প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম : বিভ্রান্তি নিরসনে মুসলমানদের যা জানা দরকার

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম : বিভ্রান্তি নিরসনে মুসলমানদের যা জানা দরকার

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

 

শুরু করতে হয় সেক্যুলারিজম দিয়ে। কারণ এ শব্দটির সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘নট রিলেটেড উইথ এনি রিলিজিয়াস এন্ড স্পিরিচুয়াল ম্যাটার।’ মানে ‘যার ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই’। এমন ব্যক্তি, সমাজ, নীতি ও সংস্থাকে বলে সেক্যুলার।

সেক্যুলারিজম এর সঠিক বাংলা অনুবাদ হবে ধর্মহীনতা। যারা এর অনুবাদ করেন ধর্মনিরপেক্ষতা, তাদের এই অনুবাদে ভিন্ন কিছু বোঝানোর সুযোগ রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের সংবিধানের মূল অংশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে এটি ধর্মহীনতা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; বরং সব নাগরিকের সমান ধর্মীয় অধিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দে উল্লেখিত হয়েছে। অতএব সেক্যুলারিজমকে নির্দ্বিধায় ইসলামবহির্ভূত একটি মতবাদ বলা যায়, ধর্মহীনতা বলা যায়, আসলেই যে অর্থে এর উদগাতা এটি তৈরি করেছেন। মৌলিক বইপত্র, এনসাইক্লোপেডিয়া ও ডিকশনারিতে এর দার্শনিক ও প্রচারকরা যে সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন। এটি সঠিক অর্থে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী মানুষই অনুসরণ করতে পারে না। ধর্মহীন মানুষই কেবল বাস্তব অর্থে সেক্যুলার হতে পারে।

কোনো মুসলমানও পরিবর্তিত এবং ব্যাখ্যামূলক অর্থ ছাড়া যেমন বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা সব মানুষের ধর্মীয় অধিকার লাভ, নিজেদের বানানো এমন অর্থ ছাড়া কোনো মুসলমান সরাসরি সেক্যুলার হতে পারে না। সেক্যুলারিজম একটি ধর্মহীন মতবাদ। এর প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ধর্মহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। ধর্মীয় জীবনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা। এই নাস্তিক্যবাদী মতাদর্শের মোকাবিলা করতে ধর্মগুলোকে বহু কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে। তবে একমাত্র ইসলাম এই মতাদর্শের সাথে কম্প্রোমাইজ না করে নিজের স্বকীয়তা নিয়ে টিকে রয়েছে। এই ধর্মহীন মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করেই দ্বীন হিসেবে পৃথিবীতে এগিয়ে চলেছে। কারণ, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো নিছক ধর্মমাত্র নয়। কিছু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়।

ইসলাম মানুষের জীবনের সব দিক নিয়ে নির্দেশনা দেয়। যে ইসলামে বিশ্বাসী সে জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী শরীয়তে বিশ্বাসী হতে বাধ্য। নিছক ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম হয়ে জীবনের বহু দিক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবনবিধান মতো চলে প্রকৃত মুসলিম হওয়া যায় না।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ کَآفَّۃً        ۪ وَ لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّیْطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ ﴿۲۰۸﴾

ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।—সূরা বাকারা, ০২ : ২০৮

আল্লাহ আরও বলেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَلَا تَمُوْتُنَّ  اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ ﴿۱۰۲﴾

ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয় করো এবং প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। —সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১০২

এখানে ঈমান ও ইসলামে পূর্ণাঙ্গ দাখিল হতে এবং মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে বলা হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এ কথাও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে,

اِنَّ الدِّیْنَ عِنْدَ اللهِ الْاِسْلَامُ

আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন—ধর্ম বা জীবনবিধান হচ্ছে ইসলাম।—সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১৯

অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,

وَمَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ     ۚ وَهُوَ فِی الْاٰخِرَۃِ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ ﴿۸۵﴾

আর যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা তালাশ বা অবলম্বন করবে, তার কাছ থেকে সেটি কোনো দিনই গ্রহণ করা হবে না। আর সে ব্যক্তি পরকালে হবে ব্যর্থ ও মহা ক্ষতিগ্রস্ত।—সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ৮৫

ইসলামের এ স্পষ্ট ঘোষণা থেকে দিবালোকের মতো উজ্জ্বল হয়ে যায় যে, ইসলামে থাকাবস্থায় মুসলিমদের পক্ষে আংশিক বা পূর্ণ ইসলাম ত্যাগ করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বানিয়ে রাখার অধিকারও নেই। ইসলামের পাশাপাশি অপর কোনো ধর্ম বা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করারও উপায় নেই। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনো পর্যায়ে ধর্মহীন হওয়ার অবকাশও নেই। মুসলমানদের কেবল মুসলমান হতে হবে, সেক্যুলার মুসলমান হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।

সেক্যুলারিজম কি কোরআন—সুন্নাহ সমর্থন করতে পারে? এ কথা বলা কি ঠিক যে, ইসলামে সেক্যুলারিজম আছে? না, এ কথা কোনোদিনই বলা যাবে না। এ কথা ঠিক নয়, হতে পারে না। ধর্মহীনতা কী করে ইসলামসম্মত হতে পারে। এমন বিষয়, যার সাথে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার কোনোই সম্পর্ক নেই, এটি কেমন করে ইসলাম সমর্থন করতে পারে। একজন মুসলমান কেমন করে এ মতবাদ গ্রহণ করতে পারে? মুসলমানের জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সেক্যুলারিজম স্থান পেতে পারে না।

ব্যক্তি মুসলিমের জীবনে, মুসলিম পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক এবং মানবিক আচরণ কেমন হবে। অন্যদের নাগরিক নিরাপত্তা ও ধর্ম পালনের অধিকার কতটুকু সুরক্ষিত থাকবে, এ প্রশ্ন যখন ওঠে তখন অনেকে এক্ষেত্রে ইসলামের আচরিত রীতি, পদ্ধতি ও সম্প্রীতির কালচারকে ইসলামের নীতি আদর্শ বা সৌন্দর্য না বলে একে সেক্যুলারিজম আখ্যা দিয়ে ফেলেন। যা মারাত্মক ভুল এবং ইসলামের প্রতি অবিচার।

ইসলামের পরমত সহিষ্ণুতা, নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রদান, শাসন সুবিচার এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে জাতি—ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণ দুনিয়াতে নজিরবিহীন শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এসব বিষয় কোরআন ও সুন্নাহয় আছে। ইসলামের ১৩শ বছরের বিশ্বনেতৃত্বের ইতিহাস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অপূর্ব দৃষ্টান্ত। একে ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ না বলে এর নাম সেক্যুলারিজম দেওয়া বিশাল বড় এক ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।

একটি সাধারণ রাষ্ট্রেও সব ধর্মের মানুষের সমান নাগরিক অধিকার এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ দেওয়ার নাম আর যাই হোক সেক্যুলারিজম হতে পারে না। তরজমা হিসেবে ধর্মহীনতা বলে চালানো না গেলে একই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বলাও সঠিক কাজ না। এটিকে বরং ‘নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার’, ‘ধর্ম পালনে সবার স্বাধীনতা’ বলা কর্তব্য ও অধিক যুক্তিযুক্ত।

কেননা, সেক্যুলারিজমে ধর্মহীনতা স্পষ্ট। যে মতবাদের সাথে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার কোনোই সম্পর্ক নেই, সেটি কেমন করে সব ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করবে? এটি তো রাষ্ট্রের নাগরিকদের ধর্মহীন, ধর্মবিমুখ এবং ধর্মদ্রোহী বানাবে। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সাথে যার কোনোরূপ সম্পর্ক নেই সে মতবাদ নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের সমান অধিকার কী করে দেবে? অতএব, ধর্মকে যারা স্বীকার করে তাদের এ মতবাদের দ্বারস্থ হওয়া উচিত হবে না। তাদের এ নাম ও পরিভাষাটি এড়িয়ে যাওয়া কর্তব্য। তাদের বলা উচিত, সব ধর্মের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ।

ঠিক যেমন বঙ্গবন্ধু ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র মানে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। কার্ল মাক্সের্র নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থা এখানে উদ্দেশ্য নয়। কার্ল মাক্সর্ লিখেছেন, ‘এদেইজম ইজ আনসেপারেবল পার্ট অব মাক্সির্জম’। মানে, আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা মাক্সর্বাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ অর্থে তো ধর্ম ও স্রষ্টায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের জনগণের সংবিধানে মাক্সির্জমের ফলিতরূপ সোশ্যালিজম আসার কথা না। এসব পরিভাষা বিশেষ করে সেক্যুলারিজম ও সোশ্যালিজম প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর উদ্দিষ্ট বিষয়বস্তু দিয়ে। কাজটি করার অগ্রাধিকার রাখেন তাঁর কন্যা।

কারণ, একটি নির্দিষ্ট বিষয় বোঝানোর জন্য কোনো পশ্চিমা ধর্মহীন নাস্তিক্যবাদী মতাদর্শকে তার ভালোমন্দসহ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী স্বাধীন জাতির সংবিধানের স্তম্ভ বানানো আবহমান বাংলাদেশের বিশ্বাস ও চেতনার সাথে যায় কি না, সেটা সংবিধান রচয়িতা, সংশোধন পরিমার্জনকারী, আইনপ্রণেতা প্রতিনিধিবর্গের সামনে সব সময়ই একটি বিবেচ্য এবং ভাববার বিষয় হয়েই থাকবে।

 

০২.

কোরআনে আছে কথাটির অর্থ ধরা হবে ইসলামে আছে। কারণ ইসলামের মৌলিক সব বিষয় কোরআনে বিস্তারিতভাবে থাকে না। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আল্লাহর ওহীর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গরূপে বিবৃত বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। এখানে কোরআনে আছে কি না, এর অর্থ ইসলাম একে সমর্থন করে কি না।

এখানে প্রথমেই পাঠককে জানতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা কী। যদি একটি সমাজে সব ধর্মের লোকেদের নাগরিক সম্প্রীতি, সামাজিক সহাবস্থান ও সবার নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার বুঝানো হয়, তাহলে উত্তরে বলা যাবে যে, এমন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহাবস্থান ইসলামে আছে। আর যদি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেউ পশ্চিমা পরিভাষা সেক্যুলারিজমের সরাসরি অনুবাদ তথা সমার্থবোধক শব্দ হিসেবে নিয়ে বলতে চান, এটি কি কোরআনে বা ইসলামে আছে? তাহলে এক কথায় জবাব হবে, না অবশ্যই নেই। থাকতে পারে না। কারণ ইসলাম একটি ধর্ম। কোরআন এর ধর্মগ্রন্থ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এই ধর্মের রাসূল। যিনি নিজে একটি ধর্মের প্রবক্তা তিনি কী করে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন? একটি ধর্মগ্রন্থ কী করে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে? ইসলাম একটি ধর্ম হয়ে সেটি কী করে ধর্মনিরপেক্ষ হয়।

এ নিয়ে আলাপ খুবই দীর্ঘ। সীমিত অর্থে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বোঝাতে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব তো ইসলামী সমাজ ও সভ্যতায় স্বীকৃত ও যুগে যুগে যথাযথ উপায়ে পরিচালিত কিন্তু এ শব্দটির মূল পরিভাষা সেক্যুলারিজম কোনোভাবেই ইসলামসম্মত নয়। এটি একটি ঈমান, ইসলাম ও কোরআনবিরোধী পরিভাষা, যাতে কোনো মুসলমান বিশ্বাসী হতে পারে না।

ইসলামের প্রথম দিকে মক্কার কাফির মুশরিকরা আল্লাহর নবীর নিকট একটি সমঝোতা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল যে, কিছুদিন আপনি আমাদের উপাস্য দেবদেবীর উপাসনা করবেন আর কিছুদিন আমরা আপনার আল্লাহর ইবাদত করব। সব ধর্মের একটি সমন্বিত ধর্মীয় সংস্কৃতি চালুর চিন্তা থেকেই এ প্রস্তাব তারা দিয়েছিল। এর জবাবে আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিলেন,

قُلْ یٰۤاَیُّهَا الْکٰفِرُوْنَ ۙ﴿۱﴾  لَاۤ  اَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ ۙ﴿۲﴾  وَ لَاۤ  اَنْتُمْ عٰبِدُوْنَ مَاۤ  اَعْبُدُ ۚ﴿۳﴾  وَ لَاۤ  اَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدْتُّمْ ۙ﴿۴﴾  وَ لَاۤ  اَنْتُمْ عٰبِدُوْنَ مَاۤ  اَعْبُدُ ؕ﴿۵﴾  لَكُمْ  دِیْنُكُمْ  وَلِیَ  دِیْنِ ﴿۶﴾

‘হে রাসূল, আপনি বলে দিন, হে অবিশ্বাসীরা, তোমরা যাদের উপাসনা করো আমি তাদের উপাসনা করি না। আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও। তোমরা যাদের উপসনা করো আমি তার ইবাদতকারী নই। আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরা তাঁর উপসনাকারী নও। তোমাদের ধর্মকর্ম ও পরকালীন পরিণামফল তোমাদের আর আমার ধর্মকর্ম ও পরকালীন পরিণামফল আমার।’ যার শেষ পঙ্ক্তিটির আরবী হলো, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।’

এখানে কাফির—মুশরিকদের সাথে ধর্মকর্ম, বিশ্বাস ও উপাসনা এক হওয়া যেকোনো দিনই সম্ভব নয়, সে কথাটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমাদের ধর্ম ও পারলৌকিক প্রতিফল একরকম, আমার ধর্ম ও পারলৌকিক প্রতিফল অন্যরকম। এটি সব ধর্মের সত্যতা, বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতার মিউচুয়াল ঘোষণা নয়। কোরআন বরং এখানে অন্যান্য ধর্ম থেকে নিজেকে দায়মুক্ত ও স্বকীয় ঘোষণা করেছে। অতএব, এ আয়াতের অর্থ, মর্ম বক্তব্য ও বার্তা অনুধাবন করেই এর প্রকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। এর গড়পড়তা ব্যবহার কোরআনের উদ্দেশ্যের সাথে যায় না।

০৩.

কেউ যদি ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী হন সেটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। রিদ্দাহ বা ইরতিদাদ ইসলামে কুফুরীর চেয়েও বেশি নিন্দিত বিষয়। কেননা ঈমান পাওয়ার পর আবার বেঈমান হয়ে যাওয়া মানবজীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। একজন মুসলমান বিশ্বাসগতভাবে সেক্যুলার হওয়া এ ধরনেরই একটি দুঃখজনক বিষয়। আরেকটি পর্যায় আছে পশ্চিমা সেক্যুলার বা ধর্মহীন না হয়ে নিজের তৈরি অর্থবোধক ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সমাজে সকল ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। রাষ্ট্র ও রাজনীতি, শাসন ও বিচার বিবেচনায় ইসলামী পদ্ধতিতে এই স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। মুসলিম শাসননীতিতে জিম্মিদের অধিকার একটি আকর্ষণীয় বিষয়। অমুসলিম জিম্মি নাগরিকদের জন্য মুসলমানদের জন্য হারাম এমন কোনো কোনো বিষয়ও তাদের সমাজে প্রচলিত থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রে এসবের বিশেষ অনুমতি থাকে। যা ইসলামই পৃথিবীকে শিখিয়েছে। আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে কূটনীতিকদের বেলায় যেমন বিশেষ আইন থাকে ঠিক তেমনই মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিম জিম্মি নাগরিকদের জন্য অধিক মানবাধিকার সংবলিত বিশেষ আইন রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ জিম্মিদের নিজস্ব বলয়ে মদ্যপান, শূকরের ব্যবহার, এসবের ব্যবসা, নারী—পুরুষের বেপর্দা একত্রে চলাফেরা প্রভৃতি মুসলিম সমাজের মতো নিষিদ্ধ নয়। তাদের ধর্ম—কর্ম পালন নিষিদ্ধ নয়। তাদের ধমীর্য় উপাসনালয়, ধমীর্য় সংস্কৃতি, ধমীর্য় সম্পত্তি ইত্যাদির নিরাপত্তা মুসলিম রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কেবল ধমীর্য় কারণে এদের উপর কোনোরূপ জুলুম ইসলামী রাষ্ট্র হতে দেয় না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম সমাজে যদি কোনো অমুসলিম জিম্মি নির্যাতিত হয় তাহলে রোজ কেয়ামতে আমি নিজে বাদী হয়ে আল্লাহর দরবারে তার পক্ষে নালিশ করব।

এ বিধান ও সংস্কৃতিকে কেউ যদি ইসলামের উদারতা বলে তাহলে কি বেশি ভালো শোনায়, না এসবকে ধর্মনিরপেক্ষতা বললে বেশি ভালো হয়—এ বিবেচনা বিজ্ঞ পাঠককে করতে হবে। তারা কি ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ও এর প্রয়োগ চিন্তা না করেই বলতে আগ্রহী হবেন যে, কোরআন শরীফেও ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। এ ধরনের একটি অসংযত বাক্য প্রয়োগের ফেতনায় বর্তমানে মুসলমানরা আছে।

বাংলাদেশের সংসদে একজন কমিউনিস্ট ভাবধারার এমপি একবার বলেছিলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। এটি তাদের ধারণার ধর্মনিরপেক্ষতা। তারা গভীরভাবে চিন্তা করতে চান না যে, ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে সেক্যুলারিজমের তরজমা। যার অর্থ ধর্মহীনতা। আগেই বলা হয়েছে, একটি ধর্মের নবী কেন এবং কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হবেন। তিনি সকল ধর্মের মানুষের সামাজিক ও মানবিক অধিকার দেওয়ার পক্ষে একটি সহনশীল রাষ্ট্রচিন্তা দান করতে পারেন। সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত একজন দায়িত্বশীল, বর্তমানে মৃত, একবার দাবি করলেন, মদীনা সনদ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং এর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ছিল না। বিষয়টি নিয়ে একটি মহল বেশ হইচই ফেলে দিলে একজন আলেম হিসেবে এই ভুল তথ্য রদ করা ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করি। বিখ্যাত সব ইতিহাসগ্রন্থ থেকে মদীনা সনদের অধ্যায় ফটো করে তাদের কাছে পেশ করা হয়। স্পষ্ট হরফে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়। আর মদীনা সনদের শুরুতে আল্লাহর কালেমা, তাওহীদ ও রেসালতের সাক্ষ্য এবং মদীনার সব ধর্মের নাগরিকরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নেতৃত্ব মেনে একটি নাগরিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলার যে চুক্তিপত্রে সম্মতি প্রদান করে, এরই নাম মদীনা সনদ বলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এটি ইসলামের কোনো মৌল রাষ্ট্রদর্শন বা বিধান নয়। এটিকে অজ্ঞতা বা অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ কোনো সনদ বলা মোটেও ইসলামসম্মত নয়।

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন