তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও উম্মাহর দরদ
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা.
[বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি মূলত বয়ানের অনুবাদ। ২০১৩ সালে শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. ব্রিটেন সফর করেন। সঙ্গে ছিলেন বেফাকুল মাদারিস পাকিস্তানের মহাসচিব মাওলানা হানীফ জালন্ধরী সাহেব। ব্রিটেনের এক মসজিদে ওলামায়ে কেরামের খুছুছী মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা হানীফ সাহেবের সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বয়ান করেন। রেকর্ড থেকে সে বয়ান অনুবাদ করেছেন মাওলানা মাহবুবুর রহমান]
الحمد لله رب العامين. والصلاة والسلام على سيد المرسلين قائد الغر المحجلين و على من تبعهم باحسان إلى يوم الدين. اما بعد. فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم. فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَۃٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ وَلِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ لَعَلَّهُمْ یَحْذَرُوْنَ.
হযরত ওলামায়ে কেরাম ও সম্মানিত উপস্থিতি
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
এটি আমার জন্য বড় আনন্দ ও সৌভাগ্যের এবং পরীক্ষার মুহূর্ত। আল্লাহ তাআলা আপনাদের সঙ্গে এখানে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন—এটা আমার জন্য আনন্দ ও সৌভাগ্যের। পাশাপাশি এটা আমার জন্য পরীক্ষারও। কারণ, ওলামায়ে কেরামের মাহফিলে মুখ খোলা (কিছু কথা বলা) আমার কাছে সর্বদা ধৃষ্টতা ও দুঃসাহস মনে হয়। বিশেষত আজকের এ মজলিসে—যদিও আপনারা সবাই আমার থেকে বড়; তথাপি—কিছু ব্যক্তি এমন আছেন, যারা আমার থেকে বয়সেও বড়, ইলমেও বড়। অনেকে এমন আছেন, যারা মর্যাদায়ও বড়, আমলেও বড়, তবে বয়সে আমার ছোট। কিন্তু অনেকে এমন আছেন যারা বয়সেও বড়। হযরত মাওলানা আব্দুর রশীদ রব্বানী সাহেব—যিনি আমার বরাবর বসে আছেন—তিনি আমাদের দারুল উলূম করাচির স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। দারুল উলূম যখন বর্তমানের কওরাঙ্গিতে স্থানান্তরিত হয় তখন তা ছিল পানি ও উদ্ভিদশূন্য বিরান এক মরুভূমি। সে সময় আমি মেশকাত জামাতে ছিলাম। আর তিনি দাওরায়ে হাদীসে ছিলেন। দারুল উলূম থেকে প্রথম যে জামাতটি ফারেগ হয়েছিল মাওলানা আব্দুর রশীদ রব্বানী সাহেব সে জামাতের প্রদীপতুল্য তালিবুল ইলম ছিলেন। তো তিনি আমার থেকে বয়সেও বড়, ইলমেও বড়, মর্যাদায়ও বড়। তিনি স্বয়ং আজকের এ মাহফিলে উপস্থিত হয়েছেন এবং আমাকে আপনাদের সামনে বসার নির্দেশ দিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছেন। এটা তাঁর মর্যাদা ও বড়ত্বের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর মর্যাদাকে দিন দিন বৃদ্ধি করুন।
ওলামায়ে কেরামের সামনে কথা বলা এ জন্য পরীক্ষা মনে হয় যে, সবাই আহলে ইলম। আল্লাহ তাআলা তাদের থেকে খেদমত নিচ্ছেন। আমি তাদের সামনে কী নসীহত করব? নসীহত করার কিছু থাকলে তার দায়িত্ব পালন করেছেন আমার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ভাই মাওলানা হানিফ জালন্ধরী সাহেব। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত সারগর্ভ আলোচনায় এমন সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন, যা আমাদের সবার জন্য পথনির্দেশক। আল্লাহ তাআলা তা বোঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন।
কিন্তু মজলিস যখন হয়েই গেছে এবং আমাকে আপনাদের সামনে বসিয়েই দেওয়া হয়েছে, তখন বুযুর্গদের থেকে শোনা কিছু কথা তাকরার করা হবে। যার লক্ষ্য হবে প্রথম আমি নিজে এরপর অন্যরা।
সর্বপ্রথম আমি আপনাদেরকে অন্তর থেকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা এই দেশে আপনাদের মাধ্যমে ঈমান ও ইলমের আলোর বিস্তার ঘটিয়েছে। আমি এই দেশে ১৯৭৮ সনে এসেছিলাম। তখনকার অবস্থা আর আজকের অবস্থা তুলনা করলে আসমান—জমিনের তফাত মনে হয়। তখন লন্ডনের মতো শহরেও মসজিদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। আর এটা কারও পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না যে, এই দেশে ইলমে দীনের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। মুসলমানদের মধ্যে এ দেশের বিষাক্ত প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে আজ এ দেশের অলিতেগলিতে অসংখ্য মসজিদ এবং শিশুদের জন্য মকতব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামী স্কুল, ইসলামী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহর খাছ মেহেরবানীতে মেয়েদের জন্য শরঈ পর্দাসহ তালীম—তরবিয়তের যে ব্যবস্থা হয়েছে, কয়েক বছর আগে এর কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। আল্লাহ তাআলা এই মহান খেদমত আপনাদের দ্বারাই আঞ্জাম দিয়েছেন।
কেউ প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো মসজিদে ইমামতি করছেন, কোনো মকতবে দীন শেখাচ্ছেন—এটা দেখতে ছোট মনে হতে পারে। এর দৃষ্টান্ত হলো, কোথাও ছোট্ট কোনো প্রদীপ প্রজ¦লিত করা হলো। এ প্রদীপ যেখানেই থাকুক তা থেকে আলোই ছড়াবে। আলোকিত করে অন্ধকার দূর করবে। তো আপনাদের প্রত্যেকে যে যেখানেই কাজ করছেন, সে আলোই ছড়াচ্ছেন। আর এই আলোর প্রভাব নজরে পড়ছে দেশের আনাচে—কানাচে।
মুফতী শফী রহ.—এর কাছে ব্রিটেনের চিঠি
এখানে যখন অল্প কিছু মুসলমান এসে বসবাস শুরু করেছিলেন তখন তারা আব্বাজান মুফতী শফী রহ.—এর কাছে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে তাঁরা লিখেছিলেন, ‘এখানে হালাল গোশত পাওয়া খুবই মুশকিল। আমাদেরকে কোনোভাবে طعام اهل الكتاب حل لكم (তথা আহলে কিতাবের খাবার তোমাদের জন্য হালাল) এ মূলনীতির আলোকে এ ফত্ওয়া দিয়ে দিন যে, এখানের বাজারে পাওয়া যাওয়া গোশত অন্তত হাজত ও জরুরতের ভিত্তিতে খাওয়া জায়েয।’ আব্বাজান রহ. এমন পরিস্থিতিতেও বললেন, কোনো কোনো সময় জরুরত ও হাজতের ভিত্তিতে ভিন্ন মাযহাবের মত অনুযায়ী ফত্ওয়া দেয়ারও অবকাশ আছে। ইমাম শাফী রহ.—এর মতে তো বিসমিল্লাহ ছাড়া জবাইকৃত পশুর গোশত হালাল। কিন্তু আজকে যদি আমরা অন্য মাযহাবের মতানুযায়ী সে গোশত খাওয়ার ফত্ওয়া দিয়ে দিই, তাহলে কখনো ওই দেশে সহজে হালাল গোশত মিলবে না। এ জন্য আজ আমরা এ কঠোর ফত্ওয়া দেব। চাই এতে মানুষ আমাদেরকে কট্টরপন্থি বলুক বা পশ্চাৎপদ বলুক কিংবা অন্ধ অনুসারীর অপবাদ দিক। তবুও আমাদের ফত্ওয়া এটাই, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানরা নিজেরা হালাল গোশতের ব্যবস্থা না করবে, ততক্ষণ তাদের জন্য গোশত খাওয়া জায়েযই হবে না।
সে ফত্ওয়ার সুফল আজ দেখতে পাচ্ছেন যে, অলিতে—গলিতে হালাল গোশতের দোকান পাওয়া যায়। ওই সময় যদি এ ফত্ওয়া দেওয়া হতো যে, জরুরতের ভিত্তিতে খাও, তাহলে এখন এ দৃশ্য আর এই পরিবেশ তৈরি হতো না। এখন যে পরিবেশ হয়েছে এবং হচ্ছে আর দিন দিন আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এসব আপনাদের চেষ্টা ও এখলাছের সুফল। আপনাদের মেহনত ও মুজাহাদার ফসল। আল্লাহ তাআলা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে আপনাদেরকে এ সম্মানে ভূষিত করেছেন। এর জন্য যতই শোকর আদায় করা হোক, তা কমই হবে।
একটি কথা হলো আল্লাহ তাআলা আপনাদের মাধ্যমে এই নূর ও আলোর বিস্তার ঘটিয়েছেন। আর মাওলানা হানীফ জালন্ধরী সাহেব তার সংক্ষেপে যে কথাগুলো বলেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা মাওলানাকে জাহেরী ও বাতেনী উন্নতি দান করুন। উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করুন। আল্লাহ তাআলা তাকে অনেক নিসবত দ্বারা সম্মানিত করেছেন। তাঁর সম্মানিত দাদার নিসবত তিনি পেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে আমাদের দীনি মাদরাসা ও জামিয়াসমূহের খেদমতের জন্য এমন সময়ে ও এমন বয়সে নির্বাচন করেছেন, যখন সাধারণত এ ধরনের গুরুদায়িত্ব মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন এবং পালন করা আরও কঠিন। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে তিনি সে বয়সেই তার দ্বারা এ বিরাট খেদমত আঞ্জাম নিয়েছেন। মাওলানার উপস্থিতিতে এ কথাগুলো বলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের এ বিষয়টি বোঝা ও অনুভব করা খুবই জরুরি। আল্লাহ তাআলা তাকে দীন ও দুনিয়ার কল্যাণ ও সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি দান করুন এবং এর উত্তম বিনিময় দান করুন।
তাফাক্কুহ ফিদ্দীন
আমি কিছু কথা তাকরার করার ইচ্ছা করেছি। সেই লক্ষ্যে এ আয়াত তিলাওয়াত করেছি :
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَۃٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ وَلِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ لَعَلَّهُمْ یَحْذَرُوْنَ.
আমার স্মরণ আছে, আব্বাজান রহ. একবার দারুল উলূমে কয়েক সপ্তাহব্যাপী এই আয়াতে কারীমার তাফসীর করেছেন। আয়াতের একেকটি শব্দে যে শিক্ষা রয়েছে তা এমনভাবে খুলে খুলে বয়ান করেছেন যে, কখনো এ আয়াত নিয়ে এভাবে ফিকির করার সুযোগই হয়নি। তার সে আলোচনা থেকে দুটি কথা তাকরার করতে চাই। তা হলো এই, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য (তালিবে ইলমদের জন্য) দুটি বাক্য ব্যবহার করেছেন :
এক. لِیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ
দুই. لِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ
আব্বাজান রহ. এ শব্দ দুটির যে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা সংক্ষিপ্ত সময়ে আলোচনা করলে আশা করি কাজে লাগবে। তিনি বলেছিলেন, একটি হলো, لِیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ। এখানে لِيَتَعَلَّمُوا الدِّيْنَ বলেননি। لِيَتَعَلَّمُوا الدِّيْنَ বাক্যটি لِیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ এর তুলনায় সহজ ও ছোট। لِیَتَفَقَّهُوْا এর জন্য في এই صلهটি ব্যবহার করতে হয়েছে। لِيَتَعَلَّمُوا বললে صله ছাড়াই متعدي হতো। لِیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ বলার কারণ হলো, علم অর্থ জানা। কোনো কিছু নিছক জেনে নেওয়া বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলতের বিষয় নয়। শয়তানও তো জানত। বলা হয়, সে এত বড় ইলমওয়ালা ছিল যে, ইমাম রাযিকে পর্যন্ত একপর্যায়ে গিয়ে যুক্তিতে হারিয়ে দিয়েছিল। সে ঘটনা সবারই জানা আছে। ইলম তো তার কাছেও ছিল। আকল—বুদ্ধিতেও সে বড় ছিল। বুদ্ধির জোর এতটাই ছিল যে, আল্লাহ তাআলার সামনে যে দলীল পেশ করেছিল, সেটাকে শুধু আকল ও বুদ্ধির আলোকে খণ্ডন করার সুযোগ নেই।
خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّ خَلَقْتَهٗ مِنْ طِیْنٍ
শুধু বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে দলীলের জবাব দেওয়া আমাদের পক্ষে বড় মুশকিল। তার বুদ্ধিও বেশি ছিল, ইলমও বেশি ছিল। থানভী রহ. বলেন, তার ভেতর তিন আইন (ع) ছিল। বড় عاقل (বুদ্ধিমান) ছিল, বড় عالم (জ্ঞানী) ছিল, বড় عابد (ইবাদতগুজার) ছিল। কেননা বর্ণনায় পাওয়া যায়, সে অনেক ইবাদত করত। তবে চতুর্থ আইনের ঘাটতি ছিল। عاشق ছিল না। যদি ইশক ও মহব্বত থাকত তাহলে সে خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّ خَلَقْتَهٗ مِنْ طِیْنٍ বলত না। বরং সে বলত, আপনি আমার খালেক। আপনি যা ইচ্ছা হুকুম দেবেন। আমার কাজ হলো, আপনার হুকুমের সামনে মাথা নত করা। বিনা বাক্যব্যয়ে তা পালন করা। তো সে عالم ছিল, عاقل ছিল, عابد ছিল, কিন্তু عاشق ছিল না। যার ফলে সে এত ভ্রষ্ট হয়েছে এবং এত অপদস্থ হয়েছে। অতএব শুধু জানা যথেষ্ট নয়, এটা ফযীলত ও মর্যাদার মাপকাঠি নয়। যদি যথেষ্ট হতো তাহলে ইবলিসই বড় হতো।
তো শুধু জানা যথেষ্ট নয়; বরং لِیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ দীনের ফিকহ (বুঝ) অর্জন করতে হবে। দীনের বুঝ শুধু ইলম দ্বারা অর্জিত হয় না, শুধু কিতাব দ্বারা অর্জিত হয় না। দীনের বুঝ, দীন বুঝনেওয়ালার সোহবত দ্বারাই অর্জন হয়। দীনের বুঝ কী? দীনের বুঝ হলো, আমার দীন আমার কাছে কখন কী চায়, দীনের কখন কী দাবি, তা সঠিকভাবে বুঝতে পারা। দীনের যে সময় যে দাবি আসে, তার ওপর আমল করার নামই হলো, تفقه فى الدين।
হযরত থানভী রহ.—এর ঘটনা
হযরত থানভী রহ.—এর জমানায় এক গ্রামে ইরতিদাদ তথা ধর্মত্যাগের ফেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল। বড় মারাত্মক ফেতনা। মানুষ মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। তবে সেখানে কিছু লোক এমন ছিল, যারা এখনো স্পষ্ট মুরতাদ হয়নি। তবে কিছু বিষয়ে কাফেরদের চালচলন অবলম্বন করেছিল। হযরত থানবী রহ. সেখানে গেলেন। ওই সকল মুসলমানদের কাছে, যারা তখনও মুসলমান ছিল, মুরতাদ হয়নি। সে সময় ভারতে শুদ্ধি অভিযান চলছিল। যার ফলে বহু মুসলমান ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করছিল। হযরত বললেন, নাকি এ শুদ্ধি অভিযানে তোমরা ইসলাম ছেড়ে দিয়েছ?
তারা উত্তর দিল, না তো, আমরা তো মুসলমান। আমরা তো তাজিয়াও বহন করি। আমরা তো মুসলমান।
হযরত থানভী রহ. বললেন, আচ্ছা, তোমরা তাজিয়া বহন করো? ঠিক আছে, তোমরা তাজিয়া বহন করো। এটা করতে থাকো। দেখো, এটা যেন ছেড়ে না দাও আবার!
এখন তাজিয়া বহনের কথা বলা বাহ্যিকভাবে কেমন? এটাকে বেদাত বলেন বা রুসম বলেন, যা কিছুই বলেন, এটা তো জায়েয নেই। তারপর হযরত তাদের এ কথা কীভাবে বললেন? এর কারণ ছিল, তখন এটাই তাদের কুফর ও ইসলামের মাঝে পার্থক্যকারী আলামত ছিল। এখন যদি তাদেরকে এটা থেকে বাধা দেওয়া হয় তাহলে তারা ইরতিদাদের শিকার হয়ে পড়বে। আর যদি তাদেরকে এখন এটাই করতে দেওয়া হয় তো সামনে এর সংশোধনের রাস্তা বের হবে।
এটাই নিছক ইলম ও تفقه في الدين এর মাঝে পার্থক্য। কোন পরিস্থিতিতে দীনের কী দাবি এবং কীসের মধ্যে দীনের ফায়দা—তা বুঝে গ্রহণ করার নামই হলো تفقه في الدين। এখন যদি কেউ ফত্ওয়া চায় যে, এক মৌলবী সাহেব এসে গ্রামবাসীকে বলেছে, তোমরা তাজিয়া বহন করো। তো এই মৌলবী সাহেবের কী হুকুম? এর জবাব যদি تفقه في الدين ছাড়া শুধু ইলমের ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তাহলে এর জবাব তো এটাই হবে, বেহুদা কথা বলেছে, গোমরাহীর কথা বলেছে। এমন ব্যক্তিকে পথভ্রষ্টই বলা হবে। কিন্তু কোন জায়গায়, কোন পরিস্থিতিতে, কোন পর্যায়ে, কোন বিষয়ে শিথিলতা করা হয়েছে এবং কোন বিষয়ে কঠোরতা করা হয়েছে, তা বোঝার নামই تفقه في الدين। আর এই تفقه في الدين শুধু কিতাব পড়েই অর্জিত হয় না। শুধু দরসে বসে ডিগ্রি অর্জন করার দ্বারা, সার্টিফিকেট অর্জন করার দ্বারা হাসিল হয় না। এটা বুযুর্গদের সোহবত দ্বারা হাসিল হয়।
نہ کتابوں سے نہ وعظوں سے نہ زر سے پیدا
دین ہوتا ہے بزرگوں کی نظر سے پیدا
কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে, ওয়াজের মজলিসে ঘুরে ঘুরে বা অর্থ—কড়ির বহর দিয়ে দীন পয়দা হয় না। বুযুর্গদের নেক দৃষ্টিতেই কেবল দীন পয়দা হয়।
মাওলানা মুজাফফর হুসাইন রহ.—এর ঘটনা
হযরত মাওলানা মুজাফফর হুসাইন কান্ধলভী রহ. এক অনন্য মনীষী ছিলেন। একবার তিনি কয়েকজন সাথিসহ পদব্রজে দিল্লির উদ্দেশে সফরে বের হলেন। পথে মাগরিবের নামাযের সময় হলো। নামাযের জায়গা তালাশ করছিলেন। গ্রামের ভেতর একটি মসজিদ পেলেন ঠিকই, কিন্তু একেবারে বিরান হয়ে আছে। ধুলো—বালিতে ভরপুর। হযরত মসজিদে প্রবেশ করলেন। আযান দিলেন। আযানের পরেও কেউ মসজিদে এলো না। ঝাড়– দিয়ে ধুলো—বালি পরিষ্কার করে সাথিদের নিয়ে জামাতে নামায আদায় করলেন।
খুব আফসোস করলেন, হায় আল্লাহ! এখানে মুসলমানরা বসবাস করে। অথচ মসজিদ বিরান পড়ে আছে। আযানও হলো, কিন্তু আল্লাহর একটি বান্দাও নামাযে এলো না। হযরতজী গ্রামবাসীর কাছে গেলেন। মুসলমানদের জিজ্ঞেস করলেন, ভাই, মসজিদ বিরান হয়ে আছে। খালি পড়ে আছে। আপনারা কেন নামায পড়তে আসেন না?
তারা বলল, আসলে আমাদের গ্রামে যিনি নবাব সাহেব, তিনি নামাযের প্রতি একেবারেই অমনোযোগী। দীন থেকে গাফেল। তিনি মসজিদে আসেন না। তিনি মসজিদে আসলে গ্রামের সবাই মসজিদে আসবে, নামায পড়বে।
হযরত তখন বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নবাব সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। নবাব সাহেবকে বললেন, ভাই, আপনি মুসলমান। আপনার এলাকার মসজিদ বিরান হয়ে পড়ে আছে। আপনি মসজিদে এলে গ্রামের সবাই মসজিদে আসবে, নামায পড়বে। আর সবার সওয়াব আপনি পেয়ে যাবেন।
হযরতের কথায় নবাবের ভেতরে কিছুটা প্রভাব পড়ল। বলল, মাওলানা, নামায আমি পড়তে যাব ঠিকই, কিন্তু দুটি কাজ ছাড়তে পারব না।
হযরত জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ?
নবাব বলল, একটি হলো আমি মদ পান করি এবং আমার কাছে খারাপ মহিলারা যাতায়াত করে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, আমি অযু করতে পারব না। তো অযু ছাড়া কীভাবে নামায পড়ব?
হযরত বললেন, আচ্ছা, আপনি একটি ওয়াদা করেন।
বলল, কী ওয়াদা?
বলেলন, অযু ছাড়াই নামায পড়বেন। তবুও নামায পড়ার ওয়াদা করুন। আপনি অযু ছাড়া নামায পড়লেও এলাকার লোকজন আপনার দেখাদেখি নামায পড়তে আসবে।
সে বলল, অযু ছাড়া নামায হবে কীভাবে?
হযরত বললেন, আমি বলছি অযু ছাড়াই নামায পড়–ন।
সে বলল, আচ্ছা, অযু ছাড়া নামায!
হযরত বললেন, অযু ছাড়া নামায হোক আর না হোক, আপনি অযু ছাড়াই নামায পড়ার ওয়াদা করুন। আর অন্য যে কাজ আপনি ঘরে করে থাকেন, করুন। কিন্তু নামাযে আসবেন। ওয়াদা করুন, আগামীকাল যোহর থেকে নামাযে আসবেন।
এরপর হযরত মাওলানা মুজাফফর সাহেব সেখান থেকে উঠে মসজিদে গেলেন। আল্লাহর দরবারে খুব কান্নাকাটি করলেন, হে আল্লাহ, আমি তাকে এ পর্যন্ত এনেছি, বাকি অযু করানো আপনার হাতে।
পরের দিন যোহরের সময় হলো। নবাব সাহেবের ওয়াদার কথা মনে হলো। যখন রওনা হলো, তখন তার দিলে নাড়া দিলো, আল্লাহর বান্দা, তুমি প্রথম দিন নামায পড়তে যাচ্ছ। অন্তত আজকের জন্য অযুটা করে নাও। সে অযু—গোসল করে মসজিদে গেল। নামায পড়ল। এরপর আল্লাহ তাআলা তার দিল এমন পরিবর্তন করে দিলেন যে, আরও যত অন্যায় কাজ ছিল, সব ছেড়ে দিল।
এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, মাওলানা মুজাফফর হুসাইন সাহেব বলেছেন, অযু ছাড়া নামায পড়ো। কিতাবে তো আছে, কেউ যদি তাচ্ছিল্য করে অযু ছাড়া নামায পড়ে তো সে কাফের হয়ে যাবে। শুধু ইলম দ্বারা ফত্ওয়া দিলে উত্তর এটাই হবে। কিন্তু এখানেتفقه في الدين ছিল।
তো لِیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ বলা হয়েছে। আমাদের কাজ, আমাদের তালিবে ইলমদের কাজ শুধু হরফ ও নকশার ইলম অর্জন করা নয়। আমাদের কাজ হলো দীনের বুঝ অর্জন করা। কোন সময় দীনের কী দাবি—তার ওপর আমল করা। আর তা বুযুর্গদের সোহবতে থেকে অর্জন করা।
উম্মতকে ভীতি প্রদর্শন করা ও সতর্ক করা
আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, لِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ অর্থাৎ স্বজাতিকে اِنْذَار করবে। আব্বাজান রহ বলেন, اِنْذَار এর তরজমা উদুর্তে করলে অর্থ হবে ڈرائے ভয় দেখাও। উদুর্তে এর জন্য একটাই শব্দ আছে। আর কোনো শব্দ নেই। আরবী ভাষায় ভীতিপ্রদর্শনের ধরন অনুপাতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ আছে। ভয় তো সাপ—বিচ্ছু থেকেও দেখানো হয়, ডাকাত থেকেও ভয় দেখানো হয়, ক্ষতিকর জিনিস থেকেও ভয় দেখানো হয়। এগুলোর জন্য اِنْذَار ব্যবহৃত হয় না। اِنْذَار বলা হয়, কারও প্রতি মহব্বতের কারণে ভয় দেখানো যে, আমার ভয় হচ্ছে, তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে। আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি নিজেকে এই ক্ষতি থেকে বাঁচাও। এটা হলা اِنْذَار।
কোরআন শরীফে অসংখ্য জায়গায় نَذِيْر শব্দ এসেছে। সকল নবী—রাসূলের জন্য نَذِيْر শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। نَذِيْر শব্দের মধ্যে এ বিষয়টি রয়েছে যে, অন্যের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বতের কারণে তাকে ভয় দেখানো ও সতর্ক করা। যেমন : বাবা তার ছেলেকে ভয় দেখায়, মা তার সন্তানকে ভয় দেখায়, উস্তাদ তার ছাত্রকে ভয় দেখায়। এখানে সন্তান ও ছাত্রকে যে ভয় দেখানো হচ্ছে তার কারণ হলো তার প্রতি স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা। এখানে তাকে তিরস্কার বা গালমন্দ করাই মূল উদ্দেশ্য থাকে না। বরং তার প্রতি পরম মমতা ও ভালোবাসা থেকেই ভয় দেখানো হয় ও সতর্ক করা হয়। এটাই হলো, لِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ।
আর এই اِنْذَار এর আরেকটি দিক হলো, (মাওলানা হানীফ সাহেব যেদিকে ইশারা করেছেন) ভাষা এমন হবে, যা মানুষের অন্তরকে ছুঁয়ে যাবে। গালির জবাব গালি দিয়ে দেবে না। গালির জবাব ফুল দিয়ে দেবে। আল্লাহর রহমতে নবীদের এ তাওফীক হয়েছে। নবীদের বলা হচ্ছে :
اِنَّا لَنَرٰىکَ فِیْ سَفَاهَۃٍ وَّ اِنَّا لَنَظُنُّکَ مِنَ الْکٰذِبِیْنَ
(আমরা তো মনে করি তুমি বোকামিতে লিপ্ত। আর আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।)
আমার মতো কেউ হলে জবাব দিত, বেটা তুই বোকা, তোর বাবা বোকা, তোর দাদা বোকা। কিন্তু নবীর শান দেখুন। নবী জবাব দিচ্ছেন :
یٰقَوْمِ لَیْسَ بِیْ سَفَاهَۃٌ وَّ لٰکِنِّیْ رَسُوْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ
(হে আমার জাতি, আমি বোকা নই; বিশ্বপ্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল।)
তাদের গালি ও অপবাদকে তাদের সাধারণ কোনো সংশয় ধরে তার নিরসনে বলে দিয়েছেন, আমি আসলে বোকা নই। হযরত মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. একবার বয়ান করছিলেন। বয়ান চলাকালীন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, মাওলানা, আমি তো শুনেছি, আপনি হারামজাদা!
এ কথা বলা হয় মাওলানা বয়ান করার সময়। আজকে আমরা একটু কল্পনা করে দেখি, যদি কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলে, তো প্রথমত আমরা এর কী জবাব দেব। আমাদের পাশে যে সকল লোক থাকবে তারাই তো তার অবস্থা খারাপ করে ফেলবে।
হযরত ইসমাঈল শহীদ রহ. জবাব দিলেন, ভাই, আপনি ভুল শুনেছেন। আপনার কাছে ভুল খবর পেঁৗছেছে। আমার মায়ের বিয়ের সাক্ষী তো এখনো দিল্লিতে জীবিত আছেন।
সুতরাং انذار এর মধ্যে স্নেহ—মমতা ও ভালোবাসা আছে। ঘৃণা নেই। বলা হয়েছে, কুফরের প্রতি ঘৃণা আছে, কাফেরের প্রতি নয়। গোনাহের প্রতি ঘৃণা আছে, গোনাহগারের প্রতি নয়। ওই ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা নেই। তার প্রতি স্নেহ আছে, মহব্বত আছে, দরদ আছে। ফলে তার ব্যাপারে সে আশঙ্কা করে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদের কোমর ধরে জাহান্নাম থেকে ফেরানোর চেষ্টা করছি। আল্লাহ তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছেন :
لَعَلَّکَ بَاخِعٌ نَّفْسَکَ اَلَّا یَكُوْنُوْا مُؤْمِنِیْنَ
তারা ঈমান আনছে না, এই দুঃখে হয়তো আপনি নিজেকেই শেষ করে দেবেন।—সূরা শুআরা : ৩
এ হলো দরদভরা দিল। ব্যথাভরা হৃদয়। দিলের মধ্যে এ আগুন লেগে গেছে যে, আমি আমার কওমকে যেভাবেই হোক বাঁচাব। এই ছিল দিলের অবস্থা। অথচ কোরআনে কারীমে এমন নবীর কথাও এসেছে, যেখানে প্রায় নিশ্চিত ছিল যে, আমি কিছু বললেও কোনো কাজ হবে না, কোনো ফায়দা হবে না। ফেরাউনের ব্যাপারেই এমন হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তো জানতেনই যে, সে ঈমান আনবে না। কিন্তু বলা হচ্ছে :
لَعَلَّهٗ یَتَذَکَّرُ اَوْ یَخْشٰی
(আশা করা যায় সে উপদেশ গ্রহণ করবে বা সতর্ক হবে।)
আল্লাহর ইলমে আছে, সে কাফের অবস্থায়ই মরবে। কিন্তু হে মূসা, হে হারুন, তোমরা তো দাঈ, মুবাল্লিগ। তোমাদের দিলের মধ্যে এই আশা অবশ্যই থাকতে হবে যে :
لَعَلَّهٗ یَتَذَکَّرُ اَوْ یَخْشٰی
নবীকে বলা হচ্ছে :
لِمَ تَعِظُوْنَ قَوْمَۨا ۙ اللهُ مُهْلِكُهُمْ
(এমন জাতিকে কেন উপদেশ দিচ্ছেন যাদের আল্লাহ ধ্বংস করে দেবেন।)
তখন এর জবাব দেওয়া হচ্ছে :
مَعْذِرَۃً اِلٰی رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ یَتَّقُوْنَ
অন্তত আল্লাহ তাআলার সামনে এ জবাব দিতে পারব যে, আমি আপনার বার্তা পেঁৗছে দিয়েছি। এবং হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে হেদায়েত দিয়ে দেবেন।
তো হতে পারে যে, বাহ্যিকভাবে শ্রোতাদের মধ্যে দাওয়াত কবুল করার কোনো আলামত নেই, সম্ভাবনা নেই। তবুও দাঈর প্রতি হুকুম হলো, তোমরা দিলের মধ্যে এই আশার আলো জ্বালিয়ে রাখো, হতে পারে আমার কথা তার জন্য কাজে লাগবে। এই পদ্ধতি আমরা অবলম্বন করলে, আল্লাহ তাআলা তার রহমতে আমাদের অন্তরেও সেই দরদ, সেই মহব্বত, সেই ব্যথা ও সেই আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে দেবেন, যা আল্লাহ তাআলা নবীদের মধ্যে দিয়েছিলেন।
বলা হয়েছে :
العلماء ورثة الانبياء
(আলেমরা নবীগণের ওয়ারিশ।)
আর ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী তো সবকিছুতেই অংশীদার হয়। মৃত ব্যক্তি একটি সুঁই রেখে গেলেও তাতে সব ওয়ারিশ অংশীদার হবে। সুতরাং যারা নবীদের ওয়ারিশ, তারা নবীদের সব বৈশিষ্ট্য, গুণ ও চেতনার ওয়ারিশ হবে। এরই একটি অংশ হলো দিলের মধ্যে এই ফিকির থাকা যে, কীভাবে আমার কওম সঠিক পথে চলে আসবে।
দুটি বিষয় জরুরি, তাফাক্কুহ ফিদ্দীন এবং মহব্বত ও দরদ নিয়ে অন্যের কাছে পয়গাম পেঁৗছানোর প্রেরণা। তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা তার কাজের মধ্যে বরকত দেবেন। আর এর জন্য আমি সর্বশেষ যে কথাটি বলব তা হলো, তাফাক্কুহ ফিদ্দীন শুধু কিতাব পড়ে অর্জিত হয় না। এটা বুযুর্গদের সোহবত দ্বারা অর্জিত হয়। এখন আফসোস, আমাদের সামনে এই বুযুর্গ নেই। কিন্তু আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে তাদের জীবনচরিত, তাদের বয়ান ও তাদের ঘটনাবলি সংরক্ষিত আছে। আমার আবেদন হলো, আমাদের মতো তালিবে ইলমদের উচিত, এই সকল আকাবির, যাদের ওসিলায় আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ পর্যন্ত এনেছেন, তাদের জীবনচরিত, কথা ও বয়ানকে নিজের জীবনের অযিফা বানিয়ে নেওয়া।
হযরত থানভী রহ. বলতেন, আসল জিনিস তো বুযুর্গদের সোহবত দ্বারা অর্জন হয়। কিন্তু কারও জন্য যদি এর সুযোগ না হয়, তাহলে তাদের হালাত ও মালফুযাত সোহবতের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। সুতরাং হযরত থানভী রহ. থেকে নিয়ে হযরত মাদানী রহ., হযরত উসমানী রহ. এবং তাদের পরবর্তী সকল বুযুর্গের জীবনচরিত সংরক্ষিত আছে, আলহামদুলিল্লাহ। তাদের মেজায, তাদের চিন্তা—চেতনা ও তাদের কর্মপদ্ধতি সবই সংরক্ষিত আছে। এগুলো পড়ার দ্বারাও সেই সোহবতওয়ালা ফায়দা হাসিল হয়ে যায়।
কিন্তু আফসোস, আমরা এটা থেকেও গাফেল। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের জীবনচরিতও আমাদের জানা নেই। সাওয়ানেহে কাসেমী আছে, তাযকিরাতুর রশীদ আছে, তাযকিরাতুল খলীল আছে। কয়জন পাওয়া যাবে যে এগুলো পড়েছে? আমার মতে এগুলো তো বারবার পড়ার জিনিস এবং এগুলোকে নিজের অযিফা বানানো উচিত। কেননা এর মাধ্যমে তাদের ওই সকল গুণাবলি, যেগুলোর দ্বারা আল্লাহ তাআলা উম্মতের মাঝে আলো ছড়িয়েছেন, সেগুলো আল্লাহর রহমতে আমাদের মধ্যেও আসতে পারে। আমি আবেদন করব, আমরা সবাই এই নিয়ত করি যে, এই সকল বুযুর্গদের জীবনী ও মালফুযাতকে নিজের জীবনের অযিফা বানিয়ে নেবো। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আশা করা যায় যে, এর দ্বারা কিছুটা হলেও ওই গুণাবলি আমাদের মধ্যে ঢেলে দেবেন, যা আমাদের জন্য অনেক উপকারী হবে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।