পরামর্শ ও এস্তেখারা : গুরুত্ব ও আদব
মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.
الْحَمْدَ للهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنُؤِمِنُ بِه وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْه وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ اَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ اَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْه فَلا هَادِيَ لَهُ وَنَشْهَدُ اَنْ لا اِلهَ اِلا اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ وَنَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ صلى الله تعالى عليه وعلى اله وصحبه اجمعين. اما بعد فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم وَشَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِ ۚ فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَکَّلْ عَلَی اللهِ ؕ اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُتَوَکِّلِیْنَ.
وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : مِنْ شَقاوَةِ ابْنِ آدَمَ تَرْكُه اسْتِخَارَةُ اللهِ
যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করার পূর্বে শরীয়ত আমাদের দুটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছে :
এক. এস্তেশারা (استشارة) অর্থাৎ পরামর্শ করা।
দুই. এস্তেখারা (استخارة)।
শয়তান সর্বদাই মানুষের পেছনে লেগে থাকে আর শরীয়তের একেবারে সহজ—সরল ও সাধারাণ বিষয়ও বিকৃতরূপে উপস্থাপন করে। শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ের মতো পরামর্শ ও এস্তেখারার রূপও বদলে দিয়েছে। একে তো অনেকে পরামর্শ ও এস্তেখারার ধারই ধারে না। আর যারা কিছুটা ধার ধারে তাদের কর্মপদ্ধতিও ত্রুটিপূর্ণ। যেহেতু শরীয়তে এস্তেখারার তুলনায় পরামর্শের গুরুত্ব বেশি তাই প্রথমে পরামর্শের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং এতে যে সকল ভুল—ভ্রান্তি হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আলোচনা করব। এরপর এস্তেÍখারার আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
পরামর্শের গুরুত্ব
পরামর্শের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণীগুলো শুনুন :
০১. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَشَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِ ۚ فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَکَّلْ عَلَی اللهِ ؕ اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُتَوَکِّلِیْنَ
আর আপনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। যখন ফায়সালা হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করুন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।—সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১৫৯
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সর্বদাই আল্লাহ তাআলার হেদায়াত ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করতেন। তা ছাড়া রাসূলের চেয়ে বুঝ, উপলব্ধি ও দূরদর্শিতা কার বেশি হতে পারে? তা সত্ত্বেও পরামর্শের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
০২. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَ الَّذِیْنَ اسْتَجَابُوْا لِرَبِّهِمْ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ ۪ وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰی بَیْنَهُمْ ۪ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ
আর যারা তাদের রবের নির্দেশ পালন করে, নামায কায়েম করে, পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে এবং আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।—সূরা শূরা, ৪২ : ৩৮
আল্লাহ তাআলার রাস্তায় ব্যয় করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ পথ হলো যাকাত। পরামর্শের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য নামায ও যাকাতের মতো মহান দুই ইবাদতের মাঝে পরামর্শের কথা আলোচনা করা হয়েছে। আর এ সূরার নামই রাখা হয়েছে ‘সূরা শূরা’ অর্থাৎ পরামর্শের বিধান—সংবলিত সূরা।
নামায ও যাকাত এমন দুই ইবাদত যে, কোরআন ও হাদীসে প্রায় সকল স্থানেই এ দুটি একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য এ দুই ইবাদতকে قرينتان তথা পরস্পরের সঙ্গী বলেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু কোরআনে কারীমে কেবল দুটি স্থানে নামায ও যাকাতের মাঝে তৃতীয় আরেকটি বিষয় উল্লেখ করে ওই বিষয়ের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। একটি হলো সূরা শূরা। এখানে নামায ও যাকাতের মাঝে পরামর্শের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো সূরা মুমিনূন। এ সূরার শুরুতেই বলা হয়েছে,
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ ۙ﴿۱﴾ الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ ۙ﴿۲﴾ وَالَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ ﴿ۙ۳﴾ وَالَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّکٰوۃِ فٰعِلُوْنَ ۙ﴿۴﴾
অবশ্যই ওই সকল মুসলমান সফলতা লাভ করেছে, যারা খুশু—খুযুর সঙ্গে নামায আদায় করে, অনর্থক বিষয় থেকে বিরত থাকে আর যাকাত আদায় করে।—সূরা মুমিনূন, ২৩ : ১—৪
এখানে আল্লাহ তাআলা নামায ও যাকাতের মতো মহান ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত দুটির মাঝে অনর্থক বিষয় থেকে বিরত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপের উদ্দেশ্যেই একে নামায ও যাকাতের মাঝে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলার সফল বান্দা তারাই, যারা এমন—সব কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকে, যাতে না দুনিয়ার কোনো ফায়দা আছে না আখেরাতের।
পরামর্শ প্রসঙ্গে কোরআনে কারীমের দুটি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস শুনুন :
০১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ما سعد أحد برأيه وما شقي أحد عن مشورة
নিজের একক সিদ্ধান্তে কেউ সফল হয়নি আর পরামর্শ করে কেউ কখনো বিফল হয়নি।—জামে সগীর : ২/৩১
ইমাম বায়হাকী রহ. তাঁর হাদীসগ্রন্থ শুয়াবুল ঈমানে (হাদীস নং : ৭১৩৭) হাদীসটি মুরসাল সনদে উল্লেখ করেছেন।
০২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাযি.—কে ইয়ামানের বিচারক করে পাঠানোর সময় এ উপদেশ দিয়েছিলেন,
استشر فان المستشير معان والمستشار مؤتمن
পরামর্শ করে কাজ করবে। কারণ, পরামর্শকারী (আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে) সাহায্যপ্রাপ্ত হয় আর যার পরামর্শ গ্রহণ করা হয় সে এ ব্যাপারে যিম্মাদার।—জামেউল আহাদীস : ৯/২০, হাদীস নং : ৮৮৪০
কার সঙ্গে পরামর্শ করব
নেককার ও দ্বীনদার ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা চাই। পাশাপাশি ওই ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকাও জরুরি।
নেককার অর্থ
হয়তো আপনারা জানেন, এমন ব্যক্তিকে নেককার বলা হয় যে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহ তাআলার নাফরমানী থেকে নিজেও বিরত থাকে, অন্যদেরও বিরত রাখার চেষ্টা করে। যে দাড়ি সেভ করে বা ছেঁটে রাখে সে তো প্রথম শ্রেণির ফাসেক, নেককার কখনোই নয়। এমনিভাবে যার ঘরে শরয়ী পর্দা নেই, খালাত, মামাত, ফুফাত, চাচাত ভাই—বোনদের সঙ্গে, দেবর, ভাসুর, বোন জামাই, ননদের জামাইদের সঙ্গে যার ঘরে পর্দা করা হয় না, সে তো দাইয়ুস। এমন ব্যক্তি কখনোই নেককার হতে পারে না, চাই সে দৈনিক হাজার রাকাত নফল নামায পড়–ক, প্রতিবছর হজ করুক। এ ধরনের বেদ্বীন ব্যক্তি কখনোই পরামর্শের উপযুক্ত নয়।
বে—দ্বীন থেকে পরামর্শ গ্রহণের ক্ষতি
বে—দ্বীন থেকে পরামর্শ গ্রহণে যেসব ক্ষতি হতে পারে :
এক. বে—দ্বীন ব্যক্তির বিচার—বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। গোনাহ ও নাফরমানী করতে করতে তাদের বিবেক—বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি আঁধারে ছেয়ে যায়। তাতে কোনো নূর থাকে না। তার অন্তরও অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিবেক—বুদ্ধিও অন্ধকারাচ্ছন্ন। যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকেই চিনল না সে আল্লাহ তাআলার বিধি—বিধান ও এর উপযোগিতা ও উপকারিতা কী করে বুঝতে সক্ষম হবে। তাই বে—দ্বীন নাফরমানের পরামর্শ গ্রহণ করবে না। তার পরামর্শে ক্ষতিরই আশঙ্কা রয়েছে, ফায়দার কোনো সম্ভাবনা নেই।
দুই. বে—দ্বীন ব্যক্তি পরামর্শ গ্রহণকারীকে জেনে—বুঝে ভুল পরামর্শ দিতে পারে।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, জেনে—বুঝে কাউকে ভুল পরামর্শ দেওয়ার ফায়দা কী? এর উত্তর শুনুন,
জেনে—বুঝে ভুল পরামর্শ দেওয়ায় বে—দ্বীনের ফায়দা
জেনে—বুঝে কাউকে ভুল পরামর্শ দেওয়াতে বে—দ্বীনের দুটি ফায়দা রয়েছে,
এক. নিজের স্বার্থ হাসিল করা।
দুই. তাকে পেরেশান করা।
আপনাকে হয়তো সে বলে দিল, এ কাজ করবেন না। এতে আপনার মারাত্মক ক্ষতি হবে। আপনাকে এভাবে কাজ থেকে দূরে রেখে সে নিজে তা করে নেবে। আপনার ফায়দার কথা চিন্তা করে নয়; বরং নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ভুল পরামর্শ দেবে। উদাহরণত আপনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ চাইলেন। তো সম্বন্ধ তার নিজের কাছেই ভালো লেগে গেল। তখন সে আপনাকে বলবে, ‘এখানে কখনোই বিয়ে করবেন না। এটা আপনার জন্য ভালো হবে না। এখানে বিয়ে করলে আপনাকে আফসোস করতে হবে।’
এভাবে আপনাকে সরিয়ে দিয়ে সে নিজেই বিয়ে করে নেবে। তদ্রƒপ আপনি কোনো ব্যবসার ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। তখন সে হাজারো ক্ষতির দিক উল্লেখ করে এর থেকে আপনাকে বিরত রাখবে। উদ্দেশ্য হলো, আপনি যদি জানেন, এতে এই এই ভালো দিক রয়েছে, এতে এত লাভ হবে তা হলে তো আপনি লাভবান হয়ে যাবেন। অতএব আপনাকে বিরত রেখে সে নিজে এ লাভ অর্জনের চেষ্টা করবে।
এমনিভাবে কোনো চাকরির ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেও একই কাজ করবে। মোটকথা বে—দ্বীন থেকে যে বিষয়েরই পরামর্শ চাওয়া হবে সে আপনার ফায়দার আগে নিজের ফায়দার কথা চিন্তা করবে। সর্বাবস্থায় তার চেষ্টা থাকবে কীভাবে তার মতলব হাসিল হবে। যদি বিষয়টি এমন হয় যে, এতে তার কোনো ফায়দা হবে না তবুও সে সঠিক পরামর্শ দেবে না। কারণ, বে—দ্বীনের কাছে অন্যের উপকার করতে ভালো লাগে না। তার মাথায় সর্বদা ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চিন্তা ঘুরপাক খায়। নিজের কোনো ফায়দা হোক বা না হোক অন্যের ক্ষতি সাধন করে। অন্যকে পেরেশান দেখে সে আনন্দিত হয়। অন্য কোনো ফায়দা হোক বা না হোক কাউকে পেরেশান করাটাও তার কাছে বড় ফায়দার বিষয়। সে যখন পেরেশান হবে তখন সে তাকে দেখে দেখে হাসবে যে, তাকে কীভাবে বোকা বানিয়ে ফেললাম।
পরামর্শ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে পরামর্শের জন্য নাফরমান ও বে—দ্বীনের ধারে—কাছেও যাবে না। পরামর্শ করতে চাইলে কোনো নেককার ও দ্বীনদার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করবে। দ্বীনদারীর পাশাপাশি যে বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করবে সে বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা আছে কি না তাও দেখে নেবে। কেউ না জেনে কোনো নেককার দ্বীনদার ব্যক্তিকে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ভেবে পরামর্শ চাইলে ওই নেককার ব্যক্তির উপর ফরয হলো, সে পরিষ্কার জানিয়ে দেবে, এ বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অতএব আমি পরামর্শ দিতে সক্ষম নই। সে তাকে এ কথা না জানালে বাহ্যিক দৃষ্টিতে নেককার হলেও প্রকৃত অর্থে সে নেককার নয়।
মানুষ পরামর্শের এ শর্তগুলোর প্রতি লক্ষ করে না। যার—তার সঙ্গে পরামর্শ করে।
পরামর্শ গ্রহণকারীর ত্রুটি
পরামর্শ গ্রহণকারীর কিছু ত্রুটি এখন উল্লেখ করব। সাধারণভাবে পরামর্শ গ্রহণকারী নিম্নোক্ত ভুলগুলো করে থাকে :
এক. পরামর্শ গ্রহণের পূর্বেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কেবল নামেমাত্র পরামর্শ করে।
দুই. পরামর্শদাতার সামনে বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না।
তিন. পরামর্শদাতার পরামর্শকে পরামর্শের পরিবর্তে নির্দেশ মনে করে।
চার. পরামর্শের পর কোনো সমস্যা দেখা দিলে পরামর্শদাতার ত্রুটি মনে করে থাকে।
এখন এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ পেশ করছি।
প্রথম ত্রুটি : পরামর্শের পূর্বেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা
পরামর্শ গ্রহণকারীর প্রথম ত্রুটি হলো, যে বিষয়ে পরামর্শ করতে চায় আগে থেকেই ভেবেচিন্তে সে বিষয়ে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নেয়। এরপর কোনো বুযুর্গের পরামর্শ চায়। বুযুর্গের পরামর্শ তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলে গেলে বলবে, অমুক বুযুর্গের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করেছি। না মিললে বুযুর্গের পরামর্শের কোনো তোয়াক্কা না করে নিজের পূর্বসিদ্ধান্তের উপরই অটল থাকে।
দ্বিতীয় ত্রুটি : পরামর্শদাতার কাছে বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন না করা
দ্বিতীয় ত্রুটি হলো, পরামর্শদাতার কাছে বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না। কোনো বুযুর্গ বা মুরব্বীর পরামর্শ গ্রহণের সময় বিষয়টির সকল ভালো দিক এক এক করে উল্লেখ করতে থাকে। যেন পরামর্শদাতা তার পক্ষেই পরামর্শ প্রদান করেন। কিন্তু বিষয়টির অপর দিক উপস্থাপনই করে না যে, এতে কী কী ক্ষতি রয়েছে। বুযুর্গ থেকে নিজের পক্ষে পরামর্শ নিয়ে মানুষদের বলে বেড়ায়, অমুক বুযুর্গ এ পরামর্শ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে সে কাজটি না করতে চাইলে বুযুর্গের সামনে বিষয়টির সকল ত্রুটি ও ক্ষতির দিক এক এক করে উল্লেখ করতে থাকে। কিন্তু এর অপরদিক উল্লেখই করে না যে, এতে কী কী ফায়দা রয়েছে।
পরামর্শের এ পদ্ধতি একেবারেই ভুল। সঠিক পদ্ধতি হলো, পরামর্শদাতার সামনে বিষয়টির লাভ—ক্ষতি উভয় দিক সঠিকভাবে উপস্থাপন করবে। তিনি উভয় দিক গভীরভাবে বিবেচনা করে উপযুক্ত পরামর্শ প্রদান করবেন। এখন তো মানুষ সঠিক বিষয় উল্লেখ করে না। এভাবে পরামর্শের কী ফায়দা?
কোথাও কোনো মেয়ে দেখে পছন্দ হয়ে গেল। এখন এল পরামর্শের জন্য যে, এখানে সম্পর্ক স্থাপন করবে কি না। তো মেয়েপক্ষের প্রশংসা শুরু হয়ে গেল, মেয়ে খুবই ভালো, মা—বাবাও খুব ভালো। মূলত তাদের পুরো বংশই খুব ভালো।
পরামর্শদাতার যদি মেয়েপক্ষ সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানাশোনা থাকে, তিনি তাদের কিছু মন্দ দিক তুলে ধরেন তা হলে তার পরামর্শ গ্রহণের পরিবর্তে তার বক্তব্য খণ্ডন করতে শুরু করে যে, না না হুযুর, আপনি জানেন না। কেউ আপনাকে ভুল তথ্য দিয়েছে। বিষয়টি যেন এমন—সে পরামর্শদাতা থেকে কোনো কিছু বুঝতে নয়; বরং পরামর্শদাতাকে কিছু বোঝাতে এসেছে। অনেক সময় আমার কাছে কেউ পরামর্শের জন্য এলে তার কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝতে পারি, সে আমার মুখ থেকে এ কথা বের করতে চায়, হ্যাঁ, এটা ঠিক আছে। তার কথা থেকেই পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যাই এবং বুঝতে পারি, এ কেবল নামমাত্র পরামর্শ করতে এসেছে। যেন সে বলতে পারে, আমি পরামর্শ করেই কাজ করেছি। বিষয়ের লাভ—ক্ষতি উভয় দিক বিস্তারিত উল্লেখ করার পরিবর্তে কেবল একটি দিক উল্লেখ করে পরামর্শ করা আজকাল মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয় ত্রুটি : পরামর্শকে নির্দেশ মনে করা
পরামর্শ গ্রহণকারী তৃতীয় যে ভুলটি করে তা হলো, পরামর্শদাতা কোনো পরামর্শ দিলে তা পরামর্শের পরিবর্তে নির্দেশ মনে করে। পরামর্শদাতা তো পরিস্থিতির বিবরণ শুনে কেবল এ পরামর্শ দিয়েছে যে, আপনি যা বর্ণনা করেছেন তা থেকে এ কাজ করাই ভালো মনে হচ্ছে। এটা শুধুই পরামর্শ। পরামর্শদাতা তা পালনে তাকে বাধ্য করে না। তাকে কোনো প্রকার নির্দেশও প্রদান করে না যে, এটাই করুন। কিন্তু সে পরামর্শগ্রহণের পর লোকদের বলতে থাকে, অমুক আমাকে এমনটি করতে বলেছেন। অমুক বুযুর্গ আমাকে বলেছেন এ কাজ করতে, তাই করছি।
আরে ভাই, তিনি কখন আপনাকে নির্দেশ করলেন! সিদ্ধান্ত তো আপনি নিজেই গ্রহণ করলেন। ওই বুযুর্গ তো আপনাকে শুধু এ কথাই বলেছেন, আপনার বর্ণনা অনুযায়ী অমুক কাজ করাই ভালো মনে হয়। অতএব তা করাই ঠিক হবে। বুযুর্গ তো এ কাজটিকে বেশির থেকে বেশি উত্তম বলেছেন। তিনি কেন বলতে যাবেন, এ কাজ করা আপনার উপর ফরয, আপনাকে অবশ্যই এটা করতে হবে! কিন্তু পরামর্শগ্রহীতা মানুষকে বলে বেড়ায়, অমুক বুযুর্গ বলার কারণে করছি। এটা অবশ্যই ওই বুযুর্গের প্রতি মিথ্যা অপবাদ।
চতুর্থ ত্রুটি : ক্ষতি হলে পরামর্শদাতাকে দোষী সাব্যস্ত করা
চতুর্থ ত্রুটি হলো, পরামর্শমতো কাজ করার পর ফায়দা হলে আর সে বুযুর্গের কথা বলে না। তার নাম আলোচনায় আনে না; বরং নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতে থাকে। যেমন নাকি কারুন বলত, ‘যা কিছু আমি উপার্জন করেছি তার সবই নিজের জ্ঞান—বুদ্ধির জোরেই করেছি।’ একই অবস্থা আজকালের পরামর্শগ্রহীতাদের। পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে কোনো ফায়দা হলে ওই বুযুর্গের কথা আর মনে থাকে না, যার পরামর্শ গ্রহণ করেছিল বা যাকে দিয়ে দুআ করিয়েছিল; বরং নিজের যোগ্যতা ও জ্ঞান—বুদ্ধির কথাই বলতে থাকে যে, যত ফায়দা হয়েছে তা আমার নিজের জ্ঞান—বুদ্ধি ও চেষ্টা—প্রচেষ্টার ফসল। পক্ষান্তরে ফায়দার পরিবর্তে (আল্লাহ না করুন) ক্ষতি হয়ে গেলে এর সকল দায়ভার ওই বুযুর্গের কাঁধে চাপিয়ে দেয় যে, আমি এ কাজ নিজ সিদ্ধান্তে করিনি; বরং অমুক বুযুর্গের পরামর্শে করেছি। শুধু তা—ই নয়; আরেকটু আগ বেড়ে বলে, হযরতই তো আমাকে এ কাজ করতে বলেছেন। অতএব আমাকে এ জন্যে তিরষ্কার করার কোনো কারণ নেই। আমি তো হযরতের নির্দেশ পালন করেছি মাত্র। তো সবখানে এ কথাই বলে বেড়ায়, এটা হযরতের নির্দেশ ছিল। তাঁর পরামর্শেই এ কাজ করা হয়েছে।
পরামর্শদাতার ত্রুটি
পরামর্শদাতা যে ভুলের শিকার হন :
এক. কিছু লোক পরামর্শ প্রদানে এতটাই আগ্রহী থাকে যে, অযথাই কারও পেছনে লেগে থাকে আর পরামর্শ চাওয়া ব্যতীত নিজ থেকেই পরামর্শ দিতে থাকে। এমন কাউকে পরামর্শ দিতে যাবেন না, যে আপনার কাছে পরামর্শ চায়নি। আবার এমন কাউকেও পরামর্শ দিতে যাবে না, যার কাছে আপনার পরামর্শের কোনো গুরুত্ব নেই।
দুই. পরামর্শ গ্রহণ করতে পীড়াপিড়ি করা এবং পরামর্শ গ্রহণ না করলে অসন্তুষ্ট হওয়া। এটা মারাত্মক ভুল। পরামর্শের মূলকথা নিজের মত প্রকাশ করা মাত্র। কেউ তা গ্রহণ করুক বা না করুক এতে সমস্যার কিছু নেই।
জীবনের ভিত্তিমূল তিনটি গুণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ خِيَارَكُمْ، وَأَغْنِيَاؤُكُمْ سُمَحَاءَكُمْ، وَأُمُورُكُمْ شُورَى بَيْنَكُمْ فَظَهْرُ الأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ بَطْنِهَا، وَإِذَا كَانَ أُمَرَاؤُكُمْ شِرَارَكُمْ وَأَغْنِيَاؤُكُمْ بُخَلاَءَكُمْ، وَأُمُورُكُمْ إِلَى نِسَائِكُمْ فَبَطْنُ الأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ ظَهْرِهَا.
শাসকশ্রেণি নেককার হওয়া, সম্পদশালীরা দানশীল হওয়া এবং পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা—এই তিনটি গুণ যতদিন পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকবে ততদিন জমিনের পেটের তুলনায় পিঠই তোমাদের জন্য উত্তম। অথার্ৎ মৃত্যুর তুলনায় পৃথিবীতে বেঁচে থাকা ভালো। কারণ, জীবন তো আখেরাত বিনির্মাণের জন্যই। উল্লিখিত পরিস্থিতিতে আখেরাত বিনির্মাণ করা যায়। যখন পৃথিবীতে এ তিনটি দোষ দেখা দেবে যে, শাসকরা মন্দ ও দুষ্ট প্রকৃতির হবে, সম্পদশালীরা কৃপণ হয়ে যাবে এবং পুরুষরা নারীদের পরামর্শে কাজকর্ম করবে তখন তোমাদের জন্য জমিনের পিঠ অপেক্ষা পেটই উত্তম হবে। অর্থাৎ এ পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুবরণ করাই ভালো। কারণ, সে জীবন জাহান্নামের দিকেই নিয়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে আখেরাত বিনির্মাণ সম্ভব হবে না। তাই এ জীবন থেকে মৃত্যুই শ্রেয়।—জামে তিরমিযী :২২৬৬
এখন হাদীসে উল্লিখিত গুণ ও দোষ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করছি।
প্রথম গুণ : শাসক নেককার হওয়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম গুণ বর্ণনা করেছেন, তোমাদের শাসকগণ নেককার হবে। যতদিন শাসকশ্রেণি ভালো ও নেককার হবে ততদিন জীবন ভালোভাবে কাটবে। আমি এ বিষয়টি বহুবার পুনরাবৃত্তি করেছি যে,
أعمالكم عمالكم
অর্থাৎ তোমাদের আমল যেমন হবে তোমাদের শাসকও তেমন হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমলগুলোকেই শাসক নির্বাচিত করেন। বিষয়টি আগেও বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তবে আজ এতটা সময় নেই।
আজকাল এটা মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে যে, সরকারের কোনো সমস্যা দেখলেই মিছিল, মিটিং, হইচই শুরু করে দেয়। সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। একবারও এ কথা ভেবে দেখে না, এটা তো আমাদের আমল ও কৃতকর্মেরই বিষফল। আমল যেমন হবে রাষ্ট্র পরিচালকরাও তেমন হবে। আমরা সরকার ও রাষ্ট্রপরিচালকদের সংশোধন চাইলে, আমরা দেশে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। এর জন্য নিজেদের আমলের প্রতি দৃষ্টি আরোপ করা আবশ্যক। নিজেরা ভালো মানুষে পরিণত হতে হবে। আল্লাহ তাআলার সকল নাফরমানী থেকে নিজেরাও বিরত থাকবে অন্যদেরও বিরত রাখার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে জিহাদ করাও এ চেষ্টার অন্তভুর্ক্ত। মোটকথা, পরিপূর্ণ দ্বীনদার হওয়ার বরকতে দেশে সুন্দর ও উত্তম শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
দ্বিতীয় গুণ : সম্পদশালীদের দানশীল হওয়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয় গুণ বর্ণনা করেছেন, তোমাদের সম্পদশালীরা দানশীল হবে। নিজেদের সম্পদ আল্লাহর রাহে ব্যয় করবে। সম্পদশালীরা যখন আল্লাহর রাহে খরচ করতে থাকবে তখন জিহাদের ধারাও অব্যাহত থাকবে। কাফের ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের উপর মুসলমানদের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে। দরিদ্র ও অসহায়ের সহযোগিতাও হবে। দ্বীনের অন্যান্য কাজও অব্যাহত থাকবে।
তৃতীয় গুণ : পরস্পর পরামর্শ করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় গুণ বর্ণনা করেছেন, তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে হবে। পুরুষরা পরস্পর পরামর্শ করবে এতে নারীদের কোনো কতৃর্ত্ব থাকবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وأمركم شورى بينكم
بينكم শব্দে কয়েকটি বিষয় এসে গেছে।
এক. তোমাদের পরামর্শ হবে তোমাদের পরস্পরে। অর্থাৎ মুসলমান মুসলমানের সঙ্গে পরামর্শ করবে, কাফেরদের সঙ্গে নয়।
দুই. পরামর্শ করবে নেককারদের সঙ্গে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সম্বোধন ছিল নেককারদের প্রতি। তোমরা নিজেরা পরামর্শ করবে, বে—দ্বীন থেকে পরামর্শ গ্রহণ করবে না।
তিন. كم শব্দ থেকে বোঝা যায়, পুরুষরা পরস্পর পরামর্শ করবে। নারীদের সঙ্গে পরামর্শ করবে না। যতদিন এ আমল অব্যাহত থাকবে ততদিন জমিনের পেট অপেক্ষা পিঠই তোমাদের জন্য উত্তম। জমিনের পিঠে জীবিত থাকাই ভালো হবে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে। এমন জীবন হবে বরকতময়। তোমাদের সকল কাজে বরকত হবে।
যখন এ তিনটি বিষয় উল্টে যাবে অর্থাৎ শাসকশ্রেণি বে—দ্বীন ও মন্দ প্রকৃতির হবে, সম্পদশালীরা কৃপণ হয়ে যাবে এবং নারীদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা হবে তখন জমিনের পিঠ অপেক্ষা পেটই তোমাদের জন্যই উত্তম হবে। জীবনের চেয়ে মৃত্যুই তখন উত্তম হবে। এ পরিস্থিতিতে জমিনের উপর জীবিত থাকার চেয়ে জমিনের পেটে চলে যাওয়াই ভালো।
এস্তেখারার গুরুত্ব
এ পর্যায়ে এস্তেখারার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস শুনুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে ততটা গুরুত্বসহ এস্তেখারা শিক্ষা দিতেন যতটা গুরুত্বসহ শিক্ষা দিতেন কোরআন শরীফের সূরা।
হাদীস নং : ১
হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَلِّمُنَا الِاسْتِخَارَةَ فِي الْأُمُورِ كُلِّهَا كَمَا يُعَلِّمُنَا السُّورَةَ مِنَ الْقُرْآنِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ততটা গুরুত্বসহ এস্তেখারা শিক্ষা দিতেন যতটা গুরুত্বসহ শিক্ষা দিতেন কোরআন শরীফের সূরা।—জামে তিরিমিযী : ৪৮০
হাদীস নং : ২
مِنْ شَقَاوَةِ ابْنِ آدَمَ تَرْكُهُ اسْتِخَارَةَ اللهِ
বনী আদমের একটি দুর্ভাগ্য হলো আল্লাহ তাআলার কাছে এস্তেখারা না করা।—জামে তিরমিযী : ২১৫১
এস্তেখারার মনগড়া পদ্ধতি ও তার কুফল
বর্তমান সময়ে মুসলমানরা নিজেরাই এস্তেখারার এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, যার সঙ্গে হাদীসে বর্ণিত এস্তেখারার দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এস্তেখারার যে পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলারই নির্দেশ। রাসূলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তা বান্দাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু বান্দারা এর মূল্যায়ন এভাবে করল, আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতি ছুড়ে ফেলে নিজেরাই নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে এস্তেখারার যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে পদ্ধতিই উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন ততটা গুরুত্বসহ যতটা গুরুত্বসহ তিনি কোরআন শরীফের সূরা শিক্ষা দিতেন।
কিন্তু আজকালের মুসলমানরা আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত সে পদ্ধতির বিপরীতে নিজেদের পছন্দমতো বিভিন্ন রকমের পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পদ্ধতির উপর তাদের আস্থা ও ভরসা নেই।
এক লোক মজলিসে এস্তেখারার নবআবিষ্কৃত একটি পদ্ধতির প্রশংসা করছিলেন যে, খুবই কার্যকর এস্তেখারা! তিনি বললেন, দুই রাকাত নামাযের নিয়ত বাঁধুন। সূরা ফাতিহা তিলাওয়াতের সময় اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ পর্যন্ত পৌঁছে এ আয়াত বার বার তিলাওয়াত করতে থাকুন। এর থেকে সামনে বাড়বেন না। যদি সে কাজ আপনার জন্য উপকারী হয় তা হলে আয়াতটি পড়তে পড়তে আপনা—আপনিই ডান দিকে ঘুরে যাবেন। ক্ষতিকর হলে বাম দিকে ঘুরে যাবেন। ব্যস, এস্তেখারা হয়ে গেল!
আমি বললাম, আপনি যে এস্তেখারা—পদ্ধতিকে অত্যন্ত কার্যকর আখ্যায়িত করেছেন তাতে একাধিক মন্দ দিক রয়েছে। তা হলো :
আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মোকাবিলা
আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশিত পথ ও পন্থার বিপরীতে নিজেরা কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করা আল্লাহর ইলমের উপর নিজের ইলমকে প্রাধান্য দেওয়ার নামান্তর। আর এটা তো কুফরী।
সুন্নত পরিত্যাগ
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, শয়তান মানুষকে সুন্নত থেকে দূরে সরিয়ে তার বিপরীতে যা কিছু তাদের অন্তরে ঢেলে দেয় তা তো শয়তানের গোলামদের কাছে অত্যন্ত কার্যকরই মনে হবে। কিন্তু আল্লাহর গোলামদের কাছে খড়—কুটার মতোই এগুলোর কোনো মূল্য নেই।
اِنَّ کَیْدَ الشَّیْطٰنِ کَانَ ضَعِیْفًا
নিশ্চয়ই শয়তানের চক্রান্ত খুবই দুর্বল।—সূরা নিসা, ৪ : ৭৬
শয়তান মানুষের মনে যে কুমন্ত্রণা দেয় তার সঙ্গে সে এ কথাও বোঝাতে সচেষ্ট হয় যে, এটা খুবই কার্যকর বিষয়। এতটাই কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ যে দয়াময় আল্লাহ পাকের কথার চেয়েও তা অগ্রগণ্য। এর সামনে নাউযুবিল্লাহ আল্লাহর কী মূল্য রয়েছে!
নামায বরবাদ করা
মাসআলা হলো, কেউ যদি اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ এই একই আয়াত জেনে—বুঝে দুইবার তিলাওয়াত করে, তা হলে তার গোনাহও হবে আবার নামায পুনরায় পড়া ওয়াজিব হবে। اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ একবার পড়ে নেওয়ার পর পরবর্তী আয়াত তিলাওয়াত করা ওয়াজিব। (আচ্ছা নফল নামাযে তো একই আয়াত বারবার তেলাওয়াত করা যায়?—নখান্দা) এরপর সূরা ফাতিহার পর অন্য একটি সূরা মিলানো ওয়াজিব। এস্তেখারাকারী যখন জেনেবুঝেই এ আয়াত বার বার তিলাওয়াত করবে তখন তার নামায পুনরায় পড়া ওয়াজিব হবে। তাই এ নামায তাকে দোহরাতে হবে এবং জেনেবুঝে নামায নষ্ট করার দরুন যে গোনাহ হয়েছে তার জন্য তওবা করতে হবে। যে ব্যক্তি কোনো গোনাহের কাজ করে আর আশা করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য কল্যাণের পথ খুলে দেবেন সে যেন একবার ভেবে দেখে, আল্লাহর নাফরমানী করে কীভাবে কল্যাণের আশা করা যায়!
নামায নিয়ে কৌতূক
এ ব্যক্তির মূলত দুই রাকাত নফল নামাযের নিয়ত নেই। তার ইচ্ছা কেবল নিয়ত বেঁধে নামাযের রূপ ধারণ করা। এটা নামাযের মতো মহান ইবাদতের সঙ্গে বিদ্রুপ ছাড়া কিছুই নয়। এ লোকের তো নামায পড়ার ইচ্ছাই নেই। সে কেবল اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ বার বার পড়ার জন্য নামাযের সুরত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাস্তবে নামাযের নিয়ত থাকলেও ডানে—বামে ঘুরে যাওয়ার কারণে নামায ভেঙে যাবে। তাই নামায শুরু করে ইচ্ছাকৃত ভেঙে ফেলার কারণে গোনাহগার হবে। নামাযে ডানে—বামে না ঘুরলেও একই আয়াত বার বার তিলাওয়াত করার কারণে তো নামায দোহরানো ওয়াজিব হবেই। আর ঘুরলে তো নামায একেবারেই শেষ।
হ্যাঁ, এখন রইল এ প্রশ্ন, যদি কোনো মাওলানা সাহেব বা কোনো সুফী—দরবেশ সাহেবের অভিজ্ঞতা থাকে যে, তিনি এ পদ্ধতিতে নামায পড়েছেন আর ঘুরেও গেছেন তবে?
এর জবাবে বলব, নামাযে ঘুরে যাওয়ার যে বিষয়টি আপনারা বলছেন যদি এ দরবেশ সাহেব একেবারে আসমানেও উঠে যান তবুও যে বিষয় শরীয়তবিরোধী, তাকে আমরা শরীয়তবিরোধী আখ্যায়িত করব এবং বলব, এতে গোনাহ হবে, এ পথে কখনোই বরকত আসতে পারে না। দাজ্জাল তো হরেক রকমের কৃতিত্ব প্রদর্শন করবে। তাই বলে এ কারসাজিতে কি সে খোদা হয়ে যাবে? দাজ্জাল দাজ্জালই থেকে যাবে। কোনো কৃতিত্ব বা অবাককরা বিষয় প্রদর্শন সত্যের মাপকাঠি নয়। যদি আমরা এটা মেনেও নিই যে, ওই সুফী সাহেব সত্যি সত্যিই اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ পড়তে পড়তে ঘুরে যান, তবুও এর দ্বারা এটা আবশ্যক নয় যে, এস্তেখারার এ পদ্ধতি সহীহ এবং এতে বরকত রয়েছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, এটা শয়তানের নির্দেশিত পথ। শয়তানের পক্ষে এটা অসম্ভব নয় যে, সে তার ক্ষমতা প্রকাশের লক্ষ্যে ওই সুফী সাহেবের কাঁধে ধরে তাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ঘাড় ধরে কখনো ডানে আর কখনো বামে ঘুরিয়ে দিয়েছে। যেন এর ফলে শয়তানের নির্দেশনার ভিত্তি মজবুত হয়। শয়তানের পক্ষে এভাবে ঘুরানো কোনো মুশকিল ব্যাপার নয়। শয়তান ঘুরিয়ে দিল আর সুফী সাহেব খুশি হয়ে গেল যে, কাজ হয়ে গেছে।
তৃতীয় কথা হলো, যখন তিনি দাঁড়িয়ে একাধারে ِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَপড়ে যাচ্ছেন তখন ঘণ্টাখানেক এভাবে চলতে থাকলে মাথা এমনিতেই চক্কর দেবে। কখনো ডানে কখনো বামে ঘুরে যাবে। এ চক্করকেই এস্তেখারার কারামত মনে করবে।
চতুর্থ কথা হলো, মানুষের চিন্তা—চেতনায় কোনো কিছু চেপে বসলে তার মনেও এর বিরাট প্রভাব পড়ে। শুরু থেকেই যখন তার মাথায় এ কথা আছে যে এস্তেখারার বরকতে আমি একদিকে ঘুরে যাব তখন এ ভাবনার প্রভাবে সে নিজেই একদিকে ঘুরে যেতে পারে।
এটা এস্তেখারার নবআবিষ্কৃত পদ্ধতিসমূহের একটি। এ ধরনের আরও কিছু এস্তেখারা—পদ্ধতি ও বিভিন্ন আমল রয়েছে। জাহেল সূফীরা এগুলো ঘরে বসে আবিষ্কার করে। মানুষও শরীয়তের অনুসরণের পরিবর্তে এসব আমলে বেশি স্বাদ অনুভব করে।
আরেকটি বিষয় মনে রাখুন, ভুল আমল ও বিদআত খণ্ডন করতে গিয়ে কখনো সূফী—দরবেশদের কথা বলি। এখানে সূফী—দরবেশ বলতে আজকালের ভণ্ড জাহেল ও বিদআতী সূফী বোঝানো হয়েছে। হক্কানী সূফী—দরবেশ তো আল্লাহর ওলীগণই হয়ে থাকেন।
এখন কেবল নবআবিষ্কৃত এস্তেখারা—পদ্ধতিসমূহের একটির বিবরণ তুলে ধরলাম। অন্যগুলোর আলোচনা করব না। হতে পারে আপনারা তা শিখে ঘরে গিয়ে আমল করতে শুরু করে দেবেন। আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত এস্তেখারা—পদ্ধতির ওপর আমল করুন। শয়তান এতটাই সচেতন ও কুচক্রী যে, কেউ কোনো নেক কাজ শুরু করলে তার প্রথম চেষ্টা থাকে তাকে তা করতেই না দেওয়া। শয়তান তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে যে, আমার কাজ করো। কেউ নেককাজ শুরু করেও দিলেও বিতাড়িত শয়তান কাজটিকে ভেজালমুক্ত রাখতে দেয় না। তার নিজের পক্ষ থেকে কোনো কিছু জুড়ে দেয়।
এস্তেখারার সুন্নত তরীকা
সুন্নত তরীকায় এস্তেখারার সহজ পদ্ধতি হলো, প্রথমে দুই রাকাত নফল নামায পড়বে। এরপর এস্তেখারার দুআ পড়বে। ব্যস। এস্তেখারার দুআতে যতগুলো শব্দ রয়েছে তার সবগুলো এখানে উদ্দেশ্য। দুআ নিম্নরূপ :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي
আরবী দুআ মুখে উচ্চারণের সময় অর্থ ও উদ্দেশ্যের প্রতিও মনোযোগ রাখবে। বিশেষত সর্বশেষ বাক্যের অর্থ। বাক্যটির অর্থ হলো, হে আল্লাহ, যে বিষয়ে আমি আপনার কাছে এস্তেখারা করছি যদি তা আপনার ইলম অনুযায়ী আমার দ্বীন ও দুনিয়ার জন্য বর্তমানেও এবং ভবিষ্যতেও উপকারী ও কল্যাণকর হয় তাহলে আমার জন্য তা নির্ধারণ করে দিন। আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং তাতে বরকত দিন। আর যদি তা আমার দ্বীন ও দুনিয়ার জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে আমার থেকে তা ফিরিয়ে নিন এবং আমাকেও তা থেকে ফিরিয়ে দিন। অর্থাৎ আমি তা করতে চাইলেও যেন করতে না পারি। তার উপায়—উপকরণ দুষ্কর করে দিন। যেন কোনোভাবেই তা ফলপ্রসূ না হয়। যেখানেই আমার কল্যাণ রয়েছে তা আমার জন্য নির্ধারণ করে দিন। এরপর আমাকে তাতে সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দান করুন।
এস্তেখারা বলতে যা বোঝায় তা এতটুকুই যে, দুই রাকাত নফল নামায পড়ে দুআ করে নেবে। এরপর সামনে যা কিছু হবে তাতে কল্যাণ রয়েছে। কাজ হলে তো তাতে কল্যাণ রয়েছে আর না হলে কল্যাণ নেই। এস্তেখারার পর মন যেদিকে ঝুঁকবে আর যে কাজের পথ খুলে যাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস রাখতে হবে, এতেই কল্যাণ রয়েছে। যদি মনের আকর্ষণ দূর হয়ে যায় অথবা সে কাজের উপায়—উপকরণের ব্যবস্থা না হয় কিংবা উপায়—উপকরণের ব্যবস্থা তো ছিল কিন্তু এস্তেখারার পর হাতছাড়া হয়ে যায়, তা হলে পূর্ণ আশ^স্ত থাকুন এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন যে, এতেই আমার কল্যাণ হবে। আমার মন খুব চায় কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমার লাভ ও ক্ষতি কিসে তা ভালোভাবেই জানেন। এ চিন্তা মাথায় থাকলে সহজেই আশ^স্ত হতে পারবেন। এস্তেখারার পর যদি কোনো দিকেই মনের বিশেষ আকর্ষণ অনুভব না করেন তা হলে বাহ্যিক উপায়—উপকরণের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে তাতেই কল্যাণ হবে। এস্তেখারার পর কোনো ক্ষতি হলে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এ সামান্য ক্ষতির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মারাত্মক কোনো ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছেন। এস্তেখারার দুআয় দুনিয়ার আগে দ্বীনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, মুসলমানের দ্বীন হলো মূল আর দুনিয়া তো দ্বীনের অনুগামী।
এস্তেখারায় জোড়াতালি
দেখুন এস্তেখারা কত সহজ। কিন্তু শয়তান এতেও বিভিন্ন বিষয় জুড়ে দিয়েছে। প্রথম সংযোজন হলো দু—রাকাত নামায পড়ে কারও সঙ্গে কথাবার্তা না বলে শুয়ে পড়বে। শোয়া জরুরি। অন্যথায় এস্তেখারা বেকার।
দ্বিতীয় সংযোজন হলো, শুতে হবে ডান কাতে।
তৃতীয় সংযোজন হলো, কেবলামুখী হয়ে শুতে হবে।
চতুর্থ সংযোজন হলো, শোয়ার পর স্বপ্নের অপেক্ষায় থাকো। এস্তেখারা করাকালীন স্বপ্ন দেখবে।
পঞ্চম সংযোজন হলো, স্বপ্নে অমুক রং দেখলে এ কাজ ভালো হবে আর অমুক রং দেখলে বুঝতে হবে তা কল্যাণকর নয়।
ষষ্ঠ সংযোজন হলো, স্বপ্নে কোনো বুযুর্গের আগমন ঘটবে। বুযুর্গের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তিনি এসে সবকিছু বলে দেবেন। ভাবনার বিষয় হলো এ বুযুর্গ কে এবং কেমন? যদি শয়তানই বুযুর্গ সেজে আসে তা হলে সে কী করে বুঝবে যে এটা শয়তান না বুযুর্গ?
মনে রাখবেন, এগুলোর কোনোটিই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। কোনো কোনো লেখক কোনোরকম তাহকীক ছাড়াই কিতাবে লিখে দিয়েছেন। আল্লাহ এ লেখকদের রহম করুন!
অন্য কারও মাধ্যমে এস্তেখারা করানো
এস্তেখারার ক্ষেত্রে মানুষ আরেকটি ভুলের শিকার হয়। এ ভুলটিও শোধরানো প্রয়োজন। ভুলটি হলো, অনেকেই নিজে এস্তেখারা করার পরিবর্তে অন্যকে দিয়ে এস্তেখারা করায়। এ তরিকাও গলদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর নির্দেশনা হলো, প্রয়োজন যার সে নিজেই এস্তেখারা করবে। অন্যকে দিয়ে এস্তেখারা করানো শরীয়তে প্রমাণিত নয়। মানুষের ধারণা হলো, আমরা তো গোনাহগার। আমাদের এস্তেখারার কী মূল্য রয়েছে। তাই অমুক আলেম, বুযুর্গ বা নেককার ব্যক্তিকে দিয়ে এস্তেখারা করানো হলে তাতে বরকত হবে। এ ধারণা ভুল। যার প্রয়োজন সে নিজেই এস্তেখারা করবে। চাই সে নেককার হোক বা গোনাহগার।
বিয়ে—শাদীর সম্বন্ধের ব্যাপারে এস্তেখারা
বিয়ে—শাদীর সম্বন্ধের বিষয়টি অন্যান্য বিষয় থেকে ভিন্ন। এটা কেবল ছেলে—মেয়েদের বিষয়ই নয়, পিতা—মাতারও বিষয়। সঠিক ও উপযুক্ত সম্বন্ধ তো পিতা—মাতাই নির্বাচন করতে পারেন। এটা তাদের দায়িত্ব। তাদেরই এ নিয়ে ভাবতে হয় যে, কোথায় সম্বন্ধ করবে। এ জন্য উত্তম হলো, যে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে, সে নিজেও এস্তেখারা করবে। তার পিতামাতা জীবিত থাকলে তারাও এস্তেখারা করবে।
গোনাহগার ব্যক্তি এস্তেখারা করবে কীভাবে
গোনাহগার ব্যক্তি এস্তেখারা করতে পারে না—মানুষের এ ধারণা দুই কারণে সঠিক নয় :
প্রথম কারণ, গোনাহ থেকে বিরত থাকা আপনার আয়ত্তাধীন বিষয়। মুসলমান হয়েও আপনি কেন গোনাহগার? গোনাহ হয়ে গিয়ে থাকলে খাঁটি দিলে তওবা করুন, গোনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যাবেন। তখন আর গোনাহগার থাকবেন না। নেককারদের কাফেলায় শামিল হয়ে যাবেন। তওবার বরকতে আল্লাহ তাআলা আপনাকে পবিত্র করে দেবেন। আপনি আল্লাহ তাআলার এ দয়া ও অনুগ্রহের মর্যাদা রক্ষা করুন। ভবিষ্যতে জেনেবুঝে আর গোনাহ করবেন না।
দ্বিতীয় কারণ, এস্তেখারার জন্য শরীয়ত এমন কোনো শর্ত আরোপ করেনি যে, এস্তেখারা কেবল আল্লাহর ওলীগণই করবেন, গোনাহগাররা এস্তেখারা করতে পারবে না। শরীয়ত যে শর্ত আরোপ করেনি আপনি নিজ থেকে তা আরোপ করতে পারেন না। শরীয়তের নির্দেশ হলো, যার প্রয়োজন সে যেন এস্তেখারা করে নেয়। চাই সে গোনাহগার হোক বা নেককার। সে যেমনই হোক নিজে এস্তেখারা করবে।
আজকালের সাধারণ মানুষ যেমন, বুযুর্গরাও তেমন। সাধারণ মানুষ বলে, এস্তেখারা করা বুযুর্গদের কাজ আর বুযুর্গরাও ভাবতে শুরু করল, হ্যাঁ, ঠিকই তো। এস্তেখারা করা তো আমাদেরই কাজ। এটা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। জনসাধারণের ভুল শুধরে দেওয়ার পরিবর্তে নিজেই ভুলের শিকার হয়ে গেলেন। তার কাছে যেই আসুক তিনি আগ থেকেই প্রস্তুত হয়ে বসে থাকেন, হ্যাঁ, আসুন। আপনার এস্তেখারা বের করে দিচ্ছি। এস্তেখারা করাকে বলে এস্তেখারা বের করা। তো বলছিলাম, আজকালের জনসাধারণ যেমন তাদের বুযুর্গও তেমন। যেমন আত্মা তেমন ফেরেশতা। এ ভুল শোধরানো খুবই জরুরি।
বয়ানের সারকথা
প্রথম কথা হলো, যে কাজে দ্বীন ও দুনিয়ার কোনো ফায়দা নেই তা থেকে বেঁচে থাকা চাই। অনর্থক বিষয় থেকে বিরত থাকার প্রতি কোরআন ও হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ বয়ানে প্রসঙ্গক্রমে এ বিষয়ে কোরআনে কারীমের একটি আয়াতও তিলাওয়াত করা হয়েছে। হাদীস শরীফেও অনর্থক কথা ও কাজের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরামর্শ করে করবে। তাও নিয়ম অনুযায়ী করবে যা বর্ণনা করা হয়েছে।
তৃতীয় কথা হলো, এস্তেখারার ক্ষেত্রে যে সকল ভুল হয়ে থাকে তা থেকে বেঁচে থাকবে।
আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানকে তার মারেফাত ও মহব্বত দান করে তাদের আকল—বুদ্ধি এ পর্যায়ে উন্নীত করুন যে, ছোট থেকে ছোট কোনো গোনাহের চিন্তা আসামাত্রই লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যায়।
صلى الله وبارك وسلم على عبدك ورسولك محمد وعلى اله وصحبه وصحبه اجمعين والحمد لله رب العلمين.