এ জীবন ধন্য করো : আধ্যাত্মিক ভ্রমণবৃত্তান্ত
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
বদায়ুন থেকে পিতৃহীন খাজা নিজামুদ্দীন তাঁর মাকে নিয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন। এতিম অবস্থায় মায়ের দুআ ও প্রেরণা তাঁকে জগতে বড় করেছিল। গরিবি হালতেও হালাল খানার প্রতি বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখা ছিল তাঁর মায়ের একটি দায়িত্ব। মুমিনের জীবনে ঈমান আনার পর প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে হালাল খাবার খাওয়া। এরপর আসে পবিত্রতা। এরপর নামায। এমনকি সতর্কতার জন্য নিজের হাতে কাটা সুতায় খাজা নিজামুদ্দীনের জামাও মা—ই তৈরি করে দিতেন। যখন তিনি পড়া শেষ করেন তখন তাঁর দস্তারবন্দীর পাগড়িটি তাঁর মা—ই নিজ হাতে সুতা কেটে বুনে দিয়েছিলেন।
খাজা নিজামুদ্দীন জীবনভর মাসের শুরুতে নতুন চাঁদ দেখে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে তাঁকে আদর ও সম্মান জানাতেন। মায়ের সাথে বা মাকে ভিত্তি করে তাঁর দুআ কবুলের একটি সম্পর্ক ছিল। কখনো কোনো পেরেশানী এলে তার কাছে দুআ চাইতেন। মায়ের ইন্তেকালের পর নতুন চাঁদ উঠলে বিশেষভাবে তার জিয়ারতে যেতেন। খুব বড় বিপদে পড়লে আল্লাহর সাথে মাকে মাধ্যম বানিয়ে কিছুটা অভিমানের মতো করতেন।
একবার যখন দিল্লির শাসক তাকে দরবারে হাজির হতে বাধ্যতামূলক নির্দেশ দিল, তিনি বুঝতে পারলেন বার বার দরবারে যেতে অস্বীকার করলেও এবার হয়তো আর রেহাই মিলবে না। তখন খাসভাবে মায়ের কবর জিয়ারতে গেলেন। বললেন, ‘আপনি আমাকে ক্ষমতাবিমুখ, আল্লাহমুখী ও আত্মমর্যাদাশালী হতে শিখিয়েছেন। সারা জীবন আপনার শিক্ষা অনুসরণ করেছি। আজ কিন্তু আমি মহাবিপদে। মনে হয়, সেনারা আমাকে জোর করে বাদশাহর দরবারে নিয়ে যাবে। আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন। তবে আম্মা, আজ যদি আমাকে সত্যিই বাদশাহর দরবারে যেতে হয়, তা হলে আর কখনো আপনার জিয়ারতে আসব না।’
এটি মূলত আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করার একটি অভিমানী কৌশল ছিল। পুণ্যবতী মায়ের একাধারে গর্ভজাত ও মানসপুত্র তার পরম আদরের ঠিকানা মায়ের পাশে আর আসবে না, এ বিষয়টি আল্লাহর রহমতের সমুদ্রে ঝড় তুলবে—এটাই স্বাভাবিক। সেদিন আর খাজা নিজামুদ্দীনকে রাজদরবারে যেতে হয়নি। ধরে নেওয়ার জন্য সৈনিকরা এলে খানকার লোকেরা চরম উদ্বিগ্ন হয়। খাজা নিজামুদ্দীন নিজে ঘরের দ্বিতল ভাগে নামাযে দাঁড়িয়ে যান। মাঝে মাঝে পায়চারি করেন। তার মুখে একটি কবিতার লাইন :
হে শৃগাল তুমি তোমার গর্তেই থাকো, সিংহকে নিজের দিকে আহ্বান কোরো না।
কারণ, সিংহের সাথে শেয়ালের সাক্ষাৎ শেয়ালের জন্য কোনোদিনই সুখকর হয় না।
অস্থিরতার মধ্যেই প্রাসাদ থেকে খবর এল, এশার আযানের সময় বাদশাহ তার এক ভৃত্যের হাতে নিহত হয়েছেন। খবর শুনে খাজা নিজামুদ্দীন মায়ের কবর জিয়ারতে গেলেন। মুখে তার স্বস্তির ভাব, মনে বিপদমুক্তির আনন্দ।
সর্বশেষ উজবেকিস্তান সফরের শিডিউল হাতে এলে দেখলাম, বোখারায় খাজা মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন নকশেবন্দীর অবস্থানস্থলে যাওয়া হবে। সেখানে দুটি মসজিদ, মাদরাসা, মিউজিয়াম, সাধারণ কবরস্থান, খাজা সাহেবের কবর ছাড়াও একই কমপ্লেক্সে তাঁর পুণ্যবতী মা আরিফা বিবির কবরও রয়েছে। সেটি তৃতীয় এক মসজিদের পাশে। শুনে খুব ভালো লাগল। মনে পড়ল, ইতিহাসের কয়েকজন বুযুর্গের মায়ের উল্লেখ ও স্মরণীয় ভূমিকার কথা।
আমিও আম্মার সাথে দেখা করতে এসেছি। এখান থেকেই সফরে যাত্রা করব। আম্মা বললেন, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি এ বাসায়ই অপেক্ষা করবেন। সফরের পর অন্য কারও সাথে কোনো কথা ভাগাভাগির কিংবা কিছু লেখার আগে প্রাথমিক আলাপটুকু এখন আম্মার সাথেই করি, যা আগে আব্বা—আম্মা দুজনের সাথে করতাম। তারা খুব মন দিয়ে শুনতেন। আব্বা সবকিছু জানা থাকা সত্ত্বেও আমি বলার সময় এমন ভাব নিয়ে শুনতেন যে, মনে হতো তিনি এই প্রথম শুনছেন। আম্মা বললেন, মধ্য এশিয়ার সফর তোমার ভালো লাগবে। অসুস্থতা ও শারীরিক দুর্বলতা সফরের সময় থাকবে না, ইনশাআল্লাহ। কারণ, এসব এলাকা তোমাদের পূর্বপুরুষের। তা ছাড়া আধ্যাত্মিক, মানসিক ও শিক্ষাগত কারণে এ অঞ্চল ও সেখানকার মনীষীগণ তোমার জন্য আকর্ষণীয়। আবেগ ও আনন্দে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি পাবে তুমি।
সত্যিই ইতিহাস, শিক্ষা, সাম্রাজ্য ও বহুবিধ অর্জনের গল্প থাকলেও তরীকা—তাসাওউফের বিষয়টি আমার সফরকে বেশি আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে তুলেছিল। আমি কিছুদিনের ব্যবধানে তুরস্ক, এরপর সোভিয়েত রাশিয়ার কিছু মুসলিম দেশ এবং সবশেষে ইরান সফর করে এসেছি। ঢাকায় একবেলা থেকে আবার গিয়েছি মালয়েশিয়া। ইরান থেকে ফিরে আম্মার সাথে সামান্য সময় কাটিয়ে আবার এয়ারপোর্ট চলে যাই। তাকে কয়েক রকম ইরানি চা, টার্কিশ কফি, বোখারার শাল ও একটি ইরানি গোলাপকলি হাদিয়া দিই। আম্মা খুব খুশি হন। তাঁর পূর্বপুরুষ এখন থেকে পাঁচ—ছয় শ বছর আগে পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। শায়েখ আব্দুল কাদের নামক এক দরবেশের বংশধর আম্মা। এমনিতেই আমরা সবাই তাঁকে ‘ইরানি গোলাপ’ বলে ডাকি।
এবার তিন দিন ব্যাপী কনফারেন্সে নানা অধিবেশনে বার বার আয়োজকদের পক্ষ থেকে অনেক ফুলের তোড়া, ক্রেস্ট ও কিতাব উপহার পেয়েছি। ইরানের বিভিন্ন মিলনায়তন ও প্রাসাদের সামনের বাগানে শত শত গোলাপের ভিড়। একটি গোলাপ—কলি হাত—ব্যাগে করে এনে আম্মাকে দিয়ে বললাম, যদিও এটি আমার দেখা দু—আড়াই শ জাতের গোলাপের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গোলাপ। এরপরও আমার মনে হয়, ‘আমাদের ইরানি গোলাপটিই সেরা।’ এরপর আম্মার সাথে কিছু আধ্যাত্ম আবহে সুরভিত সময় পার করে আমাকে আবার এয়ারপোর্টের পথে চলে যেতে হয়। ঢাকার অনেকে বিভ্রমে পড়ে যান। একটানা ভ্রমণে হঠাৎ আমি কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকায় কেন? এটি ছিল আমার মায়ের জন্য। আমাদের ‘ইরানি গোলাপে’র জন্য।
তরীকা ও তাসাওউফ সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন সমাজে আছে, এগুলো ওঠার পেছনে বেদআতী সম্প্রদায় প্রধানত দায়ী। তারা প্রশংসিত এ বিষয়টিকে নিজেদের মনগড়া ও স্খলিত রূপ দিয়ে এতই বিতর্কিত করেছে যে, মানুষ তরীকা ও তাসাওউফের মূল চেহারাটিই ভুলে গেছে। হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেছেন, ‘তাসাওউফ হচ্ছে আল্লাহর হুকুম—আহকাম আলস্য না করে মনের টান ও আগ্রহ নিয়ে পালন করা।’ যেসব আলেম তরীকা—তাসাওউফের ঘোর বিরোধী তাদের অনেকের সাথে আমার দেখা হয়, তবে তাদের ব্যাখ্যায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী তরীকা—তাসাওউফকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এ জন্য এর বিরুদ্ধে নতুন কারও কথা আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। বিশেষ করে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তাযকিয়া ও এহসান নামে এ বিষয়টিকে তুলে ধরায় আমার ধারণা আরও ইতিবাচক হয়। মাওলানা মানযুর নোমানী রহ. এর একটি মূল্যায়ন বিষয়টিকে আমার কাছে পরিপূর্ণ স্পষ্ট করে তোলে।
তা ছাড়া আমি নিজেও একটি তাযকিয়াপন্থী পরিবারের সন্তান। প্রপিতামহ, দাদাজান এবং আমার আব্বা—এরা সবাই শায়খে তরীকত হিসাবে জীবনে বহু অবদান রেখে গেছেন। আল্লাহর ফজলে ছাত্রজীবন থেকে ইহসানের পথে এগিয়ে চলার প্রবল ইচ্ছা আমাকেও এ জগতের লোকেদের সংস্পর্শে থাকতে উৎসাহিত করে। অসংখ্য মাশায়েখের ফয়েজ ও বরকত লাভ করার পাশাপাশি অনেকের বিশেষ মনোসংযোগও লাভ করি। ইতিহাস থেকে তরীকা—তাসাওউফের স্বীকৃত মনীষীদের জীবন, কর্ম ও অবদান যতদূর সম্ভব জানার আগ্রহ সব সময়ই লালন করেছি। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তাযকিয়া আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে অঙ্কিত থাকায় এ বিষয়টি সম্পর্কে আমার মনে কোনো দিনই প্রশ্ন বা সংশয়ের সৃষ্টি হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, পবিত্র কোরআনের জীবন্ত রূপ, যার জীবনাচরণই ছিল পবিত্র কোরআন, সেই মহিমান্বিত পয়গম্বর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরিত জীবনপথ ও সর্বোত্তম চরিত্র যেসব নেক বান্দার মাধ্যমে যুগে যুগে উম্মতের কাছে বিস্তৃতি লাভ করেছে, তাদের নির্বাচিত একটি অংশই তরীকা—তাসাওউফের মনীষীগণ। উলামায়ে উম্মত যেমন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ঠিক তেমনই তাদের ভেতরকার মুহসিন ও মুত্তাকী সম্প্রদায় উম্মতের বাগানে নববী ফুলের সৌরভ হয়ে বিরাজমান।
আমার শৈশবে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মনে রেখাপাত করত, তা হলো সেই চার—সাড়ে চার বছর বয়স থেকে ১৪—১৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিরাতেই আধো ঘুম—আধো জাগরণের মধ্যে ফজরের আযানের আগে কম—বেশি দুই—আড়াই ঘণ্টা আমার দাদা সাহেবের দীর্ঘ নিবেদিত ও সুন্দরতম তাহাজ্জুদ দেখা, তেলাওয়াত শোনা, যিকিরের হালকা গুঞ্জরণ, মুরাকাবা, চাপা আবেগমিশ্রিত অশ্রম্নসিক্ত দুআ—মুনাজাতের অপার্থিব আবহে পার করা সময়। তিনি বড় আলেম, শাইখুল হাদীস, মুহতামিম হওয়ার পাশাপাশি কঠোর সুন্নতের পাবন্দ একজন শায়খে তরীকত ছিলেন। দাদাজান শাইখুল হাদীস আল্লামা আহমাদ আলী খান রহ. (জন্ম ১৯০৪ ঈ. মৃত্যু ১৯৮২ ঈ.)ছিলেন হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. এর মুরীদে খাস। আর প্রধান খলীফা ও মুজায, হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ.। একবার হযরত থানভী রহ. এর ইন্তেকালের কিছুদিন আগে নিজ শায়েখ মাওলানা আতহার আলী রহ. এর সাথে হযরত থানভী রহ. এর দরবারে রওনা হন। পথে দাদাজান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। হযরত থানভী রহ. এ কথা শুনে খুব আফসোস করেন এবং মাওলানা আতহার আলী রহ. এর মাধ্যমে নিজের একটি গরম শেরওয়ানী দাদাকে তাবাররুক হিসাবে দান করেন। যা এখনো আমাদের সংগ্রহে ও সযত্ন সুরক্ষায় রয়েছে।
আব্বার জীবনও শরীয়তের কাটায় উত্তীর্ণ একজন বাস্তব সুফী—সাধকের জীবন ছিল। ঈমান, আখলাক, তাকওয়া, তহারাত এবং মুমিনের কাক্সিক্ষত গুণাবলিতে অলংকৃত জীবনটি তার, বর্তমান সমাজের অনেকটাই তুলনারহিত বলে মনে হয়। আমার নানাজানকে ঠিক একই ক্যাটাগরির শুদ্ধ মানুষ হিসাবে দেখেছি। আমার দাদিজান, নানু এবং আম্মা, খালাম্মা—তারাও মহিলা হিসাবে আল্লাহর নেক বাঁদিদের যে সংজ্ঞা ও পরিচিতি কিতাবে পাই, এর অনুরূপ জীবনরীতির ওপর চলেছেন। তরীকা—তাসাওউফকে যেহেতু জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতি মুহূর্ত আমি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি অতএব এ নিয়ে সংশয়িত হওয়া কিংবা প্রশ্ন তুলে কালক্ষেপণ করার মনোভাব আমার না থাকারই কথা। আলহামদুলিল্লাহ, কোনোদিন ছিলও না।
আমার জন্মের পর আমার একমাত্র মামা, যিনি তখনো ছাত্র ছিলেন, প্রথম ভাগ্নেকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন, যা বুঝতে বা পড়তে আমাকে কমপক্ষে বারো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেটি ছিল আউলিয়াদের জীবনকাহিনি। এর পর থেকে আজও পর্যন্ত আমার অন্যতম ফেভারিট পাঠ্য হচ্ছে আল্লাহওয়ালাদের জীবনী ও বাণী। বোধ জাগ্রত হওয়ার পর থেকে খলীফায়ে থানভী মুজাহিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ. ও আমার দাদা সাহেবকে কাছে পেয়েছি। ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে হযরতের ইন্তেকালের পর আরও ছয় বছর দাদা সাহেবকে পেয়েছি। বয়সে খুব ছোট ছিলাম বলে খুব উপকৃত হতে পারিনি। তবে সান্নিধ্যের ছোঁয়া এবং নিঃশর্ত দুআ অনেক পেয়েছি। তরবিয়ত ও তাওয়াজ্জুহ অনেক ভাগ্যে জুটেছে। দাদাজান কোনো কোনো সময় রসিকতা করে বলতেন, ‘খুব অল্পবয়সি না হলে নাসিমকে আমি এজাযত দিয়ে দিতাম।’ ১৯৮২ সালে দাদাকে হারাই। পরের বছর আরেফ বিল্লাহ হাকীম আখতার রহ. এর হাতে বাইআত হই। এর পর থেকে হযরতের জীবিত থাকা পর্যন্ত সম্পর্ক রেখে চলি। মূলত এ সময়কালে তরীকা—তাসাওউফ সম্পর্কে আমার পড়াশোনা ও অনুশীলন যথেষ্ট অগ্রসর হয়।
এ সময় কিছুদিন কিশোরগঞ্জ ছেড়ে চট্টগ্রামে থাকা হয়। শায়খে তরীকত হযরত হারুন বাবুনগরী, হাজী মুহাম্মদ ইউনুস, হযরত আলী আহমদ বোয়ালভী, মাওলানা সুলতান আহমদ নানুপুরী ও শায়খ মুহাম্মদ ইসহাক (হ্নীলা মাদরাসা)—সহ পটিয়া ও হাটহাজারীর বিশিষ্ট ওলীদের সঙ্গ ও সোহবত লাভের সুযোগ হয়। তারা সবাই আমার নাগালের অনেক ঊর্ধ্বে থাকায় তাঁদের ও আমাদের মধ্যে সেতুবন্ধের জন্য পেয়েছি আমার এক শায়খ ও প্রধান উস্তাদ মাওলানা সুলতান যওক নদভী সাহেবকে। কিছুদিন পর যাওয়া হয় নদওয়াতুল উলামা লখনৌ। সেখানে মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, মাওলানা মানযুর নোমানী, মাওলানা শাহ আবরারুল হক হক্কী, মাওলানা সিদ্দীক আহমদ বান্ধভী ও মাওলানা মাহমুদ আহমদ প্রতাপগড়ী প্রমুখের পদরেণুস্পর্শ লাভ করি। পাকিস্তানে মুফতীয়ে আজম মাওলানা রফী উসমানী, মাওলানা সলীমুল্লাহ খান, মাওলানা আব্দুর রাযযাক ইসকান্দরসহ বেশ কিছু সুলাহার সাক্ষাৎ ও স্নেহে সিক্ত হই। হারামাইন সফরের সময় শাইখুল হাদীস মালিক আব্দুল হাফিজ মক্কী (পরে হযরতের সাথে একাধিকবার ঢাকা ও করাচিতেও সাক্ষাৎ হয়।), রিয়াদের শায়খ আব্দুল আযীয, ইয়ামানের শায়খ আব্দুল্লাহ আব্দুর রহমান আলখাওলানী আলকোরাশী, তুরস্কের শায়খ মাহমুদ আফিন্দী, দামেস্কের শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহসহ সিরিয়া, মিসর, ইরাক ইত্যাদির অনেক সালেহীনের সাক্ষাৎ ও নেক দুআ লাভ করি। মুলতানের দীনপুর শরীফে শায়খ সিরাজুদ্দীন বিশেষভাবে স্নেহাশিস ও দুআ প্রদান করেন। মালয়েশিয়ায় বহুবার হাফেয মাওলানা পীর যুলফিকার আহমদ নকশেবন্দী সাহেবের মজলিসে থাকার সুযোগ হয়। হযরতের সাথে একবার মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সফরেরও সুযোগ হয়। ঢাকায় শায়খে যাত্রাবাড়ি মাওলানা মাহমুদুল হাসানসহ হারদুঈ হযরতের ৮—১০ জন খলীফার বিশেষ মহব্বত, তাওয়াজ্জুহ ও নেগরানিপ্রাপ্ত হই।
আমার প্রথম শায়খ আরেফ বিল্লাহ হযরত হাকীম আখতার রহ. এর কয়েকজন খলীফা আমাকে ভাই ও বন্ধু হিসাবে বিশেষ দুআ ও মনোসংযোগের মধ্যে রেখেছেন। শাইখুল হাদীস মাওলানা এহসানুল হক সন্দ্বীপী ও শায়খে বরুনা মাওলানা লুতফুর রহমান বর্নভী সাহেবানের সিলসিলা থেকে আমি খাস দুআ প্রাপ্ত হই। উল্লিখিত মাশায়েখগণের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত ১১ জন আমাকে ইজাযত ও নিসবত প্রদান করেন। যদিও আমি কোনো দিক দিয়েই এসব স্বীকৃতির যোগ্য ছিলাম না আর এখনো নই। তা ছাড়া নকশেবন্দী তরীকার খাজা আজীজান আলী রামিতানীর মত অনুসারে ‘কোনোদিনই নিজেকে শায়খ বা মুসলেহ বলে মনে করা এ পথের সন্ধানীর জন্য শোভন নয়’—এ নীতি ধরে রাখা নিজের জন্য বেশি উপকারী ও নিরাপদ। একজন তালিবে ইলম ও সালিকে তরীকতের মতো পথের ওপর টিকে থাকাই লক্ষ্য। পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি কেবল দেখতে চান বান্দা পথের ওপর চলতে সচেষ্ট ছিল কি না। যার মৃত্যু পথের ওপর হবে তাকে পথিকরূপে বরণ করা হবে। সালিকদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
ইতিহাসে মুসলিম মনীষীদের এক উর্বর ভূমি মধ্য এশিয়া। যার একটি অংশকে ইসলামজগৎ মাওয়ারাউন নহর নামে স্মরণ করে। খোরাসানের পর সাইহুন ও জাইহুন নদীর উত্তর পারে মাওয়ারাউন নহর। খোরাসানকে আলাদা করে আমু দরিয়া, যা বর্তমানে হিরাত ও কান্দাহারের সীমান্ত। এর পুবদিকে ধীরে ধীরে খায়বর গিরিপথ, সীমান্ত প্রদেশ, লাহোর, মুলতান, পাঞ্জাব, সিরহিন্দ, দিল্লি, পাটনা, কলকাতা হয়ে ঢাকা। মধ্য এশিয়ার মুসলিম অঞ্চলটি কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, আজারবাইজান, চেচনিয়া ইত্যাদি। বাকি আরও কয়েকটি খ্রিষ্টান দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১৫ রাষ্ট্র বিশিষ্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৭ সালে জন্ম নিয়ে ১৯৯১ সালে এর মৃত্যু হয়। সমাজতন্ত্রের ওপর রচিত এ পরাশক্তি আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে এসে পরাজিত ও নিরস্তিত্ব হয়ে যায়। স্বাধীনতা ও পুনর্জন্ম লাভ করে খোরাসান, বলখ, খারেজমসহ গোটা মাওয়ারাউন নহর। যার বুকে আছে বোখারা, সমরকন্দ, তিরমিজ, নাসাফ (যার নতুন নাম কার্শ), শাশ, মারগেনান। ইরানি ভূখণ্ড মিলিয়ে রাই, মারভ, নিশাপুর, ইস্পাহান, শিরাজ, সিজিস্তান, কিরমান, সামনান ইত্যাদি সবই এ অঞ্চলে।
পৃথিবীর কোনো গ্রন্থের সাথে আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআনের তুলনা চলে না। এর পরই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাত ও হাদীসগ্রন্থের স্থান। আমার উস্তাদ, শায়খ ও মুরুব্বী আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী এক জায়গায় লিখেছেন, ‘যদি আমাকে কেউ দেশান্তর করে আজীবনের জন্য নির্জন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয় আর বলে সম্পদ হিসাবে দুটি কিতাব সাথে নিতে পারবে, তা হলে আমি কোনো কিছু না ভেবেই একখানা কোরআন মাজীদ আর যাদুল মাআদ হাতে নিয়ে চলে যাব।’ পাঠের জন্য আমাদের পছন্দও একই ধাঁচের। এরপর যে পঠনসামগ্রী সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তা হচ্ছে সালেহ বান্দাদের জীবন ও বাণী। জীবনে বহুবার আমি নানা অসুস্থতায় শয্যাগ্রস্ত হয়েছি। দীর্ঘ সময় বিছানায় কাটাতে হয়েছে। প্রতিবারই ইতিহাসের নেক বান্দাগণের জীবনী পাঠে আমি দ্রুত সুস্থতা অর্জন করেছি। নতুন প্রাণ ও জীবনীশক্তি লাভে আউলিয়াদের জীবন সুরভি অনন্য। প্রেরণা হিসাবে এটি যেমন অনন্য, আমার মনে হয় আল্লাহর রহমত ও তাঁর পক্ষ থেকে শিফা লাভেরও একটি মাধ্যম তার প্রিয় বান্দাদের জীবনালেখ্য। কারণ, এ সুবাসিত জীবনগুলোও মানবজাতির দেহ ও মনের সুস্থতাস্বরূপ নাযিলকৃত পবিত্র কোরআন শরীফেরই বাস্তবায়িত রূপ। যে জীবনকাহিনি আমার কাছে শিফা, সঞ্জীবনী প্রেরণা ও সুস্থভাবে বাঁচার পরশ বলে অনুভূত হয় সেসব তো নিঃসন্দেহে মূল শিফা পবিত্র কোরআন ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা ও জীবনবোধের জারক রসে সিঞ্চিত।