ছোট্ট মুহাম্মদ
শায়খ আলী তানতাবী
আমি তখন ছোট ছিলাম। গোপনে কী ঘটছে বুঝতাম না। কিন্তু যখনই স্কুল থেকে এসে আব্বুকে বাইবেলের মুখস্থ করা অংশ এবং নতুন শেখা স্প্যানিশ ভাষা শোনাতাম, তখন তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন, চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। ঘরের শেষ মাথায় তার কামরায় চলে যেতেন। যেটার দরজার ধারে—কাছেও ভেড়ার অনুমতি ছিল না কারও। দীর্ঘক্ষণ থাকতেন সেখানে। কী করছেন কিছুই জানতাম না। বের হতেন লাল চোখ নিয়ে। যেন অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। অনেক কষ্ট এবং ব্যথাভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কিছু বলার জন্য ঠেঁাট নাড়তেন। শোনার জন্য কাছে গেলে না বলেই চলে যেতেন।
আম্মুকে দেখতাম, যখনই স্কুলে যেতাম বিষণ্ণ ও অশ্রম্নসিক্ত চোখে বিদায় দিতেন। উৎকণ্ঠা ও যন্ত্রণা নিয়ে আমাকে চুমু খেতেন। একবারে তৃপ্ত হতেন না। ডেকে আবার চুমু খেতেন। আমাকে ছেড়ে যেতেন কাঁদতে কাঁদতে। সারা দিন গালে সেই অশ্রম্নর উষ্ণতা অনুভব করতাম। আমি অবাক হতাম। কোনো কারণ খুঁজে পেতাম না এর। যখন ফিরতাম, এত ব্যাকুলতা ও কাতরতার সঙ্গে আমাকে এগিয়ে নিতেন, যেন আমি দশ বছর পর ফিরেছি।
আব্বু—আম্মুকে দেখতাম, আমার অগোচরে অপরিচিত একটি ভাষায় ফিসফিস করছেন। কাছে গেলে কথা বন্ধ করে দিতেন। প্রসঙ্গ পালটে আবার স্প্যানিশ ভাষায় বলতে থাকতেন। আমি এতে অবাক হতাম এবং কষ্ট পেতাম। মনে বিভিন্ন ধারণার উদয় হতো। এমনকি ভাবতাম, আমি হয়তো তাদের সন্তান না। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। দুঃখ গ্রাস করে নিত আমাকে। ঘরের এক পাশে গিয়ে খুব কাঁদতাম। ক্রমাগত এই কষ্ট ভোগের ফলে সমবয়সি অন্যদের তুলনায় আমার স্বতন্ত্র একটা স্বভাব সৃষ্টি হলো। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম না। গুটিয়ে রাখতাম নিজেকে। নির্জনে বসে থাকতাম। হাতে মাথা রেখে বিভিন্ন ভাবনায় ডুবে যেতাম। এই সংকটগুলোর কোনো সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করতাম। একপর্যায়ে পাদরি এসে আমার জামার অঁাচল ধরে উপাসনা করতে গির্জায় নিয়ে যেত।
আম্মুর আরেকটি বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়। যখন আব্বুকে একটি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চার সুসংবাদ দেওয়া হয়, তিনি খুশি হলেন না। এক চিলতে হাসিও দেখা গেল না ঠেঁাটে; বরং বিষণ্ণ মনে টলতে টলতে বাবুর জন্য পাদরিকে ডাকতে গেলেন। তাকে ডেকে তার পিছু পিছু মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকেন। চেহারায় ছিল প্রচণ্ড হতাশা ও বেদনার ছাপ। পাদরিকে আম্মুর কাছে নিয়ে গেলে আম্মুর চেহারা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিস্ফোরিত হয়ে যায় চোখদুটো। প্রবল শঙ্কা ও সতর্কতার সঙ্গে বাবুকে পাদরির কাছে দেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। দৃশ্যগুলো দেখে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। আমার কষ্ট বেড়ে আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়।
ইস্টার উৎসবের রাত। আলোকসজ্জায় ছেয়ে যায় গ্রানাডা শহর। চারদিকে মাতিয়ে তোলা সৌরভ। ঝলমল করছে আল—হামরা প্রাসাদ। প্রাসাদের বেলকনি ও মিনারাগুলোতে চকচক করছে ক্রুশ। মধ্যরাতে সবাই ঘুমে বিভোর হয়ে গেলে আব্বু আমাকে ডাকেন। চুপচাপ তার কক্ষে নিয়ে যান। সেই নিষিদ্ধ কক্ষে। আমার হৃৎপিণ্ডটা প্রচণ্ডভাবে ধুক—ধুক করতে থাকে। শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। কিন্তু নিজেকে সামলাই এবং সাহস সঞ্চার করি। আমাকে নিয়ে কক্ষে ঢুকে দরজাটা শক্ত করে বন্ধ করে দেন। এরপর বাতি খুঁজতে থাকেন। অন্ধকারে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকি আমি। মনে হয়েছিল যেন কত বছর দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর ছোট একটি কুপি জ্বালান। আমি চারদিকে চোখ বুলাই। কক্ষটা একেবারে খালি। যে আশ্চর্যজনক জিনিস দেখার আশায় ছিলাম, তার কিছুই নেই সেখানে। ছিল শুধু একটি বিছানা, তাকে রাখা একটি কিতাব, আর দেয়ালে ঝুলানো একটি তরবারি। আমাকে বিছানায় বসিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই অদ্ভুত দৃষ্টি, স্থানের আতঙ্ক, রাতের নিস্তব্ধতা সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, যেন দরজার ওপাশে ফেলে আসা জগৎ ছেড়ে অন্য আরেকটা জগতে চলে এসেছি। কেমন যেন লাগছিল বলতে পারব না।
এরপর আব্বু পরম মমতা ও স্নেহের সঙ্গে আমার দুই হাত চেপে ধরেন। খুব ক্ষীণ আওয়াজে বলেন, বাবা তোমার দশ বছর হয়ে গেছে। একজন পুরুষে পরিণত হয়েছ তুমি। এখন তোমাকে একটা বিষয় অবহিত করব, যা দীর্ঘদিন তোমার থেকে গোপন রেখেছিলাম। তুমি কি পারবে তোমার আম্মু, পরিবার, বন্ধুবান্ধবসহ সবার থেকে এটা গোপন রাখতে? কেননা তোমার একটা ইঙ্গিত তোমার আব্বুকে দিওয়ানুত তাফতীশের (সার্চ কমিটি) জল্লাদদের শাস্তির মুখোমুখি করে দিতে পারে।
দিওয়ানুশ তাফতীশের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি আপাদমস্তক কেঁপে উঠলাম। আমি ছোট ছিলাম বটে। কিন্তু জানতাম, দিওয়ানুশ তাফতীশ কী জিনিস। স্কুলে যাওয়া—আসার পথে নিয়মিত তাদের হত্যাযজ্ঞ চোখে পড়ত। কাউকে শূলে চড়ানো হচ্ছে, কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। মহিলাদের কারও চুল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কারও পেট চিড়ে ফেলা হচ্ছে।
আমি চুপ থাকলাম। কিছু বললাম না।
আব্বু বললেন, কী ব্যাপার। কথা বলছ না যে? পারবে তো আমার কথাগুলো গোপন রাখতে?
বললাম, পারব।
তিনি বললেন, তোমার আম্মু এবং তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ থেকেও কিন্তু?
বললাম, পারব।
তিনি বললেন, কাছে আসো। মন দিয়ে শোনো। জোরে কথা বলতে পারব না। দেয়ালেরও কান থাকতে পারে। সে শুনে দিওয়াতুত তাফতীশকে খবর দিয়ে দেবে। এরপর তারা আমাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারবে।
আমি কাছে গেলাম। বললাম, আমি শুনছি আব্বু।
তিনি তাকে রাখা কিতাবটার দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কী কিতাব জানো?
বললাম, না।
এটা আল্লাহর কিতাব।
বললাম, ও। পবিত্র বাইবেল যা আল্লাহর পুত্র যীশু নিয়ে এসেছেন?
তিনি একটু কেঁপে উঠলেন। বললেন, কক্ষনো না। এটা সেই কোরআন, যা আল্লাহ তাআলা (যিনি একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি না কারও জন্মদাতা, না কেউ তাঁকে জন্ম দিয়েছে) নাযিল করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ মাখলুক নবীদের নেতা আমাদের নেতা নবীয়ে আরাবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর।
বিস্ময়ে আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। কিছুই বুঝলাম না।
তিনি বলেন, এটা সেই ইসলাম ধর্মের কিতাব, যা আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে বিশ^জাতির কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি আগমন করেন সেই পাহাড়—পর্বতের পেছনে সুদূর মরুভূমিতে অবস্থিত মক্কায়। সেখানে ছিল মুশরিক, মূর্খ বিভিন্ন বেদুইন গোত্রের বসবাস। তিনি এর মাধ্যমে তাওহীদের প্রতি পথপ্রদর্শন করেন। তাদের মধ্যে ঐক্য ও শক্তির সঞ্চার করেন। তাদেরকে দান করেন জ্ঞান ও সভ্যতা। এর সাহায্যে তারা পূর্ব—পশ্চিম জয় করতে বের হন। আসতে আসতে তারা স্পেনের এই দ্বীপে উপস্থিত হন। এখানকার বাদশাহ ছিল উদ্ধত ও স্বেচ্ছাচারী। শাসনব্যবস্থা ছিল অনাচার ও অন্যায়ে পূর্ণ। জনগণ ছিল নির্যাতিত ও গরিব। মূর্খ ও পশ্চাৎপদ। তাঁরা এসে এই স্বেচ্ছাচারী বাদশাহকে হত্যা করেন। অত্যাচারী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে স্পেনের শাসনভার গ্রহণ করেন। তাঁরা মানুষের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের সঙ্গে সদাচার করেন। তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা প্রদান করেন। এখানে আটশ বৎসর শাসন করেন তাঁরা। এ সময়ে স্পেনকে পরিণত করেন বিশে^র সবচেয়ে সুন্দর ও উন্নত রাষ্ট্রে।
হঁ্যা বাবা! আমরা আরব মুসলমান।
আমি বিস্ময়ে, ভয়ে মুখ বন্ধ রাখতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম, কী! আমরা আরব মুসলমান?
তিনি বলেন, হঁ্যা, এটাই সেই রহস্য, যা আমি এখন তোমাকে বলব। হঁ্যা, আমরাই এ দেশের অধিপতি। আমরাই এ প্রাসাদগুলো নির্মাণ করেছি। একসময় তা আমাদের ছিল। এখন সেগুলো শত্রুদের হয়ে গেছে। আমরাই এই উঁচু মিনারাগুলো স্থাপন করেছি। যেখান থেকে ভেসে আসত আযানের ধ্বনি। এখন সেখানে বাজে ঘণ্টার ধ্বনি। যেখানে মুসলমানরা আল্লাহর সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াত। সম্মুখে থাকত ইমাম। মেহরাবে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করতেন। এখন সেগুলো গির্জায় পরিণত হয়েছে। যেখানে পাদরি ও যাজকরা দাঁড়িয়ে ইঞ্জিল পাঠ করে।
হঁ্যা বাবা! আমরা আরব মুসলমান। স্পেনের প্রতিটি ভূখণ্ডে আমাদের চিহ্ন আছে। এর প্রতিটি ইঞ্চিতে আমাদের কোনো—না—কোনো পূর্বপুরুষ অথবা শহীদের খণ্ডাংশ মিশে আছে। হঁ্যা, আমরাই এই শহরগুলো গড়েছি। পুলগুলো বানিয়েছি। পথগুলো তৈরি করেছি। খালগুলো খনন করেছি। গাছগুলো রোপন করেছি। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে… তুমি কি শুনছ? চল্লিশ বছর আগে এখানকার সর্বশেষ বাদশাহ আবু আব্দুল্লাহ আস—সগীরের সঙ্গে কিছু চুক্তি ও অঙ্গীকারের বিনিময়ে প্রতারণা করা হয়। ফলে তিনি তাদেরকে গ্রানাডার চাবি দিয়ে দেন। তাদেরকে উপহার দেন স্বজাতির ভিটেমাটি এবং পূর্বপুরুষদের সমাধিস্থলগুলো। এরপর মরক্কোর পথ ধরেন। সেখানে একাকী, লাঞ্ছিত, বিতাড়িত অবস্থায় মরার জন্য। তারা আমাদের সাথে স্বাধীনতা ও সুবিচারের প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার পর সকল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দিওয়ানুশ তাফতীশ গঠন করে আমাদেরকে জোরপূর্বক খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করে। মাতৃভাষা বর্জন করতে বাধ্য করে। আমাদের সন্তানদের কেড়ে নেয় খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য। এটাই হলো—আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে ইবাদত করা, দ্বীনি বিষয়ে পরীক্ষায় পড়া এবং সন্তানদের কাফের হয়ে যাওয়াতে কষ্ট পাওয়ার কারণ।
বাবা! চল্লিশ বছর ধরে আমরা এই যন্ত্রণা সহ্য করে আসছি, যা শক্ত পাথরও সইতে পারবে না। আল্লাহর সাহায্যের অপেক্ষায় আছি। হতাশ নই আমরা। আমাদের এই শক্তি, সবর, জিহাদের ধর্মে হতাশ হওয়ার অবকাশ নেই। বাবা, এটাই হলো রহস্য। তুমি তা গোপন রেখো। শোনো, তোমার দুই ঠেঁাটের মধ্যে তোমার আব্বুর জীবন ঝুলে আছে। আল্লাহর শপথ, আমি মৃত্যুকে ভয় করছি না। না আল্লাহর সাক্ষাৎকে অপছন্দ করছি। শুধু তোমাকে তোমার ভাষা ও দ্বীন শেখানোর জন্য বেঁচে থাকতে চাচ্ছি। যেন তোমাকে কুফরির অন্ধকার থেকে ঈমানের নূরের দিকে নিয়ে যেতে পারি। ঠিক আছে। এখন ঘুমোতে যাও।
এরপর থেকে যখনই আল—হামরার বেলকনি এবং গ্রানাডার মিনারাগুলো আমার চোখে পড়ত, শরীরে প্রচণ্ড একটা কাঁপুনি সৃষ্টি হতো। হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলত মায়া—দুঃখ, ক্ষোভ—ভালোবাসা। প্রায় দীর্ঘ সময়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেলে দেখতাম, আমি আল—হামরায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। তার সাথে কথোপকথন করছি। ভর্ৎসনা করছি তাকে। বলছি, ওহে আল—হামরা, ওহে পরিত্যাগী প্রেয়সী, তোমার নির্মাতাদের ভুলে গেছ? ভুলে গেছ এই মনিবদের, যারা তাঁদের জানমাল দিয়ে তোমার খাদ্য জুগিয়েছে। তোমাকে সিঞ্চিত করেছে তাঁদের রক্ত ও অশ্রম্ন দিয়ে। তুমি কি ভুলে গেছ তাঁদের সেই যুগের কথা। অস্বীকার করছ তাঁদের ভালোবাসার কথা। ভুলে গেছ ওই সকল শিকারি বাদশাহদের, যারা তোমার হলরুমগুলোতে ঘুরে বেড়াত, খুঁটিগুলোতে হেলান দিত। এরপর তোমাকে ভরে দিত গৌরব—মহিমা, সৌন্দর্য—উজ্জ্বলতায়। ওই সকল প্রভাবশালী বাদশাহ—যাদের কথায় দুনিয়া অনুগত হয়ে যেত। যাদের ডাকে যুগ সাড়া দিত। আযানের বদলে কি এখন তোমার কাছে ঘণ্টাধ্বনি ভালো লাগছে? ইমামদের পরিবর্তে কি পাদরিদের পছন্দ হচ্ছে? এরপর সচকিত হয়ে যেতাম। পাছে দিওয়ানুত তাফতীশের কেউ শুনে ফেলে কি না। আব্বুর দেওয়া আরবীর পাঠ মুখস্থ করতে পুনরায় দ্রুত বাসায় ফিরে যেতাম। আমার চোখে যেন এখনো ভাসে, তিনি অনারবী হরফ লিখিয়ে এর পাশে আরবী হরফ লিখে দিচ্ছেন। বলে দিচ্ছেন, এগুলো আমাদের হরফ। শিখিয়ে দিচ্ছেন এর উচ্চারণ ও লেখার পদ্ধতি। এরপর আমাকে দ্বীনের পাঠ দিতেন। ওযু—নামায শেখাতেন। যেন এই গুরুগম্ভীর কক্ষে তার পেছনে নামাযে দাঁড়াতে পারি। তার সব সময় ভয় হতো, আমি এই গোপন খবর ফাঁস করে দিই কি না। আম্মুকে দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করতেন। আম্মু এসে জিজ্ঞেস করতেন,
তোমার আব্বু তোমাকে কী শেখান?
আমি বলতাম, কিছুই না।
তিনি বলতেন, আমি জানি তোমার আব্বু তোমাকে কী শেখান। লুকানোর চেষ্টা কোরো না।
বলতাম, না। কিছুই শেখান না আমাকে। দেখতে দেখতে আমি আরবীটা রপ্ত করে ফেললাম। কোরআন শিখে ফেললাম। ধর্মীয় বিধি—বিধান জানা হয়ে গেল। এরপর আব্বু আমাকে এক দ্বীনি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন আমরা সবাই একসঙ্গে নামায পড়তাম। কোরআন তেলাওয়াত করতাম।
এরপর দিওয়ানুত তাফতীশের অত্যাচার তীব্র হয়ে ওঠে। অবশিষ্ট আরবদের প্রতি শাস্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় তারা। প্রায় প্রতিদিন বিশ—ত্রিশ জন করে শূলে চড়ানো হতো। অথবা জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। প্রতিদিন শত শত মানুষকে অমানবিক নির্যাতনের কথা কানে আসত। চোখের সামনেই কারও নখ উপড়ে ফেলা হচ্ছে। কাউকে এমনভাবে পানি পান করানো হচ্ছে যে নিশ^াস আটকে যাচ্ছে। কারও পায়ে কোমরে সেঁকা দেওয়া হচ্ছে। কারও আঙুল কেটে সিদ্ধ করে মুখে পুরে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে এমনভাবে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে, গোশত খসে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে তা চলতে লাগল।
একদিন আব্বু আমাকে বললেন, মনে হয় আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি এদের হাতে শাহাদাতবরণ করতে চাই। এই উসিলায় হয়তো আল্লাহ তাআলা আমাকে জান্নাত দান করবেন। এতে আমি বড় সফলকাম হব। তোমাকে কুফরের অন্ধকার থেকে বের করা এবং সেই বিশাল আমানত, যার ভারে আমি নুয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিলাম—তা অর্পণ করার পর এখন দুনিয়াতে আমার আর চাওয়া—পাওয়ার কিছু নেই। আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি তোমার এই চাচার কথামতো চলবে। কখনো তার অবাধ্য হবে না।
এভাবে কিছুদিন কেটে যায়। এক অন্ধকার রাতে এই চাচা আমাকে ডেকে বললেন, আমার সঙ্গে চলো। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতিবেশী মুসলিম দেশ মরক্কোতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি বললাম, আমার আব্বু—আম্মু কোথায়? তিনি আমাকে একটা ধমক দিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, তোমার আব্বু না বলেছে আমার কথামতো চলতে? অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সঙ্গে যেতে লাগলাম। যখন শহর পেরিয়ে চলে এলাম, অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নিল। তিনি বললেন, বাবা একটু ধৈর্য ধরো। আল্লাহ তাআলা দিওয়ানুত তাফতীশের হাতে তোমার পিতা—মাতার সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন।
বালকটি মরক্কো পেঁৗছতে সক্ষম হয় এবং মহান আলেম লেখক মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রফী আল—আন্দালুসীতে পরিণত হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর ও তাঁর কিতাবাদির মাধ্যমে আমাদের উপকৃত করুন।
আরবী থেকে অনুবাদ, মাহমুদ হাসান তাসনীম