প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

ব্যবসা—বাণিজ্যে শরীয়তের নির্দেশনা

ব্যবসা—বাণিজ্যে শরীয়তের নির্দেশনা

মাওলানা যুবায়ের আহমাদ

 

সম্পদ উপার্জন ও বৃদ্ধির প্রবণতা মানুষের স¦ভাবজাত বিষয়। মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেসব স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য দান করেছেন তার সবই তাদের প্রয়োজন ও কল্যাণার্থেই দান করেছেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলো কোথায় কীভাবে ব্যবহার করবে তার নির্দেশনা প্রদান করে আল্লাহ তাআলা দ্বীন ও শরীয়ত দান করেছেন। মানুষ যখন শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের চেষ্টা করবে তখন তার প্রয়োজন যেমন পূরণ হবে তেমনই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি এবং ইহকালীন ও পরকালীন সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাফল্য লাভ করবে। শরীয়তের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে নিজেদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের চেষ্টা করলে প্রয়োজন পূরণের বাহ্যিক কিছু উপকরণ হয়তো অর্জিত হবে, কিন্তু তাতে বরকত ও তৃপ্তি থাকবে না। উপরন্তু আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি ও পরকালীন ভয়াবহ শাস্তির উপযুক্ত সাব্যস্ত হবে।

হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হালাল উপায়ে এ উদ্দেশ্যে দুনিয়ার সম্পদ লাভ করতে চায় যে, তার যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয় এবং সে যেন পরিবার—পরিজনের জীবিকা ও আরামের ব্যবস্থা করতে পারে এবং প্রতিবেশীদের প্রতিও সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারে, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার সঙ্গে এ অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল থাকবে। আর যে ব্যক্তি হালাল উপায়েই এ উদ্দেশ্যে অর্থ—সম্পদ অর্জন করে যে, সে খুব সম্পদশালী হবে, নিজের মর্যাদা ও গৌরব প্রদর্শন করবে এবং লোক দেখানোর জন্য দান—খয়রাত করবে, কেয়ামতের দিন সে এ অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে যে, তিনি তার ওপর খুবই অসন্তুষ্ট।—বায়হাকী ও আবু নুআইম সূত্রে মাআরিফুল হাদীস

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় হযরত মাওলানা মানযুর নোমানী রহ. লেখেন, হাদীসটি থেকে জানা গেল, ভালো উদ্দেশ্যে বৈধ পন্থায় দুনিয়ার সম্পদ উপার্জন করা কেবল জায়েযই নয়; বরং এমন বিরাট পুণ্যের কাজ যে, কেয়ামতের দিন এমন ব্যক্তি যখন আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজির হবে, তখন তার ওপর আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহের চিহ্ন ফুটে উঠবে। যার ফলে তার চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় হয়ে থাকবে। কিন্তু সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্য যদি কেবল সম্পদশালী হওয়া, দুনিয়ার প্রভাব—প্রতিপত্তি লাভ করা এবং লোক দেখানোর জন্য বিরাট বিরাট কাজ করা হয়, তাহলে এ সম্পদ উপার্জন হালাল পন্থায় হলেও এটা এমন গোনাহ যে, কেয়ামতের দিন এমন ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তাআলার চরম ক্রোধ থাকবে। আর নাজায়েয ও হারাম পন্থায় হলে তো তার বিপদের কোনো সীমা পরিসীমা থাকবে না।—মাআরিফুল হাদীস : ২/৫৬ (বাংলা সংস্করণ)

মানুষ সম্পদ উপার্জনের জন্য অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করে। এ সকল পদ্ধতির ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশনা কী সংক্ষেপে সেদিকে আলোকপাত করাই বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের প্রতিপাদ্য। আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও তিনিই তাওফীকদাতা।

ব্যবসা—বাণিজ্য সম্পদ উপার্জনের অন্যতম হালাল পদ্ধতি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَاَحَلَّ اللهُ الْبَیْعَ وَحَرَّمَ الرِّبٰوا

আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।—সূরা বাকারা, ০২ : ২৭৫

ব্যবসা বা ক্রয়—বিক্রয় সংশ্লিষ্ট শরীয়তের বিধি—বিধান অনেক দীর্ঘ ও বিস্তৃত। ফিকহের কিতাবসমূহে সবিস্তারে তা বর্ণিত আছে। এ বিষয়ে স্বতন্ত্র অনেক বই—পুস্তকও আছে। এখানে সংক্ষেপে ক্রয়—বিক্রয়সংক্রান্ত শরীয়তের মৌলিক কিছু শর্ত তুলে ধরা হলো⸻

০১. যে পণ্যের ক্রয়—বিক্রয় করা হবে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পদ হতে হবে। সম্পদ নয় এমন কিছুর ক্রয়—বিক্রয় জায়েয নেই।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৩০

শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পদ নয় এমন কিছু উদাহরণ⸻

ক. যার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ এমন কিছুর ক্রয়—বিক্রয় করা হলো যা ধরা, ছেঁায়া বা কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। যেমন : শুফআর অধিকার।—আদদুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার : ৫/২২

বিষয়টি আমরা এভাবেও বুঝতে পারি, ধরুন, কোনো হকার একটি এপার্টমেন্টে দীর্ঘদিন যাবৎ পত্রিকা বিক্রয় করে আসছে। যার ফলে সে এ এপার্টমেন্টে পত্রিকা বিক্রয় করাকে একমাত্র তার অধিকার মনে করে। অন্য কোনো হকারকে এখানে পত্রিকা বিক্রয় করার সুযোগ দেয় না। এখন সে এ এপার্টমেন্ট ছেড়ে দিতে চায়। তাই অন্য হকারের কাছে অর্থের বিনিময়ে এখানে পত্রিকা বিক্রয়ের অধিকার বিক্রয় করল। শরীয়তের দৃষ্টিতে এ বিক্রয় জায়েয নয়।—কিতাবুন নাওয়াযেল : ১১/৫৮

খ. যে বস্তু মালিকানাধীন হওয়ার উপযুক্ত নয় তা—ও শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পদ নয়। যেমন : স্বাধীন মানুষ।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৩০

গ. যে বস্তুর সর্বপ্রকার ব্যবহার নাজায়েয যেমন : মদ, শূকর প্রভৃতি। শরীয়তের পরিভাষায় এগুলো সম্পদ নয়।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৩৩, ৪৩৬

মাসআলা : যে বস্তু নাজায়েয কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে কিন্তু তাতে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে জায়েয কাজেও ব্যবহার করার সুযোগ আছে, এমন বস্তুর বিক্রয় মাকরুহে তাহরীমী। অর্থাৎ বিক্রয় করলে বিক্রয় সংঘটিত হবে; কিন্তু কবীরা গোনাহ হবে। যেমন : মূর্তি, প্রাণীর সুস্পষ্ট চেহারাবিশিষ্ট পুতুল, দাবার গুটি ইত্যাদি।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৩৭

মাসআলা : যে বস্তু জায়েয ও নাজায়েয উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় তাকে নাজায়েয কাজে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে বিক্রয় করলে গোনাহ হবে। কোনো ক্রেতা নাজায়েয কাজে ব্যবহার করবে বলে নিশ্চিত জানা থাকলে তার কাছে বিক্রয় করাও গোনাহ। যেমন : সন্ত্রাসীর কাছে অস্ত্র বিক্রয় করা।—ফিকহুল বুয়ূ : ১/১৯৩—১৯৪

মাসআলা : যে বস্তু ব্যবহার করা মাকরুহ তা বিক্রয় করাও মাকরুহ। যেমন : বিড়ি, সিগারেট।—ফাতাওয়া দারুল উলূম যাকারিয়া : ৫/১৩৪

ঘ. মানুষের দৃষ্টিতে যার মূল্য নেই। যেমন : গমের একটি দানা, পচাঁ—গলা খাবার।—রদ্দুল মুহতার : ৫/৪, ইতরে হেদায়া : ৭৩

ঙ. মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গও শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পদ নয়। তাই এর ক্রয়—বিক্রয় জায়েয নেই।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৩৩

০২. ক্রয়—বিক্রয়ের মৌলিক শর্তগুলোর দ্বিতীয়টি হলো পণ্যের অস্তিত্ব থাকতে হবে। যে বস্তু এখনো অস্তিত্ব লাভ করেনি তার বিক্রয় সংঘটিত হবে না। যেমন : গাছে ফল ধরার পূর্বেই ফল বিক্রয় করে ফেলা। পশুর বাচ্চা জন্মের পূর্বেই বিক্রয় করে ফেলা।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩২৬

০৩. যে পণ্য বিক্রয় করা হবে তা বিক্রেতার মালিকানাধীন হতে হবে। যে বস্তু বিক্রেতার মালিকানাধীন নয় তার বিক্রয় সংঘটিত হবে না। যেমন : মুক্ত পাখি, বনের পশু বা নদীতে থাকা মাছ শিকার না করেই বিক্রয় করা।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৩৯—৩৪০

৪. পণ্য হস্তান্তরে সক্ষম হওয়া। বিক্রেতা যে বস্তুকে হস্তান্তর করতে সক্ষম নয় তার বিক্রয় সংঘটিত হবে না। যেমন : পুকুরে থাকা নিজের মালিকানাধীন মাছ, নিজের মালিকানাধীন যে পাখি উড়ে গেছে, নিজের মালিকানাধীন যে পশু হারিয়ে গেছে ইত্যাদি। অন্যের কাছে যে পাওনা আছে তা দেনাদার ব্যতীত তৃতীয় কারও কাছে বিক্রয় করাও এর অন্তভুর্ক্ত।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৪১—৩৪৩

৫. পণ্য নিজের কবজায় থাকা। যে বস্তু ক্রয় করার পর এখনো হস্তগত করেনি তার বিক্রয় সহীহ হবে না; বরং ফাসেদ হবে। তবে জমি ক্রয় করার পর হস্তগত করার পূর্বে অন্যত্র বিক্রয় করা জায়েয আছে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৯৪; ফাতহুল কাদীর : ৬/৪৭১—৪৭২

০৬. পণ্য নির্দিষ্ট হতে হবে। পণ্য নির্দিষ্ট না করলে বিক্রয় সহীহ হবে না; বরং ফাসেদ হবে।

মাসআলা : যদি কয়েকটি পণ্য থেকে অনির্দিষ্ট একটি বিক্রয় করে এবং সেগুলোর মাঝে তফাত থাকে; যেমন : ছাগলের পাল থেকে একটি ছাগল বিক্রয় করল, তাহলে এই বিক্রয় ফাসেদ হবে। তবে যদি বিক্রয় চুক্তিতে ক্রেতা বা বিক্রেতা নিজের পছন্দমতো একটিকে নির্ধারণ করার অধিকারের শর্ত করে নেয়, তাহলে চুক্তি ফাসেদ হবে না। যেমন বলল, আমি এই তিনটি ছাগল থেকে একটি ক্রয় করলাম এই শর্তে যে, তিনদিনের ভেতর একটিকে নির্দিষ্ট করে নেব।

মাসআলা : যদি এমন হয় যে, কয়েকটি পণ্য থেকে অনির্দিষ্ট একটি বিক্রয় করল এবং সেগুলোর মাঝে তফাত নেই; যেমন : দশ মণ ধানের স্তুপ থেকে এক মণ ধান বিক্রয় করল, তাহলে বিক্রয় সহীহ হবে। ক্রেতা যেদিক থেকে ইচ্ছা এক মণ নিয়ে নিতে পারবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৫৯—৩৬৪; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৩৭০—৩৭১

০৭. পণ্য নগদ হস্তান্তর করতে হবে। সাধারণত বিক্রয় চুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই ক্রেতা পণ্য হস্তগত করার অধিকার লাভ করে। তাই পণ্য হস্তান্তরের জন্য পরবতীর্ কোনো সময় নিধার্রণ করা সহীহ নয়। এমন শর্ত করলে চুক্তি ফাসেদ হয়ে যাবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৮৪; ইতরে হেদায়া : ৭৬

তবে বিনা শর্তে ক্রেতা যদি পণ্য হস্তান্তরের জন্য বিক্রেতাকে কিছু সময় দেয় বা বিক্রেতা পণ্য হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও ক্রেতা পণ্য গ্রহণে বিলম্ব করে তাহলে সমস্যা নেই।—ফিকহুল বুয়ূ : ১/৫৩৪

মাসআলা : বাইয়ে সলম ও ইসতিসনা (দুই প্রকারের বিশেষ বিক্রয়) উল্লিখিত বিধান থেকে ব্যতিক্রম। (স্বতন্ত্র শিরোনামে এর আলোচনা আসবে, ইনশাআল্লাহ)

০৮. বাকিতে বিক্রয় করলে চুক্তির সময়ই সুস্পষ্টভাবে মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে। যদি মেয়াদ অনির্দিষ্ট থাকে বা অস্পষ্ট থাকে; যেমন বলল : ধান কাটা হলে মূল্য দেব, তাহলে চুক্তি ফাসেদ হয়ে যাবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৯১

মাসআলা : কিস্তিতে বিক্রয় করলে কিস্তির সংখ্যা ও প্রত্যেক কিস্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট করতে হবে।—ফিকহুল বুয়ূ : ১/৫৩৯

মাসআলা : বাকি বা কিস্তিতে বিক্রয়ের কারণে নগদ মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করা জায়েয আছে।—ফিকহুল বুয়ূ : ১/৫৪২

০৯. মূল্য সুনির্দিষ্ট হতে হবে। মূল্যে যদি অস্পষ্টতা থাকে তাহলে চুক্তি ফাসেদ হয়ে যাবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৫৯; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৪২৩

মাসআলা : বিক্রেতা বলল, নগদ মূল্য প্রদান করলে এর মূল্য একশত টাকা; বাকিতে দিলে একশত বিশ টাকা। ক্রেতা এতে সম্মত হয়ে পণ্য নিয়ে নিল, কিন্তু মূল্য কি নগদ না বাকি তা নির্ধারণ করল না, তাহলে চুক্তি ফাসেদ হয়ে যাবে। যদি নগদ বা বাকি কোনো এক সুরত নিধার্রণ করে নেয় তাহলে সহীহ হবে।—ফিকহুল বুয়ূ : ১/৫৪২

১০. লেনদেন সুদমুক্ত হতে হবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৪০০

সাধারণত টাকা—পয়সা বা অন্য কোনো মুদ্রার বিনিময়ে মানুষ পণ্য বেচাকেনা করে। তবে যদি পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বা মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা বেচাকেনা করে তাহলে লেনদেনটি সুদমুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষ শর্ত রয়েছে। তা হলো̶

ক. যে বস্তু ওজন বা পাত্রের পরিমাপ (যেমন : গ্রাম, লিটার, সের) হিসেবে লেনদেন করা হয় তা সমজাতীয় বস্তুর সঙ্গে বিনিময় করা হলে লেনদেনটি সমপরিমাণে ও নগদ হতে হবে। যদিও বিনিময়কৃত বস্তুদ্বয়ের মানে তফাত থাকে। যেমন : মোটা ধান দিয়ে চিকন ধান ক্রয় করা হলে উভয় প্রকার ধানের পরিমাণ সমান হতে হবে এবং নগদ লেনদেন হতে হবে। কোনো বিনিময় বাকি রাখার শর্ত করা যাবে না।

খ. যে বস্তু ওজন বা পাত্রের পরিমাপ (যেমন : গ্রাম, লিটার, সের) হিসেবে লেনদেন করা হয় তা অনুরূপ পরিমাপযোগ্য ভিন্নজাতের বস্তুর সঙ্গে বিনিময় করা হলে নগদ হতে হবে।

মাসআলা : চাল ও আটা উভয়টি ওজন হিসেবে লেনদেন হয়। তাই এগুলোর জাত ভিন্ন হলেও পরিমাপ এক। তাই চাল দিয়ে আটা বিনিময় করা হলে নগদ হতে হবে। বাকির শর্ত করা যাবে না।

মাসআলা : দুধ ও আটার পরিমাপ ভিন্ন ভিন্ন। দুধ বিক্রি হয় পাত্রের পরিমাপে আর চাল বিক্রি হয় ওজন হিসেবে। তাই দুধ দিয়ে আটা বিনিময় করা হলে বাকির শর্ত করা যাবে।

গ. যে বস্তু ওজন বা পাত্রের পরিমাপ (যেমন : গ্রাম, লিটার, সের) হিসেবে লেনদেন করা হয় না, যেমন : গরু ছাগল, তা যদি সমশ্রেণির বস্তুর সঙ্গে বিনিময় করা হয় যেমন : ছাগলের বিনিময়ে ছাগল ক্রয় করল, তাহলে নগদ হতে হবে। কিন্তু ভিন্নজাতের বস্তুর সঙ্গে বিনিময় করলে যেমন : ছাগলের সঙ্গে গরু বিনিময় করল, তাহলে লেনদেন নগদ হওয়া শর্ত নয়। বাকির শর্ত করাও জায়েয হবে।—ফাতহুল কাদীর : ৭/৩—১৩; ফিকহুল বুয়ূ : ২/৬৬৩

(মুদ্রা ও স্বর্ণ—রুপার বিনিময়—সংক্রান্ত মাসায়েল পরবতীর্ কোনো সংখ্যায় আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ)

১১. বিক্রয়—চুক্তি সহীহ হওয়ার জন্য একটি শর্ত হলো, বিক্রয়—চুক্তির সঙ্গে এমন কোনো শর্ত করা যাবে না, যে শর্ত বিক্রয়—চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এর কারণে ক্রেতা বা বিক্রেতার অতিরিক্ত সুবিধা লাভ হয়। যেমন : ঘর বিক্রয়ের সময় বিক্রেতা শর্ত করল সে এক মাস বিনা ভাড়ায় এই ঘরে বসবাস করবে। বা ক্রেতা ঘর কেনার সময় শর্ত করল তাকে ঘর সাজিয়ে দিতে হবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৭৭; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৪৮৭

মাসআলা : যে শর্ত বিক্রয় চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তার কারণে চুক্তি ফাসেদ হবে না। যেমন : বাকি বিক্রির সময় মূল্যের বিপরীতে বন্ধক রাখার শর্ত করল অথবা ক্রেতা জমি ক্রয়ের সময় রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার শর্ত করল।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৮০; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৪৮৭

মাসআলা : যে শর্তের ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেছে তাতে ক্রেতা—বিক্রেতা কারও সুবিধা থাকলেও তার কারণে চুক্তি ফাসেদ হবে না। যেমন : ওয়ারেন্টি বা বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়ার শর্তে কোনো বস্তু বিক্রয় করল।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৮১; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৪৮৭

 

সহীহ ও ফাসেদ বিক্রয়ের বিধানগত পার্থক্য

মাসআলা : ক্রয়—বিক্রয়ের সকল শর্ত রক্ষা করে বিক্রয়—চুক্তি সম্পন্ন হলে তাকে সহীহ বিক্রয় বলা হয়। সহীহ বিক্রয়—চুক্তিতে যদি ক্রেতা—বিক্রেতা বা অন্য কারও জন্য এখতিয়ার বা ইচ্ছাধিকারের শর্ত না থাকে তাহলে তার বিধান হলো, বিক্রয়টি ‘সলম’ শ্রেণির না হলে চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা পণ্যের মালিক হয়ে যায়। সুতরাং ক্রেতার ওপর আবশ্যক হবে মূল্য প্রদান করা এবং বিক্রেতার ওপর আবশ্যক হবে পণ্য হস্তান্তর করা।—ফিকহুল বুয়ূ : ২/৭৭৬

মাসআলা : সহীহ বিক্রয় যদি নগদ হয় তাহলে বিক্রেতার জন্যে মূল্য হস্তগত না হওয়া পর্যন্ত পণ্য আটকে রাখার অধিকার আছে। তবে ক্রেতার জন্যে পণ্য হস্তগত না হওয়া পর্যন্ত মূল্য প্রদান থেকে বিরত থাকার অধিকার নেই। এ বিধান হবে যদি পণ্য উপস্থিত থাকে। তবে যদি ক্রেতা—বিক্রেতার নিকটে পণ্য উপস্থিত না থাকে তাহলে পণ্য উপস্থিত না করা পর্যন্ত মূল্য প্রদান থেকে ক্রেতা বিরত থাকতে পারবে।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৪৮৮—৪৮৯; ফিকহুল বুয়ূ : ২/৭৭৬—৭৭৭

মাসআলা : পূর্বে কিছু শর্তের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ওই শর্তের লঙ্ঘন হলে বিক্রয়—চুক্তি ফাসেদ হয়ে যায়। এ ধরনের কোনো শর্তের লঙ্ঘনের কারণে চুক্তি ফাসেদ হয়ে গেলে তাতে নিম্নোক্ত বিধানসমূহ প্রযোজ্য হয়⸻

এক. ফাসেদ বিক্রয়—চুক্তিতে জড়িত হওয়া নাজায়েয। এমন চুক্তি করে ফেললে তা প্রত্যাহার করা এবং পণ্য ও মূল্যের লেনদেন থেকে বিরত থাকা ক্রেতা—বিক্রেতা উভয়ের ওপর ওয়াজিব।

দুই. ফাসেদ বিক্রয়ের পণ্য ক্রেতা যদি হস্তগত না করে তাহলে তাতে ক্রেতার মালিকানা সাব্যস্ত হবে না।

তিন. ক্রেতা যদি বিক্রেতার অনুমতিক্রমে পণ্য কব্জা করে ফেলে তাহলে ক্রেতা অপবিত্রভাবে পণ্যের মালিক হবে। এটা খাওয়া, পান করা, পরিধান করা বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা জায়েয হবে না। তবে যদি ফাসেদ হওয়ার কারণ দূর করে নতুনভাবে চুক্তি করে তাহলে জায়েয হবে।

পাঁচ. যেহেতু পণ্য হস্তগত করার পর তাতে ক্রেতার মালিকানা সাব্যস্ত হয় যদিও অপবিত্রভাবে, তাই তাতে ক্রেতার হস্তক্ষেপ কার্যকর হবে। যেমন : তৃতীয় কারও কাছে এই পণ্য বিক্রয় করলে কার্যকর হবে। তবে ক্রেতার জন্যে এর লাভ হালাল হবে না; বরং সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব হবে।

ছয়. যদি ক্রেতার হাতে পণ্য না থাকে, যেমন : ক্রেতার হাতে পণ্য নষ্ট হয়ে গেল অথবা তাতে এমন কিছু করল যার কারণে ফেরত দেওয়া অসম্ভব, তাহলে ক্রেতা বিক্রেতাকে পণ্যের হুবহু অনুরূপ বস্তু বা বাজারদর প্রদান করবে এবং মূল্য ফেরত নেবে।—ফিকহুল বুয়ূ : ২/৯৬০

মাসআলা : কিছু শর্তের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ওই শর্তের লঙ্ঘন হলে বিক্রয় সংঘটিত হয় না। এ ধরনের কোনো শর্তের লঙ্ঘন হলে চুক্তিকে বাতিল বলা হয়। বিক্রয়—চুক্তি বাতিল হয়ে গেলে তাতে ক্রয়—বিক্রয়ের কোনো বিধান প্রযোজ্য হবে না।—বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৫৯১

 

সমাজে প্রচলিত কিছু লেনদেনের দৃষ্টান্ত :

 

গাছে ফল ধরার পূর্বেই বিক্রয় করা

বর্তমানে অনেক এলাকায় গাছে ফল ধরার পূর্বেই বাগানের ফল বিক্রয় করে দেওয়া হয়। অথচ এটা অস্তিত্বহীন বস্তুর বিক্রয়। কারও মতেই এটা জায়েয নয়।

তবে যখন ধরে এবং মানুষ বা পশুর খাবারের উপযোগী হয় তখন বিক্রয় করা সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে। আর যদি এমন হয় যে, মাত্র ফল ধরেছে তবে খাবারের উপযোগী হয়নি, এমনকি পশুর খাবারেরও উপযুক্ত হয়নি, তার ব্যাপারে হানাফী মাশায়েখদের মতভেদ আছে। পরবতীর্ ফুকাহায়ে কেরাম জায়েয হওয়ার মত গ্রহণ করেছেন। তবে ফুল থাকা অবস্থায় বিক্রয় করা জায়েয হবে না।

গাছ বা বাগানের কিছু ফল ধরেছে, কিছু এখনও ধরেনি এমতাবস্থায় সব ফল (যা ধরেছে, যা ধরেনি) বিক্রয় করা জায়েয হবে কি না, সে ব্যাপারে মতভেদ আছে। এক্ষেত্রে মূল মাযহাব হলো, শুধু যেসব ফল ধরেছে সেগুলোর বিক্রয় জায়েয হবে। কেননা, যে ফল এখনও বের হয়নি তা অস্তিত্বহীন। তবে মালেকী মাযহাব ও কতক হানাফী ফকীহের মতে সবগুলোর বিক্রয় জায়েয হবে। তারা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ফলগুলোকে মূল আর পরবর্তীতে যেসব ফল বের হবে সেগুলোকে মূলের অধীন সাব্যস্ত করেন। বর্তমানে এ অবস্থায় ফল বিক্রয় করার ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেছে। তাই বর্তমানের ফুকাহায়ে কেরাম এ অবস্থায়ও সকল ফল বিক্রয় জায়েয হওয়ার মত গ্রহণ করেছেন। তবে এ বিক্রয়ে শুধুমাত্র ওই সব ফলই অন্তর্ভুক্ত করা জায়েয হবে, যেগুলো এক ফলনে বের হয় এবং এক ফলন শেষ হতে এক বছরের বেশি সময় লাগে না। যে ফলন এখনো শুরু হয়নি তা বিক্রয় করা জায়েয হবে না।

মোটকথা, যে গাছ বা বাগানের কিছু ফল ধরেছে আর কিছু এখনও ধরেনি, সে গাছ বা বাগানের এক ফলনের সকল ফল বিক্রয় করা জায়েয হবে, যদি এক ফলন শেষ হতে এক বছরের বেশি সময় না লাগে।

—ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৯৯—১০২; আহসানুল ফাতাওয়া : ৬/৪৮৫—৪৮৭; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৩২৬—৩২৯

 

বিক্রয়ের পর গাছে ফল রেখে দেওয়া

ফল ধরার পর গাছে রেখেই বিক্রয় করার যে মাসআলা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে যদি বিক্রয়ের পরপর ফল কেটে ফেলার শর্ত থাকে, তাহলে জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। যদি বিক্রয় শর্তহীন হয়; বিক্রয়ের পর ক্রেতা ফল কেটে নিতে হবে বা গাছে রেখে দেবে এমন ‎কোনো শর্ত না করা হয়, তাহলেও এই বিক্রয় জায়েয হবে। কেননা, তাতে চুক্তির দাবি—পরিপন্থি ‎কোনো শর্ত করা হয়নি।

যদি ক্রেতা ক্রয়ের পর নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত গাছে ফল রাখার শর্ত করে তাহলে বিক্রয়—চুক্তির মাঝে অতিরিক্ত শর্ত করা হচ্ছে। যার কারণে পূর্ববতীর্ ফকীহগণের ফত্ওয়া হলো, এ শর্তের কারণে চুক্তি ফাসেদ হয়ে যাবে। তবে বর্তমানে এমন শর্তের প্রচলন হয়ে গেছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, যে শর্তের প্রচলন হয়ে যায় তার কারণে চুক্তি ফাসেদ হয় না। তাই বর্তমানে এই শর্ত জায়েয হবে।—ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৯৬; আহসানুল ফাতাওয়া : ৬/৪৮৬, ৪৯০; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৩২৯—৩৩৩

 

অনির্দিষ্ট প্লট বিক্রয় করা

কখনো ফুট বা মিটার হিসেবে জমির প্লট বিক্রয় করা হয়। স্থান নির্ধারণের কাজটি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে দেওয়া হয়। সাধারণত ‎কোনো কোম্পানি বড় জমি ক্রয় করে। এরপর সাধারণ মানুষের কাছে ফুট বা মিটার হিসেবে প্লট বিক্রয় করে। যেমন : একেকটি প্লট ৫০০ মিটারের। তবে ক্রয়ের সময় ৫০০ মিটারের স্থানটি নির্দিষ্ট করা হয় না। কোম্পানির পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তীতে নির্দিষ্ট করা হয়। প্রশ্ন হলো, এই বিক্রয়টি সহীহ হবে কি না? প্লটের ক্রেতা অন্য কারও কাছে এটা বিক্রয় করতে পারবে কি না?

ফিকহের কিতাবে এর কাছাকাছি একটি মাসআলা উল্লেখ আছে। সে মাসআলাটি হলো, ‎কোনো ব্যক্তি ‎কোনো বাড়ি থেকে অনির্দিষ্ট দশ হাত বিক্রয় করল। ইমাম আবূ হানিফা রহ. এর মতে পণ্য অজ্ঞাত থাকার কারণে এই বিক্রয়টি ফাসেদ। তাই প্লট বিক্রয়ের উপরোক্ত পদ্ধতি সহীহ হবে না। তবে যদি প্লটের স্থান নির্ধারিত হওয়ার পূর্বে বিক্রয়—চুক্তি না করে দু—পক্ষ মিলে পরবতীর্ সময়ে ক্রয়—বিক্রয় করার ব্যাপারে ওয়াদা করে এবং মূল্য পরিশোধ করা সহজ হওয়ার জন্য বিক্রেতা পক্ষের নিকট ক্রেতা পক্ষ অর্থ জমা করতে থাকে, তাহলে জায়েয হবে। পরবর্তীতে যখন প্লটের স্থান নির্ধারণ হবে তখন বিক্রয়—চুক্তি করবে। এবং পূর্বে জমাকৃত অর্থ মূল্য হিসেবে সাব্যস্ত করে নেবে। এ অবস্থায় প্লটের স্থান নির্ধারণ করে ক্রয়—চুক্তি করার পূর্বে ক্রেতার জন্য অন্যত্র বিক্রয় করা জায়েয হবে না।—আল বাহরুর রায়েক : ৫/৪৮৭—৪৮৮; রদ্দুল মুহতার : ৫/৫১; ফিকহুল বুয়ূ : ১/৭৪—৭৫, ৩৭৬—৩৭৭

 

প্রতিবিপ্লবের কবলে আরব বসন্তের সূতিকাগার

মাওলানা শাহেদ হারুন

২০১১ সালে যে আরব বসন্ত দেখা দেয় তার সূতিকাগার ছিল আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি দেশ তিউনিসিয়া। এখান থেকে চৈত্রের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র আরব বিশ্বে। অনেক দেশে তা ব্যর্থ হলেও সফল হয় বিভিন্ন দেশে। যেমন মিশরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়, যারা ছিল ইসলামপন্থি। সেই আরব বসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়ে সিরিয়ায়। দেশটি জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। সেখানে গণতন্ত্র কায়েম না হলেও দেশটি কার্যত টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আসাদ সাহেব সিংহাসন আঁকড়ে ধরে বসে থাকলেও সিরিয়ার অনেক এলাকা এখন তার বেহাত। লিবিয়ার স্বৈরশাসক গাদ্দাফির পরিণতিও আমাদের জানা। তার পতনে কাজের কাজ এতটুকুই হলো যে লিবিয়া এখন সিরিয়ার মতোই ভঙ্গুর রাষ্ট্র। অর্ধেক আমার দখলে তো বাকিটা তোমার। তবে এর ব্যতিক্রম আমরা কিছু কিছু দেশে দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত ছিলাম। যেমন, প্রেসিডেন্ট তাবুন শাসিত আলজেরিয়াকে মোটামুটি গণপ্রতিনিধিত্বমূলকই বলা চলে। এখনও সেখানে মোটামুটি স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তবে ভালোর চাইতে মন্দই দেখা দিল বেশি। ইয়েমেন হলো দ্বিখণ্ডিত। উপসাগরীয় দেশগুলোতে আরব বসন্ত তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। রাজা—বাদশাহরা উলটো টাকা খরচ করে মিশরের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়। লিবিয়ায় সফল না হলেও দেশটিকে অন্তত ভেঙে অস্থিতিশীল করে দিতে পেরেছে। তাদের সহায়তায় আসাদ সাহেবও নিজ গদিটা কোনোমতে টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। এ সবকিছু থেকে অনেকটা হেফাজতে ছিল আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিসিয়া। এর মাঝেও নির্বাচন হয়ে গেল। সরকারের পালাবদল প্রক্রিয়াটা ছিল স্বচ্ছ। কিন্তু হঠাৎ করে জুলাই মাসে আমরা শুনতে পাই সেখানে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। উৎখাত করা হয় ইসলামপন্থি বৈধ সরকারকে। কতৃর্ত্ববাদী সরকার আবার শুরু করেছে দমন—নিপীড়ন। দেশটি আবার হারিয়ে যায় সামরিক শাসনের অন্ধকার কৃষ্ণগহ্বরে। নেপথ্য কারণগুলো আমরা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি এবং তার আলোকে ভবিষ্যৎটাও কিছুটা অনুমান করে দেখতে পারি।

হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্টে কাইস সাইদ গেল ২৫ জুলাই পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেন। ইসলামপন্থিরা বললেন, এটা তো একটা ন্যক্কারজনক প্রতিবিপ্লব। তবে যথারীতি প্রেসিডেন্ট সাইদ বলেন, সংবিধান অনুযায়ী তিনি অবশ্যই নির্বাচিত সরকার ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন।

এই পার্লামেন্ট ভাঙার পেছনে প্রেসিডেন্ট সাইদের যুক্তি এটাই ছিল যে, অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া সরকার ঠিকমতো করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করতে পারেনি। এর প্রতিবাদে ইসলামপন্থি ক্ষমতাসীন হারাকাতুন—নাহদা পর্টির নেতা বলেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়াটা হচ্ছে গণতন্ত্রের ওপর নগ্ন হামলা। তিনি তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় নেমে যেতে বললেন। তারা কথামতো তা করলেও কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্টের পক্ষেও লোকজন রাস্তায় নামে পুলিশের ছত্রছায়ায়। আর ওস্তাদের মাইর হিসেবে সামরিক প্রশাসন স্পষ্টতই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে।

এতে উৎসাহিত হয়ে প্রেসিডেন্ট সাইদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইবরাহিম আল—বারতাজি এবং অন্যান্য আরও অনেক মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। তা দেখে নির্বাচিত ও বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিশাম আল—মাশিশি বলেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট যাকে চান তাকেই ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হবে, যাতে পরিস্থিতির আর অবনতি না হয়। তিনি যেখানেই যাবেন তিউনিসের খেদমতই করে যাবেন। তাঁর এই সুবোধ বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে প্রেসিডেন্ট সাইদ আগস্ট ২৭ পর্যন্ত দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে দিলেন।

৩০ জুলাই সংসদ সদস্য ইয়াসিন আল—আয়ারিকে ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। তাঁর অপরাধ, সাইদের সমালোচনায় তিনিই ছিলেন সবচাইতে মুখর। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট সাইদ সংসদ সদস্যদের আইনি সুরক্ষা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আল—আয়ারিকে কয়েক দিন পর দেখা গেল সামরিক আদালতে। তার বিরুদ্ধে ঠুনকো এক অপরাধের অভিযোগ তোলা হয়। ২০১৮ সালে মিলিটারির সমালোচনা করার দায়ে তাকে জেলে পাঠানো হলো। আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে আরেক সংসদ সদস্য মাহের যায়েদকে কারাদণ্ড দেওয়া হলো সাবেক প্রেসিডেন্ট আল—বাজির সমালোচনা করার জন্য। আমরা যেখানে দেখছি এটা হচ্ছে মূলত একধরনের সামরিক অভ্যুত্থান, সেখানে অনেক বিশ্লেষক প্রেসিডেন্ট সাইদের বেসামরিক খোলসের জন্য এটাকে আমলাতান্ত্রিক অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখছেন।

 

ঘটনার সূত্রপাত

ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন ইসলামের জন্য অবমাননাকর কিছু চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হলে সালাফিরা মাঠে নামে। তবে তাদের এই বিশৃঙ্খলা থেকে সুযোগটা নেয় আরব বসন্তের বিপক্ষ শক্তি। তারা সুযোগ লুফে নিতেও দেরি করেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে এতে বলির পাঠা হতে হয় জনগণকে, যারা চেষ্টা করে যাচ্ছিল গণতান্ত্রিক প্রশাসনের সহযোগিতায় নিজেদের কিছু আর্থসামাজিক মৌলিক অধিকার আদায় করতে। তবে সালাফিরা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিলে তার সুযোগটা নেয় সাবেক স্বৈরশাসক যয়নুল আবেদীন বিন আলীর রেখে যাওয়া সমর্থকরা। জনগণের ইসলামী মনোভাবকে পঁুজি করেই তারা সালাফিদের মাধ্যমে এই নাটকের সৃষ্টি করে ক্ষমতা লুফে নেয় প্রেসিডেন্ট সাইদের মাধ্যমে। তবে নির্বাচিত সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের এই পথ আরও সুগম হয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।

তবে সালাফি নেতৃবৃন্দ বোঝাতে চেয়েছেন তারা আসলে সাবেক স্বৈরশাসকের সমর্থকগোষ্ঠী এবং মিডিয়ার অপপ্রচারের শিকার। এই ষড়যন্ত্র শুধু তাদের বিরূদ্ধে নয়; বরং ইসলামই হলো বিরুদ্ধবাদীদের আসল টার্গেট। তাদের মতে আলোচনার টেবিলে বসলেই কে কতটুকু দায়ী তা বের হবে এবং জাতীয় অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠারও একটা পথ বের হয়ে যাবে।

 

একটু পেছন ফিরে তাকানো

২০১১ সালে যয়নুল আবেদীনের পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলেও এই দেশের রাজনৈতিক পথ যে খুব একটা মসৃণ ছিল সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তার রেখে যাওয়া প্রশাসনের লোকেরা তো সবাই যার যার জায়গায় বহাল ছিল। তাই তারাই ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে বৈধ সরকারগুলোকে বিভিন্ন বেকায়দায় ফেলার চেষ্টায় থাকত। তার সুফল অবশ্য তারা ২০২১ সালেই পেয়ে যায়। এরই মাঝে কয়েকবার সরকার গঠিত হয়, আবার উৎখাতও হয়। তবে বৈধ ও নির্বাচিত সরকারগুলোও বসে ছিল না। তারাও নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে অনেক পরিবর্তন আর সংস্কার আনতে সক্ষম হয়েছিল বলে মিশরের মতো অচিরেই তাদেরকে বিদায় নিতে হয়নি। এক্ষেত্রে জনগণের সমর্থনও তাদের অনেক কাজে লাগে।

২০১৯ সালে তিউনিসিয়ায় এক বিরাট সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েও ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও সংবিধানে পরিবর্তন এনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় এবং ইসলামপন্থি সরকার আবার ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ ধরে নিয়েছিলেন যে অন্তত তিউনিসিয়া গণতন্ত্রের ক্রান্তিকালীন সময়টা ভালোভাবেই পার করতে পেরেছে, সুতরাং তারা এখন আশঙ্কামুক্ত থাকতে পারে। আন—নাহদা মোট ২০% ভোট পায়। পক্ষান্তরে কাইস সাইদ ১৮% পেয়ে বাগিয়ে নেন প্রেসিডেন্টের পদটা। বস্তুত সাবেক প্রেসিডেন্ট কায়েদ আস—সিবসির মৃত্যুতেই তার কপালটা খুলে যায়। তিনিই নির্বাচিত হন সিবসির উত্তরাধিকারী। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি যে—কোনো আরব নেতাদের মতো অলৌকিকভাবে ৭২% ভোট পেয়ে যান। তবে আইনের এই অধ্যাপকের ছিল না কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। পক্ষান্তরে রশিদ ঘানুসিকে বানানো হয় স্পিকার। সবাই এই মনে করে আশ্বস্ত হয় যে, এবার বুঝি প্রশাসনের পুরোনোরাও আর কোনো কলকাঠি নাড়ার সুযোগ পাবে না। তাদের দুইজনই তো জনগণ ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হতে হলে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের প্রয়োজন সেটা না হওয়াতেই আকাশে ফেতনার কালো মেঘ জমা হতে থাকে ধীরে ধীরে। সুযোগসন্ধানীরাও অপেক্ষায় থাকে রাজনৈতিক চরম দ্বন্দ্বের। তাহলেই না ঘোলা জলে মাছ ধরার পথ সুগম হবে। যাই হোক, দেন—দরবারের পর এক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এ। সেটাকে অবশ্য অনেকেই জাতীয় জোড়াতালি সরকার বলে উপহাস করত। নতুন জোড়াতালি সরকারের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে দেখা দেয় সেই তৃতীয় বিশ্বের অভিন্ন সমস্যাগুলোর সমাধান। বেকারত্বের নিরসন, গণতান্ত্রিক চর্চার উন্নয়ন এবং আর্থসামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ। তবে বিশ্বব্যাপী অন্য যে—কোনো দেশের মতো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় কোভিড—১৯। এতে অর্থনীতি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। স্বভাবতই প্রধান উৎস পর্যটন খাতে ধস নামে, যা জাতীয় আয়ের ৮%। এহেন পরিস্থিতিতে সেই বছর আগস্ট মাসে আল—মাশিশি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু তাতেও সমস্যার কি আর সমাধান হয়? এ সুযোগটাই পুরোদমে কাজে লাগাল ষড়যন্ত্রকারীরা বিরোধী দলের কাঁধে চড়ে।

 

আড়ালের আন্তর্জাতিক স্বার্থ

এই সময়টাতে লিবিয়ায় চলছিল গৃহযুদ্ধ। সাবেক উপনিবেশ ম্যঁাকরো সাইদকে চাপ দেয় বিপথগামী লিবীয় নেতা জেনারেল হাফতারের পক্ষে থাকতে। কিন্তু সাইদ তা কৌশলে এড়িয়ে যায়। আবার জাতিসংঘ যখন ত্রিপলির সরকারকে স্বীকৃতি দেয় তখন তিনি তাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে ফ্রান্স হাত মেলায় আরব আমিরাতের সাথে। আরব আমিরাত প্রশ্রয় দেয় মহিলা সাংসদ আবীর মুসিকে। আবুধাবী এবং কায়রোর উসকানিতে তিনি বেশ মিটিং—মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সাইদ সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হন। মনে রাখতে হবে, তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনী কিন্তু ততটা আগ্রাসি নয়। সাবেক একনায়ক সাহায্য চাইলেও তারা এগিয়ে আসেনি। তবে তাদের ভাষ্যমতে তারা দেশের স্বার্থে এবার সংসদ ভবন ঘেরাও করে রাখে। ঘানুসি এর ব্যাখ্যা চাইলে সেনাবাহিনী সাফ বলে দেয়, তারা শুধু রাষ্ট্রপতির হুকুম পালন করছে।

 

খালেস এবং কৃত্রিম আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখে বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী দেশগুলো সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। তুরস্ক ভ্রাতৃপ্রতিম এই দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরূদ্ধে সরকার পরিচালনার জন্য প্রেসিডেন্ট সাইদের সমালোচনা করে। সৌদি আরব খুশি জাহের না করলেও বলে, দেশের স্থীতিশীলতার জন্য তারা যথাসম্ভব সাহায্য করে যাচ্ছে। আর আমেরিকা তার পুরোনো রেকর্ড বাজাতে থাকে। তারা আশা করে, সেখানে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাবে।

আপাতত তুরস্ক এই হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে যে এর মধ্যে কোনো ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানের আভাস পেলে কিংবা গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে তুরস্ক চুপচাপ বসে থাকবে না। কারণ, ফ্রান্সের মতো এই দেশে অনেক দিন উসমানি খেলাফতেরও কর্তৃত্ব ছিল!

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন