নারীদের দ্বীনি শিক্ষা ও দীক্ষার গুরুত্ব
মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী
সমাজ বিনির্মাণে নারী—পুরুষ উভয়ের অবদান রয়েছে। উভয়কে আল্লাহ তাআলা স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা দিয়েছেন। তাদের নিজ নিজ কর্তব্য পালনের জন্য স্বতন্ত্র এ বৈশিষ্ট্যগুলো অনিবার্য। নারীদের দুটি বিশেষ যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে :
এক. প্রভাবিত হওয়া।
দুই. প্রভাবিত করা।
প্রভাবিত হওয়ার জন্য অনেক আবেগ থাকা প্রয়োজন। যে যত বেশি আবেগপ্রবণ সে কোনো ঘটনায় তত বেশি ও তত দ্রুত প্রভাবিত হয়। দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত তা আমাদের চোখে পড়ে। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা পিতার স্নেহের চেয়েও প্রবল। এ জন্য বাবার সামনে যে সন্তান মুখ খুলে না, নিঃসংকোচে মায়ের কাছে সুখ—দুঃখের কথা বলে। বরং পদে পদে তাঁর আদর—সোহাগ লাভের চেষ্টা করে। বাবা—মা ঘুমিয়ে আছেন। সঙ্গে ছোট বাচ্চা। রাতে হঠাৎ বাচ্চা জেগে ওঠে। কান্নাকাটি শুরু করে বা পেশাব—পায়খানা করে দেয়। তখন বাবার ঘুম ভাঙলেও পার্শ্ব পরিবর্তন করে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু মা যতই অসুস্থ বা ক্লান্ত হোক না কেন, মায়া—মমতা তাকে বিশ্রাম নিতে দেয় না। সন্তানকে পরিষ্কার করে দুধ পান করিয়ে শান্ত না করা পর্যন্ত মা স্বস্তিবোধ করতে পারেন না। এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়ের হক বাবার চেয়ে বেশি রেখেছেন।—সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৭১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬৬৪
আসলে অধিক আবেগপ্রবণতা ও খুব বেশি প্রভাবিত হওয়ার ফলেই মায়ের এ অবস্থা হয়ে থাকে।
মা তো মা—ই। তার ভালোবাসা অতুলনীয়। এ জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার মহব্বত ও ভালোবাসাকে মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়েছেন এভাবে, ‘আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা মায়ের ভালোবাসার চেয়ে সত্তর গুণ বেশি।’ স্ত্রী যে স্বামীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়, সর্বদা তার কল্যাণকামী হয় এবং নিজের সবকিছু স্বামীর জন্য উজাড় করে দেয়—এটাও নিঃসন্দেহে তার ভালোবাসার নিদর্শন। এমনইভাবে বোন ও মেয়ে নিজের ভাই ও বাবার প্রতি যে মহব্বত ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে তাও দয়া—মায়া ও সহানুভূতির উত্তম নিদর্শন। মোটকথা মা, স্ত্রী, বোন ও মেয়ে হিসেবে কর্তব্য পালনে নারীদের মাঝে ভালোবাসার মাত্রা বেশি হওয়া আবশ্যক।
যার মাঝে আবেগ বেশি থাকে তার মধ্যে সহজে প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা থাকে। পুরুষদের মধ্যেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগপ্রবণতা কমতে থাকে। তাই শিশু ও যুবকরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। এ আবেগের কারণেই সে কোনো বিষয়ে সহজেই প্রভাবিত হয় ও দ্রুত উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
মহিলাদের দ্বিতীয় স্বভাবজাত যোগ্যতা হলো, সে পুরুষ থেকে নিজের উদ্দেশ্য আদায় ও ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ উদ্ধার করতে তাকে রাজি করিয়ে ফেলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের উদ্দেশে বলেছেন,
مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ.
বিচার—বুদ্ধিতে অপরিপক্ব হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের মাঝে এ আশ্চর্য শক্তি রয়েছে যে, তোমরা দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির পুরুষদের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারো।—সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩০৪
কার্যত ঘরের সকল সিদ্ধান্তে মহিলাদের প্রভাব থাকে। এমনকি মহিলাদের প্রতি যে বাড়াবাড়ি বা নিপীড়ন হয়ে থাকে তা বিশেষত মহিলাদের কারণেই হয়ে থাকে। সংসারে মূলত বাড়াবাড়ি ও ঝগড়া—ফ্যাসাদ হয় শাশুড়ির সঙ্গে বউয়ের, বউয়ের সঙ্গে শাশুড়ির, ননদের সঙ্গে ভাবির ও ভাবির সঙ্গে ননদের। পুরুষ বেশিরভাগ তাদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মোটকথা, সংসারজীবনে নারীদের ভূমিকা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এমনকি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোতেও মহিলাদের প্রভাব লক্ষ করার মতো। যেসব দলের প্রধান মহিলা, সেসব দল তারা একক নির্দেশনা ও একনায়কতন্ত্রের মতো পরিচালনা করে। পরিচালনার ধরনও এমন যে, একটি পাতাও তার নির্দেশ ব্যতীত নড়তে পারে না। এটা তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে পুরুষদের ওপর প্রভাব বিস্তার করারই অনন্য দৃষ্টান্ত।
এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের শয়তানের রশি অভিহিত করেছেন। বলেছেন,
النساء حبالة الشيطان
আল—মাকাসিদুল হাসানাহ : ১/৪০১; কাশফুল খাফা : ১/৩৪৫
অর্থাৎ শয়তান নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে নারীদের ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ, নারীরা দ্রুত প্রভাবিত হয় ও অন্যকেও প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে এ উম্মতের জন্য সবচেয়ে ভয়ানক ফেতনা আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন,
مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِي النَّاسِ فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ.
—সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৭৮০
নারীদেরকে ফেতনা বা শয়তানের রশি তিরস্কার বা অপমানের উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। বরং তাদের সে ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করা উদ্দেশ্য যে, তারা কোনো কিছু দ্বারা দ্রুত প্রভাবিত হয় এবং অন্যকেও প্রভাবিত করে।
পশ্চিমা দেশগুলো এর স্পষ্ট উদাহরণ। সেখানে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মানুষের বংশপরিচয় বিলুপ্তির পথে। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের সংখ্যা অনেক। ব্যাপক হারে যিনা—ব্যভিচার ও যৌন অপরাধের ফলে নতুন নতুন রোগ—ব্যাধি দেখা দিচ্ছে। লজ্জা—শরমের মতো চারিত্রিক মহাসম্পদ সে সমাজ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বয়স বাড়ার পর মহিলাদের জীবন নিজের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেখানে অসংখ্য অন্যায়—অপরাধ সংগঠিত হয়। পশ্চিমারা বিজ্ঞান—প্রযুক্তিতে যতটা অগ্রসর সম্ভবত অন্যায়—অপরাধে তারচেয়ে এগিয়ে।
চিন্তা করলে দেখা যাবে, এসবের পেছনে ইহুদীদের শয়তানি দুরভিসন্ধি রয়েছে। তারা নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নারীদের ব্যবহার করে। ক্লাব, পানশালা বা অপরাধের অন্যান্য স্থানগুলোতে নারীদেরই ক্রীড়নক ও ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। এর থেকে অন্যান্য সকল অপরাধের জন্ম হয়। পশ্চিমে কিছু লোক ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই নারী স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের ঘর থেকে বের করে এনেছে। তাদের বেআব্রু করেছে। লজ্জা—শরম নামক যে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তাআলা তাদের দান করেছেন, তা থেকে তাদের রিক্তহস্ত করেছে। পয়সার বিনিময়ে তার লজ্জা—শরমকে ব্যবসা সফল করার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এরপর সমাজে যে বিশৃঙ্খলার প্রসার ঘটাতে তারা চেয়েছিল তাতে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করে।
এ জন্য নারীর দ্বীনি ও নৈতিক শিক্ষা খুবই জরুরি। যে পথে বিপর্যয় আসে সে পথেই তা রোধ করতে হবে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, মানুষ এতে খুব একটা মনোযোগ দেয়নি। ইসলামের শুরু যুগে শিক্ষা ও দাওয়াতের কাজে নারীসমাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ, সাহিত্য ও ইসলামের প্রচার—প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখত। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় এমনও পার হয়েছে, যখন কেবল রান্না করা, স্বামীর খেদমত করা ও সন্তানের লালন—পালনই মহিলাদের কাজ মনে করা হতে থাকে। কোরআনের নাযেরা এবং ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনকে তাদের জন্য যথেষ্ট মনে করা হতো। (দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হতো না।) সবচেয়ে অবিচার হলো, এসব কাজ ইসলামের নামে করা হতো।
আল্লাহর অসংখ্য শোকর যে ২৫/৩০ বছর যাবৎ মহিলা মাদরাসা চালু হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে এর শাখা—প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যে মেয়েরা সহ—শিক্ষার পরিবেশে পড়াশোনা করছে তারা দুনিয়াবি বিষয়ে যদিও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছে কিন্তু দ্বীনি বিষয়ে এতটা অনবগত যে, দেখে দেখে কোরআন পড়তেও অক্ষম এবং প্রয়োজনীয় মাসায়েলও জানে না—তাদেরও দ্বীনি শিক্ষা ও দীক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি।
এ সময় আমাদের দেশে নারীদের দ্বীনি জ্ঞানের অভাবে সমাজে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পারিবারিক সম্পর্কগুলোয় ফাটল ধরছে। নির্লজ্জতা বেড়ে চলছে। পারিবারিক সম্পর্কে অনাস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, মুসলিম মেয়েদের অমুসলিমদের সঙ্গে উঠা—বসা ও বিবাহের ঘটনা বাড়ছে। বড় শহরগুলোতে এগুলো মহামারিতে রূপ নিয়েছে। মৌলিকভাবে এর কারণ দুটি :
এক. তাদের ধমীর্য় শিক্ষা ও তদনুসারে প্রতিপালন না হওয়া।
দুই. নারীদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থার অভাব।
প্রথমটির কারণ বাবা—মা। বাবা—মার ওপর আবশ্যক হলো, সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষা—দীক্ষার ব্যবস্থা করা ও সঠিকভাবে তদারকি করা। পবিত্র জীবন ও নৈতিকতা বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে তাদের অবহিত করা। তাদের পরকালের আযাব সম্পর্কে সতর্ক করা। তাদের বোঝানো যে, গায়রে মাহরাম পুরুষের নিকটবতীর্ হওয়া তার ধ্বংসের কারণ। লম্পট ছেলেরা সহজ—সরল মেয়েদের ফুসলিয়ে নিজেদের লালসার সহজ শিকারে পরিণত করে। আর সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একটি মেয়ে সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো, যে কেউ তাকে ছিনিয়ে নিতে পারে।
গরমের ছুটি স্কুল—কলেজের মেয়েদের দ্বীনি শিক্ষা দানের একটা ভালো সুযোগ। যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গ্রীষ্মকালীন কোর্সের ব্যবস্থা করে থাকে তাদের উচিত বিশেষত হাই স্কুল ও কলেজের মেয়েদের জন্য চল্লিশ—পঞ্চাশ দিনের কোর্সের ব্যবস্থা করা। সেখানে তাদের চিন্তা—চেতনা ও চারিত্রিক দীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা জরুরি। কেননা চিন্তা ও চেতনায় পরিবর্তন আনতে না পারলে আমরা তাদের বিপথগামিতা রোধ করতে পারব না। বাবা—মার উচিত সে সময় ঘরেও মেয়েদের শিষ্টাচার শিক্ষাদানের পাশাপাশি এসব খণ্ডকালীন ক্লাস থেকে ফায়দা হাসিলের ব্যবস্থা করা।
তদ্রƒপ যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তাদের উচিত প্রাইমারির পর ছেলে—মেয়েদের আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ইনশাআল্লাহ, এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না। ছাত্র—ছাত্রীদের নীতি—নৈতিকতার দিক থেকে এটা উপকারী পদক্ষেপ হবে। প্রত্যেক মুসলমানের এ কথা মনে রাখতে হবে, মন্দের আলোচনার দ্বারা মন্দ দূর হয় না। খারাপকে দূর করার উপায় অবলম্বন করা এবং সকলে মিলে প্রয়াস চালানো জরুরি।
—মাশআলে রাহ থেকে অনুবাদ,
মাওলানা ফয়জুল্লাহ