নারীদের ইবাদত : স্বর্ণযুগের কিছু দৃষ্টান্ত
মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী
আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে জীবনের মূল লক্ষ্য—উদ্দেশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الْاِنْسَ اِلَّا لِیَعْبُدُوْنِ
আমি মানুষ ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।—সূরা যারিয়াত ৫১ : ৫৬
এ কথাটাই এক হাদীসে কুদসীতে কিছুটা বিস্তারিত এসেছে, হে আমার বান্দারা, আমি তোমাদেরকে এজন্য সৃষ্টি করিনি যে তোমরা আমার একাকিত্বের সঙ্গী হবে। এজন্যও নয় যে, জনবল কম আছে; তাই তোমাদের জনবল বাড়াব। একা হওয়ার কারণে কোনো কাজ করতে অপারগ হয়ে তোমাদের সাহায্য কামনা করছি বিষয়টি এমনও নয়। তোমাদের দ্বারা আমার কোনো উপকার হবে কিংবা কোনো ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করব, এজন্যও তোমাদের সৃষ্টি করিনি। বরং আমি তো এজন্য তোমদের সৃষ্টি করেছি যে, তোমরা সারাটা জীবন আমার বন্দেগী করবে। বেশি বেশি আমার যিকির করবে। সকাল—সন্ধ্যা আমার গুণগান গাইবে।—(ড. ইউসুফ কারযাভী রচিত ইবাদতের প্রকৃত অর্থ, পৃষ্ঠা ৪৩)
আল্লাহ তাআলা মানবজাতির প্রত্যেক সদস্য থেকে তাঁর ইবাদতের ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছেন। কোরআনুল কারীমে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন,
اَلَمْ اَعْهَدْ اِلَیْكُمْ یٰبَنِیْۤ اٰدَمَ اَنْ لَّا تَعْبُدُوا الشَّیْطٰنَ ۚ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ ﴿ۙ۶۰﴾ وَّ اَنِ اعْبُدُوْنِیْ ؕؔ هٰذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِیْمٌ ﴿۶۱﴾
হে আদম সন্তানেরা, আমি কি তোমাদের থেকে এই ওয়াদা নিইনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করবে না। কারণ শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আর তোমরা আমারই ইবাদত করো। এটা সহজ—সরল পথ।—সূরা ইয়াসিন ৩৬ : ৬০—৬১
কিন্তু মানুষ কালের আবর্তনে সেই ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছে। এক আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে অনেক খোদার পূজা শুরু করে দিয়েছে। প্রত্যেক বড় বস্তুকে খোদার মর্যাদা দিয়ে রেখেছে। মানুষের এ ধরনের উদাসীনতার জন্যই আল্লাহ তাআলা নবী, রাসূল এবং আসমানী কিতাব অবতীর্ণের ধারা চালু করেছেন। যার মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে এক আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষকে মাখলুকের ইবাদত থেকে বের করে আল্লাহর ইবাদতের দিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
প্রত্যেক নবী ও রাসূলের নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি একই আহ্বান ছিল, হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। কোরআনের বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসংখ্য হাদীসে ইবাদতের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সঙ্গে এ কথাও বলে দেওয়া হয়েছে, যে নিজ জীবনের লক্ষ্য অর্জনে (ইবাদতে) সফলকাম হবে সে মহান রবের সন্তুষ্টি লাভ করবে। যে এতে ব্যর্থ হবে সে প্রভুর অসন্তুষ্টির কারণে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে। এজন্য বান্দার প্রকৃত কামিয়াবী আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের সুন্নত অনুযায়ী ইবাদত করার মাঝেই নিহিত। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে অন্য পথে যে সফলতা খুঁজে বেড়াবে তার জন্য ব্যর্থতাই চূড়ান্ত পরিণতি হবে।
আল্লাহ পাক কোরআনুল কারীমে পুরুষের ইবাদতের আলোচনার পাশাপাশি নারীদের ইবাদতের কথাও উল্লেখ করেছেন। ইবাদতের সওয়াব ও প্রতিদানে সমান অংশীদার তারাও। কোরআনের এই আয়াতটি এ দিকেই ইশারা করছে,
اِنَّ الْمُسْلِمِيْنَ وَ الْمُسْلِمٰتِ وَالْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ وَالْقٰنِتِيْنَ وَالْقٰنِتٰتِ وَالصّٰدِقِيْنَ وَالصّٰدِقٰتِ وَالصّٰبِرِيْنَ وَالصّٰبِرٰتِ وَالْخٰشِعِيْنَ وَالْخٰشِعٰتِ وَالْمُتَصَدِّقِيْنَ وَالْمُتَصَدِّقٰتِ وَالصَّآئِمِيْنَ وَالصّٰٓئِمٰتِ وَالْحٰفِظِيْنَ فُرُوْجَهُمْ وَالْحٰفِظٰتِ وَ الذّٰکِرِيْنَ اللهَ کَثِيْرًا وَّ الذّٰکِرٰتِ ۙ اَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَّ اَجْرًا عَظِيْمًا ﴿۳۵﴾
নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, খোদাভীরু পুরুষ ও খোদাভীরু নারী, রোযাদার পুরুষ ও রোযাদার নারী, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী পুরুষ ও নারী, অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকিরকারী পুরুষ ও অধিক যিকিরকারী নারী, আল্লাহ এদের সকলের জন্য ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।—সূরা আহযাব, ৩৩ : ৩৫
ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী যে, ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ইবাদত—বন্দেগীর এই নির্দেশের ওপর পুরুষ যেমন আমল করেছে নারীরাও তেমনই আমল করেছে। তারা কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় পুরুষরা যেমন আঁধার রজনিগুলো ইবাদত—বন্দেগীর বিভায় আলোকিত করেছে, তেমনই নারীরাও ইবাদত ও বন্দেগীর আলোর মাধ্যমে তাদের রজনিগুলো উজ্জ্বল করেছে। রবের সঙ্গে নির্জনে কথা বলার জন্য রাত্রিজাগরণ ও শেষ রাতের আহাজারিকে অভ্যাসে পরিণত করেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে আগ্রহ—উদ্দীপনা নিয়ে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন, তেমনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংশ্রবধন্য পবিত্র স্ত্রীগণও পূর্ণ আবেগ ও আগ্রহ—উদ্দীপনা নিয়ে ইবাদতে মগ্ন হতেন। পুরুষ সাহাবীরা যেমন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নত মোতাবেক ইবাদত—বন্দেগী করতেন, তেমনই নারী সাহাবীরাও রাসূলের শিক্ষা মোতাবেক আমল করতেন।
ইবাদতের ময়দানে হযরত হাসান বসরী রহ. যেমন কামেল ওলী হয়েছেন, তেমনই রাবেয়া বসরী রহ.—ও ওলী হয়েছেন। ইবাদতগুজার বান্দাদের তালিকা ওই সকল মহান নারীদের নাম উল্লেখ ব্যতীত পূর্ণতা লাভ করতে পারে না, যাদের ইবাদতের আগ্রহ—উদ্দীপনা ও রবের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা—মেহনত দেখে এ যুগের নারীরাও তাদের জীবনের লক্ষ্য—উদ্দেশ্যের কথা স্মরণ করে আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
খাইরুল কুরুন তথা কল্যাণযুগ ও সালাফে—সালেহীনের নারীদের ইবাদতের প্রতি এতটা আগ্রহ ও উদ্দীপনা ছিল যে, দিন—রাতের বেশিরভাগ সময় তারা মাওলার ইবাদতে কাটাতেন। নিজেদেরকে এমন—সব কাজেই ব্যস্ত রাখতেন যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হন। তারা ইবাদত—বন্দেগীতে আল্লাহর নৈকট্যের সে মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন যেখানে বর্তমান সময়ের বড় বড় ওলীদের পেঁৗছাও কঠিন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী আম্মাজান হযরত আয়েশা রাযি. ছিলেন একজন ইবাদতগুজার। আল্লাহ তাআলাকে ভীষণ ভয় করতেন। চাশতের নামায গুরুত্বসহ নিয়মিত আদায় করতেন। রমযানুল মুবারকে তারাবীহর ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ছিলেন। বেশিরভাগ সময় রোযা রাখতেন। প্রতি বছর পূর্ণ উদ্যম ও গভীর আবেগ নিয়ে হজ পালন করতেন। গোলামদের প্রতি সহনশীল ছিলেন। গোলাম কিনে কিনে আযাদ করে দিতেন।—শরহে বুলুগুল মারাম
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাযি.—ও একজন ইবাদতগুজার নারী ছিলেন। রবের ইবাদতে সদা মশগুল থাকতেন। রমযান ছাড়াও তিনি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতেন পাবন্দীর সাথে। তাঁর সব কাজেই আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হতো। আল্লাহর আদেশ যেমন অতি গুরুত্বসহ পালন করতেন, তেমনই নিষিদ্ধ বিষয় থেকেও সতর্কতার সঙ্গে বেঁচে থাকতেন।—ইবনে সাআদ
উম্মুল মুমিনীন হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ রাযি. অত্যন্ত দ্বীনদার, মুত্তাকী, সত্যবাদী নারী ছিলেন। আল্লাহর দরবারে খুব কাঁদতেন। তাঁর ইবাদত ও দুনিয়াবিমুখতার স্বীকৃতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়ে গেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. আল—ইছাবা গ্রন্থে একটি ঘটনা লিখেছেন। একবার হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির কিছু সাহাবীর মাঝে গনীমতের সম্পদ বণ্টন করছিলেন। সেখানে হযরত যায়নাব রাযি.—ও ছিলেন। তিনি এমন একটি কথা বললেন যা হযরত ওমর রাযি. এর অপছন্দ হলো। তখন হযরত ওমর রাযি. কিছুটা তিক্ত ভাষায় হযরত যায়নাব রাযি.—কে কথা বলতে বারণ করেন। এটা দেখে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে ওমর, তাকে কিছু বলো না। কারণ সে اوَّاه তথা আল্লাহকে খুব ভয় করে।
উম্মুল মুমিনীন হযরত জুয়ায়বিয়া রাযি.—ও খুব ইবাদতগুজার ও দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ইবাদত—বন্দেগীতে লিপ্ত পেতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই ঘর থেকে বাইরে যেতেন অথবা বাইরে থেকে ঘরে আসতেন তখনই তাকে রবের দরবারে মিনতি ও কান্নাকাটিতে রত পেতেন।
একদিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সময় তাঁকে নিজ ঘরের নামাযের স্থানে ইবাদতরত দেখলেন। এরপর অন্যান্য প্রয়োজন সেরে এসে দেখলেন তিনি আগের অবস্থায়ই আছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তখন থেকে এভাবে ইবাদতে মশগুল আছো?
উত্তরে তিনি বললেন, জি হঁ্যা, ইয়া রাসূলুল্লাহ।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি চারটি কালিমা পাঠ করেছি। যা তিন বার পাঠ করলে তুমি এ পর্যন্ত যত তাসবীহ পাঠ করেছ তার চেয়ে বেশি সওয়াব পাবে। সে কালিমা হলো:
سُبْحَانَ اللهِ وَبحَمْدِهٖ عَدَدَ خَلْقِهٖ، ورِضٰى نَفْسِهٖ، وَزِنَةَ عَرْشِهٖ، ومِدَادَ كَلِمَاتِهٖ.
—সহীহ মুসলিম
মুসনাদে আহমাদে এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন বারো রাকাত নফল নামায পড়বে, জান্নাতে তার জন্য ঘর নির্মাণ করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ বাণী হযরত উম্মে হাবীবা রাযি.—ও শুনছিলেন। এরপর থেকে এই বারো রাকাতের আমল করে গেছেন। কখনো ছাড়েননি।—মুসনাদে আহমাদ : ১৯৭০৯
হযরত ফাতেমা রাযি. আল্লাহর ইবাদতের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে এ কথা প্রসিদ্ধ যে, তিনি তাহাজ্জুদগুজার ছিলেন। অধিক পরিমাণে রোযা রাখতেন। আল্লাহর ভয়ে সদা কম্পিত থাকতেন। জবানে অবিরত আল্লাহর যিকির জারি থাকত।
হযরত আলী রাযি. বলেন, আমি ফাতেমাকে দেখতাম সে রান্না করছে, সঙ্গে আল্লাহর যিকিরও করছে। হযরত সালমান ফারসী রাযি. এর বর্ণনা, হযরত ফাতেমা রাযি. ঘরের কাজে ব্যস্ত আছেন সঙ্গে কোরআনের তেলাওয়াতও করছেন। চাক্কি পিষতে থাকা অবস্থায়ও জবানে কোরআনের তেলাওয়াত চালু থাকত।
আল্লামা ইকবালের এ পঙ্ক্তিতে হযরত ফাতেমা রাযি. এর এ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে,
آں ادب پروردۂ صبر و رضا
آسيا گردان ولب قرآن سرا
হযরত আলী রাযি. বলেন, ফাতিমা খুব বেশি পরিমাণে আল্লাহর ইবাদত করতেন। তবুও ঘর—সংসারের কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটতে দিতেন না।
হযরত হাসান রাযি. বলেন, আমার আম্মা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরের ইবাদতের নির্দিষ্ট স্থানে আল্লাহ পাকের দরবারে রোনাজারি, মিনতি, বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর প্রশংসা ও দুআ—মুনাজাতে মশগুল দেখতাম। দুআ শুধু নিজের জন্য করতেন না; বরং মুসলিম উম্মাহর নর—নারী সকলের জন্য দুআ করতেন। ইবাদতের সময় তার উজ্জ্বল চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে যেত। চক্ষুদ্বয় থেকে অঝোর ধারায় অশ্রম্ন ঝরত। এমনকি বেশিরভাগ সময় জায়নামায চোখের পানিতে ভিজে যেত।
হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত ফাতেমা রাযি. অধিকাংশ রাত নামাযে কাটিয়ে দিতেন। অসুস্থতা ও দুর্বলতার সময়ও রবের ইবাদত ছাড়তেন না। আল্লাহর ইবাদত, তাঁর হুকুম পালন, তাঁর সন্তুষ্টির অনুসন্ধান, সুন্নতে নববীর অনুসরণ যেন তাঁদের রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।—সীরাতে ফাতেমা রাযি.
ইবাদত—বন্দেগীতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এর কন্যা হযরত আসমা এর সুখ্যাতি ছিল। বড় মাপের আবেদা, যাহেদা ছিলেন। অধিক ইবাদত করা তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য গ্রহণের নামায পড়াচ্ছিলেন। বহু নারী সাহাবীও সে নামাযে শরীক হয়েছিলেন। তাঁদের মাঝে হযরত আসমা রাযি.—ও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ নামায কয়েক ঘণ্টা দীর্ঘায়িত হলো। হযরত আসমা রাযি. এর শরীর কিছুটা দুর্বল ছিল, তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তবুও নামাযে একটানা দাঁড়িয়ে থাকেন। নামায শেষ হলে বেহুশ হয়ে পড়ে যান। চেহারা ও মাথায় পানি ছিটানো হলে হুশ ফিরে আসে।—সহীহ বুখারী : ১০৫৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচি হযরত উম্মুল ফযল রাযি. খুবই পরহেজগার ও ইবাদতগুজার ছিলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, তিনি সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা সবসময় রাখতেন।
হযরত খাওলা রাযি.—ও আল্লাহর ইবাদতের প্রতি যথেষ্ট আসক্ত ছিলেন। সারা রাত ইবাদত ও নামাযে কাটিয়ে দিতেন। মুসনাদে আহমাদে তার আলোচনা এসেছে। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা রাযি. এর সঙ্গে বসা ছিলেন। তখন হযরত খাওলা রাযি. সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। হযরত আয়েশা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এই যে খাওলা। সে সারা রাত ইবাদত করে কাটায়। রাতে একটুও ঘুমায় না।
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি সে রাতে একটুও ঘুমায় না? এরপর বললেন, মানুষের এ পরিমাণ আমল করা উচিত যা সে সর্বদা করতে পারে।—মুসানাদে আহমাদ : ২৫৬৩২
হযরত সফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রাযি. এর স্ত্রী একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে অভিযোগ করলেন, তার স্বামী তাকে নামায পড়ার ব্যাপারে কঠোরতা করেন। রোযা রাখলে রোযা ভাঙিয়ে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন হযরত সফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রাযি.—কে ডেকে এর কারণ জানতে চাইলেন।
হযরত সফওয়ান রাযি. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সে নামাযে বড় দুটি সূরা পড়ে। তাই তাকে বারণ করেছি। রোযা ভাঙানোর প্রকৃত ঘটনা হলো, সে নফল রোযা রাখা শুরু করলে আর বন্ধ করে না। এতে আমার কষ্ট হয়।—মুসনাদে আহমাদ : ১১৮০১
হযরত আয়েশা বিনতে তালহা একজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ। সকাল—সন্ধ্যা আল্লাহর যিকির দ্বারা তার জিহ্বা সজীব থাকত। তার অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই পবিত্র অন্তরাত্মা তাকে সকল নারীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছিল। অনেক বিষয় স্বপ্নযোগে তার জানা হয়ে যেত।
স্বপ্নের ব্যাখ্যাদাতা প্রসিদ্ধ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সিরীনের বোন হাফসা বিনতে সিরীন স্বীয় যুগের একজন বিখ্যাত নারী তাবেঈ। তার মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন তৎকালীন বিজ্ঞ আলেমগণ। হাফসা বিনতে সিরীন আত্মিক পরিশুদ্ধি, পবিত্র ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ জীবনবোধ, দ্বীনদারি ও ইবাদত—বন্দেগীর দিক থেকে যুগের শ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন। ইবাদতের জন্য তার বিশেষ কামরা ছিল। তিনি সেখানে নির্জনে ইবাদতে মগ্ন হতেন। আল্লাহর নৈকট্য ও ঊর্ধ্বজাগতিক সে উন্নত মর্যাদার আসন তিনি লাভ করেছিলেন যে পর্যন্ত শুধু বড় বড় আবেদ—যাহেদগণই পেঁৗছাতে পারেন।
মাহদী বিন মাইমুন রহ. বলেন, হাফসা বিনতে সিরীন ত্রিশ বছর তাঁর ইবাদতের কামরায় এমনভাবে কাটিয়েছেন যে দুপুরের অল্প বিশ্রাম ও মানবিক প্রয়োজন ব্যতীত সেখান থেকে বের হননি।—সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৫০৭
হযরত মুআযাহ বিনতে আব্দুল্লাহ একজন নারী তাবেঈ। হযরত আলী রাযি. ও হযরত আয়েশা রাযি. এর শিষ্য। স্বীয় যুগের বড় মাপের আবেদা ছিলেন। নিজের নফসকে সম্বোধন করে বলতেন, হে নফস, তোমার সামনে ঘুমের দীর্ঘ সময় আসছে। তুমি চাইলে কবরে তোমার আফসোস কিংবা আনন্দের দীর্ঘ ঘুম ঘুমাতে পারবে। এরপর তার ঘুম চলে যেত। তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলার ইবাদত, দুআ—মুনাজাত ও কান্নাকাটিতে মগ্ন হয়ে যেতেন।—সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৫০৯
হযরত মুআযাহ এর কাছে সকালের কোরআন তেলাওয়াত খুবই প্রিয় ছিল। তার হৃদয় আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগানে সদা মশগুল থাকত। ইবাদতকে অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। এমনকি বাসর রাতটিও তার ইবাদতে কেটে যায়। সারা রাত যিকির—আযকার করতে থাকেন। এভাবেই ফজরের আযান শুনতে পেতেন।
তার নিয়মিত আমল ছিল, প্রতিদিন ছয়শ রাকাত নামায। প্রতি রাতে কোরআন তেলাওয়াত। শীত শুরু হলে হযরত মুআযাহ রাতে পাতলা কাপড় পরিধান করতেন। যাতে ঘুমভাব দূর হয়ে যায় এবং ইবাদতে অলসতা না আসে।—আহমাদ খলীল জুমআহ রচিত নিসাউন মিন আসরিত তাবিঈন
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম আযালী রহ. বর্ণনা করেন, মক্কায় খুবই সুন্দর ও রূপসি একজন নারী ছিলেন। রূপ—সৌন্দর্য নিয়ে তার অনেক গর্ব ছিল। একবার সে উবায়েদ ইবনে উমায়ের রহ. এর কাছে একটি মাসআলা জিজ্ঞাসা করছিলেন। কথার ফাঁকে সে তার চেহারার কাপড় সরিয়ে তাঁকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করল। তখন উবায়েদ বিন উমায়ের রহ. তাকে মৃত্যু, কবর, আল্লাহর সামনে বান্দার হাজির হওয়ার বিষয়ে উপদেশ দিলেন। ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করলেন। এতে সে এতটাই প্রভাবিত হলো যে, ঘরে গিয়ে স্বামীকে বলল, আমরা দুজনই এতদিন অন্যায়—অপরাধ ও উদাসীনতায় জীবন কাটিয়েছি। এখন থেকে জীবন নতুন করে সাজাব। এরপর থেকে সে নামায, রোযা ও অন্যান্য ইবাদতে মনোযোগী হয়। তার স্বামী বলত, উবায়েদ বিন উমায়ের আমার স্ত্রীকে কী এমন সবক দিল যে, সে সদা আল্লাহর ইবাদতে পড়ে থাকে এবং দুনিয়াবিমুখ জীবনযাপন করতে শুরু করেছে।—তাম্বীহুল গাফেলীন
এ সকল ঘটনা প্রমাণ করে, নারীরা ইবাদতে কখনো পুরুষদের থেকে পিছিয়ে ছিল না। বরং নারীদের ইবাদতের আগ্রহ এবং আল্লাহ তাআলার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক এবং আল্লাহর প্রতি মহব্বত পোষণে তাঁরা অনন্য। বর্তমান যুগের নারীরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দুনিয়া—আখেরাতে চির সফল হতে পারে।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে ইবাদতের তাওফীক দান করুন। আমীন।
[দারুল উলূম দেওবন্দের মুখপত্র মাহনামা দারুল উলূম থেকে নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন, মাওলানা মাহমূদ হাসান]