প্রেম : অনন্য মানবিক শক্তি
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
পাশ্চাত্যের মর্যাদাশীল মিডিয়ার জরিপে গত সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ মরমি কবি নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি রহ. (জন্ম : ৬০৪ হি., মৃত্যু : ৬৭২ হি.)। তিনি মুসলিম বিশ্বের সর্ববাদিসম্মত ইসলামী ভাবব্যক্তিত্ব। ২৬৬৬ পঙ্কক্তিবিশিষ্ট কাব্য সৃষ্টি মসনবী তার অমর কীর্তি। মাওলানা রুমি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ মুফতী, আলেম ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আধ্যাত্মিক ভাবনা ও সাধনা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চির অমর করে দেয়। রুমির দর্শন ছিল প্রেমের দর্শন। তার ভাষায়—প্রেম মানুষকে বিশ্বাস, বিবেক ও মানবিকতা দান করে। যখন প্রেম বা ভালোবাসা কার্যকর হয় তখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। ভালোবাসার টানে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে। মানুষ জীবনকে ভালোবাসে বলে বাঁচার লড়াই করে। নিজ পরিবার—পরিজনকে ভালোবাসে বলে তাদের জন্য ভাবে, কঠোর পরিশ্রম করে এবং আমৃত্যু তাদের সুখ—শান্তির জন্য কাজ করে যায়। এই প্রেম বা ভালোবাসা ধর্মেরও মূল চালিকাশক্তি। স্রষ্টার প্রতি প্রেম সৃষ্টিকে দায়িত্বশীল বানায়। একনিষ্ঠ ও আন্তরিক বানায়। কঠোর সাধক ও পরিশ্রমী বানায়। আল্লাহর প্রতি প্রেমই মানুষকে ইবাদতে নিমগ্ন রাখে। যিকিরে মশগুল রাখে। মানসিকভাবে আল্লাহর সকাশে অবস্থিত রাখে। আত্মিকভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে বিমোহিত করে রাখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর প্রতি ভালোবাসা মানুষকে নীতিবান ও মহৎ বানায়।
প্রেমে পড়লে মানুষ ভালোবাসার মানুষটিকে ঘিরেই নিজের জীবনকে পরিচালিত করে। তার পছন্দকে নিজের পছন্দ বানায়। যে—কোনো মূল্যে প্রেমাস্পদের আনন্দ ও সন্তুষ্টিই হয় তার একমাত্র সাধনা। সে তার নৈকট্য চায়, সান্নিধ্য চায়, তার সন্তুষ্টি ও সুখ চায়। প্রকৃত প্রেমিক নিজের প্রাপ্তির কথা ভাবে না, সে ভালোবাসতে পেরেই আনন্দিত থাকে। তার চাওয়া—পাওয়া থাকে শুধু প্রেমাস্পদের শান্তি, নিরাপত্তা, সুখ ও সমৃদ্ধি। তার রাজি খুশি ও সন্তুষ্টি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন :
قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ.
(হে নবী) আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো বলে দাবি করে থাকো তাহলে আমার অনুসারী হও; তাহলে আল্লাহই তোমাদের ভালোবাসবেন।—সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ৩১
হাদীস শরীফে এসেছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ.
তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা, পুত্র ও অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই।—সহীহ বুখারী
ইসলামে প্রেম ও ভালোবাসা এক অনন্য শক্তি। যার প্রয়োগ ও ব্যবহারে মানুষ উভয় জগতে সফলকাম হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআও করেছেন :
اَللّٰهمَّ اِنِّـيْ اَسْأَلُكَ حُـبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يُّحِـبُّكَ.
হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ো। সেসব লোকের ভালোবাসাও দান করো, যারা তোমাকে ভালোবাসে।—জামে তিরমিযী
মাওলানা রুমি বলেছেন, ভালোবাসাই জীবন। ভালোবাসা যখন কার্যকর থাকে তখন সেটি মানুষে—মানুষে সুস্থ সম্পর্ক নির্মাণ করে দেয়। ভালোবাসা যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। ভালোবাসা হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা ও পাশবিকতা ভুলিয়ে দেয়। ভালোবাসা লোহাকে মোম বানিয়ে দেয়। জ্বালানি তেলকে মধু বানিয়ে দেয়। তিতাকে মিঠা বানিয়ে দেয়। দূরকে নিকটে এনে দেয়। কঠিনকে সহজ করে দেয়।
যুগে যুগে প্রেম অসাধ্যকে সাধন করে। লায়লা—মজনু, শিরি—ফরহাদ, রজকিনি—চণ্ডিদাস যে প্রেমের দৃষ্টান্ত রেখেছেন তা শাশ্বত প্রেমেরই জয়গান। মনীষীগণ মানবীয় প্রেমকে দুভাগে ভাগ করেন: এক. প্রকৃত প্রেম। দুই. রূপক প্রেম। প্রকৃত প্রেম হয় ভোগ বা প্রাপ্তিহীন। কাম ও দেহ সংশ্রবহীন। আত্মা ও মননের সম্পর্ক দিয়ে। জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের আহ্বানে। কৃতজ্ঞতার টানে। যে প্রেম স্বর্গীয় ও অমর। যার শেষ নেই। এটি কেবল মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামীনের সাথেই হতে পারে। এর পথ ও পদ্ধতি হচ্ছে রাসূলের অনুসরণের পথ। আল্লাহর প্রেমিকদের ভালোবাসার মাধ্যমে। প্রকৃত প্রেমের উদাহরণ হচ্ছে, একটি গোলাপকে ভালোবাসা এবং একে তার গাছের বোঁটায় থাকতে দেওয়া। প্রয়োজনে এর যত্ন নেওয়া। আর রূপক প্রেমের উদাহরণ, সে ভালো লাগা গোলাপটি বোঁটা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া। এর মাধ্যমে এ ফুলটির মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হওয়া।
প্রেম শব্দটি মনের একটি ভাবের নাম। আরবীতে হুব্ব, ব্যবহারে মহব্বত। একজন শায়েখ আমাকে তার খানকায় নসীহতের সময় বলেছিলেন, জীবনের সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছে প্রেম। ভালোবাসা জড়িয়ে রেখেছে অস্তিত্বকে। টান, আকর্ষণ, ভাব, মায়া ইত্যাদি মহাশূন্য, মহাকাশ, মহাজাগতিক সবকিছুর অদেখা রশি। এ জন্য মানুষের মুখের উচ্চারণের স্থান যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু ‘হা’ আর যেখান থেকে শুরু সেখানে ‘বা’। অর্থাৎ আরবীতে ‘হুব্ব’ উচ্চারণ গোটা মুখ ভরে করতে হয়। বাংলা সাহিত্যে কথ্য বাগধারায় বলা হয়—প্রেম, প্রীতি, পিরিতি, পিরিত, ভাব, ভালোবাসা, টান, মায়া, মমতা, মহব্বত ইত্যাদি। প্রকৃত অর্থে এর কোনোটিই খারাপ বিষয় নয়। আমি জানি না, মানুষ কোন মনুষ্যত্বটিকে ভালোবাসা ছাড়া খঁুজে পাবে? একজন বুড়ো যদি একটি শিশুকে ভালোবাসে, যদি একজন পিতা তার সন্তান বা সন্তানতুল্য কাউকে ভালোবাসে, যদি একজন মা নিজ সন্তান বা দুনিয়ার অপর কোনো মায়ের সন্তানকে ভালোবাসে, এমনভাবে যদি দুনিয়ার কোনো ভাই—বোন তাদের অপর ভাই—বোনকে ভালোবাসে, যদি মানুষে মানুষে ভালোবাসা হয় তাহলে পৃথিবীতে হিংসা, অমানবিকতা, যুদ্ধ ও সন্ত্রাস এমনিতেই কমে যাওয়ার কথা। এ ভালোবাসা, এ প্রেম, এ আদর, এ মায়া, এ স্নেহ, এ বাৎসল্য কতই—না কাম্য!
বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও দায়িত্ববোধও এক ধরনের ভালোবাসা। মাকে ভালোবাসে বলেই সন্তান জীবন দিয়ে হলেও তাকে খুশি করতে চায়। পিতাকে সবকিছু উজাড় করে দেয় ভালোবাসে বলেই। দাদা—দাদি, নানা—নানি ও তাদের সমপর্যায়ভুক্ত বড়দের মানুষ যখন পরম যত্ন ও সম্মান করে, তখনও তাতে থাকে গভীর ভালোবাসা। এখানে দায়িত্ববোধ, মানবতাবোধ ও সৌজন্য, ভালোবাসা থেকেই উদ্গত। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একজন মানুষকে কেউ যখন দাদা—দাদি, নানা—নানি, বাবা—মা, ভাই—বোন, খালা—ফুপু ইত্যাদির মতো ভেবে তার সাথে সদয় ও সৌজন্যময় আচরণ করে, তখনও এখানে কাজ করে ভালোবাসা। অর্থাৎ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক তা যে পর্যায়েরই হোক, এর পেছনে লুকিয়ে থাকে মানবিক ভালোবাসা। এর সাথে যখন কোনো অনৈতিক লাভ বা স্বার্থ জড়িয়ে থাকে তখন এ ভালোবাসা হয় কলুষিত। আর লাভ বা স্বার্থ যখন হয় নৈতিক, বৈধ ও শরীয়তসিদ্ধ তখন এ ভালোবাসা দোষমুক্ত। ক্ষেত্রবিশেষে সওয়াবের কাজ। যেমন : সন্তানদের আদর করা। তাদের চুমু খাওয়া।
একবার আকরা ইবনে হাবেস রাযি. দেখতে পেলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাতি হযরত হাসান রাযি.—কে চুমু খেলেন। আকরা ইবনে হাবেস বললেন, আমার দশ সন্তান আছে। কোনোদিন তাদের কাউকে চুমু খাইনি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে অন্যের প্রতি দয়া করে না, তাকেও কেউ দয়া করে না।—সহীহ বুখারী
নিজ নাতি—নাতনিকে আদর—স্নেহ করা। স্বামী—স্ত্রী একান্তে সময় কাটানো। পিতা—মাতা বা বড় কোনো মুরুব্বীর সেবা—যত্নে নিয়োজিত থাকা। যেকোনো মুসলিম ভাইয়ের কাজ—কর্ম করে দেওয়া। অনাথ, এতিম, বিধবা, অথর্ব, অসুস্থ, নিঃসন্তান, অচল, প্রবীণ, প্রবীণা প্রভৃতি মানুষের সেবা করা। ধর্ম—বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবা। আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি প্রাণী বা জীবের প্রতি ভালোবাসা পোষণ। এসব ভালোবাসায় অফুরন্ত সওয়াব আছে। বিশেষত শরীয়তসম্মত ভালোবাসা অনেক বড় সওয়াবের সাথে জড়িত। যেমন : হাদীসে কুদসীতে আছে :
وَجَبَتْ مَحبَّتِي لِلْمُتَحَابِّينَ فيَّ.
আমার ভালোবাসা তাদের প্রতি অবধারিত, যারা আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে।—মুয়াত্তা মালেক
অন্য হাদীসে আছে :
اَلْخَلْقُ عِيَالُ اللهِ.
সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর পরিবার।—শুয়াবুল ঈমান
হাদীস শরীফে এমনও এসেছে :
ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ.
পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়ালু হও, ঊর্ধ্বলোকে যিনি আছেন (আল্লাহ) তোমাকে দয়া করবেন।—জামে তিরমিযী
আরেক হাদীসে আছে :
وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ.
আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ সে তার অপর ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে।—সহীহ মুসলিম
হাদীসে আছে :
رِضى اللَّهِ في رِضى الوالِدَينِ ، وسَخَطُ اللَّهِ في سَخَطِ الوالدينِ.
আল্লাহর সন্তুষ্টি মাতা—পিতার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। আর তাদের অসন্তুষ্টিতেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি।—শুয়াবুল ঈমান
অপর হাদীসে আছে :
الجَنَّةُ تَحْتَ أقْدامِ الأُمَّهاتِ.
মায়েদের পদতলে সন্তানের বেহেশত।—কানযুল উম্মাল
অন্য হাদীসে আছে :
إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ.
আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে দানই করা হয় তার প্রতিটির সওয়াব তুমি পাবে। এমনকি সেই লোকমা বা খাদ্য যা তুমি তোমার স্ত্রীকে মুখে দিয়ে থাকো।—আলআদাবুল মুফরাদ
أَفْضَلُ دِينَارٍ يُنْفِقُهُ الرَّجُلُ دِينَارٌ يُنْفِقُهُ عَلَى عِيَالِهِ.
সর্বশ্রেষ্ঠ দিনার (টাকা—পয়সা) সেটি যেটি মানুষ তার পরিবারের জন্য ব্যয় করে।—সহীহ মুসলিম
দুনিয়াজুড়ে যে প্রেম বা ভালোবাসার জগৎ তা বড় আকারে মানুষ চিন্তা করে না। এ জন্যই মানুষের জৈবিক আকর্ষণ বা সেক্সকে অনেকেই ভালোবাসার একমাত্র অর্থ বলে ধরে নেয়। যা অনেক বড় ভুল। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বের বড় বড় দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও শিক্ষিত লোকেরা এ ভুলটি যুগ যুগ ধরেই করে এসেছেন। আশ্চর্য লাগে, বিজ্ঞান প্রেমকে একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। কিন্তু বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা যারা জানেন তাদের জন্য এতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই; কারণ, বিজ্ঞান কেবল বিষয়টি কীভাবে হয় তা বলতে পারে, কেন হয় বা কে করেন তা কোনো দিনই বলতে পারে না। এটি বলার চেষ্টা করে দর্শন। কিন্তু সব সময়ই ভুল বলে।
কবি, সাহিত্যিক, ভাবুকরা নিজ অনুভূতি, উপলব্ধি বা কল্পনা স্বাধীনভাবে বলে যান; তবে এর শুদ্ধ—অশুদ্ধের দায়িত্ব নেন না। এ ক্ষেত্রে সত্য ও বাস্তবতা তুলে ধরার একমাত্র অথরিটি হচ্ছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। প্রেমের স্রষ্টা, প্রকৃতি ও প্রাণের স্রষ্টা, জীবন ও জগতের স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামীন ওহীর মাধ্যমে প্রেমের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটিই পরম সত্য। মহান আল্লাহর একটি নাম ‘পরম সত্য’ আল—হক। তাঁর কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন শেষ যুগের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সৃষ্টিজগতে তিনিই ‘চরম সত্যবাদী’ আস—সাদিক, আল—আমীন।
প্রেম সম্পর্কে শুরুতেই বলে এসেছি ‘আল্লাহর বাণী’ যেখানে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যেসব মানুষ দাবি করে যে তারা প্রেমিক, তারা আমাকে ভালোবাসতে চায়। তাদের আপনি বলে দিন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমি মুহাম্মদের অনুসারী হও, তবে আল্লাহই তোমাদের ভালোবাসবেন আর তোমাদের অপরাধ ক্ষমাও করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।—সুরা আলে ইমরান, ০৩ : ৩১
পাশাপাশি আল্লাহর নবীও বলেছেন, তোমরা কেউই পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমাকে নিজ পিতা, পুত্র ও দুনিয়ার সকল মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসবে।—সহীহ বুখারী
দুনিয়াতে পরস্পরকে ভালোবাসার জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূর জাহান বিখ্যাত। নূর জাহানকে পাওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর নিয়মনীতিও ভেঙেছেন কম না। সম্পর্ক এমনই ছিল যে, রাজদরবার চলাকালে দেওয়ালের ঝরোকার আড়ালে পর্দায় থেকে যদি নূর জাহান তার কোমল পেলব হাত সম্রাট জাহাঙ্গীরের পিঠে রেখে বসে না থাকতেন তাহলে সম্রাট স্থিরচিত্তে রাজকার্য পরিচালনা করতে পারতেন না।
কিন্তু তিনি এই নূর জাহানকেও আল্লাহ ও রাসূলের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন না। এর প্রমাণ, যেদিন ভুলবশত তির মেরে নূর জাহান এক দাসীর ছেলেকে হত্যা করে আর এর বিচার বসে মোঘল দরবারে, তখন সে ছেলেটির মা সম্রাজ্ঞীর দাসী বলেছিল, আজ পরীক্ষা হবে জাহাঁপনার কাছে তার প্রেম বড়; না ইনসাফ। বাদশাহ ইসলামের ন্যায়পরায়ণতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আগে জানতেন না, কে অপরাধী। বললেন, দোষী সে যেই হোক, তাকে সাজা পেতেই হবে। ঘোষণা করলেন, মৃত্যুদণ্ড।
যখন জানলেন, অপরাধী তার প্রিয়তমা যাকে ছাড়া তার জীবন চলে না। কষ্ট চেপে রেখে বিষের পেয়ালা মুখে তুলে নেওয়ার মতোই তাকে শুনিয়ে দিলেন মৃত্যুদণ্ড। অবশ্য পরে সেই দাসী নিজ থেকেই তার পুত্রশোক মেনে নিয়ে রক্তপণের বিনিময়ে নূর জাহানকে চরম দণ্ড থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, সম্রাটের ভালোবাসার কথা আমি জানি। তা ছিনিয়ে নিয়ে আমি তো আর আমার পুত্রকে ফিরে পাব না। তবে এই ন্যায়বিচারে আমি খুশি। আমি দেখলাম, মোঘল সম্রাট তার ভালোবাসার চেয়েও ন্যায়নীতি ও সুবিচারকে বেশি ভালোবাসেন।
এটিই একজন শাসক, বিচারক ও সম্রাটের পক্ষে শোভনীয়। ভালোবাসার স্তর, পর্যায় ও তুলনামূলক বিন্যাস আমরা এ ঘটনা থেকে শিখতে পারি। অবশ্য সাম্রাজ্যের প্রধান মুফতী কাজির এ বিচারের সাথে এ জন্য দ্বিমত করেছিলেন যে, খুনটি হয়েছিল ভুলক্রমে। যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। শরীয়ত যাকে ‘ক্বতলে খাতা’ বলে অভিহিত করে। নূর জাহানের তির লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ছেলেটির গায়ে লেগেছিল। আর ছেলেটি যে সেখানে আছে তা সম্রাজ্ঞী নূর জাহান জানতেনও না।
মানুষ মহাকালে ভ্রমণরত একটি প্রাণী। যে প্রাণী বুদ্ধিমান, সামাজিক ও নীতিবান। মানুষের চেতনা একটি প্রাচীন ও স্থায়ী বিষয়। পৃথিবীতে মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে তখন থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত একটি পার্থিব জীবন সে যাপন করে। মৃত্যুর সাথে সাথে তার দৈহিক জীবন স্থানান্তরিত হয়। তার আত্মা আল্লাহর হুকুমে একটি স্থানে অপেক্ষমাণ থাকে। শেষ বিচারের পূর্ব পর্যন্ত আত্মা সেখানেই থাকবে। ভালো ও মন্দ বিবেচনায় আত্মারা শান্তিময় বা অশান্তিময় দুটি ঠিকানায় থাকে। যার একটিকে বলা হয়, ‘ইল্লিয়্যীন’ বা প্রশান্তিময় ঊর্ধ্বলোক। অপরটির নাম ‘সিজ্জীন’ অশান্তিময় অধলোক বা আত্মার বন্দিশালা।
মানুষের পার্থিব দেহ পচনশীল। মৃত্যুর পর সাধারণত সেটি মাটিতে মিশে যায়। পোকা—মাকড়, কীট—পতঙ্গ ও জীবাণুর খোরাক হয়। এমনকি মানুষের হাড়গুলোও সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিহ্ন হয়ে মাটিতে পরিণত হয়। কেয়ামতের দিন আল্লাহর হুকুমে মানুষের আত্মা নতুন দেহ ফিরে পাবে। এখানে মানুষের জীবন, চেতনা, প্রাণ, আত্মা বা রুহ যা—ই বলা হোক—এটি একটি অপার্থিব বিষয়। যা মায়ের পেটে শিশুর দেহে ফুঁকে দেওয়া হয়, আবার জীবন শেষে তুলে নেওয়া হয়। যে পরিবর্তনকে মানুষ জীবন—মৃত্যু নাম দিয়ে থাকে।
মানুষ তার চেতনাটি কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকে। চেতনা থাকে বলেই সে দু—পায়ে ভর করে জীবনভর হেঁটে বেড়ায়। যেভাবে ইচ্ছা দৌড়—ঝাঁপ করে, লাফায়, যুদ্ধ করে, পরিশ্রম করে। মানুষের এই চেতনাটি সক্রিয় থাকে বলেই সে সভ্যজগতে চলার উপযোগী থাকে। এই চেতনার বিনাশ ঘটলে তার মনুষ্যত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। নিজের অজান্তে তার পেশাব—পায়খানা হয়ে যায়। সে তার আত্মমর্যাদা ধরে রাখতে পারে না। রাস্তাঘাটে, ডোবা নর্দমায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। এই চেতনা থেকে সে সাধারণত মুক্ত হয় না। কখনো এই চেতনাবিরোধী উদানীসতা পাওয়া গেলে এ জন্য ইসলাম তাকে ওযু করতে বলে। ইসলাম ধর্মে ওযু—গোসল মূলত এই খোদাপ্রদত্ত চেতনার কৃতজ্ঞতা। শুকরিয়া আদায়ের জন্যই মুসলমানরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওযু—গোসল করে। মানুষের চেতনা অনেকটাই হালকা হয় ঘুমের সময়। অনেকটাই বিদ্ধ হয় পেশাব—পায়খানা বা বায়ু ত্যাগের সময়। এ জন্যই এসবের ফলে ওযু ভেঙে যায়। পবিত্রতা অর্জনের জন্য বা আল্লাহর নির্ধারিত ইবাদতে মগ্ন হওয়ার জন্য তাদের ওযু করতে হয়। মানুষ যখন জৈবিক আহ্বানে সাড়া দেয় তখন তার দেহে একধরনের ব্যতিক্রমী ভাব বা উপলব্ধি আসে। এ অবস্থাটি তার চেতনাকে অধিক বিঘ্নিত করে; যার ফলে তাকে গোসল করতে হয়।
পৃথিবীতে মানুষের চলার জন্য যে খোদায়ী বিধান বা শরীয়ত দেওয়া হয়েছে এর প্রতিটি হুকুম মানুষের কল্যাণের জন্যই। শরীয়তের মুখ্য উদ্দেশ্য পাঁচটি :
এক. মানুষের দ্বীন—ঈমানের হেফাজত।
দুই. মানুষের নিজের অস্তিত্ব ও প্রাণের হেফাজত।
তিন. মানুষের বুদ্ধি ও চেতনার হেফাজত।
চার. মানুষের বংশধারার হেফাজত।
পাঁচ. মানুষের অর্থ—সম্পদের হেফাজত।
এ পাঁচ শিরোনামের আওতায় পৃথিবীর সকল বিষয় এসে গেছে। এখানে মানুষের বুদ্ধি—চেতনা ও বংশধারার হেফাজত বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে শরীয়তের কিছু বিধি—বিধানের সাথে। যেমন : ধরা যাক, শরীয়ত মদ ও মাদকদ্রব্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম করেছে। হোক তা অল্প বা বেশি। মানুষের বিবেক—বুদ্ধি লোপ পায় এমন যেকোনো মাদক চিরতরে হারাম। এর শাস্তিও শরীয়তে নির্ধারিত। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদণ্ডও প্রস্তাব করা হয়েছে। সাধারণ শাস্তি আশিটি দোররা (চাবুক বা বেত্রাঘাত)। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, মদ সকল গোনাহের আধার। মানুষের বিবেক—বুদ্ধি লোপ পায় এমন যেকোনো মাদক—তা অল্প হোক বা বেশি—সম্পূর্ণ হারাম। পরকালে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। নরকবাসীর দেহের ঘৃণিত ঘাম ও পুঁজ তাকে খেতে বাধ্য করা হবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির দুআ এমনকি শবে কদরেও কবুল হয় না। একই ধরনের অবস্থা ওই দুই ব্যক্তির জন্যও, যারা পিতা—মাতার অবাধ্য ও মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী।
অপর বিষয়টি হলো, বংশধারার হেফাজত। যা মানুষের জৈবিক চাহিদার সাথে জড়িত। ইসলাম সুশৃঙ্খল যৌনতায় বিশ্বাসী। বলা হয়েছে, ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَلَقَدْ اَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّنْ قَبْلِکَ وَ جَعَلْنَا لَهُمْ اَزْوَاجًا وَّذُرِّیَّۃً.
আমি আপনার পূর্বে বহু রাসূল পাঠিয়েছি এবং তাদের সকলকে স্ত্রী—পুত্র—কন্যাধারী সংসারী করেছি।—সূরা রাদ, ১৩ : ৩৮
একান্ত ব্যক্তিগত কারণ ছাড়া সংসারী না হওয়া ইসলামে প্রশংসিত নয়। বংশধারা বিস্তার, জৈবিক চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে দৈহিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ ও নিজের নৈতিক চরিত্র শুদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে আদর্শ দাম্পত্যজীবন যাপন করা আল্লাহর রাসূলের সুন্নত। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সুন্নতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করবে, সে উম্মতের অন্তভুর্ক্ত নয়।
একজন ঈমানদারের জন্য স্বাভাবিক যৌন অনুভূতি নিন্দনীয় নয়। তবে এর ফলে উৎসারিত যেকোনো অন্যায়, অশ্লীলতা ও পাপাচার নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। একজন মুমিন কখনই যিনা করতে পারে না। অন্য যেকোনো যৌনাচার তার পক্ষে শোভা পায় না। এমনকি কামভাব জাগ্রত হতে পারে এমন কোনো বিষয়, আচরণ বা পরিবেশ থেকেও তাকে সচেতনভাবে দূরে থাকতে হবে। যেমন : হাতের যিনা (স্পর্শ), কানের যিনা (অশ্লীল ও উত্তেজক বিষয় শ্রবণ), চোখের যিনা (নিষিদ্ধ দৃশ্য বা চেহারা দেখা), মনের যিনা (অন্তরে কুচিন্তা ও নিষিদ্ধ ভাবনা লালন), পায়ের যিনা (চরিত্রবিনাশী কাজে গমন) ও বাস্তবে যিনায় লিপ্ত হওয়া। এ সবই কঠোরভাবে ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ধরনের গোনাহ সংঘটিত না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে, হে রাসূল, আপনি ঈমানদার নারী—পুরুষকে বলে দিন, তারা যেন তাদের পরস্পরের দৃষ্টিকে সংযত ও অবনত রাখে। আর নিজেদের নৈতিক চরিত্রকে স্খলন থেকে রক্ষা করে।
পবিত্র কোরআনে যিনাকে বলা হয়েছে, কঠিন অশ্লীলতা ও মন্দ আচরণ হিসেবে। এ অপরাধের শাস্তিও ইসলাম নির্ধারিত করে দিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে বেত্রাঘাত ও মৃত্যুদণ্ড। পরলোকে যিনাকারী ও যিনাকারিণীদের আগুনে জ্বলা ও আরও নানাবিধ কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
যিনার আধ্যাত্মিক ক্ষতি ও গোনাহ বলে শেষ করা যাবে না। এমনকি এতে মৃত্যুর সময় ঈমান হারানোর ভয়ও থাকে। দুনিয়াতে অসম্মান, স্বাস্থ্যহানি, ভাগ্যহানি, চেহারার নূর চলে যাওয়া, মনের অন্তহীন অশান্তি ইত্যাদি তো আছেই। এখানে এর একটি ক্ষতির দিক আলোচনা করলে ভালো হবে বলে মনে হয়। সেটি হলো, যিনার দ্বারা মানুষের বংশধারার বিনাশ ঘটে। যেমন : ইসলামপূর্ব যুগে যিনার কারণে মানুষ তার সন্তানের পরিচয় নির্ধারণ করতে পারত না। বর্তমানেও পাশ্চাত্য জগৎ ও দুনিয়ায় তাদের সংস্কৃতি অনুসারীরা পিতৃপরিচয়হীন সন্তান জন্ম দিচ্ছে। উন্নত অনেক দেশে অর্ধেকের বেশি সন্তান জারজ। বিশাল পরিমাণ নারী বিবাহ—বহিভূর্ত সন্তানের মা হচ্ছেন। আমাদের আশেপাশেও বহু দেশে এ ধরনের বংশপরিচয়হীন মানবশিশু দিনদিনই বাড়ছে। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও সুদর্শন পুরুষের সন্তান ধারণের জন্য নারীরা এখন নির্বাচিত কিছু পুরুষের শুক্রাণু নিজের গর্ভে ধারণ করে বাচ্চা নিচ্ছে। এ সবই মানবজাতির বংশধারা, বংশপরিচয়, জন্মগত পবিত্রতা, উত্তরাধিকার তথা মনুষ্যত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
যৌন বিশৃঙ্খলা রোধের জন্য ইসলাম নারী—পুরুষের উভয়ের জন্য দৃষ্টি, স্পর্শ, চিন্তা, সঙ্গ ও চরিত্র নিয়ন্ত্রণের বিধান দিয়েছে। নারীদের তার পতিগৃহে অবস্থানকারী পুরুষ আত্মীয়দের (দেবর, ভাসুর, নন্দীজামাই, ভাতিজা, ভাগিনা ইত্যাদি) সাথে কঠোর সংযম, সতর্কতা ও পর্দার হুকুম দিয়েছে। নিরিবিলি কোথাও কোনো পরপুরুষের সাথে সাক্ষাৎ নিষেধ করেছে। স্বামীর অবর্তমানে কোনো পরপুরুষকে গৃহে স্বাগত জানাতেও মানা করেছে। দূরের কোনো ভ্রমণে বৈধ সঙ্গী ছাড়া যেতে নিষেধ করেছে। একই ধরনের বিধি—বিধান পুরুষের বেলায়ও প্রযোজ্য। তারাও কোনো পরনারী বা বিবাহ সম্ভব আত্মীয়ার সাথে একাকী বসতে পারবে না। দেখা, সাক্ষাৎ, স্পর্শ বা একান্তে সময় কাটানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিশেষ করে, প্রতিবেশিনীর সাথে কোনোরূপ অন্যায় সম্পর্ক ইসলাম কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এ সবই মানুষের মনুষ্যত্ব, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মর্যাদাবোধ, যৌন জীবনের পবিত্রতা, নৈতিক চরিত্র, সন্তানের বংশপরিচয় ইত্যাদি রক্ষার প্রয়াস।
এসব উদ্দেশ্যে যে নারী—পুরুষ সম্পর্ক শরীয়ত বৈধ করেছে এখানে এর লক্ষ্য—উদ্দেশ্যও কোরআনে বর্ণিত আছে। মহান আল্লাহ বলেন :
وَ مِنْ اٰیٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَیْهَا وَ جَعَلَ بَیْنَكُمْ مَّوَدَّۃً وَّ رَحْمَۃً.
আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে এটিও একটি যে, তিনি তোমাদের থেকেই সৃষ্টি করেছেন জীবনসঙ্গিনী। যেন তাদের কাছে তোমরা স্বস্তি খঁুজে পাও। আর ধীরে ধীরে এ সম্পর্ক রূপান্তরিত করেন পরস্পরের প্রতি মায়া ও ভালোবাসায়।—সূরা রূম, ৩০ : ২১
এখানে প্রেম বা ভালোবাসা আছে। কিন্তু নিজের বিবেক—বুদ্ধি, দায়িত্ব—কর্তব্য ভুলে গিয়ে স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসায় ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয় নয়। ভালোবাসার সংজ্ঞা নিরূপণ করে ভারসাম্য রক্ষা করে সারা জীবন ভালোবাসার মানুষদের ভালোবেসে যাওয়া একজন স্বাভাবিক মানুষের কাজ। এর ব্যতিক্রম অন্যায়, জুলুম ও সীমালঙ্ঘন।
যেমন : কোনো কোনো জায়গায় এমনও দেখা যায় যে, একটি ছেলে খুবই স্নেহপরায়ণ ও মাতৃভক্ত। তাকে পরিবারের লোকজন বিয়ে করালো। নতুন জীবন, নতুন অনুভূতি, নতুন সমস্যা। মা, ছেলে, তার ভাই—বোন, নতুন বউ মিলে একটি অভিনব সূচনা। ভুল—ত্রুটি সবারই হয়তো ছিল; কিন্তু ছেলেটি ভালোবাসার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। সে তার মা, ভাই—বোনকে আগের মতো আর দেখে না। হয়তো দেখতে পারে না। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারে না। কারণ, বউয়ের সাথে তার অন্য রকম আবেগের সম্পর্ক। তার সাথেই তাকে থাকতে ও বাঁচতে হয়। অন্যদের চাহিদা বা ধারণা বাস্তবে রূপ দেওয়া তার পক্ষে এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। নিঃসন্দেহে সে তার মাকে ভালোবাসে। ভাই—বোনদেরও ভালোবাসে আগের মতোই। এ ধরনের টানাপোড়েনে মানুষ সততই পড়ছে। খুব বিবেচনা, গভীর জ্ঞান, অনেক কৌশল, যথেষ্ট সংগতি থাকলেই কেবল এই ছেলেটি একটি সুন্দর অবস্থানে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে। তবে এ জন্য তার চারপাশে যারা আছেন তাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের পাশাপাশি ধৈর্য, সহনশীলতা, উদারতা ও শান্তিপ্রিয়তা বিশেষভাবে জরুরি। সমাজ ও সংসার এ ধরনের বাস্তবতাকে নির্মোহ চোখে দেখে না। তখনই দেখা দেয় সংকট। ছোট্ট সমস্যা বড় হয়ে হয়ে ধ্বংস ও ভাঙনে রূপ নেয়। একদিকের লোক দোষ দেয় মা, ভাই—বোনকে। অন্য দিকের মানুষ দায়ী করে নতুন বউকে। দু—দিকের চাপে দিশেহারা হতে হয় ছেলেটিকে। এটি আসলে ভালোবাসার সঠিক প্রয়োগ ও নিখঁুত ভারসাম্যের সংকট। যদি প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান, মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব বাস্তবতার আলোকে বুঝত এবং অপরের অধিকারটুকু স্বীকার করে খুশি মনে দিয়ে দিত, তাহলে এ সংকট থাকত না।
ভালোবাসা মনোযোগ আশা করে। নৈবেদ্য চায়। ভালোবাসা স্বার্থপরও হয়। একজন মা, একটি পরিবার যে ছেলেটিকে বড় করে, তাদের কিছু স্বপ্ন ও আশা এই ছেলেকে ঘিরে থাকাই স্বাভাবিক। আবার এই ছেলে তার জীবনের ভবিষ্যতের জন্য স্ত্রী, সন্তান গ্রহণ করে তাদেরও থাকে বিরাট আশা। এ দুয়ের সমন্বয় কঠিন। যে জন্য আমাদের সমাজে এ জাতীয় সমস্যা অন্তহীন। কোথাও শোনা যায়, বউ স্বার্থপর, যেকোনো মূল্যে সে তার স্বামীকে বশ করে মা—বাবা, ভাই—বোনসহ গোটা পরিবার থেকে ছেলেটিকে বের করে এনে নিজের দখলে নিয়ে নেয়। সে তার ভালোবাসায় কাউকে ভাগ বসাতে দিতে চায় না। এখানে ভালোবাসা অর্থ কী তা বোঝা কঠিন। সমাজে লোভ, হিংসা ও কতৃর্ত্বের স্পৃহাকে মানুষ ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিতে চায়। আমার মতে, যদি কেউ কাউকে সত্যিই ভালোবাসে তাহলে তার ভালোবাসাকে সে সম্মান করবে। যদি তার মন চায় মাকে ভালোবাসতে, বাবাকে ভালোবাসতে, ভাই—বোনকে ভালোবাসতে, তাহলে যে তাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে তার উচিত তার ভালোবাসাগুলোকে সম্মান করা। তার মন খুশি হয় এমন হয়ে থাকা। এভাবনাটি যদি বউয়ের মনে এসে যায়। যদি মা—বাবা, ভাই—বোনও ছেলেটির ভালোবাসাকে অর্থাৎ তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে নিজেরা ভালোবাসে এবং ছেলেটিকেও তাদের ভালোবাসার সুযোগ দেয়, তাহলে সব ল্যাঠাই চুকে যায়।
আমাদের সমাজে ছেলেদের জীবনে বেশিরভাগ সংকট দেখা দেয় মা ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক সুন্দর হওয়া না হওয়া নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে বউ বাড়াবাড়ি করে ছেলে ও মায়ের আবেগ বুঝতে চায় না। তখন শুরু হয় অশান্তি। আবার অনেক সময় মা হয়ে ওঠে কিছুটা অবুঝ। স্বপ্ন, আশা, আবেগ তাকে জড়িয়ে রাখে। তিনি বাস্তবতা বুঝতে চান না। তখন ছেলে তার শিক্ষা, আদর্শ, নীতি ও অঙ্গীকার রক্ষায় সচেষ্ট হয়। অপরদিকে, স্ত্রীর কাছে তার থাকে সীমাহীন দুর্বলতা। কিছুটা প্রেমের, কিছু চাহিদার, কিছু বসবাসের, খাওয়া—থাকা, নিরাপত্তা, উত্তম আচরণ, মান—মর্যাদা, সন্তান, পারিবারিক শান্তি, মানসিক স্বাভাবিকতা ইত্যাদি মিলিয়ে ছেলেটি মায়ের দিকটি পেছনে ফেলে দিতে বাধ্য হয়। আমি অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, মা নিজেই ছেলেকে তার জীবন, সংসার ও শান্তি বজায় রাখার জন্য স্ত্রীর পক্ষে চলে যেতে বলেন। তিনি এ দূরত্বটুকু মেনে নেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এর উল্টো। স্ত্রীকে কোনোভাবেই তার অধিকার, মর্যাদা ও অবস্থান দিতে চায় না ছেলেটির পরিবার। তখন ছেলে পড়ে যায় কঠিন গ্যাড়াকলে।
এমন শত শত ঘটনা সমাজে দেখা যায় যে, নতুন বউকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য পরিবারের লোকেরা বিশেষ করে মহিলারা সীমাহীন কষ্ট দিতে থাকে। অনেক সময় ছেলেটিও তাদের সাথে যোগ দেয়। কোনো কোনো সময় ছেলে নিরপেক্ষ থাকে। অনেক সময় স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে নীরব থাকে। কখনো আবার সে স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে সোচ্চার হয় এবং শক্তি—সামর্থ্য থাকলে পরিবারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এমন বিভিন্নরূপী মানুষ ও তাদের বিচিত্র গল্প আমাদের সমাজজীবনে প্রচুর।
এ দেশে একটি গল্প চালু আছে। মজার বিষয় হলো, গল্পটি আমি ইউরোপের লোককাহিনিতেও দেখেছি। কদিন আগে দেশেও এ গল্পটিই কোনো এক কাগজে পড়েছি। গল্পটি সন্তানের জন্য মায়ের নিঃশর্ত ভালোবাসার। এক ছেলেকে তার বউ ভালোবাসার কথা বলে এমনভাবেই অন্ধ করে দেয় যে, ছেলেটির কাণ্ডজ্ঞান বলতেও কিছু থাকে না। ছলে—বলে—কৌশলে বউ তাকে তার মায়ের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। মাকে দূরে সরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে ছেলের হাতে মাকে মার খাওয়ায়। শেষ পর্যন্ত ছেলেটিকে প্ররোচিত করে তার মাকে বনবাসে দিয়ে আসতে। এতেও বউয়ের জেদ মিটে না। ভালোবাসার দোহাই দিয়ে বলে, ‘তুমি যদি আমাকে খুশি করতে চাও, যদি প্রকৃতই ভালোবেসে থাকো, তাহলে কথা দাও আমার আশা পূরণ করবে কি না?’ ছেলেটি কথা দিলো, বউয়ের আশা পূরণ করবে। বউ তখন বলল, আমি তোমার মায়ের কলজে চিবিয়ে খেতে চাই। যদি ভালোবাসো তাহলে তা এনে দাও। ছেলে বনে গিয়ে বউয়ের কথামতো মাকে খুন করল। মার কলজে নিয়ে ঘরে ফিরছিল সে। হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার করে ঝড়—বৃষ্টি শুরু হলো। দ্রুত পায়ে ফিরছিল ছেলেটি। বাতাসে ভেসে এলো তার মায়ের আওয়াজ। মা বলছে, ঝড়—বৃষ্টি তোরা একটু পরে আয়। দুঃখিনী বিধবার ছেলেটি নিরাপদে ঘরে ফিরে নিক। একটু ঘোরের মধ্যে ছেলেটি উঁচু একটি টিলা পেরুবার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। সে তখন স্পষ্ট শুনতে পেল, বাবা তুই কি ব্যথা পেয়েছিস? খুব লক্ষ করে দেখল, তার মায়ের বিচ্ছিন্ন কলিজা থেকেই এই আওয়াজ এসেছে। এরপরও যথারীতি ছেলেটি মায়ের কলজে হাতে বাড়ি ফিরে গেল আর সেটি তুলে দিলো তার ভালোবাসার হাতে।
এখানে ভালোবাসা শব্দটি বেশ কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ভালোবাসা শব্দটি ঘৃণায় পর্যবসিত হয়। ভালোবাসার কথা বলে যখন একজন মানুষ জাহান্নামী হয়ে যায় তখন ভালোবাসা কি আর ভালোবাসা থাকে? প্রেমের কথা বলে যখন কোনো নারী বা পুরুষ সৃষ্টিকর্তার অবাধ্য হয় তখন তা আর প্রেম থাকে না। হয়ে যায় কুফুরী, অবাধ্যতা, শিরক, মহাপাপ। আল্লাহ তাআলা যে নারীকে হালাল করেছেন তাকে বাদ দিয়ে যদি কোনো পুরুষ অবৈধ কাজে যায়—এর শাস্তি ভয়াবহ। হাদীস শরীফে এসবের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রেম বা ভালোবাসা কথা দুটি বাজে লোকেদের হাতে পড়ে এমনই পচেছে যে, ভদ্র লোকেরা এখন আর এসব বলতে বা লিখতে চান না। অবশ্য কোরআন, সুন্নাহ, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি এ শব্দদুটি তার সঠিক অর্থেই ব্যবহার করে আসছে। আমাদের আলোচ্য বিষয়ও তাই।
সংবাদপত্রে দেখা যায়, প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ। প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার। ভালোবাসার মানুষের হাতে ধর্ষণের শিকার। প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিক ও তার বন্ধুদের লালসার শিকার। এখানে সংবাদকর্মীরা কেন প্রেম বা ভালোবাসা শব্দটি ব্যবহার করেন তা বোঝা খুবই কঠিন। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং যথার্থই লিখেছেন, ‘প্রেম বলে কিছু নেই। নারী—পুরুষের মাঝে যা আছে তা হচ্ছে কাম। পুরুষ সে যেই হোক, কোনো নারীকে দেখামাত্রই তার মনে প্রথম যে চিন্তাটি আসে সেটি হলো, এ মহিলা বিছানায় কেমন হবে?’
আমরা এতটা সরলীকরণ করব না; তবে কেউ যদি গভীরভাবে চিন্তা করে তাহলে প্রায় শতবর্ষী অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীল এ লেখকের কথাগুলি উড়িয়েও দিতে পারবে না। পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ ফ্রয়েড যেমন মানুষের জীবন, ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিকে একটিমাত্র শব্দে সীমিত করে দিয়েছেন। তার চোখে সবকিছুর পেছনেই কার্যকর রয়েছে যৌনতা। প্রেমিক প্রেমিকাকে কাছে পেতে চায় যৌনতার জন্য। বাবাও নাকি তার কন্যাকে স্নেহ, ভালোবাসা দেয় যৌনতা থেকেই। মা তার শিশুকে দুধ পান করায়—এখানেও নাকি যৌনতা কাজ করে। মানুষে মানুষে যত সম্পর্ক, যত আত্মীয়তা, যত স্নেহ—মায়া—টান—ভালোবাসা সবই নির্বিশেষে যৌনকামনাজাত। এ দর্শন অস্বাভাবিক। এটি পাশ্চাত্য সভ্যতার একটি ভিত্তি হতে পারে। যদিও সে সময়কার মানুষ এ ধারণাকে গ্রহণ করেনি। ফ্রয়েডকে মানুষ ঘৃণা করত। চলার পথে তাকে দেখতে পেলে তার দিকে থুতু ছিটাত। পরবর্তীতে ধর্মহীন নাস্তিক লোকেরা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় এবং তার মতবাদ বিশ্বব্যাপী প্রচার করে।
যুক্তিতেও তার এ মতবাদ টিকে না। কারণ মানুষ বুদ্ধিমান, সামাজিক ও নৈতিক প্রাণী। নীতি বা ধর্ম তাকে মানুষ করেছে। মনুষ্যত্ব দিয়েছে। যে জন্য একই মানুষ তার সহজাত দোষ—ত্রুটি, গুণ—সৌন্দর্য নিয়েই মানুষ। নিয়ন্ত্রণহারা সীমালঙ্ঘনকারীরা মানুষ নয়। যেমন : একজন মানুষ দীর্ঘ বিরহ শেষে যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন একই সাথে তাকে স্বাগত জানায় তার মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও অন্যান্য পাড়াপড়শি, বন্ধু—স্বজন। তখন কি তাদের পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা, আলিঙ্গন করা, চুমু খাওয়া, কান্না ও চিৎকার সবই যৌনতা থেকে উৎসারিত? নাকি এখানে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, মায়া—মমতা, আবেগ ইত্যাদি সবই আছে? মানুষভেদে, সম্পর্কভেদে অনুভূতি যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, তা কি মানুষের বিজ্ঞান বা দর্শনের বই পড়ে বুঝতে হবে? এ তো মানুষের জীবনের দৈনন্দিন পাঠেরই অংশ।
মানুষ জন্মগতভাবেই প্রেমিক। সে তার জীবনকে ভালোবাসে। ভালোবাসে তার মাকে। বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে। প্রতিবেশ, পরিবেশ, স্বদেশকে। নিজের চেনা আকাশ, বন, পাহাড়, সাগর, নদী, শস্য ক্ষেত, বৃষ্টি, রংধনু, প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ সে ভালোবাসে। যে জন্য মানুষ মাত্রই কবি। কেউ কথায়, কবিতায়, সুরে, ছন্দে, ভাবনায় নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে। কেউ করে নীরবতায়। কেউ করে বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প ও ললিতকলায়। নিজের ভাবনা ও আবেগ—অনুভূতি প্রকাশের অনেক মাধ্যম পৃথিবীতে আছে। নিজের ভেতরকার প্রেম, ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্র মানুষভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কেউ নিজের শিল্পকর্ম, কেউ পেশা, কেউ উপাসনা, কেউ ভোগ—বিলাস, কেউ অর্থ উপার্জন, কেউ সৈনিকের চাকরি আর কেউ কর্মহীন ভবঘুরেরূপে নিজের কাজটুকু করে। তবে নিষ্ঠা বা প্রেম ছাড়া, তাগিদ বা প্রেরণা ছাড়া, বিশ্বাস বা চেতনা ছাড়া কোনো কাজই উৎকৃষ্ট ও সফল হয় না।
বিশ্বপ্রেমিক মওলানা জালালুদ্দীন রুমী বলেছেন :
‘বাঁশির কান্না শুনেছ?/ যা মানুষ মাত্রেরই মনে দাগ কাটে/ দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির আওয়াজ/ মানুষকে পাগল করে তোলে/ মনে হয়, ঘর ছেড়ে চলে যাই/ বাঁশির এ সুর আসলে কী?/ এ হচ্ছে তার ঝাড় থেকে আলাদা হওয়ার কষ্ট।/ আমরা মানুষ দুনিয়ায় ছিলাম না/ আমরা আল্লাহর কাছে ছিলাম জান্নাতে ছিলাম/ দুনিয়ায় এসে সেই মূল থেকে/ বিচ্ছিন্ন হওয়ার যাতনায় ভুগছি/ বিরহব্যথায় গুমরে মরছি।’
দুনিয়ার যত ভাবুক, প্রেমিক, কবি, দার্শনিক, মরমি সাধক—এরা সবাই সে বিরহস্মৃতি আর মূলের কাছে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মনের অব্যাহত যন্ত্রণা নিঃশেষিত করার চেষ্টায় লেগে আছে। এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ আল্লাহর সাথে মিশে যাবে, নাউযুবিল্লাহ। এটি ভুল আক্বীদা। বরং তারা আবার জান্নাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে ফিরে যাবে। তাকে দেখে নিজের জীবন সার্থক করবে। যাকে বলা হয়েছে প্রেম। আল্লাহ বলেন, তোমরা যদি আমাকে ভালোবাসো বলে দাবি করো তাহলে মোহাম্মদকে অনুসরণ করো, আমিই তোমাদের ভালোবাসব। আর তোমাদের ত্রুটি—বিচ্যুতি, ব্যথা—যন্ত্রণা মুছে দেব। আমি খুব দয়ালু ও পরম ক্ষমাশীল।
মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো তার প্রাণ। মানুষ বেশি পছন্দ করে নিজের মনকে। মন যা বলে সেভাবে চলতে মানুষের ভালো লাগে। তবে মনের কথায় চললে মানুষ সফল হতে পারে না। মনের কথা ফলো করার আগে তার বিবেক, বুদ্ধি ও নিয়মনীতির দ্বারস্থ হতে হয়। মন যা চায় তা মানুষ করতে পারে না। প্রতিটি ধর্ম, আদর্শ ও নীতি মানুষকে নিঃশর্তভাবে মনের কথা মেনে না নিয়ে তার ন্যায়—অন্যায়, ভালো—মন্দ বিচার করে নিজের ভূমিকা রাখতে বলে। মানুষ তার মনের কথা বা প্রবৃত্তির চাহিদা পর্যন্ত কোরবান করে দেয় প্রেমের জন্য। অতএব, প্রেম মানুষের প্রবৃত্তির চেয়েও শক্তিশালী। যেমন : মন চায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদে ঘরে বসে থাকতে। কিন্তু প্রেমের টানে মানুষ সব বিপদ উপেক্ষা করে নিজেকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিতে পারে। প্রেম মন্দকেও উপেক্ষা করতে শেখায়। ধৈর্যধারণ করতে শেখায়। নিজেকে অপদস্থ ও ছোট করতে শেখায়। প্রেমাস্পদের রূঢ় আচরণ, অবজ্ঞা, অবহেলা এমনকি আঘাত পর্যন্ত গায়ে না মেখে ভালোবেসে যেতে শেখায়। বাংলা সাহিত্যে এ প্রবাদটি এমন অনুভূতি থেকেই উৎসারিত। ‘মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না?’ এ প্রবাদটি একটি বাক্যমাত্র নয়; বরং এটি প্রেমের একটি মূলনীতি।
আমি শুরু থেকেই চেষ্টা করে এসেছি, প্রেম শব্দটির অর্থে মর্মে এর বৃহৎ ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে। যারা প্রেম বলতে কাম বা প্রবৃত্তির চাহিদাকে বোঝেন তাদের অর্থে নয়। প্রেম অর্থ মানুষের দেহ, মন, আত্মা দিয়ে কাউকে ভালোবাসা। যা যে—কোনো বস্তু প্রাণী বিষয় পদার্থ বা ভাবনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। কেউ জীবন দিয়ে তার পরিবারকে ভালোবাসে। কেউ দেশকে। কেউ পশু, পাখি, গাছ, ফুল, পাতা, পরিবেশ ও পরিপার্শ্বকে। কেউ বই পড়া। কেউ মাছ শিকার। কেউ ফুটবল, ক্রিকেট, দাবা ইত্যাদি। কেউ ভালোবাসে নিজের মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা। কেউ অজানা অচেনা কোনো দুঃখী মানুষ কিংবা আর্তকে। কেউ নিজের ব্যবসা—প্রতিষ্ঠান, শিল্প—কারখানা, ক্ষমতার আসন, অর্থ—বিত্ত, সুনাম—সুখ্যাতিকে। পবিত্র কোরআন যেমন বলেছে :
قُلْ اِنْ کَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَاَبْنَآؤُكُمْ وَ اِخْوَانُكُمْ وَاَزْوَاجُكُمْ وَعَشِیْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُۨ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَۃٌ تَخْشَوْنَ کَسَادَهَا وَمَسٰکِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیْكُمْ مِّنَ اللهِ وَرَسُوْلِهٖ وَجِهَادٍ فِیْ سَبِیْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللهُ بِاَمْرِهٖ ؕ وَاللهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ.
হে রাসূল! আপনি বলে দিন যে, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই—বেরাদর, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়—পরিজন, তোমাদের ধন—সম্পদ—যা তোমরা সঞ্চয় করো, তোমাদের ব্যবসা—বাণিজ্য—যার মন্দাকে তোমরা ভয় করো এবং তোমাদের পছন্দের বাড়ি—ঘর—এসব যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ, রাসূল ও আল্লাহর পথে সংগ্রাম—সাধনা করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে থাকে, তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর ফায়সালার। আর আল্লাহ বিভ্রান্ত, ভ্রষ্টদের সঠিক পথ দেখান না।—সূরা তাওবা, ০৯ : ২৪
এখানে ভালোবাসার ক্ষেত্র ও পরিমাণ, তুলনামূলক অল্প ও অধিক নিয়ে আল্লাহ কথা বলেছেন। অর্থাৎ স্বভাবত মানুষ যা কিছু ভালোবাসে, যেমন : পিতা, পুত্র, পরিজন, অর্থবিত্ত, ব্যবসা—বাণিজ্য। এসবের চেয়ে বেশি প্রেম ও ভালোবাসা হতে হবে আল্লাহর পথে সংগ্রাম—সাধনার।
মানুষের মধ্যে যে প্রেমের শক্তি আল্লাহ দিয়েছেন তার প্রকৃত প্রয়োগের ক্ষেত্র তিনি নিজেই। যেমন : ইসলামী শাস্ত্রে আসক্তি বা ইশক দুই প্রকার : হাকিকী ও মাজাযী। হাকিকী অর্থ প্রকৃত প্রেম, শুদ্ধতম প্রেম, আসক্তি ও ভালোবাসা যা কেবল আল্লাহ ও রাসূল এবং এতৎসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহেই হওয়া বা পাওয়া সম্ভব। আর মাজাযী অর্থ রূপক বা ডামি। যা পার্থিব জীবনে মানুষ প্রয়োগ বা ব্যবহার করে থাকে। যে জন্য কবি বলেছেন :
جگہ جی لگانے کی دنیا نہیں ہے
یہ عبرت کی جا ہے تماشہ نہیں ہے
অর্থাৎ ভালোবাসা যায় এমন বস্তু এই পৃথিবী নয় / এ আসলে উপদেশ গ্রহণের জায়গা, ক্রীড়া—কৌতুক নয়।
আল্লাহওয়ালারা শরীয়তের হুব্ব, মহব্বত, ইশক ইত্যাদি বলতে হাকিকীটিই বোঝেন বা বোঝান। দুনিয়ার মানুষ অবশ্য মাজাযীটি বুঝে নেয়। কেউ হয়তো বৃহৎ অর্থে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা, টান ও প্রেম এসব বোঝে। আর কেউ হয়তো এ দিয়ে শুধুই কাম বা প্রবৃত্তিগত সম্পর্ককে বোঝে। যুগে যুগে আল্লাহওয়ালারা (আরবীতে আহলুল্লাহ ওয়া খাস্সাতুহু) হাকিকী প্রেমের চর্চা করে গেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর এই দুআ থেকে আমরা যার বর্ণনা পাই। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসা দান করো আর তাদের ভালোবাসা দান করো, যারা তোমাকে ভালোবাসে।’
আল্লাহওয়ালারা প্রেমের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলকে অনুসরণ করেন। অনুসরণ করেন সাহাবায়ে কেরামকে। যাঁরা নজিরবিহীন খোদা ও রাসূলপ্রেমিক ছিলেন। সাহাবীদের জীবনে রাসূলের প্রেম কী পর্যায়ের ছিল তা সীরাত ও তারীখের কিতাবে দেখা যায়।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দুনিয়ার কোনো আল্লাহওয়ালা কখনই শরীয়তবিরোধী কোনো কাজকে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। ইতিহাসে কোনো আল্লাহওয়ালা এমন পাওয়াও যাবে না, যিনি নিজ জীবন—সাধনায় শরীয়তনিষিদ্ধ কোনো বস্তু বা বিষয়কে স্থান দিয়েছেন। তবে মানুষের ভাষায় ভাব বা ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সাধক, মনীষী প্রচলিত প্রেমিক—প্রেমাস্পদের ভাষা ব্যবহার করেছেন। যা জ্ঞানী ব্যক্তিদের বুঝতে কষ্ট হয় না। তবে কিছু অজ্ঞ মানুষ এসবের আক্ষরিক অর্থ ধরে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। যে জন্য দ্ব্যর্থবোধক বা সংশয়পূর্ণ শব্দ ব্যবহারের মতোই কোনো বিতর্কিত শব্দের ব্যবহারও সতর্কতাবশত বর্জন করা ভালো। কবিতার ভাষায় :
بمے سجادہ رنگین کن گرت پیر مغاں گوید
کہ سالک بے خبر نبود ز راہ و رسم منزل ہا
‘… তোমার বিজ্ঞ মুর্শিদের কথা মেনে চলো, যদি তিনি তোমার জায়নামাযকে মদিরা দিয়ে রাঙাতেও বলেন তবে তাই করো; কেননা খোদাপ্রেমের পথে প্রতিটি চড়াই—উৎরাই, রীতিনীতি ও গন্তব্য সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন।’
নজরুলের ‘বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে হায় খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে’ নিয়ে বিতর্ক কিন্তু কম হয়নি। কবি নজরুল ইসলাম তার অনেক কবিতায়, হামদ ও নাতে এসব শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন। যা ফারসি কাব্যভাবনার অনুসৃতি। কবি কাজী অন্য এক জায়গায় বলেছেন, ‘এ কোন মধুর শরাব দিলে আলআরাবী সাকী, নেশায় হলাম দিওয়ানা যে রঙ্গিন হল আঁখি।’
ওমর খৈয়াম তার কবিতায় অনেক কথা এমন লিখেছেন যাকে মাজাযী প্রেম বা প্রণয় ধরে নিলে বলতে হয়, তিনি একজন নীতিহীন কবিমাত্র ছিলেন। অথচ বিজ্ঞজনেরা ভালো করেই জানেন যে, তিনি কত বড় একজন মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। পরিপূর্ণ ধার্মিক জীবনে তার বিন্দুমাত্র নীতিহীনতার স্থান ছিল না। তিনি তার ধর্মীয় মরমি ভাবধারা ও জীবনদর্শনকে কবিতার ছন্দে অনাগত মানবসভ্যতার জন্য অমূল্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গিয়েছেন মাত্র। যেখানে তিনি বলেন, আর কটা দিন বান্ধবী কেটে যাবে যদি সঙ্গে থাকে পানপাত্র আর সুরাহী ভরা মদ।
পারস্যের কবি হাফেজ শিরাজীর বিখ্যাত পঙ্ক্তি দেখে কত মানুষ কত কী ভাবে। তবে এ যে তার মনের ভাবমাত্র তা অনেকেই বোঝে না। কিন্তু আল্লাহওয়ালারা সব কবিতার উদ্দেশ্য ধরে নেন নিজ প্রার্থিত বস্তুকে। তাই কবিতার শরীর তাদের আটকে রাখে না। কবিতার প্রাণ তাদের লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছুতে সাহায্য করে। যেমন :
اگر آں ترک شیرازی بہ دست آرد دل ما را
بہ خال ہندوش بخشم سمرقند و بخارا را
শিরাজ নগরীর নৈসর্গিক দৃশ্যপটে যে তুকীর্ সুন্দরী আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছিল, যদি তা সে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়, তাহলে শুধু তার গালের সে তিলটির বিনিময়ে আমি তাকে বুখারা—সমরকন্দ দিয়ে দিতে পারি।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী তার কবিতায় এ ধরনের অনেক শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এনেছেন। দুনিয়ার কোনো অজ্ঞও এসবের আক্ষরিক অর্থ নেয়নি। রুমীর জীবনে প্রেম কেমন ছিল তা তার জীবনধারা থেকেই আন্দাজ করা যায়। সারা জীবন তিনি ওয়াক্তের শুরুতেই এশা পড়ে নিতেন কিছুটা নিদ্রা বা বিশ্রাম শেষে দাঁড়াতেন তাহাজ্জুদে। কোনো কোনো দিন মাঝ রাতের পর নামাযের নিয়ত বাঁধতেন, রুকুতে যাওয়ার আগেই ফজর হয়ে যেত। কখনো দু—রাকাতে রাত শেষ। কওনিয়ার প্রচণ্ড শীতে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার প্রেমে এভাবেই কাঁদতেন যে, অশ্রম্নর বিন্দু দাড়ি বেয়ে বুকে পড়ত। কঠিন শীতে অশ্রম্নধারা জমে বরফ হয়ে গেছে। দীর্ঘ শ্মশ্রম্ন বেয়ে নেমে আসা অশ্রম্নধারা যেন একটি বরফের নদী। এই ছিলেন প্রেমিক রুমী।
হজরত শাহজালাল আত্মীয়, পরিজন, স্বদেশ, জন্মভূমি ছেড়ে ঘুরেছেন দেশ—বিদেশ। জীবনের শেষভাগে চলে আসেন বাংলাদেশের সিলেটে। আল্লাহর প্রেমিক ছিলেন। রাসূলের আশেক ছিলেন। কোনো দিন সংসার করেননি। সিলেট বিজয়ের পর শাসক সেকান্দর শাহ হজরত শাহজালালের জন্য সারা বাংলাদেশ খঁুজে সৎ বংশীয় অনিন্দ্য সুন্দরী এক কন্যাকে তার বাবা—মার কাছ থেকে এনে সিলেটে পাঠালেন। সাথে আত্মীয়—স্বজন গেল যেন বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া যায়। হজরত শাহজালাল সারাটি জীবন আল্লাহ, রাসূল ও দ্বীনের কাজকে ভালোবেসে এসেছেন। তার মধ্যকার সমস্ত আকুতি, ভক্তি, প্রেম, আসক্তি, ভালো লাগা, ভালোবাসা সব তিনি নিঃশেষে নিবেদন করে এসেছেন পরম প্রেমাস্পদ মহান আল্লাহকে। তিনি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাদশাহ সেকান্দরের পাঠানো কন্যাকে নিজে তো গ্রহণ করেনইনি; বরং বিরক্তির সুরে কবিতার পঙ্ক্তি আওড়িয়েছেন। বলেছেন, ‘শাহ সেকান্দর নিজে দুনিয়ায় ডুবেছে, আমাকেও সে ডুবিয়ে মারতে চাইছে, আচ্ছা, কেউ কি আমায় বলে দেবে যে, একটি খুলির ভেতর কটি মগজ থাকে? একটি বুকে হৃৎপিণ্ড থাকে ক’টি? একটি মনে—প্রাণে একটি মস্তিষ্কে আমি ক’জন প্রেমাস্পদকে জায়গা দেব?’ কাকতালীয়ভাবে যখন হজরত শাহজালাল এ কবিতা কটি পড়ছিলেন ঠিক তখনই নদীতে নিজের শাহি বজরা ডুবিতে বাংলার শাসক সেকান্দর শাহর মৃত্যু হয়। সে সময় এই কন্যার সাথে হজরত শাহজালাল তার খাদেম হাজি ইউসুফকে বিয়ে দেন। বলেন, ইউসুফ, তুমি এই মহিলাকে বিয়ে করো। ইনশাআল্লাহ তোমাদের ঘরে যে সন্তানাদি হবে তারা তোমার ও আমার খেদমত করবে। উল্লেখ্য যে, হজরত শাহজালালের খাদেম বংশটি সেই হাজি ইউসুফেরই বংশধর। যাদের ‘সরে কওম’ বলা হয়। সিলেটের দরগাহ মহল্লা ও খাদিমনগর তাদের বসবাস।
হযরত শাহজালাল রহ. মানুষের জীবনের আসল কাজটি করেছিলেন। তিনি আল্লাহকে ভালোবেসেছিলেন। দুনিয়ার মহব্বত দিল থেকে বের করে দিয়েছিলেন। মাথায় অন্য কিছুকে জায়গা দেননি। অন্তরকে শুধু আল্লাহর জন্য খাস করে রেখেছিলেন। সুন্নতের বাইরে জীবনে কিছুই করেননি। এ জন্য বিনিময়ে আল্লাহও তাকে ভালোবেসেছিলেন।
তাঁর জীবনী খুব বেশি বিখ্যাত হলেও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে কিতাবে আছে, তিনি একশ বিশ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। প্রথম বিশ বছর নিজ দেশ ইয়ামেনে কাটান। এরপর চল্লিশ বছর থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে। বিশ বছর দিল্লি। বিশ বছর গৌড় আর শেষ বিশ বছর সিলেটে। এতই মুত্তাকি ছিলেন যে, নিজের হাতের কামাই ছাড়া কিছু্ই খেতেন না। কারও দাওয়াত বা উপহার সহজে নিতেন না। নিজের হাতে কাপড় বুনে চাদর বা জামা পরতেন। শেষ বয়সে দুটি গাভি পালতেন। কোনো মালিক নেই এমন জঙ্গলে গাভিগুলোকে ঘাস খাওয়াতেন। একদিন রোযা রাখতেন, একদিন ইফতার করতেন। (অর্থাৎ একদিন রোযা ছাড়া থাকতেন।) খানা বলতে ছিল নিজ হাতে দোহন করা গাভির দুধ। যিকির, ফিকির, মোজাহাদা ও তরবিয়তেই দিন কেটে যেত। জিহাদের ডাক এলে সাথিদের নিয়ে জীবন—মৃত্যুর খেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
সিলেটে থাকার সময় প্রতি হজের পাঁচদিন তাকে পাওয়া যেত না। পরে একজন খাস মুরীদকে বলেছিলেন, এ পাঁচদিন আল্লাহ তাকে মক্কা শরীফে নিয়ে যান। জীবনভর তিনি এভাবেই হজ করে এসেছেন। তাহাজ্জুদের পর তিনি ধ্যানে বসেন, চোখ খুলে দেখেন কাবা প্রাঙ্গণ। তিনি জামাতে শরিক হন। এরপর আরাফা, মিনা, মুযদালিফা সেরে হজ শেষে এভাবেই সিলেট ফিরে আসেন। প্রেম দেখা যায় হযরত শাহজালালের জীবনে। আল্লাহ ও রাসূলের প্রেমে তিনি নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করে দিয়েছিলেন। যে জন্য দুনিয়ার জন্মভূমি, বাড়িঘর, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, যশ—খ্যাতি, প্রতিষ্ঠান, দল ও সংগঠন, ক্ষমতা ও সুখ—শান্তি কিছুই তিনি পছন্দ করেননি। কোনো কিছুকেই ভালোবাসেননি। বাসলেও আল্লাহর জন্য বেসেছেন, তারচেয়ে কম বেসেছেন। বাদশাহ সেকান্দরের আচরণে তার দুঃখ পাওয়া ও কবিতা আবৃত্তি এই প্রেমের পথে বাধ সাধার চেষ্টা বলেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন। হযরত শাহজালালের নাম নিয়ে শুধু বড় বড় কথা বললে কোনো কাজ হবে না। তার মতো প্রেমিক হতে হবে। আল্লাহর প্রেমিক ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সুন্নতের প্রেমিক। এ বিষয়ে ইসলামের প্রায় দেড় হাজার বছরের সেরা মনীষী ও চির স্মরণীয় খোদাপ্রেমিকদের জীবনের চয়ন নিয়ে আমার একটি আলাদা বই তৈরি হচ্ছে, তাতে খোদাপ্রীতি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা থাকবে, ইনশাআল্লাহ।