প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

বাইতুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলি ও হজ্জের তাৎপর্য

বাইতুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলি ও হজ্জের তাৎপর্য

মাওলানা মুতীউর রহমান

 

اِنَّ اَوَّلَ بَیْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیْ بِبَکَّۃَ مُبٰرَكًا وَّهُدًی لِّلْعٰلَمِیْنَ ﴿ۚ۹۶﴾  فِیْهِ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ مَّقَامُ  اِبْرٰهِیْمَ    ۬ۚ وَمَنْ دَخَلَهٗ کَانَ اٰمِنًا         ؕ وَلِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا        ؕوَمَنْ کَفَرَ فَاِنَّ اللهَ غَنِیٌّ عَنِ الْعٰلَمِیْنَ ﴿۹۷﴾

অনুবাদ : নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে সেটি ওইটি যা মক্কায়, যা বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক। তাতে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি। (তন্মধ্যে) একটি হচ্ছে মাকামে ইবরাহীম। আর যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। আর আল্লাহর জন্যই মানুষের ওপর এ ঘরের হজ্জ (ফরয)। আর যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাআলা সমগ্র বিশ্ব থেকে অপ্রত্যাশী।-সূরা আলে ইমরান, ০২ : ৯৬, ৯৭

 

তাফসীর

কাবা ঘরের নির্মাণ—ইতিহাস

যে খানায়ে কাবা আমাদের কেবলা, যার দিকে ফিরে আমরা দিন—রাত নামায আদায় করি এবং হজ্জের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সম্পর্ক যে ঘরের সাথে তার ইতিহাস সকল মুসলমানের জানা থাকা উচিত। তাই খানায়ে কাবার নির্মাণ ইতিহাস তুলে ধরা হলো।

আয়াতে কারীমায় বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম ঘর যা নির্মিত হয়েছে সেটি ওইটি যা মক্কা নগরীতে। এর দুটি অর্থ হতে পারে। যথা :

এক. পৃথিবীতে কাবা ঘরই সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছে। ইতিপূর্বে কোনো ঘরই ছিল না। ইবাদতখানা হিসাবেও না, বসবাসের জন্যও নয়। এটা বিচিত্র নয় যে আল্লাহর নবী হযরত আদম আ. আপন বাসগৃহ নির্মাণ করার পূর্বে আল্লাহর ঘর অর্থাৎ ইবাদতখানা নির্মাণ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি., মুজাহিদ, কাতাদা প্রমুখ থেকে এমনই বর্ণিত রয়েছে।

দুই. ইবাদতখানা হিসাবে এটিই ছিল সর্বপ্রথম ঘর। বসবাসের জন্য হয়তো এর পূর্বেও ঘর নির্মিত হয়েছিল।

বাইহাকী দালায়েলুন্নবুয়্যাহ নামক কিতাবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হযরত আদম ও হাওয়া আ. এর পৃথিবীতে অবতরণের পর আল্লাহ তাআলা হযরত জিব্রাঈল আ. এর মাধ্যমে তাঁকে বাইতুল্লাহ শরীফ নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন। অতঃপর ওই ঘরের তাওয়াফ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাঁকে বলা হয়েছে, আপনি সর্বপ্রথম মানুষ আর এটি হচ্ছে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।

যাইহোক, কাবা ঘর সর্বপ্রথম হযরত আদম আ. এর যুগে নির্মিত হয়। এরপর হযরত নূহ আ. এর প্লাবনের সময় ঘরটি আসমানে তুলে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম আ. কে পুনর্নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়। প্লাবনের কারণে যেহেতু ঘরের চৌহদ্দি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তাই আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈল আ. এর মাধ্যমে চৌহদ্দি জানিয়ে দেন।

আয়াতে কারীমা

وَ اِذْ بَوَّاْنَا لِاِبْرٰهِیْمَ مَکَانَ الْبَیْتِ اَنْ لَّا تُشْرِكْ بِیْ شَیْئًا وَّ طَهِّرْ بَیْتِیَ لِلطَّآئِفِیْنَ وَ الْقَآئِمِیْنَ وَالرُّکَّعِ السُّجُوْدِ

দ্বারা এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ : যখন আমি ইবরাহীমকে জানিয়ে দিলাম বাইতুল্লাহর স্থান (আর এ নির্দেশ দিলাম যে) আমার সাথে কোনো কিছুকেই শরীক করবে না আর আমার ঘরকে পবিত্র রাখবে তাওয়াফকারী এবং (নামাযে) দণ্ডায়মান ও রুকু—সেজদাকারীদের  জন্য।—সূরা হজ্জ (২২) : ২৬

ইবনে আবি হাতেম হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণনা করেন, হযরত ইবরাহীম আ. যখন কাবা ঘরের নির্মাণ কার্য সম্পন্ন করলেন তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে এ আদেশ করলেন যে, ওহে ইবরাহীম! তুমি মানুষের মাঝে ঘোষণা করে দাও যে, তারা যেন এ ঘরের হজ্জ করে।

হযরত ইবরাহীম আ. আরজ করলেন, হে আল্লাহ, (এটা তো একটা বিজন মরুভূমি, এখানে কোনো জনবসতি নেই।) আর যেখানে জনবসতি রয়েছে সেটা তো অনেক দূরে সে পর্যন্ত আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছাবে!

আল্লাহ তাআলা বললেন, তোমার দায়িত্ব কেবল ঘোষণা দেওয়া আর সারাবিশ্বে এ ঘোষণা পৌঁছানোর দায়িত্ব হচ্ছে আমার।

হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহর আদেশে মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে (যা আল্লাহ তাআলা উঁচু করে দিলেন। অপর এক বর্ণনা অনুযায়ী জাবালে আবি কুবাইস নামক পাহাড়ে আরোহণ করে) দু—কানে অঙ্গুলি রেখে চারিদিকে এ ঘোষণা দিলেন, হে মানবমণ্ডলী, তোমাদের রব একটি ঘর নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর ওই ঘরের হজ্জ ফরয করেছেন। অতএব তোমরা আপন রবের আদেশ পালন করো।

আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আ. এর এ ঘোষণা সারাবিশ্বে পেঁৗছিয়ে দিয়েছেন। আর সেটা কেবল ওই সময়কার মানুষের মাঝেই নয় বরং কিয়ামত অবধি যত মানুষ জন্ম নেবে সকলের কাছেই মু’জেযাস্বরূপ এ ঘোষণা পেঁৗছে গিয়েছে। যাদের ভাগ্যে আল্লাহ তাআলা হজ্জ লিখেছেন তাদের সবাই ওই সময় লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলেছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, আজ হাজীরা যে লাব্বাইক বলে থাকেন এটা হযরত ইবরাহীম আ. এর সেই ডাকেরই সাড়া।-কুরতুবী, মাযহারী

অতঃপর কোনো এক কারণে কাবা ঘর ধসে গেলে জুরহুম গোত্র তার মেরামত করে। এরপর ধসে গেলে আমালেকা গোত্র মেরামত করে। এরপর ধসে গেলে কুরাইশরা মেরামত করে। ওই মেরামতকাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোদ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং হাজারে আসওয়াদ নিজ হাতে স্থাপন করেছিলেন যার ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ।

কুরাইশ যখন কাবা ঘর মেরামত করে তখন তারা এতে কিছু পরিবর্তন ঘটায়।

যেমন : এক. উত্তর দিক থেকে কাবা ঘরের কিছু অংশ বাদ দেয় যা হাতীমে কাবা নামে অভিহিত।

দুই. পূর্বে কাবা ঘরের দরজা ছিল দুইটি। একটি পূর্ব দিকে যেদিক দিয়ে প্রবেশ করত। আরেকটি পশ্চিম দিকে যেদিক দিয়ে বের হতো। তারা পশ্চিম দিকের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং শুধু পূর্বদিকের দরজাটা বহাল রাখে।

তিন. পূর্বে কাবা ঘরের দরজা ছিল মাটিসমান। কিন্তু কুরাইশরা দরজা মাটি থেকে বেশ উঁচু রাখে যাতে যে কেউ সহজে প্রবেশ করতে না পারে বরং তারা যাকে প্রবেশ করতে দেয় সেই প্রবেশ করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত আয়েশা রাযি. কে বললেন, আয়েশা, আমার মনে চায়, কাবা ঘরের বর্তমান কাঠামো ভেঙে হযরত ইবরাহীম আ. এর কাঠামো অনুযায়ী নির্মাণ করি। কুরাইশরা যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে তা সংশোধন করে দিই। অর্থাৎ হাতীম বা ভগ্নাংশকে কাবা ঘরের অন্তর্ভুক্ত করে নিই। পশ্চিম দিকে আরেকটি দরজা খুলে দিই আর দরজা নিচু করে মাটিসমান করে দিই। কিন্তু নওমুসলিমদের মাঝে এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে তাই কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে আপন অবস্থায় রেখে দিচ্ছি।

কিন্তু হযরত আয়েশা রাযি. এর ভাগ্নে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযি. যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মনোবাঞ্ছার কথা হযরত আয়েশা রাযি. এর কাছ থেকে শুনেছিলেন তাই তিনি যখন মক্কার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন তখন খানায়ে কাবাকে হযরত ইবরাহীম আ. যুগীয় কাঠামো অনুযায়ী পুনর্নির্মাণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। অর্থাৎ খানায়ে কাবার দুটি দরজা খুলেন। দরজা মাটি সমান নিচু করেন এবং হাতীম অর্থাৎ উত্তর দিকের ভগ্নাংশকে কাবা ঘরের সাথে সংযুক্ত করে দেন।

কিন্তু কিছুদিন পরেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মক্কায় হামলা করে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযি. কে শহীদ করে। শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও তদানীন্তন আমীর আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান, হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাযি. এর এ কীর্তি অম্লান ও অক্ষুণ্ণ থাকবে তা সহ্য করতে পারেনি। তাই হাজ্জাজ মানুষকে এ ভুল ধারণা দিল যে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের কাবা ঘরের যে পরিবর্তন সাধন করেছে তা সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন সেই অবস্থায়ই রাখা চাই। এ বাহানা করে সে কাবা ঘর ভেঙে পুনরায় কুরাইশী ও জাহেলী যুগের অবস্থায় নিয়ে যায়। হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাযি. এর একটি কাজ বহাল রেখেছিল। সেটি হচ্ছে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাযি. কাবা ঘরের উচ্চতা পূর্বের তুলনায় দশহাত বৃদ্ধি করেছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের পরামর্শে এটি বহাল রাখে।

পরবতীর্তে কোনো এক মুসলমান ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ এসে বাইতুল্লাহর বর্তমান রূপ পরিবর্তন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মনোবাঞ্ছনা অনুযায়ী নির্মাণ করতে চাইলে তখনকার প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ ইমাম মালেক রহ. এতে বাধা প্রদান করেন এবং বললেন, এভাবে যদি বাইতুল্লাহ বারবার ভাঙা হয় আর নির্মাণ করা হয় তাহলে ভবিষ্যৎ বাদশাহদের জন্য বাইতুল্লাহ খেলনায় পরিণত হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কীর্তি রেখে যাওয়ার জন্য এবং খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে নতুন নতুন আঙ্গিকে বাইতুল্লাহর সংস্কার করতে চাইবে। এটা বাইতুল্লাহর মর্যাদার পরিপন্থী। অতএব বাইতুল্লাহ যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায়ই রেখে দেওয়া চাই। ইমাম মালেক রহ. এর এ ফতোয়া ও রায় সকলেই মেনে নেন। তাই অদ্যবধি বাইতুল্লাহ সেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কতৃর্ক নির্মিত আঙ্গিকেই বহাল রয়েছে। অবশ্য প্রয়োজনীয় ছোট—খাটো মেরামত হতে থাকে।

বাইতুল্লাহর বরকতসমূহ 

বরকত এর শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, অধিক কল্যাণ লাভ হওয়া। বাইতুল্লাহ শরীফের মাঝে দ্বীনি—দুনিয়াবী উভয় ধরনের বহুবিধ বরকত বিজড়িত রয়েছে।

দুনিয়াবী বরকতের বিষয়টি তো সুস্পষ্ট। যেমন : বাইতুল্লাহ যে মক্কা নগরীতে অবস্থিত সেই মক্কা নগরী এবং তার আশেপাশের এলাকা পাহাড়—পর্বতে ঘেরা আর অবশিষ্ট জায়গা হচ্ছে মরুভূমি। ফল—ফসল কিছুই উৎপন্ন হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে ফলমূল ও খাবার—দাবারের এত প্রাচুর্য যে শুধু সেখানকার অধিবাসীগণই নয় বরং হজ্জ—ওমরার মৌসুমে লক্ষ লক্ষ মানুষের চাহিদা মিটছেই না শুধু বরং উদ্বৃত্ত থাকছে। আজ পর্যন্ত কখনো এ কথা শোনা যায়নি যে মক্কা শরীফে অমুক সময় অমুক খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। হাজীগণ পশু কুরবানী করছেন। অনেকেই একাধিক কুরবানী করছেন। কিন্তু কখনো কুরবানীর পশুর সংকট হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

কোরআনে কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে—

یُّجْبٰۤی  اِلَیْهِ  ثَمَرٰتُ كُلِّ شَیْءٍ

‘এখানে আমদানি করা হয় প্রত্যেক জিনিসের ফল’।

আর এসব যেন হযরত ইবরাহীম আ. এর দুআর ফল। তিনি দুআ করেছিলেন (যা খোদ কোরআনে উল্লেখ রয়েছে)—

رَبَّنَاۤ  اِنِّیْۤ  اَسْکَنْتُ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ بِوَادٍ غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ عِنْدَ بَیْتِکَ الْمُحَرَّمِ ۙ رَبَّنَا لِیُـقِیْمُوا الصَّلٰوۃَ فَاجْعَلْ اَفْئِدَۃً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِیْۤ اِلَیْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّهُمْ یَشْكُرُوْنَ ﴿۳۷﴾

হে আমাদের রব, আমি আমার সন্তানকে বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি শস্যবিহীন মাঠে আপনার সম্মানিত ঘরের নিকট। হে আমাদের রব, যেন তারা নামায কায়েম করে। অতএব আপনি কিছু মানুষের অন্তর তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিন আর তাদের খাবারের জন্য ফল—মূলের ব্যবস্থা করে দিন। হয়তো তারা শোকর আদায় করবে।Ñসূরা ইবরাহীম (১৪)  : ৩৭

আর দীনি বরকত তো আরও সুস্পষ্ট। যেমন : হজ্জ—উমরার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সম্পর্ক ওই বাইতুল্লাহর সাথে। আর হজ্জ—উমরার অপরিসীম ফযীলতের কথা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। বাইতুল্লাহয় নামায আদায় করলে লক্ষগুণ সাওয়াব বেশি লাভ হয়। আর এ লক্ষগুণ সাওয়াব সাধারণ মসজিদের তুলনায় নয়; বরং মসজিদে নববীর তুলনায় যা হাদীসের বিস্তারিত বিবরণ থেকে বোঝা যায়।

هُدًی لِّلْعٰلَمِیْنَ : বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক এভাবে যে এই বাইতুল্লাহর মাধ্যমেই বিশ্বমুসলিম তাদের নামাযের কেবলা জানতে পারছে।

 

বাইতুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলী

বাইতুল্লাহর সাথে আল্লাহ তাআলার বহু কুদরতের নিদর্শন বিজড়িত। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাকামে ইবরাহীম। মাকামে ইবরাহীম ওই পাথরের নাম যার ওপর দাঁড়িয়ে হযরত ইবরাহীম আ. কাবা ঘরের নির্মাণকাজ করতেন। পাথরটি প্রয়োজন অনুপাতে উঠা—নামা করত। পাথরটিতে হযরত ইবরাহীম আ. এর পায়ের পূর্ণ ও স্পষ্ট ছাপ পড়ে আছে যা দর্শকরা অনায়াসেই দেখতে পান। এহেন শক্ত পাথরে কাদা মাটিতে দাঁড়ালে যেভাবে পায়ের ছাপ পড়ে সেভাবে গভীর ছাপ পড়া, নিজে নিজে প্রয়োজন অনুসারে উঠা—নামা করা, আবার দীর্ঘকাল যাবৎ টিকে থাকা যেন কুদরতের স্বতন্ত্র নিদর্শনাবলী।

এ পাথর প্রথমে বাইতুল্লাহর দরজার কাছে   ছিল। যখন وَ اتَّخِذُوْا مِنْ مَّقَامِ اِبْرٰهٖمَ مُصَلًّی আয়াত নাযিল হয় তখন (ওই সময়কার অবস্থা অনুপাতে) মাতাফের বাইরে যমযমের নিকট রেখে দেওয়া হয়। বর্তমানে কাঁচের ভেতর সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

তাওয়াফের যে দুই রাকাত নামায পড়া ওয়াজিব তা মাকামে ইবরাহীমের কাছে পড়া উত্তম। যদি সেখানে পড়া সম্ভব না হয় তবে মসজিদে হারামের যেকোনো জায়গায় পড়লে আদায় হয়ে যাবে।

এমনিভাবে কুদরতের নির্দশনাবলির মধ্যে এটিও একটি যে বাইতুল্লাহর ওসীলায় সর্বকালেই মক্কাবাসীরা বহিরাগত গোত্রের আক্রমণ থেকে নিরাপদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আবরাহা বাদশাহর আক্রমণ ও তার ধ্বংসের ঘটনা উল্লেখযোগ্য যা সর্বজনবিদিত। সূরায়ে ফীলে   এ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।

 

وَمَنْ دَخَلَهٗ کَانَ اٰمِنًا    : যে ব্যক্তি এ ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা পেয়ে যাবে।

এটা যেমন শরয়ী বিধান যে কেউ যদি বাইতুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করে  তাকে নিরাপত্তা দিতে হবে সে যত বড় অপরাধী হোক না কেন, সে যদি কারও ঘাতকও হয়ে থাকে তবু সেখানে তার বিচার করা যাবে না, তবে তাকে সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য বাধ্য করা হবে অতঃপর তাকে সাজা দেওয়া হবে।

তেমনিভাবে তাকভীনি ও কুদরতীভাবে বাইতুল্লাহর ভাবমূর্তি মানুষের অন্তরে এমনিভাবে গ্রথিত যে মুসলিম—অমুসলিম নির্বিশেষে সর্বকালে বাইতুল্লাহর সম্মান করে আসছে। শত মতভেদ সত্ত্বেও বাইতুল্লাহর সম্মান—মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে তারা একমত ছিল। জাহেলী যুগের মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধ—বিগ্রহের কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও হরম শরীফে পুত্রের সামনে আপন পিতার ঘাতক এসে গেলে চক্ষু নিচু করে চলে যেত, বাইতুল্লাহ ও হরম শরীফের সম্মানার্থে তাকে কিছুই বলত না। এমনকি হরম শরীফের প্রাণীদেরও এ অনুভূতি আছে যে তারা সেখানে নিরাপদ।

মক্কা বিজয়কালে কয়েক ঘণ্টার জন্য দীনের স্বার্থে আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর জন্য যুদ্ধের অনুমতি লাভ হয়েছিল। এরপর ওই হুকুম রহিত হয়ে যায় এবং পুনরায় চিরকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা এসে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত তাকিদের সাথে বলেছিলেন, হরম শরীফে যুদ্ধ—বিগ্রহ আমার পূর্বেও কারও জন্য হালাল ছিল না আমার পরেও কারও জন্য হালাল হবে না। আমার জন্য কেবল কয়েক ঘণ্টার জন্য হালাল করা হয়েছিল। অতঃপর পুনরায় হারাম করে দেওয়া হয়েছে।

 

وَلِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا

আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর বাইতুল্লাহর হজ্জ ফরয যে ওই পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়।

বাইতুল্লাহ শরীফের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম আল্লাহ তাআলা তার ওপর হজ্জ ফরয করে দিয়েছেন।

এ সক্ষমতা লাভ হয় তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে। যথা :

এক. এমন সামর্থ্যবান হওয়া যে বাইতুল্লাহ পর্যন্ত আসা—যাওয়ার এবং পরিবার—পরিজনের ভরণ—পোষণের প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে সক্ষম।

দুই. সুস্থতা অর্থাৎ হাত, পা ও দৃষ্টিশক্তি সচল থাকা।

তিন. পথ নিরাপদ থাকা।

আর বিশেষ করে মহিলার জন্য সফরের সময় কোনো মাহরাম সাথে থাকা।

উপরোক্ত শর্তাবলি পূরণ হওয়ার মাধ্যমে যখন কারও সক্ষমতা লাভ হবে তখন হজ্জ আদায়ে দেরি না করা চাই।

(মাআরেফুল কুরআন থেকে সংকলিত ও সংক্ষেপিত)

 

হজ্জের তাৎপর্য

হজ্জ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। হজ্জের আভিধানিক অর্থ ইরাদা করা। আর শরয়ী পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, ইসলামের একটি রুকন বা স্তম্ভ আদায়ের উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর (সফরের) ইচ্ছা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের ইলাহ ও মাওলা আর আমরা তাঁর গোলাম। গোলামের জন্য মাওলার আদেশ পালন করা অপরিহার্য। তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে সেটা মাওলা—গোলামের সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এ ছাড়া আরেকটি সম্পর্কও রয়েছে। সেটি হচ্ছে আশেক—মাশুকের সম্পর্ক। মনিব—দাসের মাঝে যে নিছক নীতিগত সম্পর্ক রয়েছে আল্লাহর মাঝে আর আমাদের মাঝে নিছক ওই নীতিগত সম্পর্কই নয় বরং তার ঊর্ধ্বে ইশক ও মহাব্বতের একটি আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য যেসব ইবাদত প্রবর্তন করেছেন তার প্রত্যেকটিরই কিছু বিশেষত্ব আছে। তন্মধ্যে হজ্জ এমন একটি ইবাদত যার মধ্যে উপরিউক্ত বিশেষত্বটি রয়েছে। অর্থাৎ হজ্জের মধ্যে ইশক ও মহব্বতের সম্বন্ধের বিকাশ ঘটে।

সাধারণত এবং প্রকৃতিগতভাবে আশেক (প্রেমিক) আপন মাশুকের (প্রেমাস্পদের) সাক্ষাৎ কামনা করে থাকে। মাশুকের সাক্ষাৎ ও দর্শনে আশেকের চক্ষু জুড়ায়, অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। একজন সত্যিকার মুমেন বান্দা অবশ্যই আল্লাহর আশেক হবে। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর মাশুক হিসাবে আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ অবশ্যই তার কাম্য হবে এবং অবশ্যই সে আল্লাহর দীদারের জন্য উদগ্রীব থাকবে। হৃদয় ব্যাকুল থাকবে। দীদার ও সাক্ষাৎ লাভ না হওয়া পর্যন্ত যেন তার মন অস্থির ও অধীর থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আর এটাও অবধারিত সত্য যে, এ নশ্বর জগতে আল্লাহ তাআলার  মহান ও পবিত্র সত্তার দীদার ও সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। অপরদিকে এটাও অনস্বীকার্য বাস্তব যে, মানুষ আপন প্রিয়জনের সাক্ষাৎ না পেলে তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত বস্তু যেমন, বাসস্থান, পোশাক—পরিচ্ছদ ইত্যাদির দর্শনের মাধ্যমে মনের সান্ত্বনা লাভ করে। এর মাধ্যমে সাক্ষাতের পিপাসা নিবারণ করে। যেমন মজনু লায়লার সাক্ষাৎ না পেয়ে তার দর ও দিওয়ারে (ঘর দরজায়) চুম্বন করছিল আর বলছিল⸻

أمر على الديار ديار ليلى           وأقبل ذا الجدار وذا الجدار

وماحب الديار شغفن قلبى          ولكن حب من سكن الديار

‘আমি লায়লার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি আর এদিক—ওদিকের দেয়ালে চুম্বন করছি। আসলে এ বাড়ির ভালোবাসায় আমি দেয়ালে চুম্বন করছি না। মূলত চুম্বন করছি বাড়িতে যে বাস করে তার (অর্থাৎ লায়লার) ভালোবাসায়।’

তাই আল্লাহ তাআলা আপন নামের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করে একটি ঘর নির্মাণ করেছেন। সেটির নাম হচ্ছে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। অতঃপর ওই ঘরের যিয়ারত করার জন্য এবং তাঁর সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল বান্দাদের আদেশ করেছেন যেন তারা আপন মাহবুব ও মাশুক মাওলার সাথে সম্বন্ধযুক্ত ঘরের যিয়ারত করে এবং তাঁর দর্শন লাভ করে আপাতত মনকে প্রবোধ দিতে পারে।

অতএব হুজ্জাজে কেরামের উচিত নিছক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে নয় বরং অন্তরে পরম ইশক ও মহাব্বত নিয়ে বাইতুল্লাহর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। আর যিয়ারতকালে যেন মাওলা পাকের মহাব্বত ও তাঁর সম্মানিত ঘরের মহাব্বতে অন্তর ভরপুর থাকে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ইশক ও মহব্বত নিয়ে তাঁর পবিত্র ঘরের যিয়ারত করার তৌফীক দান করুন। আমীন।

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন