পারিবারিক জীবন : কিছু জরুরি কথা
ইসলাহী মজলিস
পারিবারিক জীবন : কিছু জরুরি কথা
মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ
الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى، اللّهم صلّ على سيّدنا ونبيّنا وشفيعنا وحبيبنا ومولانا محمد صلى الله تعالى عليه وعلى آله وأصحابه وبارك وسلم، أما بعد :
فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم وَعَاشِرُوْهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ صدق الله العظيم
وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : الْمَرْأَةُ كَالضِّلَعِ إِنْ أَقَمْتَهَا كَسَرْتَهَا وَإِنْ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَفِيهَا عِوَجٌ رواه الإمام البخاري رحمه الله تعالى
وعن أبي هريرة رضي الله تعالى عنه وعنهم قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا وخياركم خياركم لنسائهم، رواه الإمام الترمذي رحمه الله تعالى.
পারিবারিক জীবন
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন
وَعَاشِرُوْهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ.
অর্থাৎ স্ত্রীদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো। নেককার সে ব্যক্তি যে সকল মাখলুকের হক আদায় করে। আমার ওপর যাদের হক আছে তার মধ্যে স্ত্রীর হক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিচ্ছেন। স্ত্রীর পক্ষ থেকে অপছন্দনীয় কোনো আচরণ প্রকাশ পেলেও সবর করতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে-
الْمَرْأَةُ كَالضِّلَعِ إِنْ أَقَمْتَهَا كَسَرْتَهَا وَإِنْ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَفِيهَا عِوَجٌ.
নারী জাতি বুকের পাঁজরের হাড়ের মতো। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙে ফেলবে। আর যদি তার থেকে উপকৃত হতে চাও তাহলে বক্রতাসহই উপকৃত হতে হবে।—সহীহ বুখারী
আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন হযরত আদম আ.—এর বাম পাঁজরের হাড় থেকে হযরত হাওয়া আ.—কে সৃষ্টি করেছেন। এরপর তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। হাদীস শরীফে বলা হচ্ছে, নারী জাতি পাঁজরের হাড়ের মতো। পাঁজরের হাড় যেমন বাঁকা তাদের আচার—আচরণেও কিছুটা বক্রতা থাকবে। এ বক্রতা মেনে নিয়েই সংসার করতে হবে। সৃষ্টিগত এ বক্রতা সোজা করতে গেলে সোজা তো হবেই না; বরং আরও ঝামেলা বৃদ্ধি পাবে। অতএব বৈবাহিক জীবনে স্ত্রী থেকে এ ধরনের আচরণ প্রকাশ পাবে—এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মেনে নিতে হবে।
নবীজীবনের কয়েকটি ঘটনা
দেখুন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর স্ত্রীদের চেয়ে উত্তম নারী পৃথিবীতে আর কে হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর বিবিদের থেকেও এ ধরনের কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা রাযি.—কে সবচেয়ে বেশি মহব্বত করতেন। সেই আয়েশা রাযি.—এর ঘটনা শুনুন। তিনি নিজেই বলেন, একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন̶
إنِّي لَأَعْلَمُ إذا كُنْتِ عَنِّي راضِيَةً، وإذا كُنْتِ عَلَيَّ غَضْبূى، قالَتْ: فَقُلتُ: مِن أيْنَ تَعْرِفُ ذلكَ؟
فقالَ: أمَّا إذا كُنْتِ عَنِّي راضِيَةً، فإنَّكِ تَقُولِينَ: لا ورَبِّ مُحَمَّدٍ، وإذا كُنْتِ عَلَيَّ غَضْبى، قُلْتِ: لا ورَبِّ إبْراهِيمَ،
قالَتْ: قُلتُ: أجَلْ
আয়েশা, তুমি কখন আমার প্রতি রুষ্ট থাকো আর কখন সন্তুষ্ট থাকো তা আমি বুঝতে পারি।
আমি বললাম, আপনি কীভাবে তা বুঝতে পারেন?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে বলো, ورَبِّ مُحَمَّدٍ তথা মুহাম্মদের রবের কসম। আর যখন তুমি আমার ওপর রুষ্ট থাকো তখন বলো, ورَبِّ إبْراهِيمَ তথা ইবরাহীমের রবের কসম!
আমি বললাম, আপনি ঠিকই বলেছেন।—সহীহ বুখারী
দেখুন, নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর প্রিয়তম স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো কখনো নবীর প্রতি রুষ্ট হতেন। বলুন, নবীর স্ত্রী যদি নবীর ওপর রুষ্ট হয়ে থাকেন তো আমাদের স্ত্রীরা আমাদের ওপর রুষ্ট হবে কি না?
হযরত আয়েশা রাযি.—এর ওপর একবার জিনার অপবাদ দেওয়া হলো। মুনাফিকরা বিষয়টি নিয়ে বেশ চর্চা করতে লাগল। ওদিকে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকেও কোনো ফয়সালা আসছে না। দীর্ঘ সময় ওহী বন্ধ ছিল। হযরত আয়েশা রাযি. বাবার বাড়িতে চলে গেলেন। এরপর আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে হযরত আয়েশা রাযি.—এর পবিত্রতার বিবরণসহ আয়াত নাযিল হলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আয়েশা, সুসংবাদ গ্রহণ করো, আল্লাহ পাক তোমার পবিত্রতার বিষয়ে কোরআনে আয়াত নাযিল করেছেন। এ কথা শুনে হযরত আয়েশা রাযি.—এর বাবা—মা বললেন, আয়েশা, ওঠো নবীজির কাছে যাও।
তখন হযরত আয়েশা রাযি.—এর মনে নবীজির প্রতি ক্ষোভ কাজ করছিল । তাই তিনি বললেন̶
وَاللَّهِ لَا أَقُومُ إِلَيْهِ وَلَا أَحْمَدُهُ وَلَا أَحْمَدُكُمَا وَلَكِنْ أَحْمَدُ اللَّهَ الَّذِي أَنْزَلَ بَرَاءَتِي.
আল্লাহর কসম, আমি তাঁর কাছে যাব না, তাঁর প্রশংসাও করব না। আপনাদেরও প্রশংসা করব না। আমি বরং আল্লাহর প্রশংসা করব। যিনি আমার পবিত্রতার বিবরণ দিয়ে কোরআন নাযিল করেছেন।—সহীহ বুখারী
আমরা জানি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একাধিক স্ত্রী ছিল। স্ত্রীদের পরস্পরেও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। একবারের ঘটনা হযরত আনাস রাযি. বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোনো এক স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করছিলেন। এ সময় অপর কোনো স্ত্রীর ঘর থেকে একটি পাত্রে করে খাবার পাঠানো হলো। খাদেমা খাবার নিয়ে এলে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে স্ত্রীর ঘরে ছিলেন তিনি খাদেমার হাত থেকে খাবারের পাত্রটি মাটিতে ফেলে দিলেন। পাত্রটি ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। খাবার মাটিতে পড়ে গেল। এ পরিস্থিতি দেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে গিয়ে পাত্রের ভাঙা অংশ একত্র করলেন। পড়ে যাওয়া খাবার তুললেন। বললেন, তোমাদের মায়ের আত্মসম্মানে লেগেছে। (অর্থাৎ তার ঘরে থাকা অবস্থায় কেন অন্যজন খাবার পাঠাতে গেল, এতে তার আত্মসম্মানে লেগেছে।)
এরপর নবীজি এ ঘর থেকে একটি ভালো পাত্র দিয়ে খাদেমাকে পাঠিয়ে দিলেন।—সহীহ বুখারী
তো এ ঘটনাগুলো থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? সংসারজীবনে এমন ঘটনা ঘটাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে নবীজি কী করেছেন? সবর করেছেন। নীরবে সয়ে নিয়েছেন। আমাদেরকেও নবীজির সুন্নাহ মেনে চলতে হবে। এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন̶
أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا وخياركم خياركم لنسائهم.
ঈমানে পরিপূর্ণ সে ব্যক্তি যে আখলাকের দিক থেকে সর্বোত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ওই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।—জামে তিরমিযী
স্ত্রীর সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে
মনে রাখবেন, আমি সাথি—সঙ্গীদের সঙ্গে ভালো। বাইরে সবার কাছে প্রিয়। কিন্তু স্ত্রীর কাছে ভালো নই, তাহলে হাদীসের ভাষায় আমি ভালো নই। আমার ভালো—খারাপের সনদ দেবে আমার স্ত্রী। দেশ—বিদেশের বড় বড় শিক্ষা—প্রতিষ্ঠানের সনদে কাজ হবে না। এখন কথা হলো স্ত্রীর আচরণে আমাকে সবর করতে হবে কেন? এর কিছু যৌক্তিক কারণ শুনুন :
এক. স্বামী—স্ত্রীর মাঝে বয়সে বড় কে? সাধারণত স্বামী বয়সে বড় এবং স্ত্রী ছোট হয়ে থাকে। স্ত্রী সাধারণত স্বামী থেকে ৬/৭ বছর বা কখনো আরও বেশি ছোট হয়ে থাকে। একটু চিন্তা করে দেখুন তো, এ বয়সে আমি কেমন ছিলাম? আমার বোঝ কেমন ছিল? আচার—আচরণ কেমন ছিল? এ বয়সে আমি বাবা—মার সঙ্গে কত রাগ করেছি। খারাপ আচরণ করেছি। আমার স্ত্রী এখন যে বয়সে আছে সে বয়সে যদি আমার বোঝ কম থেকে থাকে আর আচার—আচরণ ভালো না থাকে, রাগ একটু বেশি থেকে থাকে, তাহলে স্ত্রীর বেলায় কেন এটা বুঝতে চাই না। স্বাভাবিক যুক্তিই তো বলে, তার থেকে বয়স হিসেবে কিছু ভুল—ত্রুটি হবেই। অতএব আমাকে সবর করতে হবে।
দুই. বিয়ের পর কে নিজ বাড়ি ছেড়ে অপরিচিত এক পরিবেশে যায়? স্ত্রীকেই তার বাবা—মা, ভাই—বোন ও নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় একেবারে অপরিচিত একটি পরিবারে। সেখানে গিয়ে তাকে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদসহ সকলের মন তুষ্ট করতে হয়। একেকজনকে একেকভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। এমনিতেই স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বয়সে ছোট। তার ওপর তাকে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পরিবেশে অবস্থান করতে হয়। চারপাশের মানুষগুলোও অপরিচিত। এমন পরিস্থিতিতে আপনার পক্ষেও কি সকলের মন রক্ষা করা, সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা সম্ভব হবে? আপনি পুরুষ হয়ে এবং স্ত্রীর চেয়ে বয়সে বড় হয়েও যদি তা না পারেন বা কঠিন হয় তাহলে স্ত্রীর বেলায় বিষয়টি আমরা কেন বুঝতে চাই না? অতএব এক্ষেত্রে স্ত্রীর ভুল হলে সবর করতে হবে।
তিন. পড়ালেখা ও জানাশোনা কার বেশি থাকে? সাধারণত স্বামীরই পড়ালেখা, জানাশোনা ও অভিজ্ঞতা বেশি থাকে। সে তুলনায় স্ত্রীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কম থাকে। এ পরিস্থিতিতে স্ত্রী থেকে কোনো ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। অতএব আমাকে সবর করতে হবে।
চার. ঘরের কাজ কে করে? স্ত্রীই ঘরের কাজ করে। সবার খাবারের ব্যবস্থা করে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। আপনার চেয়ে বয়সে ছোট, অভিজ্ঞতায় অপরিপক্ব একটি মেয়ে নিজের ঘর—বাড়ি ও পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে আপনার নতুন ও অপরিচিত পরিবেশে এসে সবার জন্য যে কাজ করে যাচ্ছে, তা কি বিরাট ব্যাপার নয়?
এখন তো কোথাও কোথাও কাজের লোক রান্না করে। স্ত্রীর রান্না আর কাজের লোকের রান্না কি এক হতে পারে কখনো? রান্নায় পরিষ্কার—পরিচ্ছন্নতা ও পাক—পবিত্রতারও তো একটি ব্যাপার থাকে। কাজের মহিলা এ বিষয়ে কতটা যত্নবান হবে? ওদের তো এ বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞানও নেই। পবিত্রতার মাসায়েলও জানা থাকে না। এ অবস্থায় কাজের লোকদের দিয়ে রান্না করানো কতটা যুক্তিযুক্ত একটু খেয়াল করে দেখি?
হযরত ফাতেমা রাযি.—এর ঘটনা
হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর স্নেহের কন্যা হযরত ফাতেমা রাযি.—এর জীবনী দেখুন। তিনি নিজ হাতে ঘরের কাজ আঞ্জাম দিতেন। নিজ হাতে চাক্কিতে গম পিষে আটা প্রস্তুত করতেন। এ কাজ খুব সহজ ছিল না। গম পিষতে পিষতে হযরত ফাতেমা রাযি.—এর হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। তিনি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর কাছে গেলেন একজন খাদেমের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলতে। কিন্তু নবীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না। ফলে হযরত আয়েশা রাযি.—কে নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে এলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে তাশরীফ আনলে আয়েশা রাযি. হযরত ফাতেমা রাযি.—এর আগমনের কথা জানালেন। ঘটনা শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতেমা রাযি.—এর ঘরে গেলেন। হযরত আলী রাযি. ও হযরত ফাতেমা রাযি.—এর মাঝে বসলেন। বললেন̶
أَلَا أُعَلِّمُكُمَا خَيْرًا مِمَّا سَأَلْتُمَانِي إِذَا أَخَذْتُمَا مَضَاجِعَكُمَا تُكَبِّرَا أَرْبَعًا وَثَلَاثِينَ وَتُسَبِّحَا ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ وَتَحْمَدَا ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمَا مِنْ خَادِمٍ.
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে আমার কাছে যা চেয়েছ তার চেয়েও উত্তম কিছু শিক্ষা দেব। তা হলো, যখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাবে তখন ৩৪ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ এবং ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করবে। এটা তোমাদের জন্য খাদেম থেকেও উত্তম।—সহীহ বুখারী
দেখা গেল হযরত ফাতেমা রাযি. নিজ হাতেই ঘরের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর কাছে কাজের লোক চাইলেও নবীজি আমল শিক্ষা দিয়েছেন। এভাবে তিনি আজীবন নিজ হাতে কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই শিক্ষণীয়। তো আমি বলছিলাম, স্ত্রী যেহেতু ঘরের কাজ আঞ্জাম দেয় অতএব তার সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। আমার মনের বিরুদ্ধে কিছু বললে সবর করতে হবে।
হযরত উম্মে সালামা রাযি. একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন̶
أنساء الدنيا أفضل أم الحور العين؟
দুনিয়ার মহিলারা শ্রেষ্ঠ হবে নাকি জান্নাতের হুর।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন̶
قال: بل نساء الدنيا أفضل من الحور العين.
দুনিয়ার মহিলাই শ্রেষ্ঠ হবে।
এ কথা শুনে হযরত উম্মে সালামা রাযি. জানতে চাইলেন, কেন? দুনিয়ার মহিলারা জান্নাতের হুর থেকে উত্তম হবে কেন?
নবীজি সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
بصلاتهنَّ وصيامهنَّ وعبادتهنَّ الله.
কারণ, তারা দুনিয়াতে নামায পড়েছে, রোযা রেখেছে, আল্লাহর হুকুমমতো জীবনযাপন করেছে।—তাবারানী
বোঝা গেল, দুনিয়াতে আল্লাহর হুকুমমতো চললে দুনিয়ার মহিলাদেরকে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের হুরদের চেয়েও সুন্দর করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যে হুরদের বিবরণ এসেছে অনেক হাদীসে। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَلَنَصِيفُهَا عَلَى رَأْسِهَا خَيْرٌ مِنْ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا.
জান্নাতের হুরদের মাথায় যে উড়না থাকবে তা দুনিয়া ও দুনিয়ায় যত কিছু আছে সবকিছুর চেয়ে উৎকৃষ্ট হবে।—সহীহ বুখারী
তো জান্নাতের সে মহান সম্মান লাভের জন্য মহিলাদের কষ্ট করতে হবে। নামায, রোযার পাবন্দ হতে হবে। ইবাদতে মনোযোগী হতে হবে। স্বামীর আনুগত্য করতে হবে। নিজের ঘরের কাজ নিজ হাতে আঞ্জাম দিতে হবে।
পাঁচ. পুরুষের তুলনায় সাধারণত মহিলাদের বিচার—বুদ্ধি কম। বোঝশক্তি কম হওয়ার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে এমন আচরণ করবে যার কারণে স্বামীর কষ্ট লাগতে পারে। বিষয়টি হাদীস শরীফেও এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন̶
لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ كُلَّهُ ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ.
তুমি একযুগ তার সঙ্গে সদাচার করার পর কেবল একদিন ভিন্ন আচরণ পেয়ে বলে বসবে, তোমার থেকে কখনই ভালো কিছু পাইনি।—সহীহ বুখারী
তো এখানে পাঁচটি দিক উল্লেখ করা হলো, যে পাঁচটি দিক বিবেচনায় আমাদেরকে স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। স্ত্রীর সঙ্গে সর্বোচ্চ আখলাকের পরিচয় দিতে হবে। স্ত্রী থেকে মনের বিপরীত কিছু প্রকাশ পেয়ে গেলে সবর করতে হবে। ওপরের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি, এ ধরনের আচার—আচরণ প্রকাশ পাওয়া স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতিগুলোর জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এতটুকু বক্রতা একজন নারীর মধ্যে থাকবেই। এটাকে জোর—জবরদস্তি করে সোজা করা সম্ভব নয়। জোর করতে গেলে ফলাফল বিপরীত হবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ হাদীস মনে রাখতে হবে̶
الْمَرْأَةُ كَالضِّلَعِ إِنْ أَقَمْتَهَا كَسَرْتَهَا وَإِنْ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَفِيهَا عِوَجٌ.
নারী জাতি বুকের পাঁজরের হাড়ের মতো। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙে ফেলবে। আর যদি তার থেকে উপকৃত হতে চাও তাহলে বক্রতাসহই উপকৃত হতে হবে।—সহীহ বুখারী
স্ত্রীর আচরণে কষ্ট পেলে সবর করা প্রসঙ্গে কয়েকটি ঘটনা
সংসার কেবল আমাদের নয়, আমাদের নবীজিরও ছিল, সাহাবায়ে কেরামেরও ছিল, আকাবিরে উম্মতের ছিল। তারা বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান করেছেন তা আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পারিবারিক জীবনের কয়েকটি ঘটনা তো পেছনে উল্লেখ করেছি। এখন একজন বুযুর্গের ঘটনা বলছি।
আমাদের এ হিন্দুস্তানের একজন বড় বুযুর্গ ছিলেন হযরত মির্জা মাজহার জানে জানাঁ রহ.। হযরত জানে জানাঁ রহ. খুবই নাজুক ও সংবেদনশীল মেজাজের অধিকারী। একবার ইংরেজের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা হযরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে সে কর্মকর্তা পানি পান করল। খালি পেয়ালাটি রাখতে গিয়ে একটু বাঁকা করে রাখল। পেয়ালা বাঁকা দেখে হযরত রহ.—এর বিরক্তি বোধ হতে লাগল। বিরক্তি থেকে প্রচণ্ড মাথাব্যথা শুরু হলো। সে কর্মকর্তা একপর্যায়ে বললেন, হযরত আপনার কাজ করার জন্য আমি একজন লোক দিতে চাই। হযরত বললেন, ভাই আপনার লোক থেকে আমি পানাহ চাই।
কর্মকর্তা আশ্চর্য হয়ে বললেন, কেন হযরত, আমার লোক থেকে পানাহ চাইছেন কেন?
হযরত বললেন, আপনি পানি পান করে পেয়ালা ঠিকমতো রাখতে জানেন না। এর কারণে আমি মাথাব্যথায় অস্থির হয়ে পড়েছি। আপনি যে লোক দেবেন সে কেমন হবে?
এমন নাজুক তবিয়তের মানুষ ছিলেন মির্জা মাজহার জানে জানাঁ রহ.। একবার হযরতকে ইলহামের মাধ্যমে জানানো হলো অমুক এলাকার অমুক মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। সঙ্গে এও জানানো হলো, সে তোমাকে যত ধরনের কষ্ট দেবে তাতে তোমাকে সবর করতে হবে। তার সঙ্গে ধৈর্য ও সবর করে জীবন কাটাতে পারলে আল্লাহ তাআলা বড় পুরস্কার দান করবেন। নির্দেশনা মোতাবেক মির্জা সাহেব সে মহিলাকে বিয়ে করলেন। সে মহিলা হযরতের সঙ্গে খুবই রূঢ় আচরণ করত।
একবারের ঘটনা। হযরতের এক শাগরিদ খাবার আনতে ঘরে গেল। হযরতকে শায়খ বলে সম্বোধন করতেই হযরতের স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে শেখ না মেখ। আমি সারা দিন থাকি আমি জানি না, কীসের শেখ।’ এ ধরনের আরও অনেক কথা শুনিয়ে দিল। বেচারা খুবই ব্যথিত হলো এবং রাগান্বিতও হলো। বিষয়টি সে হযরতকে জানাল। হযরত বললেন, তুমি এতটুকু কথায় রাগ হচ্ছ। অথচ আমি রাত—দিন তা শুনছি। আমি সবর করি। তাহলে তুমি কেন বেসবর হচ্ছ?
আরেক বুযুর্গের ঘটনা। ওই বুযুর্গের স্ত্রী খুব খারাপ আচরণ করত। বুযুর্গের কথা শুনত না। তিনি সবর করতেন। একবার তিনি দুআ করলেন, হে আল্লাহ, এমন কিছু দেখিয়ে দিন, যাতে আমার স্ত্রী আমার বাধ্য হয়ে যায়। আমাকে শ্রদ্ধা করে। তখন আল্লাহ পাক বুযুর্গের একটি কারামত প্রকাশ করলেন। তিনি যে খাটে বসে ছিলেন সে খাটটি তাঁকে নিয়ে আকাশে উড়তে লাগল। একটি খাট আকাশে উড়ছে আর তাতে একজন মানুষ বসা—এ দৃশ্য স্ত্রী দেখল। কিছুক্ষণ পর তিনি নেমে এলেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আকাশে কি কিছু উড়তে দেখেছ?
স্ত্রী বলল, একজনকে দেখলাম খাটসহ আকাশে উড়ছে। সম্ভবত বড় কোনো আল্লাহর ওলী হবেন।
স্ত্রী এ কথা বলতেই বুযুর্গ বললেন, সেটা তো আমিই ছিলাম।
স্ত্রী বলল, ও তাই তো বলি, খাটটা এমন কাত হয়ে উড়ছে কেন? আপনার মতো লোক বসা ছিলেন বলেই এমন হয়েছে। সত্যিকার কোনো বুযুর্গ হলে এমন হতো না।
আবুল হাসান খিরকানী রহ.—এর ঘটনা
আবুল হাসান খিরকানী নামে একজন বিশিষ্ট বুযুর্গ ছিলেন। দূর—দূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে মুরীদ হতে আসত। কিন্তু হযরতের স্ত্রীও ছিল খুব মেজাজি। খুবই খারাপ আচরণ করত। মোটেও শ্রদ্ধা করত না। একবার এক লোক এলো হযরতের কাছে বাইআত হতে। লোকটি এসেছিল এক হাজার মাইল দূর থেকে। ঘরে এসে হযরতকে তালাশ করল। তিনি ঘরে ছিলেন না। হযরতের স্ত্রী বাইআত হতে আসা লোকটির কাছে হযরতের ব্যাপারে যা তা মন্তব্য করল। মহিলার কথা শুনে বেচারার মন খারাপ হয়ে গেল। লোকটি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। পাশের লোকজনদের হযরত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, হযরতের স্ত্রী খুবই বদমেজাজি। তার কথায় মন খারাপ করবেন না। আপনি হযরতের জন্য অপেক্ষা করুন। হযরত জঙ্গলে গিয়েছেন লাকড়ি সংগ্রহ করতে।
লোকটি অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জঙ্গল থেকে এক ব্যক্তি বেরিয়ে এলো। তিনি লাকড়িসহ একটি বাঘের ওপর সওয়ার ছিলেন। হাতে ছিল একটি সাপ। যা দিয়ে তিনি বাঘকে পরিচালনা করছিলেন। লোকটি তো এ দৃশ্য দেখে হতবাক।
হযরত নেমে এলে তার আগমনের কারণ জানাল। সঙ্গে হযরতের স্ত্রীর দুর্ব্যবহারের কথাও বলল। হযরত বললেন, আমার স্ত্রী আজীবন আমার সঙ্গে এমন আচরণই করে আসছে। আমি সবর করছি। এর বদৌলতে আল্লাহ পাক আমাকে এ কারামত দান করেছেন যে, আমি বাঘের ওপর সওয়ার হয়ে সাপ দিয়ে তাকে পরিচালনা করতে পারি। সুবহানাল্লাহ।
অতএব আমাদের অধৈর্য হলে চলবে না। স্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন আচরণ হবে তা মাথায় রাখতে হবে এবং সবর করতে হবে। সবর করলে ইনশাআল্লাহ এর প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যাবে।
সবরের প্রতিদানের একটি ঘটনা
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা লিখেছেন। এক দরিদ্র মানুষ সারা দিন কাজ করার পর ঘরে গেল খাবার খাওয়ার জন্য। বিবি খাবার পরিবেশন করল। সেদিন ঘটনাক্রমে খাবারে লবণ খুব বেশি পড়ে গিয়েছিল। লোকটি এক লোকমা খাবার মুখে দিয়ে অতিরিক্ত লবণের কারণে আর খেতে পারল না। সারা দিনের ক্ষুধার পর এমন খাবারে মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু তিনি সবর করলেন। বিবিকে কিছুই বললেন না। চুপচাপ উঠে গেলেন। এ সবরের কারণে মৃত্যুর পর আল্লাহ পাক তার সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন।
অতএব আমরা সবর করি। যারা বিয়ে—শাদি করে ফেলেছি তারা এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকি। স্ত্রীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করি। উত্তম আখলাকের পরিচয় দিই।
যারা বিয়ে—শাদি করেননি তাদের ব্যাপারে পরামর্শ
যারা এখনো বিয়ে—শাদি করেননি তাদেরকে বলব, বিয়ে—শাদি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। এখন দেখা যায়, কথা হয় আর তাড়াহুড়া করে বিয়ে হয়ে যায়। এটা সঠিক পদ্ধতি নয়। সম্বন্ধের ব্যাপারে চিন্তা—ভাবনা করতে হবে। অবশ্যই ইস্তেখারা করতে হবে। কেবল একদিন ইস্তেখারা করে জিম্মাদারি শেষ নয়। লাগাতার ইস্তেখারা করবেন। সপ্তাহখানেক ইস্তেখারার পর মন যেদিকে ধাবিত হয় সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তাহলে বরকত হবে।
ইস্তেখারার নিয়ম
ইস্তেখারার একটি নিয়ম তো হাদীসে উল্লেখ আছে। দুই রাকাত নামায আদায় করবেন। নামাযের পর ইস্তেখারার বিশেষ দুআ পড়বেন। ইস্তেখারার পর স্বপ্নে কিছু দেখলে বুযুর্গ কারও কাছ থেকে এর ব্যাখ্যা জেনে নেবেন। স্বপ্নে কিছু না দেখলে মন যেদিকে অগ্রসর হবে সে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবেন। এটা হলো ইস্তেখারার প্রসিদ্ধ পদ্ধতি।
আরেকটি উপায় কোনো কোনো বুযুর্গ থেকে বর্ণিত আছে। দুই রাকাত নফল নামাযের নিয়ত করবে। সূরা ফাতেহার পর আলিফ লাম মীম থেকে মুফলিহুন পর্যন্ত বার বার পড়তে থাকবে, যতক্ষণ না মাথা নিজ থেকে ডানে বা বামে ঘুরে যায়। পড়তে পড়তে ডানে ঘুরলে বুঝতে হবে ভালো। আর বামদিকে ঘুরলে বুঝতে হবে খারাপ।
তৃতীয় আরেকটি পদ্ধতির কথা কেউ কেউ বলেছেন, তা হলো দুআ রাকাত নফল নামাযের নিয়ত করবেন। সূরা ফাতেহা শুরু করে, اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ বার বার পড়তে থাকবেন যতক্ষণ না মাথা নিজ থেকে ডানে বা বামে ঘুরে যায়। পড়তে পড়তে ডানে ঘুরলে বুঝতে হবে ভালো। আর বামদিকে ঘুরলে বুঝতে হবে খারাপ। এ দুই পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়নি। কোনো কোনো বুযুর্গ অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন। মোটকথা ইস্তেখারা করে ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না।
স্ত্রীর হকসমূহ
এখন শুনুন স্বামীর ওপর স্ত্রীর হক কী কী। স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকগুলো আমি এক দুই করে বলছি, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন। মনে রাখুন। লিখে রাখুন।
এক. স্ত্রীর সঙ্গে সদাচরণ করা। ভালো ব্যবহার করা। উত্তম আখলাকের পরিচয় দেওয়া। অনেকে বাইরে কোনো ঝামেলা হলে রাগ দেখায় গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে। এটা করা যাবে না। সব সময় ভালো আচরণ করতে হবে।
দুই. স্ত্রী কষ্ট দিলে এ’তেদালের সাথে তথা ভারসাম্য রক্ষা করে সবর করা। অর্থাৎ আপনার মনের পরিপন্থি কোনো কথা বললে বা কোনো কাজ করলে নরমভাবে বুঝিয়ে দেবেন। যেন ভবিষ্যতে সে এ ধরনের ভুল থেকে বেঁচে থাকতে পারে। সাধারণ ও ছোট—খাটো বিষয় নিয়ে রাগ না করা। ঝগড়া—ঝাটি না করা।
তিন. আত্মসম্মানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা। অর্থাৎ অযথা স্ত্রীকে সন্দেহ করবে না। আবার একেবারে বেখবর হয়ে থাকবে না। সে কী করছে, না করছে তার একেবারেই খেয়াল রাখবে না—এমনও যেন না হয়।
চার. খরচের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা। অর্থাৎ সামর্থে্যর মধ্যে খরচ করা। সামর্থে্যর বাইরে ঋণ করে খরচ না করা। স্ত্রীর কারণে ঋণ করলে এগুলো কে আদায় করবে? আপনার মৃত্যু হয়ে গেলে ঋণের কী হবে? মনে রাখবেন, ঋণ বড় কঠিন জিনিস। তো স্ত্রীর চাহিদা পূরণের জন্য নিজের সাধ্যের মধ্যে খরচ করবেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করবে না। স্ত্রী চাইলেও কোনো গোনাহের আসবাব কিনে দেবেন না।
পাঁচ. হায়েয, নেফাস, ত্বহারাতসহ দ্বীনের জরুরি মাসায়েল নিজে শিখে স্ত্রীকে শিক্ষা দেওয়া। দ্বীনের ওপর চলতে উদ্বুদ্ধ করা।
ছয়. একাধিক স্ত্রী থাকলে সবার মাঝে সমতা রক্ষা করা। প্রত্যেকের হক আদায় করা।
সাত. বসবাসের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।
স্ত্রীর এ হকগুলো পরিপূর্ণরূপে আদায়ের চেষ্টা করি। স্ত্রীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করি। স্ত্রীর আচরণে সবর করি। উত্তম আখলাকের পরিচয় দিই। কখনো যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে, স্ত্রীর আচার—আচরণ এমন যে, তার সঙ্গে আর ঘর—সংসার করা সম্ভব নয়, তখন কী করতে হবে তা—ও শরীয়তে বলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা বা রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। খুব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। স্ত্রীকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এরপরও সম্ভব না হলে কোরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন̶
وَ اِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَیْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَکَمًا مِّنْ اَهْلِهٖ وَحَکَمًا مِّنْ اَهْلِهَا ۚ اِنْ یُّرِیْدَاۤ اِصْلَاحًا یُّوَفِّقِ اللهُ بَیْنَهُمَا.
অর্থাৎ উভয়ের মাঝে বনিবনা না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে দুই পক্ষ থেকে সালিশ নির্বাচন করবে। তারা উভয়ে পরামর্শ করে স্বামী—স্ত্রীকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। আর যদি বিবাহ—বিচ্ছেদই তাদের জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে দুই সালিশ মিলেই সে সিদ্ধান্ত জানাবেন। নিজ থেকে রাগের মাথায় হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। এ বিষয়ে খুব বেশি সতর্ক থাকি। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন।