প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

তালিবুল ইলমের উদ্দেশে কিছু জরুরি কথা

তালিবুল ইলমের উদ্দেশে কিছু জরুরি কথা

মুফতী রফী উসমানী

 

الحمد لله و كفى والصلاة والسلام على نبيه المجتبى وعلى عباده الذين اصطفى، أما بعد :

সম্মানিত উপস্থিতি ও শ্রোতামণ্ডলী

আমাদের জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আবারও বুখারী শরীফের ইফতিতাহের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনা করার তাওফীক দান করেছেন। আজকের এ মজলিস বুখারী শরীফের ইফতিতাহ তথা উদ্বোধনী সবকের দিন, আবার নতুন শিক্ষাবর্ষেরও প্রথম দিন।

(বুখারী শরীফের) হাদীসের সনদে যে সকল মহান ব্যক্তিবর্গের নাম উচ্চারিত হয়েছে তাঁদের প্রত্যেকেই ইলম ও আমলের পাহাড় ছিলেন। এমন ইলমী ব্যক্তিত্ব খুব কমই হয়ে থাকে। তাঁরা সকলেই এমন উঁচু পর্যায়ের বুযুর্গ ছিলেন যে, তাঁদের নামেও বরকত আছে। আমরা আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁদের বরকত দান করবেন।

ইমাম বুখারী রহ. কিতাব শুরু করেছেন এ হাদীস দিয়ে,

إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى

অর্থাৎ আমলের ভিত্তি ও বুনিয়াদ হলো নিয়তের উপর। প্রত্যেকে তা—ই লাভ করবে যার সে নিয়ত করবে।

ইমাম বুখারী রহ. অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন :

كَيْفَ كَانَ بَدْءُ الْوَحْيِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

অর্থাৎ এ অধ্যায়ে আলোচনা হবে কীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার সূচনা হয়েছিল? এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার ধরন কী ছিল? কিন্তু এ শিরোনামের অধীনে হাদীস এনেছেন,

إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّات وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى.

অর্থাৎ আমলের ভিত্তি ও বুনিয়াদ হলো নিয়তের উপর। প্রত্যেকে তা—ই লাভ করবে যার সে নিয়ত করবে।

বাহ্যিকভাবে এ হাদীসের সঙ্গে তরজমাতুল বাব তথা অধ্যায়ের শিরোনামের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করে কেউ কোনো যোগসূত্র বের করলে করতেও পারে, কিন্তু বাহ্যিকভাবে কোনো যোগসূত্র নেই। ইমাম বুখারী রহ. তাঁর এ হাদীসগ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় এমনটি করেছেন। তিনি এটি করেছেন তালিবুল ইলমের মনোযোগ আকর্ষণ ও সচেতন করার উদ্দেশ্যে। এখানেও ইমাম বুখারী রহ. এমনই করেছেন। শিরোনাম দিয়েছেন, كَيْفَ كَانَ بَدْءُ الْوَحْيِ আর হাদীস এনেছেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّات।

ইমাম বুখারী রহ. বলতে চান, সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে নিজের অন্তরের খবর নাও, নিজের দিকে একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দাও, নিয়ত ঠিক করে নাও। এমন যেন না হয়, এ কিতাব পড়া ও পড়ানোর উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত অন্য কিছু। তাই প্রথমেই নিজের নিয়ত ঠিক করে নাও।

আজকের দিনে দাওরায়ে হাদীস ও অন্যান্য জামাতের তালিবুল ইলম, আসাতিযায়ে কেরাম এবং দারুল উলূমের খাদেমগণের জন্যে ইমাম বুখারী রহ.—এর পক্ষ থেকে প্রথম সবক হলো—আজ নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনা হচ্ছে এবং এমন এক মহান আমল হচ্ছে সর্বসম্মতিক্রমে উম্মতের সকল ইজতিমায়ী কর্মকাণ্ড ও নফল ইবাদত—বন্দেগীর মধ্যে যা সবচেয়ে উত্তম—এ মহান কাজ শুরুর পূর্বে প্রত্যেকে নিজেদের নিয়তের খবর নিই এবং নিয়ত ঠিক করে নিই।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন,

تدارس العلم ساعة من الليل خير من إحياءها

রাতের কোনো এক অংশে দ্বীনি ইলম শেখা ও শেখানোর কাজে মগ্ন থাকা সমগ্র রাত আল্লাহর ইবাদতে কাটানোর চেয়ে উত্তম।—মেশকাত

অতএব এ মহান আমল শুরু করার আগে নিজেদের নিয়ত দুরস্ত করে নিই। কারণ নিয়তের উপরই আমলের ভিত্তি ও বুনিয়াদ। যেহেতু আমলের ভিত্তি নিয়তের উপর তাই নিয়ত দুরস্ত না হলে কিছু আমল তো আদায়ই হয় না। যেমন : নামায, রোযা, হজ, যাকাত সহীহ হওয়ার জন্য নিয়তের উপর নির্ভরশীল। কিছু আমল নিয়ত ছাড়া আদায় হয়ে যায়, যেমন : ওযু, কিন্তু নিয়ত না থাকার কারণে সওয়াব পাওয়া যায় না। মোটকথা নিয়তের কারণে কোনো কোনো আমল আদায়ই হয় না, আর কোনো আমল আদায় হলেও সওয়াব পাওয়া যায় না।

মনের ইচ্ছা ও সংকল্পকে নিয়ত বলা হয়। মুখে নিয়ত করা জরুরি নয়। মূল নিয়ত হয় অন্তরে। কেউ কেউ মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করাকে জরুরি মনে করে। এটা ঠিক নয়। মুখে উচ্চারণ না করলেও মনে নিয়ত থাকলেই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে মুখে নিয়ত করল ঠিকই কিন্তু মন থেকে করেনি, তাহলে মুখের এ নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।

 

কী নিয়ত করব

প্রথমে নিয়ত করতে হবে, আমরা যা কিছু পড়ব বা পড়াব—চাই তা কোরআনে কারীমের তাফসীর হোক, হাদীস হোক, ফিকহ হোক বা অন্য কোনো শাস্ত্র হোক—এর মধ্যে যেগুলোর সম্পর্ক আকীদার সঙ্গে, সেগুলোর মাধ্যমে নিজেদের আকীদা দুরস্ত করব, যেগুলোর সম্পর্ক আমলের সঙ্গে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সেগুলোর উপর আমল করব।

খুব ভালোভাবে মনে রাখবেন, আমরা যা কিছু পড়ি বা পড়াই, তার সবই প্রথমে নিজের জন্য। এ পড়া ও পড়ানো অপরের জন্যেও, তবে তা দ্বিতীয় পর্যায়ে। অতএব প্রথমে নিজে আমল করার নিয়তে পড়তে হবে। কোনো বিষয় মনে রাখার সবচেয়ে শক্তিশালী ও উত্তম উপায় হলো তার উপর আমল করা। বারবার জপলেও কোনো বিষয় এতটা মনে থাকে না, যতটা আমল করার দ্বারা থাকে। আজ থেকে যদি আমরা এ হাদীসের উপরও আমল করতে শুরু করি তাহলে এ হাদীসও আমাদের স্মরণে থাকবে।

আমাদের দ্বিতীয় যে নিয়ত করতে হবে তা হলো, সুন্নত মোতাবেক নিজেদের জীবন গঠন করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পয়গাম অন্যদের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য ইলম হাসিল করব। এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা লাভ করতে পারব। এ নিয়তকে গলার তাবিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখুন। অন্তরের অন্তঃস্থলে গেঁথে নেন। তালিবে ইলম, আসাতিযা, খাদেম সকলকেই এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে।

 

গুরুত্বপূর্ণ একটি সূক্ষ্ম বিষয়

বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার একটি বড় অনুগ্রহ হলো, মানুষ নেক নিয়তে কোনো কাজ শুরু করার পর কাজ করার সময় ওই নেক নিয়তের প্রতি তার খেয়াল না গেলেও যদি সে এ নেক নিয়তের বিপরীত কোনো কিছু না করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তার নেক নিয়তের সওয়াব ও বিধান অক্ষুণ্ণ রাখেন। কারণ সর্বক্ষণ নিয়ত স্মরণে রাখা জরুরি নয়।

 

সহীহ নিয়তের মাঝে গলদ নিয়তের অনুপ্রবেশ

বিপরীত নিয়ত কী হতে পারে? উদাহরণত এ নিয়ত করা, আমি আলেম হব, আমার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে অথবা কোনো বড় পদ পেয়ে যাব, কোনো বড় চাকরি পাব অথবা আমাকে আল্লামা বলা হবে, এ যুগে আরও কত কি উপাধি লাভ হবে—এ সবই গলদ নিয়ত। এ ধরনের কোনো নিয়ত চলে এলে পূর্বের নিয়ত বাতিল হয়ে যাবে। তখন আর এ কাজ ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না; বরং গোনাহে পরিণত হবে। (اللهم احفظنا منه) পাশাপাশি আমাদের দুআ করতে থাকা উচিত যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহীহ নিয়ত করার এবং সহীহ নিয়তের উপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করেন।

পঠিত হাদীসের আলোকে এ পর্যন্ত কিছু কথা নিবেদন করলাম। অবশিষ্ট আলোচনা দরসগাহে হবে, ইনশাআল্লাহ। এখন তালিবে ইলম ভাইদের উদ্দেশে কিছু কথা বলতে চাই।

 

ইলমের মাধ্যমেই দ্বীন টিকে থাকবে

প্রথম কথা হলো, আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত যে তিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠতর কাজে নিয়োজিত হওয়ার তাওফীক দান করেছেন। এ কাজের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। আর বিষয়টি সুস্পষ্টই  কারণ এর মাধ্যমেই দ্বীন টিকে থাকবে। যে দ্বীনের ইলম বাকি থাকে না সে দ্বীন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঈসায়ীদের ওই দ্বীন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে যা হযরত ঈসা আ. নিয়ে এসেছিলেন। কারণ তাঁর ইলম অবশিষ্ট নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দ্বীনে ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জিম্মাদারি গ্রহণ করেছেন। তারা বড়ই সৌভাগ্যবান যারা এ দ্বীন টিকিয়ে রাখার কাজে নিজেদের শ্রম ও মেধা ব্যয় করবে। দ্বীন টিকে থাকার সবচেয়ে প্রথম ধাপ হলো, তা’লীমে দ্বীন। সাধারণভাবে তা’লীমে দ্বীনের জিম্মাদারি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জিম্মাদারি। যদিও জিহাদ ও তাবলীগেরও অনেক ফযীলত আছে। কিন্তু খুব ভালোভাবে মনে রাখবেন, সাধারণ পরিস্থিতিতে তা’লীমে দ্বীনের কাজ এ দুটো থেকে উত্তম। যদিও কোনো কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে এ দুটির গুরুত্ব তা’লীমে দ্বীন থেকেও বেড়ে যায়। উদাহরণত, একবার জিহাদ চলাকালীন এক ব্যক্তি মুসলমান হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে লোকটি নিবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল, কী আমল করব?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জিহাদ চলছে, জিহাদে শরিক হয়ে যাও।

লোকটি জানতে চাইল, যদি আমি এ জিহাদে মৃত্যুবরণ করি তাহলে আমার কী হবে?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জান্নাতে যাবে।

এ কথা শুনে ওই সাহাবী জিহাদে অংশগ্রহণ করলেন। অত্যন্ত বিরত্বের সঙ্গে লড়াই করলেন এবং শাহাদতের মর্যাদা লাভে ধন্য হলেন। সোজা জান্নাতে চলে গেলেন।

এ সময় এ সাহাবীকে হাদীস পড়া, ইলমে দ্বীন হাসিল করা কিংবা নামায পড়ারও হুকুম দেওয়া হয়নি। কারণ, তখন কোনো নামাযের ওয়াক্ত ছিল না। বোঝা গেল এটা বিশেষ এক অবস্থা ছিল। তবে সাধারণ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উত্তম হলো তা’লীমে দ্বীন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ দ্বীনের খেদমত করার পাশাপাশি এ মহা নেয়ামতের মূল্যায়ন করার এবং আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

শোকরের মর্ম

শোকরের মর্মের ভেতর এ বিষয়টি মৌলিকভাবে অন্তভুর্ক্ত যে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে সকল নেয়ামত দান করেছেন আমরা সে নেয়ামতগুলো আল্লাহ পাকের নাফরমানির কাজে ব্যবহার করব না। আল্লাহ তাআলা যেহেতু আমাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে তা’লীমে দ্বীনের নেয়ামত দান করেছেন অতএব তা হাসিলের জন্য পূর্ণ অভিনিবেশের সঙ্গে আত্মনিয়োগ করতে হবে। নিজেদের সময়কে অন্যায় ও গোনাহের কাজ থেকে হেফাজত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যেতে হবে।

 

আমাদের আকাবিরের ত্যাগ ও কোরবানী

আজকে হাদীসের সনদে যে সকল মনীষীর নাম উচ্চারিত হয়েছে তাঁদের জীবনী খুলে দেখুন। তাঁদের জীবনচরিত পাঠ করুন। ইমাম বুখারী রহ.—এর জীবনী দেখুন। ইলমে দ্বীন হাসিলের জন্য কত কষ্ট, মুসিবত ও দুর্দশা সয়েছেন। ইমাম বুখারী রহ. জীবনের একটি দীর্ঘ সময় পার করেছেন কোনো তরকারি না খেয়ে। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তাররা তাঁর প্রস্রাব পরীক্ষা করে বললেন, এটা তো কোনো খ্রিষ্টান সন্নাসী পাদরির প্রস্রাব বলে মনে হয়, যে কোনো ধরনের তরকারি খায় না। ইমাম বুখারী রহ.—কে জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন, আমি ৪০ বছর যাবৎ তরকারি খাই না। ডাক্তাররা এর চিকিৎসায় তরকারি খাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু তিনি তরকারি খেতে অস্বীকার করলেন। পরে উলামা ও মাশায়েখের পীড়াপীড়ির পর সম্মত হলেন যে, ঠিক আছে রুটির সঙ্গে মিষ্টিজাতীয় কিছু খেয়ে নেব।—হাদয়ুস সারী : ৪৮১; তাহযীবুল আসমা, ১ম খণ্ড

ছাত্রজীবনে একবার তিনি হঠাৎই দরসে আসা বন্ধ করে দিলেন। তাঁর সহপাঠীদের দুশ্চিন্তা হলো, সে তো কখনো সবকে দেরি করে আসে না; তো আজ একেবারে এলোই না কেন? পরদিনও যখন তিনি এলেন না তখন সহপাঠীরা খোঁজখবর নিতে তার ঘরে গেল। দরজায় কড়া নাড়ল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। অবশেষে তারা উঁচু আওয়াজে বলল, বুখারী, জীবিত থাকলে উত্তর দাও। না হয় আমরা দরজা ভেঙে তোমার অবস্থা জেনে নেব।

ইমাম বুখারী ভেতর থেকে জবাব দিলেন, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমি দরসে হাজির না হওয়ার কারণ হলো, আমার আসলে একজোড়া কাপড়ই ছিল। ওটাই পরিধান করতাম। ছিঁড়ে গেলে তালি দিয়ে নিতাম। কিন্তু এখন তা এতটাই পাতলা হয়ে গিয়েছে যে আর তালি লাগানোর উপযুক্ত নয়।

ইমাম নববী রহ.—এর জীবনী পড়ে দেখুন। কত বড় ইমাম ও কত মর্যাদাশীল মুহাদ্দিস ছিলেন। শাফেয়ী মাযহাবে তিনি আসহাবুত তারযীহের অন্তভুর্ক্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বুযুর্গদের মাঝেও সুউচ্চ মর্যাদা অধিকারী করেছিলেন। কিন্তু হায়াত পেয়েছেন মাত্র ৪৫ বছর। বিয়ে করেননি। জীবনে কখনো দুই তরকারি একসঙ্গে খাননি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেবল এক ঘণ্টা বিশ্রাম করতেন। অবিশষ্ট সময় ইবাদত—বন্দেগীতে কাটাতেন। আল্লাহর যিকির ও ইলমে দ্বীনের চর্চায় ডুবে থাকতেন। ইলমের ময়দানে এত বড় বড় কাজ করে গেছেন মাত্র ৪৫ বছরের জীবনেই। আর তা—ও মুসিবত ও দুঃখ—কষ্টের উপত্যকা পাড়ি দিয়ে। সীমাহীন দারিদে্র্যর মাঝে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেসব কষ্টে নিপতিত করেননি। আমাদের কাছে সেসব কোরবানী ও ত্যাগ—স্বীকারের দাবিও করেননি। আমাদের জন্য সুযোগ—সুবিধার এত ব্যবস্থা রেখেছেন যে, যদি আমাদের এ যুগকে সে যুগের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে মনে হয় আল্লাহ আমাদের শাহজাদা বানিয়ে রেখেছেন। সবকিছুর তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ যুগে হাদীস পড়া কত সহজ করে দিয়েছেন। অথচ সে যুগে হাদীস পড়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। সকল হাদীস এক জায়গায় অবস্থান করে পড়া সম্ভব ছিল না। কিছু হাদীস পাওয়া যেত বসরায়। কিছু শামে। কিছু ইরাকে। কিছু হাদীসের জন্য হেজায সফর করতে হয়েছে। সে সফরও হতো পাথেয়বিহীন। আল্লাহ তাআলা আমাদের থেকে সে কষ্ট ও মুজাহাদার দাবি করেননি। আমাদের জন্য কত সহজ ব্যবস্থা করেছেন, থাকা—খাওয়া, চলাফেরা সব। ছাত্ররা এখানে থাকে। উস্তাদগণও এখানে থাকেন। সব ধরনের নেয়ামত এখানে বিদ্যমান। অতএব আমাদের জন্য সে মহান দাতার শোকর আদায় করা জরুরি।

শোকরের মূল কথা হলো নিজের সময়কে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচাবে। তাকওয়া অবলম্বন করবে। সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে। সময় আপনাদের কাছে আমানত। উম্মত এ অর্থ—সম্পদ দারুল উলূমকে দিয়েছে আপনাদের পেছনে ব্যয় করার জন্যই। নিজেদের দিন—রাতের কামাই, কষ্টের উপার্জন আপনাদের জন্য ব্যয় করছে যেন আপনারা নিজেদের সময়কে দ্বীনি ইলম অর্জনে ব্যয় করেন এবং দ্বীন প্রচারের এ কাজকে অগ্রসর করেন। মনে রাখবেন, দ্বীনের তাবলীগ ও প্রচার—প্রসার ততক্ষণ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ না তাকে আমলের মাধ্যমে সুসজ্জিত করা না হবে।

 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমগ্র পৃথিবীর জন্য আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। সে আদর্শকে প্রত্যক্ষ করে সাহাবায়ে কেরামের নমুনা তৈরি হয়েছে। আমরা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আসহাবে সুফফা ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্দরতম আদর্শ ধারণের জন্যই এখানে এসেছি তখন প্রতিটি আমল এবং প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণে তাঁদের আদর্শকে নিজেদের জীবনে ধারণ করতে হবে। আমলের মাধ্যমে দ্বীনের যে প্রসার ঘটে তা মুখে বলার দ্বারা ঘটে না। তাই ইলমকে আমলে পরিণত করার চেষ্টা করুন। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনি আপনার সময় গোনাহ ও নাফরমানি থেকে হেফাজত করবেন।

 

দারুল উলূমের নিয়মকানুন মেনে চলুন

এমনইভাবে আমাদেরকে নিয়ম—কানুন মেনে চলার ক্ষেত্রেও ওই সাহাবায়ে কেরামের পথ ও পদ্ধতিকে গ্রহণ করতে হবে। আপনারা জানেন, এখানকার সবকিছু নিয়মমাফিক করা হয়। এখানে নিয়ম—কানুনের ঊর্ধ্বে কেউ নেই। সাধারণ একজন খাদেম থেকে নিয়ে পরিচালক পর্যন্ত সকলেই নিয়ম—কানুনের অধীন। এখানে কোনো ত্রুটি হলে তা ত্রুটি হিসেবেই দেখা হবে। ছাড় দেওয়া হবে না। প্রতিটি বিষয়ের জিম্মাদার নিযুক্ত আছেন। আপনি বিষয়টি হয়তো জেনে গিয়ে থাকবেন, আর না জেনে থাকলে জেনে নেওয়া জরুরি যে, এখানে যে বিষয়ের যিনি জিম্মাদার সে বিষয়ে তাঁর আনুগত্য করা আবশ্যক। কারণ, গোনাহের বিষয় ব্যতীত সকল বিষয়ে আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব। এখানে তো আর গোনাহের কোনো হুকুম কেউ দেবে না। আল্লাহ না করুন, যদি এমন কোনো নির্দেশ কেউ দেন তাহলে তা মান্য করা যাবে না, বরং তার অমান্য করা ওয়াজিব হবে।

 

নিয়মকানুন মেনে চলার ফায়দা

এখানে আপনাকে নিয়ম—কানুন মেনে চলতে হবে। এটা আপনার জন্য অমূল্য নেয়ামত। এর ফলে আপনার অসংখ্য ফায়দার মধ্যে বড় একটি ফায়দা এই হবে যে, আপনি সুশৃঙ্খল জীবন কাকে বলে তা শিখতে পারবেন। তা ছাড়া এজন্যও নিয়ম—নীতি মেনে চলা জরুরি যে, এটা শরীয়তেরও নির্দেশ। এর দৃষ্টান্ত হলো শরীয়তের আমীরকে মান্য করা ওয়াজিব। কারণ নিয়ম—শৃঙ্খলা রক্ষা করতে আমীরের নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। জায়গায় জায়গায় দারুল উলূমের নিয়ম—কানুন লেখা আছে। দেওয়ালে, বোর্ডে, কাগজে লেখা আছে। এগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন। দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা লাভ করবেন।

 

কিছু লক্ষণীয় বিষয়

নিয়ম—শৃঙ্খলা মেনে চললে সকলেরই আরাম হয়। তাই বিশেষ করে ইজতিমায়ী জায়গাগুলোতে নিয়ম—শৃঙ্খলার প্রতি যত্নবান হওয়া বেশি জরুরি। যেমন : রান্নাঘর, মসজিদ ও এমন—সব জায়গা যেখানে একসঙ্গে অনেকে একত্র হয়।

শরীয়তের মাসআলা হলো যখন জামাত শুরু হয়ে যায় তখন জামাতের কাতারের কাছে সুন্নত পড়া কোনো সুরতেই মাকরুহ থেকে মুক্ত নয়। ফুকাহায়ে কেরামের কেউ কেউ তো জামাতের কাছাকাছি সুন্নত পড়তে একেবারেই নিষেধ করেছেন। যারা পড়ার অনুমতি দিয়েছেন তারাও বিভিন্ন শর্ত আরোপ করেছেন। যেমন : যতটা সম্ভব কাতার থেকে দূরে সুন্নত পড়বে। কিন্তু দেখা যায়, কিছু তালিবে ইলম এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখে না।

এমনইভাবে জামাতে কাতার করার তারতীব হলো মাঝখান থেকে কাতার শুরু হবে। অথচ কখনো দেখা যায়, ডান দিক থেকে তালিবে ইলমরা এলে ডান দিক থেকেই কাতার শুরু করে দেয়। বাম দিক থেকে এলে বাম দিক থেকে শুরু করে। এ বিষয়গুলো পড়ার সময়ই যদি না শিখেন তো কখন শিখবেন।

রান্নাঘরের বিষয়টিও এমনই। ওখানে খাবারের জন্য লাইন লেগে যায়। একজন উস্তাদকে নিয়মতান্ত্রিক নেগরানী করতে হয়। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। যাদের জীবন মাদরাসায় কেটেছে, ক্বালাল্লাহ আর ক্বালার—রাসূলের পরিবেশে যাদের সময় কেটেছে তাদের তো এতটা সুশৃঙ্খল হওয়া কাম্য ছিল যে তাদের কোনো নেগরানের প্রয়োজন হবে না। আফসোস, আমরা এর উপর আমল করতে পারিনি।

আপনারা জানেন, أرض مباح তথা এমন জায়গা যা সুনির্দিষ্ট কারও মালিকানায় নয়, যে প্রথমে আসবে সে—ই তার হকদার হবে। অন্য কারও জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। যেমন : আপনি মসজিদে নামাযের জন্য গেলেন আর প্রথম কাতারে বসে পড়লেন। এখন কারও এ অধিকার নেই যে আপনাকে উঠিয়ে নিজে বসে যাবে। এমনইভাবে রান্নাঘরের লাইন ভাঙা, কাউকে ধাক্কা দিয়ে আগে চলে যাওয়া সুস্পষ্ট নাজায়েয ও জুলুম। এটা মাদরাসার কানুনের লঙ্ঘন। শরীয়তের পরিপন্থি। অতএব আপনার জন্য জরুরি হলো লাইনে এমনভাবে দাঁড়াবেন যেন অপর কোনো সাথির বিন্দু পরিমাণ কষ্ট না হয়।

আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই যেন দেশে ইসলামী আইন ও ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রণয়ন করে। আমাদের এ দাবি সঠিক। তাদের জন্যও আমাদের এ দাবি পূরণ করা জরুরি। কিন্তু আপনাদের কাছে আমার নিবেদন হলো, আপনারা নিজেদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটু ভাবুন, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও দারুল উলূমের অভ্যন্তরে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, ক্ষুদ্র শহর ও ছোট্ট একটি পৃথিবী দিয়েছেন। আমরা আমাদের এ রাষ্ট্রে ইসলামের বিধান কার্যকর করি। যেন এখানে আগমনকারী প্রত্যেকে দেখে নিতে পারে ইসলামী সমাজব্যবস্থা কেমন হতে পারে?

আজ আমরা যখন ইসলামী আইন বাস্তবায়নের কথা বলি তখন তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে বর্তমানে পৃথিবীতে কোথাও কি ইসলামী আইন প্রচলিত আছে? যাকে আপনারা নমুনা হিসেবে দেখাতে পারেন? তখন আমাদের এ উত্তরই দিতে হয় যে, নেই। আমাদের উচিত আমরা এ প্রতিষ্ঠানে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা। ইসলামী কানুনের মধ্যে এটাও আছে যে লাইন ভাঙা যাবে না। বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। মানুষকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।

 

মুসাফাহার আদব

আরেকটি বিষয়ের প্রতি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি, আর তা হলো নিঃসন্দেহে মুসাফাহা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। কিন্তু সব ইবাদতের কিছু আদব, কিছু নিয়ম—নীতি ও কিছু পদ্ধতি থাকে। মুসাফাহা করা মুস্তাহাব। সালামের সূচনা করা সুন্নতে মুআক্কাদা। আর সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তু আজকাল সালামকে তো জরুরি মনে করে না কিন্তু মুসাফাহাকে জরুরি মনে করে। চাই এর জন্য যা কিছুই করার দরকার হয়। চাই কাউকে ধাক্কা দিয়ে, আঘাত করে আগে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। মুসাফাহার প্রতিযোগিতা এক অনিঃশেষ তুফানে পরিণত হয়েছে। নামায ছুটে যাক, সালাম ছুটে যাক, সালামের জবাব ছুটে যাক—কোনো পরোয়া নেই, তবুও মুসাফাহা করতে হবে।

একবার আমি নামায পড়তে আসছিলাম। জামাত শুরু হয়ে গেছে। এক তালিবে ইলম আমাকে দেখতেই কাতারে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আমার সঙ্গে মুসাফাহা করতে ছুটে এলো। এ নির্বোধের নিবুর্দ্ধিতা তো দেখুন। তাকে কেউ জিজ্ঞেস করুক, এটা কি মুসাফাহা করার সময়?

 

অপরকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকুন

ভাই, মুসাফাহা অবশ্যই করবেন তবে ওই সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে। এমনভাবে মুসাফাহা করুন যেন কারও কষ্ট না হয়। এমনইভাবে তালিবে ইলম একসঙ্গে অবস্থান করে। আমাদেরকে সকল সাথির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে যেন কারও অপছন্দের বা কষ্টের কিছু না ঘটে। কখনো যদি অপছন্দনীয় কোনো বিষয় ঘটে যায় তাহলে তা বরদাশত করে নিতে হবে।

হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্য—শাবানের রাতে (শবে বরাতে) কবরস্থানে যাওয়ার জন্য উঠলেন। তখন পায়ের দিক দিয়েই কেবল যাওয়ার জায়গা ছিল। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাবলেন আমি ঘুমিয়ে গেছি। অথচ আমি সজাগই ছিলাম। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ের দিক দিয়ে বিছানা থেকে নামলেন। ধীর কদমে পা বাড়ালেন। আস্তে করে দরজা খুললেন। খুব সতর্কতার সঙ্গে দরজা বন্ধ করলেন। অতঃপর জান্নাতুলে বাকীতে গমন করলেন। ঘটনা দীর্ঘ।

আমার বলার উদ্দেশ্য হলো, হযরত আয়েশা রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী। আর স্ত্রী—ও রাসূলের জন্য জীবন উৎসর্গকারী স্ত্রী। কোনো কষ্ট হলে তিনি আনন্দচিত্তে তা মেনে নিতেন। কিন্তু বিশ্বজগতের রহমত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাইলেন, তাঁর ঘুমের যেন ব্যাঘাত না ঘটে। তাই পায়ের দিক দিয়ে বিছানা থেকে নামলেন এবং খুবই ধীরপদে সন্তর্পণে বাইরে বের হলেন।

আমাদেরও সঙ্গী—সাথিদের প্রতি পরিপূর্ণ লক্ষ রাখা জরুরি। সাথি বিশ্রাম করছে তো বাতি না জ্বালাই। প্রয়োজন পড়লে প্রয়োজনমতোই জ্বালাই। শোরগোল ও শব্দ না করি। মোটকথা সামাজিক যত হক আছে আমরা তার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখব। ইসলামে সামাজিক হকসমূহের প্রতি খুব বেশি লক্ষ রাখা হয়েছে। সুন্দর সামাজিক আচরণের সারমর্ম ও সকল উত্তম গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিবরণ এসে গেছে এই এক হাদীসেই :

المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده.

এ মূলনীতি মনে রাখবেন যে, আমাদের কোনো কথা বা কাজে যেন কারও কষ্ট না হয়। এর থেকে সমাজ—জীবনের সকল হক ও অধিকার এমনিতেই বুঝে এসে যাবে।

আদব কাকে বলে

আমার শাইখ ও মুর্শিদ হযরত ডা. আব্দুল হাই আরেফী সাহেব রহ. একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আদবের সংজ্ঞা কী?

আমি চুপ রইলাম।

হযরত নিজেই বললেন, আদব হলো তোমার কোনো কাজ বা কথায় যেন কেউ কষ্ট না পায়।

সবত্র আদবের দাবি একরকম হয় না। উদাহরণত, আজকাল মনে করা হয় বুযুর্গদের পেছনে পেছনে চলাই আদব। অথচ এটা কোনো কায়েদায়ে কুল্লিয়া তথা সর্বত্র প্রযোজ্য মূলনীতি নয়। যদি এমন হয়, আপনি বড় কারও সঙ্গে চলছেন আর কথা বলছেন। এখন আপনি যদি তার পেছনে পেছনে চলেন তাহলে আপনার কথার জবাব দেওয়ার জন্য তাকে বারবার পেছনে ফিরতে হবে। এটা বেআদবি গণ্য হবে। এখানে আদবের দাবি হলো বরাবরে চলুন। এমনইভাবে যদি দুজন থাকে তাহলে আদবের দাবি হলো একজন উস্তাদের ডান পাশে থাকবে আর অপরজন বাম পাশে। এখন উস্তাদ দুজনেরই কথা শুনতে পারবেন। দুজনেরই কথার জবাব দিতে পারবেন।

কখনো আদবেরই দাবি হয় বড়দের আগে চলা। উদাহরণত আপনি অন্ধকার রাতে আপনার বাবা, শাইখ বা উস্তাদের সঙ্গে চলছেন। আর পথ বিপদসংকুল। এখানে কি আপনি বলবেন, আব্বাজান আপনি আগে আগে চলুন আমি পেছন পেছন আসছি? বরং এখানে আদবের দাবি হলো এ কথা বলা যে, আমি আগে আগে চলছি, আপনি আমার পেছনে পেছনে আসুন।

 

পড়ালেখার সময় রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সভাসমাবেশে অংশগ্রহণ করা নিষেধ

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা দারুল উলূমের কানুনের মধ্যে এসেছে তা হলো, দারুল উলূমে পড়া অবস্থায় রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কোনো সভা—সমাবেশে অংশগ্রহণ করার অনুমতি নেই। অরাজনৈতিক ও নিখাঁদ দ্বীনি কোনো মজলিস হলে সেখানে যেতেও আপনাকে মাদরাসার অনুমতি নিতে হবে। মনে রাখবেন, আপনাদের বাবা—মা আমাদের উপর ভরসা করেছেন বলেই এতদূর থেকে আপনাদেরকে আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন। আপনারা কত দূর—দূরান্ত থেকে এখানে এসেছেন। চাতরাল থেকে এসেছেন। বেলুচিস্তান থেকে এসেছেন। আরও বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন। দীর্ঘ সফরের কষ্ট বরদাশত করে এসেছেন। আমি এটাও জানি, এখানে ভর্তি হতে গিয়েও আপনাদের বিভিন্ন পেরেশানীর সম্মুখীন হতে হয়েছে। এসবই আপনাদের সকলের উপকারার্থে ও শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যই করা হয়েছে। যাতে হকদার তার অধিকার পেয়ে যায়। এ উদ্দেশ্যে এসব ব্যবস্থাপনা। আর আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের আসাতিযায়ে কেরামকেও বহু কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এক শ্রেণিতে ছয়জন তালিবে ইলম প্রয়োজন। খাতা জমা দিয়েছে দুইশ ষোলো। তো ওই ছয়জনের জন্যে আসাতিযায়ে কেরামকে দুইশ খাতাই দেখতে হয়।

এ কষ্ট স্বীকারেও আপনাদের জন্য কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। কারণ দ্বীনের যে কাজে যতটা কষ্ট হবে তাতে ততটা বরকত হবে। ইলমে দ্বীনের জন্য এ কষ্ট স্বীকার আপনাদেরকে না জানি কতটা উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবে। তো আপনাদের বাবা—মা এজন্যেই আমাদের কাছে আপনাদের পাঠিয়েছেন যেন আমাদের সন্তানদের দ্বীনি ও আখলাকী দীক্ষা লাভ হয় এবং তাদের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা পায়। আপনারা জানেন, করাচি শহরের নিরাপত্তার যে কী দুর্দশা চলছে। দ্বীনি মাদরাসার তালিবে ইলমদের না জানি কী পরিমাণ দুশমন এখানে আছে। সমগ্র কুফরী দুনিয়া মাদরাসার তালিবে ইলমদের দুশমন। এ কারণেও আপনাদের দারুল উলূম থেকে বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাআলা সব ধরনের নেয়ামত দান করেছেন। মাদরাসা থেকে বের হওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। সবকিছুই ভেতরে মজুদ আছে। আসাতিযায়ে কেরাম আছেন। কিতাবপত্র আছে। দরসগাহ আছে। মসজিদ ও জুমার নামাযও এখানে হয়। খাবারের ব্যবস্থাও এখানেই। খেলাধূলার মাঠও আছে। ডাক্তারও আছে। টেলিফোনের সহজ ব্যবস্থা আছে। পোস্ট অফিস ও ক্যান্টিনও আছে। অতএব অনুমতি ছাড়া দারুল উলূম থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আপনারা জেনে থাকবেন হয়তো কয়েক বছর আগে কয়েকজন ছাত্রকে এজন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল যে তারা মাদরাসার অনুমতি ব্যতীত বাইরের সভায় অংশগ্রহণ করেছিল। এখানে কোনো আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এটা দেখা হয় না যে, এখন বছরের শুরু না শেষ। যেকোনো সময় কানুন প্রয়োগ হতে পারে।

আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহ যে এখানে এমন তালিবে ইলমও অনেক আছেন যাদের মেহনত—মুজাহাদা দেখে খুব খুশি লাগে। অন্তর থেকে তাদের জন্য দুআ আসে। আলহামদুলিল্লাহ প্রতি বছর দাওরা হাদীসের বহুসংখ্যক তালিবে ইলম এমন থাকে যাদের পুরো বছরে এক দিন তো দূরের কথা এক ঘণ্টারও ছুটি বা অনুপস্থিতি নেই। আর ছুটি তো দূরের কথা কোনো ঘণ্টায় দেরি করেও আসে না। কোনো একটি হাদীসও ছুটেনি এমন বহুসংখ্যক তালিবে ইলম থাকে বুখারী শরীফে। মুসলিম শরীফেও। বড় একটি সংখ্যা আবূ দাউদসহ অন্যান্য কিতাবের ক্ষেত্রেও হয়।

ভেবে দেখুন, এটা সাধারণ কষ্ট নয়। এর পেছনে বড় ধরনের মুজাহাদা আছে। কারণ মেহনত ছাড়া কিছু হয় না। আমরা দুআ করি, আর এটা আমাদের আশাও যে, এ সংখ্যা যেন আরও বৃদ্ধি পায়। (আমীন)

 

ইলম অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মৌলিক বিষয়

ইলম অর্জনের জন্য আমাদেরকে এ তিনটি মৌলিক বিষয় মেনে চলতে হবে :

এক. সবকের আগের মুতালাআ।

দুই. সবকে উপস্থিতি।

তিন. তাকরারের প্রতি যত্নবান হওয়া।

যে তালিবে ইলম এ তিন বিষয়ের প্রতি যত্নবান হবে এবং পূর্ণ মেহনতের সাথে এর উপর আমল করবে আল্লাহ তাআলা তাকে ইলম থেকে কখনো বঞ্চিত করবেন না।

সবকের আগের মুতালাআয় দুটি মৌলিক ফায়দা আছে :

এক. এর দ্বারা কিতাব বোঝা ও হল করার যোগ্যতা তৈরি হয়।

দুই. এর দ্বারা সবক খুব ভালোভাবে হৃদয়ে গেঁথে যায়। আর মুতাআলার  জন্য এটা জরুরি নয় যে সবক পুরোপুরি বুঝে আসতে হবে। বরং হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেন, ‘মুতাআলার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে معلومات তথা জানা বিষয়কে مجهولات তথা অজানা বিষয় থেকে আলাদা করে ফেলা হলো।’

ইবারত পড়ল আর এ বিষয়টি বুঝে নিল যে কোন বিষয়টি বুঝে এসেছে আর কোন বিষয়টি বুঝে আসেনি। সবকে উপস্থিত হওয়া এবং নিয়মিত উপস্থিত থাকাতে অফুরন্ত বরকত আছে। কোনো তালিবে ইলম সে যত মেধাবীই হোক না কেন সবকে উপস্থিত না হয়ে কেবল নিজের যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে যদি কিতাব পড়েও নেয় তবুও সবকে উপস্থিতির বরকত সে লাভ করতে পারবে না। সে ওই বরকত থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। তাই নিয়মিত সবকে হাজির থাকা চাই। যেন আমরা সবক চলাকালীন আল্লাহর পক্ষ থেকে যে রহমত ও বরকতের ধারা অবতীর্ণ হয় তা থেকে বঞ্চিত না হয়ে যাই।

সবকের পর তাকরারের প্রতি কেউ যত্নশীল না হলে ইলমে গভীরতা লাভ করা সম্ভব নয়। তাকরারের দ্বারা সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদানের ক্ষমতা তৈরি হয়। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার যোগ্যতা তৈরি হয়। দাওয়াত ও তাবলীগের কৌশল জানা যায়। তাকরার এতটাই অতুলনীয় ও নজিরবিহীন বিষয় যে দুনিয়ার আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এখন তাকরারের পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে চিন্তা—ভাবনা করছে।

যে তালিবে ইলম এ তিনটি বিষয়ের প্রতি যত্নবান হবে, আল্লাহ তাআলার কাছে আশা করি, তিনি তো মানুষের চেষ্টার মূল্যায়ন করেন, ইনশাআল্লাহ তিনি সে তালিবে ইলমকে ইলমে নাফে থেকে মাহরুম করবেন না।

 

ইলম অর্জন ও তাকওয়া

ইলম অর্জনের জন্য এ বিষয়গুলোর উপর আমল করার পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। যে বিষয়টির উপর সকল বিষয়ের ভিত্তি। সে বিষয়টি হলো, আমাদের তাকওয়া অবলম্বনের চেষ্টা করতে হবে। কারণ তাকওয়া ব্যতীত ইলম অর্জিত হয় না। ইলম আল্লাহ তাআলার একটি নূর। তাকওয়াশূন্য হৃদয়ে আল্লাহর এ নূর কীভাবে প্রবেশ করবে?

তাকওয়া অর্জনের জন্য কোনো আল্লাহওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। তালিবে ইলমরা মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়ে খানকায় রওনা করে। আমরা চাই এ দ্বীনি মাদরাসাগুলোই খানকাহ হয়ে যাক।

আমাদের দাদাজান হযরত মাওলানা ইয়াসীন রহ.। যিনি হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.—এর সহপাঠী ও দারুল উলূম দেওবন্দের সমবয়সি ছিলেন। যে বছর দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা লাভ করে সে বছরই দাদাজান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আমি দারুল উলূম দেওবন্দের সে যুগ দেখেছি যখন দারুর উলূম দেওবন্দের সদরে মুদাররিস ও মুহতামিম থেকে নিয়ে সাধারণ খাদেম পর্যন্ত সকলে সাহেবে নিসবত আল্লাহওয়ালা ছিলেন।

এটাই তো দারুল উলূম দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, যেখানে তা একটি আদর্শ দরসগাহ সেখানে তা একটি খানকাও ছিল। আসাতিযায়ে কেরাম বুযুর্গগণের তারবিয়ত ও দীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন। তালিবে ইলমরা আসাতিযায়ে কেরামের খেদমতে থাকত। এ খেদমতে থেকেই তারা দ্বীন শিক্ষা করত। নিজেদের সংশোধন করে তাকওয়ার উচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত হতো। অতএব আমাদেরকেও দারুল উলূম (করাচি) এর সুরভিত ও পবিত্র পরিবেশকে গনীমত মনে করে আসাতিযায়ে কেরাম থেকে নিজেদের সংশোধন ও আত্মশুদ্ধিও করানো জরুরি। যেন আমরা তাকওয়ার মহাসম্পদ লাভ করতে পারি।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিয়ত বিশুদ্ধ করার ও ইলমের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

[ইসলাহী তাকরীরে ৯ম খণ্ড থেকে অনূদিত।

অনুবাদ, আব্দুল মুমিন

১৬ শাবান ১৪৪২ হিজরী। রাত ১১ : ৩০।]

 

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন