প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কথিত ইসলামিক স্কলারদের বালখিল্যতা

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কথিত ইসলামিক স্কলারদের বালখিল্যতা

পবিত্র কোরআন অনেক বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। যা অক্ষরে অক্ষরে হয় বাস্তবায়িত হয়েছে, নয়তো ভবিষ্যতে হবে। তবে সন—তারিখসহ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী কোরআনে করা হয়নি। এসবের ইঙ্গিত অনেকটাই রূপক। কিন্তু এর বাস্তবতা বাস্তবের চেয়েও সত্য। ঠিক এমনই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর হাদীসে প্রচুর ভবিষ্যদ্বাণী আছে। যেগুলো সুনির্দিষ্ট, কিছু আছে ইশারা আর অনেকগুলো প্রকৃত অর্থেই উন্মুক্ত। যেখানে স্থান, সময়, সংখ্যা ইত্যাদি আছে, সেখানে তো আছেই। যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবায়িত হয়ে গেছে, সেসব এখন আর অনিষ্পন্ন ভবিষ্যদ্বাণীরূপে নেই। অবশ্য বাস্তবায়িত হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে প্রকৃত মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুআররিখদের মধ্যে যদি ভিন্নমত থেকে থাকে তাহলে এটি উম্মাহর আমলে নেওয়ার মতো বিষয়। যেমন: গাজওয়ায়ে হিন্দ।

ইদানীং ভিন্নমত নেই এমন কিছু বিষয়েও কোনো কোনো ইসলামিক স্কলারখ্যাত ব্যক্তি মতামত দিচ্ছেন। যা উম্মাহকে দ্বিধায় ফেলছে। আলেম নন কিংবা আনুষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষা নেই, এমন আধুনিক শিক্ষিত লোকজন ভবিষ্যদ্বাণী—সংবলিত হাদীস বা কিতাবুল ফিতান অংশ পড়ে এমন সব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যা ইসলামী ঐতিহ্যের পরিপন্থি। অনেক মানুষ প্রকৃত আলেমদের কাছে না গিয়ে ভাচুর্য়াল জগতে এসব কথিত ইসলামিক স্কলারের কথা হাদীসের ব্যাখ্যা মনে করে আগ্রহভরে শুনছে। শুধু যে বিশ্বাস করছে তাই নয়; বরং এসব ব্যাখ্যাকে নিজেদের আকীদা—বিশ্বাসের স্থানে জায়গা করে দিচ্ছে।

কেউ বলছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর বর্ণিত কুসতুনতুনিয়া নাকি এখনো বিজিত হয়নি। আগামী কিছুদিনের মধ্যে কুসতুনতুনিয়া বিজিত হবে। তুরস্ক ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং পশ্চিমা জগৎ বিশেষত ইউরোপ এবং আশেপাশের এলাকায় পারমাণবিক যুদ্ধ হবে। আর এর কথাই মালহামা শব্দে হাদীস শরীফে এসেছে। এ ধরনের ইসলামিক স্কলাররা ফুরাতের ভেতর থেকে সোনার খনি উঠা এবং এ নিয়ে যুদ্ধে প্রতি একশজনের নিরানব্বই জন নিহত হওয়ার হাদীস নিজের মনের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। কখনো বলছেন, মাটি ফুড়ে সোনা উঠবে। কখনো বলছেন, ইরাকের তেলই সেই সোনা। কখনো বলছেন, আনবিক যুদ্ধ সামনে হবে। তখন একশর মধ্যে নিরানব্বই জন মারা যাবে। মালহামা বলতে তারা পারমাণবিক যুদ্ধকেই বুঝে নিয়েছেন। আর সে সময় গ্রামে চলে যাওয়া, খাদ্যশস্য মজুদ রাখা, পানির সংস্থান রাখা ইত্যাদি হাদীসকে গোজামিল দিয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

এসব দেড় হাজার বছর ধরে উলামায়ে কেরাম পড়ছেন, পড়াচ্ছেন। গ্রহণযোগ্য ও যথেষ্ট ব্যাখ্যাও তাঁরা দিচ্ছেন। কিন্তু নিজে একপেশে ও সীমিত জ্ঞানের অধিকারী, বিজ্ঞানমনস্ক এবং অস্থিরমতি হওয়ায় যুগে যুগে ব্যর্থ ব্যাখ্যাতাদের মতো আধুনিক সময়েও এসব কথিত ইসলামিক স্কলার, যা মনে আসে তাই বলে চলেছেন। দাজ্জাল নিয়ে তাদের মনগড়া বিশ্লেষণ, ইমাম মাহদী নিয়ে ধারণা—কল্পনা ও ঈসা আ. সম্পর্কে নানা রকম ব্যাখ্যা সব সময়ের মতোই স্থূল এবং ভ্রান্ত বলে সাব্যস্ত হচ্ছে। এসব ব্যাপারে প্রকৃত আলেম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুআররিখ ও মুফাককিরগণের আলোচনা সামনে আসা খুবই প্রয়োজন। মানুষ নিজেদের চিন্তার কাছাকাছি সহজ ও সস্তা চিন্তাকে সহজে গ্রহণ করে। তবে ইসলামী বিষয় বা কোরআন—সুন্নাহর গভীর, ব্যাপক, অর্থবহ বাণীকে—তা প্রকৃত অর্থে বা রূপক অর্থে যেটাই হোক—পূর্ববর্তী ব্যাখ্যাকারগণের নির্দেশনার আলোকে বোঝাই একমাত্র নিরাপদ ও সঠিক পন্থা, যা হক্কানী আলেমগণের কাছেই কেবল পাওয়া যায়।

করোনাকালে বিশ্বে যুদ্ধ ছিল না। পৃথিবীতে করোনার পর একটি যুদ্ধ শুরু হয়ে এখনো চলছে। রাশিয়া বনাম ইউক্রেন। ইউক্রেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশ না হলেও নানা কারণে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদনের একটি বড় অংশ সেখানে হয়। জ্বালানিও তাদের রয়েছে প্রচুর। এই ভৌগোলিক জায়গাটি অনেক সম্ভাবনাময়। অঞ্চলটিও কোরআনের তাফসীরে বর্ণিত বিশ্বজয়ী সম্রাট জুলকারনাইনের শাসনাধীন এলাকার অংশ বলে প্রমাণিত।

দেশটিকে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলের কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের জন্য পশ্চিমারা তাদের শিখণ্ডিরূপে ব্যবহার করে। গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা, সাথে ইসরাইল জোট বেঁধে ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র দিয়ে সমৃদ্ধ করে। বড় পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুত করে। কিন্তু তারা যে এখানে তেমন কিছু করতে পারবে না সেটা আগে তাদের বুঝে আসেনি। রাশিয়া তাদের চেয়ে অগ্রসর চিন্তা করে তা বাস্তবায়নে নেমে পড়ে। আল্লাহর কুদরত এই যে, তিনি যখন কাউকে লাঞ্ছিত ও পরাজিত করতে চান, তখন তাদের চিন্তাশক্তি সঠিকভাবে কাজ করে না। তারা নিজেরাই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।

যেমন : হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় কাফেররা নিজেদের সুবিধামতো সব শর্ত জুড়ে দেয় আর আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন চুক্তি মেনে নেওয়ার নির্দেশ দেন। বলে দেন, এটাই হবে আপনার বিজয়ের কারণ। উপস্থিত মুমিনগণ এর কৌশল বুঝতে না পেরে মনে কষ্ট পান। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর নির্দেশে নিজেদের বিপক্ষে যাওয়া সব শর্ত মেনে নেন। ফলাফল দাঁড়ায় উল্টো। আল্লাহ কাফেরদের কৌশলের বিরুদ্ধে নিজে মহা কৌশল প্রদর্শন করেন। দুই বছর পর ঐতিহাসিক মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়।

হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তিতে কাফেররা যেমন নিজেরাই নিজেদের দেওয়া শর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত চুক্তিলঙ্ঘন করেছিল এবং একপর্যায়ে মুসলমানরা বিজয় অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, তুলনা চলে না, তবুও ঘটনা মিলে যাওয়ায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমারাও বুদ্ধি নষ্ট হয়ে নিজেদের খাদ্য ও জ্বালানির ভান্ডারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসে, যা তারা নিজেরাই লঙ্ঘন করতে বাধ্য হয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা নিষেধাজ্ঞা দেয়। অথচ রাশিয়ার খাদ্য ও জ্বালানি ছাড়া তারা অচল। এই ফাঁকে রাশিয়া ইচ্ছামতো তার তেল বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় ফান্ড সমৃদ্ধ করে নেয়।

জ্বালানির অস্ত্র ব্যবহার করে ন্যাটো জোটকে দ্বিধা—বিভক্ত করে। জার্মানিকে গ্যাসের ফাঁদে ফেলে দলছুট করে। ইতালি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের আরও পাঁচ—সাতটি রাষ্ট্রকে জোটের পথ ছেড়ে রাশিয়ার স্বনির্ধারিত নীতি অনুসরণে বাধ্য করে।

আমেরিকা দূর থেকে সমর্থন দিয়ে চললেও কার্যত দূরে সরে যায়। এদিকে ইউক্রেন ভবিষ্যতে রাশিয়ার জন্য হুমকি হওয়ার মতো সব বন্দর, শিল্প এলাকা ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমি হারায়। রাশিয়া অতি সামান্য সৈন্য ও সাধারণ কিছু অস্ত্র প্রয়োগ করে সুকৌশলে রাজধানী কিয়েভ ও কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত সব জায়গা দখল করে নেয়।

যুদ্ধের ভেতরেই তারা এসব জায়গা সহজগম্য বানায়। ব্রিজ, রেললাইন চালু করে। বন্দরগুলো ব্যবহার উপযোগী করে এবং রুশ সমর্থক লোকজনকে রাশিয়ান পাসপোর্ট দিতে শুরু করে। এককথায় রাশিয়া যা চেয়েছিল তা তারা অর্জন করে নেয়। বর্তমানে তার বিপক্ষের সব শক্তি খাদ্য ও জ্বালানির সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ইউক্রেনকে কেবলই নীতিগত সমর্থন ও জরুরি লিপ সার্ভিস দিয়ে চলেছে। মিডিয়ায় বানোয়াট সংবাদ, যুদ্ধ জয়ের গল্প আর দেশ—বিদেশের নেতা, পাতি নেতার কিয়েভ সফর ছাড়া ইউক্রেনের আর কোনো অগ্রগতি নেই। যুদ্ধ প্রলম্বিত করা ও অস্ত্র ব্যবসা ছাড়া পশ্চিমাদের ইউক্রেনে আর করার তেমন কিছুই নেই।

সাবেক কমেডিয়ান প্রেসিডেন্ট জেলেনোস্কি এখন হিটলারের তথ্যমন্ত্রীর ভাষায় বড় বড় ফাঁকা বুলি ছাড়ার কাজটিই নিয়মিত করে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিস্থিতি তার পক্ষে নয়। যাঁরা মনে করেছিলেন, এটিই হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা, তাদের ধারণাও সঠিক বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, এককালের অহংকারী ইউরোপীয়দের এখন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। খাদ্য, জ্বালানি, জলবায়ু ও জীবনমান ধরে রাখার সংকট গোটা ইউরোপকে বর্তমানে ঘিরে ধরেছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপট দ্রুততার সাথে বদলে যাচ্ছে। মানুষ, প্রকৃতি বা প্রযুক্তির যেখানে তেমন কোনো হাত নেই। ইউরোপে নদ—নদী ও হ্রদ শুকিয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচশ বছরেও এমন খরা ইউরোপে হয়নি। চলছে অস্বাভাবিক দাবদাহ। মিডিয়া বলছে, শীতপ্রধান ইউরোপ এখন সূর্যের তাপে ফিশ ফ্রাই হচ্ছে। খাদ্যসংকটে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। অনেক এলাকায় মানুষ সন্তানদের খাবার দিতে নিজেরা এক বেলা খেয়ে থাকছে। গ্যাস ও অন্য অনেক জরুরি পণ্যে কঠোর রেশনিং শুরু হয়েছে। গোটা ইউরোপ কঠিন সংকটে আছে।

খাদ্য ও জ্বালানি বিক্রি করতে না পেরে ইউক্রেনের মানুষ চরম হতাশ। তাদের কৃষিপণ্য জমা রাখার সাইলোগুলো পূর্ণ। এসব সারা দুনিয়ায় বিক্রি না করতে পারলে আগামী ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হবে। অনেক কৃষক গম ক্ষেত পুড়িয়ে ফেলছে। রাশিয়া এই বিরক্তি ও অসন্তোষটি কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছে। তুরস্কের মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের ব্যানারে কিছু শস্যের জাহাজ ইউক্রেন বাইরে পাঠাচ্ছে। তবে এসবই চাহিদার তুলনায় নগণ্য। ইউক্রেন এমন কিছু রকেট ছুড়ছে, যা অঞ্চলের পারমাণবিক চুল্লি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে পশ্চিমাদের স্বেচ্ছাচারে এলাকায় আরেকটি চেরেনবিল হওয়ার আতঙ্ক কাজ করছে।

পশ্চিমাদের বিশেষ করে ইসরাইলের অবিবেচনায় এই এলাকায় পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যাওয়াও বিচিত্র নয়। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার একটি আয়োজন। কোনো সুস্থ মানুষ আধিপত্য বিস্তারের জন্য বা শক্তির ভারসাম্য রক্ষার নামে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও মজুদ করতে পারে, তা স্বাভাবিক মানবজাতি চিন্তা করতে পারে না। অথচ এটি আজ আধুনিক বিশ্বের এক দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা। কিছু লোকের খামখেয়ালি, অপ্রকৃতস্থ আচরণ, অমানবিক নৃশংসতা কিংবা নিছক ভুল গোটা পৃথিবীর মানুষকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। এমন আতঙ্ক নিয়ে সাড়ে আটশ কোটি মানুষকে এই গ্রহে জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা।

সুস্থ মানুষ সাদা চোখে বিষয়টি দেখলে সে নিজেই অবাক হবে। বলবে, এটা কি মানুষের পৃথিবী। যেখানে প্রতিটি রাজধানী পরাশক্তিগুলোর ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় কথিত নিরাপদ। যে আগে হামলা করবে সেও এখানে জিতবে না। কেননা পাল্টা হামলা ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় আছে। আর যেকোনো একজনের হামলায় ঘুমন্ত সব পারমাণবিক অস্ত্র নিজে থেকেই সচল হবে। লক্ষ্যভেদ না করুক। সর্বাত্মক ধ্বংস করবে।

এমন নৃশংস প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অতীতে কখনো ছিল না। আর এসব যদি নিজেদের মধ্যে আলাপ—আলোচনার মাধ্যমে নিস্ক্রিয় করে দেওয়া না হয় তাহলে সে দিনটি একসময় আসবে যখন মানুষ আবার তির—ধনুক, বর্শা, তলোয়ার ও হাতি, ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ করবে। খুব সহজে এটিকে হাদীসের মালহামা শব্দ দিয়ে যারা ব্যাখ্যা করেন, শুরুতেই বলেছি তারা খুব তাড়াহুড়াপ্রবণ। এখানে নিশ্চিত করে কিছু না বলাই আমাদের ঐতিহ্য। প্রকৃত আলেমগণ আর কথিত একমুখী শিক্ষিত ইসলামিক স্কলারদের আলোচনা ও ব্যাখ্যার পার্থক্য এখানেই। যা আমরা শুরুতেও আলোচনা করেছি।

ভেবে দেখুন, এই ইউক্রেন এবং এর কমেডিয়ান প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগেও কত অহংকারী ছিল। আল্লাহ তাদের দর্প চূর্ণ করে দিয়েছেন। এটিই আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির নিয়ম। এটি আল্লাহরই বিধান, যা দ্রুত বা বিলম্বে অবশ্যই কার্যকর হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন :

وَتِلْکَ الْاَیَّامُ نُدَاوِلُهَا بَیْنَ النَّاسِ

এ তো দিন—পরিক্রমা, যা আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে বদলাতে থাকি।—সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৪০

পাঠকের হয়তো মনে আছে, কয়েক বছর আগে ইসরাইলিরা যখন গাজার শিশুদের গোলাবর্ষণ করে হত্যা করছিল, তখন ফুলের মতো নিষ্পাপ এ শিশুদের দেখে দুনিয়ার মানুষ কাঁদত। কিছু বৈষম্য ও বিদ্বেষে বিশ্বাসী পশুমনা মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সবাই গাজায় নিহত শিশুদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেছে। তখন এই জেলেনোস্কি তার টুইটারে লিখেছিল, ‘ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যায় সে দুঃখিত নয়। এরা নাকি সাপের বাচ্চা, বড় হয়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধা হবে। তাই ইসরাইলিরা তাদের হত্যা করে কোনো অন্যায় করছে না।’

আমাদের প্রশ্ন, রাশিয়ার গোলায় যখন তার দশ হাজার সৈন্য আর বহুসংখ্যক আবাল—বৃদ্ধ—বণিতা বেসামরিক অঞ্চলে নিহত হয়, তখনও কি তার মনে কোনো ব্যথা হয়নি? ফিলিস্তিনের শিশুরাও তো ইউক্রেনের শিশুদের থেকে ভিন্ন কিছু নয়।

পাঠকের মনে আছে, বাগদাদ যুদ্ধের সময় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ধারক জাদুঘর লুট হয়েছিল। সেখানে ইউক্রেন বাহিনী ছিল আগে আগে। শহীদ প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের প্রাসাদ দখলেও ইউক্রেনীয়রা আগে আগে ছিল। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বের মানুষ সবই দেখতে পেয়েছে। মিত্রদের মাঝে শক্তি ও অবস্থানের তুলনায় তাদের দম্ভ ছিল বেশি। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি হয়ে যাওয়ার মতোই। রাশিয়ান গোলায় ইউক্রেনের এক শহরে জাদুঘর ভেঙে পড়ার সময় মানুষের মনে পড়েছিল মিত্র শক্তির বাগদাদ ধ্বংসের কথা।

আমেরিকা, ইউরোপ এখন এই যুদ্ধে পিছুটান দিয়েছে। ইউক্রেনের পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাথা নত করে শস্য বিক্রির চেষ্টায় আছে তারা। চাপিয়ে দেওয়া কৌশলগত আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করে রাশিয়া এখন সব দিক দিয়ে লাভবান রয়েছে। গোটা অঞ্চল পশ্চিমাদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্থানীয় নতুন নেতৃত্ব শক্তিশালী হচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের যে জ্বালানি ও খাদ্যসংকট তা নিরসনে মধ্যস্থতাকারী নতুন নায়কের ভূমিকায় উঠে এসেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এক হয়েছে অঞ্চলের শৃঙ্খলা পুনর্বিন্যাসে। চীন তার প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনায় আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। সহসাই চীনের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরব সফর করবেন। আফ্রিকা মধ্য—এশিয়া ককেশাস অঞ্চলে নতুন মেরুকরণ সম্পন্নের পথে।

সূরা বাকারার ২৫১ নং আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

وَلَوْ لَا دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ ۙ لَّفَسَدَتِ الْاَرْضُ وَلٰکِنَّ اللهَ ذُوْفَضْلٍ عَلَی الْعٰلَمِیْنَ.

আর আল্লাহ মানুষের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করলে অবশ্যই জমিন ফাসাদপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর ওপর অনুগ্রহশীল।

মানুষের জ্ঞান সীমিত। চিন্তা—পরিকল্পনা ক্ষুদ্র। আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন আল্লাহর সিদ্ধান্তের সামনে তুচ্ছ। মানুষ কোটিবার চাইলেও কিছুই হবে না। আল্লাহ যা চাইবেন সেটাই হবে।

وَ مَا تَشَآءُوْنَ  اِلَّاۤ  اَنْ یَّشَآءَ اللهُ  رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের সীমালঙ্ঘন ও কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ এক জালেমকে অপর জালেমের হাতেও শায়েস্তা করে থাকেন। সত্য—মিথ্যার ফায়সালা এ দুনিয়ায় পূর্ণরূপে না হলেও এক শক্তি দিয়ে অন্য শক্তিকে দমন করার মাধ্যমে মানববিশ্বের ভারসাম্য বজায় রাখার বিধানও আল্লাহর নীতিতে রয়েছে। এ মর্মেই আল্লাহ পাকের ঘোষণা :

وَ کَذٰلِکَ نُوَلِّیْ بَعْضَ الظّٰلِمِیْنَ بَعْضًۢا بِمَا کَانُوْا یَكْسِبُوْنَ

—মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন