস্থা সুস্থতার দিকে ছিল। কিন্তু ইন্তেকালের দুইদিন আগে অর্থাৎ ২৩ রমযান হঠাৎ করে অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা বললেন, ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। অবশেষে এই অবস্থায়ই ২৫ রমযানুল মোবারক ১৪৪১ হিজরী মঙ্গলবার দিন ভোরে তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।
হাসপাতালেই তাকে গোসল করানো হয় এবং কাফন পরানো হয়। পাশের মসজিদের মাঠে হযরতের সাহেবজাদা মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ সাহেবের ইমামতিতে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম যোগেশ্বরী মুসলিম কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। রাহিমাহুল্লাহ রাহমাতান ওয়াসিয়া।
আল্লাহ তাআলা হযরত মুফতী সাহেব রাহিমাহুল্লাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। উম্মতকে তাঁর উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করুন। তাঁকে তাঁর খেদমতসমূহের উত্তম থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। ভক্ত—অনুরক্তদের সবরে জামিল দান করুন। আমাদের সবাইকে তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন সুম্মা আমীন।
[উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন, মাওলানা মুরতাজা মাহদী, শিক্ষক, জামেয়া হুসাইনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ]