গোনাহের ক্ষতি
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.
ভাষান্তর : মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল
হামদ ও সালাতের পর।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযাদার প্রসঙ্গে বলেন,
مَن لم يَدَعْ قول الزُّور والعملَ به، فليس للهِ حاجةٌ أن يَدَعَ طعامه وشرابه.
যে ব্যক্তি মিথ্যা ও তদনুযায়ী আমল পরিহার না করে, তার পানাহার বর্জন আল্লাহ পাকের নিকট কোনো গুরুত্ব রাখে না।
এটি বড় একটি হাদীসের টুকরো, না পূর্ণ হাদীস, না তার কাছাকাছি শব্দ? পরিষ্কার মনে পড়ছে না। যাই হোক, রোযাদার প্রসঙ্গে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি বাণী। যেমনটা এইমাত্র তরজমা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল। রমযানের পূর্বে যদিও আরেকটি জুমা আছে যাতে রমযান প্রসঙ্গে আলোচনা যথোচিত হতো কিন্তু তখন আমি সফরে থাকব বিধায় আজই রমযান প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে জরুরি কিছু বিষয় আলোচনা করছি। ঘটনাক্রমে পূর্বকৃত ওয়াদার কারণে এর সঙ্গে এমন একটি বিষয় আলোচিত হবে, যা বহুদিন যাবৎ আলোচনা করব বলে চিন্তা করছিলাম, কিন্তু আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছিল তা খুব একটা সহজবোধ্য না হওয়ায় এমন অন্য বিষয়ের সঙ্গে আলোচিত হবে যা সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহীও বটে।
গোনাহের ফলে নেক কাজের বরকত কমে যায়
সে বিষয়টি হলো এই—একবার এক আলোচনায় সংক্ষিপ্তভাবে দাবি করেছিলাম ইবাদত—বন্দেগী সহীহ হওয়াটা সব ধরনের গোনাহ পুরোপুরি বর্জন করার উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ বিষয়টা এমন নয় যে গোনাহের কাজ করার পাশাপাশি নেক কাজ করলে তা সহীহ হবে না। তবে নেক কাজের বরকত ও সওয়াব অতি অবশ্যই কমে যায়।
অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি নামাযও পড়ে, গীবতও করে, তাহলে গীবতের মতো কবীরা গোনাহে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তার নামায সহীহ হয়নি বলা হবে না। যেমনটা আজকাল কিছু মানুষ মনে করে থাকে, যখন গোনাহ ছাড়তে পারছি না তখন নেক কাজ করে কী লাভ? তদুপরি এরা গোনাহ বর্জনকে নিজেদের পক্ষে কঠিন মনে করে; তাই তারা নেক কাজই ছেড়ে দেয়। গোনাহ বর্জনের চেষ্টা করে না। দেখুন কী মারাত্মক ক্ষতি! এ ধরনের লোকদের কখনো নেক কাজের তাওফীকই হয় না। এমনকি এরা ঈমান ছেড়ে দিলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। কেননা গোনাহ করতে করতে এহেন মনোভাব সৃষ্টি হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয় যে, নাজাতের তো আশাই নেই তাই ঈমানেরই আর কী দরকার।
গোনাহের ফলে নেক কাজ বৃথা যাবে না
তাই এ বিষয় আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যদি গোনাহও করে নেক কাজও করে তাহলে গোনাহের শাস্তি আলাদা হবে আর নেক কাজের সওয়াবও আলাদা পাবে। গোনাহের কারণে নেক কাজ সব বিফলে যাবে, কোনো সওয়াব হবে না—এমনটা হবে না। তাই কোনো অবস্থাতেই ইবাদত ও নেক কাজ তরক করা যাবে না। তো এ বিষয়টি আলোচনার কারণ হলো, কতিপয় লোকের ওই বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা যা এইমাত্র উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা বর্তমানে মানুষের যে উদাসীনতা সে বিবেচনায় এ আলোচনা না তোলাই সমীচীন ছিল। কেননা যদি এই বিশ্বাস থাকত, গোনাহ করলে ইবাদত সহীহ হবে না তাহলে হয়তো এই ভয়ে গোনাহ বর্জনের চেষ্টা করত এবং তা থেকে তওবা করে আত্মরক্ষা করত, যাতে ইবাদত—বন্দেগী সহীহ হয়। আর এ আলোচনা দ্বারা আরও উদাসীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, গোনাহ বর্জন ছাড়াই যদি ইবাদত সহীহ হয়ে যায় তখন গোনাহ বর্জন তেমন আহামরি কিছু নয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় চরম হতাশা ও নিরাশার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে আর নিরাশার ক্ষতি বড় মারাত্মক। কেননা যদি এই অমূলক ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, গোনাহ ছাড়তে না পারা অবস্থায় আমার সকল ইবাদত বেকার তাহলে সে গোনাহ করতেই থাকবে আর অবশ্যপালনীয় ফরয আমল যথা নামায, রোযা সবই ছেড়ে দেবে। তো দেখুন এটা কত মারাত্মক ক্ষতি। অথচ উদাসীনতা এতটা আশঙ্কাজনক নয়। কেননা এতে বড়জোর এটুকু হবে যে, গোনাহ বর্জনের তাওফীক হবে না। তবে অবশ্যপালনীয় ফরয আমলগুলো পালন করতে থাকবে, যাতে ইসলামের শান ও মর্যাদা প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে নিরাশ অবস্থায় নামায, রোযা ইত্যাদির উপর প্রভাব পড়বে অর্থাৎ এসব ছেড়ে দেবে।
এ হলো আমলের উপর নিরাশার প্রভাব তথা ইসলামের শান ও শোভা প্রকাশ পায় যেসব আমল দ্বারা সেসব আমলও ছুটে যাবে। আর আকীদা ও বিশ্বাসের উপর এই প্রভাব পড়বে যে, আল্লাহ পাকের অসীম দয়া ও মাগফেরাত থেকে নিরাশ হয়ে যাবে। কেননা সাদা চোখে কেবল গোনাহের স্তূপই নজরে পড়বে। নেক কাজের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাবে না। ফলে শয়তান নিরাশ করে দেওয়ার মহাসুযোগ পেয়ে যাবে যে, মুক্তি ও নাজাতের পথই নেই। যদি এই নিরাশা নিয়ে মৃত্যু এসে পড়ে তাহলে কুফরের অবস্থায় মৃত্যু হবে। এমন ব্যক্তি আপন গোনাহ থেকে তওবাও করবে না। কেননা নাজাত ও মুক্তির ব্যাপারে নিরাশার চরমে পেঁৗছে গেছে। ক্ষতিপূরণের কোনো সুযোগ থাকবে না। কতিপয় লোকের ক্ষেত্রে এমনটা বাস্তবে ঘটেছেও।
নিরাশার চরমে পৌঁছে যাওয়া এক ব্যক্তির ঘটনা
আল—জাওয়াবুল কাফী নামক গ্রন্থে এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, জনৈক ব্যক্তিকে মুমূর্ষু অবস্থায় কালেমা পড়তে বলা হলো। সে উত্তর দিল, এক কালেমা দিয়ে কী হবে? আমার পাপরাশির স্তূপ এত বিশাল যে এক কালেমা দিয়ে স্খলন সম্ভব নয়। তো দেখুন, এহেন ধারণা কতটা ক্ষতিকর যে, ঈমানহারা হয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। তাই এ বিষয়টি আলোচনার খুব প্রয়োজন ছিল। এখান থেকে ওই সকল বক্তাদের ভুলের বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেল, যারা অহেতুক কঠোরতা করে। আপন স্বভাব—কঠোরতার কারণে কঠোর ও ভীতিকর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। দয়া, মায়া, রহমত ও মাগফেরাতের বিষয়বস্তু নিয়ে কম আলোচনা করে।
শ্রোতাদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেওয়ার কথাও আমি বলছি না এবং একেবারেই ভীতিপ্রদর্শন করা যাবে না তাও বলছি না। কিন্তু কঠোরতারও একটা সীমা থাকা উচিত। একালের মানুষের অন্তর দুর্বল। মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা দেখালে তাদের মনোবল ভেঙে যায়। তাওফীক হয় না। তো একালে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা খুব একটা উপকারী নয়। বরং তাদেরকে খুশি করে উৎসাহিত করলে তাদের দ্বারা নেক কাজের আশা করা যায় বেশি। পক্ষান্তরে নিরাশ করে তাদের থেকে কোনো কাজ আদায় করা সম্ভব নয়। তাই জনসাধারণের অন্তর থেকে এ ধারণার মূলোৎপাটন অপরিহার্য যে, গোনাহ করলে নেক কাজের সওয়াব হয় না; বরং নেক কাজের সওয়াব যা তা ঠিকই পাওয়া যায় তবে বরকত কমে যায়। এ বিষয়টি তো ছিল এমন, যা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু ঘটনাক্রমে আজকের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আলোচনা হয়ে গেল।
এখনকার বিষয়বস্তু
এখনকার বিষয়বস্তু হলো, যে ব্যক্তি রোযা অবস্থায় মিথ্যা ও অন্যায় বর্জন করে না, তার পানাহার বর্জন আল্লাহ পাকের নিকট গুরুত্ব রাখে না। অর্থাৎ গোনাহের কাজ ও অন্যায় কথা বর্জন না করে রোযা রাখাতে কী লাভ হলো। তো এই বয়ানে তিনটি বিষয় আলোচিত হবে :
এক. গোনাহ করলে নেক কাজের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায় না।
দুই. অপর বিষয় (যা এখনকার মূল আলোচ্য বিষয়) গোনাহ থাকা সত্ত্বেও অতি অবশ্যই নেক কাজের সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন গীবতও করে নামাযও পড়ে, তো এক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না যে নামায সহীহ হয়নি। কিংবা তার সওয়াব লাভ হয়নি। তবে নামাযের বরকত অবশ্যই কমে যাবে। অর্থাৎ গীবতের গোনাহে আক্রান্ত না থাকলে নামাযের মধ্যে যে নূরানিয়ত সৃষ্টি হতো, গীবতে আক্রান্ত থাকার দরুন তা আর হবে না। এর দৃষ্টান্ত হলো, এমন যেমন সুস্থ সবল মানুষ যদি খাদ্য গ্রহণ করে তাহলে তা তার জন্য উপকারী হয়। শরীরে শক্তি জোগায়। দুর্বল অসুস্থ কেউ খেলেও উপকারী হয়। কিন্তু সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে অধিক উপকারী হয়। অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে কম উপকারী হয়। কিংবা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি শক্তিবর্ধক ওষুধ সেবন করানো হয় তাহলে তার জন্য খুব একটা উপকারী হয় না কিন্তু পেট ভালো হওয়ার পর যদি সেবন করানো হয় তাহলে খুবই উপকার হয়। এক্ষেত্রেও ঠিক তদ্রƒপ গোনাহ বর্জনের পর যে নেক কাজ হবে তা অধিক নূর ও বরকত হবে।
তিন. তৃতীয় বিষয়বস্তু হলো যা হাদীসে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যে রোযা রেখে মিথ্যা পরিহার করল না তার রোযা রাখার কী লাভ হলো? সারকথা হলো এই—রোযা অবস্থায় মুখের খানা—পিনা যেমন বন্ধ রাখা জরুরি তদ্রƒপ অন্যান্য পাপও পুরোপুরি বর্জন করা অপরিহার্য।
আশ্চর্য কথা, মানুষ রোযা অবস্থায় পানাহার, স্ত্রী মিলন পরিহার অত্যাবশ্যক মনে করে; কিন্তু গোনাহ বর্জনকে অত্যাবশ্যক মনে করে না। অথচ ওই তিন কাজ অন্য সময় বৈধ ছিল এমনকি কখনো কখনো ফরয ও জরুরি হয়ে যায়। খোদ রমযান মাসেও রাতের বেলা উক্ত তিন কাজ বৈধ। তো রোযা অবস্থায় যখন ওই সকল কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায় যা অন্য সময় বৈধ তখন যে সকল কাজ সর্বাবস্থায় হারাম ও নিষিদ্ধ তা কী করে রোযা অবস্থায় বর্জন করা জরুরি ও অপরিহার্য হবে না। সুতরাং কেউ যদি রোযা অবস্থায় গীবত করে কিংবা কুদৃষ্টি করে অথবা অন্য কোনো গোনাহের কাজ করে তাহলে এ কথা বলা হবে না যে, তার রোযা হয়নি। কিন্তু এ কথা অবশ্যই বলতে হবে, রোযা বরকতশূন্য হয়ে গেছে। এই তৃতীয় বিষয়টি আলোচ্য হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এরই মাধ্যমে দ্বিতীয় বিষয়টিও প্রমাণিত হয়ে গেছে। কেননা গোনাহের কারণে যখন রোযার মতো নেক কাজের প্রভাব নষ্ট হয়ে যায় তখন অন্যান্য নেক কাজেরও একই অবস্থা হবে। তথা সেসবের বরকতও নষ্ট হয়ে যাবে। এ বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট ও পরিষ্কার। তো দ্বিতীয় ও তৃতীয় আলোচ্য বিষয় দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয়ে গেল। বাকি রইল প্রথম বিষয়ের দলীল।
গোনাহ থাকা সত্ত্বে নেক কাজের সওয়াব লাভ হবে
তো প্রথম বিষয় ছিল গোনাহ থাকা সত্ত্বেও নেক কাজের সওয়াব লাভ হবে। তার দলীল হলো এই আয়াত,
فَمَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّۃٍ خَیْرًا یَّرَهٗ ؕ﴿۷﴾ وَ مَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَهٗ ﴿۸﴾
অর্থ : যে সামান্যতম নেক আমল করবে সে তা দেখতে পাবে আর যে সামান্যতম বদ আমল করবে সে তা দেখতে পাবে।—সূরা যিলযাল, ৯৯ : ৭—৮
এ আয়াতে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেমনটা তরজমা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এক. নেক কাজ আদায়কারী প্রসঙ্গে তথা যে ব্যক্তি সামান্যতম নেক আমল করবে সে তা দেখতে পাবে। এ আয়াতের বক্তব্য ব্যাপক। সৎকর্মশীল নেককার হোক কিংবা গোনাহগার। এর দ্বারা পরিষ্কার জানা গেল, সৎকর্মশীল সর্বাবস্থায় সওয়াব পাবে। কোনো অবস্থাতেই তার নেকী নষ্ট হবে না। তবে এর জন্য শর্ত হলো, তার নেকী অবশিষ্ট থাকতে হবে। নাস্তিক, মুরতাদ হওয়ার দ্বারা নেকি মিটে গিয়ে না থাকতে হবে। কেননা মুরতাদ হওয়ার দ্বারা সমস্ত নেকী মিটে যায়।
দুই. গোনাহকারীদের প্রসঙ্গে, যে গোনাহ করবে, মন্দ কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। এ বিধানও ব্যাপক, হোক সে পাপী কিংবা সৎ। এতে আত্মগর্বের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে যেমন প্রথম আয়াতে নিরাশার চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ হোক সে যত বড় গোনাহগার, ঈমান থাকলে নেক কাজ করে তার নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং সওয়াবের আশা রাখা উচিত। তো এই দ্বিতীয় আয়াতে আত্মগর্বের চিকিৎসা করা হয়েছে অর্থাৎ যদি কোনো বড় ওলী, বুযুর্গও গোনাহ করে তাহলে তাঁরও গোনাহ হবে, তাই তারা আপন ইবাদত—বন্দেগী নিয়ে আত্মগর্বে ভোগার সুযোগ নেই।
কিছু লোক মনে করে আমরা যা—ই করি না কেন আমাদের গোনাহ হয় না
কিছু লোক মনে করে, আমরা যা কিছুই করি না কেন আমাদের কোনো গোনাহ হয় না। বাস্তবেই তাদের বিশ্বাস এমন হয়ে থাকলে তারা কুফুরিতে লিপ্ত। কেননা এহেন বিশ্বাস পোষণ করা কুফুরি। এ শ্রেণির লোকেরা নিজেদের এমন মনে করে যেমন কোনো দরিয়ায় যদি দু—চার ফেঁাটা পেশাব পড়ে যায় তাহলে তা নাপাক হয় না; বরং সেসব ফেঁাটাই তাতে বিলীন হয়ে যায়। দরিয়া যেমন পাক ছিল তেমনই পাক রয়ে যায়।
এরা নিজেদের মতলবের উপমার খুব ভালোই বিবরণ দিয়েছে, কিন্তু কেউ তাদের প্রশ্ন করুক তোমরা যে নিজেদের দরিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছ তা কি তোমাদের মনগড়া উপমা, না কোরআন—হাদীসের কোথাও তা বর্ণিত আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে বলো দেখি কোথায় আছে? ইনশাআল্লাহ কোথাও দেখাতে পারবে না, বরং এর উল্টো পাওয়া যাবে। যেমন মাত্রই আমি একটি আয়াতে পড়েছি, এতে এর বিপরীত হুকুম বিদ্যমান। পক্ষান্তরে যদি নিজেদের মনগড়া হয়ে থাকে এবং তোমাদের দৃষ্টিতে তা যথার্থ মনে হয় তাহলে এ কাজও শুরু করো, তথা সরকার বাহাদুর যার আইন—কানুন এতদিন মেনে এসেছ তার আওতাধীন এলাকায় ডাকাতি ও লুটতরাজ শুরু করে দাও; আর এ দুষ্কর্মে গ্রেফতার হয়ে যখন বিচারের সম্মুখীন হবে তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে উক্ত উপমা পেশ করো যে, আমরা এখন দরিয়ায় পরিণত হয়েছি তাই আমরা যা—ই করি না কেন তা আমাদের বেলায় অপরাধ নয়। যদি এই অজুহাত শুনে বিচারক তোমাদের ছেড়ে দেয় তাহলে আল্লাহ পাকের নিকট ছাড় পাওয়ার আশা রেখো। আর আল্লাহ পাকের নিকট যেমন আশায় বুক বেঁধেছ যে তিনি আমাদেরকে দরিয়া মনে করে ছেড়ে দেবেন। তদ্রƒপ ডাকাতি ও লুটতরাজ করে সরকারের নিকট আশায় বুক বাঁধা উচিত। (এহেন দুরাশা কেউই করে না)
তো এসব আসলে নফসের ছলনা আর শয়তানি ছাড়া কিছুই না। প্রকৃতপক্ষে না কেউ দরিয়া আর না কারও এ ধরনের দাবি করার অধিকার আছে। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—যিনি প্রকৃতপক্ষে দরিয়া ছিলেন; কেননা তিনি নিষ্পাপ ছিলেন, যাঁর নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতার উচ্চতার শান এমন ছিল যে, তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য পূর্বাপর সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। সেই তিনিই তো কখনো এই দাবি করেননি তখন আজ কোন মুখে কেউ এহেন দাবি করতে পারে; বরং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এত সমাদর ও নৈকট্য সত্ত্বেও এ কথা বলতেন,
اني أخشاكم لله وأعلمكم بالله.
অর্থাৎ আল্লাহ পাককে আমি তোমাদের সবার চেয়ে বেশি ভয় করি এবং আল্লাহ পাকের পরিচয়জ্ঞান তোমাদের সবার চেয়ে আমার বেশি।
এখানে ভয়ের পর এলেমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে এত ভয় ছিল আল্লাহ পাকের গভীর মা’রেফাত ও পরিচয়জ্ঞানের সুবাদেই। সুতরাং এখন যারা আল্লাহ পাককে ভয় করে না এর কারণ একমাত্র এটাই যে, তাদের আল্লাহ পাকের পরিচয়জ্ঞান নেই। তো রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো দরিয়ায় পরিণত হওয়ার এহেন দাবি করেননি আর এর ভিত্তিতে কখনো কারও হক নষ্ট করেননি।
এমনকি একবার তিনি মজা করে এক সাহাবীর কোমরে আঙুল দিয়ে গুঁতো দিয়েছিলেন। সাহাবী এর বদলা দাবি করে বসল। তিনি বললেন, ঠিক আছে বদলা নিয়ে নাও, এই বলে তিনি কোমর এগিয়ে দিলেন। সাহাবী আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ তখন আমার শরীর খালি ছিল অথচ আপনি কোর্তা পরিহিত।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাৎ কোর্তা উপরে তোলে দিলেন। তখন ওই সাহাবী তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে লাগলেন আর নিবেদন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ এটাই আমার উদ্দেশ্য ছিল।
লোকেরা ‘ওয়াফাতনামা’ নামক হযরত উক্কাশার নামে যে কাহিনি গড়ে নিয়েছে তা সঠিক নয়। সঠিক ঘটনা তা—ই যা আমি এখন আপনাদের সামনে আলোচনা করলাম। আমাদের অঞ্চলে মহিলাসমাজে ব্যাপক সমাদৃত কিসসা—কাহিনির যত বই আছে তার সবই বানোয়াট। যেমন : স্বপ্ননামা, মু’জেযায়ে আলে নবী, ওয়াফাতনামা, অবশ্য হরিণীর মুজেযার ঘটনা সহীহ। এ ছাড়া কিসসা—কাহিনির যত বই আছে বিশেষত যেগুলোর নাম আমি উল্লেখ করলাম এর সবই বানোয়াট, কুসংস্কার, নিরর্থক এবং সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। এই শ্রেণির বইসমূহের একটি বইয়ে ওই ছয়পদীও আছে যার তৃতীয় পঙ্ক্তি হলো এই,
مری بارکيوں دير اتنی کری
অর্থ : আমার বেলা কেন এত দেরি।
এই ছয়পদীও একেবারেই বেহুদা। এটাও কিছুতেই পাঠ করা উচিত নয়। এই জালেম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সঙ্গে লড়াই করেছে। কোথাও সে নবীদের নবুয়ত প্রাপ্তিতে হিংসা করেছে, কোথাও রাজা—বাদশাদের রাজত্ব প্রাপ্তি নিয়ে ঈর্ষা করেছে। তারপর প্রতিটি হিংসাত্মক বক্তব্যের পর এই অভিযোগ তোলেছে যে, আমি কেন বঞ্চিত হলাম। এহেন বই কিছুতেই কারও কাছে কারও ঘরে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়; বরং তা নির্দ্বিধায় আগুনে ছুড়ে ফেলার যোগ্য।
মু’জেয়ায়ে আলে নবী যাতে এ ঘটনা লেখা হয়েছে যে, হযরত আলী রাযি. তাঁর প্রিয় পুত্রকে কোনো ভিক্ষুককে দিয়ে দেন আর সে তাকে বিক্রি করে দেয়। নিতান্তই বানোয়াট উদ্ভট গল্প। তদ্রƒপ হযরত উক্কাশা প্রসঙ্গে যে কাহিনি লোকমুখে খ্যাত তা একেবারে ডাহা মিথ্যা। প্রকৃত ঘটনা তা—ই যা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি। মোটকথা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে না কখনো দরিয়া দাবি করেছেন আর না কারও হক আটকে রেখেছেন। তদ্রƒপ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রাণোৎসর্গী সাহাবীরা কখনো নিজেদের এত বড় মনে করেননি। তাঁরা সদা ভয়ে প্রকম্পিত থাকতেন। এমন কখনো হয়নি যে কখনো কারও প্রতি কঠোরতা হয়ে গেছে আর তারা তার বদলা দেননি।
হযরত আবু উবাইদা রাযি. শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের অন্যতম ছিলেন। তিনি শামের মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। সেখানে এক জায়গায় কোনো এক খ্রিষ্টান রাজার চিত্র অঙ্কিত ছিল। সময়টা ছিল সেখানকার খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সন্ধির কাল। মুসলিম সৈন্যরা ওই জায়গায় সমর প্রশিক্ষণের জন্য যেত। কোনো এক মুসলমান জোশের বশবর্তী হয়ে ওই ছবির চোখ ফঁুড়ে দেয়। এই সংবাদ যখন হযরত আবু উবাইদা রাযি. এর কানে পেঁৗছল তখন তিনি প্রতিনিধি মারফত এই বার্তা পাঠালেন যে, তারা যদি ছবির বদলায় আমার এক চোখ ফুঁড়ে দিতে চায় তাহলে আমি তাতে সানন্দে রাজি।
হযরত আবু বকর রাযি. প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে, তিনি আপন জিভ ধরে টানছেন আর বলছেন,
هذا أوردني الموارد.
এটা আমাকে বহু অনর্থে ফাঁসিয়েছে।
তদ্রুপ হযরত উমর রাযি.—কে দেখা গেছে তিনি পানির মশক কাঁধে করে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এক লোক এসে আমার খুব প্রশংসা করেছে। পরে ভেবে দেখলাম, এতে আমার প্রবৃত্তি বেশ আনন্দিত হয়েছে তাই তাকে একটু শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি।
গভীরভাবে ভেবে দেখুন, এ সকল মহান সাহাবী এ কথা বলেননি যে, আমরা তো দরিয়া, যা—ই করি সব মাফ। ঠিক এমনই আরেকটি ঘটনা মনে পড়ল। হযরত আলী রাযি. একবার একটি কোর্তা পরলেন কিন্তু হাতা কেটে দিলেন। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, আমি যখন কোর্তাটি পরলাম তখন আমায় খুব মানাল তাই হৃদয়মন আত্মহারা হয়ে তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাই আমি তার হাতা কেটে ফেলে দিয়েছি যাতে তা খারাপ দেখায়। অথচ এখনকার অবস্থা হলো কাপড়ে সেলাইয়ে যদি সামান্য হেরফের হয় তাহলে তা দর্জি বেচারার মুখে ছুড়ে মারা হয়। অথচ তারা ভালো কাপড় নষ্ট করে দিতেন।
মোটকথা কারও এহেন ধারণা যে, আমি দরিয়ায় পরিণত হয়েছি আর গোনাহের দ্বারা আমার কোনো ক্ষতি হয় না একেবারে অমূলক। এ ধরনের লোক এ কালেও আছে, পূর্বেও ছিল।
জুনাইদ বাগদাদী রহ.—কে প্রশ্ন করা হলো, কিছু মানুষ নিজেদের ব্যাপারে দাবি করে,
نحن وصلنا فلا حاجة لنا الى الصلاة و الصوم.
অর্থ : আমরা (নৈকট্যের) চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেছি তাই আমাদের আর নামায রোযার প্রয়োজন নেই।
উত্তরে তিনি বলেন,
صدقوا فى الوصول ولكن إلى سقر.
অর্থাৎ তারা ঠিকই বলেছে, পৌঁছেছে তবে নরকে।
তারপর তিনি বলেন, আমার জীবন যদি হাজার বছর দীর্ঘ হয় তাহলে একেবারে শেষ বয়সেও আমি আমার কোনো ওযিফাই ছাড়ব না।
মোটকথা, এ ধারণা একেবারেই অমূলক যে আমরা যা—ই করি তাতে কোনো গোনাহ হবে না আর এ আয়াতে وَ مَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَهٗ (অর্থ : যে বিন্দু পরিমাণও অন্যায় কাজ করে সে তা দেখতে পাবে) এহেন ধারণার গোড়া কেটে দিয়েছেন তথা যে বিন্দু পরিমাণ অন্যায় কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। তবে বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গ হলো উক্ত আয়াতের আগের আয়াত যা দ্বারা এ কথা পরিষ্কার জানা গেছে যে, গোনাহগারও যদি নেক কাজ করে তাহলে সে সওয়াব পাবে।
রইল গোনাহের সাজার কথা। যদি তা মাফ না হয় তাহলে তার সাজা স্বতন্ত্রভাবে ভোগ করতে হবে। যেমন : কোনো বিচারক যদি তার উপর আরোপিত দায়িত্ব ঠিকঠিক আদায় করার পাশাপাশি ঘুসও খায় আর তা ঊর্ধ্বতন কতৃর্পক্ষ জানতে পারে তাহলে সে ঘুসে জড়িয়ে পড়ার শাস্তি পাবে; কিন্তু তখন যেহেতু আদালতের দায়িত্বও পালন করেছে তাই সে তখনকার বেতন—ভাতাও অবশ্যই পাবে। তো প্রথম দাবি এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, গোনাহগারও নেক কাজের সওয়াব পাবে।
গোনাহ করার দ্বারা নেক আমলের বরকত নষ্ট হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত
রইল দ্বিতীয় দাবি তথা গোনাহের কারণে সরাসরি নেক আমল তো নষ্ট হয় না; তবে তার বরকত ও নূরানিয়ত নষ্ট হয়ে যায়। এ হাদীসই তার দলীল যার আলোচনা চলছে। এ ছাড়া আরও দলীল—প্রমাণ আছে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রোযাদার প্রসঙ্গে বলেছেন, সে যদি গোনাহ বর্জন না করে তাহলে তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন আল্লাহ পাকের নেই। আর এ ব্যাপারে সকল উলামায়ে কেরাম একমত, গোনাহের কারণে রোযা বাতিল হয়ে যায় না, আর তার কাযাও আবশ্যক হয় না। এতে বোঝা গেল, এই হাদীসের অর্থ এই নয় যে এ ধরনের ব্যক্তির রোযা হবে না; বরং এর অর্থ অন্য কিছু। আর তা হলো এ ধরনের রোযার প্রতি আল্লাহ পাক ততটা গুরুত্ব দেন না যাতে নিছক পানাহার বর্জন করা হয়, গোনাহ বর্জন করা হয় না। (তার রোযার কোনো প্রয়োজন নেই) এ কথার অর্থ এটাই যে, তার নূরানিয়ত ও উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে যায়।
তো এ হাদীস থেকে এ বিষয়টি জানা হয়ে গেল, যে রোযায় গোনাহ পরিহার না করা হয় তার বরকত ও নূরানিয়ত কমে যায়। আর অন্যান্য নেক কাজের অবস্থাও এমনটাই হবে তথা গোনাহের কারণে সেসব বরকতশূন্য হতে থাকবে। বিষয়টি বাস্তবতার আলোকেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নেক কাজ করার পাশাপাশি কেউ যদি গোনাহ থেকেও বেঁচে থাকে তাহলে তখন নেক কাজের সুবাদে হৃদয়ে যে নূর পয়দা হবে তা গোনাহসহ নেক কাজে কিছুতেই সৃষ্টি হবে না। বরং এটা এমনই হবে, যেমন খুব সুস্বাদু খাবারের সঙ্গে সামান্য কিছু ছাই মিশিয়ে পরিবেশন করা। তো ছাই মেশানোর পরে তা খাবার হিসেবে গণ্য হলেও তা বিস্বাদ হয়ে যায়। তদ্রƒপ গোনাহগার ব্যক্তি নামায পড়ে কিন্তু স্বাদ পায় না, বিস্বাদ বিস্বাদ মনে হয়। নামায দ্বারা যে উদ্যম ও সজীবতা লাভ হয় তা তার হয় না। যদিও তার নামায হয়ে যায় এবং সওয়াবেরও আশা থাকে কিন্তু অন্তর একেবারে বদ্ধ ও বেকার হয়ে যায়। বোঝা গেল গোনাহের কারণে নেক কাজ এতটাই বরকতহীন হয়ে পড়ে, যে সওয়াব পাওয়া যায় তা চোখেই পড়ে না। বরং গোনাহের কালো আঁধারে ঢাকা পড়ে যায়।
এর দৃষ্টান্ত হলো, কেউ বাতি জ্বালিয়ে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল, এক্ষেত্রে তার আলো ভেতরে তো বাকি থাকবে কিন্তু বাহির থেকে এতটাই ফিকে হয়ে যাবে যে, পথের উঁচু—নিচু খানা—খন্দক পর্যন্ত দেখা যাবে না। এমনকি স্বয়ং তাকেও দেখা যাবে না। অবশ্য কেউ খুব প্রখর দৃষ্টির অধিকারী হলে হয়তো দেখতে পাবে কিংবা এমন কেউ দেখে বললে হয়তো মেনে নেবে। বাকি নিজে কিছু দেখতে পাবে না। তদ্রƒপ এক্ষেত্রে বোঝার চেষ্টা করুন যে, শরীয়ত আমাদের অবহিত করে দিয়েছে গোনাহগার ব্যক্তি নামাযের সওয়াব পাবে তাই আমরা তা মেনে নেব যে, তার ভেতরে আলো ও রৌশনি অবশ্যই আছে। উপর থেকে গোনাহের এই পরিমাণ আস্তর পড়েছে যে, তা একেবারে দেখাই যায় না। মোটকথা, এ কথা ঠিক যে গোনাহের দ্বারা নেক আমল নষ্ট হয় না কিন্তু তাতে একটু কথা আছে।
গোনাহ দুই প্রকার আর প্রতিটি নেক কাজে তার প্রভাব—প্রতিক্রিয়ার ধরন
সে কথা হলো―গোনাহ দুই প্রকার। কিছু গোনাহ এমন, তাতে লিপ্ত হলে না কোনো কাজ সহীহ ও মকবুল হয় আর না কোনো নেক কাজ বহাল থাকে। যেমন কুফুর, তাতে লিপ্ত থাকা অবস্থায় না কোনো নেক কাজ সহীহ হয়, আর না বহাল থাকে। অর্থাৎ ধরুন যদি কোনো কাফের নামায পড়ে তাহলে তা সহীহ হবে না কিংবা কেউ নামায পড়ে কাফের হয়ে গেল তাহলে ওই নামায বহাল থাকবে না। একই পরিণতি হবে রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদির। এখান থেকে সেসব লোকের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যারা কুফুরি শব্দ উচ্চারণে কোনো পরোয়াই করে না। আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন কতিপয় লোককে যখন রোযা রাখতে বলা হয় তখন তারা জবাব দেয়, যার ঘরে খাবার নেই সে রোযা রাখবে। এই শব্দ বড় মারাত্মক শব্দ। এ শব্দ কারও মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে তো সে কাফের হয়ে গেছে। তার বিয়ে ভেঙে গেছে। হজ বরবাদ হয়ে গেছে। তওবা করে তার বিয়ে দোহরাতে হবে। পূর্বকৃত তার সব নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তওবা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নতুন কোনো নেক আমলও কবুল হবে না। কুফুর ছাড়া আরও একটা পাপ কাজ আছে যা এক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, তার প্রভাব—প্রতিক্রিয়াও কুফুরের মতোই, তা দ্বারাও সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়।
নবীজির শানে বেয়াদবীর দরুন আমল বরবাদ হয়ে যায়
আর তা হচ্ছে―নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেওয়া এবং তার শানে বেয়াদবি করা, যদিও তা ইচ্ছাকৃত না হয়। বেপরোয়া আচরণ থেকে বেখেয়ালিতে হয়ে গেলেও (তার সব আমল বরবাদ হয়ে যাবে)। এর দ্বারা প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুউচ্চ মর্যাদার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহ পাকের নিকট তাঁর মর্যাদা কতটা সুউচ্চ ও সুমহান।
সুধীবৃন্দ, আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করুন যে, আল্লাহ পাক প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত বানিয়ে বিরল সম্মান ও সৌভাগ্য দান করেছেন। আর এই আয়াত হলো এই :
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَرْفَعُوْۤا اَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِیِّ وَلَا تَجْهَرُوْا لَهٗ بِالْقَوْلِ کَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ اَنْ تَحْبَطَ اَعْمَالُكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ ﴿۲﴾
অর্থ : হে ঈমানদারগণ তোমরা নিজেদের আওয়াজ নবীজির আওয়াজের চেয়ে উঁচু করো না, এমন খোলামেলা কথা বলো না যেমন পরস্পরে খোলামেলা বলে থাকো; যাতে তোমাদের অজান্তে তোমাদের আমল বরবাদ না হয়ে যায়।—সূরা হুজুরাত, ৪৯ : ০২
এই আয়াতের বক্তব্য পরিষ্কার যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে বেয়াদবির দরুন আমল নষ্ট হয়ে যাওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। এ আয়াত থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয়ে গেল শরীয়ত আমাদের আদব—কায়দাও শিখিয়েছে।
[চলবে ইনশাআল্লাহ]