ভাস্কর্য ইস্যু : আলেমসমাজের দায়িত্ব ও সরকারের করণীয়
মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে যারা বিতর্ক করেন তাদের সব পক্ষকেই একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, এটি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি ধর্মীয় আলোচনা। ইসলামে পূজার জন্য ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ যেমন নিষিদ্ধ, অন্য কোনো কারণেও মানবমূর্তি ও প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ সমভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামে শরীয়ত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে ভাস্কর্যের কোনো বৈধতা আছে কিনা তা ইসলাম বিশেষজ্ঞদের চেয়ে অন্যদের বেশি জানার কথা নয়। এ কথা জেনে রাখা উচিত যে, ইসলামের কোনো বিধান না মানতে পারলে এর ক্ষতিপূরণ আছে। তওবা আছে। কিন্তু ইসলামের কোনো বিধানকে অস্বীকার করলে কিংবা অবৈধকে বৈধ বলে দাবি করলে মানুষের মুসলিম থাকা দায়। এমন অবস্থায় ঈমানহারা হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। অতএব, কোনো কারণে শরীয়তের নিয়ম লঙ্ঘন হয়ে গেলে এটিকে গোনাহ জেনে আল্লাহর কাছে তওবার আশা করা বাঞ্ছনীয়। এটিকে বৈধ বলে শরীয়তের হুকুমকে উড়িয়ে দেওয়া এবং যারা এ বিধান বর্ণনা করেন তাদের গালাগাল, হুমকি ও ধিক্কার দেওয়া মোটেও সঙ্গত নয়। দুনিয়ার সব মুসলমানের কাছে আজকের দিনে ন্যূনতম এতটুকুই ইসলাম প্রচারক আলেম ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাগণের প্রত্যাশা।
এ ছাড়া যারা বলতে চান যে, ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়, তারা ভুল বলেন। তাদের বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আপনারা যেকোনো নির্ভরযোগ্য বাংলা অভিধান দেখুন, সেখানে ভাস্কর্য আর মূর্তি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সমাজেও প্রতিমা নির্মাতা ও ভাস্কর্য নির্মাতা উভয়কেই ভাস্কর বলা হয়। কলকাতার সব পত্রিকায় সব সময় বাংলাদেশে আমরা যাকে ভাস্কর্য বলি, তাকে বলা হয় মূর্তি। ভারতে বলে গান্ধিমূর্তি, নেতাজীর মূর্তি। কিছুদিন আগে কুষ্টিয়ায় যে ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে সে খবর কলকাতায় ছাপা হয়েছে ‘বাংলাদেশে মুজিবের মূর্তি ভেঙেছে দুর্বৃত্তরা’ শিরোনামে।
আলেমসমাজ ইসলামের দায়িত্বশীল ব্যাখ্যাতা। তারা সাধারণ মানুষকে তাদের ঈমান—আমল, বিশ্বাস—চেতনা সম্পর্কে কোরআন—সুন্নাহর আলোকে সচেতন করবেন—এটাই স্বাভাবিক। পবিত্র কোরআনে নবীগণের কাজের পদ্ধতি মহান আল্লাহ যেভাবে তুলে ধরেছেন তা এমনই। নবী হযরত শোয়াইব আ. তাঁর জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
اِنْ اُرِیْدُ اِلَّا الْاِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ
আমি শুধু আমার সাধ্যমতো তোমাদের সংশোধনই কামনা করি।—সূরা হুদ, ১১ : ৮৮
অন্যত্র কয়েক জন রাসূলের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে এভাবে,
وَمَا عَلَیْنَاۤ اِلَّا الْبَلٰغُ الْمُبِیْنُ
সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের দায়িত্ব।—সূরা ইয়াসীন, ৩৬ : ১৭
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
مَا عَلَی الرَّسُوْلِ اِلَّا الْبَلٰغُ
রাসূলের দায়িত্ব বার্তা পৌঁছে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।—সূরা মায়েদা, ০৫ :৯৯
যে জন্য নবীজীবনের ২৩ বছরের মধ্যে ২১ বছরই তিনি তাঁর জাতির মন থেকে মূর্তির প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দূর করার চেষ্টা করেছেন। সে জায়গায় এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা স্থাপন করেছেন। শক্তি অর্জিত না হওয়ায় বাইরের মূর্তিগুলো ভাঙেননি। জাতির বিশ্বাস ও চেতনা থেকে মূর্তিপ্রীতি দূর হওয়ার পর, সামাজিক বাধা দূর হওয়ার পর, রাজশক্তি নিজ হাতে আসার পর অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় মুশরিকদের দ্বারা স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি কাবাগৃহ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অপসারণ করেন। সে সময় কাবাগৃহে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পান, হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইসমাঈল আ.—এর মূর্তি বা ভাস্কর্য। যাদের হাতে ভাগ্যনির্ধারক তীর ধরানো ছিল। মক্কার মুশরিকরা তাদের ইবাদত করত না। এ ভাস্কর্য দুটি ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্মিতও ছিল না। ছিল কেবল এই দুই মহান পয়গম্বরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। যারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বসূরি পয়গম্বর ও পিতৃপুরুষ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূজার মূর্তির পাশাপাশি এ দুটি মূর্তিও অপসারণ করেন এবং বাইরে অপেক্ষমাণ সাহাবীরা এ দুটিও ভেঙে চুরমার করে দেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেন, আল্লাহ মুশরিকদের ধ্বংস করুন। [আবু দাউদ, হাদিস নং ২০২৭]
সাধারণত আলেমসমাজ বা এদেশের আলেম—ওলামা, পীর—মাশায়েখ, ইমাম—খতীব প্রত্যেকে রাষ্ট্র ও সরকারের কল্যাণকামী। তাদের কোনো পার্থিব বা প্রচলিত রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তা নেই। তারা আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব থেকেই জনগণ থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেন। সকলকে শরীয়তের বিধান পালনের আহ্বান জানান। কেউ তা পালন করে, কেউ করে না। আলেমগণ কখনোই এ ব্যাপারে শক্তি প্রয়োগ করেন না। চলমান ভাস্কর্য ইস্যুও এমনই একটি বিষয়।
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙা নিয়ে জনগণের মনে নানা বিষয় অস্পষ্ট হয়ে আছে। এতে যথেষ্ট গোঁজামিল ও সন্দেহ—সংশয় তারা দেখতে পাচ্ছে। আলেমসমাজ বিষয়টির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন। এ মূর্তির সাথে দেশি—বিদেশি চক্রান্তও জড়িয়ে আছে বলে আলেমসমাজ ও সাধারণ মানুষের প্রবল ধারণা। অনেকে এর মাধ্যমে দেশের স্থিতি, সম্প্রীতি ও সরকারের উন্নয়ন বিঘ্নিত করার গভীর ষড়যন্ত্রও দেখতে পাচ্ছেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। আলেম—ওলামা ও ধর্মপ্রাণ জনগণের উপর মূর্তি ভাঙার দোষ চাপিয়ে, মূর্তি ভাঙার গোটা বিষয়টির পূর্বাপর ঢাক ঢাক গুড় গুড় অবস্থা দেখে অনেকে বলছেন, শরীয়তের বিধান বর্ণনাকারীদের উপর মিথ্যা দায় চাপিয়ে ইসলামবিদ্ধেষী চক্রের ভাষায়, মৌলবাদীদের একহাত নেওয়ার চক্রান্ত চলছে। এক শ্রেণির ধর্মবিদ্বেষী লোকের অতি উৎসাহ ও পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর পাঁয়তারা দেখে এমনটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক। শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ধীর চিন্তাশীল সেন্সেটিভ মন্তব্য থেকে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষারোপ না করা, ধর্ম ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, তাদের প্রতি বিষোদগার না করা এবং বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজে হ্যান্ডেলিং করছেন মর্মে ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন যে, ক্ষমতাসীন সরকারকে খুব ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এ থেকে দলীয় সকলের যে বার্তা লাভ করা উচিত ছিল কোনো কোনো নেতা ও দায়িত্বশীলের আচরণ ও কথাবার্তা শুনে এমন মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তারা সরকারের উচ্চ মহলের এই বার্তা হয় অনুধাবন করতে পারেননি অথবা সরকারের এই শান্তি ও স্থিতিপ্রিয় ভূমিকা তাদের পছন্দ হয়নি। তারা চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন, যারা এই ভাস্কর্য ইস্যুকে অবলম্বন করে দেশে একটি সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়। আলেমসমাজ ও তাওহীদিজনতার সাথে সরকারের যে চলমান বোঝাপড়া তা ভেঙে দিয়ে দেশকে দুর্বল ও জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে চায়। উসকানিমূলক কথাবার্তা আলেমসমাজের রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে এক পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এবং সরকার এ বিষয়টিকে লালন ও উৎসাহিত করা সত্ত্বেও কুচক্রী মহলটি নিজেদের মুখে লাগাম দিচ্ছে না। তারা বরং আগে বেড়ে নানা বিষোদগার ও কটূক্তি করে দেশের উন্নয়ন, শান্তি, স্থিতি এবং ধর্মীয়, সামাজিক সম্প্রীতি, সহাবস্থানকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে আলেমসমাজকে যেমন কোরআন—সুন্নাহর বার্তা প্রজ্ঞা—কৌশল, নম্রতা—আন্তরিকতা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে সমাজের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রত্যেকের কানে পৌঁছে দিতে হবে, আল্লাহ ও রাসূলের বাণী পৌঁছে দেওয়ার পর কেউ মানুক বা না মানুক এর দায় আলেমসমাজের উপর থাকবে না, ঠিক তেমনই রাষ্ট্র ও সরকারকে এ বিষয়ে কেউ যেন ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে না পারে, দেশ ও জাতির সর্বনাশ করতে না পারে, সেদিকে সযত্ন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। অপরিণামদর্শী দলীয় লোকজনকে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও উচ্চতা থেকে প্রধানমন্ত্রী নিজে নিবৃত করবেন। আলেমসমাজ ও ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে তার বহু সাধনায় গড়ে ওঠা বোঝাপড়াটিকে রাষ্ট্রের স্বার্থেই ধরে রাখতে হবে। নিজেদের দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে ভাস্কর্য ইস্যুকে সামনে নিয়ে কোনোরূপ অশান্তি যেন সমাজে কেউ সৃষ্টি করতে না পারে এবং দেশবিরোধী কোনো চক্র যেন ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে না পারে, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে উলামায়ে কেরাম সরকারের উচ্চমহলের সাথে বৈঠক ও মতবিনিময় করেছেন। যে বা যারা পরিবেশ, সম্প্রীতি, স্থিতি, উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা এবং অভূতপূর্ব সামাজিক সহাবস্থান ও জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য ভাস্কর্য ইস্যুকে টেনে লম্বা করছে, তাদের সব ষড়যন্ত্র ও নেপথ্যের খেলা সরকারকেই রুখে দিতে হবে। এভাবেই ভাস্কর্য ইস্যুর একটি সমাধান দ্রুত বের করতে হবে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কারও কাম্য হতে পারে না।