দীনের গভীর বুঝ অর্জন করতে হবে
মুফতী কিফায়াতুল্লাহ
৬ষ্ঠ কিস্তি
এই আলোচনাটি সূক্ষ্ম এবং স্পর্শকাতর। তাহকীকের বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই প্রকাশ করা হলো।
মাযহাবসমূহের পারস্পরিক ইখতিলাফ ও মতপার্থক্যের স্বরূপ বিষয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। আজকের মজলিসে বিশেষভাবে আলোচনা হবে, মতানৈক্য কেন হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে হয়? কোনটা প্রয়োজনীয় আর কোনটা অপ্রয়োজনীয়? কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা অগ্রহণযোগ্য? কোনটা পছন্দনীয় আর কোনটা অপছন্দনীয়? বাতিল ফেরকাগুলোর সাথে আহলে হকের ইখতিলাফ এবং আহলে হকের মাঝে পরস্পরের ইখতিলাফÑÑএই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য কোথায়?
এ বিষয়গুলো যদি পরিষ্কার হয় তাহলে মাযহাবের ইখতিলাফের বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এবং দীনকে কেন্দ্র করে যত ইখতিলাফ রয়েছে বা সৃষ্টি হতে পারে সে সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা তৈরি হবে।
বিষয়গুলো উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলে আলোচনা অনেক বেশি দীর্ঘ হয়ে যাবে। তাই উদাহরণের পেছনে না পড়ে সাধারণভাবে কথাগুলো বলা হবে। মনে রাখতে হবে, ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য হয় দুই ধরনের : ভিত্তিহীন বা বাতিল ইখতিলাফ এবং হক ও উপকারী ইখতিলাফ। প্রথম প্রকার ইখতিলাফ নিন্দনীয় ও ঘৃণিত, আর দ্বিতীয় প্রকার ইখতিলাফ প্রশংসনীয়। বিষয়টি খুব ভালোভাবে পরিস্কার হওয়ার জন্য আমরা প্রথমে মানুষের জ্ঞান আহরণের রীতি—ধারা নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করবো তারপর আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে আসব।
অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের পথে
মানুষ জন্ম গ্রহণ করে অজ্ঞ ও অক্ষম অবস্থায়। কিছুই জানে না, বোঝে না, করতে পারে না। মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়—স্বজনকেও চিনে না। যে মা না, তাকে মা ডাকে। যে বাবা না, তাকে বাবা ডাকে। খাবার চিনে না। নিজে নিজে খেতে পারে না। পরতে পারে না। চলতে—ফিরতে পারে না।
তার সবকিছু অন্যরা করে দেয়। মা—বাবা করে দেয়। তার সবকিছু আরেকজন জ্ঞানী ও সক্ষমের দ্বারা পরিচালিত হয়। এভাবে কিছু সময় পার হয়। সে কিছু কিছু বুঝতে ও করতে শুরু করে। তবে তা খুবই সামান্য ও অসম্পূর্ণ। যার দ্বারা সে এখনও চলতে পারে না, উপকৃত হয় না। কিছু খেতে চাইলে সেটা বুঝাতে পারে না। আবার অখাদ্যকে খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলে। কিছু নিতে চাইলে, সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। দুয়েক পা অগ্রসর হয়ে থেমে যেতে হয়। আবার ক্ষতিকর বস্তু ধরে ফেলতে চায়। এ পর্যায়েও তার সবকিছু আরেকজন জ্ঞানী ও সক্ষমের দ্বারা পরিচালিত হয়। মা—বাবার দ্বারা পরিচালিত হয়। তারা তার ভালো—মন্দ বুঝে তার সবকিছু করে দেয়।
আরও কিছু সময় অতিবাহিত হলে সে আরও বুঝতে শুরু করে। তার জ্ঞান আরও খোলে। এবার সে জ্ঞানের স্তরে উপনীত হয়। তার জ্ঞান পূর্ণ হয়। ধারণা স্বচ্ছ হয়। তবে সীমিত পরিসরে। সে অন্য জ্ঞানী ও সক্ষমের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে কিছু করতে পারে। খাদ্য—অখাদ্য চিনে। নিজে নিজে খেতে পারে। নিজের ঘর—বাড়ি চিনে। আগুন—পানির পার্থক্য বোঝে। নিজের মনের ইচ্ছা বুঝাতে পারে। তবে অলি—গলি চিনে না। গ্রাম—ইউনিয়ন বুঝে না। হিসাব—নিকাশ বোঝে না। ব্যবসা—বাণিজ্য বোঝে না। সামান্য জ্ঞানে সামান্য পথ চলতে পারে। অতঃপর একসময় তার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়। এখন সে অনেক জানে। অনেক কিছু করতে পারে। শহর—বন্দর চিনে। ব্যবসা—বাণিজ্য বোঝে। সবকিছুই নিজে নিজে বুঝতে ও করতে পারে।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, এই যে মানুষ অজ্ঞতা ও অক্ষমতার স্তর থেকে জ্ঞান ও সক্ষমতার স্তরে পৌঁছে—তা কীভাবে? তা তার কল্পনা—জল্পনার মাধ্যমে, যা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে তার ব্রেনে সংগৃহীত ছবিগুলোর উপর পরিচালনা করে। পরিভাষায় যাকে নযর—ফিকির বলা হয়। একেবারে ছোটবেলা থেকেই মানুষ কল্পনা—জল্পনা করতে থাকে। পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা যা কিছু অনুভব করে সবকিছু নিয়ে মানুষের কল্পনা—জল্পনা চলমান থাকে।
وَ اللهُ اَخْرَجَكُمْ مِّنْۢ بُطُوْنِ اُمَّهٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَیْئًا ۙ وَّ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْاَبْصَارَ وَالْاَفْـِٕدَۃَ ۙ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ
প্রথমে সেটি থাকে অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ। যার থেকে কোনো ফলাফল আসে না। কোনো উপকার পাওয়া যায় না। কিন্তু এক সময় সেটি পূর্ণতা লাভ করে। ভুল করতে করতে একসময় শিখে ফেলে। যেমন : শিশুরা পড়তে পড়তে একসময় হাঁটতে শিখে ফেলে, দৌড়াতেও পারে। তখন তার অনেক বিষয়ে নিভুর্ল, স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়। যার মাধ্যমে সে তার প্রয়োজনগুলো সহজ ও সুন্দরভাবে পূরণ করতে পারে।
এভাবে যার কল্পনা—জল্পনা যত উন্নত, তার জ্ঞান তত বেশি। আর যে যত বেশি জ্ঞানী সে তত দামি ও সম্মানী। সে তার কল্পনা—জল্পনার উচ্চতা পর্যন্ত তার জীবনকে নিয়ে যেতে পারে। জীবনকে সেভাবে সাজাতে পারে। উপকৃত হতে পারে।
এ জানার কোনো শেষ থাকে না। মানুষ জ্ঞানের যে পর্যায়েই যাক তারপরও অজানার শেষ থাকে না। বরং সে যা জানে তার বাহিরেও থাকে অনেক অজানা এবং যা জানে তার ভিতরেও থেকে যায় অনেক অজানা। এ অজানার পিছনে ছুটে মানুষের কল্পনা—জল্পনা। সে অজানাকে উদঘাটন করতে মানুষ কল্পনা—জল্পনা করতে থাকে।
অজানাকে উদঘাটন করতে মানুষ কল্পনা—জল্পনা করে যে স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও প্রবল ধারণা অর্জন করে এবং সে ধারণার ভিত্তিতে যা বলে সেটিই হয় তার মতামত, তার বক্তব্য। একাধিক ব্যক্তি যখন কোনো অজানাকে উদঘাটন করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা অর্জন করে, তার ভিত্তিতে মতামত প্রকাশ করে। তখন সেটি হয় মতভিন্নতা, মতপার্থক্য, মতানৈক্য।
সুতরাং ধারণা, বক্তব্য, মতামত এবং সে থেকে মতানৈক্য মতভিন্নতা এ সবই উপকারী, কল্যাণকর ও জরুরি। জ্ঞানের পথযাত্রার চালিকাশক্তি। যা অস্বীকার ও অপছন্দ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এ পথেই আমরা জ্ঞান অর্জন করে এসেছি। অজ্ঞ ও অক্ষম থেকে ধীরে ধীরে জ্ঞানী ও সক্ষমে পরিণত হয়েছি। তাহলে এখন কী করে এটি মন্দ ও গর্হিত হয়ে যাবে।
এটি বন্ধ করে দিলে তো জ্ঞানের যাত্রাই থেমে যাবে। অথচ আমাদের রয়ে গেছে অনেক অজানা জানার বাহিরে ও ভিতরে। এজন্য মতভিন্নতা, মতপার্থক্য প্রশংসনীয়। কারণ, জ্ঞানের অন্বেষণেই এটি হয়ে থাকে। যার দ্বারা মানুষের উন্নতি ও কল্যাণ সাধিত হয়।
তাহলে মতানৈক্যকে খারাপ বলব কী করে, তা তো মানুষের জন্য উপকারী?
এর উত্তর হলো, অজানাকে জানতে কল্পনা—জল্পনা ও অনুসন্ধান করে মানুষ যে ধারণা তৈরি করে এবং সে ধারণার ভিত্তিতে যে মত প্রকাশ করে ও মতামত দেয় এবং একাধিক ব্যক্তির এমন প্রচেষ্টা থেকে যে ভিন্ন ধারণা ও ভিন্ন ভিন্ন মত ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, এগুলোর কোনোটিই দূষণীয় না।
কিন্তু একাধিক ধারণার মধ্য থেকে কোনো একটি ধারণা যখন স্বচ্ছ ও অকাট্য হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যায়, তখন সেটিকে অস্বীকার করে ভিন্ন মত প্রকাশ করা হল হঠকারীতা। আর এটিই খারাপ ও নিন্দনীয়।
এই পরিস্কার, স্বচ্ছ ও অকাট্য সত্যকে তাহলে কারা অস্বীকার করে আর কেন অস্বীকার করে?
দাম্ভিক ও অহংকারীরাই করে। যখন দুর্বলরা তাদের সামনে স্বীয় দাবি অকাট্য দলীল সহকারে পেশ করে, তখন তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে সত্য ও অকাট্য দাবিকে অস্বীকার করে এবং হঠকারিতা প্রদর্শন করে তাদেরকে প্রতিহত করে।
যেভাবে যুগে যুগে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতালোভীরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতার জোরে অকাট্য সত্যকে অস্বীকার করেছে। ফিরআউন, নমরুদ, আবু জাহেল ও প্রত্যেক নবীর বিরোধিতাকারীরা নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জেনে বুঝে হক ও সত্যকে অস্বীকার করেছে।
فَلَمَّا جَآءَتْهُمْ اٰیٰتُنَا مُبْصِرَۃً قَالُوْا هٰذَا سِحْرٌ مُّبِیْنٌ ﴿ۚ۱۳﴾ وَجَحَدُوْا بِهَا وَ اسْتَیْقَنَتْهَاۤ اَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَّ عُلُوًّا ؕ فَانْظُرْ کَیْفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الْمُفْسِدِیْنَ ﴿۱۴﴾
অকাট্য সত্য ও সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পরম বাস্তবতাকে অস্বীকার করা ও হঠকারিতা প্রদর্শন করা অত্যন্ত গর্হিত এবং জঘন্য মানসিকতা ।
আর কিছু বিষয় আছে যেগুলো অকাট্য না হলেও অকাট্যের মতো। যেগুলোতে ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণের সুযোগ থাকলেও তার একটি ব্যাখ্যা একেবারে পরিষ্কার ও স্পষ্ট। নিরপেক্ষ ব্যক্তি যা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু ক্ষমতালোভী, দাম্ভিক ও স্বার্থান্বেষীরা ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে সে স্পষ্ট ব্যাখ্যা অস্বীকার করে বা সেটিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে। তার এই ব্যাখ্যা আসলে ব্যাখ্যা নয়; বরং অপব্যাখ্যা।
উভয়ের পার্থক্য হলো, প্রথমটি কোনো প্রকার ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। একদম পরিষ্কার ও অকাট্য। আর দ্বিতীয় প্রকার ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে, কিন্তু তার সঠিক ব্যাখ্যা পরিষ্কার। যা অস্বীকার করা হঠকারিতা। অতএব এ উভয় ক্ষেত্রে মতানৈক্য বা ভিন্নমত প্রকাশ করা নিন্দনীয় ও গর্হিত।
আর যে সকল বিষয় অকাট্য ও পরিষ্কার নয়, জ্ঞান আহরণের পথে সে সকল বিষয়ে ধারণা, মতপ্রকাশ করা ও মতানৈক্য দূষণীয় নয়।
আর এ অস্পষ্ট ও অজানা বিষয়গুলো দুই ধরণের। কিছু বিষয় একেবারে অজানা থাকে, কল্পনা—জল্পনার মাধ্যমে তার ব্যাপারে ধারণা লাভ হয়। আর কিছু বিষয় পরিষ্কার ও স্পষ্ট থাকে, কিন্তু সে পরিষ্কার ও স্পষ্ট বিষয়ের মাঝেও কিছু কিছু বিষয় অস্পষ্ট থেকে যায়, যা কল্পনা—জল্পনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। প্রথম প্রকারের উদাহরণ হলো, আকাশে একটি বিন্দুর মতো দেখা গেল। সেটি কী তা একেবারে অজানা। কল্পনা—জল্পনা ও গবেষণার মাধ্যমে পরে জানা গেল যে সেটি আসলে চাঁদ অথবা অন্য কোনো গ্রহ। এখানে এ বিন্দুর ব্যাপারে আগে কিছুই জানা ছিল না। পরে কল্পনা—জল্পনা ও গবেষণার মাধ্যমে সেটি কী তা জানা গেল। আর দ্বিতীয় প্রকারের উদাহরণ হলো, আকাশে চাঁদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু চাঁদটি কতদিনের, তার বয়স কত, তা অস্পষ্ট ও অজানা। গবেষণা ও কল্পনা—জল্পনার মাধ্যমে জানা গেল যে এ চাঁদের বয়স পাঁচ দিন অথবা সাত দিন। এখানে চাঁদ স্পষ্টভাবে জানা থাকলেও সে স্পষ্টের মধ্যে একটি বিষয় অস্পষ্ট ছিল। তা হলো চাঁদের বয়স। এ অস্পষ্ট বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে জানা গেল।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, শরীয়তে যে ইখতিলাফ গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয়, তা দ্বিতীয় প্রকারের মত। অথার্ৎ শরীয়তের বিধানগুলো অকাট্য ও স্পষ্ট। কিন্তু সে অকাট্য ও স্পষ্ট বিষয়ের মধ্যে কিছু বিষয় থাকে অস্পষ্ট। সেগুলোতে মুজতাহিদগণ কল্পনা—জল্পনা ও গবেষণা করে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করেন। এতে অনেক সময় তাদের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আর তা থেকে ইখতিলাফ ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। এ ইখতিলাফ ও মতানৈক্য গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয়।
উপরোক্ত মৌলিক বিষয়টিকে সামনে রেখে ধর্ম—কেন্দ্রিক ইখতিলাফগুলোকে ভাগ করলে সেগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়।
০১. আস্তিক—নাস্তিকের মতানৈক্য। এই মতানৈক্যটা হচ্ছে ¯্রষ্টা নিয়ে। একদল বলছে ¯্রষ্টা আছে, আরেক দল তা অস্বীকার করছে। কিন্তু সৃষ্টি তথা দৃশ্যমান জগৎ যে আছে তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এক্ষেত্রে সৃষ্টির অস্তিত্ব হচ্ছে সর্বজন স্বীকৃত, আর ¯্রষ্টার অস্তিত্ব হচ্ছে মতবিরোধের ক্ষেত্র। এটা হচ্ছে বাতিল ও নিন্দনীয় মতানৈক্যের উদাহরণ। এ ধরনের মতানৈক্যকে আসলে ইখতিলাফ বলার সুযোগ নেই, এগুলো হচ্ছে হঠকারিতা। কোরআন হাদীস বা শাস্ত্রীয় পরিভাষায় যাকে ‘ইনাদ’ বা ‘জুহুদ’ বলা হয়। এমন হঠকারীদের সাথে তাদেরকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে দলীল—প্রমাণ ভিত্তিক আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। কারণ তারা স্পষ্ট বুঝে, তাদের বিপক্ষের দলীলগুলো প্রমাণিত সত্য, এবং তাদের দাবীর কোনো ভিত্তি নেই; তবুও তারা মানতে রাজি হয় না। কথাকে ঘুরিয়ে—পেঁচিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আর এটাকেই ‘ইলহাদ’ বলা হয়।
এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো। তা হলো, একদল আছে যারা সবকিছু নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে। দৃশ্যমান জগত নিয়েও তারা সন্দেহ পোষণ করে। তাদেরকে আর কীভাবে বুঝানো সম্ভব। তারা আগুন পানি নিয়েও সন্দেহে থাকে। তাই বলা হয়, তাদেরকে আগুন বুঝানোর একটাই পথ আর তা হলো, তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা।
মোটকথা ঈমানের পতাকাবাহীদের সাথে বস্তুবাদীরা আরও যে সকল মতানৈক্যে জড়ায় সবই হঠকারিতা ও ইলহাদের পর্যায়ের। এ ইখতিলাফ মাযমূম তথা নিন্দনীয়। বস্তুবাদীরা কেবল বস্তু মানে। তারা বিশ্বাস করে সকল বস্তু নিজে নিজেই অস্তিত্ব লাভ করেছে, এর পেছনে কোনো মহান সত্ত্বার অবদান নেই! পক্ষান্তরে আমরা ঈমানদাররা বস্তুও মানি, বাস্তবতাও মানি। অর্থাৎ আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর তাবৎ সৃষ্টির পেছনে একজন ¯্রষ্টা আছেন, সকল বস্তুই তার সৃষ্টি। সুতরাং যেকোনো বস্তুই আমরা দেখি না কেন, সেটা কেবল একটা অবকাঠামো ও আকৃতি। কতগুলো প্রাণহীন জড় পদার্থকে একত্র করে তার ভেতরে রূহ ও প্রাণ দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাকে অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং টিকিয়ে রেখেছেন। কোরআনে এই কথাগুলো বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বস্তুবাদী ও নাস্তিকদের সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ যে বিষয়ে তার দলীলগুলো পরিপূর্ণরূপে স্পষ্ট। ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায়,
قطعي الثبوت و قطعي الدلالة
এই ধরনের অকাট্য দলীল—প্রমাণকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই এবং এতে তাবীল বা মনগড়া ব্যাখ্যা করারও সুযোগ নেই। যারা এক্ষেত্রে তাবীল ও অপব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবে তারা ঈমানের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
০২. আস্তিকদের মধ্যকার তাওহীদ ও শিরকের ইখতিলাফ এবং ইসলামের সাথে বর্তমান আহলে কিতাবদের বাতিল আকিদাগত ইখতিলাফ। এটিও প্রথম প্রকারের মত। তারাও আহলে হকের সুস্পষ্ট দলিল—প্রমাণকে অস্বীকার করে, যা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু না।
এই উভয় দলের ইখতিলাফ জঘন্যতম হঠকারিতা ও সুস্পষ্ট সত্যের অস্বীকার।
০৩. ইসলামের দাবিদারদের মধ্যকার ইখতিলাফ। অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর সাথে শীয়া, রাফেজী, খারেজী, মুতাজিলা প্রমুখ বাতিল ফেরকাসমূহের ইখতিলাফ। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের দলীলগুলো খুবই স্পষ্ট। পুরোপুরি ক্বতয়ী ও অকাট্য না হলেও ক্বতয়ীর মতোই (كالقطعي)। ক্ষেত্রবিশেষে এই ধরণের দলীলের মাঝে তাবীল করার সুযোগ থাকে। তবে ঢালাওভাবে তাবীল করলে তা গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা বিবেচিত হবে। শীয়া, রাফেজী, খারেজী, জাহমিয়্যাহ, কার্যামিয়্যাহ ইত্যাদি বাতিল দলগুলোর সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মতানৈক্য এই প্রকারেরই। তারা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলোর মাঝে মতানৈক্য ও মনগড়া তাবীল করার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআর গন্ডি থেকে বের হয়ে গেছে। তবে যে ধরণের দলীল—প্রমাণে তারা তাবীল ও মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয় যেহেতু সে ধরনের দলীল—প্রমাণে ক্ষেত্র বিশেষ বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট যুক্তির দাবিতে কোনো কোনো সময় তাবীলের কিছুটা অবকাশ থাকে সেহেতু তাদেরকে ইসলামের গন্ডি থেকে একেবারে বের করে দেওয়াও হয় না।
তাদের এই মানসিকতা ও আচরণ হঠকারিতার দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভু্ক্ত, যা অগ্রহণযোগ্য, গর্হিত ও জঘন্য।
তাদের অন্যতম আরেকটা গোমরাহী হলো, কোনো খবরে ওয়াহেদ যদি তাদের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তারা নির্দ্বিধায় বলে দেয়, আমরা খবরে ওয়াহেদ মানি না! তদ্রƒপ সাহাবায়ে কেরামের সর্বসম্মত মতামতও যদি তাদের মনমতো না হয় তাহলে তারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে, সাহাবীদের যেমন আকল ছিল আমাদেরও তেমন আকল আছে, সুতরাং আমাদের আকলে না ধরলে তাদের কথা আমরা মানব কেন?! অথচ শরীয়তের নির্দেশ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সুন্নাত এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামের জামাতের বিপরীতে নিজেদের আকলকে প্রাধান্য না দেওয়া; বরং তাদের কথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া। তো এই যে তারা খবরে ওয়াহেদকে পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করছে, এটা হলো তাদের হঠকারিতা, স্পষ্ট ভ্রষ্টতা এবং গোমরাহী।
পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত খবরে ওয়াহেদকে আমভাবে এবং ব্যাপকহারে অগ্রহণযোগ্যও বলে না আবার গ্রহণও করে না। বরং তারা যাচাই—বাছাই করে দেখে যে, খবরে ওয়াহেদটা ফাসেকের বর্ণনা দ্বারা আমাদের পর্যন্ত পেঁৗছেছে, না কি আদেলের বর্ণনা দ্বারা। ফাসেকের বর্ণনা হলে গ্রহণ করে না, আদেলের হলে গ্রহণ করে থাকে যতক্ষণ না তাতে অনিচ্ছাকৃত হয়ে যাওয়া কোনো ভুল বা সমস্যা ধরা পড়ে।
অতএব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নীতি হলো, কোনো বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণযোগ্য বর্ণনায় কোনো হাদীস, কোনো খবরে ওয়াহেদ থাকলে অথবা সাহাবায়ে কেরামের কোনো বক্তব্য থাকলে সেটাকেই ঐ বিষয়ের ভিত্তি বিবেচনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। এবার চাই সেটা মানুষের আকলে ধরুক বা না ধরুক। পক্ষান্তরে বাতিল ফেরকাগুলো নিজেদের আকলকে মূল ভিত্তি ধরে, এরপর যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের মতামত ও বক্তব্য তাদের বুঝ ও আকল অনুযায়ী হয় তাহলে সেগুলো গ্রহণ করে, অন্যথায় গ্রহণ করে না। এটা হচ্ছে তাদের বড় একটা গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা। এর মাধ্যমে তারা একদিকে আখবারে আহাদ সম্পর্কে সর্বক্ষেত্রে সর্বজনস¦ীকৃত নীতিকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায়। অন্যদিকে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইতাআত তথা আনুগত্যের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দুর্বলতার পরিচয় দেয়, যা তাদের ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে তাদের এ ধৃষ্টতা বা দুর্বলতা এ পর্যায়ের নয়, যার কারণে তারা কাফের হয়ে যায়।
এজন্য বলা হয়ে থাকে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীসগুলোর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে মানুষ তিন শ্রেণির।
এক শ্রেণি হলো যারা না বুঝে অর্থাৎ কোনো রকম ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ করা ছাড়াই বাহ্যিক দিকের উপর আমল করতে চায়। আরেক শ্রেণি হলো, যারা বুঝে বুঝে আমল করে আর এটাকেই ফিকহ বলে।
উদাহরণস্বরূপ, বনু কুরাইযার যুদ্ধের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, তোমরা বনু কুরাইযায় গিয়ে আসর পড়বে। এরপর পথিমধ্যে যখন আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিল তখন সাহাবীদের এক দল এই বলে আসর আদায় করে নিলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্রুত বনু কুরাইযায় পৌঁছার গুরুত্ব বুঝানো, নামাযকে বিলম্বে আদায় করতে বলা তার উদ্দেশ্য নয়।
পক্ষান্তরে আরেক দল এই বলে আসর নামাযকে কাযা করলেন এবং বনু কুরাইযায় পৌঁছা পর্যন্ত বিলম্বিত করলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন আমরা অক্ষরে অক্ষরে সেটাই পালন করব। তাহলে উভয় দলই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর আনুগত্য করেছে, তবে এক দল রাসূলের কথার মাকসাদ ও উদ্দেশ্য বুঝে সে অনুযায়ী তার আনুগত্য করার চেষ্টা করেছে, আর আরেক দল কোনোরূপ ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ ছাড়া হুবহু রাসূলের কথা অনুযায়ী আমল করেছে। তো এই উভয় দলই হক এবং সঠিক পথে আছে বলে বিবেচিত হবে।
এ তো গেল রাসূলের হাদীসের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির আলোচনা। তৃতীয় আরেকটা শ্রেণি হচ্ছে, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর হাদীসকে ততটুকু গ্রহণ করে যতটুকু তাদের বিবেকে ধরে। পক্ষান্তরে যা তাদের বুঝে আসে না, আকলে ধরে না সেটা তারা মানে না। একেবারেই যে মানে না তা না, একেবারেই না মানলে তো তারা ঈমানের গন্ডি থেকেই বের হয়ে যেত! তো এদের সমস্যা ও বিভ্রান্তি হচ্ছে এটাই, তারা রাসূলের হাদীস ও খবরে ওয়াহেদকে গ্রহণ করে না এবং তার আনুগত্য করে না। হয়ত একেবারেই গ্রহণ করে না, অথবা কিছু—যা তাদের মন মতো হয়—গ্রহণ করে, আর কিছু—যা তাদের মন মতো হয় না— গ্রহণ করে না। সুতরাং তাদেরকে ঈমানের গন্ডিতে কোনোমতে রাখা গেলেও সঠিক পন্থার অধিকারী আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা সুন্নত মানে না, তাই আহলে সুন্নত নয়, আর জামায়াত তথা সাহাবায়ে কেরামের মেজাজ ও আকীদা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে তারা আহলে জামায়াতেরও অন্তভুর্ক্ত নয়।
সারকথা হলো, উপরোক্ত তিনও দলের ইখতিলাফ নিন্দনীয়। প্রথম দুই দল অকাট্য দলীল—প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত বিষয়, যাতে তাবীল ও ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণের কোনো সুযোগ নেই, তাতে ইখতিলাফ করে যা মাযমুম ও নিন্দনীয়। আর তৃতীয় দল যেই বিষয়গুলো অকাট্য দলীল—প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের মতোই তবে ক্ষেত্রবিশেষে তাতে তাবীলের সুযোগ আছে বা আবশ্যক, সেই বিশেষ ক্ষেত্র অতিক্রম করে ইখতিলাফ করে এবং ব্যাপকহারে তাবীল ও মনগড়া ব্যাখ্যা করে চলে। এটাও নিন্দনীয়।
০৪. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর পরস্পরের ইখতিলাফ। তারা প্রথম প্রকার তথা অকাট্য দলীল—প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলোকে মেনে নেয়। দ্বিতীয় প্রকার যা প্রথম প্রকারের মতোই সাধারণ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যÑÑতাতে মনগড়া অপব্যাখ্যা না করে তাও মেনে নেয়। তারপর শুধু ঐ সকল ক্ষেত্রে, যা এই দুই প্রকারের অন্তভুক্ত না, সে সকল শাখাগত বিষয়ে দলীলের ভিত্তিতে তারা ইখতিলাফ করে বা মতামত পেশ করে। এই ইখতিলাফ মাহমুদ তথা প্রশংসনীয়। কারণ, যন্নী ও শাখাগত বিষয়ে যেই ইখতিলাফ হয় সেটার মাকসাদ হলো আল্লাহ তাআলার দীনকে বুঝা এবং একাধিক বুঝ থেকে সঠিক বুঝকে প্রাধান্য দিয়ে সে অনুযায়ী আমল করা। এ কাজ করতে গিয়ে এক এক ইমাম এক এক মতকে তারযীহ দেন, ফলে তাদের মাঝে মতপার্থক্য তৈরি হয়। মূলত মতপার্থক্যের উদ্দেশ্যটা মাহমুদ, এই জন্য বলা হয় ইখতিলাফটাও মাহমুদ। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাতিল ফেরকাগুলো সরাসরি মুসাল্লামাত ও কতয়ীয়্যাত তথা সর্বজন স্বীকৃত ও অকাট্য বিষয়গুলোর মাঝে ইখতিলাফ করে। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর যাদের পরস্পরে ইখতিলাফ হয় তাদের ইখতিলাফটা হচ্ছে যন্নী ও শাখাগত বিষয়ে, সর্বজন স্বীকৃত মৌলিক ও অকাট্য বিষয়ে নয়।
উল্লেখ্য যে, এই যন্নী ও শাখাগত ইখতিলাফটা সুন্নত, মুস্তাহাবের ক্ষেত্রেও হতে পারে, আবার ওয়াজিব, ফরযে আমলীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। সুনান ও মুস্তাহাবের মাঝে ইখতিলাফ হলে আমাদের কাছে তা খুব একটা জটিল মনে হয় না, কিন্তু ফরযে আমলীর মাঝে ইখতিলাফ হয় কীভাবে তা অনেকের কাছে অস্পষ্ট, এই বিষয়ে কিছু আলোচনা আগের পর্বগুলোতে হয়েছে।
এখন সামনের আলোচনায় যাওয়ার আগে এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর কথাকে চূড়ান্ত বিবেচনা করতে হবে এবং তা মানতে হবে। এবার চাই সেটা আমাদের আকল ও বুঝ মতো হোক কিংবা না হোক। পক্ষান্তরে অনেক বাতিল ফেরকা ও পথভ্রষ্ট দলগুলোর আকীদা হলো, আকল এবং বুঝই সব, সুতরাং রাসূলের কোনো কথা যদি তাদের আকলে না ধরে তাহলে তারা তা মানে না। রাসূলের কোনো হাদীস সামনে এলে এই আকীদাকে সামনে রেখে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত যাচাই—বাছাই করে যে, হাদীসের শব্দগুলো বাস্তবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে থেকে প্রমাণিত কি না, তেমনি হাদীসের দালালত নিয়েও তারা যাচাই—বাছাই করেন। এরপর হাদীসের আলফায প্রমাণিত হয়ে গেলে এবং তার দালালত স্পষ্ট হয়ে গেলে তারা নির্দ্বিধায় তা মেনে নেন, চাই সেটা তাদের আকলে ধরুক কিংবা না ধরুক।
বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি। একজন অসুস্থ লোক যখন চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় তখন সে কী করে? প্রথমে যাচাই—বাছাই করে দেখে সে আসলেই ভালো মানের ডাক্তার কি না। কারণ যদি সে যাচাই—বাছাই করা ছাড়া যে কারও কাছে চিকিৎসার জন্য যায় তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য! দেখা যাবে, বড় সাইনবোর্ড দেখে যার কাছে চিকিৎসার জন্য যাবে সে আদতে কোনো ডাক্তারই না! এই জন্য প্রথমে যাচাই—বাছাই করে দেখতে হবে যার কাছে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে সে আসলেই ভালো যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ডাক্তার কি না! যখন প্রমাণ হয়ে যায় যে, সে ভালো যোগ্যতাসম্পন্ন অভিজ্ঞ ডাক্তার তখন সে তার সব কথাকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। চাই তার বুঝে আসুক বা না আসুক। তবে যে বুঝে বুঝে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী চলে সে বেশি লাভবান হয় এবং দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারে। কিন্তু এটাও সত্য যে রোগী ডাক্তারের সব কথা চেষ্টা করলেও বুঝবে না! যেগুলো বুঝবে না সেগুলো না বুঝেই মানতে হবে। তদ্রƒপ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সব কথা আমরা বুঝতে পারব না, কারণ আল্লাহ তো আলীম, হাকীম! তাঁর জ্ঞান ও ইলম অসীম। আর আমাদের জ্ঞান হচ্ছে সসীম। সসীমের পক্ষে অসীমকে পুরোপুরি বুঝা কীভাবে সম্ভব হবে?
অতএব যেমনিভাবে চিকিৎসার জন্য আমরা প্রথমে ভালো ডাক্তার খুঁজে বের করি, তারপর তার সব কথা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেই, তেমনিভাবে সত্য ও প্রকৃত ¯্রষ্টা ও তাঁর রাসূলকে খুঁজে বের করে তার সব কথাকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এখন প্রশ্ন হলো আমরা নিজেরা ¯্রষ্টা না হয়ে প্রকৃত রব ও ¯্রষ্টা কে তা বুঝব কী করে? এর উত্তর হলো, যেভাবে ডাক্তার না হয়েও ভালো ডাক্তার আমরা খুঁজে বের করি! অর্থাৎ কে বড় ডাক্তার তা বুঝার জন্য যেমন নিজে ডাক্তার হতে হয় না; বরং সামান্য জ্ঞান খাটালেই হয়, তেমনি প্রকৃত রব ও ¯্রষ্টা চেনার জন্য নিজের রব হওয়ার প্রয়োজন নেই, আকল ও বিবেক—বুদ্ধি কাজে লাগালেই প্রকৃত ¯্রষ্টার সন্ধান পাওয়া যাবে।
মোটকথা, যেমনিভাবে আমরা বদীহীভাবে তথা আকলকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত ডাক্তার খুঁজে বের করি তারপর তার কথা অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করি তেমনি আকল দ্বারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনব, কোরআন—সুন্নাহকে সত্য বলে জানব যেভাবে কোরআন আমাদেরকে বারবার বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝতে বলেছে। অতঃপর কোরআন—সুন্নাহর সকল আদেশ—নিষেধ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে চলব। তবে যারা বুঝে বুঝে মানবে তারা কখনো কখনো হয়ত বুঝ অনুযায়ী সামান্য এদিক—সেদিক করবে, ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ করবে। অনেকের কাছে বাহ্য দৃষ্টিতে এটাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পরিপন্থী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা একনিষ্ঠ আনুগত্যেরই প্রকাশ ঘটায়। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পেরে হুবহু নসের বাহ্যিক দিকের উপর আমল করে চলে। তারাও হক ও সত্যপন্থী বিবেচিত হবে।
যেমন : আমাদের পূর্বের উদাহরণে ডাক্তারের কথা মানতে গিয়ে দুই দল বের হয়েছিল। একদল ডাক্তারের কথা বুঝে বুঝে মানে, আরেক দল না বুঝে মানে। তো যারা বুঝে মানে তারা নিজেদের বুঝ অনুযায়ী কখনো কখনো ডাক্তারের লেখা ফাইলে পরিবর্তন আনে, কমবেশি করে। কথার কথা প্রেসক্রিপশনে যদি অন্যান্য ওষুধের সাথে প্যারাসিটামল খেতে বলল পাঁচ দিন কিন্তু জ¦র তিন দিনের মাথায় নেমে গেলে আর প্যারাসিটামল সেবন করে না। এটা কিন্তু বাহ্যদৃষ্টিতে ডাক্তারের অবাধ্যতা, কিন্তু গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে অবাধ্যতা তো নয়ই; বরং তা ডাক্তারের যথাযথ অনুসরণ! কিন্তু যে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন না বুঝে হুবহু ডাক্তারের কথা অনুযায়ী চলতে থাকে, মোটেও কমবেশি করে না, তো এটাও ঠিক আছে। এর দ্বারা সেও আরোগ্য লাভ করতে পারে।
সারকথা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে হবে। বুঝে আসলেও, বুঝে না আসলেও। কোরআনে কারীমে আছে,
لَا یُسْـَٔلُ عَمَّا یَفْعَلُ وَ هُمْ یُسْـَٔلُوْنَ
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কী করলেন কেন করলেন তার কোনো জবাবদিহিতা নেই, কিন্তু মানুষকে তার কাজের জবাবদিহি করা হবে। (সূরা আম্বিয়া, ২১ : ২৩)
আল্লাহ যেহেতু খালিক, মালিক এবং তিনি সবার মহান ¯্রষ্টা, তার কোনো ভুল হয় না, তিনি সকল ভুলের ঊর্ধ্বে, সেহেতু আল্লাহর যেকোনো বিধান বুঝে না আসলেও মানতে হবে, আপত্তি করা যাবে না। তবে হঁ্যা, অস্বীকার ও হঠকারিতার পথ অবলম্বন না করে বুঝার জন্য প্রশ্ন করা এবং ইতমিনান তথা আত্মপ্রশান্তি অর্জনের জন্য কারণ জানতে চাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ শরীয়তের সব বিধানের পিছনেই ইল্লত তথা যথোপযুক্ত কারণ রয়েছে।
الأصل في الأحكام أن تكون معللة
[চলবে, ইনশাআল্লাহ]