প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

প্রসঙ্গ : রমযানে কয়েকটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা : ধৈর্য, দুআ ও সতর্কতা কাম্য

প্রসঙ্গ : রমযানে কয়েকটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা : ধৈর্য, দুআ ও সতর্কতা কাম্য

মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ


এক.

এ রমযানে (১৪৪৪ হিজরী/২০২৩ ঈসায়ী) বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অনেক মার্কেটে আগুন লেগেছে। বিশেষ করে গুলিস্তানের বঙ্গবাজার মার্কেটটি আগুনে পুড়ে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বছরের এ সময়টাতেই ব্যবসায়ীরা দোকানে পঁুজি খাটান সবচেয়ে বেশি। মালামালে পূর্ণ ছিল তাদের দোকান ও গোডাউন। সবকিছু পুড়ে গেছে আগুনে। আল্লাহ তাআলা ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার তাওফীক দান করুন। তাদের হালাল ব্যবসায় বরকত দান করুন। আমাদের সকলকে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে হেফাজত করুন।

 

দুই.

মনে রাখতে হবে, ঘটনা হোক আর দুর্ঘটনা—বুদ্ধিমানের জন্য তাতে থাকে শিক্ষার অনেক উপাদান। মুমিন বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে, সাহায্য করে, নিজে সতর্ক হয়, শিক্ষাগ্রহণ করে এবং আল্লাহর দরবারে প্রতিদানের আশা করে।

মানুষের জীবন মৌলিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত থাকে। এক ভাগ সুখ ও শান্তির, অপর ভাগ দুঃখ ও কষ্টের। তো মুমিন বান্দা যখন সুখ—শান্তিতে থাকবে তখন আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করবে। এটা হলো, তার শোকরের অবস্থা। যখন সে কোনো দুঃখ—কষ্টে পতিত হবে তখন সবর করবে। এটা তার সবরের অবস্থা। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

الإِيْمَانُ نِصْفَانِ نِصْفٌ فِيْ الصَّبْرِ وَنِصْفٌ فِيْ الشُّكْرِ

ঈমান দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ সবরের মধ্যে অপর ভাগ শোকরের মধ্যে।—বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৯৭১৫

ঈমানদার জীবনের সব পরিস্থিতিতে উপকৃত হয়, সওয়াব লাভ করে। আনন্দের সময় শোকর আদায় করে নেকী অর্জন করে। দুঃখ—কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে সওয়াব লাভ করে।

এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عجبا لأمر المؤمن ان امره كله له خير وليس ذلك لأحد إلا للمؤمن ، ان اصابتة سراء شكر فكان خيرا له وان اصابته ضراء صبر فكان خيرا له

মুমিনের ব্যাপারটা বড়ই আশ্চর্যের, তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া আর কারও এ অবস্থা নেই। সে সুখকর কিছু লাভ করলে আল্লাহর শোকর আদায় করে। এ শোকর তার জন্য কল্যাণকর। কষ্টদায়ক কোনো কিছুর (যেমন : অসুস্থতা বা বালা—মুসিবতের) সম্মুখীন হলে সে সবর করে। এ সবরও তার জন্য কল্যাণকর।—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ২২৯৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং : ১৬২২

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَا يُصِيْبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلَا وَصَبٍ وَلَا هَمٍّ وَلَا حَزَنٍ وَلَا أَذًى وَلَا غَمٍّ حَتّٰى الشَّوْكَةَ يُشَاكُهَا إِلَّا كَفَّرَ اللهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ

মুসলমান যে ধরনের দুঃখ—কষ্ট ও বিপদ—আপদেই পতিত হোক না কেন আল্লাহ পাক এর জন্য গোনাহ মাফ করেন। চাই তা অসুস্থতার প্রথম কষ্টই হোক বা অসুস্থতার পূর্ণ সময়জুড়ে স্থায়ী কষ্টই হোক। চাই ভবিষ্যতের কোনো শঙ্কা ও ভীতিই হোক বা অতীতের কোনো বিষয়ের দুঃখ—কষ্টই হোক। যেকোনো কষ্ট বা পেরেশানিই হোক। এমনকি মুসলমানের শরীরে কোনো কাঁটা বিদ্ধ হলেও আল্লাহ পাক এ কষ্টের বিনিময়ে তার গোনাহ মাফ করেন।—সহীহ বুখারী : ৫৬৪১; ৫৬৪২

ঈমানদার বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করলে উপকৃত হয়। বালা—মসিবত ঈমানদারের ঈমান বৃদ্ধি করে। আখেরাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করে। ঈমানদার বিপদ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে। পক্ষান্তরে মুনাফিক বিপদ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে না। সে বিপদে পতিত হওয়ার আগে যেমন ছিল তেমনি থেকে যায়।

এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أَصَابَه السَّقَمُ ثُمَّ أَعْفَاهُ اللهُ مِنْهُ كَانَ كَفَّارَةً لِمَا مَضٰى مِنْ ذُنُوْبِه وَمَوْعِــظَةً لَه فِيْمَا يَسْتَقْبِلُ، وَإِنَّ الْمُنَافِقَ إِذَا مَرِضَ ثُمِّ أُعْفِيَ كَانَ كَالْبَعِيْرِ عَقَلَه أَهْلُه ثُمَّ أَرْسَلُوْهُ فَلَمْ يَدْرِ لِـمَ عَقَلُوْهُ وَلَـمْ يَدْرِ لِـمَ أَرْسَلُوْهُ.

মুমিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ করলে এ রোগ তার পূর্ববর্তী গোনাহের কাফফারা হয়, ভবিষ্যতে তার জন্য উপদেশ হয়ে থাকে। কোনো মুনাফিক রোগ থেকে মুক্তি লাভ করলে তার অবস্থা হয় ওই উটের মতো যাকে তার মালিক বেঁধে রেখেছে, পরবর্তী সময় আবার মুক্ত করে দিয়েছে। কারণ, সে জানেই না, কেন তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল আর কেনই বা তাকে আবার মুক্ত করা হলো।—সুনানে আবু দাউদ : ৩০৮৯

অর্থাৎ মুমিন বান্দা কোনো রোগে বা বিপদে আক্রান্ত হলে এর কারণে সে দুটি পুরস্কার লাভ করে,

এক. আল্লাহ পাক তার পূর্ববর্তী গোনাহ ক্ষমা করে দেন।

দুই. তার ভবিষ্যৎ—জীবনের জন্য তা উপদেশ হয়ে থাকে।

বিপদ থেকে মুক্তি লাভের পর সে চিন্তা করবে, আল্লাহ তাআলাই এ রোগ ও বিপদ দিয়েছিলেন, তিনিই আবার সুস্থতা ও মুক্তি দান করেছেন। এ জন্য আমার গোনাহ থেকে বিরত থাকা উচিত। নাফরমানিতে লিপ্ত হলে আল্লাহ তো আবারও অসুস্থ করে দিতে পারেন। আবার বিপদে আক্রান্ত করতে পারেন। এ কথা ভেবে মুমিন বান্দা ভবিষ্যতে গোনাহ থেকে বিরত থাকবে।

আর মুনাফিক রোগাক্রান্ত হলে বা বিপদগ্রস্ত হলে এ পুরস্কার লাভ করে না। এর দ্বারা তার গোনাহ মাফ হয় না, সে এ থেকে কোনো উপদেশও গ্রহণ করে না। মুনাফিকের অবস্থা তুলনা করা হয়েছে উটের সঙ্গে। মালিক একটি উট ছেড়ে রাখল। উটটি স্বাধীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে কারও ক্ষেতে প্রবেশ করে ইচ্ছেমতো ফসল নষ্ট করল। এ অবস্থা দেখে ক্ষেতের মালিক উটটিকে তাড়া করল এবং উটের মালিককে গালিগালাজ করল। গ্রামে—গঞ্জে যেমনটি হয়ে থাকে। তো উটের মালিক উটকে ইচ্ছেমতো প্রহার করে রশি দিয়ে বেঁধে রাখল। দুদিন আর ছাড়ল না, কোনো খাবারও দিলো না। দুদিন পর রশি খুলে দিলো। উটটি সুযোগ পেলে আবার অন্যের ক্ষেতে প্রবেশ করবে কি না? অবশ্যই করবে। কারণ, মালিক যে প্রহার করেছে, বেঁধে রেখেছে এরপর মুক্তি দিয়েছে—এসব থেকে উট কোনো শিক্ষাগ্রহণ করে না। উট জানেই না, মালিক তাকে কী কারণে বেঁধে রাখল এবং আবার কী কারণে ছেড়ে দিলো। মুনাফিকের অবস্থাও তা—ই। মুনাফিক রোগাক্রান্ত হয়ে বা বিপদগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন গোনাহে লিপ্ত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে গোনাহ থেকে বিরত থাকে। এরপর সুস্থ হয়ে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।

তো একজন মুমিনের কর্তব্য হলো, নেয়ামতপ্রাপ্ত হলে শোকর আদায় করা এবং কোনো বিপদ—আপদ, দুঃখ—কষ্টের সম্মুখীন হলে সবর করা।

 

তিন.

পৃথিবীতে যত বিপর্যয় ও বিপদাপদ আসে তার সবই আমাদের কৃতকর্মের ফল। বর্তমান পৃথিবীতে যত অশান্তি ও অস্থিরতা সবই আমাদের বদআমলের ফল। উম্মত সামগ্রিকভাবে দীন—শরীয়ত থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। আখেরাতে আল্লাহ পাকের নেয়ামত ও গজব মানুষ লাভ করবে প্রত্যেকের নিজ নিজ আমলের হিসাবে। ওখানে একজনের বদআমল আরেকজনের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের হিসাব ভিন্ন। শান্তি—শৃঙ্খলা ও অশান্তি অস্থিরতা এখানে আসে উম্মতের সামগ্রিক অবস্থার ওপর বিচার করে। উম্মতের সামগ্রিক অবস্থা ভালো হলে আল্লাহ পাক রহমত ও বরকতের দরজা খুলে দেন আর সামগ্রিক অবস্থা খারাপ হলে তাঁর রহমত ও বরকত উঠে যায়। আল্লাহর আযাব নেমে আসে। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন—খারাবি বৃদ্ধি পায়। ফলে অন্যায়কারীদের পাশাপাশি আল্লাহর প্রিয় বান্দা, নিষ্পাপ শিশু ও অবোধ পশু—পাখিও কষ্ট ভোগ করে। তো যেকোনো বিপদকেই নিজের গোনাহের ফল মনে করে আল্লাহর দরবারে তওবা করতে হবে। চাই সে বিপদ আমার ওপর আসুক বা অন্য কারও ওপর।

বিপর্যয় ও দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন এ কথা বলার সুযোগ নেই, আক্রান্ত ব্যক্তিদের গোনাহের ফলেই এ বিপদ এসেছে। কারণ, দেখা যাবে সেখানে অনেক নিষ্পাপ ও আল্লাহওয়ালা মানুষও আক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহ পাক এ উম্মতকে একেবারে ধ্বংস করবেন না। তাই বিভিন্ন জায়গায় খণ্ড খণ্ডভাবে বিপর্যয় নেমে আসে। তাই আমরা সকলে আল্লাহর দরবারে তওবা করি। মনে করতে হবে, এ বিপর্যয় আমার গোনাহেরই ফল। আল্লাহ পাকের কাছে পানাহ চাইতে হবে যেন আল্লাহ পাক এ ধরনের বিপর্যয় থেকে সবাইকে হেফাজত করেন।

 

চার.

এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা জরুরি মনে করছি, বাহ্যিক যে কারণে এ বিপর্যয় ঘটেছে সে ব্যাপারে আমরা খুব খেয়াল রাখি। আগুনের সূত্রপাত হতে পারে যেসব কারণে সেগুলো থেকে আমরা দূরে থাকি। সতর্কতা অবলম্বন করি। এখানে যদি কারও বেআইনি কাজ ও অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অবশ্যই এদের শাস্তির আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য বাহ্যিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সতর্কতা অবলম্বন করাও শরীয়তের নির্দেশ।

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ اَعْقِلُهَا وَأَتَوَكَّلُ أَوْ أُطْلِقُهَا وَأَتَوَكَّلُ؟

قَالَ: اِعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ

এক লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি আমার উটনী বেঁধে রেখে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করব? নাকি ছেড়ে দিয়ে তাওয়াক্কুল করব?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি প্রথমে উটনী বাঁধো এরপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো।—জামে তিরমিযী, হাদীস নং : ২৫১৭

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝালেন, আল্লাহর ওপর বান্দার তাওয়াক্কুল ও ভরসা থাকবে পাশাপাশি নিজেকেও সচেতন হতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সতর্কতা ও সচেতনার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে যে, বিপর্যয় থেকে রক্ষার মালিক তো আল্লাহ।

আমরা জরুরি সতর্কতা অবলম্বন করব, আল্লাহর কাছে দুআ করব এবং রাসূলের শেখানো দুআগুলো পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে পড়ব। হাদীসে অনেক দুআর কথা এসেছে, যা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৈনিক পাঠ করতেন। এখানে কিছু বিশেষ আমলের কথা উল্লেখ করছি।

তিরমিযী শরীফে (হাদীস নং : ৩৪৩২) এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি বালা—মুসিবতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে দেখে এ দুআ পড়বে, ওই বালা—মুসিবত তাকে আক্রান্ত করবে না। দুআটি হলো :

اَلْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ عَافَانِيْ مِمَّا ابْتَلَاكَ بِهٖ وَفَضَّلَنِيْ عَلٰى كَثِيْرٍ مِّمَّنْ خَلَقَ تَفْضِيْلًا

দুআটি মনে মনে পড়ে নেবে। দুআটি বেশি বড় নয়। ছোট দুআ। আগ্রহ থাকলে অল্প সময়েই আমরা শিখে নিতে পারি। এর লাভ কত ভেবে দেখুন। কোনো বিপদগ্রস্তকে দেখে এ দুআ পড়লে আল্লাহ পাক ওই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।

ইমাম নববী রহ. তাঁর বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ আল—আযকারে লেখেন, একবার এক লোক হযরত আবু দারদা রাযি. এর কাছে বললেন, আবু দারদা, আপনার বাড়ি পুড়ে গেছে।

আবু দারদা রাযি. বললেন, না পোড়েনি। আল্লাহ পাক এমনটি হতে দেবেন না ওই দুআর কারণে, যা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, যে এ দুআ পাঠ করবে দিনের শুরুতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কোনো বিপদ হবে না। আর যে তা পাঠ করবে দিনের শেষে সকাল পর্যন্ত তার কোনো বিপদ ঘটবে না। দুআটি হলো :

اَللّٰهُمَّ اَنْتَ رَبِّيْ، لَا اِلٰهَ اِلَّا اَنْتَ عَلَيْكَ تَـوَكَّلْتُ وَاَنْتَ رَبُّ العَرْشِ الْعَظِيْمِِ، مَا شَاءَ اللهُ كَانَ، وَمَا لَمْ يَشَأْ لَمْ يَكُنْ، لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ العَلِيِّ العَظِيْمِ، أعْلَمُ أَنَّ اللهَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، وَأنَّ اللهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا، اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِيْ، وَمِنْ شَرِّ كُلِّ دَابَّةٍ أَنْتَ اٰخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا، إِنَّ رَبِّيْ عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ

অর্থ : হে আল্লাহ, আপনি আমার প্রভু। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনার ওপর ভরসা করেছি। আপনি মহান আরশের অধিপতি। আল্লাহ যা চান তা হয়। তিনি যা চান না তা হয় না। শক্তি ও ক্ষমতা কেবলই সর্বোচ্চ মহান আল্লাহর। আমি জানি আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। আল্লাহর জ্ঞান সবকিছু বেষ্টন করে আছে। হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আমার নফসের মন্দ থেকে। আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন সব ধরনের প্রাণী থেকে। নিশ্চয় আমার প্রভু সরল পথে রয়েছেন।

কত বরকতপূর্ণ দুআ। এ দুআর আমল আমরা নিয়মিত করি এবং মজবুত একীনের সঙ্গে পড়ি। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ পাক আমাদেরকে মুসিবত থেকে হেফাজত করবেন।

আরেকটি দুআ বলছি। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রাযি. এর ছেলে হযরত আবান রহ. বলেন, আমি হযরত উসমান রাযি. কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ عَبْدٍ يَقُوْلُ فِيْ صَبَاحِ كُلِّ يَوْمٍ وَمَسَاءِ كُلِّ لَيْلَةٍ: بِسْمِ اللهِ الَّذِيْ لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِه شَيْءُ فَي الْأَرْضِ وَلَا فِيْ السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ لَمْ يَضُرَّه شَيْءٌ

وَكَانَ أَبَانُ قَدْ أَصَابَه طَرَفُ فَالِجٍ فَجَعَلَ الرَّجُلُ يَنْظُرُ إِلَيْهِ، فَقَالَ لَه أَبَانُ: مَا تَنْظُرُ؟ أَمَّا إِنَّ الْحَدِيْثَ كَمَا حَدَّثْتُكَ، وَلكِنِّيْ لَمْ أَقُلْهُ يَوْمَئِذٍ لِيُمْضِيَ اللهُ عَلَيَّ قَدَرَه

যে কেউ প্রতিদিন সকাল—সন্ধ্যায় এ দুআ তিনবার পাঠ করবে পৃথিবীর কিছুই তার কোনো ক্ষতি করবে না। দুআটি হলো :

بِسْمِ اللهِ الَّذِيْ لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهٖ شَيْءٌ فِي الْاَرْضِ وَلَا فِيْ السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ

হযরত আবান রহ. এ হাদীস বর্ণনা করলেন। তাঁর এক পা অবশের মতো ছিল। এক লোক বার বার তাকে দেখছিল। (যেন সে বোঝাতে চায়, দুআ পড়লে যদি কোনো ক্ষতিই না হয়, তা হলে আপনার এ সমস্যা হলো কীভাবে।) হযরত আবান বিষয়টি বুঝতে পারলেন। বললেন, তুমি কী দেখছ? হাদীস আমি যা বলেছি তা—ই। কিন্তু আমি সেদিন দুআটি পড়িনি। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে যা ঘটার তা—ই ঘটল।—জামে তিরমিযী, হাদীস নং : ৩৩৮৮

 

পাঁচ

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যারা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আল্লাহ পাক সবাইকে ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নেওয়ার তাওফীক দান করুন। আমাদের কর্তব্য হলো যথাসাধ্য তাদের সহযোগিতা করা। যে যেভাবে পারি সাহায্য—সহযোগিতা করি। তাদের খেঁাজখবর নিই।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِيْ تَوَادِّهِمْ وتَرَاحُمِهِمْ وتَعاطُفِهِمْ، مَثَلُ الْجَسَدِ إَذَا اشْتَكى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعى لَه سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهْرِ وَالْحُمّى

পরস্পর মহব্বত, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে ঈমানদাররা এক দেহের মতো। তার কোনো একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে এর কারণে সারা দেহ রাত্রি জাগরণ করে ও জ্বরে ভোগে।—সহীহ মুসলিম : ৬৫৮৬

অপর এক হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

وَاَللّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ

যতক্ষণ কোনো বান্দা অপরের সাহায্য—সহযোগিতা করে ততক্ষণ আল্লাহ তার সাহায্য—সহযোগিতা করেন।—সহীহ মুসলিম

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اَلْمُسْلِمُ أَخُوْ الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهٗ وَلَا يُسْلِمُهٗ وَمَنْ كَانَ فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِيْ حَاجَتِهٖ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ. (باب ما جاء في الستر على المسلم)

মুসলমান মুসলমানের ভাই। তাই এক মুসলমান আরেক মুসলমানের উপর জুলুম করতে পারে না। এমনিভাবে মুসলিম ভাইকে কোনো জালেমের মুখে ছেড়ে আসতে পারে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে স্বয়ং আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। যে মুসলমানের কষ্ট দূর করে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করে দেবেন।—জামে তিরমিযী : ১৪৮৯

বিপদগ্রস্তকে সহযোগিতা করা তাদের প্রতি আমাদের দয়া নয়; আমাদের দীনি কর্তব্য। এ কর্তব্য পালন না করলে কাল কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: يَا ابْنَ آدَمَ! مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِيْ، قَالَ: يَا رَبِّ! كَيْفَ أَعُودُكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ! قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِيْ فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهٗ لَوَجَدْتَنِيْ عِنْدَهٗ؟ يَا ابْنَ آدَمَ! اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِيْ، قَالَ: يَا رَبِّ! وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ! قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهٗ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِيْ فُلَانٌ، فَلَمْ تُطْعِمْهُ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهٗ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِيْ، يَا ابْنَ آدَمَ! اسْتَسْقَيْتُكَ، فَلَمْ تَسْقِنِيْ، قَالَ: يَا رَبِّ! كَيْفَ أَسْقِيكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ! قَالَ: اسْتَسْقَاكَ عَبْدِيْ فُلَانٌ فَلَمْ تَسْقِهٖ، أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهٗ وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِيْ. (باب فضل عيادة المريض.)

আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন বলবেন, হে আদমসন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছি তুমি দেখতে যাওনি।

বান্দা বলবে, হে প্রভু, কীভাবে আপনাকে দেখতে যাব অথচ আপনি বিশ্বজাহানের রব!

আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল? তুমি তো তাকে দেখতে যাওনি। তাকে দেখতে গেলে সেখানে আমাকেই পেতে।

আল্লাহ বলবেন, হে আদমসন্তান, আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছি কিন্তু তুমি খাবার দাওনি।

বান্দা বলবে, হে প্রভু, আমি কীভাবে আপনাকে খাবার খাওয়াব, আপনি তো বিশ্বপ্রতিপালক!

আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি তাকে খাবার খাওয়ালে তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে।

আল্লাহ বলবেন, হে আদমসন্তান, আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি পান করাওনি।

বান্দা বলবে, হে প্রভু, কীভাবে আপনাকে পান করাব, আপনি তো রাব্বুল আলামীন!

আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল। তুমি তাকে পান করাওনি। তুমি তাকে পান করালে তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে।—সহীহ মুসলিম : ৬৫৫৬

অতএব আমরা সাধ্যমতো ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত ভাইদের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করি।

 

এসব ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। নিজেদের সংশোধনের ফিকির করি। আল্লাহর কাছে তওবা—ইস্তেগফার করি। মৃত্যুকে স্মরণ করি। কখন কীভাবে কোন অবস্থায় যে মৃত্যু এসে উপস্থিত হবে তা কেউ বলতে পারি না। অতএব নেক আমলের ফিকিরে থাকি। গোনাহ ছেড়ে দিই। আর যে আমলগুলোর কথা বলা হলো এগুলোর প্রতিও গুরুত্বারোপ করি। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে দীনের ওপর চলার তাওফীক দান করুন। পুরো জাতিকে পূর্ণ দীনদার হওয়ার তাওফীক দান করুন। এ দেশে রহমত ও বরকত নাযিল করুন। সকলকে নিরাপদে বসবাস করার তাওফীক দান করুন। সকল বালা—মুসিবত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

লেখক, প্রিন্সিপাল, ফরিদাবাদ মাদরাসা

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন