প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

তোমাদের লেখা

তোমাদের লেখা

বিরহের দিন

মানুষের মন অনেকটা আকাশের মতো। আকাশ যেমন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়, মানুষের মনের অবস্থাও তেমনই। মানুষের মন যে কখন ভালো আর কখন খারাপ হবে সেটা বোঝাই মুশকিল।

আমার মন আজ অনেক খারাপ। বেশ কদিন ফুরফুরে মেজায ছিল, কিন্তু আজ কী হলো বুঝতে পারছি না।

ফজর থেকে বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু মন খারাপের শুরুটা হয়েছে আজ যখন দরসের পূর্বে ঘুম থেকে জাগ্রত হই তখন থেকে। এর কারণ হলো, আমি ঘুমের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম দুঃস্বপ্নের রাজ্যে। এটাই হয়তো—বা মন খারাপের কারণ।

ঘুম থেকে জাগ্রত হয়েছি নয়টায়। আমাদের দরস শুরু হয়েছে নয়টা পনেরো মিনিটে। রীতিমতো দরস শেষ হয়েছে বারোটা পনেরো মিনিটে। আমি যেহেতু দরসের পূর্বেই গোসল সেরে নিই, তাই এই সময়ে একটু পড়ালেখা করা যায়।

মন যেহেতু খারাপ তাই আজ সহজ কিতাব সফওয়াতুল মাসাদির হাতে নিয়ে বসলাম। পাশে ফরিদ ভাই, আশিক ভাই এবং সাঈদ ভাইও ছিল। এরই মধ্যে আব্দুল্লাহ সা’আদ ভাই এসে খরব দিল, জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ আমরা সকলে পড়লাম।

কেন যেন আমার খবরটা বিশ^াস হচ্ছিল না। কারণ বর্তমান সময়ে তো মিডিয়া বহু মিথ্যা খবর প্রচার করে। এ জন্যেই হয়তো মনে এরকম সন্দেহ জেগেছিল। নিশ্চিত হবার জন্য দেঁৗড়ে স্যারের কাছে গেলাম। স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম। স্যার বললেন, আমিও শুনলাম। স্যার নিশ্চিতভাবে কিছুই বললেন না। এরপর কামরায় ফিরে এসে দেখি দুপুরের খানা চলে এসেছে, তাই খানা খেয়ে নিলাম।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি যোহরের নামাযের সময় হয়ে গিয়েছে, তাই নামাযের কাতারে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামায আদায়ের পর মুতাআলায় বসলাম। একটু পরে আবার দরস শুরু হবে। এখনো তিনটা ঘণ্টা বাকি আছে।

দুইটা ত্রিশে দরসগাহে বসে গেলাম। পাঁচ মিনিট পর হুজুর এলেন এবং বেহেশতী জেওরের ঘণ্টা শুরু হলো। আজ সবক একটু কমিয়ে দিয়েছেন হুজুর, যেহেতু পুরো সপ্তাহের সবক পড়তে হবে। দরসও আজ দশ মিনিট আগে শেষ করলেন। এই সুযোগে ছাত্ররা বিভিন্ন মাসআলা হুজুরকে জিজ্ঞাসা করল। হুজুরও খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবে উত্তর দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।

এরপরই এক ছাত্র হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব নাকি ইন্তেকাল করেছেন? হুজুর বললেন, হঁ্যা। আমি দুপুরবেলা খবর পেয়েছি এবং সাথে সাথেই তিনবার সূরা ইখলাস পড়ে ঈসালে সওয়াব করেছি। তোমরাও তিনবার সূরা ইখলাস পড়ে ঈসালে সওয়াব করো। এরপর হুজুর একটা দীর্ঘ নিশ^াস ছেড়ে বললেন, আহ্ হা! কীভাবে ওলামায়ে কেরাম একে এক সব বিদায় নিচ্ছেন।

এই কথাটা শুনে কেন জানি আমার হৃদয় ডুকরে কান্না আসছিল। তৎক্ষণাৎ সূরা ইখলাস পড়ে আমরা সকলেই ঈসালে সওয়াব করলাম। এবং হুজুর আমাদের সালাম দিয়ে দরস থেকে বিদায় নিলেন।

—তাশরিফ হুসাইন

শিক্ষার্থী, জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ

 

মায়ের দুআ

আমি দেখেছি একটি ছেলেকে। সে সব সময় মাকে কষ্ট দিত। ঘরে কোনোকিছু এদিক—সেদিক হলেই সবকিছু ভাংচুর করত। কানে সব সময় ইয়ারফোন থাকত। গান শুনত, ছবি দেখত। ঘরে চুপ থাকতে হতো মায়ের। মা বেশি থেকে বেশি নামাযের কথা বলত। এতেই সে রেগে উঠত। এভাবেই দুটি ছেলেকে নিয়ে মায়ের দিন—রাত অনেক কষ্টে কাটছিল। কিন্তু মা কখনো নিরাশ হননি। সব সময় আল্লাহর কাছে দুআ করতেন যেন তিনি তাকে হেদায়েত করেন। সেই মা আমাদের বাসায় আসতেন। বলতেন, তার কষ্টের কথা। খুব কাঁদতেন আর বলতেন, তোমাদের এখানেই আমি একটু মন খুলে কথা বলি। বাসায় তো শুধু চুপচাপ কাম—কাজ করি। আমার আম্মা তাকে সান্ত্বনা দিতেন। বলতেন, মায়ের দুআ আল্লাহ কবুল করেন। আপনি সব সময় দুআ করবেন।

একদিন আমাদের বাসার সকল পুরুষ ঢাকা মালিবাগের হাফীজুদ্দীন সাহেব হুজুরের তিনদিনের মাহফিলে গেলেন। আম্মা বললেন, এই ছেলেটিকেও নিয়ে যাওয়া যায়। তাই আমার মেঝো দুলাভাই নিজে ওই ছেলেকে বললেন। ছেলেটি লজ্জায় না করতে পারেনি। রাজি হয়ে গেল।

সেখান থেকে আসার পর ছেলেটি পাক্কা নামাযী হয়ে গেল। আশ্চর্য তিন মাস হয়ে গেল কোনো নামায বাদ দেয়নি। তার মা তো খুশিতে আটখানা। তিনি বারবার আল্লাহর শোকর আদায় করছেন। আমাদের বাসায় এসে বললেন, আমার ছেলে এখন নামায পড়ে, ভালো ব্যবহার করে, আমাকে পানি এনে দেয়। এ সবই হুজুরের সোহবতে। আমি বললাম, এ সবই হচ্ছে আপনার দুআর কারণে। সত্যিই মায়ের দুআ কীভাবে কবুল হয়, জীবনকে কীভাবে পরিবর্তন করতে পারে তা স্বচক্ষে দেখতে পেলাম। সকল মা—ই সন্তানকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। তাই আমাদের উচিত মাকে কষ্ট না দেওয়া।

—উম্মে মুহাম্মাদ

 

জীবন

আমার মৃত্যু যদি হয় কোনো বৃষ্টির দিনে, লাশটা দাফন হবে বৃষ্টিভেজা শেষ বিকালে। আকাশ বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টি—কণার সাথে ধুয়েমুছে যাবে আমার প্রিয়জনদের কষ্ট—ব্যথা…

মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। দাফন করতে আসা মানুষদের হাতে থাকা কালো কালো ছাতায় ঢেকে যাবে কবরস্থান। আমার শেষ ঠিকানা…!

কবরের শক্ত মাটি বৃষ্টির পানিতে কাঁদা হয়ে আমার শেষ পোশাকে লেগে যাবে। কেউ পরিষ্কার করে দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করবে না। কাঁদা—মাটির কালো কালো ছোপ লেগে থাকা কাফনসহই কাঁচা—পাকা বাঁশের নিচে রেখে দেওয়া হবে আমায়। তার ওপর মাটির আস্তরণ…

কেউ ভেবেও দেখবে না, এই মেয়েটাই কিছুদিন আগে তার কালো জামায় কালো কলমের দাগ পড়ে যাওয়া নিয়ে চিল্লাচিল্লি করেছিল। আর তাকেই কিনা…

 

দাফন শেষ হবে। বৃষ্টি মাথায় সবাই গুটিগুটি পায়ে কবরস্থান প্রাঙ্গণ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। কেউ হয়তো—বা খানিকটা শোকাহত কণ্ঠে বলে উঠবে ‘আর যা—ই বলুন! মেয়েটা কিন্তু ভালো ছিলো।’

প্রিয়জনদের কেউ কেউ হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠবে। এ—ই তো…তারপর সব শেষ! সব শোকতাপ যেন দুনিয়ার ব্যস্ততায় ঢেকে যাবে।

প্রথম প্রথম কবর জিয়ারতের হুল্লোড় পড়বে। তারপর আস্তেধীরে সবাই ভুলতে বসবে।

কালের আবর্তে আমার শেষ ঠিকানায় অন্য কোনো লাশের ঠিকানা হবে। জীর্ণশীর্ণ কবরের ওপর আরও কবর দেওয়া হবে। আমি মাটির আরও গভীরে চলে যাব..আরও গভীরে!

এ—ই তো জীবন! এই যে নিশ্বাস নিচ্ছি, বেঁচে আছি, সকলেই মাথায় করে মাতিয়ে রাখছে। চলে যাব তো সব আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হবে। কেবল একটা মাত্রই পরিচয় তখন…‘লাশ!’

 

রোযনামচা

২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ঈসায়ী

সোমবার

আজ মেশকাত শরীফে একটি হাদীস পড়লাম, হাদীসটি আমার খুব ভালো লেগেছে। হাদীসটি হলো, হযরত উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, নাজাত তথা মুক্তি কীসের মাঝে?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন,

এক. জবান নিয়ন্ত্রণ করো।

দুই. তোমার ঘরই যেন তোমার সর্বদার অবস্থানের জায়গা হয় অর্থাৎ নিরুপায় না হলে ঘর থেকে বের হয়ো না।

তিন. নিজের কৃত গোনাহের জন্য ক্রন্দন করো।

সত্যিই অপূর্ব নসিহত। আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিটি উপদেশ—ই অত্যন্ত মূল্যবান। প্রতিটি কথাই আমার অনেক প্রিয়। পড়াশোনার জীবনে হাদীসে রাসূল ছিল আমার ভীষণ প্রিয় একটি বিষয়। হাদীস পড়ার সময় একটা অন্যরকম স্বাদ অনুভব করতাম। মনে হতো, রাসূলের মুখ থেকে সরাসরি রাসুলের কথা শুনছি, রাসূলের দরবারে হাজির হয়ে, তাঁর সামনে বসে।

দাওরায়ে হাদীসের বছরে নেসাব শেষ করতে অনেক কষ্ট হলেও এই বছরটা আমার অনেক প্রিয় ছিল। কারণ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাদীসের মাঝেই ডুবে থাকতাম আমরা। হাদীসের মধ্যেই খুঁজে নিতাম কোরআনী শিক্ষা।

এমনকি নাহু, সরফ, উসূল, ফিকহ অর্থাৎ জীবনে যা যা পড়াশোনা করেছি সব খুঁজে পেতাম হাদীসে। সকাল—দুপুর—রাতে একটাই ধ্বনি গুঞ্জরিত হতো আমাদের কানে, ওয়া বিহি ক্বালা  হাদ্দাসানা… … ক্বালা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম… …

জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল সেটি। জীবনের এই সময়ে এসে খুব মিস করি সেই সময়টাকে।

তোমরা যারা সেই মধুর সময় পার করছ বা সেই সময়ের কাছাকাছি আছো, কামনা করি, তোমাদের জন্য এই সময়টা জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় হোক। হাদীসে রাসুলের আলোতে আলোকিত হোক তোমাদের এবং আমাদের সবার জীবন।

—বিনতে আবুল হাশেম

০১ মে ২০২১ ঈসায়ী

 

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন