পরিবারে খুন, নৃশংসতা এবং ব্যাপক সামাজিক ধ্বস
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
মানুষ হত্যা মহাপাপ। ইসলাম হত্যা, খুন, গুম ও নৃশংসতাকে হারাম সাব্যস্ত করেছে। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে কবিরা গোনাহের অন্যতম হচ্ছে ‘কাতলুন নাফস’। নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা ইসলামে মহাপাপ। কোরআন শরীফে মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ یَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهٗ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِیْهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَیْهِ وَلَعَنَهٗ وَاَعَدَّ لَهٗ عَذَابًا عَظِیْمًا ﴿۹۳﴾
যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে তার পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।—সূরা নিসা : ৯৩
ইসলামে খুনির সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। আল্লাহ বলেন,
اَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ
খুনের বদলা খুন।
অপর এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَکَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا ؕ وَمَنْ اَحْیَاهَا فَکَاَنَّمَاۤ اَحْیَا النَّاسَ جَمِیْعًا
কেউ নিরপরাধ কোনো মানুষকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে রক্ষা করল।—সূরা মায়িদা ০৫ : ৩২
হাদীস শরীফেও এসেছে,
لو أن أهل السماء وأهل الأرض اشتركوا في دم مؤمن لأكبهم الله في النار.
আসমান ও জমিনের সকল অধিবাসী মিলেও যদি কোনো মুমিনের রক্তে হাত রঞ্জিত করে তথাপিও আল্লাহ তাআলা তাদের আগুনের উত্তাপ আস্বাদন করাবেন।—জামে তিরমিযী : ১৩৯৮
أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِى الدِّمَاءِ.
কেয়ামতের দিন প্রথমে মানুষের খুনের মামলাগুলো ফয়সালা করা হবে।—সহীহ মুসলিম : ১৬৭৮
সমাজে হত্যা, খুন, নৃশংসতা নানা কারণে দেখা দেয়। শয়তান এক্ষেত্রে মানুষকে প্ররোচিত করে। আল্লাহ বলেছেন,
لَّا تَعْبُدُوا الشَّیْطٰنَ ۚ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ
তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।—সূরা ইয়াসিন ৩৬ : ৬০
নিজের রাগ ও ক্রোধ সংবরণ করা এজন্যই জরুরি। মানুষের মধ্যকার ঝগড়া, ক্রোধ, জিঘাংসা, প্রতিশোধ থেকেই খুন ও নৃশংসতা সংঘটিত হয়ে থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্যায়ের প্রতিকার এবং ন্যায়বিচার প্রচলিত থাকলে বহু খুন, গুম, নৃশংসতা ও অপরাধ থেকে মানবজাতি রক্ষা পায়। যদি অপরাধের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি হয় তাহলে অসংখ্য অপরাধের শিকড় উপড়ে যায়। মানুষ যখন জানে যে, কাউকে খুন করলে নিজেকেও মরতে হবে, তাহলে সে খুন করবে না।
দ্রুততম সময়ে জনসমক্ষে খুনির মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হলে মানুষের মন থেকে খুন করার প্রবণতা ও সাহস দূর হয়ে যেত। ইসলামী বিচার ও শাসনব্যবস্থায় রয়েছে সব সমস্যার সমাধান। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন,
وَلَكُمْ فِی الْقِصَاصِ حَیٰوۃٌ یّٰۤاُولِی الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ
আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে (আল্লাহর দেওয়া বিচারে সমান সমান বদলা লওয়ার নীতিতে) রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।—সুরা বাকারা : ১৭৯
সম্প্রতি খুনের ঘটনা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক নৃশংসতাও দিনদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এক মেয়ে তার মা, বাবা ও ছোট বোনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, হাত বা বেঁধে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই মেয়ে তার প্রথম স্বামীকেও হত্যা করেছিল বলে মিডিয়া জানায়। খুনি তার বর্তমান স্বামী, শিশুকন্যা ও কনিষ্ঠ বোনকেও ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রাখে। পুলিশ এসে মৃতদের লাশ দেখতে পায়। তারা অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এবং খুনিকে গ্রেফতার করে।
ইদানীং দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন পারিবারিক নৃশংসতার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যা। সন্তানদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মায়ের নিজেরও গলায় দড়ি দিতে দেখা গেছে। স্ত্রী—সন্তানকে হত্যা করেছে পুরুষ। পরকীয়া করে নিজের স্বামীকে খুন করানো। এ ধরনের কিছু ঘটনা অহরহ সমাজে ঘটতে দেখা যায়।
এসবের পেছনে মূলত ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব এবং সুশিক্ষা না থাকা দায়ী। পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চরম সঙ্কটও দায়ী। দায়ী মানবিকতার চর্চা কমে যাওয়া। মুসলিম সমাজে ইসলামী অনুশাসন না মানার ফলে হাজারো সমস্যা তৈরি হয়। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় ও আদর্শিক শূন্যতা থেকেও এমন ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। অন্যায় দুর্নীতি অবিচার নাগরিকদের সকল ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। মানুষ দায়িত্বহীন হয়ে গেলে তখন অপর মানুষেরা অধিকার—বঞ্চিত হয়।
অমানবিক সমাজে বহু মানুষ তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনে চলে যায় আর কিছু লোক হয়ে যায় বিপথগামী। সমাজ তার দায়িত্বে অবহেলা করলে মানুষের অন্যায় ও পাপাচার সমাজের ওপরই গজব হয়ে ফিরে আসে। সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজ প্রতিরোধের কাজ রাষ্ট্র, সমাজ এবং সম্প্রদায় যখন ছেড়ে দেয় তখন মানুষের জীবনে আযাব নেমে আসে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন না থাকলে আর মনুষ্য বসবাসের উপযোগী থাকে না। এজন্যই ধর্ম মানুষকে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পাহারা দেয়। পথনির্দেশ দেয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ¯্রষ্টাকে ভয় করে চলার মনমানসিকতা না থাকলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। পরকালে জবাবদিহির চেতনা জাগ্রত না থাকলে মানুষ পশুর চেয়েও অধম হয়ে দাঁড়ায়।
পবিত্র কোরআনে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদেরকে বারবার বলেছেন ধৈর্য ও সবর অবলম্বন করতে। চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছেন,
اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।—সূরা বাকারা ০২ : ১৫৩
আমাদের সমাজে অসংখ্য নজির আছে যে, একবেলা ভাত খেয়ে, একটি কাপড় পরে, সামান্য ছাদের নিচে মাথা গুঁজে কোটি নারী ইজ্জত—সম্মান, পর্দা, পবিত্রতা নিয়ে জীবনযাপন করেন। ধর্মপ্রাণ তরুণীরা কঠোর সাধনার মাধ্যমে খেয়ে না খেয়ে সততা পবিত্রতা ও উচ্চ আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে এ সমাজে যুগ যুগ ধরে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। তারা ঈমান এনেছে, নামায পড়ে, হালাল খায় আর দরদি মন নিয়ে সৎকর্ম করে। সর্বোপরি এরা ধৈর্যশীল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَکَرٍ اَوْ اُنْثٰی وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْیِیَنَّهٗ حَیٰوۃً طَیِّبَۃً.
পুরুষ ও নারীদের মধ্য থেকে যেসব ঈমানদার নেক আমল করবে তাদের আমি উত্তম বিনিময় দান করব।—সুরা নাহল ১৬ : ৯৭
ইসলামে ধৈর্য তিন প্রকার :
এক. ধৈর্য ধরে আল্লাহর ইবাদত ও সৎকাজে লেগে থাকা।
দুই. আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ, অন্যায়, অশ্লীলতা, পাপাচার থেকে ধৈর্যের সাথে বিরত থাকা।
তিন. জ্বরা, ব্যাধি, মৃত্যু, অভাব ও বিপদে ধৈর্যধারণ করা।
ধৈর্য ধরা খুবই কঠিন কাজ। শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির আহ্বানকে অস্বীকার করে নিজেকে নেকির পথে, ন্যায়ের পথে, ধৈর্যের পথে মজবুত রাখা একটি জীবনব্যাপী যুদ্ধের নাম। জীবনের যাত্রাপথে দুঃখ—কষ্ট বরণ করা কিন্তু তবুও লোভ, লালসা, দুর্নীতি ও পাপাচারের পথে না যাওয়া—এক বিশাল মাপের ধৈর্য। এজন্যই বলা হয়, সবুরে মেওয়া ফলে। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। অধৈর্য বা অস্থিরতা মানুষকে ধ্বংস, বিব্রত ও লজ্জিত করে। বলা হয়, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। লোভে পড়ে বেঘোরে ঈমানহারা মৃত্যু জাহান্নামের কারণ হয়।
মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ জেনেছে যে, স্বামী সউদি প্রবাসী। স্ত্রী নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অভাবী নন। সুন্দরী এ মহিলা নিজে আরও বেশি সম্পদ ও ভোগ—বিলাসের লোভে দেহব্যবসায় নামেন। বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন ক্ষমতাসীন লোকের সাথে। এর পর নেটওয়ার্ক বড় করতে থাকেন। হয়ে যান চরিত্রহীনাদের সর্দারনি। পাপাচারী পুরুষের লালসার উসকানি ও জোগানদাতা। অমানুষ হয়ে পড়েন এ নারী। নিজের পেটের দুই প্রিয়দর্শিনী নিষ্পাপ সন্তানকেও তার ক্লায়েন্টদের কাছে যেতে বাধ্য করেন। লোভ তাকে অন্ধ করে দেয়।
স্বামীর আয় ও নিজের ধৈর্যের পরিবেশ তার পছন্দ হয়নি। তিনি লোভ, লালসা ও কামনার দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়েন। দীনের আহ্বানে, ধর্মীয় মনমানসিকতায়, তালীম ও ইবাদত—বন্দেগীর পরিবেশে তিনি নিজেকে আটকে রাখেননি। যেসব ব্যবস্থায় তার চারপাশের কোটি নারী সুন্দর, নিরাপদ, পবিত্র ও আত্মসম্মানের জীবনযাপন করছেন, ধৈর্য তাদের জান্নাতের পথ দেখাচ্ছে।
নিজ মেয়ের হাতে খুন হওয়া এমন এক নারী আজ কবরে রয়েছেন। গণমাধ্যম ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, একসময় এ নারীর বন্ধু নামক লম্পট পুরুষ তার মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে এবং তাদের বিয়ে হয়। উচ্ছৃঙ্খল লোভী ও পাপাচারীদের যেমন বন্ধুত্ব, পাপ, পুণ্য, বিয়ে, ব্যভিচার, স্ত্রী, কন্যা, শাশুড়ি বলতে কোনো কিছুরই পার্থক্য থাকে না। শয়তানের পূর্ণ গিরেফতে চলে গিয়ে তারা নিজেরাও শয়তানী চরিত্রের হয়ে যায়।
মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যমতে, যা সত্য—অসত্য দুটোই হতে পারে, যৌনতার পাশবিকতার চোখে মা ও মেয়েকে সমানভাবে দেখার ফলে সবাই মিলে খুন করে ফেলে ওই মায়ের বন্ধু ও মেয়ের স্বামীকে। যারা হত্যা করে বলে মামলা হয় তারা সে ধৈর্যহারা লোভী ও তার মাধ্যমে দেহব্যবসায় যুক্ত এবং দুনিয়ার পাপ, পঙ্কিলতা, কলুষতায় ত্যক্ত, বিরক্ত পরিবার, বিশেষ করে এই খুনি কন্যা। এভাবেই কন্যাটি একবার স্বামী খুনের দায়ে জেল খাটে।
দ্বিতীয়বার আরেক লোককে বিয়ে করে এবং বাবা—মায়ের কাছে সম্পত্তি দাবি করে। ধারণা করা হয় ছোট বয়সে মা তাকে দিয়ে দেহব্যবসা করিয়ে যে অর্থসম্পদ জড়ো করেন, তার বড় ভাগটি নগদে পাওয়ার জন্যই এ জেলখাটা মেয়ে বারবার ঝগড়াঝাটি করতেন। সর্বশেষ সে হয়তো বাবা—মার ওপর চাপ দিতেই কথা তুলে দেয় যে, তার বর্তমান স্বামীর সাথে তার ছোট বোনের পরকীয়া আছে। মা চক্রান্ত করে তার সংসার ভাঙছে।
আমাদের বাংলাদেশে এমন ধর্ম, সমাজ ও মানবতাবিরোধী ঘৃন্য জীবনাচার কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়, হতে পারে না। অনুতাপ, অনুশোচনা, আত্মজাগরণ থেকে কিংবা নিজের জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দুঃখ, কষ্ট ও খেদে এই বড় মেয়েটি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, হাত—পা—মুখ বেঁধে নিজের বাবা, মা ও ছোট বোনটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। স্বামী—সন্তানকেও ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রাখে। তাদেরকে সে হত্যা করেনি। নিজেও আত্মহত্যা করেনি। ঠান্ডা মাথায় নিজেই আবার পুলিশকে ফোন করে বলে, তিনজনকে খুন করেছি। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন। দেরি করলে বাকি সবাইকে খুন করব। পুলিশ এসে এ আত্মস্বীকৃত খুনি নারীকে গ্রেফতার করে। যিনি আগে তার প্রথম স্বামীকে হত্যার দায়ে বহু বছর জেল খেটেছেন।
বাংলাদেশের এমন ঘটনা কী ইঙ্গিত দেয়। আমাদের সমাজ ধ্বংসের পথে কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনে বর্ণিত সবগুলো অপরাধ শাস্তিযোগ্য হলেও নির্বিঘ্নে বছরের পর বছর এখানে পরকীয়া, দেহব্যবসা, নারী সাপ্লাই, নারী ও শিশু নির্যাতন, অযাচার, বেহায়াপনা, অসামাজিকতা, নোংরামি আরামছে চলেছে। গণমাধ্যম, পুলিশ প্রশাসন, সমাজ ইত্যাদি কেউই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত লোভ, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, জিঘাংসা, মনোবৈকল্যের মিশ্র ও জটিল প্রতিক্রিয়া তিনটি পরিবারকে মৃত্যু, ধ্বংস ও মর্মান্তিক নিয়তি উপহার দিল।
বলতে দ্বিধা নেই, একমাত্র ইসলামী আইন, বিচার ও অনুশাসনই পারত এ ধরনের সমস্যাকবলিত ভাগ্যাহত পরিবারগুলোকে প্রথম দিন থেকেই সুন্দর ও সফল জীবন উপহার দিতে। কিন্তু লোভ, লালসা, উচ্চাভিলাস, অনৈতিক ভোগ—বিলাস যখন মানুষকে অন্ধ ও অধীর বানিয়ে ফেলে, তখন তাদের আর ধর্মের কথা শোনার সময় বা রুচি থাকে না। ফলে দুনিয়াতে তারা আকছার দুঃখ—বেদনা হতাশা ও অশান্তির আগুনে জ্বলেপুড়ে মান—সম্মান, সুখ—শান্তি এবং জীবন পর্যন্ত হারায়।
কোনো কারণে আল্লাহ বিশেষ ক্ষমার ব্যবস্থা না করলে এমন লোকেদের আখেরাত বরবাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। আর ইসলামী আইন, শাসন, বিচার ও সমাজব্যবস্থার কথা তো বেদীন সমাজে বলাও এখন অপরাধ। অথচ এসব সমস্যা ও পরিণতি নিয়ন্ত্রণ এবং দূরীকরণে ইসলামী জীবনব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, ইসলাম মানবজাতির মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী শিক্ষা, প্র্যাকটিস, মোটিভেশন থেকে শুরু করে সমস্যার শিকড় পর্যন্ত আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিচারিক দিকের সমন্বয়ে বাস্তব ও সযত্ন সমাধান দিয়ে থাকে। দুনিয়ার আর কোনো পলিসি বা সিস্টেম এসব সমস্যার সমন্বিত সমাধান দিতে কোনো দিনই সক্ষম নয়।
বিশ্বব্যাপী অপরাধ জগতে এখন সীমাতিক্রম চলছে। সভ্য অসভ্য কোনো জনপদই নিরাপদ নয়। অন্যায়, অনাচার, জুলুম, পাপাচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, মাদক, সন্ত্রাস ইত্যাদিতে মানবজাতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেও সমাধানের পথে আসতে তারা উদার নয়। ইসলামী মূল্যবোধ, মোটিভেশন, আইন, বিচার, শাসন ও দীনি তত্ত্বাবধানকে তারা গ্রহণ করতে নারাজ। শয়তান তাদের অন্তকরণে মোহর মেরে দিয়েছে। তাদের চোখে পর্দা, কানে তালা, মুখে কুলুপ, চিন্তা—চেতনা ও বোধে প্রতিবন্ধিতা।
বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মানুষ ইসলামের আলো লাভ করেও কেন যেন উদাস। অবহেলা করছে কোরআন—সুন্নাহকে। ইসলামী জীবনবোধকে তারা অবলীলায় উপেক্ষা করে চলেছে। অল্পকিছু মানুষই দীনকে ভালোবেসে জীবনে বাস্তবায়িত করে। অধিকাংশই দীনকে মুখে স্বীকার করলেও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে না। সমাজের কর্তা ও দায়িত্বশীলরা তো অনেকাংশেই দীনবিমুখ। মনোচেতনায়, কথা ও কাজে তাদের অনেকে ইসলামবিদ্বেষী। ধ্বংস ও জাহান্নামকে মেনে নেবে কিন্তু ইসলামকে ভালোবেসে মেনে নেবে না।
সুযোগে ইসলামপ্রচারক, কোরআন—সুন্নাহর ধারক—বাহক শ্রেণিটিকে আঘাত, বদনাম এমনকি নির্মূল করার চিন্তাও তারা পেটে পেটে করে। সময় সময় তাদের কথা, কাজ ও ভূমিকায় এসব প্রকাশও পেয়ে যায়। অথচ হাজার বছরে পীর—মাশায়েখ, ওলী—আউলিয়া, আলেম, ইমাম, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সংগ্রাম ও সাধনায় তৈরি সমাজকে তারা দিনে দিনে ধ্বংসের অতলে ঠেলে দিচ্ছে।
একজন নারীর পক্ষে পরিবারের প্রতি এমন নৃশংসতা কি চিন্তা করা যায়। তার বাবা ২৫ বছর প্রবাস কাটালেন কেন। তার মা কেন এমন অভ্যাস, পেশা ও জীবন বেছে নিলেন। কেন তিনি নিজ গর্ভের দুটি ফুলের মতো নিষ্পাপ কন্যাকে প্রথম এ পথে নামালেন। কেন চরিত্র ও নৈতিকতার কথা তার মনে পড়ল না। পর্দার কথা কি সে কোনোদিন শুনেনি।
মা মেয়ের একই ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্ক বা তথাকথিত বন্ধুত্ব কী করে হয়। ছোট বোন কী করে বড় বোনের স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। এ সবকিছু জেনেশুনে তাদের বাবা কেন এ সংসারে নীরবে অবস্থান করেন। তাদের মা কি শরীয়ত, আইন, সমাজ, সভ্যতা, রুচি ও মনুষ্যত্বের কিছুই জানতেন না? এমন শত প্রশ্ন এখন উঠবে।
তবে এসবের সত্যাসত্য যাচাই বা উদ্ভূত প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর জানার জন্য তার পূর্বের স্বামী, বাবা, মা ও ছোট বোনটি বেঁচে নেই। খুনি অপরাধী মেয়ের জবানবন্দি থেকে শোনা বাবা, মা ও বোন সম্পর্কিত সব ধরনের কথাই এখন হতে পারে অপরাধীর বানানো উক্তি। সত্যি ঘটনা আল্লাহ ছাড়া কেউ আর উদঘাটনের ক্ষমতা রাখে না। জানা নেই, আদালত আত্মস্বীকৃত খুনি মেয়েটির ব্যাপারে কী রায় দেয়। তবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এ অবক্ষয় আর মর্মান্তিক বিপর্যয় অনেক জটিল একটি কেসহিস্ট্রি। এই মেয়ের বিচিত্র মনোদৈহিক কেমিস্ট্রির বিশ্লেষণ মহাজ্ঞানী শরীয়া বিশেষজ্ঞ ইসলামী বিচারক ও জুরি বোর্ড ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। একমুখী শিক্ষিত আধুনিক বিচারকরা তো এসব জানারই কথা নয়।
মজা হতো যদি কোনো শরীয়তি আদালতে এ মামলাটি উঠত। ঘটনার শুরু থেকে ইসলামী ও সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, ঈমান, নামায, হালাল উপার্জন, স্ত্রী থেকে স্বামীর দীর্ঘ সময় দূরে থাকা, মেয়েদের শিক্ষা, সম্মান, নিরাপত্তা, স্ত্রীকে শাসনের সীমানায় রাখা, ধর্মীয় জীবনাচার, সামাজিক বন্ধন ও শাসন, অল্পেতুষ্টি, ধৈর্য, সহজ—সরল আর্থিক জীবন, মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক জীবনবোধ, পরপুরুষের সাথে খোলামেলা আচরণ, অবাধ মেলামেশা, বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, নাগরিক অসামাজিকতা, আত্মীয়—স্বজন ও বংশীয় বলয় থেকে দূরত্ব ইত্যাদি পয়েন্ট থেকে কেসস্টাডি হলে এটি একটি মাইলফলক বিশ্লেষণ ও বিচার হতে পারত।
কিন্তু কোরআন, সুন্নাহ, শরীয়ত ও দীনধর্ম তো এখন এদেশে কিছু দরদি লোকের ঈমানী দায়বদ্ধতার ফলে নামমাত্র ও চরম উপেক্ষিত অবস্থায় টিকে আছে মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। ইসলামের সমাজ শাসন আইন ও বিচারব্যবস্থা এখানে ব্যাপকভাবে জননন্দিত নয়। শরীয়ত যদিও অনেকের আচরিত, বহু কাক্সিক্ষত। তবে কিছু লোকের চোখের বালিও বটে। পারলে ধর্মহীনতার দোহাই দিয়ে তারা ইসলামের নাম—নিশানাটুকুও মুছে দিতে চায়।
এমন ধর্ম সমাজ ও সুশাসনবিরোধী সামাজিক জীবনযাত্রা একটি—দুটি নয়, দেশ ও প্রবাসের হাজারো পরিবারকে নরকের আগুনে নিক্ষেপ করেছে। লোকচক্ষু লজ্জায় মানুষ সব প্রকাশ না করলেও হাজারো ব্যক্তি, পরিবার এবং প্রায় গোটা সমাজ অভ্যন্তরীণ অশান্তির তুষের অনলে জ্বলে—পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। অথচ ইসলামী জীবনবোধ, ঈমানী চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও কোরআনী আমল—আখলাকের সুশীতল ছায়ায় তারা আসতে নারাজ।
দীনি জীবনের বরফশীতল সুখচ্ছায়ায় তারা প্রবেশ করতে কেন জানি ভয় পায়। শয়তান এখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা, রহমত ও চিরস্থায়ী জান্নাতের ডাকে মানুষ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সাথে সাড়া দেয় না। সবকিছু জেনে—বুঝেও মানুষ শয়তানের বৃত্তেই বন্দি থাকে। দীনি জীবনের ঐশী আনন্দলোকে মানুষ প্রবেশ করে না।