নাযেম সাহেব হুজুরের বিদায় : সৃষ্টি হলো আরেকটি শূন্যতা
জীবনী
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
আখেরাতের সফরে রওনা হয়ে গেলেন মাওলানা মাহবুবুর রহমান সাহেব রহ.। এ এমন এক সফর, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। এ এমন সফর, যেখানে আমাদের সকলকেই রওনা করতে হবে। একটু আগে কিংবা একটু পরে—এই যা ব্যবধান।
إن لله ما أخذ وله ما أعطى وكل شيء عنده بأجل مسمى
আল্লাহ যা কিছু নিয়ে নেন, তা তাঁরই, যা তিনি দান করেন তাও তাঁর। আর সবকিছুর জন্যেই তাঁর নিকট রয়েছে একটি সুনির্ধারিত মেয়াদ।
এটা আমাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাস আমাদের দ্বীন ও ঈমানের অঙ্গ। আমরা বিশ্বাস করি—আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রত্যেকের জন্যে যে মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, এর ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। সকলেই তার জন্যে নির্ধারিত সময়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, আখেরাতের পথে রওনা হয়। ‘অকাল মৃত্যু’ বলে তাই কিছু নেই। তবুও আপনজনদের মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত হই। আমাদের পৃথিবীটা যেন দুলে ওঠে। গভীর শূন্যতায় হারিয়ে যাই। আবার চলতে থাকি দুনিয়ার অবশিষ্ট পথ। এই তো জীবন। এটাই স্বাভাবিকতা।
মাওলানা মাহবুবুর রহমান রহ.—জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি পরিচিত ছিলেন ‘নাযেম সাহেব হুজুর’ নামে। বাবা—মায়ের দেওয়া নাম শফীকুল্লাহ। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে তিনি পরিচিত এ নামেই। তবে ঢাকায় তিনি মাওলানা মাহবুবুর রহমান। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সময়ে কামরাঙ্গীরচরের নুরিয়া মাদরাসায় ছিলেন অনেক দিন। তাঁর পরবর্তর্ী কর্মস্থল—মাদরাসাতুল মাদীনা। সেখান থেকেই এ নাম—নাযেম সাহেব হুজুর। বাংলাভাষী তালিবুল ইলমদের হাতে ‘মাদানী নেসাব’ নামে একটি উপহার তুলে দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল মাদরাসাতুল মাদীনা। আদীব হুজুরের স্বপ্নের সেই প্রতিষ্ঠানে একেবারে শুরুর দিন থেকে না হলেও শুরুর দিক থেকেই তিনি ছিলেন। প্রায় দুই যুগ ছিলেন সেখানে। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন মারকাযুল কুরআন নামে একটি প্রতিষ্ঠান, কামরাঙ্গীরচরেই। বছর কয়েক এখানে কাটিয়ে গড়ে তুলেন আরেক প্রতিষ্ঠান—মারকাযুল কুরআন ঢাকা। এবার আর চরে নয়, উত্তরার উত্তরখান এলাকায়। এখান থেকেই বিদায় নিলেন তিনি। নাযেমে তালিমাত ছিলেন নুরিয়া মাদরাসায়, মাদরাসাতুল মাদীনায়ও ছিলেন বেশ কিছুদিন, শেষে মারকাযুল কুরআনে তো মুহতামিমই। কিন্তু ‘নাযেম সাহেব হুজুর’—ই ছিল তাঁর পরিচয়। তাঁর মৃত্যুসংবাদ যখন শুনি, তখনো এভাবেই শুনেছি—নাযেম সাহেব হুজুর ইন্তেকাল করেছেন!
ইন্তেকালের আগে প্রায় দুই বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি—অবনতি সবই হয়েছে। কখনো বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন, আবার শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে আরও অবনতি হয়েছে। কয়েকদিন থেকেই ছিল আশঙ্কা—কখন যেন হুজুর চলে যান! কখন যেন ফোনে শুনতে হয় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ! এ শঙ্কাটি এমন এক সময় বাস্তবে রূপ নিল, যখন বাংলাদেশের আলেমসমাজের প্রাণপুরুষ হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. এর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠা যায়নি। কাসেমী সাহেব রহ. এর ইন্তেকালের ঠিক এক মাসের মাথায় হুজুরও চলে গেলেন। হারিয়ে গেল শত শত আলেম ও তালিবুল ইলমের এক নিরাপদ আশ্রয়।
মাওলানা মাহবুবুর রহমান সাহেব রহ. জাতীয় পর্যায়ে অতি পরিচিত কোনো ব্যক্তি ছিলেন না ঠিক, কিন্তু নিজস্ব গণ্ডিতে তিনি ছিলেন এককথায় মহামানব। পরিচিতজনদের নিকট তাঁর প্রথম পরিচয়—কর্মবীর। সত্তর পার করা বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ১৩.১.২০২১ বিকাল চারটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে, আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হসপিটালে। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পূর্বপর্যন্ত, শরীর যতদিন তাকে সঙ্গ দিয়েছে, তিনি তাঁর নানামুখী ব্যস্ততার ভেতর দিয়েই জীবন কাটিয়েছেন। শিক্ষকতাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ, পেশা ও নেশা। ক্যান্সারের আঘাতে তিনি যখন শয্যাশায়ী, এ অবস্থাতেও তিনি পড়িয়েছেন ছাত্রদের। ইহতিমামের দায়িত্বের অজুহাতে কিংবা নিজের প্রভাব ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কখনোই এড়িয়ে যেতে চাননি শিক্ষকতার কোনো অংশকে। বরাবরই বুকে আগলে রেখেছেন তাদরিস ও শিক্ষকতার এ মহান দায়িত্ব।
পরিচিতজনদের খুবই কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। পড়িয়েছেন আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার ছাত্র। তাঁর ছাত্রদের অনেকেই এখন মাদরাসার মুহতামিম, শায়খুল হাদীস কিংবা এ মানের কোনো খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। ছাত্রদের কী পরিমাণ ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছিলেন, তাঁর একটি নজির পরিলক্ষিত হয়েছে জানাজার নামাজে। দশটায় জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই তাঁর লাশবাহী গাড়িটি পৌঁছে যায় মাঠে। মাদরাসার পার্শ্ববর্তী একটি মাঠ। বেশ বড়সড়। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো আলেম—ওলামা ও তালিবুল ইলমগণ। আর অনেকেই আসছেন শেষবারের মতো একনজর দেখার জন্যে প্রাণপ্রিয় এ মানুষটিকে। ছাত্ররা হাতে হাত রেখে একটি পথ তৈরি করে দিয়েছিল। সে পথ ধরেই মাঠের দক্ষিণ দিক থেকে এসে হুজুরের চেহারাটি দেখে উত্তর দিকে চলে যাচ্ছিলেন সকলে। এরপর কাতারে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এভাবে চলল দীর্ঘক্ষণ। যানজটের শহর ঢাকায় সেদিন জটের তীব্রতা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এতে নির্ধারিত সময়ের পূর্বে গুণীজনদের অনেকেই পেঁৗছাতে পারেননি। অনেকেই ফোন করে জানাজার নামাজ একটু বিলম্বিত করার জোর অনুরোধ করলেন। সে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই জানাজা বিলম্বিত হলো। নির্ধারিত সময়ের আধাঘণ্টারও বেশি সময় পর যখন জানাজার নামাজ শুরু হলো, তখনো এ শহরের পরিচিত অনেকেই ছিলেন রাস্তায়, জটের সামনে অসহায়। যে দৃশ্যটির কথা বলতে চাচ্ছি—জানাজার নামাজের পূর্বমুহূর্তে হুজুরের নিথর দেহটি যখন লাশবাহী গাড়ি থেকে খাটিয়ায় নামিয়ে আনা হলো, তখন খাটিয়ার পাশে উপস্থিত মারকাযুল কুরআনের বেশ কয়েকজন ছাত্র যেন খাটিয়ার উপর একপ্রকার হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এমনভাবে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ল, জীবনে যত জানাজার নামাজ আমি দেখেছি, শরিক হয়েছি, কিন্তু এমন কোনো জানাজা আমি দেখিনি, যেখানে আপনজনেরা এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারে। তাদের যেন কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। মাইকে বলা হচ্ছে, উপস্থিত মুরুব্বিগণ তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তারা তবুও যেন মেনে নিতে পারছিল না নিজেদের প্রাণপ্রিয় হুজুরের এ বিদায়।
ইন্তেকালের পর রাতেই হুজুরকে দেখার জন্যে ছুটে এসেছিলেন বহু মানুষ। আমার সৌভাগ্য, সে কাফেলায় আমিও ছিলাম। আমি দেখেছি, শুনেছি—কতজন কতভাবে হুজুরের স্মৃতিচারণ করছেন! সবার কথাতেই ঠিকড়ে পড়ছিল হুজুরের নানামুখী গুণ, বিশেষত সুন্দর আখলাকের কথা। সেসব স্মৃতিচারণের একটি টুকরো—উপস্থিতদের একজন ছিলেন মাওলানা রজীবুল হক সাহেব। হুজুর যখন নুরিয়ায়, তিনি তখন সেখানে হেফজখানায় পড়েন। সম্পর্ক তখন থেকেই। তিনি সারা দেশেই সেবামূলক কাজ করেন। তিনি জানালেন, ‘হুজুর নিয়মিতই তাকে ফোন করতেন। এমনকি অসুস্থ অবস্থাতেও। প্রতিমাসে একবার তো ফোন করতেনই।’ আমি অবাক হয়ে শুনলাম। হুজুরকে যদি ‘বিশাল’ বলি, আমরা তো সেখানে ‘ক্ষুদ্র’ও নই। অথচ নিজেদের ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে কত আপনজনদের সঙ্গে বছরেও এক—দুইবারও কথা হয় না। সেখানে তিনি ফোন দিতেন প্রতিমাসেই! হুজুরের তালিকায় এমন আরও কত রজীবুল হক ছিলেন, কে জানে!
হুজুরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য অনেকের মতো শিষ্যত্বের নয়। হুজুরের ছেলে মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আর আমি একই সঙ্গে বাইতুস সালাম মাদরাসায় পড়েছি পাঁচ বছর—প্রথম বর্ষ থেকে পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত। এ সুবাদেই হুজুরের সঙ্গে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক। সর্বপ্রথম কবে তাকে দেখেছি—এখন মনে নেই। তবে এতটুকু মনে পড়ে—২০০২ সালের শেষ দিকে, তখন আমরা প্রথম বর্ষে পড়ি, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বাইতুস সালাম মাদরাসা থেকে মাদরাসাতুল মাদীনায় গিয়েছিলাম। ইমদাদ ভাই তো ছিলেনই, সঙ্গে ছিলেন আমাদের আরেক সহপাঠী মাওলানা সালাহুদ্দীনও। আমরা অনেক সময় সেখানে কাটিয়েছিলাম। সোজা হুজুরের মেহমানই হয়েছিলাম। হুজুরের কামরায় বসে একসঙ্গে এক দস্তরখানে খেয়েছিলাম। হুজুর সেদিন মাদরাসার ফলাফলও ঘোষণা করেছিলেন। সে মজলিসেও শরিক হয়েছিলাম। ‘রাকমুন নাজ্ম’, স্কুল—কলেজে যেটা ‘স্টার মার্ক’, আরবি এ শব্দটি এবং এর ব্যবহার হুজুরের মুখেই আমি প্রথম শুনেছিলাম। এ মুহূর্তে হুজুরের চেহারা যেমন বারবার আমার চোখে ভেসে উঠছে, হুজুরের সেদিনের ‘রাকমুন নাজম’ এবং ফলাফল ঘোষণার দৃশ্যটাও যেন চোখে ভাসছে, কিছু শব্দ যেন কানে ভেসে আসছে। সেদিনই আমি প্রথমবারের মতো হুজুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছিলাম। মাদরাসাতুল মাদীনায় এরপর আরও অনেক গিয়েছি এবং প্রায় প্রতিবারই হুজুরের রুমে একসঙ্গে বসে খেয়েছি। তাঁর জীবনের অনেক গল্প শুনেছি। সেখানে আমি অনুভব করতাম পরম স্নেহ—ভালোবাসা—যত্ন ও আদরের এক শীতল পরশ। এ মুগ্ধতা প্রকাশ করার মতো নয়।
আমার জীবনের এক চরম সংকটকালে পরামর্শের জন্যে আমি হুজুরের কাছে উপস্থিত হয়েছিলাম। সে সংকটের সমাধান নিয়ে পরামর্শ করার মতো আমার সামনে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। হুজুর পরামর্শ দিলেন, সাহস জোগালেন। আল্লাহ দয়াময় সে সংকট থেকে আমাকে উদ্ধারও করেছেন। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু বিষয় নিয়ে হুজুরের পরামর্শ চেয়েছিলাম। এমনকি এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরও। তাঁর বাসায় তাকে দেখতে গিয়ে। বরাবরই আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি সংকট শুনতেন, বুঝতে চাইতেন, এরপর পরামর্শ দিতেন।
হুজুরের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ভিত্তি ছিল—আমি তাঁর ছেলের সহপাঠী। আবার আমাদের অনেক উস্তাযও হুজুরের ছাত্র। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি অনুভব করতাম—কারও মধ্যস্থতায় নয়, হুজুর সরাসরিই আমাকে স্নেহ করেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন আমার আব্বার কথা। আব্বা দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। তিনি দেশে আসছেন কি না, কী করছেন, তাঁর স্বাস্থ্য কেমন ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিতেন। এমন বড় মানুষের এ স্নেহ আমার জন্যে এক বড় প্রাপ্তি।
আমাদের মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুফতী মাহমুদুল হাসান সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ, মধুর। দুজনই নিজের ছেলেকে পড়তে দিয়েছিলেন অপরজনের কাছে এবং সন্তানের প্রতি, সন্তানের উস্তাযদের প্রতি দুজনই যারপরনাই যত্নবান। সম্পর্কের এ ঘনিষ্ঠতা ছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত। আমার সৌভাগ্য, দুজনই আমাকে স্নেহ করতেন। একজন তো চলে গেলেন আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে, আরেকজন এখনো আছেন। এ ছায়াকে আল্লাহ দয়াময় আমাদের জন্যে অনেক দীর্ঘ করে দিন।
গত কয়েক বছরে, নাযেম সাহেব হুজুরের সঙ্গে যখনই সাক্ষাৎ হয়েছে, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি আমার সব খোঁজখবর নেয়ার পাশাপাশি জানতে চাইতেন আমাদের মুহতামিম সাহেব হুজুরের কথা। দুই মুরব্বির স্নেহের কথা ভেবে আমি তৃপ্তি পেতাম। গত কয়েকদিন আগে, হুজুর যখন হাসপাতালে ভর্তি, আমি গিয়েছিলাম হুজুরকে একনজর দেখার জন্যে। সেদিন হঠাৎ করেই তাঁর অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক হয়ে পড়েছিল। মাগরিবের কিছুক্ষণ পূর্বে আমি হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছিলাম। হুজুর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। হাত—পা তখনো নাড়াতে পারেন। আমার সঙ্গে আগের মতোই কথা বলেছেন। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি, একজন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। সেখানে শুয়ে শুয়ে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমাদের মুহতামিম সাহেব হুজুরের কথা। বললেন—মুফতী সাহেব হুজুর কেমন আছেন? ভাবা যায়! আমাদের জন্যে তিনি দুআ করলেন। তিনিও দুআ চাইলেন, বললেন, মুফতী সাহেব হুজুরের কাছে দুআর কথা বলার জন্যে। আমি তাকে হুজুরের অসুস্থতার কথাও জানালাম। তিনিও হুজুরের জন্যে দুআ করলেন। এ দুআ চাওয়া এবং দুআ করার মধ্যে দেখেছি, এমন অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁর মনোবল ভেঙে পড়েনি। শুয়ে শুয়েই তিনি উপস্থিত অন্যদের তাগাদা দিচ্ছিলেন আমাদের মেহমানদারি করার জন্যে। হুজুরের দস্তরখান তো আমার জন্যে অনেক পুরোনো, অনেক দিনের পরিচিত। সেই দস্তরখান মাদরাসা বাসা হয়ে হাসপাতালেও বিস্তৃত হলো। এ জীবনে হুজুরের সঙ্গে সেদিনের কথাই আমার শেষ কথা।
এরপর আরেকদিন গিয়েছিলাম। তখন আর তিনি কথাও বলতে পারতেন না। কিছু সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইমদাদ ভাই আমার কথা বললেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এ অবস্থাতে তাঁকে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরপর যখন তাঁকে দেখেছি, তখন তো আর তিনি আমাদের মাঝে নেই। আমাদের সামনে একটি খাটিয়ায় রাখা ছিল কেবলই তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ।
তাঁর ছেলের সঙ্গে দীর্ঘদিন পড়ার সুবাদে তাঁর সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। তাঁর আখলাকে হাসানার গল্প, হৃদয়ের মহত্ত্বের গল্প। গ্রামের এক ব্যক্তি অন্যায়ভাবে তাঁর নামে একটি মামলা করেছিল। সে মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্যে তিনি যাচ্ছিলেন রিকশায়, আর মামলাকারী যাচ্ছিলেন পায়ে হেঁটে। বিশ্বাস করা যায়—এ লোককে তিনি নিজের রিকশায় তুলে নিয়েছিলেন পরম মমতায়! এ ধরনের ঘটনা আমরাই শুনেছি অনেক। আর যারা কাছে থেকে তাকে দেখেছেন দিনের পর দিন, তাদের সামনে তো এর নজির বিদ্যমান অসংখ্য। জীবনের শেষ লগ্নে এসে যখন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষকদের বেতন কখনোই বাকি রাখেননি। মাদরাসার ফান্ডে টাকা থাকলেও দিয়েছেন, যখন টাকা থাকত না, ধার করে হলেও দিয়েছেন। শিক্ষকদের কাছ থেকেই শোনা, তাদের বেতন দেয়ার জন্যে এমন মানুষের কাছ থেকেও তিনি ধার করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে যা ছিল তাঁর জন্যে অনেকটা আত্মসম্মানের বিষয়। করোনার সংকটের সময়ে চারিদিকে যখন বেতন না দেওয়া কিংবা কমিয়ে দেওয়া, কমপক্ষে আংশিক পরিশোধ করার কথা ভাবতে হয়েছে অনেককে, বলা যায় প্রায় সকলকেই, তখন তিনি শিক্ষকদের পুরো বেতন পরিশোধ করেছেন। এমনকি মাদরাসার জমি কেনার জন্যে যে টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন, সে টাকা বিলিয়ে দিয়েছেন বেতন পরিশোধ করতে গিয়ে। অধীনস্থদের প্রতি এভাবেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। তাদের যেকোনো সমস্যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন, সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এ সহযোগিতা বিস্তৃত ছিল গ্রামের বাড়ির অসচ্ছল মানুষজন পর্যন্ত। কত মানুষ, কত পরিবার যে তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত সহযোগিতা পেয়েছে এর হিসাব তিনি তাঁর একান্ত আপনজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও বলেননি। এ জন্যে তাঁকে যথেষ্ট ঋণও করতে হয়েছে। দর্জির দোকানে লক্ষাধিক টাকা বাকি রেখে জামাকাপড় বানিয়ে দিয়েছেন। এলাকার গণমানুষের জোর দাবি ছিল—মৃত্যুর পর তাঁকে যেন গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সংগত কারণেই অবশ্য তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
জানাজা নামাজের পূর্বে যারাই কথা বলেছেন, তাঁর উত্তম আখলাকের কথা বলেছেন। মারকাযুল কুরআন নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথাও বলেছেন। এমন মানুষ যখনই বিদায় নেন, অন্যদের মনে হয়—তিনি যদি আরও কিছুদিন থাকতেন আমাদের মাঝে!
একেবারে শেষ মুহূর্তে জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন হুজুরের দীর্ঘদিনের সহকর্মী খ্যাতিমান প্রবীণ আলেমে দ্বীন মাওলানা ইসমাঈল বরিশালী দা.বা.। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত কথা শুরু করেছিলেন এ পঙক্তি দিয়ে—
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।
এমন ঈর্ষণীয় এক জীবনেরই অধিকারী ছিলেন আমাদের নাযেম সাহেব হুজুর। যারা তাঁর পাশে ছিলেন তারা দেখেছেন, শেষ নিঃশ্বাসটি ফেলার সময় বাস্তবিক অর্থেই তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল হাসির ঝিলিক। এ হাসি অপার্থিব। এ হাসি অসীম জীবনের এক শুভ সূচনার—আমরা এমনই কামনা করি।
২৫.১.২০২১
রাত ১০.৪০