ফতওয়া জিজ্ঞাসা
নামায
মুহা. রিয়াজুল ইসলাম
মেরিন একাডেমি, নারায়ণগঞ্জ
১৩৬৭. প্রশ্ন : আমি একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমাদের দেশীয় একটি জাহাজে কর্মরত আছি। জাহাজে চাকরির সুবাদে আমাকে বছরের প্রায় ৬/৭ মাস সমুদ্রে কাটাতে হয়। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য বহন করে নিয়ে যাই। যখন কোনো বন্দরে জাহাজ নোঙ্গর করি তখন সেখানে সর্বোচ্চ ১০/১২ দিন অবস্থান করি। এমতাবস্থায় আমি কি পুরো ৬/৭ মাস নামায কসর করব নাকি পূর্ণ নামায আদায় করব?
উত্তর : আপনি যত দিন সমুদ্রে অবস্থান করবেন ততদিন মুসাফির হিসাবে গণ্য হবেন। এই সময়টাতে আপনি নামায কসর করবেন। কোনো বন্দরে নোঙ্গর করে যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, এখানে জাহাজ পনেরো দিন বা তার চেয়ে বেশি অবস্থান করবে তাহলে সেখানে পূর্ণ নামায আদায় করবেন। আর যদি এমন হয় যে, ‘আজ বা কাল চলে যাব’ এভাবে পনেরো দিন বা তার বেশি সময় বন্দরে অবস্থান করা হলেও আপনি নামায কসর করে যাবেন।—আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ২/১২৬; হিদায়া : ১/১৬৬; বাদায়েউস সানায়ে : ১/২৭১; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ৪/৪৪৮; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১১/৬১০
রাকিব হাসান
মিল—ব্যারাক পুলিশ লাইন
১৩৬৮. প্রশ্ন : নারী—পুরুষের নামায কি একই না কোনো পার্থক্য আছে, যদি পার্থক্য থাকে তাহলে সেগুলো কী কী? রেফারেন্সসহ জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
উত্তর : নারী—পুরুষের শারীরিক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি পার্থক্য রয়েছে ইবাদতসহ শরীয়তের অনেক বিষয়ে। যেমন :
১. সতর। পুরুষের সতর হচ্ছে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত, পক্ষান্তরে পরপুরুষের সামনে মহিলার প্রায় পুরো শরীরই ঢেকে রাখা ফরয।
২. মহিলা ও পুরুষ উভয়ের উপরই হজ্জ ফরয; কিন্ত মহিলাদের জন্য পথখরচ ছাড়াও হজ্জের সফরে স্বামী বা মাহরাম পুরুষের উপস্থিতি শর্ত।
৩. ইহরাম খোলার সময় পুরুষ মাথা মুণ্ডাবে; কিন্তু মহিলার মাথা মুণ্ডানো নিষেধ।
৪. হজ্জ পালনের সময় পুরুষ উচ্চ আওয়াজে ‘তালবিয়া’ পাঠ করে, অথচ মহিলাদের জন্য নিম্ন আওয়াজে পড়া জরুরি।
৫. ইমাম ও খতীব শুধু পুরুষই হতে পারে; মহিলা ইমাম ও খতীব হতে পারে না।
৬. আযান ও ইকামত শুধু পুরুষরাই দেয়; মহিলারা নয়।
উপরিউক্ত মাসআলাসমূহে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, অনেকগুলো কাজ সুন্নাত বা ফরয হওয়া সত্ত্বেও মহিলাদের সতর ও পর্দার বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের জন্য স্বতন্ত্র হুকুম দেওয়া হয়েছে। তদ্রƒপ নামায আদায়ের পদ্ধতির মধ্যেও মহিলাদের সতর ও পর্দার বিশেষ বিবেচনা করতে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় শরীয়ত মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র বিধান নির্ধারণ করেছে। তথা তাকবীরে তাহরীমার জন্য হাত উঠানো, হাত বাঁধা, রুকু, সেজদা, ১ম ও শেষ বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী পুরুষ থেকে ভিন্ন। মুসলিম উম্মাহর প্রায় দেড় হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন আমলের ধারা তা—ই প্রমাণ করে। বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের ফতোয়া ও আছার দ্বারাও প্রমাণিত। সুতরাং নামাযের যেসব ক্ষেত্রে নারী পুরুষ থেকে ভিন্ন সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. মহিলারা তাকবীরে তাহরীমার জন্য সর্বদা ওড়না বা চাদরের ভেতর থেকে কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠাবে।
২. তাকবীরে তাহরীমা বলার পর ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর বাঁধবে।
৩. রুকুতে এই পরিমাণ ঝুঁকবে যাতে হাত হাঁটুতে পৌঁছে। রুকু অবস্থায় পিঠ পূর্ণ সোজা করবে না।
৪. উভয় হাতের আঙুলগুলো রানের উপর এইভাবে মিলিয়ে রাখবে যাতে আঙুলের মাথা হাঁটুতে পৌঁছে।
৫. রুকুতে হাতের উপর ভর দেবে না।
৬. হাঁটু ঝুঁকিয়ে বাঁকা রাখবে, পুরুষদের মতো পূর্ণ সোজা করবে না।
৭. মহিলা রুকুতে নিজ বাহু ও কনুই পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবে।
৮. সেজদাতে পেট রানের সাথে বাহু বগলের সাথে মিলিয়ে রাখবে। কনুই ও হাত জমিনের উপর বিছিয়ে দেবে।
৯. সেজদাতে উভয় পা ডান দিক দিয়ে বের করে খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করবে।
১০. ১ম ও শেষ বৈঠকে মহিলা উভয় পা ডান দিক দিয়ে বের করে দিয়ে বাম নিতম্বের উপর বসবে।
এ প্রসঙ্গে কিছু হাদীস :
عن يزيد بن أبي حبيب، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على إمرأتين تصليان فقال : ( إذا سجدتما فضمَّا بعض اللحم إلى الأرض ؛ فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل ) . (مراسيل أبي داود رقم :৮৭؛ والسنن للبيهقي :2/452، رقم :3201
১. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব রহ. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন, যখন সেজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে রাখবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়।—কিতাবুল মারাসিল, ইমাম আবু দাউদ, হাদীস নং : ৮৭, (মুআসসাসাতুর রিসালাহ সংস্করণ)
عن عبد الله بن عمر قال قال رسول الله عليه و سلم إذا جلست المرأة فى الصلاة وضعت فخذها على فخذها الأخرى، وإذا سجدت ألصقت بطنها فى فخذيها كأستر ما يكون لها، وإن الله تعالى ينظر إليها و يقول : يا ملائكتى أشهدكم أنى قد غفرت لها. (السنن للبيهقي :2/452؛ رقم:3199، دار الحديث
২. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) ঊরু অপর ঊরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট ঊরুর সাথে মিলিয়ে রাখে, যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তাআলা তাকে দেখে (ফেরেশতাদের সম্বোধন করে) বলেন, হে ফেরেশতারা, তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।—সুনানে কুবরা, বায়হাকী : ২/৪৫২
عن وائل بن حجر قال قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها. (مجمع الزوائد للهيثمي :5/48، رقم :2621، دارالمنهاج
৩. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলাম, তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে এ কথাও) বলেছিলেন, হে ওয়াইল ইবনে হুজর, যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর।—মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৫/৪৮, হাদীস নং : ২৬২১, (দারুল মিনহাজ সংস্করণ)
عن الحارث عن علي رضي الله عنه قال إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها. (المصنف لعبد الرزاق :3/138، رقم :5072
৪. হযরত আলী রাযি. বলেছেন, মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় ঊরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।—মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৩/১৩৮, হাদীস নং : ৫০৭২
عن ابن عباس أنه سئل عن صلاة المرأة فقال تجتمع و تحتفر. (المصنف لا بن أبي شيبة :2/505، رقم : 2794
৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.—কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, মহিলা কীভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন, খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৫০৫, হাদীস নং : ২৭৯৪
عن ابن جريج قال : قلت لعطاء تشير المرأة بيديها بالتكبير كالرجل؟ قال : لا ترفع بذلك يديه كالرجل، وأشار فخفض يديه جدا، و جمعهما إليه جدا، وقال : إن للمرأة هيئة ليست للرجل، وإن تركت ذلك فلا حرج. (مصنف ابن أبي شيبه :2/821، رقم :2489
৬. ইবনে জুরাইজ রহ. বলেন, আমি আতা ইবনে আবী রবাহকে জিজ্ঞেস করলাম, মহিলা কি তাকবীরের সময় পুরুষের সমান হাত তুলবে? তিনি বললেন, মহিলা পুরুষের মতো হাত তুলবে না। এরপর তিনি (মহিলাদের হাত তোলার ভঙ্গি দেখালেন এবং) তাঁর উভয় হাত (পুরুষ অপেক্ষা) অনেক নিচুতে রেখে শরীরের সাথে খুব মিলিয়ে রাখলেন এবং বললেন, মহিলাদের পদ্ধতি পুরুষ থেকে ভিন্ন। তবে এমন না করলেও অসুবিধা নেই।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৪২১, হাদীস নং : ২৪৮৯
عن الزهري قال : ترفع يديها حذو منكبيها. (مصنف ابن أبي شيبه :2/421، رقم:2487
৭. যুহরী রহ. বলেন, মহিলা কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠাবে।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৪২১, হাদীস নং : ২৪৮৭
عبد الرزاق عن معمر عن الحسن وقتادة قالا إذا سجدت المرأة فأنها تنضم ما استطاعت و لا تتجافى لكي لا ترفع عجيزتها. (مصنف عبد الرزاق لأبي بكر الصنعاني : 3/137، رقم :5068
৮. হাসান বসরী ও কাতাদা রহ. বলেছেন, মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ—প্রতঙ্গ ফাঁকা রেখে সেজদা দেবে না; যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে।—মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৩/১৩৭, হাদীস নং : ৫০৬৮
عن إبراهيم قال : إذا سجدت المرأة فلتضم فخذيها و لتضع بطنها عليهما. (مصنف ابن أبي شيبة :2/505، رقم :2795
৯. ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. বলেন, মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যেন উভয় ঊরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট ঊরুর সাথে মিলিয়ে রাখে।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৫০৫, হাদীস নং : ২৭৯৫
عبد الرزاق عن معمر و الثوري عن منصور عن إبراهيم قال كانت تؤمر المرأة أن تضع ذراعها و بطنها على فخذيها إذا سجدت و لا تتجافى كما يتجافى الرجل لكي لا ترفع عجيزتها. (مصنف عبد الرزاق :3/128، رقم :5071؛ مصنف ابن أبي شيبة :2/505، رقم :2798
১০. ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. আরও বলেন, মহিলাদের আদেশ করা হতো তারা যেন সেজদা অবস্থায় হাত ও পেট ঊরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। পুরুষের মতো অঙ্গ—প্রতঙ্গ ফাঁকা না রাখে; যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে।—মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৩/১৩৮, হাদীস নং : ৫০৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৫০৫, হাদীস নং : ২৭৯৮
عن زرعة ابن إبراهيم عن خالد بن اللجلاج قال كن النساء يؤمرن أن يتربعن إذا جلسن فى الصلاة ، ولا يجلسن جلوس الرجال على أوراكهن يتقى ذلك على المرأة مخافة أن يكون منها الشئ. (المصنف ابن أبي شيبة :2/506، رقم :2799
১১. মহিলাদের আদেশ করা হতো তারা যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মতো না বসে। আবরণযোগ্য কোনো কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মহিলাদের এমনটি করতে হয়।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৫০৬, হাদীস নং : ২৭৯৯
عن نافع قال : كن نساء ابن عمر يتربعن فى الصلاة. (المصنف لا بن أبي شيبة :2/507، رقم :2805
১২. নাফে রহ. বলেন, হযরত ইবনে উমর রাযি. এর ঘরের মহিলারা নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসতেন।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২/৫০৭, হাদীস নং : ২৮০৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৩০—৩৩; হাশিয়াতুত তাহতাবী : ২৫৯; ফাতাওয়া দারুল উলূম যাকারিয়া : ২/১৫০
মুহাম্মদ লুৎফুর রহমান
তেলিসাইর, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
১৩৬৯. প্রশ্ন : যে ব্যক্তি ইমাম সাহেবের সাথে তিন বা চার রাকাত বিশিষ্ট নামাযের দ্বিতীয় রাকাতে শরীক হলো, সে কি ইমামের সাথে প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়বে?
উত্তর : হ্যাঁ, এমন মাসবুক ব্যক্তির জন্য ইমামের সাথে প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া ওয়াজিব। মাসবুক যদি ইমামের সাথে প্রথম বৈঠকে শরীক হওয়ার পর তাশাহহুদ শেষ করার আগেই ইমাম সাহেব তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে মাসবুকের জন্য তাশাহহুদ শেষ করে তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়ানো ওয়াজিব। অন্যথায় নামায মাকরুহে তাহরিমী হবে।—গুনইয়াতুল মুতামাল্লী : ৫২৭; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ১/৪৯৬; হাশিয়াতুত তাহ্তাবী আলাল মারাক্বী : ৩১০; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১০/৪০৯; আহ্সানুল ফাতাওয়া : ৩/৩৭৬
ইকবাল হুসাইন
ভোলা
১৩৭০. প্রশ্ন : অনেকগুলো তিলওয়াতে সেজদা জমা হয়ে গেলে প্রতিবার সেজদার পূর্বে দাঁড়ানো কি জরুরি? নাকি বসে আদায় করলেও যথেষ্ট হয়ে যাবে?
উত্তর : সেজদায়ে তেলাওয়াত আদায়ের পূর্বে দাঁড়িয়ে তারপর সেজদায় যাওয়া মুস্তাহাব তথা উত্তম। না দাঁড়িয়ে বসে সেজদা করলেও হয়ে যাবে। একসাথে অনেকগুলো সেজদা করলেও একই বিধান।—সুনানে কুবরা, বাইহাকী : ২/৬৫৮; আলবাহরুর রায়েক : ২/২২৩; আন্নাহরুল ফায়েক্ব : ১/৩৪৩; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ২/৪৮১
আযিযুর রহমান
পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ
১৩৭১. প্রশ্ন : সেজদায়ে তেলাওয়াত আদায় করার সঠিক পদ্ধতি কী? একাধিক সেজদায়ে তেলাওয়াত আদায়ের নিয়ম কী?
উত্তর : সেজদায়ে তেলাওয়াত আদায় করার পদ্ধতি হলো, সোজা হয়ে দাঁড়ানো থেকে সেজদায় যাওয়া এবং সেজদায় গিয়ে কমপক্ষে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ পড়া। অতঃপর সেজদা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেজদা শেষ করা। এটা মুস্তাহাব পদ্ধতি। তবে যদি কেউ বসা অবস্থা থেকেই সেজদায় চলে যায় এবং সেজদা থেকে উঠে না দাঁড়ায় তাহলেও তার সেজদা আদায় হয়ে যাবে। একাধিক সেজদায়ে তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো এক সেজদা শেষ করে দাঁড়িয়ে পরবর্তী সেজদা আদায় করা।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯৫; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ২/১০৭; আলবাহরুর রায়েক : ২/২২৩; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ২/৪৭৮
মুহাম্মদ নুরুল হুদা
খতীব, স্ক্যান সিমেন্ট কোম্পানি জামে মসজিদ
১৩৭২. প্রশ্ন : আমি স্ক্যান সিমেন্ট কোম্পানি জামে মসজিদের খতীব। মসজিদটি কোম্পানির সীমানার ভেতরে। নিরাপত্তার স্বার্থে কোম্পানির সীমানার ভেতর অপরিচিত কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। আর এ নিষেধাজ্ঞা মসজিদ হওয়ার আগেও ছিল এবং নামায ছাড়া অন্য সময়েও থাকে। ভেতরে যারা আছে তাদের নামায পড়তে কোনো বাধা দেওয়া হয় না। কোম্পানির কতৃর্পক্ষ বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা নামাযের জন্য নয়; বরং কোম্পানির নিরাপত্তার স্বার্থে। উল্লেখ্য, কোম্পানির ভেতর কেউ আবাসিক থাকে না, ডিউটি শেষে সবাই চলে যায়। এখন মুফতী সাহেবের নিকট আমার জানার বিষয় হলো, এ নিষেধাজ্ঞার কারণে কোম্পানির মসজিদে জুমা সহীহ হবে কি না? এবং উক্ত মসজিদে ইতেকাফ করা জরুরি কি না?
উত্তর : হ্যাঁ, প্রশ্নোক্ত মসজিদে জুমা সহীহ হবে। কেননা, উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা নামাযের জন্য নয়; বরং কোম্পানির নিরাপত্তার স্বার্থে। উক্ত মসজিদে কমপক্ষে একজন ইতেকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।—আদ্দুররুল মুখতার : ২/১৫১—৫২, ৪৪২; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১২/৩১৭; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/২৮
জনৈক আল্লাহর বান্দা
১৩৭৩. প্রশ্ন : মসজিদের নিচতলায় নামাযের জামাত দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় ৩য় ও ৪র্থ তলা আংশিক কিংবা পূর্ণ খালি রেখে ৫ম তলায় নামায আদায় করার হুকুম কী? ৫ম তলার প্রথম কাতারের মুসল্লীগণ কি হাদীসে বর্ণিত প্রথম কাতারের সাওয়াব পাবেন?
উত্তর : প্রশ্নে বর্ণিত সুরতে মসজিদের ৩য়/৪র্থ তলা খালি রেখে চাই আংশিক হোক অথবা পূর্ণাঙ্গ, ৫ম তলায় নামায আদায় করলে নামায হয়ে যাবে, তবে মাকরুহ হবে। কারণ, এটা প্রথম কাতার খালি রেখে দ্বিতীয় কাতারে নামায আদায় করার মতো। আর এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে অনেক সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
৫ম তলার প্রথম কাতারে নামায আদায়কারী ব্যক্তি হাদীসে বর্ণিত প্রথম কাতারের সাওয়াব পাবে না। কারণ, ৫ম তলায় কাতার শুরু হয় ৪র্থ তলার সর্বশেষ কাতার পূর্ণ হওয়ার পর।—ফাতাওয়া কাজী খান : ১/৬১; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ২/৩৭৪; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ৯/৫০৪; উমদাতুল ফিক্হ : ২/৬৪
মুহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম
১৩৭৪. প্রশ্ন : কিছুদিন পূর্বে আমি ঢাকা যাত্রাবাড়ী থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হই। যাত্রার সময় আমার কসরের বিধান নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। আর তা হলো ঢাকা থেকে যাত্রাবাড়ী দিয়ে সফর শুরু করে কতটুকু দূরে গেলে কসরের বিধান শুরু হবে? এবং গ্রামের বাড়ির কতটুকু নিকটে গেলে কসরের বিধান শেষ হবে?
উত্তর : ঢাকা শহরের সীমা সিটি কর্পোরেশন কতৃর্ক যতটুকু নির্ধারিত রয়েছে, তা অতিক্রম করলে কসরের বিধান শুরু হয়। সে অনুযায়ী আপনি যেহেতু যাত্রাবাড়ী দিয়ে সফর শুরু করেছেন তাই সাইনবোর্ড থেকে আপনার জন্য কসরের বিধান শুরু হবে। অনুরূপভাবে ঢাকায় আসার সময় উল্লিখিত সীমায় পৌঁছলেই আপনি মুকীম হয়ে যাবেন।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, যখন আপনি আপনার গ্রামের আবাদী তথা বসতি যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে পৌঁছাবেন মুকীম হয়ে যাবেন, এর আগ পর্যন্ত কসরের বিধান বহাল থাকবে।—মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ২/৫২৯; আল মুহীতুল বুরহানী : ২/৩৮৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯৯
জানাযা—দাফন—কাফন
মুহা. শফিকুল ইসলাম
ফরিদাবাদ, ঢাকা
১৩৭৫. প্রশ্ন : মৃত ব্যক্তির জন্য যখন কবর খনন করা হয়, তখন দেখা যায় বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের কবর খনন করে। জানার বিষয় হচ্ছে, কোরআন ও হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী কবরের ধরন কয়টি (কবর কত প্রকার) হতে পারে। দলীল—ভিত্তিক জানালে উপকৃত হব। বিশেষত, সমাজে প্রচলিত যে কবর অর্থাৎ লম্বা গর্ত খুঁড়ে লাশ রেখে উপরে বাঁশ খাড়া করে দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এর কোনো ভিত্তি হাদীসে আছে কি না?
উত্তর : মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার বিষয়ে হাদীস ও ফিক্হের কিতাবে দুই ধরনের কবরের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এক. ‘লাহাদ অর্থাৎ কবর খনন শেষে কেবলার দিকে মায়্যিতের শারীরিক গঠন অনুপাতে আরেকটি গর্ত করবে এবং মৃত ব্যক্তিকে পূর্ণ ডান কাত করে সে গর্তে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কাঁচা ইট বা বাঁশ দিয়ে গর্ত বন্ধ করে দেবে। কবরের এই প্রকারটাই হানাফী মাযহাবের ফকীহগণের মতে সুন্নাত।
দুই. ‘শাক্ব’ বা সিন্ধুকী কবর অর্থাৎ কবর খনন করে মায়্যিতের শারীরিক গঠন অনুপাতে কবরের মাঝখানে খালের মতো আরেকটি গর্ত খনন করবে এবং মৃত ব্যক্তিকে পূর্ণ ডান কাত করে তাতে রেখে উপরে বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে মাটি দিয়ে দেবে। এই দ্বিতীয় প্রকার কবর দেবে যদি মাটি নরম হয়। অন্যথায় প্রথম প্রকারটিই অবলম্বন করবে।
উল্লেখ্য, সমাজে প্রচলিত কবরের যে পদ্ধতির কথা প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে, তা সুন্নত পরিপন্থী। এ জন্য এই ধরনের কবর দেওয়া থেকে বিরত থাকবে এবং অবস্থাভেদে উপরিউক্ত দুই প্রকারের কবর দেওয়ার চেষ্টা করবে।—সুনানে নাসাঈ : ৫৩৬, হাদীস নং : ২০০৯; ফাতহুল ক্বদীর : ২/১৪৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৬—২২৭; বাদায়েউস সানায়ে : ২/৬০; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ৫/৩৭৭; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১৩/২৫৩
মুহাম্মদ ফেরদাউস
বরগুনা
১৩৭৬. প্রশ্ন : বাড়ির পুরাতন কবরস্থানের উপর বসবাসের জন্য ঘর তৈরি করার হুকুম কী? এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিধি—নিষেধ অবহিত করার জন্য অনুরোধ করছি।
উত্তর : জায়গাটি যদি কবরস্থানের জন্য ওয়াক্ফ করা না হয়ে থাকে এবং কবরগুলো এত পুরাতন হয় যে, মৃতব্যক্তির শরীর মাটির সাথে মিশে গেছে তাহলে সেখানে ঘর—বাড়ি তৈরি করা জায়েয আছে।—তাবয়ীনুল হাক্বায়িক্ব : ১/৫৮৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ২/৪৭০; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ : ১৪/১৭৫
বিবাহ—ইদ্দত—তালাক
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
১৩৭৭. প্রশ্ন : আমি বছরখানেক আগে বিয়ে করেছি। বিয়ের সময় কাবিননামা লেখা হয়নি। আমার স্ত্রীকে আদৌ তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কয়েক দিন আগে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয়। সে ম্যাসেঞ্জারে আমাকে লেখে, ‘তালাক নাম্বার ওয়ান অমুকের (আমার মায়ের নাম ছিল) ছেলেকে, তালাক নাম্বার টু আমুকের (আমার বাবার নাম ছিল) ছেলেকে, তালাক নাম্বার থ্রি অমুকের (তার নিজের নাম ছিল) ভালোবাসাকে।’
উল্লেখ্য, আমার স্ত্রীর তালাক সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এখন সে কান্নাকাটি করছে। আমার জানার বিষয় হলো, তার এ লেখার দ্বারা কি আমাদের মাঝে তালাক হয়ে গেছে?
উত্তর : ইসলামী শরীয়তে তালাক প্রদানের অধিকার একমাত্র স্বামীর। স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাকের অধিকার প্রদান করে তাহলে স্ত্রী তালাক গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। প্রশ্নের বর্ণনানুযায়ী স্ত্রী কতৃর্ক স্বামীকে তালাক দেওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। তাই আপনাদের ঘর—সংসার করতে কোনো সমস্যা নেই। অবশ্যই মনে রাখবেন, তালাক কোনো ছেলে—খেলা নয়। তাই ভবিষ্যতে কখনো তালাক দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে মুরব্বি কিংবা কোনো আলেমের সাথে পরামর্শ করে শরীয়ত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।—সূরা ত্বালাক : ০১; ফাতহুল ক্বদীর : ৩/৪৬৮; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১৮/৯৯
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক
১৩৭৮. প্রশ্ন : আমার সংসার দীর্ঘ সময়ের। বর্তমানে কয়েক সন্তানের মা আমি। এমন অবস্থায় আমার স্বামীর সাথে সাধারণ কথা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। একসময় আমার স্বামী আমাকে বলে, ‘তোকে আমি রাখব না। তোকে তালাক দিলাম, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, তোকে আমি বাইন তালাক দিলাম।’ এরপর আমি আমার বোনের বাসায় চলে যাই। তখন আমার স্বামী আমার বোনের বাসায় গিয়ে বলে আমাকে নিতে এসেছে।
তখন আমি বলি, ‘আমাকে তালাক দিয়ে আবার কী জন্যে নিতে এসেছে।’ তখন সে আমার বোনদের সাথে বলে, ‘আমি তালাক দিই নাই।’ আবার অনেক হুযুরদের থেকে ফত্ওয়া এনে আমার মা, ভাই—বোনদের দেখায় যে আমার তালাক হয়নি। আবার কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে বলে, আমি তালাক দিইনি। অথচ সে মিথ্যা বলছে, সত্য বলছে না। কিন্তু হুযুর আমি আল্লাহকে ভয় করি, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ও আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আমার আল্লাহ সত্য, আমার কানও সত্য, সে আমাকে তিন তালাক দিয়েছে। হুযুর আমার তাওবার দরজা খোলা আছে, এই জন্য আমি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আপনার থেকে সঠিক ফতওয়া চাই। আর আমার যদি তালাক হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর জন্য আমি স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে যাব। আল্লাহর জন্য আমি সব ত্যাগ করতে পারব, স্বামীর কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাব।
উত্তর : প্রশ্নের বর্ণনানুযায়ী আপনার উপর তিন তালাক (মুগাল্লাযা) পতিত হয়েছে। তাই এখন আপনার জন্য উক্ত স্বামীর সাথে ঘর—সংসার করা জায়েয নেই। যদিও আপনার স্বামী তালাকের কথা অস্বীকার করছে কিন্তু আপনি যেহেতু নিজ কানে তিন তালাকের শব্দ শুনেছেন তাই আপনি আপনার স্বামীকে নিজের সাথে মেলামেশার সুযোগ দেবেন না; বরং ‘খোলা’ করে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে তার থেকে পৃথক হয়ে যাবেন।—আলবাহরুর রায়েক : ৪/৯৪, ৩/৪৪৮; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ৩/৪০৯; কিফায়াতুল মুফতী : ৮/৯৮, ১২৪
মাসউদুর রহমান
কেরাণীগঞ্জ খেজুরবাগ, ঢাকা
১৩৭৯. প্রশ্ন : কোনো এক বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর ঝগড়া হয়। ঝগড়ার একপর্যায়ে স্বামী অধিক রাগান্বিত হয়ে স্ত্রীকে ফোন করে বলেছে যে, ‘তুই এক তালাক, দুই তালাক।’ অর্থাৎ তালাক শব্দটি দুই বার বলেছে। এর দ্বারা স্বামী তিন তালাকের ইচ্ছাও করেনি। তবে এই ক্ষেত্রে স্ত্রীর দাবি হচ্ছে, তার স্বামী তাকে ফোনে বলেছে, ‘তুই এক তালাক, দুই তালাক, বাইন তালাক।’ আর এই কথাটি স্ত্রীর ছোট বোন, যার বয়স ৯—১০ বছর, সে সরাসরি শুনেছে। এই ছোট মেয়েটি ছাড়া তার আর কোনো সাক্ষী বা প্রমাণ নেই। এখন আমার জানার বিষয় হচ্ছে, উল্লিখিত তালাকের দ্বারা কত তালাক পতিত হবে? এবং এ ক্ষেত্রে কার কথা গ্রহণযোগ্য হবে? শরীয়তের দলীল—প্রমাণ ও হাদীস দ্বারা সমাধান পেশ করলে উপকৃত হতাম। আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম বিনময় দান করুন।
উত্তর : প্রশ্নের বিবরণ অনুযায়ী যেহেতু স্ত্রীর কাছে দুই থেকে অতিরিক্ত তালাকের ব্যাপারে দুই জন শরঈ সাক্ষী নেই, তাই উল্লিখিত ক্ষেত্রে স্বামীর দাবি মেনে নিয়ে স্ত্রীর উপর আইনত দুই তালাক পতিত হয়েছে অর্থাৎ আদালত বা পঞ্চায়েতের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে তারা দুই তালাকের সিদ্ধান্ত দেবে। তবে স্ত্রীর যদি নিজ দাবির উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থেকে থাকে তাহলে তার জন্য উক্ত স্বামীর ঘর—সংসার করা জায়েয হবে না। স্বামী থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সে প্রথমত স্বামীকে আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের শাস্তির ভয় দেখিয়ে বলবে, ভুল ও মিথ্যা বলে সারা জীবন গোনাহে লিপ্ত থাকার চেয়ে তৃতীয় তালাকের কথা স্বীকার করে নিতে কিংবা তাকে (স্ত্রীকে) আলাদা করে দিতে। যদি সে তাতে রাজি না হয় তাহলে সে তার মোহরানার টাকা মাফ করে দেবে বা তার সাথে ‘খোলা’ করবে অর্থাৎ টাকা—পয়সা দিয়ে তার থেকে তালাক নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। যদি তাও সম্ভব না হয় তখন স্ত্রীর জন্য জায়েয আছে, সে স্বামীর ঘর ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়িতে চলে যাবে। উল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে যদি কোনোটার উপরই আমল করা স্ত্রীর জন্য সম্ভব না হয়, যেহেতু স্ত্রী এ ক্ষেত্রে বাধ্য, তাই সব গোনাহ স্বামীর উপর বর্তাবে।
বি. দ্র. এ অবস্থায় উক্ত স্ত্রী কোনো অবস্থাতেই স্বামীকে শারীরিক সম্পর্ক করতে দেবে না।—রদ্দুল মুহতার : ৩/২৫১; আলবাহরুর রায়েক : ৩/৪৪৮; কিফায়াতুল মুফতী : ৮/১২৪; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ১৯/২৩৮
জায়েয—নাজায়েয
জনৈক আল্লাহর বান্দা
১৩৮০. প্রশ্ন : আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়াল দিতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ কেউ পরে এসে সিরিয়াল মেইন্টেনকারীদের কিছু টাকা দিয়ে আগে চলে যায়। এমতাবস্থায় যারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সিরিয়ালে ছিল তাদের কেউ যদি তার সিরিয়াল ঠিক রাখার জন্য সিরিয়াল মেইন্টেনকারীকে কিছু টাকা দেয় তাহলে তার জন্য এই টাকা দেওয়া বৈধ হবে কি না?
উত্তর : যার সিরিয়াল প্রথমে সর্বপ্রথম ডাক্তার দেখানো তার হক। এরপর দ্বিতীয় জন। এ ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত। কেউ যদি তার এ হক নষ্ট করতে চায়, আর সে কাউকে টাকা দেওয়া ব্যতীত অন্য কোনোভাবে তার হক ঠিক রাখতে না পারে, তাহলে সে সিরিয়াল মেইন্টেনকারীদের কিছু টাকা দিয়ে তার হক ঠিক রাখতে পারবে। তবে তাদের জন্য এ টাকা নেওয়া বৈধ হবে না।—ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৩/২৯৬; রদ্দুল মুহতার : ৮/৪২, ৭/২৬৬; আহসানুল ফাতাওয়া : ৮/৯৭
মুহাম্মদ মাহমুদ আদিল
কুমিল্লা
১৩৮১. প্রশ্ন : আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার দেখানোর জন্যে সিরিয়াল দিতে হয়। রোগীদের মধ্যে কেউ যদি সিরিয়াল মেইন্টেনকারীদের কাউকে কিছু টাকা দেয়, তাহলে সে তাকে অন্যদের (যারা সিরিয়ালে তার আগে ছিল) পূর্বেই ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দেয়। আমার জানার বিষয় হলো, টাকা দিয়ে এভাবে আগে চলে যাওয়া এবং উক্ত টাকা দেওয়া ও নেওয়ার হুকুম কী?
উত্তর : টাকা দিয়ে এভাবে আগে চলে যাওয়া, অন্যদের প্রতি জুলুম। জুলুমের কাজে সহায়তা করে টাকা নেওয়া ঘুষের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া উভয়টিই হারাম।—ফাতহুল ক্বদীর : ৭/২৫৪; রদ্দুল মুহতার : ৮/৪২; আহসানুল ফাতাওয়া : ৮/৯৭; কিতাবুল নাওয়াযিল : ১৬/৫৭০
মুহাম্মদ নাছির উদ্দিন
বরুড়া, কুমিল্লা
১৩৮২. প্রশ্ন : আমাদের এলাকায় কিছু মানুষ গরু—ছাগলের নাড়ি—ভঁুরির ন্যায় মুরগির আঁতও পরিষ্কার করে খায়। আমার জানার বিষয় হলো, মুরগির আঁত পরিষ্কার করে খাওয়া জায়েয আছে কি না?
উত্তর : জবাইকৃত প্রাণীর সাত অঙ্গ খাওয়া নাজায়েয। প্রবাহিত রক্ত, নর প্রাণীর মলদ্বার, অণ্ডকোষ, মাদি প্রাণীর মলদ্বার, মূত্রথলি, পিত্ত ও জমাট রক্তের তৈরি গ্রন্থি। আঁত এগুলোর অন্তভুর্ক্ত নয়। অতএব, মুরগির আঁত খাওয়া জায়েয। তবে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে, যাতে কোনো নাপাকী না থাকে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯০; রদ্দুল মুহতার (আদ্দুররুল মুখতারসহ) : ১০/৫১২; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ২৬/২১২
জনৈক আল্লাহর বান্দা
১৩৮৩. প্রশ্ন : কেউ যদি নারিকেল, তাল, খেজুর ইত্যাদির গাছ এভাবে ভাড়া নেয় যে, তুমি আমাকে অমুক গাছটি এত মাসের জন্য ভাড়া দাও। এই সময়ের মধ্যে যা কিছু আয় হবে তা আমি নেব। তাহলে তা জায়েয হবে কি না?
উত্তর : ফল—ফলাদির জন্য (বাগানের) গাছ ভাড়া দেওয়া জায়েয নেই।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৪/৪৭৭; রদ্দুল মুহতার : ৯/১৪; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৭/৪১২; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ২৫/১৫৪
জনৈক আল্লাহর বান্দা
১৩৮৪. প্রশ্ন : মাইক টেস্টের জন্য কোরআন তেলাওয়াত করা জায়েয আছে কি না? এবং এ সময় শ্রোতাদের জন্য কোরআন শোনা জরুরি কি না?
উত্তর : মাইক টেস্টের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, যদি মাইক দ্বীনি মজলিসের হয়, যেখানে কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য দ্বীনি আলোচনা হবে, তাহলে সে ক্ষেত্রে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মাইক টেস্ট করাতে তেমন সমস্যা নেই। তবে উত্তম হলো এ অবস্থায় তেলাওয়াতের দ্বারা মাইক টেস্ট না করা। কারণ কোরআন তো হলো মাকসাদ, তা মাইক টেস্টে ব্যবহার হলে মাধ্যমে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, যা কোরআনের শান নয়। তবে এই মুহূর্তে তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য যেহেতু পরবর্তীতে যখন মূল আলোচনার সময় কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য দ্বীনি আলোচনা হবে তখন যেন কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। তো যেন কোরআনকে কোরআনের জন্যই ব্যবহার করা হলো। এ জন্যে এটাকে কোরআনের সাথে কোনো ধরনের বেআদবী বলা যায় না। তাই এটা মাকরুহ না হলেও অনুত্তম অবশ্যই।
আর যদি মাইক দুনিয়াবি কোনো মজলিসের হয়। যেখানে মাইক দিয়ে দুনিয়াবি কথাবার্তা বলাই উদ্দেশ্য। তাহলে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মাইক টেস্ট করা, কোরআনের প্রতি বেআদবী। সুতরাং তা মাকরুহ ও নিষিদ্ধ। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মাইক টেস্ট করার সময় শ্রোতাদের জন্য তেলাওয়াত শ্রবণ করা ওয়াজিব নয়। তবে মুস্তাহাব হলো ওই সময়ও মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা।—আদ্দুররুল মানসুর : ৩/২৮৫; তাফসীরাতে আহমাদিয়া : ৪০০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩৬৩; ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৮/৪৮১; মাআরিফুল কুরআন : ৪/১৬৩; কিতাবুল নাওয়াযিল : ১৩/৪৩০
দেলোয়ার হোসেন
মুন্সীগঞ্জ
১৩৮৫. প্রশ্ন : আমাদের এলাকায় হিজড়াদের একটি বসতি গড়ে উঠেছে। তারা এখানে বাড়ি ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তাদের ইনকাম সোর্স হলো গরু—ছাগলের ব্যবসা এবং সপ্তাহে একবার বাজার কালেকশন। তারা আমাদের সাথে সকল সামাজিক কাজে যেমন ইমামের বেতন, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদিতে শরীক হয়। রমযানে তারা একদিন সকল মুসল্লীকে ইফতারি করায়। এখন আমাদের এলাকার কিছু লোক বলে, এদের দান থেকে ইমামের বেতন প্রদান, মসজিদ নির্মাণ এবং তাদের ইফতার গ্রহণ করা জায়েয হবে না। এখন মুফতী সাহেবের নিকট জানার বিষয় হলো, তাদের কথা সঠিক কি না? উল্লেখ্য, তারা অধিকাংশ মুসলমান।
উত্তর : হিজড়া সম্প্রদায়ে যারা মুসলমান তারা বিশেষ কিছু মাসআলা ব্যতীত অন্য সকল মাসআলায় সাধারণ পুরুষ/মহিলা মুসলমানদের মতোই। সুতরাং তারা যদি তাদের হালাল আয় থেকে দান করে তাহলে তাদের দান করা টাকা থেকে ইমামের বেতন প্রদান, মসজিদ নির্মাণ এবং তাদের ইফতারি গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে জায়েয।—রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৮; আলআশবাহু ওয়ান নাজাইর : ১/৩৫৫
মাওলানা জাকির হোসাইন
মতলব, চাঁদপুর
১৩৮৬. প্রশ্ন : বর্তমানে অনেক জায়গাতেই বরশি প্রতিযোগিতার প্রচলন আছে। এতে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়। নির্ধারিত সময়ে বরশি দিয়ে মাছ ধরা হয়। যে যে পরিমাণ মাছ ধরতে পারে সে তার মালিক গণ্য হয়। এ প্রতিযোগিতা জায়েয কি না? এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যে মাছ ধরা হয় তা খাওয়া হালাল কি না?
উত্তর : প্রশ্নে বর্ণিত পদ্ধতি জায়েয নয়। এভাবে মাছ শিকার করা হলে তা ফাসেদ চুক্তির মাধ্যমে অর্জিত হওয়ার কারণে খাওয়া জায়েয হবে না; বরং মাছ ফিরিয়ে দিয়ে নিজের টাকা ফেরত নেওয়া ওয়াজিব।
তবে যে মাছ কারও মালিকানাধীন নয় যেমন, নদী বা উন্মুক্ত স্থানের মাছ, এমন মাছ শিকার করা হলে তাতে শিকারকারীর সহীহ মালিকানা সাব্যস্ত হবে এবং তা খাওয়া জায়েয হবে।—কিতাবুল খারাজ : ৯৫; বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৭; রদ্দুল মুহতার : ৫/১৭৮; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ৫/৯০—৯১; ফিক্হুল বুয়ূ : ২/৯৫৫—৫৬
মুহাম্মদ হুমায়ন কবীর
ঢাকা
১৩৮৭. প্রশ্ন : আমি সরকারি চাকরি করি। সরকারি মেসে ব্যাচলর হিসাবে বসবাস করি। বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল দিতে হয় না। রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা আছে। বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত পয়েন্ট আছে। এমতাবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে রান্না করার জন্য রাইস কুকার, কাপড় ইস্ত্রি ও আলাদা বিদ্যুৎ লাইন করে বাতি, ফ্যান ব্যবহার করা যাবে কি না? অথবা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ বিল হিসাবে আনুমানিক কিছু টাকার স্ট্যাম্প কিনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে দায়মুক্ত হওয়া যাবে কি না?
উত্তর : বিদ্যুৎ যেহেতু সরকার সরবরাহ করে, তাই আপনাকে সরকারি নিয়ম অনুযায়ীই তা ব্যবহার করতে হবে। সুতরাং সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যদি ব্যক্তিগতভাবে রাইস কুকার, ইস্ত্রি ও আলাদা বিদ্যুৎ লাইন করার অনুমতি থাকে তাহলে এ সমস্ত সুযোগ নেওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি অনুমতি না থাকে তাহলে এ সমস্ত সুযোগ গ্রহণ করা বৈধ হবে না।
উল্লেখ্য, অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি কোনো সময় এ সমস্ত জিনিস ব্যবহার করে ফেলে, তাহলে এর থেকে দায়মুক্ত হওয়ার জন্য আনুমানিক কিছু টাকার স্ট্যাম্প কিনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট তার কৃতকর্মের জন্য তাওবা করলে আশা করা যায় আল্লাহ পাক তাকে মাফ করে দেবেন।—সূরা বাক্বারা, ০২ : ১৮৮; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুখতারসহ) : ৯/৩৩৪; শরহুল মাজাল্লাহ : ১/৬১; জাওয়াহিরুল ফিক্হ : ৩/৬৯
মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ
১৩৮৮. প্রশ্ন : বর্তমান প্রচলিত ইলেকট্রিক ব্যাট, যা দিয়ে মশা—মাছি ইত্যাদি মারা হয়, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বিধান কী?
উত্তর : প্রশ্নে বর্ণিত ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা—মাছি ইত্যাদি মারলে আমাদের জানামতে তা জ্বলে বা পুড়ে যায়। তাই ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা—মাছি ইত্যাদি মারা আগুনে জ্বালিয়ে মেরে ফেলার মতোই, আর শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো প্রাণীকে আগুনে জ্বালিয়ে মেরে ফেলা মাকরুহ। তবে যদি কোথাও মশা—মাছি অনেক বেশি হয় এবং সমস্যা করে আর অন্য কোনো পন্থায় তা দমন করা সম্ভব না হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে আগুনে জ্বালিয়ে বা ব্যাট দিয়ে মারা জায়েয হবে।—সুনানে আবু দাউদ : ৩৬২—৬৩; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ) : ৬/৭৫২; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া : ২৭/২০৮