পরচর্চা আমাদেরকে আত্ম—সংশোধনের ব্যাপারে চরম উদাসীন করে রেখেছে
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.
[পূর্বপ্রকাশের পর]
অহেতুক কাজ বর্জনের প্রতি উৎসাহ প্রদান
এমন সব কাজ যা শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরি ও উপকারী নয় তা অনর্থক ও অহেতুক আখ্যায়িত হয়। হাদীস শরীফে সেসব বর্জনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। বুযুর্গরা এ ক্ষেত্রে খুব সাধনা ও মুজাহাদা করেছেন।
জনৈক বুযুর্গের জীবনীতে আছে, তিনি কারও বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। ভেতর থেকে উত্তর এলো, তিনি নেই।
বুযুর্গ জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কোথায় গিয়েছেন?
ভেতর থেকে উত্তর এলো, জানা নেই।
তাঁর জীবনীতে লেখা হয়েছে, এই অনর্থক প্রশ্নের কারণে ত্রিশ বছর পর্যন্ত রোনাজারি করতে থাকেন যে, কেন আমি এই অহেতুক প্রশ্ন করলাম।
দেওবন্দ মাদরাসার প্রথম মুহতামিম মাওলানা রফিউদ্দিন সাহেবের পিতা মাওলানা ফরিদুদ্দিন রহ. প্রসঙ্গে শুনেছি, তিনি খুব কম কথা বলতেন। কঠিন প্রয়োজন ছাড়া অবনত দৃষ্টি ওপরে উঠাতেন না। এমনকি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখে উত্তর দিয়ে দিতেন, কিন্তু চেহারা ওপরে তুলতেন না। শুধু এ জন্য যে, বিনা প্রয়োজনে কেন দৃষ্টিশক্তি ব্যয় করব। দ্বিতীয়ত কোরআনে কারীমেরও হুকুম—
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ.
অর্থ : আপনি ঈমানদারদের বলে দিন তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।—সূরা নূর, ২৪ : ৩০
অন্যত্র ঈমানদারদের প্রশংসা করে ইরশাদ করা হয়—
الَّذِیْنَ یَمْشُوْنَ عَلَی الْاَرْضِ هَوْنًا.
অর্থাৎ তারা জমিনে বিনয়াবনত হয়ে চলে।—সূরা ফুরকান, ২৫ : ৬৩
ফেতনা থেকে আত্মরক্ষার কার্যকর উপায় হলো দৃষ্টি অবনত রাখা
ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, শয়তান মানুষকে বিপথগামী করার ক্ষেত্রে চারটি দিকের কথা উল্লেখ করেছে—
ثُمَّ لَاٰتِیَنَّهُمْ مِّنْۢ بَیْنِ اَیْدِیْهِمْ وَ مِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ اَیْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَآئِلِهِمْ.
তারপর আমি আসব তাদের নিকট সামনের দিক থেকে, পেছনের দিক থেকে, ডানদিক থেকে, বামদিক থেকে।—সূরা আরাফ, ০৭ : ১৭
চারদিকের কথা উল্লেখ করেছে, দুই দিকের কথা উল্লেখ করেনি। এর দ্বারা বোঝা যায়, এই দুই দিক তার প্ররোচনা থেকে নিরাপদ। তবে ওপর দ্বারা দিল্লির চাঁদনি চকের কুঠি উদ্দেশ্য নয়; বরং আকাশ উদ্দেশ্য। কিন্তু সদা ওপরে তাকিয়ে থাকা অত্যন্ত কঠিন তাই বাকি রয়ে গেছে কেবল নিচের দিক। বাকি চারদিক সামনে—পেছনে, ডানে—বামের অবস্থা হলো, এসব দিকে তাকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ফিতনায় আক্রান্ত হয়ে যায়। এ কারণেই কতক বুযুর্গ জঙ্গলে অবস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
শেখ সাদী রহ. বলেন, আমি এক বুযুর্গকে এক পাহাড়ের গুহায় অবস্থান করতে দেখে প্রশ্ন করলাম, আপনি এখানে নির্জনে কেন থাকেন? কখনো শহরে কেন যান না, যাতে আরামে থাকতে পারেন?
তিনি উত্তর দিলেন, শহরে সদা সুন্দর—সুন্দরীর ভিড় থাকে। এমতাবস্থায় বড় বড় দ্বীনদারদেরও সামলে থাকতে হিমশিম খেতে হয়। যেমন বেশি কাদা পানিতে হাতিকে হিমশিম খেতে হয়।
যাই হোক, এমনটা যেহেতু ঘটে থাকে তাই তার চিকিৎসা এটাই যে, এই চারদিকে দেখা একেবারে কমিয়ে দেবে। আর ওপরে তাকিয়ে চলাফেরায় যেহেতু পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে যেমনটা পূর্বে আলোচনা হয়েছে। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে চলাটাই নিরাপদ সুতরাং অভিজ্ঞতা, কোরআনে কারীমের আয়াত ও বুযুর্গদের ঘটনাবলির আলোকে পরিষ্কার হয়ে গেল—নিরাপদে ও হেফাজতে থাকার দিক নিচের দিক। বুযুর্গরা যখন অনর্থক বিষয় থেকে এতটা আত্মরক্ষা করেছেন আর হাদীসে এসেছে—
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ
অর্থ : ব্যক্তির মুসলমানিত্বের কিছু সৌন্দর্য হলো অহেতুক বিষয় বর্জন করা।
তাই দোষক্রটি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বিনা প্রয়োজনের শর্ত যোগ করেছি (প্রয়োজনে দায়িত্বশীলদের অনুসন্ধানের অধিকার আছে)। অন্যের দোষ—ত্রুটি অনুসন্ধান যদি গোনাহের কাজ নাও হতো তবুও অনর্থক অবশ্যই হতো, আর তা থেকেও আত্মরক্ষা অপরিহার্য।
অহেতুক ও অনর্থক বিষয়ে লিপ্ততার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ও তার ক্ষতি
অনর্থক বিষয়ে লিপ্ত হওয়া যখন গোনাহও, তখন তা থেকে আত্মরক্ষাও অপরিহার্য। কতক নির্বোধের অভ্যাস হলো তারা পুরো সময়টাই অহেতুক কাজে বরবাদ করে। যেমন, অনেক মানুষ প্রশ্ন করে থাকে—জনাব, আমীরে মুয়াবিয়া রাযি. প্রসঙ্গে আপনার তাহকীক ও মূল্যায়ন কী? কোনো বিবেকবান তাকে পাল্টা প্রশ্ন করুক, হযরত মুয়াবিয়া রাযি.—এর বিষয় নিয়ে তোমার মাথাব্যথা কীসের? তুমি নিজের চিন্তা করো।
মাওলানা মুহাম্মদ নাঈম ফিরিঙ্গি মহল্লী সাহেবের কাছে এক ইংরেজ এসে বলতে লাগল, হযরত মুয়াবিয়া প্রসঙ্গে কোনো মামলা এলে তা প্রত্যাখ্যান করবেন আর বলে দেবেন, আমি এ ব্যাপারে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, কিন্তু এ প্রসঙ্গে কেউ আমায় কিছু বলেনি। আরেক ভদ্র লোক জনৈক মাওলানা সাহেবের কাছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পিতা—মাতা ঈমানদার কি না, এ প্রশ্ন নিয়ে হাজির। মাওলানা সাহেব ভদ্র লোককে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, নামাযের ফরজ কয়টি আপনার কি তা জানা আছে?
ভদ্র লোক : জি না।
মাওলানা সাহেব : হায় হায়, বলেন কি! যেই নামাযের হিসাব—কিতাব কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হবে এবং যার ফরজগুলো দৈনিক পাঁচবার প্রয়োজন হয়, যা আদায় না হয়ে থাকলে নামাযই সহীহ না হওয়ার আশঙ্কা আছে, আপনার সেসবের খবর নেই। অথচ আপনি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পিতা—মাতার ঈমান থাকা না থাকা নিয়ে ব্যস্ত—যার ব্যাপারে নিঃসন্দেহে না কেয়ামতের দিন প্রশ্ন হবে আর না দুনিয়াবি কোনো কাজ এর ওপর নির্ভরশীল যে, আপনি তা নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
সুধীবৃন্দ, কেউ খারাপ হলে আপনার তাতে কী আসে যায় আর ভালো হলেই—বা আপনার কী লাভ। আপনার তো নিজের ভালো—মন্দের চিন্তা করা উচিত। বাকি প্রত্যেকের খোঁজ—খবর রাখা কিংবা খেয়াল রাখা এটা আল্লাহ পাকের দায়িত্ব, কিংবা যার কাঁধে আল্লাহ পাক মানুষের সংশোধনের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। কেননা জানা ছাড়া কারও অবস্থা সংশোধন করা সম্ভবই নয়। আর এ কারণেই আমি বিনা প্রয়োজনের শর্ত আরোপ করেছিলাম। কেননা শাসক ও বিচারক অবস্থা ভালো করে যাচাই না করলে অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারবেন না। কিন্তু তাদেরও এমন সব মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত ও অনুসন্ধানের অনুমোদন আছে যেসব ক্ষেত্রে তদন্ত না হলে ফাসাদ—বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে এ ধরনের আশঙ্কা নেই সেসব ক্ষেত্রে শাসকেরও তদন্ত ও অনুসন্ধানের অনুমোদন নেই।
হযরত উমর রাযি.—এর ঘটনা মানবেতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা
হযরত উমর রাযি. এক রাতে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। হঠাৎ এক ঘর থেকে গানের শব্দ পেলেন। তিনি বাড়ির গেইট খোলানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তারা নাচ—গানে এতটাই মত্ত ছিল যে, তাঁর আওয়াজই শুনতে পায়নি। অবশেষে তিনি বাড়ির পেছন দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। হযরত উমর রাযি.—কে দেখে সকলে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু যেহেতু জানতেন যে, হযরত উমর সত্যভাষণে কিছুতেই ক্ষুব্ধ হবেন না তাই একজন সাহস করে নিবেদন করল, আমীরুল মুমিনীন, আমরা তো কেবল একটা গোনাহ করেছি কিন্তু আপনার তিনটি গোনাহ হয়ে গেছে :
এক. আপনি বিনা অনুমতিতে আমাদের ঘরে প্রবেশ করেছেন অথচ কোরআন শরীফে পরিষ্কার বলা হয়েছে—
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ بُیُوْتِكُمْ حَتّٰی تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَهْلِهَا
অর্থাৎ অনুমতি গ্রহণ ও সালাম প্রদানের পূর্বে অন্যের ঘরে প্রবেশ করো না।—সূরা নূর, ২৪ : ২৭
দুই. আপনি বিনা প্রয়োজনে তদন্ত ও অনুসন্ধান করছেন অথচ কোরআনে কারীমে বলা হয়েছে,
وَلَا تَجَسَّسُوْا
অর্থাৎ তোমরা বিনা প্রয়োজনে তদন্ত—অনুসন্ধান করতে যেয়ো না।—সূরা হুজুরাত, ৪৯ : ১২
তিন. আপনি বাড়ির পেছন দিয়ে প্রবেশ করেছেন অথচ কোরআন শরীফে বলা হয়েছে,
وَلَیْسَ الْبِرُّ بِاَنْ تَاْتُوا الْبُیُوْتَ مِنْ ظُهُوْرِهَا.
অর্থাৎ পেছন দিয়ে গৃহে প্রবেশ করা কোনো ভালো কাজ নয়।—সূরা বাক্বারা, ০২ : ১৮৯
তার কথা শুনে হযরত উমর রাযি. বলেন, আমি নিজের গোনাহ থেকে তওবা করছি, তোমরাও নিজ নিজ গোনাহ থেকে তওবা করো।
যাদের মুখে বাকস্বাধীনতার খই ফুটে তারা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করুক। বাকস্বাধীনতা তাদের মধ্যে ছিল, না এ কালের বাকস্বাধীনতার দাবিদারদের মধ্যে আছে? নামায—রোযার খবর নেই, পশুর মতো দুই বেলা পেট পুরে খেয়ে প্রবৃত্তির খেয়াল—খুশি মোতাবেক জীবন পার করে দেওয়ার নাম বুঝি স্বাধীনতা?
সুধীবৃন্দ, এসব স্বাধীনতা নয়; বরং প্রবৃত্তির শয়তানি ও স্বেচ্ছাচারিতা, কামনা—বাসনার দাসত্ব ও গোলামি। এ স্বাধীনতা ছাড়া—গরুর স্বাধীনতার মতো। যা খেতে ইচ্ছা মুখ দিয়ে দেয়, যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে চলতে শুরু করে, যা ইচ্ছা তা করে ফেলে। তো স্বাধীনতার ধ্বজাধারীরা কি ছাড়া—গরু পছন্দ করেন? এর উত্তর যদি হয় হ্যাঁ, তাহলে আজ থেকে আমাদের পক্ষ থেকে এই উপাধি কবুল করে নিন ,আর উত্তর যদি হয় ‘না’ তাহলে একটু কষ্ট করে আপনার আর ছাড়া—গরুর মধ্যকার কোনো পার্থক্য থাকলে বলে দিন।
তদ্রূপ যদি কেউ আতালিক (যিনি শিশুদের শিক্ষাদীক্ষার কাজ করেন) কিংবা তত্ত্বাবধায়ক হন, তাহলে তারও হাল—অবস্থার তদন্ত ও অনুসন্ধান করা জরুরি। কেননা তার দায়িত্ব হলো তাদের সংশোধন করা। কিংবা কেউ জাতির সংশোধনের দায়িত্বশীল তাহলে সমষ্টিগতভাবে পুরো জাতির হাল—অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি। নতুবা ওয়াজ—নসীহত কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু তারও এ কাজ করার অনুমোদন ততক্ষণ থাকবে যতক্ষণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হবে ইসলাহ ও সংশোধন। যদি কাউকে তাচ্ছিল্যের জন্য এ কাজ করে তাহলে তার আর এ কাজ করার অনুমোদন থাকবে না। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে,
إنما الأعمال بالنيات.
মানুষের আমলের ফলাফল তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।
উল্লিখিত কয়েক শ্রেণির মানুষ ছাড়া বাকিরা ভেবে দেখুন অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণে আপনাদের উদ্দেশ্য কী?
গীবতের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আর এহেন কাজ ব্যক্তির নাকেছ ও অপরিপক্ব হওয়ার দলিল
ওই ব্যক্তির দোষত্রুটি দূর হয়ে যাক এই উদ্দেশ্য নাকি তাকে নিছক বদনাম করা উদ্দেশ্য? যদি প্রথমটা উদ্দেশ্য হয় তাহলে কেন কখনো এর আলামত পাওয়া যায় না। কখনো কেউ কোনো দোষী ব্যক্তিকে মমতার সঙ্গে তার দোষত্রুটি অবগত করেছেন? আর যদি না করে থাকে তাহলে কি শুধু দু—চারজন মানুষের মধ্যে কারও দোষত্রুটির কথা আলোচনা করে দিলেই কি তা ইসলাহ ও সংশোধন বলে অভিহিত হবে? কিছুতেই না। কিন্তু আমাদের মজলিসে দিন—রাত মানুষের গীবত—শেকায়ত চলতে থাকে। এর দ্বারা একজনকে বদনাম করা ছাড়া আর কোনো লাভ হয় না। তো এ সকল লোক একে তো গীবতের গোনাহে আক্রান্ত, দ্বিতীয়ত একটা অনর্থক কাজ করছে যার কদর্যতা ওপরে আলোচিত হয়েছে।
হযরত রাবেয়া বসরী রহ.—এর জীবনীতে আছে, তিনি শয়তানকেও গালমন্দ করতেন না, আর বলতেন, যতক্ষণ এই অনর্থক কাজে ব্যয় হবে ততক্ষণ যদি প্রিয়তমের যিকিরে লিপ্ত থাকা যায় তাহলে কত ফায়দা হবে।
শেখ সাদী রহ. হযরত হাকীম বাহলূল রহ.—এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি এক দরবেশের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যে অন্যদের সঙ্গে ঝগড়া—বিবাদ করছিল। তখন তিনি মন্তব্য করেন, এই কথিত দরবেশ যদি প্রিয়তমের পরিচয় পেয়ে যেত তাহলে শত্রুদের সঙ্গে ঝগড়া—বিবাদে লিপ্ত হতো না।
দেখুন, কেউ যদি তার প্রিয়তমের সান্নিধ্যে প্রেমালাপে মগ্ন থাকে এমতাবস্থায় একজন ওই প্রেমিকের মাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেয় তাহলে কি প্রেমিক প্রিয়তমাকে বাদ দিয়ে প্রতিশোধ নিতে শত্রুর সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে? যদি সে এমনটা করে তাহলে বলা হবে তার প্রেম দুর্বল ও নাকেছ। তদ্রূপ সমঝদার মানুষজন এ ধরনের পরিস্থিতিতে টের পেয়ে যায়, শয়তান যে আমাদের ঘোরতম শত্রু, সে এই লোককে হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছে, যাতে তাকে অন্যদিকে ব্যস্ত করে বিপথগামী করতে পারে। তাই সে এর পরোয়াই করে না। প্রিয়তমের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রেমে যত কমতি হয় তাতে (মনোযোগেও) তত ঘাটতি হয়।
তিন বুযুর্গের ঘটনা
জনৈক ব্যক্তি এক বুযুর্গকে জিজ্ঞেস করল, বুযুর্গদের শান নাকি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে? তা কীভাবে হয় একটু বুঝিয়ে বলবেন কি? তিনি উত্তরে বললেন, অমুক মসজিদে গিয়ে দেখো, তিনজন বুযুর্গ বসে আছেন। তাদের কাছে যাও। তাহলে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে কীভাবে বুযুর্গদের শান বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কথামতো ওই লোক সেখানে গিয়ে দেখতে পেল, এক বেয়াদব এসে ওই বুযুর্গদের মধ্য থেকে প্রথমজনের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল। প্রতিউত্তরে তিনিও উঠে ঠিক ততটাই জোরে একটা কিল তার পিঠে বসিয়ে দিলেন। তারপর পুনরায় নিজের যিকিরে মশগুল হয়ে পড়লেন। এরপর সে দ্বিতীয় বুযুর্গের কাছে গিয়ে তার পিঠেও একটা কিল বসিয়ে দিল। তিনি তার দিকে ফিরেও তাকালেন না; বরং নিজের কাজেই নিমগ্ন রইলেন। তারপর সে তৃতীয়জনের কাছে গিয়ে তার পিঠেও একটা কিল বসিয়ে দিল। বুযুর্গ তৎক্ষণাৎ তার হাত নিজের হাতে নিয়ে তা দাবিয়ে দিতে শুরু করলেন আর বলতে লাগলেন, ভাই হাতে ব্যথা পাননি তো?
সে এখানে এই তামাশা দেখে ওই বুযুর্গের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে বুযুর্গ মন্তব্য করলেন, ব্যস এটুকুই পার্থক্য এই তিনজনের হালতে। আর তাদের মধ্যেও দেখলে দেখতে পাবেন যিনি ধৈর্যশীল ছিলেন না তিনি বদলা না নিয়ে থাকতে পারেননি। তিনিও সামান্যতম অনর্থক কাজ করেননি। অর্থাৎ আঘাতকারীকে এই প্রশ্নটুকু পর্যন্ত করলেন না কেন তুমি এহেন কাজ করলে বরংوَجَزٰٓؤُا سَیِّئَۃٍ سَیِّئَۃٌ مِّثْلُهَا মন্দের বদলা তার সমপরিমাণ মন্দ—এই নীতির ওপর আমল করে নিজেও তার পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে আপন কাজে মগ্ন হয়ে গিয়েছেন।
আজকাল লোকজন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়
এ কালের অবস্থা হলো এই—ছোটখাটো কিংবা হালকা কিছু বললেও দেখবেন তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়। একজন আরেকজনের পেছনে লেগে যায়।
আমার এক বন্ধু মাওলানা ইসহাক সাহেব বলেন, আমি একবার পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সম্মুখ থেকে একজনকে আসতে দেখে মনে হলো, তিনি আমার পরিচিতজনদের কেউ হবেন। এই খেয়াল করে আমি অত্যন্ত উষ্ণভাবে তাকে সালাম দিলাম। কাছে এলে দেখা গেল, আমার ধারণা ভুল। তিনি অন্য কেউ। নিজে থেকে ধোঁকায় পড়ে যাওয়ায় আমার মুখ থেকে অজান্তেই লা—হাওলা বেরিয়ে গেল। ব্যস, ওই লোক আমার সঙ্গে এ নিয়ে লেগে গেল যে, তুমি আমাকে শয়তান মনে করে লা—হাওলা পড়েছ। এখন আমি তাকে যতই বোঝাই আর যতই খোশামোদ করি সে মানতেই চায় না। অনেক দূর পর্যন্ত তার পেছনে পেছনে গেলাম। অবশেষে সম্ভবত তার দৃষ্টি এড়িয়ে কোনো গলিতে ঢুকে গিয়ে তখনকার মতো আত্মরক্ষা করি।
মোটকথা এই হলো আমাদের দ্বীনদার লোকদের হালত। অথচ আগেকার লোকজন এতটাই সতর্ক থাকতেন যে, তারা অনর্থক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতেন। অন্যের দোষ তালাশের আরেকটি ক্ষতি হলো, যার দোষ চর্চা করা হয় এসব তার নিকট পৌঁছবে না এটা সম্ভব নয়। খবর পৌঁছার পর এটা অসম্ভব যে সে পাল্টা সমালোচনা করবে না, আর এটাও অসম্ভব নয় যে তার সমালোচনা তোমার কানে পৌঁছবে না। এই সমালোচনা ও প্রতি—সমালোচনার বিষফল এই হয়—পরস্পরে শত্রুতা ও দুশমনি শুরু হয়ে যায়। তারপর এই শত্রুতা প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকে। অথচ এর ভিত্তি সামান্য একটা কথা, যা একজন বলে ফেলেছিল। অথচ এই বলে ফেলাতেই বা কী হয়েছিল। বিরাট কোনো মানহানি হয়ে গিয়েছিল?
জনৈক বুযুর্গের সহনশীলতার ঘটনা
জনৈক বুযুর্গের ঘটনা। তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। সঙ্গে কয়েকজন মুরিদও ছিল। পথিমধ্যে এক লোক তাঁকে লক্ষ্য করে বলল, এ তো বড় ধান্ধাবাজ। এ কথা শুনে এক মুরিদের খুব রাগ উঠল। সে তাকে মারতে উদ্যত হলো। পীর সাহেব তাকে নিরস্ত করে নিজ বাড়িতে নিয়ে এলেন। তাঁর নামে আসা অনেকগুলো চিঠিপত্র মুরিদের সামনে রেখে দিলেন। যেসবে বড় বড় লকব ও উপাধি এবং সম্মানসূচক শব্দমালা লেখা ছিল। কোনোটায় কেবলায়ে কাউনাইন—উভয় জগতের কেবলা, কা’বায়ে দারাইন—উভয় জাহানের কা’বা, কোনোটায় রাহনুমায়ে জাহান—জগতের পথপ্রদর্শক ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব চিঠিপত্র দেখিয়ে মন্তব্য করলেন, ভাই, আমি এতটা খারাপ নই যতটা এ ব্যক্তির কথা থেকে প্রকাশ পেয়েছে। আর এতটা ভালো নই যতটা এই লোকেরা লিখেছে। সুতরাং অবাস্তব কথা বলার কারণে যদি এই লোকের ওপর রাগ উঠে থাকে তাহলে একই কারণে ওই লোকদের ওপরও তো রাগ উঠা উচিত। তাদের মুখও বন্ধ করা উচিত যারা আমাকে যুগের জুনাইদ বাগদাদী ও জামানার ফরীদুদ্দীন আত্তার লিখে থাকে।
হযরত মাওলানা আহমদ আলী রহ.—এর সহনশীলতা
এক লোক এসে মাওলানা আহমদ আলী মুহাদ্দিসে সাহারানপুরী রহ.—কে গালমন্দ করা শুরু করল। মাওলানা সাহেব যেহেতু খুব উঁচু মরতবার লোক ছিলেন তাই তার ছাত্ররা খুব ক্ষুব্ধ হলো। ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মারতে উদ্যত হলো। মাওলানা সাহেব তাদের লক্ষ্য করে বললেন, ভাই সব কথা তো আর মিথ্যা বলছে না, কিছু তো সত্যও আছে, সেগুলোই দেখো।
ইমাম আবু হানীফা রহ.—এর সহনশীলতা
জনৈক ব্যক্তি ইমাম আবু হানীফা রহ.—এর গীবত করল। জানতে পেরে তিনি তার জন্য হাদিয়া পাঠালেন। ইমাম সাহেবের জীবনীতে আছে, তিনি কখনো কারও গীবত করতেন না। তিনি বলতেন, যদি আমি কারও গীবত করি তাহলে আমার মায়ের গীবত করাটাই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত। যাতে আমার নেকীগুলো আমার মায়ের কাছেই থাকে, অন্যের কাছে না যায়।
হযরত ইমাম সুফীয়ান সাওরী রহ. বলতেন, ইমাম আবু হানীফা বড় বুদ্ধিমান। কারণ, আমাদের নেকীসমূহ নিয়ে নেন (অর্থাৎ যেহেতু আমরা তার ব্যাপারে কখনো কখনো এটা—সেটা বলে ফেলি আর তিনি কখনো কোনো নেকী দেন না অর্থাৎ তিনি কখনো কারও গীবত করেন না।)
সুধীবৃন্দ, একটু গভীরভাবে ভাবুন তো কোথায় আমাদের মহান পূর্বসূরিগণ? কেমন উন্নত ছিল তাদের হালত? আর কোথায় আমাদের মতো অধম উত্তরসূরি আর কী দশাই—বা আমাদের স্বভাব—চরিত্রের? শেখ সাদী রহ. বড় চমৎকার বলেছেন, আমি তো শুনেছি আল্লাহওয়ালাগণ নাকি শত্রুর মনেও আঘাত দেন না। তো হে ভাই, আপনজনদের সঙ্গে ঝগড়ায় মেতে থেকে কীভাবে তুমি ওই মর্যাদা লাভের আশা করো?
অনৈক্যের গোড়া হলো জবানের লাগামহীনতা
আজকাল বড় জোরে—শোরে এই চেষ্টা শুরু হয়েছে যে, আমাদের মাঝে যেন কোনো অনৈক্য না থাকে। এ জন্য আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়, পেপার—পত্রিকায় প্রবন্ধ ছাপা হয়, সভা—সেমিনারের আয়োজন করা হয়। কিন্তু অনৈক্যের গোড়া তথা জবানকে কাটার ফিকির আজ পর্যন্ত হয়নি।
সুধীবৃন্দ, আমি সত্যি করে বলছি, অনৈক্যের বড় কারণ হলো আমাদের জবান। যাতে কোনো লাগামই নেই। যা ইচ্ছা বকতে থাক, যাকে ইচ্ছা বলতে থাকে। এই জালেম এতটাই চলতে থাকে যে, এর কোনো সীমা—সরহদ নেই। তদুপরি গজবের কথা হলো এই বেহায়ার ক্লান্তিও নেই। অন্যান্য অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ যেমন, মাথা, চোখ, কান, হাত, পা এগুলো দ্বারা যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ নেওয়া হয় তাহলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু জবানের কখনো ক্লান্তির নামই নেই। তাই হাদীস শরীফে আছে, যখন সকাল হয় তখন সমস্ত অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ জবানকে দোহাই দিয়ে বলে, তুমি ঠিক থেকো। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকতে পারব। আর তুমি বিগড়ে গেলে আমরাও বিগড়ে যেতে বাধ্য হব।
সব শ্রেণির মধ্যেই গীবত—রোগের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে
মোটকথা দোষচর্চা ও দোষ তালাশের রোগ আমাদের মধ্যে ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যাদের আল্লাহ পাক দু—চার পয়সা দান করেছেন তারা এতে বিশেষভাবে আক্রান্ত। কেননা উপার্জনের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার দরুন তাদের তো আর কোনো কাজ নেই, আর যা আসল কাজ ছিল তথা আল্লাহর যিকির, তা তো আর করে না। তাই দিন—রাত চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণ করার এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেউ—কেটাদের সমাগম হবে আর তাতে সারা দুনিয়ার হাবি—জাবি উগড়ে দেওয়া হবে। এমনকি কতক দ্বীনদারও যাদের কিছুটা অবসর রয়েছে তারাও এতে আক্রান্ত। আর যারা একেবারে বে—ফিকির, নির্ভার ও নিশ্চিন্ত, তারা আম মানুষজনের চেয়ে আরও বেশি আক্রান্ত। কেননা তারা বেশিরভাগ দাবা—তাশ খেলায় মগ্ন থেকে এর থেকে রেহাই পেয়ে যায়। পক্ষান্তরে দ্বীনদার লোকজন এসবকে নিজের শানের খেলাফ মনে করে। তাই বেশিরভাগ সময় তাদের জলসাবাজি, বক্তৃতাবাজি ও সমালোচনাবাজি ছাড়া কাজই জোটে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি গীবত থেকে আত্মরক্ষার জন্য দাবা—তাশ ইত্যাদির অনুমতি দিচ্ছি, কিছুতেই না। এ দুইয়ের অবস্থা পেশাব—পায়খানার মতো। না পায়খানা পেশাবের চেয়ে বেশি খারাপ, না পেশাব পায়খানার চেয়ে বেশি খারাপ। দ্বিতীয়ত দাবা ইত্যাদিতে মানুষ এতটা নিমগ্ন হয়ে যায় যে, এর ফলে দ্বীন—দুনিয়ার সবকিছু থেকে বেখবর হয়ে যায়।
এক দাবাড়–র ঘটনা
আমি আমার উস্তাদের মুখে শুনেছি, এক লোক দাবা খেলছিল। এদিকে তার ছেলে ঘরে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে ছিল। খেলার মাঝখানে এসে একজন খবর দিল, ছেলের অবস্থা খুব খারাপ।
সে উত্তর দিল, এই তো আসছি। এই বলে পুনরায় খেলায় মগ্ন হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে বলল, ছেলের তো মরণাপন্ন অবস্থা।
সে বলল, এই তো আসছি। এই বলে সে পুনরায় খেলায় মগ্ন হয়ে গেল।
এরপর কেউ এসে খবর দিল, ছেলের তো ইন্তেকাল হয়ে গেছে।
সে উত্তর দিল, আচ্ছা আসছি।
ধারাবাহিক এই প্রশ্নোত্তর সবই হলো কিন্তু তার ওঠার তাওফীক হলো না। যখন দাবার আসর খতম হলো তখন তার চোখ খুলল এবং হুঁশ ফিরল। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। বলুন দেখি, যে খেলার পরিণাম এহেন সে খেলার অনুমোদন কীভাবে দেওয়া যেতে পারে? তো অনুমোদন প্রদান উদ্দেশ্য নয়; বরং শুধু এটুকু বলা উদ্দেশ্য যে, আমজনতা সরাসরি গোনাহে লিপ্ত থেকে কখনো কখনো গীবতের গোনাহ থেকে বেঁচে যায়, কিন্তু এহেন দ্বীনদারীর দাবিদাররা জাহেরী দ্বীনদারীর আড়ালে আরও বড় গোনাহে আক্রান্ত। সুতরাং এই সূত্রে আমাদের অবস্থা অনেকটা কাফেরের কবরের মতো। যার বাহ্যিক অবস্থা খুবই শানদার অথচ এর ভেতরে আল্লাহ তাআলার গজবের ভান্ডার। কিংবা যেমন কেউ ইয়াযিদের সমালোচনা করে অথচ তার ভেতরের অবস্থা এতটাই কদর্য, যা শুনলে ইয়াযিদও শরমে মুখ ঢেকে ফেলে। আজকাল আমরা কেবল দ্বীনের বেশ—ভূষা ধারণ করাটাকেই দ্বীনদারী নাম দিয়ে রেখেছি। বাকি অন্যান্য আমল—আখলাক যেমনই হোক না কেন (তাতে কিছু যায় আসে না)। আমজনতার অবস্থা এই দৃষ্টিকোণ থেকে আরও বেশি আফসোসজনক। কারণ, তাদের বাহ্যিক অবস্থাই ঠিক নয়।
কেবল বাহ্যিক অবস্থার সংশোধনও অর্থহীন নয়
আর মনে রাখবেন, বাহ্যিক সংশোধনটাও অর্থহীন নয়, এরও অন্তরের ওপর বিরাট প্রভাব পড়ে। হযরত মূসা আ. যখন ফেরাউনের যাদুকরদের সঙ্গে মোকাবিলায় অবতীর্ণ হলেন, মোকাবিলার পর যাদুকররা মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফেরাউন মুসলমান হয়নি। হযরত মূসা আ. আল্লাহ তাআলার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন।
উত্তর এলো, হে মূসা, ফেরাউনের যাদুকররা তখন তোমার লেবাস পরে এসেছিল। আমার রহমতের নজরে এটি বরদাশত হয়নি যে, তোমার মতো লেবাস—পোশাক ধারণ করে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তাই আমি তাদের ঈমান গ্রহণের তাওফীক দিয়ে দিয়েছি। আর ফেরাউন বঞ্চিত রয়ে গেছে।
সারকথা দাঁড়ালো, বাহ্যিক সংশোধনটাও ভালো জিনিস, তবে নিছক এর সংশোধনটাকে যথেষ্ট মনে না করা উচিত; বরং এর পাশাপাশি অন্তরকে সুন্দর ও সংশোধন করার চেষ্টায় লেগে থাকা কর্তব্য।
দ্বীনদার অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের গীবত শোনা বর্জন করা উচিত
যারা অনুসরণীয় তাদের বেশি চিন্তা করা উচিত। কেননা অ—অনুসরণীয় ব্যক্তিদের গীবত শোনার সুযোগ কম হয়, কিন্তু অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে যেহেতু মানুষের ভিড় লেগে থাকে, তাই তাদের গীবত শোনার পালায় পড়তে হয় বেশি। শত শত মানুষ তাদের কাছে আসে আর প্রত্যেকেই তাঁদের কাছে উপহার নিয়ে আসে। তাঁরা এই উপহার কবুল করেন। হ্যাঁ, যারা বুদ্ধিমান তারা এ ধরনের মানুষেরও চিকিৎসা করেন। হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.—এর কাছে এক লোক এসে বলতে লাগল, অমুকে আপনাকে এমন কথা বলে। হযরত বললেন, ও তো পেছনে বলেছে, অথচ তুমি তার চেয়ে এক ধাপ বেশি নির্লজ্জ হয়ে আমার সম্মুখে বলছ।
হযরত মীর দর্দ দেহলভী রহ.—এর গান শোনায় কিছুটা আসক্তি ছিল। তার ব্যাপারে এক লোক এসে হযরত মির্যা মাযহার জানেজানাঁ রহ.—এর নিকট অভিযোগ করল, হযরত মীর দর্দ গান শোনে।
উত্তরে তিনি বললেন, ভাই, কেউ কানের রোগী আর কেউ চোখের রোগী।
মির্যা সাহেবের এই বক্তব্য থেকে অনেক জাহেল এ কথা বুঝে নিয়েছে যে, মির্যা সাহেব সূক্ষ্ম রুচিবোধের কারণে বিশ্রী মানুষদের দেখতে পারতেন না। (আসলে এটা তার ঐচ্ছিক বিষয় ছিল না।) কেননা মির্যা সাহেবের শৈশবের ঘটনাবলি থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ মির্যা সাহেবের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি কোনো বিশ্রী লোকের কোলে যেতেন না। অথচ তখন তিনি সুশ্রী ও বিশ্রী বুঝতেনই না, কিন্তু রুহ নাযুক ও সংবেদনশীল হওয়ার কারণে তাঁর তখনও কষ্ট হতো এর প্রভাব বড় হওয়ার পরও ছিল। মোটকথা এই মহামানবগণ এ ধরনের লোকদের মুখ তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেন আর যারা সতর্কতা অবলম্বন করে না তারা এ ধরনের দর্শনার্থীদের কারণে অধিকাংশ সময় গোনাহে আক্রান্ত হয়ে যান। অথচ তাদের বোঝা উচিত, যে ব্যক্তি তার সম্মুখে অন্যদের দোষচর্চা করে সে তার দোষের কথাও অন্যদের কাছে অবশ্যই বলে বেড়াবে। তাই আমি বলছিলাম তাকওয়া ও সতর্কতাহীন অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ এই আপদে আরও বেশি আক্রান্ত। এই হলো সেই রোগ। اَتَاْمُرُوْنَ النَّاسَ আয়াত দ্বারা নিজের দোষত্রুটির প্রতি নজর রাখার প্রমাণ এখন আমি পেশ করব। কিন্তু এ বিষয়টির পূর্বে যে বিষয়গুলো বোঝা দরকার সেগুলো আগে আলোচনা করব, তারপর তা বুঝে আসবে।
নিজে আমল করুক বা না করুক অন্যকে নেক কাজের কথা বলাটাও নেক কাজ
আরেকটি বিষয় হলো নেক আমলের কথা বলা সর্বদাই নেক কাজ; তদনুযায়ী আমল হোক বা না হোক। এটাই সেই ভুল যা এই আয়াতের ভুল উদ্দেশ্য বোঝার ক্ষেত্রে আলেমদের হয়েছে। এর ফলে তাদের কেউ কেউ ওয়াজ—নসীহত একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। যখন তাদের নিকট এর কারণ জিজ্ঞেস করা হয় তখন তারা জবাবে কোরআনে কারীমের এই আয়াত পেশ করে—
اَتَاْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ اَنْفُسَكُمْ وَاَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْکِتٰبَ
তোমরা কি লোকদের নেক কাজের হুকুম করো আর নিজেদের কথা ভুলে যাও। অথচ তোমরা আল্লাহর কিতাব পড়।
এই জবাবের পর নিজেদের একেবারে দায়মুক্ত মনে করে বসে থাকে। কিন্তু এটা একটা ধোঁকা। লোকজন এ কথা মনে করে নিয়েছে যে, কোরআনের উদ্দেশ্য হলো যদি নিজে আমল না করো তাহলে অন্যকে নসীহত করতে পারবে না। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়; বরং অন্যকে নসীহত করা নেক কাজ আর এই নেক কাজের শর্তাবলির মধ্যে কোথাও এ কথা উল্লেখ নেই যে, যদি নিজে আমল করে তাহলে তা নেক কাজ হবে, অন্যথায় নয়। হ্যাঁ, নিজে আমল না করা আলাদা গোনাহ যা অবশ্য পরিত্যাজ্য। তবে নসীহত করতে হলে আমল করতে হবে, অন্যথায় নসীহত হবে না, এ ধরনের কোনো শর্ত নেই। আর এ কথা কোনো হাদীস কিংবা কোনো ইমামের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত নয় যে, কেউ যদি গোনাহ থেকে পরহেজ না করে তাহলে তার অন্যান্য নেক কাজ নেক কাজ বলে গণ্য হবে না। যদি তা মেনে নেওয়া হয় তাহলে এই আয়াতের কী অর্থ দাঁড়াবে?
اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ
অর্থ : নিশ্চয়ই নেক আমলসমূহ পাপরাশি মিটিয়ে দেয়।—সূরা হুদ, ১১ : ১১৪
কেননা এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায় এর দ্বারা ওই লোক উদ্দেশ্য যে নেক কাজও করে কিন্তু গোনাহেও আক্রান্ত। যদি গোনাহ করাটা অন্য নেক আমল অস্তিত্বের ব্যাপারে অন্তরায় হতো তাহলে এর কাফফারা—ক্ষতিপূরণের কোনো পথ থাকত না। আর এটা এ আয়াতের বিষয়বস্তুর সঙ্গে একেবারে সাংঘর্ষিক। অবশ্য কেউ যদি এমন গোনাহ করে যার দ্বারা নেক কাজ নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই নেক কাজ আর নেকী হিসেবে থাকবে না। আর ওই গোনাহ যদি এমন না হয় তাহলে নেকী বহাল থাকবে, যদিও খারাপ কাজ করার কারণে গোনাহও হবে। এ ক্ষেত্রে এটুকু প্রভাব অবশ্যই পড়বে যে, গোনাহের কারণে নেক কাজের বরকত কমে যাবে, তো এটা একটা স্বতন্ত্র মাসআলা—যা অন্য সময় স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করব। (হযরত বলেন, ভালো হয় যদি আমাকে এ প্রসঙ্গটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। কেননা এই মাসআলা না জানা থাকার কারণে কতক লোক গোনাহ করার ব্যাপারে একেবারেই বে—পরোয়া হয়ে গেছে। কারণ, তারা মনে করে গোনাহের দ্বারা কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ বাস্তবতা হলো এতে নেক কাজের বরকত কমে যায়।)
গোনাহ করা সত্ত্বেও নেকী আপন অবস্থায় থাকবে, তবে হ্যাঁ বরকত কমে যায়
তবে এখনকার আলোচ্য বিষয় হলো, গোনাহের কারণে নেকী নষ্ট হয়ে যায় না। এর দলিল হলো এই আয়াত—
اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ
নিঃসন্দেহে নেক আমল গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়।
সুতরাং আয়াতে তিরস্কারের বিষয়বস্তু যখন অন্য বিষয় তো (আমল না করে) ওয়াজ—নসীহত করলে গোনাহগার হতে হবে—এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সুতরাং নসীহত করাটা নেক কাজ আর তার নেকী হওয়াটা গোনাহ না করার ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং আয়াতের তিরস্কার এ ব্যাপারে—তোমরা নিজেরা কেন আমল করছ না? আর ওয়াজ—নসীহত ছেড়ে দেওয়ার ফলে তো অপরাধ আরেকটা বাড়ল; অর্থাৎ না নিজে আমল করে আর জানা থাকা সত্ত্বেও না অন্যকে বলে। এ হলো আলেমদের এ ক্ষেত্রে ভুলের বিবরণ।
দ্বিতীয় কথা হলো এই—اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ অর্থ : নিশ্চয়ই নেকীসমূহ পাপরাশির কাফফারা হয়ে যায়।
তৃতীয় কথা হলো এই—একজন মানুষ যখন কাউকে নসীহত করে তখন তা যেহেতু নেকী হিসেবে গণ্য হয় আর নেকী গোনাহের কাফফারা হয়, তো এর প্রভাব এই হতে পারত যে, এটা নিজের কথা ভুলে যাওয়া তথা আমল ত্যাগের গোনাহের কাফফারা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু এই নেকী থাকা সত্ত্বেও তার আমল ছাড়াটা তিরস্কারযোগ্য হয়, তাহলে যেখানে এই নেকী ও নেক আমলই না থাকে, উল্টো বদ আমল যার মধ্যে গীবতও শামিল, তাহলে তা কী করে তিরস্কারযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। অবশ্যই, আরও বেশি তিরস্কারযোগ্য বিবেচিত হবে।
اَتَاْمُرُوْنَ النَّاسَ আয়াতের সারকথা
সারকথা এই দাঁড়াবে, হে ওই ব্যক্তি, যে নিজের অবস্থা ভুলে একটা গোনাহ ও একটি নেকীর সহাবস্থান সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তিরস্কারযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে তো একটিও যদি নেকী না থাকে বরং উভয় কাজ গোনাহেরই কাজ হয়, তাহলে কী করে তিরস্কারযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। আর দুই গোনাহ এভাবে হয়েছে যে বদ—আমলি তো আপন অবস্থায় রয়েছেই, যাকে تَنْسَوْنَ اَنْفُسَكُمْ এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভুলে যাও তোমরা নিজেদেরকে এবং নসীহতকে। আর নসীহত করার পরিবর্তে অন্যদের গীবত হয়ে গেলে তো এমতাবস্থায় তার চেয়ে বেশি তিরস্কারযোগ্য হওয়া উচিত।
সুতরাং বোঝা গেল এই আয়াতে—যাতে তিরস্কারের কারণ গীবত ও বদ—আমল তাতে—কেবল আলেমদের লক্ষ্য করেই অভিযোগ করা হয়নি; বরং জাহেলদের বিরুদ্ধেও জোরালো অভিযোগ করা হয়েছে। আলেমদের বিরুদ্ধে লঘু অভিযোগ করা হয়েছে, কেননা তাদের নিকট একটি নেকী তো অন্তত আছে অর্থাৎ নসীহত করা। পক্ষান্তরে জাহেলদের নিকট একটিও নেই। এখন পারলে গর্ব করুন এবং জাহেলদের গর্ব করা দেখুন যা তারা নিজেদের মূর্খতা নিয়ে করে থাকে। কেননা এ কারণে খোদায়ী দণ্ডবিধির আরেকটি দফা তাদের ব্যাপারে সংযোজিত হলো।
এ সকল আলোচনার উদ্দেশ্য এই, আমাদের যে বদ অভ্যাস হয়ে গেছে, আমরা অন্যদের গীবত করি তা চিরতরে বর্জন করা উচিত এবং নিজের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। সুধীবৃন্দ, যেখানে নিজের অন্যায়—অপরাধেরই শেষ নেই সেখানে অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়া কী করে সাজে?
জাতির সংশোধনের স্বার্থে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের নীতিমালা
আমি যে বলেছিলাম জাতির সংশোধনের জন্য তাদের অবস্থার অনুসন্ধান জায়েয, এ ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালাও আছে, তা জেনে নেওয়া জরুরি।
তো একটি মূলনীতি হলো এই—আম মজলিসে কারও ইসলাহ—সংশোধনের কাজ করা যাবে না। কেননা এতে সে শরম পাবে আর এই শরমের প্রতিক্রিয়া এই হয় যে, নসীহতকারীর প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যায়, এমনকি কখনো কখনো ওই কাজ বর্জনের পরিবর্তে আরও বেশি করে করতে শুরু করে। কেননা তখন সে ভাবে, অপদস্থ যখন হয়েই গেছি তখন আর কেন বর্জন করব। তাই এ ক্ষেত্রে ভালো হয় নির্জনে নিয়ে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলে দেওয়া। কিংবা নিজে না বলতে পারলে এমন কারও নিকট বলে দেওয়া যিনি তাকে সংশোধন করতে পারেন। তবে তার শত্রুকে বলবে না। কেননা শত্রুকে বলার দ্বারা সংশোধন হতে পারে না; এতে বরং সে লাঞ্ছিত হয়।
দ্বিতীয় মূলনীতি হলো এই—নরম ভাষায় কোমলভাবে বলা। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খোঁচা মেরে না বলা।
তৃতীয় মূলনীতি—জনসমাবেশে যদি আমভাবে বলা হয় তাহলে এমনভাবে বলা যাতে সে অপদস্থ না হয়। আমাকে অনেকবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে অর্থাৎ ওয়াজের পূর্বে বলা হয় অমুক সুদ খায়—ওয়াজে তাকে একটু সাইজ করবেন, অমুক অন্যের হক জবর—দখল করে রখেছে—তারও একটু খবর নিয়ে ছাড়বেন। কিন্তু আল্লাহ পাকের শোকর এ ধরনের ফরমায়েশ অনুযায়ী আমি কখনো আমল করিনি। কেননা আমি জানি, এই পদ্ধতিতে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি হয় বেশি। কারণ, কথার প্রসঙ্গ থেকে শ্রোতারা টের পেয়ে যায় যে অমুককে বলা হচ্ছে, ফলে জনসমাবেশে সে লজ্জিত হয়ে যায়। যার বিষফল হলো ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা। এ কারণে উত্তম পদ্ধতি হলো, বাস্তবেই যদি কারও সংশোধন কাম্য হয় তাহলে প্রথমে তার সঙ্গে মেলামেশা করা। যখন একেবারে অকৃত্রিম সম্পর্ক হয়ে যাবে তখন ধীরে ধীরে সময় বুঝে নরমভাবে তাকে বোঝাবে। আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর জন্য দুআ করা, এ ছাড়া যেসব কৌশল তার ক্ষেত্রে উপকারী হয় তা অবলম্বন করা।
মোটকথা, এমন আচরণ করা যেমন আচরণ করা হয় নিজের সন্তানদের সঙ্গে। কেননা যদি তাদের নামে নালিশ করা হয় তাহলে আপন বন্ধু—বান্ধবদের সঙ্গেই করা হয়, যারা তার সংশোধন করতে পারে কিংবা কোনো বুযুর্গের নিকট করা হয় যাতে তিনি দুআ করেন। মোটকথা, যাদের দ্বারা সংশোধনের আশা আছে তাদের নিকট বলা হবে, আর যেখানে এই আশা থাকবে না সেখানে সন্তানের দোষ—ত্রুটির কথা মুখে উচ্চারণও করা হবে না। এটি এমন উৎকৃষ্ট এক উদাহরণ যা সামনে থাকলে ইসলাহ ও সংশোধনের নীতিমালা পরিষ্কার হয়ে যাবে। অর্থাৎ যখন কোনো মুসলমানের সংশোধন করতে চান তখন এই চিন্তা করুন যে, এহেন অবস্থা যদি সন্তানের হয় তাহলে তার সঙ্গে আমার আচরণ কেমন হতো। তো তার সঙ্গে যে আচরণ উপযোগী মনে করতেন সেই আচরণই অন্যের সঙ্গে অবলম্বন করুন।
মুসলমান মুসলমানের আয়না—হাদীসের অর্থ
আর আমি المسلم مرآة المسلم মুসলমান মুসলমানের আয়না, হাদীসের এক অর্থ এই বর্ণনা করে থাকি—অর্থাৎ আয়নার বৈশিষ্ট্য তা যেমন তোমার চেহারার দোষ—ত্রুটি তোমার কাছ থেকে লোকায় না এবং অন্যের সামনে প্রকাশ করে না; তদ্রূপ এক মুসলমান আরেক মুসলমানের দোষ তার কাছ থেকে লোকাবে না এবং অন্যের কাছে প্রকাশও করবে না।
দ্বিতীয় অর্থ হলো এই—এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ব্যাপারে অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ না করা; বরং আয়নার মতো অন্তর একেবারে পরিষ্কার রাখা উচিত। সারকথা এই—কারও দোষ—ত্রুটি জানতে পারলে শুধু তাকে জানিয়ে দাও, আর এতে কাজ না হলে আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করো।
মোটকথা অন্যের দোষ—ত্রুটি তালাশ করে বলে দেওয়া উল্লিখিত কল্যাণ বিবেচনায় তো জায়েয; আর যদি এসব কল্যাণ না থাকে তাহলে একটা ক্ষেত্র ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে একেবারে হারাম।
দোষ—ত্রুটি প্রকাশের জায়েয ক্ষেত্র
ওই ক্ষেত্রটি হলো এই—মজলুম জালেমের দোষ—ত্রুটির কথা বলতে পারবে, কেননা মজলুম জালেমের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে আর সেই ক্ষোভ ন্যায্য ক্ষোভ। তাই শরীয়ত মজলুমকে ন্যায্য ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার দিয়েছে।
সুবহানাল্লাহ! শরীয়তের শিক্ষাও কী দারুণ পবিত্র শিক্ষা। খেয়াল করার মতো দিকগুলোর কোনোটিই বাদ দেয়নি। দেখুন মজলুম যেহেতু নিজের ন্যায্য ক্ষোভ প্রকাশ করে আর স্বভাবতই তা হজম করা কষ্টকর হয়ে থাকে—তাই তাকে অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তদুপরি তাতেও কল্যাণ রয়েছে যে, মজলুমের বলার দ্বারা যখন জালেমের হাল—অবস্থা মানুষের কাছে প্রকাশ পেয়ে যাবে তখন সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। এমনকি কতক বুযুর্গ তো এই কল্যাণের কথাও বলে দিয়েছেন যে, মজলুম যদি কোনো আলামত বুঝতে পারে যে আমার সবরের ফলে জালেমের ওপর অবশ্যই আল্লাহর গযব নাযিল হবে (কেননা কারও কারও সঙ্গে আল্লাহ পাকের বিশেষ মুআমালা থাকে) তাহলে মুখে অবশ্যই জালেমকে কিছু গালমন্দ করে রাগ ঝেরে ফেলবে। কেননা তার নীরবতার কারণে আশঙ্কা আছে যে দুনিয়াতেই তার ওপর আল্লাহ পাকের গযব নেমে আসবে। কিছু কিছু মানুষের বাণী থেকে যে, কিছু না বলার ফযীলত বোঝা যায় তা এই ভিত্তিতে যে, সবর করা একটি নেক আমল। এতে মজলুমের সওয়াব বেশি হবে। তবে যারা কিছু বলে করে ফেলার অনুমতি দিয়েছেন এবং একে উত্তম বলেছেন, তারা এই চিন্তা থেকে বলেছেন যে, মুসলমান বান্দাকে যেন দোযখের আযাবে ভুগতে না হয়। আর তার (জালেমের) আল্লাহ পাকের আযাব থেকে বাঁচার উপায় এই হতে পারে যে, মজলুম তাকে ক্ষমা করে দেবে। তো মনে রাখতে হবে আল্লাহ পাকের সঙ্গে কতক লোকের মুআমালা এমন থাকে যে তারা ক্ষমা করে দিলেও আল্লাহ পাক নিজের হকের ভিত্তিতে—যারা তাদের কষ্ট দিয়েছিল—তাদের ক্ষমা করেন না। জনৈক বুযুর্গের ঘটনা, তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে এক লোক তাঁকে অহেতুক কিছু একটা বলে বসল। বুযুর্গ তার মুরিদকে হুকুম দিলেন—ওকে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দাও। হুকুম তামিলে মুরিদের একটু দেরি হলো, ইতিমধ্যে হঠাৎ ওই লোকটি জমিনে আঁছড়ে পড়ল এবং সেখানেই মরে গেল। বুযুর্গ মুরিদকে লক্ষ্য করে বললেন, দেখলে তোমার দেরি করার ফল। তারপর বললেন, যখন সে আমাকে গালমন্দ করছিল, আমি দেখছিলাম আল্লাহর গযব তার ওপর নাযিল হওয়ার উপক্রম; তাই আমার ইচ্ছা ছিল আমি নিজেই তাকে কিছু বলে—কয়ে দেব, যাতে আল্লাহর গযব তার ওপর না পড়ে। কিন্তু তোমার দেরিতে লোকটার সর্বনাশ হয়ে গেল।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর নিষেধ সত্ত্বেও যারা তাঁকে তেতো ওষুধ পান করিয়েছিল, হুঁশ ফেরার পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যারা আমার মুখে তেতো ওষুধ ঢেলেছে হযরত আব্বাস ছাড়া বাকি সবার মুখে তা ঢালা হোক—কেননা তিনি এ সিদ্ধান্তে শরিক ছিলেন না—যাতে বদলা হয়ে যায় এবং এরা আল্লাহ পাকের গযবের শিকার না হন।
হযরত মির্যা মাযহার জানেজা রহ. বেশিরভাগ লোককেই তার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিতেন না। কেউ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, মানুষের আচরণে অনেক সময় আমার কষ্ট লাগে। আমার কষ্টের কারণে মানুষ বিপদে পড়ে যায় আর আমি কতবার যে আল্লাহ পাকের নিকট এই দুআ করেছি যে, আমার কারণে যেন মানুষ বিপদে না পড়ে। কিন্তু আমার এই দুআ কবুল হয়নি। হাফেজ সিরাজী রহ. বলেন, আমার বহুবারের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা বুযুর্গদের বিরুদ্ধে লেগেছে তাদেরই সর্বনাশ হয়েছে।
তো কতক ক্ষমা করার পরও যেহেতু পুরোপুরি ক্ষমা হয় না, তাই কিছু বলে—কয়ে ফেলাতেই সমূহ কল্যাণ।
মোটকথা মজলুমের জন্য জুলুম প্রকাশ ছাড়া অন্য একটি কল্যাণ বিবেচনায়ও দোষ প্রকাশের অনুমোদন রয়েছে। আর সে ক্ষেত্রে যদি বিপদ চলে যাওয়া কিংবা হালকা হয়ে যাওয়ার নিয়ত থাকে—তা সওয়াবেরও কাজ—তবে অন্যদের ক্ষেত্রে বিনা মাসলেহাতে এ কাজের অনুমোদন নেই।
অবশিষ্ট আয়াতের তাফসীর ও বয়ানের পরিশিষ্ট
এ পর্যায়ে আমি অবশিষ্ট আয়াতের তরজমা করে আমার বয়ানের ইতি টানছি। وَاَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْکِتٰبَ অর্থাৎ অথচ তোমরা আল্লাহর কিতাব পড় আর তার হুকুম তোমাদের জানা। কেউ হয়তো এই তরজমা শুনে খুশি হবে যে, এ সবকিছু তাদের জন্যে যারা কিতাব পড়ে। আমরা যেহেতু কিতাব পড়ি না তাই এ হুকুম আমাদের ওপর প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এই খুশি যথার্থ নয়। কেননা সামনে এ কথাও বলা হয়েছে اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ অর্থাৎ তোমরা কি বুঝো না? যার দ্বারা বোঝা যায় এ মাসআলা যেমন শরীয়তের, তদ্রূপ তা যুক্তিবুদ্ধির দ্বারা প্রমাণিত; অর্থাৎ বিবেক—বুদ্ধিও তা গর্হিত হওয়ার কথা বলে।
যাইহোক, এই আয়াত দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে এ ব্যাপারে তিরস্কার করা হয়েছে যে, অন্যদের বোঝাও অথচ নিজে আমল করো না। তদুপরি সুনিশ্চিতভাবে এ কথা প্রমাণিত হলো যে, নিজের দোষ—ত্রুটির কথা ভুলে গিয়ে অন্যের দোষচর্চায় মেতে থাকা আরও জঘন্য বিষয়। প্রয়োজন হলো সদা নিজের গোনাহ ও দোষ—ত্রুটি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা এবং তার চিকিৎসা ও সংশোধনের ফিকির করা। যে ক্ষেত্রে নিজ চিন্তা ও কৌশল যথেষ্ট না হয় সে ক্ষেত্রে কোনো বিজ্ঞজনের শরণাপন্ন হোন, তার কাছ থেকে জেনে নিন। শরম ও সংকোচের কারণে নিজের রোগ—ব্যাধি চিকিৎসকের কাছে গোপন করা উচিত নয়। কোনো রোগের কথা প্রকাশ করা ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব নয়। এখানেই আলোচনা শেষ করছি। যেহেতু এ রোগে বেশিরভাগ মানুষ আক্রান্ত তাই তা আলোচনা করা জরুরি মনে করেছি। তো আল্লাহ পাকের শোকর এ প্রসঙ্গে যথেষ্ট আলোচনা হয়ে গেছে।
এখন আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করুন যেন তিনি আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করেন এবং নেক কাজের তাওফিক দান করেন। আমীন।
الحمد لله الذى بنعمة تتم الصالحات