বিপথগামী হবেন না
মাওলানা যুলফিকার আহমাদ নক্শবন্দী
[পূর্বপ্রকাশের পর}
ঘরে পর্দার পরিবেশ গড়ুন
মা—বাবা ছোট থেকেই মেয়ের মনে পর্দা করে চলার অনুভূতি জাগ্রত করবেন। পর্দা করে চলতে বলবেন। অনেক মা নিজেই পর্দা করেন না, তো তারা কীভাবে এ আশা করতে পারেন যে, তাদের মেয়েরা পর্দা করে চলবে এবং নিজেকে হেফাজত করবে? মা—বাবা ঘরে পর্দার পরিবেশ তৈরি করবেন। সাধারণত এমন হয়, মানুষ বাইরের পরপুরুষদের সঙ্গে মেয়েদের পর্দা করায় ঠিকই, কিন্তু নিকটাত্মীয় গায়রে মাহরাম ছেলেদের থেকে পর্দা করায় না। বলে, এরা তো কাজিন, ভাই—বোন! অথচ সে ভাই নয়, (বরং কখনো) কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এটা মা—বাবার মারাত্মক ভুল যে তারা বলে থাকেন, ওরা এখনো ছোট, ভাই—বোনের মতো। এ সুযোগে শয়তান একজনকে অপর জনের প্রতি আকৃষ্ট করে দেয়। এর থেকেই অন্যায়ের সূচনা হয়। ঘর থেকেই এ অন্যায়ের সূচনা হয়ে পরে এ ধারা সামনে অগ্রসর হতে থাকে।
প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের রোযায় অভ্যস্ত করুন
প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেলে মেয়েদের যেমন নামায পড়া ও কোরআন তিলাওয়াত করা জরুরি তেমনি (নফল) রোযায় অভ্যস্ত হওয়াও জরুরি। প্রতি মাসে আইয়ামে বীযের তিন দিন (প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) রোযা রাখলে ভালো। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযার অভ্যাস করতে পারলে খুবই ভালো। যদি এর চেয়েও অগ্রসর হয়ে এক দিন রোযা আর এক দিন রোযা ছাড়া থাকার রুটিন করতে পারে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সুবহানাল্লাহ! ছেলে—মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিয়মমাফিক (নফল) রোযা রাখায় অভ্যস্ত করুন। রোযা মানুষের জৈবিক চাহিদা দমন করে এবং ব্যক্তির ভেতর লজ্জা—শরম ও পবিত্র জীবনবোধ জাগ্রত করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ১৮০৬)
পর্দার গুরুত্ব
মেয়েরা নিজেই নিজের পর্দার প্রতি খুব লক্ষ রাখবে। কোনো পরপুরুষের দৃষ্টি যেন তার উপর না পড়ে সে ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। বিষয়টি একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝাচ্ছি। মনে করুন, আপনাকে কেউ ১০ হাজার ডলার দিল। এখন আপনি তো এমনটা করবেন না যে, ডলারগুলো হাতে নিয়ে মানুষকে দেখাতে দেখাতে পথ চলবেন। কারণ আপনার জানা আছে, চোর বা ছিনতাইকারীরা দেখলে হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালাবে। মানুষ সম্পদ রক্ষা করার জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। টাকা—পয়সা এমনই বস্তু যে মানুষ এগুলোকে লুকিয়ে রাখে। পার্সের ভেতরে পকেটের ভেতর যে পকেট থাকে তাতে মহিলারা টাকা রাখে। যেন কারও নজরে না পড়ে, তার কাছে কত টাকা আছে। যেমনিভাবে নিজের টাকা—পয়সা নিজে হেফাজত করতে হয় তেমনি নিজের ইজ্জত—আব্রুর হেফাজতও নিজেই করতে হয়।
এক লোক খুবই পর্দাবিদ্বেষী ছিল। নিজের মেয়েকে পর্দা করতে দিতো না। একদিন তার এক বন্ধু তাকে বলল, আচ্ছা, আপনি দোকান থেকে গোশত কিনে বাসায় আসার সময় তা ব্যাগে ঢুকিয়ে হাতে করে আনেন?
—হঁ্যা, এভাবেই তো আনি।
—আজ এমন করুন, গোশত কিনে একটি ট্রেতে রাখুন। এরপর সেই ট্রে মাথায় করে বাসায় আসুন।
—ঠিক আছে।
কথামতো লোকটি ট্রেতে গোশত রেখে মাথায় নিয়ে যেই না দোকান থেকে বের হয়েছে অমনি এক ঝাঁক কাক এসে হানা দিল। কাকেরা গোশত নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিল। এক কাক এদিক থেকে ছেঁা মারে তো আরেক কাক আরেক দিক থেকে ছেঁা মারে। এর মধ্যে কয়েক টুকরা মাটিতে পড়ে গেলে পেছন থেকে কুকুর এসে হাজির। কুকুরও সে গোশত নিয়ে টানাটানি শুরু করল। অবশেষে লোকটি যখন বাসায় পেঁৗছল তখন তার ট্রেতে এক টুকরা গোশতও অবশিষ্ট নেই।
বন্ধু তখন বলল, দেখুন, এ ছিল এক কেজি গোশত। যা খোলা রেখে আপনি পথ চলছিলেন। ফলে কাকও তাতে ছেঁা মেরেছে, কুকুরও হানা দিয়েছে। আর আপনার মেয়ে, মাশাআল্লাহ তার ওজন ৫০ থেকে ৬০ কেজি হবে। সে যদি পথে বেপর্দা থাকে তাহলে ইজ্জত—আব্রু হরণকারীরা তার উপর হামলে পড়বে। তার পেছনে পড়বে। তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ছাড়বে।
লোকটি তখন বিষয়টি বুঝতে পারল। এরপর মেয়েকে পর্দা করার অনুমতি দিল।
সর্বোত্তম নারী কে
একবার সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে আলোচনা উঠল, সর্বোত্তম নারী কে? সে মজলিসে হযরত আলী রাযি.ও উপস্থিত ছিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাযি. কে জিজ্ঞেস করলেন, আলী বলো তো সর্বোত্তম নারী কে?
হযরত আলী রাযি. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি এখনই আসছি।
হযরত আলী রাযি. ঘরে গিয়ে হযরত ফাতেমা রাযি. কে জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোত্তম নারী কে?
তিনি উত্তর দিলেন,
لا يرين الرجال ولا يرونهن
সর্বোত্তম নারী সে যে নিজে কোনো গায়রে মাহরাম পুরুষকে দেখে না এবং কোনো গায়রে মাহরাম পুরুষও তাকে দেখে না।
হযরত আলী রাযি. মজলিসে এসে এ উত্তর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শোনালে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দিত হয়ে বললেন,
إنما فاطمة بضعة مني
ফাতেমা তো আমার কলিজার টুকরা।—কানযুল উম্মাল : ২৬/১৬৯, হাদীস নং : ২৬০১২
তো সর্বোত্তম নারী সে যে না নিজে কোনো পরপুরুষকে দেখে আর না তাকে কোনো পরপুরুষ দেখতে পায়। খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা রাযি. তো মৃত্যুর সময় এ অসিয়ত করেছিলেন, আমার জানাযা যেন দিনের আলোয় বের করা না হয়।
জিজ্ঞেস করা হলো, কেন? লাশ তো কাপড়ে মোড়ানো থাকে।
তিনি বললেন, কাপড়ে মোড়ানো থাকলেও দেহের উচ্চতা ও স্বাস্থ্যের অবস্থা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। আমি চাই না, কোনো পরপুরুষ আমার ব্যাপারে এতটুকুও জানতে পারুক। তাই আমি চাই, রাতের অঁাধারে আমার জানাযা বের করা হবে এবং অতি দ্রুত দাফন করা হবে।—ফাতহুল বারী : ২২/২৪৯
মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়ার ফিকির করবে
মেয়ের বয়স ২০ হয়ে গেলে মা—বাবার উচিত দ্রুত বিয়ে—শাদির ব্যবস্থা করা। উপযুক্ত পাত্র পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবে। অনেক জায়গায় এ আপদ এসেছে যে বলে থাকে :
মেয়ের ডিগ্রি নিতে হবে।
ওকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে হবে।
তাকে কম্পিউটার ডিজাইনার হতে হবে।
তাকে ওয়েব ডিজাইনার হতে হবে।
আরও কত কিছু হতে হবে…
কখনো বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। মেয়ে পড়ালেখার জন্য একাকী চলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার লুসাকায়। সেখানে হোস্টেলে থাকে। এমন ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন পড়ালেখা করে যেখানে ছেলে—মেয়েরা একসঙ্গে থাকে। এদের মা—বাবাদের ঘুম হয় কীভাবে? স্বস্তি পায় কীভাবে? মেয়েটি কি সেখানে নিরাপদে থাকবে? সেখানে মেয়েদের অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের ভেতরের অবস্থা জানা গেলে বোঝা যাবে যে মা—বাবারা তাদের সেখানে পাঠিয়ে বড় ভুল করেছেন। অধিকাংশ মেয়েই কোনো না কোনো গোনাহে কোনো না কোনো পর্যায়ে আক্রান্ত হয়েই যায়। এমন ইউনিভার্সিটিতে একাকী পড়ালেখার করার চেয়ে মেয়ের ইজ্জত—আব্রুর সুরক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বুযুর্গরা লিখেছেন, মেয়েরা হয় স্বামীর কাছে নিরাপদ আর না হয় কবরে নিরাপদ। এ দুই জায়গা ছাড়া আর কোথাও মেয়েরা নিরাপদ নয়। অতএব মেয়েরা বিয়ের বয়সে উপনীত হলে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের পূর্বসূরিদের অনেকে তো এ বিষয়ে এতটা কঠোরতা করেছেন যে গ্রামে যদি কোনো লোক এমন থাকে যে মেয়ে উপযুক্ত হওয়ার পরও বিয়ে—শাদির ব্যাপারে ফিকির করছে না, তাহলে তার কুয়া থেকে পানি পান করতেন না। বলতেন, আমরা তার কুয়া থেকে পানি পান করি না। কারণ সে অকারণে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রেখেছে। বিয়ে—শাদির ফিকির করছে না।
[চলবে, ইনশাআল্লাহ]