প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী


এক.

সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের জন্য বিশ্বজুড়ে ভারতের বদনাম আছে। বর্তমানে (২০২২ জুন) এটি টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সে দেশে হয়েছে। ৬০ হাজার বড় দাঙ্গার রেকর্ড ভারতের সরকারি হিসাবেই আছে। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য যেন ভারতের অলিখিত আইন। সরকারি চাকরিতে যথোপযুক্ত পদে তাদের অবস্থান ভারতের জন্য খুবই লজ্জাজনক। যদিও সংবিধানে বৈষম্যহীন অধিকারের কথা সকলের জন্যই বলা আছে। বর্তমান মোদি সরকার আমলে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। ভারত একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বড় দেশ, এ দাবি মোদি সরকারের যুগে ধুলোয় মিশে গেছে। ভারতের যে গৌরবজনক পরিচয় একসময় আধুনিক বিশ্বে ছিল, অধিকাংশ ভারতীয়ের মতেই সম্ভবত এই কথাটি এখন আর বহাল নেই। তাদের দৃষ্টিতেও এটিকে এখন উদার রাষ্ট্র বলা ঠিক হবে না। কারণ, মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের প্রতি উগ্র হিন্দুত্ববাদের আচরণ সংবিধানের কথার সাথে যায় না। বিশেষ করে আর্থিক মন্দা, রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও উন্নয়নের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য হিংসা, ভেদ—ভাবনা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে একমাত্র পুঁজি করে ভারত সরকার চলছে।

ইউপিতে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক দমন—পীড়ন সংগঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ সারা ভারতের কোটি মানুষ নাগরিকত্ব বাতিলের হুমকির শিকার। সারা ভারতই পশ্চাৎপদ হিন্দুত্ব ও উগ্রবাদের শিকার। দল, সরকার ও বিচারালয় শুধু নয়, ধর্ম ও উচ্চ শিক্ষার সাথে যুক্ত লোকেরাও মিথ্যা গল্পের পেছনে ছুটছে। গরুর গোশত আছে বলে সন্দেহ করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণপিটুনীতে বহু মুসলিম নিহত হয়েছে। মুসলিম সন্দেহে হিন্দুকেও হত্যা করা হয়েছে। জনসমাবেশে ধর্মীয় গুরু কর্তৃক প্রকাশ্যে মুসলিমদের মা—বোনদের ধরে এনে ধর্ষণের উসকানিপূর্ণ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মুসলিম জাতিগত গণহত্যার পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়েছে। ভিসা নিয়ে ভ্রমণরত বিদেশি মুসলিমদের বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীরূপে দেখানো হয়েছে।

ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপনাকে শিব মন্দির বলে দাবি করা হচ্ছে। এমন কি তাজমহলকেও মন্দির, কুতুব মিনারকে হিন্দু স্থাপনা বলে দাবি করা হচ্ছে। একথাও বলা হয়েছে যে, আজমির শরীফের হযরত খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি রহ. —এর মসজিদ, মাজার ও খানকাহ এসবও প্রাচীন হিন্দু স্থাপনার ওপর নির্মিত। এতসব কাজের বিষয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। এই তৎপরতা ও প্রচারণার সাথে সরকারি মেকানিজম যুক্ত বলে বারবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েই চলেছে। এসব ধর্ম ও বর্ণবৈষম্য মিডিয়ার যুগে বিশ্বের সব জায়গায় প্রচারিত হয়। যার ফলে সর্বশেষ একটি কথা বিশ্ব সমাজে চালু হয়েছে যে, ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইসরাইলে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইসরাইল যেমন ফিলিস্তিনের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা ও মাতৃভূমিকেও স্বীকার করে না, আজকের ভারতও হাজার বছরের মুসলিম জাতি, তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান ও ভারতীয় সভ্যতায় তাদের অতুলনীয় অংশগ্রহণ মোটেও স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়, বরং সেখানে মুসলমানদের অস্তিত্বকেই সহ্য করা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, মুসলমানরা আগে হিন্দু ছিল। তবে, একথাটি কেউ বলছে না যে, হিন্দুরাই প্রথমত ভারতে বহিরাগত। তারা মধ্য এশিয়া থেকে আগত আর্য জাতি, ব্রাহ্মণ্যবাদ যার প্রতীক। এর বাইরে বাকিসব অনার্য ভারতীয় অন্য কোনো চেতনা ও বিশ্বাসের।

যখন সব ধর্মের লোকদের কাছে স্বীকৃত সুলতানুল হিন্দ খাজা আজমীরির দরগাহটিও হিন্দু মন্দির বলে দাবি করা শুরু হলো, তখন অনেক বোদ্ধা ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে চলছে। এরই মধ্যে শাসকদলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা সীমাতিক্রম করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করে বসে। যা মানবজাতির জীবনে সর্বোচ্চ কলঙ্কজনক ও নিকৃষ্ট অপরাধ। যে জাতি বা সম্প্রদায়ের আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর প্রতি যত শত্রুতা, তারা তত দ্রুত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন,

اِنَّا کَفَیْنٰکَ الْمُسْتَهْزِءِیْنَ

অর্থাৎ (হে নবী,) আপনাকে নিয়ে বিদ্রুপকারীদের জন্য আমি আল্লাহই যথেষ্ট।—সূরা হিজ্র, ১৫ : ৯৫

একজন নেত্রী যিনি শাসকদলের মুখপাত্র তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সম্মানিত সহধর্মিণী হযরত আয়েশা রাযি. এর বিষয়ে কটু মন্তব্য করেন। অন্য নেতা যিনি দিল্লির মিডিয়া প্রধান তিনিও কটূক্তি ও সীমালঙ্ঘন করেন। জাতীয় মিডিয়ায় এসব সারা বিশ্বের নজরে আসে। এর ফলে বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান তাদের কলিজায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ অধিক মর্মাহত হয়। অন্য সময় শাসকরা বিশ্ব রাজনীতির টানে ভারতের ন্যায়—অন্যায় নিয়ে চিন্তা করে না। তারা উম্মাহর চিন্তা বাদ দিয়ে শাসন ক্ষমতা, ব্যবসা ও স্বার্থের চিন্তাকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার চাপে এবং পাশ্চাত্য—রাশিয়া বিরোধ পরিস্থিতিতে আরবের শাসকরাও জনগণের অনুভূতির সাথে মিল রেখে চলতে বাধ্য হয়। এমন না হলে তারা নতুন আরব বসন্তের শিকার হবে। এসব ক্ষেত্রে ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়া ভালো ভূমিকা রাখে। একজন আরব ব্যবসায়ী তার বার্তায় লেখেন, আমি ভারতীয় অমুসলিম সব কর্মীর কাজের চুক্তি বাতিল করে দিয়েছি। তাদের সব পাওনা চুকিয়ে দিয়ে একমুখী বিমানের টিকিট কেটে দিয়েছি। ভারতের সাথে আমার সব ধরনের বাণিজ্যিক লেনদেনের ইতি টেনেছি। আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এই আচরণের ফলে এমনটি করা ছাড়া আমার ঈমানের ন্যূনতম দাবিও পূরণ হতো না।

এই বার্তাটি সারা আরবজাহানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এরপর যেসব দেশে আগে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানিরা কোনো মিছিল করলে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হতো। দেশে ফেরত পাঠানো হতো। সেসব দেশের সরকার ভারতীয় দূতকে ডেকে এমন সীমালঙ্ঘনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। তারা ভারত সরকারকে বিশ্বের মুসলিমদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলে। ব্যবসায়ী ও নাগরিক পর্যায়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। আরব বিশ্বের অনেক আলেম ও মুফতী সোচ্চার হন। ভারতীয় কিছু নেতানেত্রীর মুসলিমবিদ্বেষ এবারই প্রথম মুসলিম বিশ্বের অনুভূতিকে এভাবেই আহত করে। কোরআনে মহান আল্লাহর ঘোষণা,

وَاللهُ یَعْصِمُکَ مِنَ النَّاسِ

অর্থাৎ, মানুষের শত্রুতা থেকে আল্লাহ স্বয়ং আপনাকে হেফাজত করবেন।—সূরা মায়েদা, ০৫ : ৬৭

وَ مَا یَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّکَ اِلَّا هُوَ

আপনার প্রভুর সৈন্য—সামন্ত সম্পর্কে তিনি নিজেই জানেন আর কেউ জানে না।—সূরা মুদ্দাসসির, ৭৪ : ৩১

একই সাথে সউদী আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, তুরস্ক, জর্ডান, বাহরাইন, ওমান ও ইরান এমন ভূমিকা রাখে। ওআইসি নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে সারা মুসলিম বিশ্ব প্রতিবাদী হয়ে উঠে। এরপর পাকিস্তানের শাসক ও সেনাবাহিনী এর নিন্দা জানায়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এই কাজের নিন্দা ও প্রতিবাদ করে। ভারতের কানপুরে জুমার নামাযের পর মুসলিমরা প্রতিবাদ করতে নামলে যোগি সরকার কঠোর হাতে তাদের দমন করে। ভিডিও ছবি দেখে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়। নতুন নিবর্তনমূলক আইনের দ্বারা মুসলমানদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ভারতের মুসলমনরা বিশ্ব নবীর অবমাননাকে যে কোনো ভয়—ভীতি ও চাপের মুখেও মেনে নিতে পারেন না। সারা ভারতে প্রতিবাদ শুরু হয়।

আরব বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্য খুব ভারি হয়ে দেখা দেয়। কারণ, ভঙ্গুর ও টাল—মাটাল অর্থনীতিতে ভারত মুসলিম বিশ্বের এই বয়কট একসপ্তাহ সহ্য করারও ক্ষমতা রাখে না। কারণ, মুসলিম বিশ্বে প্রায় দুই কোটি ভারতীয় চাকরি করে। কেবল আরব দেশগুলোতেই এক কোটি ৩৬ লাখ ভারতীয় কর্মী রয়েছে। তাদের যদি ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে ভারতের জীবনযাত্রার চাকা বসে পড়বে। বৈদেশিক আয়ে আরব বিশ্বের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কেবল একমাস বন্ধ থাকলেই ভারতের অর্থনীতির দফারফা শুরু হবে। বেশি ক্ষতি হয় এ কারণে যে, বয়কট ও রাষ্ট্রদূতদের ডেকে প্রতিবাদ করার সময় ভারতের উপরাষ্ট্রপতি আরব বিশ্বের সফরে ছিলেন। কাতারের আমির তার সাথে বৈঠক বাতিল করে দেন। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল বিষয়ের গুরুত্ব আঁচ করতে পেরে কটূক্তিকারী দুই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে এবং ঘোষণা দেয় যে, বিজেপি সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

কিন্তু আরব ও মুসলিম বিশ্ব এতটুকুতেই সন্তুষ্ট নয়। তারা ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলছে। কেননা, শাসকদলের উচ্চ পর্যায় থেকে এই কটূক্তি ছিল বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত। কেননা, মুসলমানের জীবনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মর্যাদা রক্ষার চেয়ে আর কোনো ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসলে দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক উগ্রতা ও মুসলমানদের সাথে চরম বৈরি আচরণ মুসলমানদের মনে দুঃখ ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মর্যাদাহানীর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মুসলমান অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর প্রতি বিষোদ্গার বা শত্রুতা তারা মেনে নিতে পারে না। যার নজির নিকট অতীতে ইতালি, ফ্রান্স ও আমেরিকার কিছু ঘটনায় দেখা গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ফরাসি প্রেসিডেন্টসহ বড় বড় অনেক নেতাকে যে জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। বয়কটের বিষয়ে ফ্রান্সকে মুসলিম বিশ্বের সহানুভূতি কামনা করতে হয়েছে। কূটনৈতিক ভাষায় এগুলোই ক্ষমা প্রার্থনা।

চলমান অস্থিরতা নিরসন পুরোটাই ভারত সরকারের নীতি ও আচরণের ওপর নির্ভর করে। মুসলমানদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ছাড়া মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জন তাদের জন্য সুকঠিন। এবারকার এই বৈশ্বিক আলোড়ন থেকে ভারতের শিক্ষা নিতে হবে। বৈষম্য নয়, সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করাই আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র। ভারতে মুসলমানদের সাথে শুরু হওয়া আচরণ সভ্য পৃথিবীর নীতিমালায় পড়ে না। তুর্কি ধর্মমন্ত্রী ড. আলী এরবাশ টুইট বার্তায় বলেছেন, বৈষম্য আধুনিক রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। মিশরের আল আজহারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য কেবল তুলনামূলক ধর্ম ও সভ্যতার বিষয়ে গণ্ডমূর্খ ব্যক্তিই করতে পারে।

ওআইসি সদস্য হিসাবে বাংলাদেশ তার মনোভাব আলাদাভাবে প্রকাশ না করলেও ৫৭ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ইসলামী নেতৃবৃন্দ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার মুক্তিদূত হিসাবে সব মানুষেরই প্রাতস্মরণীয় আদর্শ। বাংলাদেশের সব দল—মতের নেতারা কিন্তু তাঁর অবমাননার ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানায়নি। অথচ ভোটের সময় এরাই ধর্মের প্রলেপ মেখে মাঠে নামে। ইসলামী নেতৃবৃন্দের কর্তব্য, ঈমানি ইস্যুকে দলীয় বিচারে না দেখে উম্মাহর সামগ্রিক চেতনার আলোকে বিবেচনা করা। মুসলমানদের কমন ইস্যুতে বাংলাদেশ বিশ্ব মুসলিম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, পিছিয়েও থাকতে পারে না। সরকার ও জনসাধারণের পারস্পরিক সহযোগিতায় সারা দেশে ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ কাম্য। আইনশৃঙ্খলা ও পরিবেশ পরিস্থিতি সুন্দর রেখে নিয়মতান্ত্রিক বিক্ষোভ প্রদর্শন ঈমানের দাবিতেই জরুরি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর মর্যাদার ইস্যুতে ভারতীয় মুসলমানদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার মৌলিক অংশ। বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর সাথে সংহতিও শতকরা ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি বাংলাদেশের নৈতিক দায়িত্ব। মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে, ঈমানের দাবি পূরণে সোচ্চার ও সচেষ্ট থাকা। প্রিয়নবীর শান ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়ে রেখেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন,

وَ رَفَعْنَا لَکَ ذِكْرَکَ

আপনার আলোচনা ও স্মরণকে আমি আল্লাহ সমুন্নত করে রাখব।—সূরা ইনশিরাহ, ৯৪ : ০৪

অন্য আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন বলেছেন,

اِنَّ شَانِئَکَ هُوَ الْاَبْتَرُ

হে নবী, আপনার প্রতি বিদ্বেষীরাই সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে।—সূরা কাওছার, ১০৪ : ০৩

 

দুই.

দিল্লি­ জাওহার লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ সত্ত্বেও আফরিন ফাতিমাদের ডুপ্লেক্স বাড়িটি নিমেষেই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। ভারতের বর্তমান সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক বৈষম্যের নজির স্থাপন করে চলেছে। অথচ অধিকাংশ ভারতীয় জনগণ এমনটি পছন্দ করে না। বড় বড় হিন্দু আইনজীবীরা ফাতিমাদের পক্ষে মামলা লড়বেন বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন। বাড়ি ও পরে ধ্বংসস্তুপ হওয়া দুটি ছবি পাশাপাশি দিয়ে ফাতিমা লিখেন, শুধু আমাদের বাড়ি কেন, আমার ধরে নিয়ে যাওয়া পিতা—মাতা ও ছোট বোনের এমনকি আমার নিজের জীবনের চেয়েও আমি আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক ভালোবাসি। আফরিন ফাতিমার সে টুইট বার্তাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

বাংলাদেশে দেশি—বিদেশি যারাই ইসলামী চেতনার কবর রচনার স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্ম তাদের হতাশ করেছে। শাহবাগী যে ধারায় তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন, তাদের ধারণার বাইরে দেশব্যাপী চালু রয়েছে নিন্দা ও প্রতিবাদ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবমাননার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ।

ঢাবিতে নাতে রাসূলের কর্মসূচি, পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন, বৃষ্টির মধ্যে শাবিপ্রবির মাঠে নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, নটরডেম, ইডেন, ডুটেক্সসহ সারাদেশের শতশত স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির সাধারণ ছাত্র—ছাত্রীদের প্রতিবাদ মিছিল ছিল আলেম—ওলামা, মুসল্লীদের কর্মসূচির বাইরে। ইসলামী কর্মতৎপরতার সাথে যুক্ত লোকেদের বাইরে নবীপ্রেমের এ স্বতঃস্ফূর্ত নতুনধারা ভেতর থেকে বদলে যাওয়া পজিটিভ বাংলাদেশের রূপ। মহান রাব্বুল আলামীনের বাণী, وَ رَفَعْنَا لَکَ ذِكْرَکَ এর আধ্যাত্মিক বহিঃপ্রকাশ। নবীজীর ভালোবাসায় উজ্জীবিত বাংলাদেশই স্বাধীনতার অটুট গৌরব। নবীপ্রেমের এ ঐশী ফল্গুধারাই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান রিজিওনের ৭০ কোটি মুসলমানের রক্ষাকবচ।

বিশ্বের ১২০টি দেশে বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী কুয়েতি নিউজ ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামা’ আরব বিশ্বে প্রাচীন ও নেতৃ—চরিত্রের মিডিয়া। চলতি মাসে এর কভার স্টোরি ছিল বিপন্ন ভারতীয় মুসলমান। রাজপথে একটি নামাযের জামাতের ছবি দিয়ে শিরোনাম করা হয়েছে, ‘ভারতীয় মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন’। ভেতরে স্টোরি শুরু হয়েছে ইতিহাসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। বলা হয়েছে, বহু শতাব্দী আগে হিন্দুস্তানের সামুদ্রিক দস্যুদের কবলে পড়া নারীদের একজন সমুদ্র উপকূলেই চিৎকার করেছিল, ‘হে মুসলমানের খলিফা, আমাকে উদ্ধার করুন’। এই বিপন্ন জাহাজের নারী কণ্ঠের চিৎকার লোকমুখে পৌঁছে গিয়েছিল বাগদাদে। খলিফার প্রাসাদে। তিনি সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। এই জলদস্যুদের ধরে নারী ও শিশুদের উদ্ধার করেছিলেন এবং ভারতের পশ্চিম দক্ষিণ অঞ্চলটি মুসলমানদের জন্য নিরাপদ করা হয়েছিল।

এর আগে ৭১২ ইংরেজিতে শাসক হাজ্জাজের যুগে তার সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেন। দেবল বন্দর দখল করে তখনকার রাজা দাহিরকে পরাজিত করেন। মূলত এটিই মুসলমানদের হিন্দুস্থান বিজয়ের সূচনা। এরপর আরব, তুর্কি ও মধ্য এশিয়া বিজেতারা সারা ভারত জয় ও শাসন করেন। কমবেশী ৯০০ বছর মুসলমানরা ভারতবর্ষকে নিজেদের সামগ্রিক অবদানে একটি অতুলনীয় সভ্যতা হিসাবে গড়ে তোলেন।

‘আল মুজতামা’য় বলা হয় আজকের ভারতে প্রায় ৩০ কোটি মুসলমান অস্তিত্ব বিলোপ ও নির্বাসনের মুখোমুখি। হেন অত্যাচার নেই, যা তাদের ওপর চলছে না। জান, মাল, নিরাপত্তা, মানবিক মর্যাদা, অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এমন সময় তাদের সাহায্য করার মতো কোনো শক্তি কি পৃথিবীতে আছে? এখানে ভারতীয় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা হয়েছে। ২০০ কোটির সামনে প্রশ্ন ছুঁঁড়ে দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নের জবাব মুসলিম উম্মাহ হয়তো খুঁজে বের করবে। তাছাড়া মানুষের তকদির তো কোনো শাসক বা শক্তি কর্তৃক লিখিত হয় না। তকদির তো লেখা হয়, আসমানে।

আল্লাহ বলেন,

اِنَّ الَّذِیْنَ یُؤْذُوْنَ اللهَ  وَ رَسُوْلَهٗ  لَعَنَهُمُ اللهُ  فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَۃِ  وَ اَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِیْنًا ﴿۵۷﴾

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানজনক আযাব।—সূরা আহযাব, ৩৩ : ৫৭

বস্তুগত দৃষ্টিতে চিন্তা করলে এমন শক্তির খোঁজ পাওয়া যাবে না। তবে আল্লাহর অভাবনীয় কুদরতের ফায়সালার ওপর আস্থার আলোকে ভাবলে ঠিক সময়মতো সমাধান প্রত্যক্ষ করা যাবে। মুসলমানদের ঈমানী শক্তি আর সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিধানের প্রতি দৃষ্টি রাখলে এই প্রতীতি জন্মে যে, যুগে যুগে সীমালঙ্ঘনকারীদের যে পরিণতি হয়েছে, এ যুগেও তেমনই হবে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, মহান আল্লাহ বলেন,

مَن عادى لي وليًّا فقد آذنتُه بالحرب

অর্থাৎ, যে আমার প্রিয় বান্দার সাথে শত্রুতায় লেগে যায়, আমি আল্লাহ স্বয়ং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে দেই।

উগ্রবাদী লোকজন ছাড়া সারা ভারত তার সন্তানদের সুন্দর সহাবস্থানই চায়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বৃটিশ শাসন না এলে ভারতের বর্তমান এ রূপ দাঁড়াতো না। ভারতের দীর্ঘ ১৯০ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদানই উজ্জ্বলতর। বিগত ৭৫ বছর ভারত স্বাধীন। আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ৩০/৩৫ কোটি মুসলমান বাদ দিলে কেবল ভারতেই এর সমপরিমাণ মুসলমান থাকা সম্ভব। কিন্তু শাসকদের সংবিধানবিরোধী আচরণ ও সা¤প্রদায়িক বৈষম্য ভারতকে এক নতুন চেহারায় উপনীত করেছে। গত প্রায় ৭০ বছরের গণতান্ত্রিক ভারতের সাথে যার অমিল স্পষ্ট। ভারতীয় শাসনতন্ত্রের উদার ও বহুমাত্রিকতা ইদানীং নিতান্ত পর্যুদস্ত।

মুসলিমদের শত শত বছরের প্রিয় মাতৃভূমি যা হযরত নূহ আ. এর বংশধর কর্তৃক প্রথম আবাদকৃত সুন্দর প্রকৃতির দেশ। বলা হয়, সিন্দ এবং হিন্দ নাম দুটোও হযরত নূহ আ. এর সন্তানদের রাখা। এরপর পৃথিবীর নানা জাতি এখানে এসে দখল ও বসত গড়ে। মুসলিম বিজয়ের পর থেকে এখনও পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষ মুসলমান ধর্মপ্রচারক, পীর—আউলিয়া, দরবেশ, উলামা—মাশায়েখ, শাসক ও গুণীবুদ্ধিজীবীদের স্নেহ, মায়া—মমতা ও উচ্চতর মানবিকতার প্রবহমাণ ধারায় নিষিক্ত।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও এমন নেই, যেখানে গত হাজার বছরে ইসলামের ভাবসম্পদ ও সংস্কৃতি চর্চা হয়নি। কেবল ভারতেরই আসমুদ্র হিমাচল মানচিত্রে লাখো পীর—মাশায়েখের জীবন চর্চার শিক্ষা ও আলো চির সঞ্জীবিত রয়েছে। তাতারিরা যখন আরবে মুসলমানদের রাজধানী ও অন্য অনেক ভূখণ্ড দখল করে নেয়, তখন হেজাজ ও মিশর ছাড়া মুসলিম বিশ্বের আর কোনো আশ্রয় ছিল না। তখন মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় ও নিরাপদ বৃহৎ আশ্রয় ছিল এই উপমহাদেশ।

ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দনি খিলজি ও সুলতানুল আউলিয়া খাজা নিজামুদ্দীন রহ. এর সময়কালটি দেখলে ভারতের প্রতি মুসলমানের অবদান সহজে বোঝা যাবে। এরও বহু আগে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পবিত্র রওজা শরীফ থেকে সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রহ. যখন হিমালয়ের দেশটিতে প্রবেশ করেন। লাহোরের দাতা গঞ্জবখশ হযরত আবুল হাসান আলী ইবনে উসমান হুজবিরি রহ. এর মাজারের খাস কামরায় খাজা চিশতি সাঞ্জারী রহ. চিল্লা শেষ করে নিজ পীর হযরত উসমান হারুনী রহ. এর নির্দেশনায় আজমীরে এসে আস্তানা গাড়েন। তখনই ভারতবর্ষের মানচিত্রে আধ্যাত্মিক অনপনেয় ছাপ মেরে দেওয়া হয়। পরবর্তী সকল যুগের সব শাসক সে দৃষ্টিকোণ থেকে খাজা আজমিরীকে উন্নত ও আধুনিক ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের প্রতীক ‘সুলতানুল হিন্দ’ স্বীকার করে এসেছেন।

এই প্রথম উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক খাজা আজমিরীর মাজার, মসজিদ ও খানকাহকে প্রাচীন মন্দির আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভারতের আরও অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ, স্মৃতিসৌধ, মিনার, স্থাপনা দখল ও উচ্ছেদের ছক তৈরী হচ্ছে। ভারতের ৩০/৩৫ কোটি মুসলমানকে নির্মূলের ভাবনা কল্পনাও জোরদার হচ্ছে। যদিও মানুষ নিজেকেই সর্বশক্তির অধিকারী মনে করে বারবার ভুল করে থাকে।

তবুও একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া কর্তব্য যে, মানুষ মূলত সবচেয়ে অসহায় ও দুর্বল সৃষ্টি। আল্লাহ সুযোগ, শক্তি ও সামর্থ্য দান করেন বলে সে নিজেকে শক্তিমান মনে করে। যখন আল্লাহ তাকে ধরেন তখন তার এই পাকড়াও ধারণা—কল্পনার বাইরে হয়ে থাকে। কোন্ কোন্ দিক দিয়ে যে দাম্ভিকদের সর্বনাশের আসমানী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে তা কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই জানেন। ইচ্ছা করলে পৃথিবীর মাটির নিচে সমাহিত বড় শক্তিগুলোর ইতিবৃত্ত থেকেই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে।

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন