মূর্তি ও ভাস্কর্য : যুগে যুগে শিরকের সর্ববৃহৎ প্রণোদনা
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিমা, প্রতিকৃতি—যে নামই বলা হোক তা ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ ও পরিত্যাজ্য। যেসব উলামায়ে কেরাম এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তারা নিজেদের মতের ভিত্তিতে কিছু বলছেন না, কুরআন—সুন্নাহর অমীয় বাণীই তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে, ব্যাস এতটুকুই। তাদের বিরুদ্ধে যারা বিষোদগার, প্রতিবাদ ও আন্দোলন করছে, তারা মূলত কুরআন—সুন্নাহর বিরুদ্ধেই আন্দোলন করছে। যারা এই মূর্তি স্থাপনের পক্ষে আন্দোলনে শরীক হচ্ছে, তারা বুঝে না বুঝে মূলত ইসলামী শরীয়তের বিপক্ষে নিজেদের দাঁড় করাচ্ছে। এখানে ইসলামের মূল বক্তব্য মানুষের সামনে তুলে ধরা ঈমানদার মুসলমানদের দায়িত্ব। সকলকে দাওয়াত দিতে হবে, কেউ মানুক বা না—ই মানুক।
কোনো প্রাণীর মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামী শরীয়তে কঠিন কবীরা গোনাহ ও হারাম। মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা সবই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। মূর্তিপূজার কথা তো বলাই বাহুল্য, মূর্তি নির্মাণেরও কিছু কিছু পর্যায় এমন রয়েছে, যা কুফরী।
কেউ কেউ মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য দেখাতে চান। এটা চরম ভুল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য। কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদের স্পষ্ট নির্দেশ—
فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ
তোমরা পরিহার করো অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার করো মিথ্যাকথন।—সূরা হজ্জ, ২২ : ৩০
এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে সব ধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকাণ্ড বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আরও লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উপরের আয়াতে সকল ধরনের মূর্তিকে ‘রিজ্স’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজ্স’ অর্থ নোংরা ও অপবিত্র বস্তু। বোঝা যাচ্ছে, মূর্তির সংশ্রব পরিহার করা পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচায়ক।
পৃথিবীতে প্রথম মূর্তিপূজা
হযরত আদম আ. থেকে মানবজাতির সূচনা। এরপর শীশ আ. ও ইদরীস আ. নবী হন। প্রায় দুই হাজার বছর পর হযরত নূহ আ. এর যুগ। তখনই প্রথম মানুষ আল্লাহকে অস্বীকার করে আর কিছু মানুষ আল্লাহর সাথে শরীক করে। এদের দ্বারাই প্রথম মূর্তিপূজা সংঘটিত হয়।
মূর্তিপূজা আসলে পূজা হিসাবে শুরু হয়নি। এসব হয়েছিল শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে। স্মৃতি তর্পণ থেকে। নূহ আ.—এর আগেকার জাতি সবাই ছিল তাওহীদে বিশ্বাসী। তারা কেবল আল্লাহরই ইবাদত করত। তখন পর্যন্ত বিস্তারিত শরীয়ত নাযিল হয়নি। মানবজাতির প্রাথমিক সময়, সভ্যতার উষালগ্ন তখন। জীবন, জগৎ ও সভ্যতা বিষয়েই আল্লাহর ওহী আসত। বিস্তারিত জীবনবিধান আসতে শুরু করে হযরত নূহ আ.—এর যুগে।
আদিযুগের মানুষের মধ্যে সৎ, মহৎ ও অধিক খোদাভীরু লোকেদের মৃত্যুর পর তাদের ভক্তরা শোক ও দুঃখ ভোলার জন্য এবং তাদের স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য পাথরে তাদের প্রতিকৃতি আঁকে। পরের প্রজন্ম ছোটবেলায় দেখা সেই প্রতিকৃতি যা রোদ—বৃষ্টি—ঝড়ে মুছে গিয়েছিল সেসব খোদাই করে ভাস্কর্য তৈরি করে। এর পরের প্রজন্ম আরও মমতা মিশিয়ে পাথর কেটে—ছেটে নিপুণ মূর্তি তৈরি করে। তখন এসব তারা উঠান, বাজার ও চত্বরে স্থাপন করেছিল। পরের প্রজন্ম এসবকে উপাসনার স্থানে স্থাপন করে ঘরটিকে দেবালয়ে রূপ দেয়। শুরুতে তারা আল্লাহর ইবাদতের ঘরে পেছনের দেয়ালে মূর্তিগুলো ঠেস দিয়ে রাখে। মূলত তারা আল্লাহরই ইবাদত করত। বলত, এসব মূর্তি আমাদের প্রভু নয়। আমরা এদের ইবাদতও করি না। আল্লাহর এসব প্রিয় বান্দা আর মহৎ ব্যক্তিকে স্মরণ ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভেরই চেষ্টা করি মাত্র। মুশরিক পৌত্তলিক সমাজ যে নির্দোষ ও সুন্দরভাবে শিরকের ব্যাখ্যা দিত সেটি আল্লাহ তাআলা কুরআনে তুলে ধরেছেন এভাবে,
وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهٖۤ اَوْلِیَآءَ ۘ مَا نَعْبُدُهُمْ اِلَّا لِیُقَرِّبُوْنَاۤ اِلَی اللهِ زُلْفٰی
যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য অভিভাবক গ্রহণ করেছে তারা বলে, এসব মূর্তিকে তো আমরা (খোদা মনে করি না; বরং এদের) ইবাদত করি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসাবে।—সূরা যুমার, ৩৯ : ০৩
দুয়েক প্রজন্ম পর শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের পেছনে রাখাটা আর তাদের ভালো লাগেনি। ইবাদতখানার সামনের দেয়ালে এসব মূর্তি স্থাপিত হয়। নূহ আ. এই ক্রমান্বয়ে প্রচলিত শিরকের প্রথম সংশোধনকারী। ৯৫০ বছর তিনি এসব মানুষকে হেদায়াতের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু খুব সামান্য লোকই তার ডাকে সাড়া দেয়। বাকিরা তাদের বাপদাদার সংস্কৃতি ও মনগড়া শিরকী চেতনা ছাড়তে সম্মত হয়নি। মহান আল্লাহ বিষয়টি এভাবে বলেছেন,
وَ قَالُوْا لَا تَذَرُنَّ اٰلِهَتَكُمْ وَ لَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّ لَا سُوَاعًا ۬ۙ وَّ لَا یَغُوْثَ وَ یَعُوْقَ وَ نَسْرًا
তাদের নেতারা বলল, তোমরা (নূহ আ.—এর কথায়) তোমাদের দেবতাদের ত্যাগ করো না। তোমরা ছেড়ে দিয়ো না, ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসরকে।—সূরা নূহ, ৭১ : ২৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, কুরআনে বর্ণিত ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসর হচ্ছে নূহ আ.—এর কওমের কিছু মহৎ লোকের নাম। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান জনগণকে বোঝাল, তোমরা এসব ব্যক্তির বৈঠকখানার পাশে একটি ভাস্কর্য তৈরি করো। প্রতিটি ভাস্কর্যকে তোমরা সেই মহৎ ব্যক্তির নামে নামকরণ করবে। অতএব তারা শয়তানের প্ররোচনায় ভাস্কর্য তৈরি করল বটে, কিন্তু কোনোদিনই সেগুলোর উপাসনা করেনি। অবশ্য কিছুদিন পর নতুন প্রজন্মের লোকজন ভক্তি ও স্মৃতির সীমালঙ্ঘন করে এসব মূর্তির উপাসনা শুরু করে।—সহীহ বুখারী : ৪৬৩৬
প্রথম যিনি মূর্তি ভাঙলেন
হযরত নূহ আ. সাড়ে নয়শ বছর তার জাতিকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। কুফর ও শিরক থেকে তাদের বিরত করার চেষ্টা করেন। হযরত নূহ আ. আল্লাহর দরবারে তার উম্মতের বিষয়টি তুলে ধরেন এভাবে,
قَالَ رَبِّ اِنِّیْ دَعَوْتُ قَوْمِیْ لَیْلًا وَّ نَهَارًا ۙ﴿۵﴾ فَلَمْ یَزِدْهُمْ دُعَآءِیْۤ اِلَّا فِرَارًا ﴿۶﴾
নূহ বলল, হে আমার রব, আমি আমার জাতিকে দিবস—রজনীতে দাওয়াত দিয়েছি। (তারা আমার কথা শোনেনি; বরং) যতই দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছি, তাদের অবাধ্যতার মাত্রা বেড়ে গিয়েছে।—সূরা নূহ, ৭১ : ০৪—০৫
এভাবে সাড়ে নয়শ বছর দাওয়াত দিয়েও যখন তিনি স্বজাতিকে কুফর, শিরক ও খোদাদ্রোহিতা থেকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হন তখন তিনি তাদের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেন। পবিত্র কুরআন সে বক্তব্যটি উল্লেখ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ قَالَ نُوحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَی الْاَرْضِ مِنَ الْکٰفِرِیْنَ دَیَّارًا ﴿۲۶﴾ اِنَّکَ اِنْ تَذَرْهُمْ یُضِلُّوْا عِبَادَکَ وَ لَا یَلِدُوْۤا اِلَّا فَاجِرًا کَفَّارًا ﴿۲۷﴾
নূহ বলল, হে আমার রব, আপনি কাফেরদের কাউকে জমিনে ছেড়ে দেবেন না। (তাদের নিমূর্ল করে দিন।) নতুবা এরা (এতই খারাপ হয়ে গেছে যে, নিজেরা তো হেদায়াত পাবেই না; বরং) আপনার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং এদের থেকে জন্ম নেওয়া পরবর্তী প্রজন্মও পাপাচারী কাফেরই হবে।—সূরা নূহ, ৭১ : ২৬—২৭
হযরত নূহ আ.—এর পর শয়তানের প্ররোচনায় তার পরবর্তী লোকেদের মধ্যে ওই একই কায়দায় মূর্তিপূজা শুরু হয়। প্রথমে মহৎ ব্যক্তি ও নেককার বান্দাদের চিত্র, পরে ভাস্কর্য ও মূর্তি। শুরুতে শ্রদ্ধা ও স্মৃতি, পরের প্রজন্মে উপাসনা। আগে মাঠে ময়দানে, পরে দেবালয়ে। এই হচ্ছে মূর্তিপূজার বসন্তকাল। একসময় মধ্যপ্রাচ্যে নমরুদ শাসক হিসাবে আসে। আগেকার দেব—দেবীর পাশাপাশি সে নিজেকেও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ইশ্বর বলে দাবি করে।
তখনকার বিশ্বে হযরত নূহ আ. পূর্ব তাওহীদ এবং হযরত নূহ আ.—এর ঈমানী চেতনা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মূর্তি, প্রতিমা ও ভাস্কর্যবিরোধী মিশন নিয়ে দুনিয়ায় আগমন করেন হযরত ইবরাহীম আ.। তিনি কেবল কল্পনার দেব—দেবী উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি খোদায়ী দাবিদার এবং মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, ভাগ্যবিধাতা মানবরূপী নেতা শাসক ও কথিত ইশ^রদেরও উচ্ছেদ করেন। সর্বপ্রথম তিনিই মূর্তি ভেঙে দেন। হযরত ইবরাহীম আ.—এর পিতাও ছিলেন মুশরিক। তিনি তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়কে শিরক বর্জনের দাওয়াত দেন। একপর্যায়ে তিনি তাদের শিরকের উৎস মূর্তি ভেঙে ফেলার মনস্থ করেন। এ বিষয়টি কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে এভাবে,
وَتَاللهِ لَاَکِیْدَنَّ اَصْنَامَكُمْ بَعْدَ اَنْ تُوَلُّوْا مُدْبِرِیْنَ ﴿۵۷﴾ فَجَعَلَهُمْ جُذٰذًا اِلَّا کَبِیْرًا لَّهُمْ لَعَلَّهُمْ اِلَیْهِ یَرْجِعُوْنَ ﴿۵۸﴾
(ইবরাহীম আ. মনে মনে বললেন) আল্লাহর কসম, অবশ্যই আমি তোমাদের মূর্তিগুলোকে শায়েস্তা করব তোমরা ফিরে যাওয়ার পর। অতঃপর তিনি বড় মূর্তিটি বাদে সবগুলোকে চূর্ণ—বিচূর্ণ করে ফেললেন, যাতে তারা তার কাছে রুজু করতে পারে।—সূরা আম্বিয়া, ২১ : ৫৭, ৫৮
ইবরাহীমি চেতনা
গোমরাহ ও পৌত্তলিক পৃথিবীতে এক আল্লাহর পরিচয় স্পষ্ট করা, তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ এবং তার প্রতি বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের নজিরবিহীন পরীক্ষায় শতভাগ সাফল্য নিয়ে উত্তীর্ণ হন মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আ.। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত এবং সকল প্রকার শিরকের প্রতি ঘৃণা, দ্রোহ ও সংগ্রাম ছিল ইবরাহীমি চেতনা। এই চেতনার উপর মুসলিম মিল্লাত বা বিশ্ব মুসলিম জাতি প্রতিষ্ঠিত।
হযরত ইবরাহীম আ.—এর দুই সন্তানই নবী হন। হযরত ইসমাঈল আ. ও হযরত ইসহাক আ.। হযরত ইসমাঈল আ.—কে পবিত্র মক্কায় মহান রাব্বুল আলামীন স্থিত করেন। তিনি স্ত্রী ও শিশু ইসমাঈলকে মক্কার নির্জন মরুভূমিতে রেখে আসেন আল্লাহর নির্দেশে। ফিরে আসার সময় তিনি তাদের আড়াল হয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন,
رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا الْبَلَدَ اٰمِنًا وَّاجْنُبْنِیْ وَبَنِیَّ اَنْ نَّعْبُدَ الْاَصْنَامَ ﴿ؕ۳۵﴾ رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ کَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ
হে রব, এই শহরকে আপনি নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার উত্তরসূরিদের মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করুন। ইয়া রব, এরা (মূর্তি ও ভাস্কর্য) অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে।—সূরা ইবরাহীম, ১৪ : ৩৬
উল্লেখ্য এ দুআয় হযরত ইবরাহীম আ. মূর্তি ও ভাস্কর্যকে পথভ্রষ্টকারী সাব্যস্ত করেছেন, যা কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে। কুরআন মাজীদে একটি বস্তুকে ভ্রষ্টতার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হবে, এরপরও ইসলামী শরীয়তে তা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য থাকবে—এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে।
এরপর হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইসমাঈল আ.—কে নিয়ে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করেন। যা নূহ আ.—এর বন্যার সময় ধসে পড়ে পলিতে ঢেকে গিয়েছিল। কাবাঘর নির্মাণ শেষে তিনি আল্লাহর হুকুমে দুআ করেন। বলেন,
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ؕ اِنَّکَ اَنْتَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ
হে রব, আপনি আমাদের পক্ষ থেকে এই খেদমত কবুল করুন।—সূরা বাকারা, ০২ : ১২৭
দুআয় তিনি আরও বলেন,
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِکَ وَیُعَلِّمُهُمُ الْکِتٰبَ وَالْحِكْمَۃَ وَیُزَکِّیْهِمْ ؕ اِنَّکَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَکِیْمُ ﴿۱۲۹﴾
হে রব, আপনি এই নগরীতে আমার উত্তরসূরিদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করুন। যিনি তাদের সামনে আপনার মহাগ্রন্থ তেলাওয়াত করবেন। তাদের শিক্ষা দেবেন আপনার কিতাব ও ঐশী প্রজ্ঞা। এবং তিনি তাদের আত্মশুদ্ধি করবেন।—সূরা বাকারা, ০২ : ১২৯
এ দুআরই ফসল ইবরাহীম পুত্র ইসমাঈল আ.—এর বংশধারায় জন্ম নেওয়া বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পাশাপাশি ইসলামের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কাজে বারবার হযরত ইবরাহীম আ.—এর নাম উচ্চরিত হওয়ার কারণও এটিই। তিনি ছিলেন, মূর্তিপূজাবিরোধী তাওহীদের একনিষ্ঠ বিশ্ব নেতা। তার স্বপ্নের রাসূল হলেন আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
যিনি দীর্ঘ সংগ্রামের পর আরবের মানুষের মন থেকে মূর্তির প্রতি ভক্তি, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মারাত্মক ক্যান্সার ধীরে ধীরে দূর করে তাদের মনে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও মহব্বত স্থাপন করেন। কাবাঘৃহ ও মক্কানগরীর বিশেষ বিশেষ জায়গা থেকে মূর্তি উচ্ছেদ করেন। তিনি নিজ হাতে মক্কা বিজয়ের পর পবিত্র কাবাগৃহ ও তার আশপাশ থেকে মুশরিকদের স্থাপিত ৩৬০ মূর্তি ভেঙে বাইরে ফেলে দেন এবং আল্লাহর তরফ থেকে ঘোষণা দিয়ে বলেন, সত্য সমাগত মিথ্যা দূরীভূত। নিঃসন্দেহে মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী।
মক্কায় মূর্তি এল কখন
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী। তাঁর ৫০০ বছর আগে ইমিডিয়েট নবী ছিলেন হযরত ঈসা আ.। হযরত ঈসা থেকে মধ্যবর্তী ৫০০ বছর তাওহীদের দাওয়াত দুর্বল হয়ে যায়। ঈসা আ.—এর ঊর্ধ্বগমনের পরপরই তাঁর বিশিষ্ট হাওয়ারীগণ মারা গেলে ইহুদিরা ধর্মটিকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। ১০০ বছর পর জন পল নামক এক ইহুদী নিজের মনোমতো নতুন খ্রিষ্টধর্ম তৈরি করে। বার্নাবাসের বাইবেল লুকিয়ে ফেলে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে বাইবেল রচনা করে। যাতে মূল ইঞ্জিল বা আসমানী কিতাবের কিছু অংশই থেকে থাকবে মাত্র। বাকি সব মানুষের রচনা। এ সময় আরবরা বিশেষ করে হেজাজের লোকজন ছিল দ্বীনে হানীফের উপর। অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম আ. এর তাওহীদি ধর্মের উপর। কিছু লোক অবশ্য প্রকৃত খ্রিষ্টধর্মের সন্ধানও পেয়েছিল।
এরই মধ্যে মিশর, সিরিয়া ও প্রাচীন ইরাকি পৌত্তলিক মুশরিক সম্প্রদায়ের দেখাদেখি মূর্তিপূজা করতে এক—দুজন আরব উৎসাহী হয়। তখন সর্বপ্রথম জাযিরাতুল আরবে মূর্তি প্রবেশ করায় ইহুদী আমর ইবনে লুহাই। এর আগে আরব উপদ্বীপের লোকেরা মূর্তি কি জিনিস, তা জানত না। এরা তাওহীদি সমাজে বা দ্বীনে হানীফে বিশ্বাসী মক্কাবাসীর সামনে শিরকের প্রস্তাব দিতে সাহস পায়নি। তখন আসে এই ভাস্কর্য পদ্ধতি।
নবীবিহীন ৫০০ বছরের অবসরে কোনো এক ফাঁকে তায়েফের লোকেরা একজন আল্লাহওয়ালা মহৎ ব্যক্তির মৃত্যুর পর স্মৃতি, শ্রদ্ধা ও ভক্তির জন্য ভাস্কর্যের নামে তার মূর্তি তৈরি করে। লোকটির নাম ছিল লাত। কালক্রমে একদল লোক এটিকে পবিত্র মক্কায় নিয়ে আসে। মক্কাবাসী আরেক মহৎ ব্যক্তির মূর্তি নির্মাণ করে, তার নাম মানাত। আরেক বংশের লোক নিজেদের বিশিষ্ট ব্যক্তি উজ্জার ভাস্কর্য নির্মাণ করে। আরেক গোত্র নির্মাণ করে হোবল। এই হলো লাত, মানাত, হোবল ও উজ্জার গল্প।
আমর ইবনে লুহাই এর আনা মডেল মূর্তিটির ধারণা থেকেই এসবের নির্মাণ। এসব ছিল শিল্প—সৌকর্যহীন বড় বড় পাথরের অসুন্দর মূর্তি। এরপর ধীরে ধীরে নানা প্রজন্ম শৈল্পিক সৌকর্যমণ্ডিত সুদর্শন মূর্তি এনে আরবে স্থাপন করে। আরবে আনুষ্ঠানিক মূর্তিপূজার বিকাশ করেছে তারাই। এরপর নতুন প্রজন্ম শ্রদ্ধার বদলে লাত, মানাত, হোবল, উজ্জার ইবাদত শুরু করে। সময়ে সময়ে আল্লাহর ঘরেও ঢুকতে থাকে মূর্তি। একে একে ৩৬০টি ছোট—বড় মূর্তিতে ভরে যায় কাবাঘর ও আশপাশের এলাকা। পূজা শুরু হয় কৌশলে। দ্বীনে হানীফের নামে শুরু হয় পৌত্তলিকতা মিশ্রিত নতুন ধর্ম। ইবরাহীমি ঐতিহ্য টিকে থাকে হজ্জের নামে।
আরবের মুশরিকরা নারী—পুরুষ মিলিত আকারে উলঙ্গ হয়ে পবিত্র কাবা তাওয়াফ করত। স্বয়ং আবু জাহেল এ ধরনের হজ্জ করেছিল ২৫ বার।
মূর্তি ভাস্কর্য ও শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
হাদীস শরীফে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে পরিষ্কার বিধান প্রদান করেছেন। যেমন :
১. হযরত আমর ইবনে আবাসা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনোকিছুকে শরীক না করার বিধান দিয়ে।—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৮৩২
২. আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব রাযি. আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি—সৌধ ভূমিসাৎ করে দেবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে,… এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে।—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৯৬৯
৩. আলী ইবনে আবী তালেব রাযি. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি—সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দেবে?
আলী রাযি. এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনোকিছু তৈরি করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।—মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং : ৬৫৭
এই হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, যে—কোনো প্রাণী মূর্তিই ইসলামে পরিত্যাজ্য এবং তা বিলুপ্ত করাই হলো ইসলামের বিধান। আর এগুলো নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُوْنَ.
প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণি হলো ওইসব লোকদের অন্তভুর্ক্ত, যাদেরকে কিয়ামত—দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৫৯৫০
৫. আবু হুরায়রা রাযি. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ أَصْحَابَ هَذِهِ الصُّوَرِ يُعَذَّبُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَيُقَالُ لَهُمْ : أَحْيُوْا مَا خَلَقْتُمْ.
এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) কিয়ামত—দিবসে আযাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা ‘সৃষ্টি’ করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার করো।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৭৫৫৭, ৭৫৫৮
এই হাদীসটি বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যখন ভাস্কর—চিত্রকর, এমনকি গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদেরকে পর্যন্ত স্রষ্টা’ বলতে এবং তাদের কর্মকান্ডকে ‘সৃষ্টি’ বলতে সামান্যতমও দ্বিধাবোধ করা হয় না। কোনো কোনো আলোচকের আলোচনা থেকে এতটা ঔদ্ধত্যও প্রকাশিত হয় যে, যেন তারা সত্যি সত্যিই স্রষ্টার আসনে আসীন হয়ে গিয়েছেন!
সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. লেখেন, এই ভাস্কর ও চিত্রকর সর্বাবস্থাতেই হারাম কাজের মধ্যে লিপ্ত। আর যে এমন কিছু নির্মাণ করে যার পূজা করা হয় তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আর যে স্রষ্টার সামঞ্জস্য গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে সে কাফের।—ফতহুল বারী : ১০/৩৯৭
৬. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ خَلْقًا كَخَلْقِيْ؟ فَلْيَخْلُقُوْا ذَرَّةً وَلْيَخْلُقُوْا حَبَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوْا شَعِيْرَةً.
ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শস্য কিংবা একটি যব!—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৫৯৫৩
৭. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. বলেন, আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করে কিয়ামত—দিবসে তাকে আদেশ করা হবে, সে যেন তাতে প্রাণসঞ্চার করে অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৫৯৬৩
৮. আউন ইবনে আবু জুহাইফা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারী, উল্কি অঙ্কণকারী ও উল্কি গ্রহণকারী এবং প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) উপর লানত করেছেন।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৫৯৬২
এই হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন কবীরা গোনাহ। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুফরীরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
৯. হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় থাকা অবস্থায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ ও তার রাসূল মদ ও মূর্তি এবং শূকর ও মৃত প্রাণী বিক্রি করা হারাম করেছেন।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ২২৩৬
১০. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা ইতঃপূর্বে হাবাশায় গিয়েছিলেন। তারা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন, ওই জাতির কোনো পুণ্যবান লোক যখন মারা যেত তখন তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ১৩৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৫২৮; নাসায়ী, হাদীস নং : ৭০৪
১১. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. বলেন, (ফতহে মক্কার সময়) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বায়তুল্লায় বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখলেন তখন তা মুছে ফেলার আদেশ দিলেন। প্রতিকৃতিগুলো মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত তিনি তাতে প্রবেশ করেননি।—সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৩৩৫২
দৃষ্টান্তস্বরূপ এগারটি হাদীস পেশ করা হলো। আলোচিত প্রসঙ্গে ইসলামী বিধান বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কুরআন মাজীদে যে—কোনো ধরনের মূর্তির সংশ্রব ও সংশ্লিষ্টতা পরিহারের যে আদেশ মুমিনদেরকে করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটা বিস্তারিত ধারণাও উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে জানা গেল।
কুরআন ও সুন্নাহর এই সুস্পষ্ট বিধানের কারণে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল বিষয়ের অবৈধতার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দেখুন : উমদাতুল কারী : ১০/৩০৯; ফাতহুল বারী : ১০/৪০১; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম : ১/১৫৯
[এ শিরোনামে হাদীসের উদ্ধৃতিগুলো মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ সাহেবের সৌজন্যে।]
মানুষের বিশ্বাস ও চেতনাকে আল্লাহ ছাড়া সকল সৃষ্টি থেকে ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের দিকে নিয়ে আসাই নবী—রাসূলের কাজ। এ কাজ উম্মত হিসাবে কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মদীর দায়িত্ব। অতএব, যে কারও ভাস্কর্য ও মূর্তির কৌশলী অনুপ্রবেশকে নিরুৎসাহিত করা, মানুষকে সচেতন করা, শক্তি থাকলে উৎখাত করা ঈমানদার মাত্ররই ধর্মীয় দায়িত্ব। ভিন্ন ধর্মের লোকেদের উপাসনালয়ে মূর্তি থাকতে পারে। তবে, মুসলিম সমাজে যত্রতত্র কেউ ভাস্কর্য ও মূর্তি সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে চাইলে তা প্রতিরোধ করা মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।
কেননা, আমাদের নবী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন এবং নিজ জীবনে কার্যত দেখিয়েও গিয়েছেন যে, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপ শিরক তথা মূর্তিপূজা থেকে মানবতাকে উদ্ধারের জন্যই জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। যা মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أرسلني بصلة الأرحام وكسر الأوثان
আল্লাহ আমাকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ও মূর্তি উচ্ছেদের জন্যই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন।—সহীহ মুসলিম : ৮৩২
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র জীবন দাওয়াত, তালীম ও তাযকিয়ার কাজ করে গেছেন। আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা, কুরআন—সুন্নাহর শিক্ষা প্রচার ও মানুষের আত্মশুদ্ধি ছিল তার কর্মপন্থা। সবশেষে প্রায় ৮০টি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। ২৭ টি যুদ্ধে নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। সাহাবীরা হতাহত হন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আহত হন। ওফাতের দুই বছর আগে তিনি মক্কা বিজয় করেন। নিজ হাতে সব মূর্তি ভেঙে দেন। আর বলেন, এই নগরীতে আর কখনো মূর্তি আসবে না। এই পবিত্র গৃহে আর কোনোদিন ভাস্কর্য বসবে না। এই হুকুম প্রতিটি মুসলিম সমাজের জন্য। যেখানে আল্লাহ তাওহীদ, একত্ববাদ, ঈমান, ইসলাম দিয়েছেন সেখানে কোনোভাবেই যেন মূর্তি, ভাস্কর্য ও প্রতিমার অনুপ্রবেশ না ঘটে। এটাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা।