প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

প্রচলিত বিশ্ব ব্যবস্থার টার্গেট ‘ইসলামী শরীয়াভিত্তিক আর্থসমাজ সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র’

প্রচলিত বিশ্ব ব্যবস্থার টার্গেট ‘ইসলামী শরীয়াভিত্তিক আর্থসমাজ সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র’

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

 

সারা পৃথিবীতে এই কয়েক দিনের টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড হলো তালেবান। তালেবানের ব্যাপারে মানুষ যা—ই বলুক, আমাদের সামনে একটি স্বচ্ছ ফিচার থাকতে হবে। লেখাপড়া জানা মানুষরা জানেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আফগানিস্তানের একটি জিওপলিটিক্যাল কৌশলগত অবস্থান আছে। ভৌগোলিকভাবে স্থল—পৃথিবীর সংযোগ হলো আফগানিস্তান। এখানকার গিরিপথ পাড়ি না দিয়ে মানুষ চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত চলাচল করতে পারত না। সেটা হোক পাঁচ হাজার বছর আগে বা চার হাজার বছর আগে। তা ছাড়া ইতিহাসের সবচেয়ে পরাশক্তি যাদের ভাবা হতো তারা কেউই আফগানিস্তানে দখলদারত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। যেমন : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তাদের সা¤্রাজ্য এত বড় ছিল যে, সেখানে সূর্য অস্ত যেত না। সত্যিই তাই। কারণ, জাপান থেকে নিয়ে আমেরিকা পর্যন্ত যদি কারও সা¤্রাজ্য থাকে আর আফ্রিকা, আরববিশ্ব ও উপমহাদেশও থাকে, তাহলে তো এমনই হয়। কিন্তু সেখানে আফগানিস্তান একসেপশন। দুই—আড়াইশ বছর চেষ্টা করার পরও ব্রিটিশরা সেখানে স্থিত হয়নি। শেষমেশ আফগান গোত্রপতিরা যখন ব্রিটিশদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয় তখন ২০ হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র একজন ব্যক্তি প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল। এটা একটি সিগনিফিক্যান্ট ইতিহাস।

এরপর আমরা ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের প্রসঙ্গে আসি। যা পুঁজিবাদি ও বুর্জোয়া পৃথিবীতে নতুন মোড় নেয় সমাজতন্ত্রের নামে। বলশেভিকরা ১৫টি রাষ্ট্র দখল করে। তার মধ্যে ৬টি ছিল মুসলিম রাষ্ট্র। যেগুলো আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর বড় বড় দেশ। তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এই তিনটি দেশ একেবারে আফগানিস্তানের বর্ডারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার এমন সময় শুরু করে যে সময়টি তাদের যৌবনের নয়। যদিও আগে তারা তাদের পাশের ৬টি মুসলিম সাম্রাজ্য তাদের আয়ত্তে নিয়ে যায়। কিন্তু আফগানিস্তান আয়ত্ত নেওয়ার চেষ্টা করে ১৯৭৯ সালে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন আসার পর আফগানিস্তানে একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়। এটাকে খুব জোর দিয়ে বলা হয় যে, এটা স্বাধীনতা সংগ্রাম। কারণ, তাদের ওপর সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসন হয়েছিল। আফগানিস্তান যখন এর মোকাবিলায় দাঁড়ায় তখন নেপথ্যে তাদের সাহায্য করে আমেরিকা। ১৪ বছর যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজয়বরণ করে। তারা তখন বলেছিল, আমরা প্রতিদিন এত টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায় তৎকালীন ২০০ কোটি) খরচ করতে পারব না। শেষ ব্যক্তিটি সেখান থেকে পালিয়েছিল উজবেকিস্তানের বর্ডারে অবস্থিত আমু দরিয়া দিয়ে। এটা সেই ঐতিহাসিক আমু দরিয়া, যা পার হয়ে বাবর এবং অন্যান্য বিদেশিরা ভারতবর্ষে এসেছেন। সে দরিয়া দিয়ে শেষ ব্যক্তিটি যখন পার হয় তখন বলেছিল, আমরা একটি ভুল জায়গায় পা দিয়েছিলাম। সমাজতান্ত্রিক বিশে^ আমাদের যে নেতৃত্ব তা শেষ হয়ে যাবে আফগানিস্তানের মাটিতে পা দেওয়ার কারণে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের পর তাদের ঐক্যে ফাটল দেখা দেয়। সব সময় এমন হয়, একটি জাতির যখন বড় দুর্দিন আসে তখন সেখানে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। আফগানিস্তানেও তা হয়েছিল। সে ঐক্য নষ্ট হওয়ার কারণ হলো, সেখানে কমিউনিস্ট ও স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদরা ছিল। একটি ছোট অংশ ছিল ইসলামী, যারা তাত্ত্বিকভাবে ইসলামিক কিন্তু পলিটিকেলি উদার। ফলে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। এজন্য শান্তি ফিরে আসেনি। এ সময় ব্যাপক দুর্নীতি, স্বাধীনতার ফল না পাওয়া এবং আন্তর্জাতিক জগতের সঙ্গে আফগানিস্তানের টানাপোড়েনে সেখানকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কওমী মাদরাসার ছাত্ররা একটি ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে, যা পাল্টা বিপ্লবের মতো। যুদ্ধ বন্ধ হোক, ব্যাপক দুর্নীতি বন্ধ হোক এবং দেশ শান্তিতে থাকুক—এটাই ছিল সে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। সে আন্দোলনটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানের মাটি ও মানুষ আলাদা। তারা প্রকৃতিগতভাবেই কষ্টসহিষ্ণু ও যোদ্ধা। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে গোলাগুলি তাদের কাছে ডাল—ভাতের মতো। এমন না যে তারা হঠাৎ রেডিক্যাল হয়ে গেছে। যুগ—যুগান্তর থেকে আফগানিস্তানের মানুষ রেডিক্যাল। এর মধ্যে তালেবানরা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের রেখে যাওয়া অস্ত্র এবং আফগানদের সাহায্য করার জন্য আমেরিকার সরবরাহ করা অস্ত্র পায়। অস্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো স্ট্রিঙ্গার ক্ষেপনাস্ত্র, যা কাঁধে বহন করা যায় এবং সেটা এন্টিএয়ার ক্রাফ্টগান। এটা তখনকার লেটেস্ট অস্ত্র। যেখানেই বিমান থাকবে সেখানেই এটা ঘুরে ঘুরে হামলা করবে। এ ধরনের পঁচিশ হাজার অস্ত্র আফগানিস্তানে ছিল। আমেরিকা এগুলো নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়েই বিরোধের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান গভর্মেন্টের সাহায্য চাওয়া হয়, কিন্তু তারাও এগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। ফলে তালেবানের হাতেই সে অস্ত্রগুলো রয়ে যায়।

তখন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বুরহানুদ্দীন রব্বানী। যিনি একজন ইসলামিক চিন্তাবিদ এবং ওখানকার জামাতের চিফ ছিলেন। জামাতের নাম সেখানে জমিয়তে ইসলামী ছিল। তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় তালেবানরা বা ওখানকার যুবক তরুণ শক্তি, যারা বয়স্ক সিনিয়ার পলিটিশিয়ানদের আচরণে বিরক্ত এবং দুর্নীতি ও বিদেশি সাহায্যের চাপ সহ্য করতে না পারা জনগণের মন জয় করতে পারা একটি শক্তি। তাদের প্রথম উত্থান শুরু হয়েছিল একটি রেপ কেস দিয়ে। মোল্লা ওমর যেখানে থাকতেন, সেখানকার কাছে কোথাও রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় একটি রেপ হয়। যে রেপের বিচার হয়নি। ফলে সে মেয়ে এবং তার বাবা আত্মহত্যা করার পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক শক্তি বা দলীয় ছত্রছায়ার কারণে পুলিশও কাজ করছিল না। তখন মোল্লা উমর, যিনি দেওবন্দী মাদরাসায় পড়া লোক এবং যিনি পাকিস্তানে পড়াশোনা করেছেন, তিনি আঞ্চলিকভাবে ওই রেপিস্টকে ধরে মৃত্যুদণ্ড দেন। তখন এলাকায় তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। মানুষ যেখানে অক্ষম, যেখানে আইনের শাসন নেই, যেখানে সরকারের কোনো সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে মানুষ তাকে অনুসরণ করে।

আফগানিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি হলো পাখতুন জাতি। যাদের ভাষা পশতু। এরাই মূল আফগান। এ ছাড়া উজবেক, তাজিকসহ অন্যান্য জাতিও আছে। এদের মধ্যে পাখতুুন সবচেয়ে শক্তিশালী। তারা যে শাসককে সমর্থন করে তারাই শাসক থাকে, অতীতে এমনই দেখা গেছে। মোল্লা উমর জনগণের অধিকাংশের সমর্থন পেয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। সউদি আরব, পাকিস্তানসহ তিনটি রাষ্ট্র তাঁকে সমর্থন দেয়। তারা গণতন্ত্রকে স্বীকার করেন না এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচারকদের ওপরও তাদের অশ্রদ্ধা ছিল। কারণ, অনেক জায়গায় গণতন্ত্রের জন্য দেশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, গণতন্ত্র নেই বলে উৎখাত করে দেওয়া হয়, এই গণতন্ত্রের যারা মূল তারাই অনেক সময় রাজতন্ত্রকে লালন করে, অনেক জায়গায় তারা স্বৈরশাসনকে বসিয়ে রাখে এবং অনেক জায়গায় তারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিকে উৎখাত করে আর্মিদের শাসনে বসায়; এজন্য এই ডেমোক্রেসিকে তারা ফালতু মনে করে। সমাজতন্ত্রকে তো তাড়িয়েই দিয়েছে। তারা মনে করে, আফগানিস্তানের অধিকাংশই মুসলিম। তারা ইসলামী অনুশাসনে বিশ্বাসী এবং অনেক বেশি মেজোরিটি, প্রায় ১৬ আনা লোকই ইসলামের ওপর আমল করতে চায়। ব্যক্তিগত জীবনেও তারা ইসলামকে ধারণ করে আছে। তাদের বিশ্বাস, তালেবানরা যদি দেশ শাসন করেন তাহলে দেশে যুদ্ধ বন্ধ হবে, শান্তি আসবে, উন্নয়ন আসবে, অত্যাচার—জুলুম আর থাকবে না।

টুইন টাওয়ারে যে হামলা হলো সেই হামলার সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে দাবির একটি ধারা এই রকম যে এটা করেছেন বিন লাদেন। এখানে সউদি আরব ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার কথাও তারা বলে। এটাও একটি রহস্যজনক ব্যাপার। বলা হয়, বাইরে যারা ব্যবহৃত হয়েছেন মুজাহিদ নামে, তাদের পেছনে নেপথ্যে মাস্টার প্ল্যানটা ছিল আমেরিকারই। এটা মার্কিন জার্নাল, পত্রিকা, মিডিয়ায় এসেছে। নেপথ্যকাহিনি হলো, এ টাওয়ার ভেঙে ফেলার সময় হয়ে গিয়েছিল। আর আফগানিস্তানের যে কৌশলগত অবস্থান—চীন, পাকিস্তান, ভারতের মধ্যখানে, ইরানের পাশে—সেখানে আমেরিকার বসা দরকার ছিল। সে বসার প্রস্তুতি হিসেবে টুইন টাওয়ারের ঘটনা ঘটানো হয়। যেখানে বাইরে থেকে কয়েকটি বিমানের হামলা ঘটানো হয়। আগে থেকেই তাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া, তাদেরকে লালন করা, তাদের ভিসা দেওয়া̶—সবকিছুই মার্কিন গোয়েন্দারা জানত। এ বিষয়ের এক্সপার্টরা বলেছেন, ভেতরে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ ছাড়া শুধু বিমানের ধাক্কায় এই বিল্ডিং এভাবে ধসে পড়ে না। কারণ এটি একটি স্টীল বিল্ডিং, কংক্রিট বিল্ডিং নয় যে নিচের পিলার কেটে দিলে এটা বসে যাবে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, টুইন টাওয়ারের বিভিন্ন লেভেলে, বিভিন্ন বিজনেস সেন্টারে ও বিভিন্ন অফিসে চার হাজার ইহুদী কাজ করত, যাদের একজনও সেদিন অফিসে যায়নি। আর মৃতের মধ্যে একজনও ইহুদী নেই। এটা এই পক্ষ বলে। আর ওই পক্ষ বলে, এটা ইসলামী জঙ্গিদের কাজ এবং এর পেছনে আছে আলকায়দা।

তখন আলকায়দার চিফ ছিলেন উসামা বিন লাদেন। তিনি আফগানিস্তানের আগেকার যুদ্ধে ছিলেন। তখন আমেরিকার সাথে তার মিটিং হয়। আমেরিকানরা অস্ত্রসরঞ্জাম সবকিছু দিয়েছে। তখন মুজাহিদ বাহিনী এবং এদের তরুণদের মধ্যে জিহাদী গোষ্ঠী সৃষ্টিও হয়েছে আমেরিকানদের জানার মধ্যেই। কারণ, তখন তারা মিত্রশক্তি ছিল। সোভিয়ত ইউনিয়নকে ভেঙে দেওয়ার জন্য আমেরিকা, আফগানিস্তান, সৌদি আরব এদের সমান স্বার্থ ছিল।

তখন আমাদের বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের যুগ চলছিল। তিনিও এই ব্লকে ছিলেন। যেজন্য বাংলাদেশের কিছু মানুষ যাদের কেউ দেওবন্দ পড়ত, কেউ পাকিস্তান পড়ত, তাদের কেউ কেউ শখে যুদ্ধ দেখতে গিয়েছিল। আমরা যতটুকু শুনেছি, তাদের সংখ্যা ৩৫ জন। ওই সময়ে নতুন আফগান গভর্নমেন্ট হওয়ায় তার প্রধানমন্ত্রী হন গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার। যিনি বর্তমানে এই সরকারের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আছেন। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে মিটিংও করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে তার ব্যক্তিগত একটি রিভালবার উপহার দিয়েছিলেন স্মারক হিসেবে। পরে এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা করার সময় ওই রিভলবার দেখিয়ে বলা হয়, তার কাছে বেআইনী অস্ত্র আছে। মার্কিন বলয়ের সুবাদে এ মিল—মহব্বত, চলাফেরা, মুখ দেখাদেখি সে সময় ছিল।

পরে আমেরিকা যখন হামলা করতে আসে তখন সারা পৃথিবীতে বিশ^ সন্ত্রাসবিরোধী মহামৈত্রী গঠিত হয়। এটাতে বাংলাদেশও ছিল। তখন আফগানিস্তানকে বা তালেবানকে আমরা বাংলাদেশ থেকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম। আমাদের গভর্নমেন্ট যদিও বিশ^ সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্যের অংশ কিন্তু তারা কোনোদিনই সেখানে আর্মি পাঠাননি। বর্তমান সরকারের সময়কালে দুয়েক বার সৈন্য চাওয়া হচ্ছে বলে আমরা শুনেছি। তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত হওয়ার কারণে তাদের সৈন্য গিয়েছে আফগানিস্তানে। হানাদার বাহিনী কিংবা মিত্রবাহিনী যা—ই বলি, যারা ২০ বছর দখলদারত্ব করেছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে যেতে হয়নি। এটা আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ ও শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল।

এখন তালেবানরা যুদ্ধের মাধ্যমে এবং কূটনৈতিকভাবে দু—একটি দেশের সঙ্গে তাদের পজিটিভ সম্পর্ক করে দেশটিকে শান্তিপূর্ণভাবে দখল করেছে। যেখানে ভয়াবহ ব্লাড শেডের কথা সারা পৃথিবী ভাবত সেখানে বাংলাদেশ থেকে ১০/১২ গুণ বড় একটি দেশ এভাবে রক্তপাতহীনভাবে তারা দখল করে নিল। সেখানে প্রায় তিন লাখ কম্বাইন্ড ফোর্স ছিল। আফগান আর্মি প্লাস মার্কিন ও ন্যাটোভুক্ত সৈন্য। আমেরিকান সৈন্যরা যাদের ২০ বছর ট্রেনিং দিয়েছে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও তাদের আছে। এ আর্মি একটি গুলিও করল না। বিনা বাধায় তারা সবগুলো প্রদেশ দখল করল। সব জেলা দখল করল। সামরিক ঘাঁটি কান্দাহার দখল করল। পলিটিক্যাল বড় হাব মাজারই শরীফ দখল করল। শেষ পর্যন্ত তারা কাবুল এসেছে। এই কাবুলে আসার সময়ও এখানকার গভর্নমেন্ট একটা ভাব দেখাচ্ছিল যে বড় কিছু হবে, আমরা প্রস্তুত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। আফগানিস্তানের সান অব সয়েল যারা তাদের কারও প্রতি তালেবানদের কোনো প্রতিশোধস্পৃহা ছিল না। তারা ভাবে, যেহেতু আমেরিকানরা এখানে এসে বসেছিল তাই আমাদের দেশের কিছু লোক তো তাদের সাহায্য করবেই। এরপরও তারা তো আমাদের দেশেরই লোক। এ কারণে তারা কোনো ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করেনি যে আমরা গিয়েই প্রথমে তাদেরকে মারব।

নিজের অপরাধ কিংবা নৈতিক দুর্বলতার জন্য মানুষ নিজেই নিজেকে অপরাধী মনে করে। যেমন আশরাফ গনী, তিনি একজন পাপেট পটিলিটিশিয়ান। তিনি থেকে গেলে তাকে কিছুই করা হতো না। অথবা তিনি যদি পাকিস্তান বা চীনকে মেসেজ দিতেন যে আমিও কাতার আসতে চাই, তাহলে তাকে কাতার নিয়ে যাওয়া হতো। এখানে আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ আছেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আছেন তার আগের শাসক হামিদ কারজাই, যিনি মার্কিনিদের আসল মিত্রজন। আগে যিনি জাতিসংঘে চাকুরি করতেন। তাকেও কিন্তু কিছুই করা হয়নি।

আফগানিস্তান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা পালাচ্ছে তারা আসলে দুই রকমের মানুষ। এত বড় একটি দেশ, যেখানে ২০ বছর বিদেশি পরাশক্তি ছিল, সেখানে তাদের কিছু চাকর—নকর থাকাই স্বাভাবিক। যাদের সঙ্গে টাকা—পয়সা ও বিভিন্ন জিনিস সাপ্লাই দেওয়ার ব্যাপার থাকতে পারে। আবার এমনও কিছু থাকতে পারে, যারা হিংসা—বিদ্বেষবশত কাউকে ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফলে অনেককে গোয়েন্তানামো কারাগারে যেতে হয়েছে। এ লোকগুলো ক্ষমা পাওয়ার পরও নিজেরাই নিজেদেরকে ক্ষমা করতে পারছে না, তাই পালাচ্ছে। এটা হচ্ছে নাম্বার ওয়ান রিজন। আরেকটা হচ্ছে, যারা ভাবে, আমরা এই সুযোগে পশ্চিমা দেশে চলে যাই। এটা কিন্তু সব দেশেই দেখা যাবে। আমাদের দেশের কত মানুষ লিবিয়াতে, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যায়। আলবেনিয়ার জঙ্গলে ও মালেশিয়াতে কত মানুষ মারা যায়। আমাদের দেশে যদি বলা হয়, এই মুহূর্তে পাসপোর্ট—ভিসা ছাড়া কতগুলো কার্গো বিমান আমেরিকায় যাবে। যারা উঠতে পারো উঠো। তাহলে ঢাকায় যে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে, তা অবশ্যই আফগানিস্তান থেকে বেশি হবে। কাজেই আমি তাদের সবাইকে রাজাকার বা পলাতক বলতে চাই না। বলতে চাই, ভাগ্যান্বেষী আফগান, যারা ৪০ বছরের যুদ্ধে পযুর্দস্ত। তাদের কেউ হয়তো তাদের অপরাধে এবং কেউ তাদের জীবনে সমৃদ্ধি লাভের আশায় পশ্চিমা দেশে পাড়ি জমানোর সুযোগ নিচ্ছে।

আফগানিস্তানের প্রতি কিছুদিন আগেও বিশ্বের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এখন দ্রুত এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পথে। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে সশস্ত্রভাবে নিজের দেশের জনগণের সমর্থনকে কার্যকর করার ক্ষমতা। যেহেতু তারা ক্ষমতায় এসেছে এবং অধিকাংশ জনগণ তাদের সমর্থন করে, ২০ বছর তারা মাঠে লড়াই করেছে এবং তারা ডিপ্লোমেসি শিখেছে, তারা পৃথিবীর ভাষা বুঝেছে এবং শত্রুদের ট্র্যাপ, তাদের এমবেডেড মিডিয়া, তাদের স্কলার এবং তাদের পরিভাষা সবকিছু নিয়ে তাদের নেতৃবৃন্দের জ্ঞান, ধারণা ও চর্চা হয়েছে। একসময় তালেবান সম্পর্কে ইসলামপন্থিরাই ভাবছিলেন—তারা যদি নিজেদের মাদরাসার ভেতরের যে ইউনিফর্ম, তাদের উঠা—বসা, তাদের প্যারা মিলিশিয়া  টাইপের সাধনার জিন্দেগী, এটা যদি সমস্ত মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে এটা দুর্বল মুসলমানরা নিতে পারবে না।

আমরা দেখলাম, সিএনএন ও অন্যান্য ওয়েস্টার্ন মিডিয়াকর্মীরা নিজেরাই সাধারণ পোশাক পরেছে। কারণ, মুসলমান নারীদের বলতে হয় তোমরা তোমাদের কাপড়গুলো সঠিকভাবে পরিধান করো। একটা পুরুষ যেভাবে নিজেকে ঢাকে তোমরা নারী হয়ে অন্তত এতটুকু ঢাকো। এই কথাগুলো বলাও তো পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধ।

মিডিয়াতে আমরা দেখেছি, দায়িত্বশীল একজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলেছেন, কোভিড—১৯ এবং অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে ডাক্তার ও নার্সরা যেভাবে কাজ করে আসছিলেন সেভাবে কাজ করে যান। আপনাদের কারও চাকুরিচ্যুতি বা শাস্তির বিষয় নেই। সবার বেতন ঠিক থাকবে। সবাই চাকুরিতে আসুন। স্কুল, কলেজ খোলা রাখার জন্য তারা গার্ডিয়ানদের অনুরোধ করেছেন এবং স্কুল, কলেজ খোলাও আছে। দোকানপাটে গিয়ে বলেছেন, আপনারা দোকানপাট খুলুন। তাহলে এখানে চুরি বা লুটপাটের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। কারণ বাইরের কোনো বেড এলিমেন্ট না আসুক এটাই আমরা চাই।

তালেবানদের তো আমরা দেখিনি বা তালেবানদের সঙ্গে তো আমদের কোনো যোগাযোগ নেই। আমরা মিডিয়া থেকেই সব পাই। মিডিয়া তো আসলে যুদ্ধরত। না হয়, ফেইসবুকের মতো একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অফিসিয়ালি কীভাবে বলে, তালেবানরা সন্ত্রাসী—গোষ্ঠী, তাই তালেবান সম্পর্কে কোনো ছবি বা নিউজ কেউ আপলোড করলে তার আইডি ক্যানসেল করে দেবে। এই ঘোষণাটা খুবই ন্যারো মাইন্ডের এবং খুবই খারাপ। কারণ, লক্ষ—কোটি গ্রাহক এটাকে গ্রহণ করেছে এবং সার্ভিস নিচ্ছে। এ ঘোষণা তাদের হীনতা। পশ্চিমাদের বাকস্বাধীনতা আসলে যে একটি মিথ্যা স্লোগান এ কথাটি ফেইসবুকের আচরণ থেকে বোঝা যায়। কারণ বৈশি^কভাবে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের মানুষ তাদের দেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা সেখানে উন্নয়ন বা রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য যাইনি, আমরা গিয়েছি সহায়তার জন্য। সে ধারা তারা অব্যাহত রাখতে পারেনি, এটা তাদের ব্যর্থতা।

আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা তৃতীয় কোনো দেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আফগানিস্তানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য আমরা চাই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। আফগানিস্তানের মানুষের অনেক সক্ষমতা আছে, তারা তা ব্যবহার করে যেন পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ভৌগোলিক যে অবস্থানে আছে সেখানে তার সবচেয়ে ফিজিক্যালি নেইবার হলো ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব, মিত্রতা অফিসিয়ালি চলে আসছে। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ তার বিভিন্ন স্বার্থে, ফান্ডিংয়ের ও বিনিয়োগের জন্য বা উন্নয়ন পরিচালনার জন্য চীনের দ্বারস্থ হচ্ছে। আর মিয়ানমারের সমস্যাও দূর হলে চীনের মাধ্যমেই দূর হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে বর্তমানে সুবিধা ও কৌশলগত অবস্থানে আছে। যেখানে সে না বলতে পারে। এটা অনেক বড় একটি বিষয়। সাময়িকভাবে কিছু আফগান নাগরিককে আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল আমেরিকা। বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে, এখানে কোনো লোক নেওয়া হবে না। কয়েক দিন আগে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব এসেছে, বাংলাদেশে ১০ লক্ষ যে রোহিঙ্গা আছে তাদেরকে থাকতে দিন এবং তাদেরকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিশিয়ে নিন। বাংলাদেশ এর কঠোর নিন্দা করেছে। তো এখন বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী বা ক্ষতিকর কোনো বিষয়ে না বলে দেওয়ার শক্তি বাংলাদেশের আছে। আমাদের দেশের, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, তালেবানরা আফগানিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা। জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বিবেকবান মানুষ, তার জন্য এটা সাজে মুক্তিযোদ্ধা কাকে বলে সেটা বোঝা।

তালেবানের মুখপাত্র বলেছেন, আমাদের কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই। দুনিয়ার কোথাও আমাদের কোনো এজেন্ডা নেই। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আছে। সেটা অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে আরও বৃদ্ধি পাবে।

একজন প্রশ্ন করেছেন, ইন্ডিয়ার সঙ্গে আপনাদের শত্রুতা নাকি বন্ধুত্ব?

তিনি বলেছেন, ইন্ডিয়াকে জিজ্ঞেস করুন, তারা কি তালেবানকে শত্রু মনে করে নাকি বন্ধু? যদি তারা আমাদেরকে শত্রু মনে করে বা আমাদের রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে তারা বিরোধীদের সহায়তা দেয় তাহলে আমরা ধরে নেব তারা শত্রু। কারণ আমরা তো ক্ষমতায় ছিলাম না, কাজেই আমরা কীভাবে বলব? আমরা এখন দেখব, কারা আমাদের বন্ধু মনে করে। আর কারা শত্রু মনে করে।

পৃথিবীতে আমরা যুদ্ধের ইতিহাস পড়ি। অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে রয়েছে। ইতিহাসের যুদ্ধ একটি বিষয় আর নিজের সমকালীন যুদ্ধ আরেকটি বিষয়। আগেকার যুগে যোগাযোগ এত সহজ ছিল না। আধুনিক তথ্য—প্রযুক্তিও ছিল না। যেজন্য যুদ্ধ হলেও এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের যুদ্ধের খবর পেত না। কিন্তু আজকের পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজ। বর্তমানের তথ্য—প্রযুক্তি অতীতের চেয়ে অনেক উন্নত। কাজেই প্রতিদিন মানুষ জানতে পারে কোথায় কতজন মানুষ মারা যাচ্ছে, কোথায় বিমান হামলা হলো, কোথায় রকেট হামলা হলো। এই সচেতন বিশ^বাসীর সামনে সম্প্রতি সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মর্মান্তিক দুটি যুদ্ধ ছিল। প্রথম যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের মাধ্যমে সাহায্য করে। পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তানের আর্মি, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরপর শুরু হয় ২০ বছরের এক নতুন যুদ্ধ। এর মধ্যে ৬/৭ বছরের একটি গ্যাপ রয়েছে। ওই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আফগানরা নিজেদেরকে শাসন করেছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক ছিলেন সমাজতন্ত্রী, যারা কমিউনিস্ট এবং কিছু লোক এমন ছিলেন যারা ডেমোক্রেটিক ও সেক্যুলারিস্ট। এটা ব্যবহারিক অর্থে বলছি না, ইথিক্যাল অর্থে বলছি। ডেমোক্রেসি মানে পশ্চিমাদের একটি শাসনব্যবস্থা বা কালচার। আর সেক্যুলারিজম একটি ইজম, যেটা মানুষকে ধার্মিক থাকতে দেয় কিন্তু ধর্ম নিয়ে এগিয়ে যেতে দেয় না। তার ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে ধর্ম থাকবে না। ধর্মের নীতি বা নৈতিকতা তার শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি বা তার জীবনের অন্য ক্ষেত্রে সে পালন করবে না। সে একজন নিউট্র্যাল মানুষ হবে, যে মানুষটির বিশেষ কোনো নীতিমালা থাকবে না। এই সেক্যুলারিস্ট বা ডেমোক্রেটিক যারা তাদের সঙ্গে স্থানীয় লোকেদের দ্বিমত হয়ে যায়। সে সমস্ত স্থানীয় লোকের দুটি গুণ, একটি হলো তারা স্বাধীনচেতা আফগান এবং আরেকটি হলো তারা পূর্ণাঙ্গ অর্থে মুসলমান। তারা তাদের দেশে আমেরিকার অবস্থানকে মেনে নেয়নি।

যে যাই বলুক, আমেরিকার আগমন ও অবস্থান সবটাই ছিল তাদের জন্য দখল, সন্ত্রাসবাদ, সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং বিদেশি শক্তির অবস্থান। সারা বিশ্ব এটা এক হিসেবে নিয়েছিল যে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গী আছে। তাদেরকে দমন করার জন্য পৃথিবীর সবাই এক হয়ে ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধ করে। সেখানে মার্কিন বলয়ে সাধারণ বিশে^র ৫২টি রাষ্ট্র একত্রিত হয়েছিল। এত বড় পরাশক্তির সাথে অতীতে কোনো এক দেশের লড়াই হয়নি। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আর কোনো দেশ ছিল না। আর আমেরিকার সাথে ন্যাটো জোট আছে। ন্যাটো জোটের বাইরে অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশও নৈতিকভাবে তাদেরকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ সেখানে বলা হয়েছিল অশেষ লড়াই হবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। তবে আরব ও মুসলিম দেশের সংখ্যা না জানা বিপুল মুসলমান একে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ মনে করত না। মনে করত, ইসলামী শক্তিবিরোধী ক্রুসেড লড়াই। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে আক্রমণের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, এটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের নতুন ক্রুসেড। এ কারণে কোটি কোটি মুসলমান এ লড়াইয়ের বিরোধী শক্তিকে ধর্মসম্মত পবিত্র জিহাদ বলে মনে করতেন। যা তালেবানদেরও দাবি।

এই অশেষ লড়াইটি শেষ হয়ে গেল এবং আফগানিস্তানের মানুষ জয়ী হলো। সেই মানুষগুলো হোক মুসলিম, হোক তারা অন্য ধর্মের, হোক তারা উপজাতি, হোক তারা অসভ্য। তাদের মাতৃভূমিতে বিদেশী শক্তির যে অবস্থান সে শক্তিকে, সেই শক্তির মিত্র গোষ্ঠীকে এবং সে শক্তির সাথে দেশীয় যারা যোগ দিয়েছিল যাদেরকে রাজাকার বলা হয়, তাদের সবাইকে পরাজিত করেছে একটি ছোট্ট দল। যাদের সবোর্চ্চ সংখ্যা ছিল এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। তাদের ধারণায় তাদের সাথিবর্গের মধ্যে সত্তর থেকে আশি হাজার আছেন। আর আশি হাজার শহীদ হয়েছেন।

বিশে^র মানুষ গত ১৫ই আগস্ট একটি বিজয় দেখেছে। যেখানে সমস্ত শক্তিশালী শক্তি, সামরিক বাহিনী, তাদের উন্নত প্রযুক্তি এবং সফিস্টিকেটেড ওয়েপন যেগুলো পৃথিবীর মানুষ এখনো জানেইনি। কারণ এই প্রযুক্তির অনেকগুলো চীনের কাছে নেই, অনেকগুলো রাশিয়ার কাছে নেই, অনেকগুলো ফ্রান্স জার্মানির কাছে নেই আর মুসলিম বিশে^ তো প্রশ্নই ওঠে না। এমন শক্তিশালী সুসজ্জিত বাহিনী যে পরাজিত হয়েছে সেটি মানুষের চোখে দেখা একটি ঘটনা।

এই ইভেন্টের যারা সাক্ষী তারা সবাই একটি আনন্দের মধ্যে থাকবে যে, আমরা দেখেছি একটি দেশ মুক্ত হওয়ার দৃশ্য, শুনেছি একটি মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কথা, একটি দখলদার সৈন্যবাহিনীর বিদায়ের কথা। আগামী দিনের ইতিহাসে মানুষ এটা পড়বে কিন্তু আমরা মনে করি যে, আমরা এটি দেখেছি। যেহেতু এটার লোকেশন হলো দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ায়, অতএব আমরা এটার প্রতিবেশী। এটি আমরা অনেক কাছ থেকে দেখেছি। এর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে কিন্তু আমি বলতে চাই, মানবজাতির জীবনে এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা। এক তো আফগানিস্তান জমিনটাই স্মরণীয় যেখানে মোঙ্গলরা এসে টিকতে পারেনি, বিট্রিশরা পারেনি, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারেনি, আমেরিকা পারেনি এবং তার বন্ধুরাও পারেনি।

অনেকেই বলে থাকেন, তালেবানদের আগের সময়টা নানা কারণে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন ভালোই দেখা যাচ্ছে। আর ব্যক্তিগতভাবে তাদের আচরণ খুবই ভালো। বলা হচ্ছে, এখন সবাই দেখবে, তারা কী করে? আমার কথা হলো, তালেবানদের দেখবে তারা কীভাবে চলে, এরপরে স্বীকৃতি দেওয়া না—দেওয়ার প্রশ্ন। তাহলে মিয়ানমারের গভর্নমেন্ট গত চল্লিশ বছর যাবৎ যা কিছু করেছে, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় কীভাবে? পশ্চিমারা দেখবে তালেবানরা কেমন, এরপর তাদের স্বীকৃতির প্রশ্ন। এটা তো তাদের পরাজিত হওয়ার একটি ক্ষত। সেই ক্ষত শুকানোর জন্য তারা বলছে যে আমরা দেখি কী করা যায়। এসব কথার কোনো মানে নেই। আসলে তারা স্বার্থের জন্য দৌড়—ঝাঁপ শুরু করেছে। না হলে তাদের এত আনাগোনা কেন? পাকিস্তানে কাতারে কে আসেননি? কাবুল জয়ের পরে সিআইএর ডাইরেক্টর আফগানিস্তানে কেন এসেছিলেন? কাতারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আরেকজন বড় মন্ত্রী কেন এসেছিলেন?

যারা বলতে চান, তালেবানদের আমরা দেখব তারা কেমন। তাদেরকে আমি বলতে চাই, পৃথিবীর যে—কোনো যুদ্ধের বিজয়ের দিনটা আপনি দেখুন। জার্মানি বিজয়ের সময় মস্কোর সৈন্যদের আপনি দেখুন অথবা ওয়াটারলু যুদ্ধ আপনি দেখুন, ট্রাফাল গার যুদ্ধ দেখুন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখুন, ভারত—পাকিস্তান যুদ্ধ দেখুন, জাপান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেখুন। কোনো দিন মানুষ যুদ্ধ জয়ের পর এত শান্ত সমাহিত, এত ফ্রেন্ডলি, এত কুল, সফট এন্ড সোবার ছিল, এমন নজির আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম আমাকে দেখান যে, কাবুলের মধ্যে তালেবানরা বিজয়ের পর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শান্তি ও ক্ষমার, এমন দৃষ্টান্ত আরেকটি দেখাতে পারবেন না। পারলেও নিশ্চয়ই কোনো ইসলামী বাহিনীর বিজয় দেখাতে হবে।

তালেবানরা খুব খারাপ বলে প্রচার হচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, তালেবানরা এত খারাপ কেন? তারা ইসলামী ল’ বা শরীয়া ফলো করবে। সেটাই হলো সবার মনে একটি প্রশ্ন যে শরীয়াভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হয়ে গেল, যেটা ডেমোক্রেসি ক্লাবের বাইরে বা সমাজতান্ত্রিক ক্লাবের বাইরে অথবা মিয়ানমারের হিংস্র সেনাবাহিনীর উগ্র খুনিদের ক্লাবের বাইরে। এটাই হলো তাদের খারাপ লাগার মূল বিষয়।

একজন সাংবাদিক বলেছেন, ‘আমেরিকা তো মারের চোটে পালিয়ে যায়নি, তারা তো আলাপ—আলোচনা করেই গেছে।’ আসলে একটি পরাশক্তি কখন আলোচনার টেবিলে আসে? বুঝতে হবে, যারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পিষে ফেলার কথা বলেছিল কী অবস্থা দাঁড়ালে আলাপ—আলোচনা করে সে শক্তি চলে যায়? ব্রিটিশরা যে ১৯০ বছর পর ভারত থেকে চলে গিয়েছিল, তারা কি পরাজিত হয়ে গিয়েছিল নাকি দয়া করে স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছিল? এটা ইতিহাসের মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার একশ বছর আগে কংগ্রেস পার্টি গঠন করে এবং সেখানে রাজনীতি করার জন্য মানুষদেরকে তৈরি করে। তারা তাদের ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসি টাইপের রাজনীতি সেখানে শিখিয়ে যায় এবং ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান আর ১৫ই আগস্ট ভারতকে স্বাধীন ঘোষণা করে চলে যায়। ভারতের পরবর্তী কয়েক বছর ব্রিটিশ কলোনিয়ানরাই সবকিছু শিখিয়েছে, পড়িয়েছে, চালিয়েছে। তখনকার গভর্নর জেনারেল পর্যন্ত ইংরেজ ছিলেন। পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ব্রিটিশদের তৈরি। আইএসআই গোয়েন্দা সংস্থাও ব্রিটিশদের তৈরি। অতএব এর অর্থ এটা নয়, তারা যেহেতু এখানে সবাইকে তৈরি করে, শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে, এখানকার রুটিন কাজকর্ম শিখিয়ে চলে গেছে, কাজেই তারা দয়া করে চলে গেছে। তারা তাদের সাম্রাজ্য হারিয়ে এবং পরাজিত হয়েই গিয়েছে। কারণ এখানে ১৯০ বছরে অনেক সংগ্রাম, বড় বড় বিপ্লব, অনেক মানুষের রক্তদান, তিন কোটি ভারতীয়ের জীবন বিসর্জন রয়েছে। বোম্বেতে স্বাধীনতা স্তম্ভে যে কয়েক হাজার মানুষের নাম লেখা আছে এরা জানা শহীদ এবং সেখানে সবচেয়ে বেশি নাম হলো মুসলিমদের। এটা কি স্বাধীনতা নয়? এটা কি ব্রিটিশদের পরাজয় নয়?

আজকে আমেরিকানরা এখান থেকে বিদায় হয়েছে কেন? কারণ তারা আলাপ—আলোচনা করার মাধ্যমে প্রাণ নিয়ে বিদায়ের পথ খুঁজছিল। দ্রুত না গেলে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেত। ৮—১০ বছর যাবৎ কাতারে তালেবানের অফিস ছিল। আমরা  জানি, মোল্লা আব্দুল গনী বারাদরকে পাকিস্তানে আমেরিকানরা গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তানি সরকারের সাহায্যে। পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকেই তাকে খুঁজে বের করা হয় যে, এই লোকটি আলাপ—আলোচনায় পারদশীর্ এবং কূটনীতিতেও বেশ ভালো জ্ঞান রাখে। কাজেই তাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করি এবং আফগানিস্তান থেকে দ্রুত বের হওয়ার উপায় বের করি। আমেরিকা যে নির্মম পরাজয় বরণ করেছে তার প্রমাণ হলো, কাতার অফিসে আমেরিকা যখন সিগনেচার করে তখন সেখানে তারা বলে, আপনারা ইসলামী রাষ্ট্র করবেন এটা তো আমরা মানি না।

তখন আব্দুল গনী বারাদর বললেন, তোমরা এখান থেকে যাবে, এটা মেনে নাও। ইসলামী রাষ্ট্র করব কি না, এটা আমাদের ব্যাপার।

পরে তিনি বললেন, ইসলামী রাষ্ট্র করলে তোমরা যদি স্বীকৃতি না দাও তাই আমরা চাই, ইসলামী রাষ্ট্র হবে, এটাতে তোমরা সাইন করবে। নারীদের ব্যাপারে পশ্চিমা নীতি আমরা মানি না। এখানে ইসলামী নীতিই চলবে।

এরপর আমেরিকানরা বলল, আমাদের বাধা—ধরা সময়ের মধ্যেই আমরা সবাই বিদায় হয়ে যাব। আমাদের অস্ত্রপাতি কী করব? শিফট করতে পারব কি না?

মোল্লা বারাদর বলেছিলেন, এত কথার প্রয়োজন নেই। তোমরা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছ এবং সেইফ এক্সিট চাচ্ছ। সুতরাং বেশি কথার সুযোগ এখানে নেই। আমি আর দুই মিনিট এখানে বসব, শান্তিচুক্তিতে সাইন করার হলে করো, না হয় আরেকটি বৈঠক হবে বিশ বছর পর। তখন হয়তো আমার জুনিয়ররা সেখানে বসবে। কিন্তু আমেরিকা পক্ষের কেউ এখানে বসার মতো থাকবে না। কারণ বিশ বছর পর আমেরিকা এই বিশে^ গণ্য হওয়ার মতো কোনো শক্তি হিসেবে থাকবে না।

এটা ঐতিহাসিক চুক্তি। এরপর আমেরিকানরা এখান থেকে গেল। তাদের থ্রেট দেওয়া হয়েছিল, ৩১ আগস্টের পর যদি মার্কিন বাহিনী বা মিত্রবাহিনীর কেউ এখানে থাকে তাহলে এর দায়—দায়িত্ব কিন্তু আমরা নেব না। এই থ্রেটের পর ৩০ আগস্ট মধ্যরাতে তাদের শেষ সৈন্যটিও চলে যায়। তারা যদি বন্ধু হয়ে কোনো চুক্তি করে যেত তাহলে অবশ্যই এয়ারপোর্ট ভেঙে, সেখানের নিরাপত্তাব্যবস্থা চুরমার করে এবং তাদের হাতে যে পরিমাণ অস্ত্র ছিল সেগুলো ব্যবহার করে এতগুলো ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার, বিমান, হাম্বি ও অন্যান্য যানবাহন ধ্বংস করে যেত না। নিরাপদে যেতে পারবে না এই ভয়ে তারা সারা দেশের অস্ত্রভান্ডারগুলো ধ্বংসের কাজে হাত দেয়নি। কিন্তু জেন্টেলম্যান কমিটমেন্টের অপব্যবহার করে তারা সত্যিই পরাজিত শক্তির মতো আচরণ করেছে শুধু বিদায়ের মুহূর্তে এয়ারপোর্টে। কাজেই আমেরিকা তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে এটা কেউ বললে অন্তত বাস্তবতা তা স্বীকার করবে না।

এখন পৃথিবীর বিশাল অস্ত্রসামগ্রীর ভান্ডার আফগানিস্তানের তালেবানদের হাতে। এরপর বিরোধীরা আবার বললেন, পানশিরে তারা ঢুকতে পারেনি, যদিও তারা সারা আফগান দখল করে নিয়েছে। পানশির কোনো দিন কেউ পারেনি। সোভিয়ত ইউনিয়নের সময়ও পারেনি। কেন পারেনি? কারণ সোভিয়েতের বিরুদ্ধে সারা দেশেই মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। পানশিরের আহমদ শাহ মাসুদ লড়াই করেছিলেন। পানশির একটা অর্ধেক প্রদেশের সমান। বাকি ৩৪টি প্রদেশের জালালুদ্দীন হাক্কানী, গোলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, বুরহানুদ্দীন রব্বানী, আব্দুর রশীদ দুস্তাম, সৈয়দ আহমদ পীর এই সমস্ত লোক কি লড়াই করেননি? এই পানশির যখন পতন হয়ে গেছে তখন সবারই মন খারাপ। আহ্ হা! শেষ একটি যুদ্ধ আমরা করতাম মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে, স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে, আফগানিস্তানের সান অব সয়েলদের বিরুদ্ধে। শেষ যুদ্ধক্ষেত্র পানশির। সেখানে আমরা ৫২ রাষ্ট্র আবার সাহায্য করতে না পারি ষড়যন্ত্র তো অবশ্যই করতাম, কিন্তু সেটাও তো শেষ হয়ে গেল। যার হাতে পানশিরের পতন হয়েছে তাকে তালেবান সরকার সেনাবাহিনী প্রধান করেছে।

তালেবান ক্ষমতায় আসার দিন তাদের শরীয়া আইন সম্পর্কিত এক আলোচনায় আমাদের সাথে জনাব হাসান মাহমুদ সাহেব আমেরিকা থেকে যুক্ত ছিলেন। তিনি আসলে গবেষণা করেন ইসলামের একটি মডারেট রূপ তৈরির চেষ্টায়। আমি তার বই পড়েছি। তিনি যেভাবে কথাগুলো বলেন তা আর কারও সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন না। তিনি যদি বন্ধু হিসেবে একজন প্রকৃত ঈমানদার ও এলেমওয়ালা গবেষককে সঙ্গে নিতেন তাহলে তাঁর কথাগুলো ম্যাচিউর হতো। অনেক সময় দেখা যায় তিনি শরীয়তকে অস্বীকার করছেন। কখনো তিনি বলতে চান, শরীয়া হলো মানব চিত স্বার্থবাদী আইন। আল্লাহর আইন এমন হতে পারে না। কোরআন—হাদীস থেকে সরে গিয়ে মানুষ নিজেদের স্বার্থে শরীয়া আইনকে ব্যবহার করছে। এ কথাগুলো আলোচনার স্বার্থে যদি এক পার্সেন্টও সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, যদিও এ কথা মোটেও সত্য নয়। কিন্তু এসবের ফল যা হয়, আমাদের পাঠক ও শ্রোতার মনে হবে যে, তিনি ইচ্ছা করে শরীয়াকে ধসিয়ে দিচ্ছেন। ইসলামিক আইন ও ল—এর ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁর প্রশ্নগুলো তিনি নিজের মধ্যে রাখেন না, প্রজন্মের মধ্যে এ প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দেন। যা হাজার মানুষের মুরতাদ হওয়ার কারণ হতে পারে। এটি একটি অপরাধ।

তিনি তার আলোচনায় যিনা বিল জবরের ব্যাপারে পাকিস্তানের যে আইনের কথা বললেন, তা পাকিস্তানের সরকার করেছে। যিনা বিল জবর প্রমাণের জন্য চারজন সাক্ষী লাগবেই, এটা ইসলামে নেই। কারণ যেখানে যিনা সংঘটিত হয় সেখানেও সাক্ষীর বিষয়টি এত কঠিন রাখা হয়েছে, যেন ভুলক্রমে একজন মানুষের প্রাণহানি না ঘটে। মানুষকে মেরে ফেলা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু যিনা, ব্যভিচার, চরিত্রহীনতা, সংসারবিমুখতা, ফ্রি সেক্সকে নিমূর্ল করার জন্য ইসলাম এ আইন দিয়েছে। ইসলামের আইনের প্রেরণার সবটাই উপদেশ ও আখেরাতের ভয়। আল্লাহর ভয়। হাসান মাহমুদ সাহেব যদি বাংলাদেশি হয়ে থাকেন তাহলে তিনি জানেন যে বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ নিজেদের চারিত্রিক পবিত্রতা হেফাজত করতে চেষ্টা করেন। সে ৮০ ভাগ মানুষকে কি দুররা মারা হয়েছিল, না পাথর নিক্ষেপ করার ভয় আছে? এ দেশের শতকরা ৯০ জন মানুষ তো হাতের কাছে মদ পেলেও পান করেন না। তারা কি ৮০ বেত্রাঘাতের ভয়ে পান করেন না? এখানেই তার ভুল হয়েছে। তিনি শরীয়ার শাস্তিকে আল্লাহর আইন মানতে চান না, আবার ফকীহদের বিশ্লেষণকে সরাসরি আল্লাহর আইন বলে নাউযুবিল্লাহ আল্লাহর ওপর দোষ চাপাতে চায়।

পাকিস্তানের যে আইন রয়েছে সেখানে অবশ্যই একটি শর্ত লাগবে যে, ধর্ষণ প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। তা মানুষের দ্বারা হোক, ফিজিক্যাল টেস্টের দ্বারা হোক অথবা দুনিয়ার যে—কোনো পদ্ধতিতে হোক, সেটা করা লাগবে। যদি কিছু কড়াকড়ি করা না হয় তাহলে চরিত্রহীন নারী বা বদ লোকেরা নিরপরাধ মানুষকে কৌশলে ধর্ষণের মামলা দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াবে। কারণ যিনার জন্য ইসলাম যে শাস্তির বিধান দিয়েছে, একতরফা ধর্ষণের জন্য তা নয়; বরং আরও কঠিন। সমাজে তাকওয়া ও সুন্দর ব্যবস্থাপনার দ্বারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হবে যখন অপরাধী নিজেই আন্তরিকভাবে বলবে, আমি গোনাহ করেছি। আমাকে পবিত্র করুন। আমি ইসলামের আইন লঙ্ঘন করেছি। কোরআনে লিখিত আইনের আমি অবাধ্য হয়েছি। আমাকে শাস্তি দেন। যেমন ঘটনা রাসূলের সময়ে দু—একবার পাওয়া যায়। কিন্তু এই চৌদ্দশ বছরে ব্রিটিশদের আসার আগে পর্যন্ত পৃথিবীর লক্ষ—কোটি মুসলমানের ওপর যে ইসলামী শরীয়া আইন চলেছিল সেই সময়ও কি শুধু পাথর মারা হচ্ছে, শুধু চাবকানো হচ্ছে এই দৃশ্য দেখা যাবে? নিশ্চয়ই এমন নয়। কারণ, সমাজ ভালো হয়ে যাওয়ায় অপরাধের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় চলে আসে। তখন আর শাস্তির সুযোগই ঘটে না। মানুষ নিজে থেকেই আল্লাহর হুকুম মানতে থাকে। যেমন : শরীয়া আইনবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় গত একশ থেকে তিনশ বছর যাবৎ পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলমানরা চুরি, মদ্যপান, যিনা ইত্যাদি থেকে যে চেতনায় বেঁচে থাকে, সেখানে এমনিতেই একটা পবিত্র—পরিচ্ছন্ন মুসলিম জীবন এসে যায়। যেটা শরীয়াব্যবস্থার আধ্যাত্মিক প্রভাব। তাই যে—কোনো বিচারে শরীয়া আইন পশ্চিমা শাসনব্যবস্থা ও সভ্যতা থেকে শতগুণ উত্তম।

তিনি তো জানেন, আমেরিকাতে কী পরিমাণ ধর্ষন হয় আর আমাদের মুসলিম দেশগুলোতে কী পরিমাণ হয়। তিনি জানেন, সৌদি আরবে কী পরিমাণ হয়। মানবাধিকারের ব্যাপারে মুসলিম দেশে তাদের দৃষ্টিতে কিছু সমস্যা আছে। সেই গিলটি বা ক্রাইম শাসকদের। তারা পূর্ণ শরীয়া অনুসরণ করে না। আমি পূর্বেই বলেছি, ইসলাম একটি শরীয়া ধর্ম। ইসলাম শুধু উপদেশ নয়। শরীয়াকে যদি কেউ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়, যেমন ডেমোক্রেসিকে মানুষ ব্যবহার করে, সেক্যুলারিজমকে মানুষ ব্যবহার করে, ভদ্রতাকে মানুষ ব্যবহার করে, এডুকেশনকে মানুষ অপব্যবহার করে, সার্ভিস বা সেবাকে মানুষ অপব্যবহার করে, ঠিক এমন অপব্যবহার ধর্মেরও কেউ কেউ করে। সেটা এনে ইসলামের ওপর প্রশ্ন তোলা যায় না। প্রশ্নটা এভাবে করবেন, যারা করে তাদের ওপর আমার প্রশ্ন।

কোরআনে চার, পাঁচ, ছয়টির বেশি নির্ধারিত শাস্তি নেই। বাকি সকল শাস্তি শরীয়াবিশারদ বিচারকের মেধা, বুদ্ধি—বিবেচনা এবং যে ব্যক্তি ভিকটিম তার অবস্থা আর যে ব্যক্তি জালেম তার অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সেখানে অনেক সময় ক্ষমা করে দেওয়া হয়, অনেক সময় উল্টা সাহায্য ও পুনর্বাসন করা হয় এবং অনেক সময় নিরুপায় চোরের হাত কাটা বন্ধ করে সমাজের মানুষকে বেত্রাঘাত করা হয়।

এমন একজন নিরীহ মানুষ যার আয় নেই, ক্ষুধা ও অভাবের তাড়নায় শেষ পর্যন্ত তার খাদ্য চুরি করতে হলো কেন? শাসকরা তোমরা কোথায় ছিলে? সে দায় প্রতিবেশীর ওপর আসে, সেগুলো সিভিল সোসাইটির ওপর আসে, সেগুলো আর্মি পুলিশের ওপর আসে। এরপর আসে মূল শাসকের ওপর। কাজেই ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। শরীয়া একটি অসাধারণ সুন্দর ব্যবস্থা। শরীয়তের মধ্যে ফ্লেক্সিবিলিটি কী বা কতটুকু আছে সেটা নিয়ে মুসলমানরা নিজেরা কথা বললে ভালো লাগবে। কিন্তু বাইরের কেউ যদি এটা বলেন যে, শরীয়ার ওপর এই প্রশ্ন আমি তুলি। এমন প্রশ্নের জন্য যদি তিনি ‘স্পেশালিস্ট’ হয়ে যান এবং তিনি যদি বলেন, এমন তথাকথিত মডারেট মুসলমান আমি তৈরি করব, যারা শরীয়ার বিরুদ্ধে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে অথবা আমেরিকা টাইপ মুসলমান চাই, যারা শরীয়াকে স্থায়ী বিধান মনে করে না, আল্লাহর বিধান মনে করে না, এটি কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ কথা সবাই জানেন যে, পৃথিবীর সকল ল’ এর সূচনা হলো আল্লাহর বিধান। ব্রিটিশ ল’ বা আমেরিকান ল’ তাদের প্রথম আইনের বই তো বাইবেল। মানবজাতির প্রথম আইনই হয় ধর্মগ্রন্থ। যেজন্য কোরআন হলো আমাদের সোর্স। আমাদের হাদীস এবং কনভেনশনও সোর্স। আধুনিক একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইসলামে সবকিছু রয়েছে। কিন্তু এটা প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানসিকভাবে আমরা বিকারগ্রস্ত হয়ে গেছি। আমরা সমঅধিকার চাই কিন্তু সমান দায়িত্ব নিতে চাই না। নারীদের ইসলাম যে অধিকার দিয়েছে তাকে আমরা পশ্চিমাদের চোখে দেখি। তখন এসব বাজে কথা শুনে মুসলিম নারীরাও মনে করে, আসলেই কি আমরা কম অধিকার পেয়েছি? কিন্তু নিজের সম্মান ও দায়িত্বের কথা ভুলে যান।

আমি বলতে চাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তো দুইশ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু সেখানে একজন নারী প্রেসিডেন্ট কেন হয়নি? ইসলামী শাসনব্যবস্থায় আমীরুল মুমিনীন পদ ছাড়া অন্য কোনো জরুরি পদে নারী দায়িত্ব পালন করতে পারে। মুসলিম শাসনব্যবস্থায় সর্বশেষ ধর্মীয় ব্যক্তিটিকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। কারণ, তিনি ন্যাশনাল ইমাম। জাতীয় জামাতের নামায এবং জুমা যিনি পড়াবেন তিনি অবশ্যই পুরুষ হবেন। আর এর নিচের পদে প্রয়োজনে নারী অধিষ্ঠিত হতে পারেন। উপদেষ্টা নারী হতে পারেন। রাজনীতি শাখার প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীও প্রয়োজনে নারী হতে পারেন। যারা ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞানের সাধনায় জীবন দিচ্ছেন তাদের কাছে আপনাদের ইসলাম বুঝতে হবে। পশ্চিমা গোষ্ঠীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইসলাম বুঝলে হবে না।

আমি বলতে চাই না, হাসান মাহমুদ সাহেব ইসলামবিরোধী। কিন্তু তার স্টাডি এবং লেখায় চরম বেখাপ্পা এবং ভুল ব্যাখ্যার ভাব রয়েছে। বই লেখায় তার মেসেজটা বাইরে চলে যায়। মনে হয়, তিনি যেন ইসলামকে খুলে খুলে এলোমেলো করে দিচ্ছেন। ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা করছেন। ইউরোপ আমেরিকার এরকম ওরিয়েন্টালিস্ট ছিলেন, যারা ২০/৩০ বছর পরিশ্রম করার পর আরবী, কোরআন, হাদীস শিখে ইসলাম নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে তারা খেঁাচা দিয়ে বিষ মিশিয়ে ইসলামকে বিনাশ করেছেন।

ইসলাম ও ইসলামী শরীয়ার ব্যাপারে আমরা তার পজেটিভ চিন্তা কামনা করি। ইসলামের ব্যাপারে যদি তার অশ্রদ্ধা থাকে তাহলে ভেতরগতভাবে তিনি যেন পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন হয়ে খাঁটি মুসলমানের মতো মনোভাব পোষণ ও আচরণ করেন। তিনি যেন তার আগের লেখাগুলো অবশ্যই রিভাইস করেন। তার আগের লেখাগুলোতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার ভিত্তিতে উলামায়ে কেরাম তার ঈমানের ব্যাপারেও সন্দিহান হতে পারেন। তিনি যেন তার গবেষণাটা আরেকটু পরিশুদ্ধ করেন। একজন প্রকৃত বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেন।

ইসলামী আইন ও ইসলামী শরীয়াই শ্রেষ্ঠ এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। ইসলামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, সুষ্ঠু বিবেচনার মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন