কোরবানী : ফযীলত ও জরুরি মাসায়েল
মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
কোরবানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আল্লাহ তাআলার মহান দুই রাসূল হযরত ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ.—এর পবিত্র স্মৃতি। আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্পণের অভূতপূর্ব ঘটনার স্মারক। আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে নিজের প্রিয় থেকে প্রিয়তম ব্যক্তি ও বস্তু, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত কোনো দ্বিধা, সংকোচ, বাহানা ও বিলম্ব ব্যতীত বিলিয়ে দিতে হবে—কোরবানীর ইতিহাস আমাদের সে শিক্ষাই দেয়। এর মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে মুসলিম তথা আল্লাহ তাআলার সামনে আত্মসমর্পণকারী গণ্য হওয়া যাবে।
কোরবানীর ফযীলত
তিরমিযী শরীফে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, কোরবানী কী? অর্থাৎ, কেন আমরা কোরবানী করি?
—এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম আ.—এর সুন্নত ও স্মৃতি।
—আমাদের এতে লাভ কী?
—কোরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে পাবে একটি নেকী।
—অগণিত পশমবিশিষ্ট প্রাণী যেমন বকরি, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির ক্ষেত্রে?
—এসব প্রাণীরও প্রত্যেক পশমের বিপরীতে আল্লাহ তাআলা একটি করে নেকী দেবেন। সুবহানাল্লাহ!
তিরমিযী শরীফের অপর এক হাদীসে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোরবানীর দিনের আমলসমূহের মধ্যে আল্লাহর কাছে কোরবানীর চেয়ে অধিক প্রিয় কোনো আমল নেই। কেয়ামতের দিন ওই পশুকে পশম, শিং ও খুরসহ উপস্থিত করা হবে (যেন নেকীর পাল্লা ভারী হয়)। কোরবানীকৃত পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এ ব্যাপারে খুশি থাকো।
কোরবানী কার ওপর ওয়াজিব
প্রাপ্তবয়স্ক, জ্ঞান—বুদ্ধিসম্পন্ন, মুকীম মুসলমান নর—নারী যদি যিলহজের ১০, ১১ ও ১২—এই তিন দিনের মধ্যে দায়—দেনা ও মৌলিক প্রয়োজনাদির অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে তার ওপর কোরবানী ওয়াজিব হবে।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫
মাসআলা : কোরবানীর নেসাব হলো, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমমূল্যের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে—কোনো সম্পদ।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৩৭
মাসআলা : স্বর্ণ, রুপা, ব্যবসার সম্পদ, টাকা—পয়সা, যে—কোনো ধাতুর অলংকার—সর্বাবস্থায় কোরবানীর নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে। এ ছাড়া অন্যান্য সম্পদ যেমন, আসবাবপত্র, গবাদি পশু ও গাছ—গাছালি এগুলোর যতটুকু জীবন জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে ব্যবহার হয় না তা নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৩৭—৩৩৮; রদ্দুল মুহতার : ২/৩৪৭—৩৪৮
মাসআলা : ঘরে যদি এমন অতিরিক্ত ফল—ফসল থাকে যার ওপর জীবিকা নির্বাহ নির্ভরশীল নয় তাহলে তা নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫; রদ্দুল মুহতার : ২/৩৪৮
মাসআলা : জীবিকা নির্বাহের জন্য যে জমির আয়ের প্রয়োজন হয় না তার মূল্য নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫০৬
মাসআলা : মিরাসের সম্পদ হস্তগত হলে তা নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে। যদিও তা যৌথ হয়।—কিফায়াতুল মুফতী : ৮/১৮০
তবে যদি হস্তগত না হয়; বরং অন্য ওয়ারিশদের দখলে থাকে, তাহলে তা নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে না।—অনলাইন ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৬৬২২৮
মাসআলা : হারাম সম্পদ নেসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং তাকে প্রকৃত হকদারের কাছে পেঁৗছে দেওয়া আবশ্যক। হকদারের সন্ধান না পেলে সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত সদকা করে দেওয়া আবশ্যক।—রদ্দুল মুহতার : ২/২৯১; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫০৬
মাসআলা : অন্যকে প্রদত্ত ঋণ, বিনিয়োগ, আমানত ও জামানত নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে।—আলবাহরুর রায়েক : ২/৪২০; মুহীতে সারাখসী : ৬/৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২৫১, ৫/৩৫৫; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৫৫৩
মাসআলা : ব্যবসার বকেয়া পাওনা নেসাবের অন্তভুর্ক্ত হবে।—আলবাহরুর রায়েক : ২/৪২০; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫১২
মাসআলা : কোনো ব্যক্তি নেসাবের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার হাতে যদি কোরবানীর পশু কেনার মতো অর্থ না থাকে তাহলে তার কাছে যদি সহজে বিক্রয়যোগ্য কোনো বস্তু যেমন, স্বর্ণ, রুপা থাকে, তাহলে তা বিক্রয় করে কোরবানীর ব্যবস্থা করবে। আর যদি এমন কিছু না থাকে এবং কোরবানীর দিনগুলোতে পাওনা টাকাও হাতে না আসে, তাহলে তার কোরবানীর বিধান রহিত হয়ে যাবে।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৫৫; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৫৫৩
মাসআলা : কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে যিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদেক থেকে যিলহজের ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের ভেতর নেসাবের মালিক হওয়া ধর্তব্য হবে। এই সময়ের যে—কোনো অংশে নেসাবের মালিক হলে কোরবানী ওয়াজিব হবে। তবে চূড়ান্ত বিধান হবে শেষ সময় হিসেবে। সুতরাং কেউ যদি শুরুভাগে নেসাবের মালিক থাকে কিন্তু কোরবানী না করে, অতঃপর ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে তার নেসাব বাকি না থাকে—যেমন, সম্পদ চুরি হয়ে গেল—তাহলে তার ওপর থেকে ওয়াজিব বিধান রহিত হয়ে যাবে। আবার কোনো ব্যক্তি যিলহজের ১০ ও ১১ তারিখ নেসাবের মালিক ছিল না কিন্তু ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে নেসাবের মালিক হয়ে গেল, তাহলে তার ওপর কোরবানী ওয়াজিব হয়ে যাবে।—ফাতাওয়া বাযযাযিয়া : ৩/১৫৫; মুহীতে সারাখসী : ৬/৫৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৩৮, ৩৪২
মাসআলা : মুসাফিরের ওপর কোরবানী ওয়াজিব হয় না। তাই যিলহজের ১২ তারিখ দিনের শেষাংশে কেউ মুসাফির অবস্থায় থাকলে নেসাবের মালিক হলেও তার ওপর কোরবানী ওয়াজিব হবে না।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৩৭
মাসআলা : কোনো ব্যক্তি নেসাবের মালিক না হওয়া সত্ত্বেও কোরবানী করল, অতঃপর কোরবানীর সময় থাকতেই নেসাবের মালিক হয়ে গেল, তার পূর্বের কোরবানী যথেষ্ট হবে, পুনরায় কোরবানী ওয়াজিব হবে না।— ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৫৩; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১৬
মাসআলা : হারাম সম্পদ দিয়ে কোরবানীর পশু ক্রয় করা জায়েয নয়। হারাম সম্পদ দিয়ে ক্রয়কৃত পশু কোরবানী করলে তা কবুল হবে না এবং কোরবানীর সওয়াবও পাবে না। তবে তা কোরবানী হয়েছে বলে গণ্য হবে। তাই এর কাযা করা আবশ্যক হবে না।—রদ্দুল মুহতার : ২/২৯১—২৯২; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৫/৫৫৯; অনলাইন ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৭৬২৫৭
শরীকে কোরবানী
মাসআলা : একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কোরবানী করতে পারবে। এগুলোর একটি দ্বারা একাধিক ব্যক্তি কোরবানী করলে কারও কোরবানীই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারও কোরবানী সহীহ হবে না।—সহীহ মুসলিম : ১৩১৮; মুয়াত্তা মালেক : ১০৫৭; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৬—২০৭
মাসআলা : কোরবানীর গরু, মহিষ ও উটে সাতজন শরিক হতে পারে। কারও অংশ এক—সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। সাতজনের কমেও শরিক হওয়া যায়। সাত নাম পূর্ণ করা জরুরি নয়। দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় নামেও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নাম অনুপাতে টাকা দিয়ে শরিক হতে হবে। একজনের অংশ এক—সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না, এমন হলে কারও কোরবানী আদায় হবে না।—সহীহ মুসলিম : ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৫১
মাসআলা : কয়েকজন মিলে কোরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরিকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিশগণ যদি মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানী করার অনুমতি দেয়, তাহলে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরিকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার স্থলে অন্যকেও শরিক করা যাবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩০৯; আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৬
মাসআলা : শরিকে কোরবানী করলে হালাল উপার্জনকারীদের সঙ্গে শরিক হওয়া উচিত।—কিফায়াতুল মুফতী : ৮/১৯০
কোরবানীর সময়
মাসআলা : যিলহজের ১০ তারিখ ঈদের জামাত শেষ হওয়ার পর থেকে কোরবানী করা যায়।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১৮; কিতাবুল মাসায়েল : ২/২৯৫
মাসআলা : শহরের এক জায়গায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পুরো শহরবাসীর জন্য কোরবানী করা জায়েয হয়ে যাবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১১; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৫/৫০৯
মাসআলা : যে গ্রাম এলাকায় জুমআ ও ঈদের নামায সহীহ হয় না তাতে যিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের সময় থেকে কোরবানী করা জায়েয আছে। তবে উত্তম হলো সূর্যোদয়ের পর কোরবানী করা।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৪০—৩৪১; কিতাবুল মাসায়েল : ২/২৯৫
মাসআলা : পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে যিলহজের ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কোরবানী করা জায়েয আছে।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৪১; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২০
অন্যের পক্ষ থেকে কোরবানী করা
মাসআলা : অন্যের ওয়াজিব কোরবানীর খরচ বহন করতে চাইলে কিংবা অন্যের পক্ষ থেকে ওয়াজিব কোরবানী করতে চাইলে ওই ব্যক্তির (যার নামে কোরবানী করতে ইচ্ছুক তার) অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় ওই ব্যক্তির ওয়াজিব আদায় হবে না।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৩৯
মাসআলা : প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে—মেয়ের পক্ষ থেকে মা—বাবা কিংবা অভিভাবক, স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামী যদি নিয়মিত কোরবানী করে, তাহলে নতুন করে অনুমতির প্রয়োজন নেই।—ফাতাওয়া কাযীখান : ৩/২৪৩
মাসআলা : কোনো ব্যক্তি যদি নিজের অর্থ দিয়ে কোরবানীর পশু ক্রয় করে অতঃপর ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে মৃত ব্যক্তির নাম নির্ধারণ করে তা কোরবানী করে তাহলে মৃত ব্যক্তি এর সওয়াব পাবে। তবে কোরবানী আদায় হবে পশু মালিকের পক্ষ থেকে। তাই পশুর মালিকের ওপরে কোরবানী ওয়াজিব থাকলে এর দ্বারা তা আদায় হয়ে যাবে।—ফাতাওয়া কাযীখান : ৩/২৪৮
মাসআলা : মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত কিংবা মান্নত পূরণার্থে তার রেখে যাওয়া টাকায় কোরবানী করা হলে তার গোশত গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে।—ফাতাওয়া কাযীখান : ৩/২৪৭—৪৮
মাসআলা : বিদেশে অবস্থানরত কারও পক্ষ থেকে কোরবানী করলে পশু যেখানে জবাই হবে সেখানের সময় ধর্তব্য হবে। তবে যার পক্ষ থেকে কোরবানী করবে তার জায়গায় যিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদেক হতে হবে। সুতরাং যখন বাংলাদেশে যিলহজের ৯ তারিখ এবং সৌদি আরবে ১০ তারিখ থাকবে, তখন বাংলাদেশির পক্ষ থেকে সৌদি আরবে কোরবানী সহীহ হবে না। তবে যখন সৌদি আরবে ১৩ তারিখ এবং বাংলাদেশে ১২ তারিখ থাকবে তখন সৌদি আরববাসীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে কোরবানী করা সহীহ হবে।—কিতাবুল মাসায়েল : ২/৩০১—৩০২
কোরবানীর পশু
মাসআলা : ছাগল, ভেড়া, দুম্বা নর হোক বা মাদি এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি। এক বছরের কমে কোরবানী সহীহ হবে না। তবে ছয় মাসের দুম্বা বা ভেড়া যদি দেখতে এক বছরের মতো মনে হয়, তাহলে তার দ্বারা কোরবানী করা জায়েয। ছাগলের ক্ষেত্রে অবশ্যই বছর পূর্ণ হতে হবে।—আল বাহরুর রায়েক : ৯/৩২৫
মাসআলা : গরু, মহিষ নর হোক বা মাদি, দুই বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত। তার চাইতে এক দিন কম হলেও কোরবানী সহীহ হবে না।—আল বাহরুর রায়েক : ৯/৩২৫; তাবয়ীনুল হাকায়েক : ৬/৪৮৪
মাসআলা : যে পশুর উপযুক্ত বয়স হয়েছে তার যদি বয়স অনুপাতে দাঁত না ওঠে, তবুও তার কোরবানী সহীহ হবে।—কিফায়াতুল মুফতী : ৮/২১৭; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫২০
মাসআলা : এমন খোঁড়া বা ল্যাংড়া জানোয়ার যা এক বা একাধিক পায়ে ভর করতে পারে না, তার দ্বারা কোরবানী করা জায়েয হবে না।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/২৯৭; তাবয়ীনুল হাকায়েক : ৬/৪৭৯
মাসআলা : পুড়ে যাওয়ার কারণে যদি কোনো প্রাণীর পশম না গজায় এবং অন্য কোনো ক্ষত বা জখম না থাকে, তাহলে এর দ্বারা কোরবানী জায়েয।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৩; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫১৭
মাসআলা : যে মহিষের কাঁধে বা নিতম্বে হালচাষ বা প্রহারের কারণে দাগ বা ঘা হয়, তা দ্বারাও কোরবানী করা জায়েয।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৩; তাবয়ীনুল হাকায়েক : ৬/৪৭৯; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫১৭
মাসআলা : যে গরুর জন্মগতভাবে শিং নেই বা ভেঙে গেছে তার দ্বারা কোরবানী জায়েয। তবে যদি আঘাত মগজ পর্যন্ত পেঁৗছে যায়, তাহলে তার কোরবানী জায়েয নেই।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৩; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫০১
মাসআলা : কোনো গাভির ওলানের এক বেঁাটা কাটা থাকলে তার দ্বারা কোরবানী জায়েয। কিন্তু একাধিক বেঁাটা কাটা থাকলে জায়েয নেই। আর ছাগলের এক বেঁাটা না থাকলে তা দ্বারা কোরবানী জায়েয নেই।—ফাতাওয়া শামী : ৬/৩২৪; কাযীখান : ৩/২৪৯
যে পশুর সকল বা অধিকাংশ দাঁত না থাকার কারণে খাবার চিবাতে পারে না তা দ্বারা কোরবানী জায়েয হবে না। তবে দাঁত না থাকা সত্ত্বেও খাবার চিবাতে সক্ষম হলে কোরবানী সহীহ হবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১৫—২১৬; মুহীতে সারাখসী : ৬/৬১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৪৪; আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫১৪,৫২০
মাসআলা : কোরবানী করার আগেই যদি ওয়াজিব কোরবানী আদায়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশুর পা ভেঙে যায়, তাহলে আরেকটি সুস্থ পশু ক্রয় করে কোরবানী করা আবশ্যক।—আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৫; কিফায়াতুল মুফতী : ৮/১৯১
মাসআলা : পশু যদি মোটা হওয়ার কারণে জবাইর স্থান পর্যন্ত যেতে না পারে, তাহলে এর দ্বারা কোরবানী করতে সমস্যা নেই।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া; ৫/৩৪৫; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ২৬/২৬৫
মাসআলা : যে পশুর জন্ম থেকেই কান নেই কিংবা কান আছে, কিন্তু এক—তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে বেশি কাটা, তার দ্বারা কোরবানী জায়েয নেই।—হিদায়া : ৪/৪৪৭; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৩
মাসআলা : জন্ম থেকে কান আছে কিন্তু ছোট ছোট, এমন পশু দ্বারা কোরবানী করা জায়েয।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৪
কোরবানীর পশু জবাই
মাসআলা : একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং ইবাদত মনে করে কোরবানীর পশু জবাই করবে। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে জবাই করবে না।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩০৪; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৮
মাসআলা : কোরবানীর পশু জবাইয়ের আগে এ দুআ পড়বে,
اِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمٰوَاتِ وَالْاَرْضَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا وَمَا اَنَا مِنْ الْمُشْرِكِيْنَ اِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لَا شَرِيْكَ لَه وَبِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ بِسْمِ اللهِ وَاللهُ اَكْبَرُ اللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ
—মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং : ১৫০২
মাসআলা : জবাইকারী ব্যক্তি কোরবানীর পশু জবাই করার সময় দাতার নাম না জানলে কিংবা না পাঠ করলেও কোরবানীদাতার ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।—ফাতাওয়া কাযীখান : ৩/২৫০
মাসআলা : জবাই করার সময় পশুকে অহেতুক কষ্ট দেওয়া মাকরুহ। তাই জবাই করার আগে ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেবে। যখন চারটি রগ কেটে যাবে তখন ছুরি চালানো বন্ধ করে দিতে হবে।—আবু দাউদ : ২/৩৩; আদ্দুররুল মুখতার : ৯/৩৫৬
মাসআলা : জবাইয়ের জন্য প্রস্তুত করার সময় কোনো ত্রুটি বা ক্ষত সৃষ্টি হলো, যেমন : পা ভেঙে গেল বা চোখে আঘাত লাগল, এতে কোরবানীতে কোনো অসুবিধা নেই।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/২৯৯
মাসআলা : কোরবানীর পশু জবাই করে টাকা নেওয়া জায়েয। (তবে পূর্ব থেকে পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করলে জবাইকারী টাকার হকদার হবে না।)—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৪৫৪
কোরবানীর পশুর গোশত
মাসআলা : কোরবানীদাতার জন্য নিজ কোরবানীর গোশত খাওয়া মুস্তাহাব।—সূরা হজ : ২৮
মাসআলা : অমুসলিমকে কোরবানীর গোশত হাদিয়া দেওয়া জায়েয।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩০০; ইলাউস সুনান : ১৭/২৮৮
মাসআলা : জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। তবে চুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে দেওয়া জায়েয।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৮; ইলাউস সুনান : ১৭/২৬৩ ও ২৬৭; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৫
গোশত বণ্টন
মাসআলা : কয়েকজন মিলে গরু বা উট কোরবানী করলে ওজন হিসেবে গোশত বণ্টন করা আবশ্যক। তবে যদি গোশত ও হাড়কে একসঙ্গে মিশ্রিত করে বণ্টন করে তাহলে অনুমান করে বণ্টন করা জায়েয হবে।—ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১৭/৪৫৫
মাসআলা : একই ঘরের কয়েক ব্যক্তি মিলে বড় পশু কোরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করা আবশ্যক নয়।—রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১৭
মাসআলা : কোরবানীর দিনে পশু কোরবানীর পরিবর্তে পশু অথবা পশুর মূল্য সদকা করলে কোরবানী আদায় হবে না।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া—৫/৩৩৯
মাসআলা : কোনো ধনী ব্যক্তি কোনো কারণে কোরবানীর দিনগুলোতে কোরবানী করতে না পারলে, তার ওপর কাযা ওয়াজিব হবে। জীবিত পশু ক্রয় করে সদকা করে দেবে বা তার সমমূল্য সদকা করে দেবে। আর যদি কোরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করে থাকে আর তা কোরবানী না করে তাহলে ওই পশুই সদকা করতে হবে।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৩৯
কোরবানীর পশুর চামড়া
মাসআলা : যারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত তারাই চামড়ার মূল্য পাওয়ার উপযুক্ত। অর্থাৎ মুসলমান ফকির—মিসকিন এবং এতিমখানা ও দ্বীনি মাদরাসার গরিব অভাবগ্রস্ত ছাত্ররা।—রদ্দুল মুহতার : ৩/২৮৩; মাজমাউল আনহুর : ৪/১৭৫; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ২৬/৩৭২; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৫/৫৯১
মাসআলা : বে—ওয়ারিশ মাইয়েতের কাফন—দাফনে কোরবানীর চামড়ার মূল্য দান করা জায়েয নেই।—রদ্দুল মুহতার : ৩/২৯৩; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৫/৫৯৬
মাসআলা : কোরবানীর চামড়ার মূল্য অমুসলিমকে দেওয়া জায়েয নেই।—রদ্দুল মুহতার : ৩/২৯৩; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৫/৬০১
কোরবানীর পশুতে আকীকার অংশ
মাসআলা : কোরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। এতে কোরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।—তাহতাবী আলাদ্দুর : ৪/১৬৬; রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৬; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৯; ফাতাওয়া কাযীখান : ৩/২৪৭