গোটা দেশবাসীর আশীর্বাদে ধন্য একজন টিটিই শফিকুল
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
ঘটনাটি ঈদের ছুটির। কীভাবে যেন এখন প্রতি বছরই ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে একটা দীর্ঘ ছুটিতে যায় পুরো দেশ। এবার ছুটি হলো অনেকের জন্যেই নয় দিনের। কারও কারও জন্যে দুই দিন কম। এ ছুটিতে, গত ৫ মে ২০২২ তারিখে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন টিটিই শফিকুল ইসলাম। এরপর একজন যাত্রীর অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল আলোচনা। আলোচনা তো নয়, বরং সমালোচনা। অবশেষে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ১০ মে ২০২২ তারিখে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে তিনি আবারও দায়িত্ব পালনের জন্যে ট্রেনে চড়েন। এ চার-পাঁচ দিনেই তিনি হয়ে যান টক অব দ্যা কান্ট্রি। সততা ও সাহসিকতার নায়ক হিসেবে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। ধন্য তিনি গোটা দেশবাসীর আশীর্বাদে।
আসলে কী ঘটেছিল সেদিন—এ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন : টিকিট ছাড়াই পাবনা থেকে ঢাকামুখী ট্রেন উঠে এসি কামরায় বসেছিলেন তিন যাত্রী। ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) এলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন তারা। তখন টিটিই বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য তাদের কাছ থেকে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করেন। পাশাপাশি এসি কামরাও ছাড়তে হয় তাদের। গত বৃহস্পতিবার রাতের এ ঘটনার পর ওই টিটিইকে মুঠোফোনে বরখাস্ত করার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। শুক্রবার তিনি আর কাজে যোগ দিতে পারেননি। বরখাস্ত হওয়া টিটিই হলেন মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি পশ্চিম রেলের সদর দপ্তর ঈশ্বরদীতে সংযুক্ত। শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা ওই তিন যাত্রীর কাছে টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। পরে তাদের এসি কামরা থেকে শোভন কামরার টিকিট দেওয়া হয়। এই অপরাধেই আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’ রেলওয়ের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর তিন ভাগনে বৃহস্পতিবার রাতে ঈশ্বরদী থেকে ঢাকামুখী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়েন। টিকিট ছাড়াই এসি কামরায় বসেছিলেন তারা। টিকিট পরিদর্শক টিকিট চাইলে তারা সুলভ (শোভন) কামরার তিনটি টিকিট দিতে বলেন। একই সঙ্গে এসি কামরা খালি থাকায় সেখানে বসে ভ্রমণের আবদার করেন। তখন টিটিই তাদের জরিমানা ও সুলভের ভাড়া বাবদ মোট ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়ে এসি কামরা ছাড়তে বলেন। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে ওই তিন যাত্রীর কথা কাটাকাটি হয়। এরপর তারা এসি কামরা ছেড়ে শোভন কামরাতেই ঢাকায় পৌঁছান। কিছুক্ষণ পরই মুঠোফোনে টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের কথা জানানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পশ্চিম রেলের পাকশী বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জরিমানা করার জন্য তাকে বরখাস্ত করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে তিন যাত্রীকে হয়রানি ও অশোভন আচরণ করার অভিযোগ পাওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। যথাযথ জবাব দিতে পারলে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হতে পারে। তবে টিটিই শফিকুল ইসলাম বলেছেন, তিনি ওই তিন যাত্রীর সঙ্গে কোনো অশোভন আচরণ করেননি। [প্রকাশ : ৭ মে ২০২২, ০০ : ২৯]
যে যাত্রীর হাতের লেখা একটি অভিযোগে টিটিই বরখাস্ত হলেন, সেটাতে কী ছিল—এ নিয়ে পত্রিকার রিপোর্ট : ‘অভিযোগপত্রে ওই যাত্রী দাবি করেছেন, তিনি ৫ মে দিবাগত রাত ২টা ১৫ মিনিটে কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে ট্রেনে ওঠেন। এরপর টিটিই এসে তাদের কাছে টিকিট চান। তিনি টিকিট পাননি বলে জানান। পরে টিকিট দিতে বললে টিটিই তিনজনের ভাড়া বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করেন। ৩০০ টাকার টিকিট ৫০০ কেন, জানতে চাইলে তিনি ৩ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে টিকিট নিতে হবে বলে জানান। এত টাকা দেওয়া সম্ভব না বলাতে টিটিই ক্ষেপে যান। তিনি বকাবকি করেন। ওই যাত্রীর দাবি, টিটিই মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি তার শাস্তি দাবি করেন।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিসিও নাসির উদ্দিন বলেন, টিটিই শফিকুল ইসলাম হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তিনি এর আগেও যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। ফলে, যাত্রীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। [প্রথম আলো, প্রকাশ : ৭ মে ২০২২, ১৫ : ৪৩]
অল্প সময়ে অনেক কিছুই তো ঘটে গেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একে ‘রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ’ বললেও হয়তো ভুল হবে না। অনলাইন-অফলাইন পত্রিকা থেকে পাওয়া কয়েকটি ধারাবাহিক শিরোনাম পড়ুন—
রেলমন্ত্রীর আত্মীয়কে জরিমানা করা টিটিই বরখাস্ত [দেশ রূপান্তর], টিটিই শফিকুল মানসিক সমস্যায় ভুগছেন : রেলওয়ে কর্মকর্তা [আমাদের সময়], বিনা টিকিটে ট্রেনে : তদন্ত কমিটিকে ব্যাখ্যা দেবেন বরখাস্ত টিটিই [বিডিনিউজ২৪], টিটিই বরখাস্ত নিয়েও কিছু জানতাম না : রেলমন্ত্রী [বিডিনিউজ২৪] বিনা টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই : রেলমন্ত্রী [আজকালের খবর], রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনেই বরখাস্ত হন টিটিই শফিকুল! [রাইজিংবিডি.কম], মাদকসেবন তো দূরের কথা, ধূমপানও করি না : টিটিই শফিকুল [দেশেবিদেশে], টিকিটবিহীন যাত্রীর সঙ্গে আত্মীয়তা স্বীকার করলেন মন্ত্রী, টিটিইর বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার [বিডিনিউজ২৪], টিটিই শফিকুল বললেন ‘শুকরিয়া’ [বিডিনিউজ২৪], মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় টিটিইকে বরখাস্ত করা সমীচীন নয় : হাছান মাহমুদ [বিডিনিউজ২৪], মন্ত্রীর স্বজন হলেও বাড়তি সুবিধা দেবেন না, নির্দেশ রেলকর্মীদের [বিডিনিউজ২৪], সাংবাদিকেরা বাড়াবাড়ি করেছে, দাবি রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নের [বিডিনিউজ২৪], সাংবাদিকেরা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন : টিটিই শফিকুল [এনটিভি], কর্মস্থলে টিটিই শফিকুল [বিডিনিউজ২৪], সেই টিটিই শফিকুল ২৯ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করলেন ৯ ঘণ্টায় [ইনকিলাব]।
আমাদের এ দেশে যারা নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন, তাদের কাছে টিটিই (টিটি) একটি অতিপরিচিত শব্দ। নিজস্ব ইউনিফর্ম পরে তারা আসেন তাদের ভ্রাম্যমাণ অফিসে, ট্র্রেনে। তারা ভ্রাম্যমাণ টিকিট চেকার। যাত্রীদের টিকিট চেক করা তাদের দায়িত্ব। তারা টিকিট চেক করেন। যাদের টিকিট থাকে না, তাদের টিকিট করিয়ে দেবেন—এটাই তাদের কাজ। তবে এ কাজের বাইরেও তাদের কেউ কেউ আরেকটি কাজ করে থাকেন অঘোষিতভাবে—টিকিট না দিয়ে মূল ভাড়ার কম-বেশি কিংবা নামমাত্র কিছু নিয়ে তারা যাত্রীদের ভ্রমণের সুযোগ করে দেন। ৬০ টাকার ভাড়া জরিমানাসহ যদি ১২০ টাকা হয়, তবে তাদেরকে কেউ কেউ ২০-৩০ টাকা দিয়েও পার পেয়ে যায়। দুর্নীতি আর অনিয়ম অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও বাসা বাঁধে। ধীরে ধীরে এটাই যেন একটা নিয়মে পরিণত হয়। যারা টিকিট কাটার তারা টিকিট কাটবে। যারা কাটবে না, তারা আরও অনেক কম টাকায় গন্তব্যে চলে যাবে। ভ্রমণের সুবিধাভোগের ক্ষেত্রে টিকিট কাটা আর না কাটার কোনো পার্থক্যই যেন নেই। এরপরও সব জায়গায়ই তো কিছু ভালো মানুষ থাকেন। মাঝেমধ্যে অসংখ্য খারাপ মানুষের ভিড়েও গুটিকয়েক ভালো মানুষ নিজেদের সংগ্রাম চালিয়ে যান ন্যায়, সততা ও মানবিকতার পক্ষে। সমাজের অন্যায় রক্তচক্ষুকে তারা উপেক্ষা করেন। করুণ কণ্ঠের অবৈধ সকল আবদারকে তারা অগ্রাহ্য করেন। অন্যায় দাবি পায়ে মাড়িয়ে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলেন নিজেদের নৈতিকতার মিশনে। ট্রেনের নিয়মিত যাত্রায় আমরা মাঝেমধ্যে এমন সাহসী উদ্যমী নীতিবান টিটিইর সাক্ষাৎ-ও পেয়ে যাই। যারা টিকিট করে ট্রেনে চড়েন, তারা এ টিটিইদের আচরণে আশান্বিত হন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যারা অনন্যোপায় হয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠেন, তারা এ টিটিইদের কাছ থেকে টিকিট করিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করেন। এ নীতিবান টিটিইরা যখন আসেন টিকিট চেকে, তখন তাদের সঙ্গে যাত্রীদের কিছুটা কথা কাটাকাটি দেখেও আমরা অভ্যস্ত। জরিমানা কেন দেব, এত টাকা নেবেন কেন, আমার কাছে টাকা নেই—এমন নানা কথা টিটিইদের শুনতে হয়। তারা কখনো অল্প কথায় জবাব দেন, কখনো নিজেদের দায়িত্ব পালন করে সরে পড়েন। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক, টিকিট না কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করা অন্যায়। সে অন্যায় প্রতিবিধানের সুযোগ আছে। টিটিইদের কাছ থেকে একটু বেশি টাকা দিয়ে টিকিট করিয়ে নেওয়া যায়। বিনা টিকিটের যাত্রীদের এভাবে একটু বেশি টাকা নিয়ে টিকিট করিয়ে দেওয়া টিটিইদের দায়িত্ব। এটা রেলওয়ের আইন। এ আইন নিয়ে কথা হতে পারে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় টিকিট করা সম্ভব হয় না। ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী, অথচ টিকিট কাটা নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়নি, এমন কাউকে আমাদের এ দেশে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ডিজিটাল টিকিট যখন থেকে চালু হয়েছে, তখন থেকে শুরু হয়েছে ডিজিটাল সমস্যা। ট্রেন ছাড়ার সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ট্রেন এখনো ছেড়ে যায়নি। এ সময় টিকিট করতে গেলে বলা হতো—টিকিট দেওয়া যাবে না। স্টেশন, কাউন্টার, ট্রেন, যাত্রীর আগ্রহ—সবই আছে। কিন্তু শুধুই সিস্টেমের কারণে অনেকে টিকিট কাটতে পারতেন না। আবার ট্রেনে উঠলে টিটিই এসে হাজির। বৈধভাবে টিকিট নিতে চাইলে জরিমানা গুণতে হবে, অন্যথায় টিটিইকে ‘চা খাওয়ার টাকা দিয়ে’ নিজে অন্যায়ে জড়াতে হবে এবং আরেকজনকেও অন্যায়ে জড়াতে হবে। আর এখন তো আসনবিহীন টিকিট ইস্যুই করা হয় না। আবার ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরও অভাব থাকে না। রেলের যাত্রীদের এমন নানা অসংগতি নিয়মিতই দেখতে হয়। এত অসংগতির ভিড়ে টিকিটবিহীন একজন ‘অবৈধ’ যাত্রীর কাছ থেকে আইন মেনে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করতে গিয়ে টিটিইকে প্রায়ই একটু তর্কে জড়িয়ে যেতে হয়। তবে এটাকে কেউ অশোভন আচরণ মনে করেন না। যিনি জরিমানা দিলেন, তার একটু কষ্ট লাগতেও পারে। কিন্তু মোটের ওপর বলা যায়, এমন টিটিই যখন আসেন, তখন স্বস্তিবোধ করেন সকলেই। যারা টিকিট নিয়ে ট্রেনে আসেন, তারাও। যারা টিকিট কাটতে চেয়েও পারেননি, তারাও। টিটিই শফিকুল ইসলাম গোটা দেশবাসীর কাছেই এখন একজন নীতিবান মানুষ। তিনি নীতি সাহসিকতা ও আদর্শের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমি ট্রেনে নিয়মিতই যাতায়াত করি। করোনার প্রথম ধাক্কায় যখন সব ধরনের ট্রেন বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন, এরপর আবার চালু হলো, তখন ট্রেন এলো নতুন রূপে। স্টেশন ঝকঝকে, কমলাপুর স্টেশনে ঢুকতেই হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা, মানুষের ভিড় নেই। ট্রেনও ফাঁকা ফাঁকা। অর্ধেক আসনে যাত্রী। কদিন পর থেকে অবশ্য সব আসনেই যাত্রী পরিবহণ শুরু হয়। সে সময়ের কথা। একদিন যাচ্ছি ট্রেনে করে। টিটিই এসেছেন। কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে তিনি টিকিট করিয়ে দিচ্ছেন। ৬০ টাকার টিকিট জরিমানাসহ ১২০ টাকা। একজন দিল ৫০ টাকা। তিনি দাবি করলেন, তার কাছে আর টাকা নেই। টিটিই তার এ কথাটা বিশ্বাস করলেন। এমন পরিস্থিতিতে হাতে থাকা টিকিটের বইয়ে টাকাটা গুজে সামনে এগিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। সমাজের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাকে তেমন কোনো অন্যায়ও মনে হবে না। কিন্তু এ টিটিই টাকাটা ফেরত দিয়ে চলে গেলেন। টিকিট দেবেন না, তো টাকাও নেবেন না। তার নাম আমি জানি না। তবে তিনিও আরেক ‘শফিকুল’। এ শফিকুলদের আশায়ই পথ চেয়ে আছে বাংলাদেশ।
টিটিই শফিকুল ইসলামের এ একটিমাত্র ঘটনাতে ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজের নানা অসংগতির চিত্র। মোটা দাগের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করি—১. বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করতে চেষ্টা করা কিংবা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সিস্টেম-জটিলতার কারণে যাত্রীদের টিকিট কাটায় অসুবিধে, ২. আইন অমান্য করার প্রবণতা, ৩. ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্কের নাম ভাঙিয়ে অন্যায় সুবিধা লাভের প্রবণতা, ৪. ক্ষমতার জোরে অধীনস্থদের অন্যায় শাসন করা, ৫. ক্ষমতাসীন কারও কাছের মানুষ বলে আইনের জোর না থাকলেও ক্ষমতার জোর খাটানোর চেষ্টা করা, ৬. কাছের মানুষের কোনো অন্যায়কেও অন্যায় না বলার প্রবণতা, ৭. ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে কাছের মানুষের পক্ষ নেওয়া এবং এ পক্ষপাতিত্বের ফলে যতটা সম্ভব অন্যায় শাসন চাপিয়ে দেওয়া, ৮. মিথ্যা অভিযোগ করা, ৯. ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাসীনের কাছের কারও অন্যায় আদেশকে আইনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা…। কথা হলো, এতসব অসংগতি যদি একটি ঘটনাতেই থাকে, তবে এ কথা বলার আর সুযোগ কোথায়—‘আইনের চোখে সবাই সমান’?
তবুও আমরা আশাবাদী, প্রিয় এ বাংলাদেশে কিছু ‘শফিকুল’ আছেন। সংখ্যায় হয়তো তারা সামান্য, ক্ষমতায়ও তারা দুর্বল, হেঁটে হেঁটে যাত্রীদের টিকিট চেক করার মতো কষ্টকর দায়িত্ব তাদের পালন করতে হয়। শুধু তাই নয়, তাদের হাতে অর্জিত হয় দেশের লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। আমরা আশায় বুক বাঁধি, এ শফিকুলদের হাত ধরেই এগিয়ে আসবে আরও অনেক শফিকুল। তাদের হাতে গড়ে উঠবে সোনার বাংলাদেশ। নীতি-নৈতিকতায় আমরা এগিয়ে যাব বহুদূর। দুর্নীতির কালিমা ঝেড়ে ফেলে ধুয়ে-মুছে আমরা বুক টান করে বলতে পারব ন্যায়ের কথা, আদর্শের কথা। আমাদের ক্ষমতাসীনেরা বাস্তবিক অর্থেই নিজেদের মনে করবে জনগণের সেবক। নিজেদের কাছের কেউ, এমনকি পরিবারের লোকেরা অন্যায় করলেও ক্ষমতার দাপট দেখানোর সাহস করবে না কেউ। আইন চলবে আইনের গতিতে। আইনের চোখে ধনী-গরীবের তারতম্য থাকবে না। মন্ত্রীর আত্মীয় কেন, মন্ত্রী নিজেকেও চলতে হবে দেশের আইন মেনে। আর দেশের প্রতিটি অফিসে, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে আদর্শ ও নৈতিকতায় উজ্জীবিত তরুণ-যুবকেরা নির্ভয়ে অদম্য সাহসিকতায় পালন করবেন নিজেদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব। কোনো ক্ষমতাসীনের আত্মীয় বলে অবৈধ সুবিধাভোগ তো দূরের কথা, অন্যায় করে ক্ষমতাসীন কারও নাম বলারই সাহস করবে না কেউ। আমরা এমন একটি দেশেরই আশা করি, যে দেশের প্রতিটি নাগরিক কর্মে ও বিশ্বাসে লালন করবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী—
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهْوَ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। শাসক দায়িত্বশীল, তাকে তার প্রজাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামীর বাড়িতে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। কর্মচারী তার মালিকের সম্পদের বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৯৩