তাফসীরুল কুরআনিল কারীম
মাওলানা মুতীউর রহমান
وَقَالَ اِنِّیْ ذَاهِبٌ اِلٰی رَبِّیْ سَیَهْدِیْنِ ﴿۹۹﴾ رَبِّ هَبْ لِیْ مِنَ الصّٰلِحِیْنَ ﴿۱۰۰﴾ فَبَشَّرْنٰهُ بِغُلٰمٍ حَلِیْمٍ ﴿۱۰۱﴾ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیْۤ اَرٰی فِی الْمَنَامِ اَنِّیْۤ اَذْبَحُکَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصّٰبِرِیْنَ ﴿۱۰۲﴾ فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلْجَبِیْنِ ﴿۱۰۳﴾ۚ وَ نَادَیْنٰهُ اَنْ یّٰۤاِبْرٰهِیْمُ ﴿۱۰۴﴾ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْیَا ۚ اِنَّا کَذٰلِکَ نَجْزِی الْمُحْسِنِیْنَ ﴿۱۰۵﴾ اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓـؤُا الْمُبِیْنُ ﴿۱۰۶﴾ وَ فَدَیْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِیْمٍ ﴿۱۰۷﴾
অনুবাদ : আর (ইবরাহীম আ.) বললেন, আমি আপন রবের দিকে চলে যাচ্ছি, তিনি আমাকে পথ দেখাবেন। হে রব, আপনি আমাকে একজন নেক সন্তান দান করুন। অতএব আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল ছেলের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন বলল, বৎস, আমি খাবে দেখছি যে তোমাকে যবেহ করছি। অতএব তুমি চিন্তা করে দেখো তোমার কী রায়।
সে বলল, আব্বাজান, আপনার প্রতি যে নির্দেশ হয়েছে তা আপনি পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্য হতে পাবেন। অতঃপর যখন উভয়ই মেনে নিল এবং পিতা ছেলেকে কাত করে শোয়ালো আমি তাকে আওয়াজ দিলাম, হে ইবরাহীম, তুমি খাব সত্য ও বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি নেককারদেরকে এমনি প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক বিরাট পরীক্ষা ছিল। আর আমি তার পরিবর্তে একটি বড় কোরবানীর পশু দান করি।—সূরা সাফফাত, ৩৭ : ৯৯—১০৭
তাফসীর : হযরত ইবরাহীম আ. স্বদেশবাসীর ঈমান আনয়ন থেকে নিরাশ হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে সিরিয়াতে চলে যান। তখনো তাঁর কোনো সন্তান হয়নি। তিনি আল্লাহর কাছে একজন নেক সন্তানের দুআ করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে একজন ধৈর্যশীল সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। ধৈর্যশীল গুণটি উল্লেখ করার দ্বারা এ দিকে ইঙ্গিত হচ্ছে যে এ সন্তান অচিরেই অত্যন্ত বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হবে এবং তাতে ধৈর্যের পরিচয় দেবে।
তৎকালীন মিশরের বাদশাহ আপন কন্যা হাজেরাকে হযরত ইবরাহীম আ. এর স্ত্রী সারা এর খেদমতের জন্য দান করেছিলেন। তাঁরই গর্ভে হযরত ইসমাঈল আ. জন্ম গ্রহণ করেন।
হযরত ইসমাঈল আ. যখন এমন বয়সে উপনীত হলেন যে পিতার সাথে চলাফেরা করতে পারেন তখন হযরত ইবরাহীম আ. খাবে দেখতে পেলেন যে, তিনি ছেলে ইসমাঈল আ. কে যবেহ করছেন। কোনো কোনো বর্ণনামতে তিনি এ খাব লাগাতার তিন দিন দেখেছিলেন। যাই হোক, তিনি ছেলেকে খাবের কথা বললেন এবং তার মতামত চাইলেন। তবে মতামত চাওয়ার উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে, ছেলে রাজি হলে কোরবানী করবেন নচেৎ করবেন না; বরং এর উদ্দেশ্য ছিল ছেলের মনোভাব যাচাই করা। ছেলেকে পরীক্ষা করা। দ্বিতীয়ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজি হলে কাজ সহজ হবে। যাই হোক, ছেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠল, আব্বাজান, আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা নির্দ্বিধায় পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্য হতে পাবেন।
হযরত ইসমাঈল আ. এ ক্ষেত্রে ‘আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন’ একথা না বলে ‘ধৈর্যশীলদের মধ্য হতে পাবেন’ একথা বলে এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, এরূপ ধৈর্যশীল কেবল আমিই নই; বরং আরও রয়েছেন। এটা তাঁর একান্ত বিনয়ের পরিচয়। যাই হোক, পিতাপুত্র উভয়ই আল্লাহর আদেশপালনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। হযরত ইবরাহীম আ. যখন হযরত ইসমাঈল আ. কে শুইয়ে ছুরি চালাচ্ছিলেন হযরত ইসমাঈল আ. এর গলা কাটছিল না। কারণ, আল্লাহর কুদরতে ছুরি ও গলার মাঝখানে একটি পিতলের টুকরা অন্তরায় হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য হযরত ইসমাঈল আ. কে যবেহ করে ফেলানো ছিল না; বরং হযরত ইবরাহীম আ. এর ত্যাগ যাচাই করা আর এটা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে, তাই আল্লাহর পক্ষ হতে আওয়াজ এল,
وَ نَادَیْنٰهُ اَنْ یّٰۤـاِبْرٰهِیْمُ ﴿۱۰۴﴾ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْیَا
আর আমি আওয়াজ দিলাম, ও হে ইবরাহীম, তুমি খাবকে সত্য করে দেখিয়েছ।
এরপর আল্লাহ তাআলা হযরত ইসমাঈল আ. এর পরিবর্তে কোরবানীর জন্য আসমান থেকে এক দুম্বা নাযিল করলেন এবং সেটা কোরবানী করলেন। উদ্দেশ্যও হাসিল হয়ে গেল, ছেলেও বেঁচে গেল। আল্লাহ যাকে চান এভাবেই রক্ষা করেন। বর্ণিত আছে, হযরত ইবরাহীম আ. যখন পুত্র ইসমাঈল আ. কে কোরবানী করার উদ্দেশ্যে মিনায় নিয়ে কোরবানী করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন তখন শয়তান হযরত ইবরাহীম আ. কে প্ররোচনা দিতে চাচ্ছিল। ইবরাহীম আ. তার প্রতি সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করে তাকে বিতাড়িত করেছিলেন। আর এরূপ তিনবার ঘটেছিল। আজ হজের মৌসুমে হুজ্জাজে কেরাম যে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করে সেটা আল্লাহর মকবুল ও প্রিয় বান্দা খলীল আ. এরই স্মৃতি।—মাআরেফুল কুরআন থেকে সংকলিত ও সংক্ষেপিত
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আ. এর ত্যাগের কিছু হিস্যা দান করুন। আমীন।