কওমী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে জাতির দীনি শিক্ষার প্রতিও নজর দিতে হবে
রমযানের পর যথারীতি কওমী মাদরাসার নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। শাওয়ালের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব কওমী মাদরাসা ভর্তির কাজ সম্পন্ন করে। দেশের কম—বেশি ৪০ হাজারের মতো আনুষ্ঠানিক কওমী মাদরাসার শিক্ষাক্রম এ মাসেই শুরু হয়। ছয়টি বোর্ডের আওতায় কওমী মাদরাসা একটি একাডেমিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ। এসবের বাইরে লাখো দীনি শিক্ষাকেন্দ্র এমন আছে, যেগুলো আনুষ্ঠানিক মাদরাসা নয়। তবে দীনি শিক্ষাকেন্দ্র। যেমন তিন—চার লাখ মসজিদে পরিচালিত মক্তব এবং লাখো জায়গায় ব্যক্তি বা উস্তাদকেন্দ্রিক দীনি মক্তব ও মাদরাসা। একজন পুরুষ বা মহিলা শিক্ষক পরিচালিত ঘরোয়া মক্তব বা উঠান মাদরাসা। এসবই কওমী ধারার নীতি অনুসরণ করে চলে।
কওমী মাদরাসা দেশে প্রকৃত আলেম তৈরির উপর জোর দেয় বেশি। মহিলা ও পুরুষ শিক্ষার্থীরা কওমী মাদরাসায় পড়ালেখা শেষ করার পর আলেম হিসাবেই সমাজে দায়িত্ব পালন করেন। তারা সাধারণত দীনি শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখেন। কেউ নতুন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, অনেকেই শিক্ষকতায় যোগদান কেউ আবার সংসার বা অন্য পেশায় গেলেও প্রজন্মের শিক্ষার সাথে যুক্ত থাকবেন। যেসব আলেম মসজিদ মাদরাসার সাথে জড়িত হবেন তারা শিক্ষার্থী বা জনগণ পর্যায়ে শিক্ষার বিস্তারেই লেগে থাকবেন। সমাজকে শিক্ষিত ও আলোকিত করার ক্ষেত্রে জুমার খতিব, ইমাম, তাফসীরকারক, দীনি আলোচক ও মুবাল্লিগদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এ মহান খেদমতটি আরও পরিকল্পিতভাবে করার সুযোগ রয়েছে।
কওমী মাদরাসার মাধ্যমে যে পরিমাণ মানুষ সরাসরি দীনি শিক্ষা অর্জন করছে, এ সংখ্যা মোটেও যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে কওমী আলেম ও শিক্ষার্থীদের আরও বেশি ভূমিকা রাখা চাই। প্রতিটি মুসলমানের প্রাথমিক দীনি চিন্তা—চেতনা, বোধ—বিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনাচার দীনের আলোকে পরিচালনার একটি দায়িত্ব সমাজের আলেম—আলেমা ও ইলম—শিক্ষার্থীদের আছে। নামায শুদ্ধ হওয়া পরিমাণ সূরা কিরাআত, নামাযের অনুশীলন, শরীয়তের জরুরি মাসআলা—মাসায়েলের চর্চা, ব্যবসায়িক লেনদেন ও আচরণের শিক্ষা, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক রীতি—পদ্ধতি, সুন্নত, আদব—কায়দা, শিষ্টাচার—শালীনতা, মানবিক গুণাবলি প্রভৃতি মানুষকে শিখানোর দায়িত্ব আলেম সমাজের। এ কাজটি পরিকল্পিতভাবে করতে হলে আলেমদের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও একতাবদ্ধ হয়ে থাকার বিকল্প নেই। এ কাজ না করলে বাংলাদেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। মানুষ মুসলিম চরিত্র হারিয়ে এক ধরনের পরিচয়হীন, ব্যক্তিত্বহীন এবং নৈতিক চরিত্রহীন জীব হিসেবে আবিভূর্ত হবে। যা ধর্মহীন সমাজে সচরাচর দেখা যায়।
কওমী আলেমগণ যদি তাদের অবস্থানগত জিম্মাদারী পালন করেন, তাহলে মসজিদগুলোকে আরও আবাদ করতে হবে। মসজিদে দীনি গণশিক্ষার প্রচলন করতে হবে। প্রত্যেক আলেম যদি নিজ আওতার মুসল্লী বা সাধারণ মানুষকে ঈমান—আমলের শিক্ষা দেন, হাতে কলমে নামায শিখান, জরুরি সূরা কিরাআত, সুন্নত, আদব, হালাল—হারাম, পাক—নাপাক ও ব্যবহারিক ফিকহ শিক্ষা দেন তাহলে অনানুষ্ঠানিক এ শিক্ষায় সমাজ আলোকিত হয়ে উঠবে। ফরযে আইন, ঈমান—আকীদা, লেনদেনের হালাল—হারাম, পাক—নাপাক, কবীরা গোনাহ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা না থাকলে একজন মানুষ নামেই শুধু মুসলমান থেকে যায়। এই সমাজকে সভ্য, সুশিক্ষিত ও আলোকিত বানানোর একমাত্র স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে তাদেরকে ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলা। এ কাজটি বিশেষভাবে কওমী ওলামায়ে কেরামকেই করতে হবে।
আলেম তিনি কর্মজীবনে যে পেশায়ই থাকেন অবস্থানগতভাবে তিনি সবসময়ই আলেম। তিনি সার্বক্ষণিক শিক্ষক ও নেতা। তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণকে কোরআন—সুন্নাহর আলোকে পথ প্রদর্শন করবেন। এটাই স্বাভাবিক এবং এ শৃঙ্খলার আলোকেই বাংলাদেশের সমাজ গড়ে উঠেছে। মানুষ ইমাম, মুফতী, আলেম, মুহতামিম, ওয়ায়েজ ও বক্তাদের যে কারণে চিরদিন রোল মডেল হিসেবে দেখতে চেয়েছে। যুগে যুগে হক্কানী পীর—মাশায়েখ এ দেশে যে শৃঙ্খলা বিধান ও বিনির্মাণের কাজটি করেছেন। যার ফলে শত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও বাংলাদেশের সমাজ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর আদর্শ সমাজ বা পরিবেশের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ বহুসূচকে শতগুণ এগিয়ে রয়েছে। শত্রু চোখে এসব ধরা পড়বে না। হিংসুকের দৃষ্টিতে যে চিত্র ধরা পড়ে না। বাংলাদেশকে, এ দেশের মানুষকে, এ দেশের মানুষের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে খোলা চোখে দেখলে এ দেশের সৌন্দর্য ধরা পড়বে। এ সৌন্দর্য, এ আলো, এ সম্প্রীতি আলেম—ওলামা, পীর—মাশায়েখের অবদান। মসজিদ, মাদরাসা, মকতব ও খানকার অবদান।
শাওয়াল মাসের শুরুতে নতুন কওমী শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময় গোটা জাতির শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারেও কওমী ওলামা—তলাবাদের ভাবতে হবে। কিছু নৈতিক, মানবিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এমন আছে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায় না। ডিগ্রি লাভের সাথেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু পারিবারিক শিক্ষা এমন আছে, যা বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রিধারীরাও লালন করে না। মানুষ শিক্ষিত হয় পরিবার—সমাজ, মসজিদ—মকতব, ওয়াজ—মাহফিল, তাবলীগ ও উসতায মুরব্বীদের কাছ থেকে।
মসজিদে নববীর আদলে সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তোলার গণমুখী ব্যাপক শিক্ষা কওমী মাদরাসা তার চরিত্রে ধারণ করে আছে। কওমী আলেম—ওলামা ও শিক্ষার্থীগণ নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দেশ জাতি ও সমাজের সামগ্রিক শিক্ষাদীক্ষার প্রতি নজর দিবেন। কওমী নতুন শিক্ষাবর্ষে জাতির এটাই কামনা।
—মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী