মেয়ে জন্মের আনন্দ : হাসপাতালে লেখা এক বাবার ডায়েরি
[লেখাটি একজন বাবার ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। একজন স্বামীর হৃদয়ের লালিত পবিত্র অনুভূতি। যাতে তার মেয়ের জন্মের সময়ে হাসপাতালে থাকা কয়েক দিনের অনুভূতি উঠে এসেছে। এখানে তিনি তার স্ত্রী, কন্যা, বাবা, মা ও প্রিয় কিছু মানুষের প্রতি হৃদয়ের আবেগ—অনুভূতি তুলে ধরেছেন, একান্ত নিজের মতো করে। বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত হলেও এতে এ সমাজের একটি অতি সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে, যা যুগ যুগ ধরে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমাজের উচ্ছন্নে যাওয়া হাতেগোনা কিছু মানুষের চিন্তা—ভাবনা ও আচার—আচরণকে পুরো সমাজের চিত্র বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েরা অবহেলিত, মেয়ে জন্ম নিলে মানুষ খুশি হয় না, মেয়েদের মূল্যায়ন করা হয় না, স্ত্রীদের প্রতি স্বামীরা কেবলই রূঢ় আচরণ করে, স্ত্রী সবসময় দিয়ে যান আর স্বামীরা শুধুই ভোগ করে যায়—নারীবাদীরা এসব প্রচার করে করে এক শ্রেণির নারীদের পরিবারব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ একজন নেককার স্বামী ও বাবা যে কতটা দরদি ও স্নেহশীল হন, তা কেবল হৃদয় দিয়েই উপলব্ধি করা যায়। কারণ, স্বামী ও বাবাদের ভালোবাসা ও স্নেহের গল্পগুলো সবসময় আড়ালে থাকে। মা ও স্ত্রীদের চোখের পানি দেখা গেলেও বাবা ও স্বামীরা সর্বদাই চোখের পানি আড়ালে রাখেন। কষ্টগুলো গোপন করেন। নিজেদের শ্রম ও পরিশ্রম, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের কথা ভুলে যান। লেখাটি পড়ে হয়তো আমাদের ঘরে ঘরে যে প্রেমময় স্বামী ও স্নেহশীল বাবারা জনম জনম ধরে ছায়া দিয়ে আমাদের রেখেছেন তাদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার দৃষ্টি পড়বে, এ আশায় পাঠকের জন্য চিঠিটি প্রকাশ করা হলো।—নির্বাহী সম্পাদক]
তুমি শুয়ে আছ এক বেডে, আমি শুয়ে আছি এক বেডে, আমাদের মাঝে মাত্র তিন হাত দূরত্ব। তোমার হাতে স্যালাইন পুশ করা। যেকোনো মুহূর্তে তোমাকে ডেকে নেওয়া হবে। এ সময় সালাহউদ্দীন জানাল, ওর মা আসতে পারবেন না। আমার চোখে অন্ধকার নেমে এলো। তুমি আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে।
ডাক্তার এসে গেছে। নার্সরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। তোমার মুখ মলিন। আমার দিকে তাকিয়ে তুমি অপারেশন রুমের দিকে যাত্রা করলে। তুমি কি জানো, সে সময় আমার মনের অনুভূতি কী হয়েছিল? পৃথিবীর কেউ জানে?
প্রায় ছয় বছর আগে একদিন আমার বাবা মাদরাসায় এসেছিলেন আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে। কারণ… কারণ আমার মা ছয়দিন যাবত শয্যাশায়ী। যেকোনো সময় আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন। এ ছয়দিন তিনি বারবার আমাকে দেখতে চেয়েছেন। সবাই যখন বুঝতে পেরেছে, তার সময় বেশি বাকি নেই, তখন আমাকে নিয়ে যেতে বাবাকে পাঠিয়েছে। আব্বা আমার কাছে এসেছেন, তাঁর মাথার টুপিটা ছেঁড়া। আমি রুমে ছিলাম না। ছাত্ররা দৌড়ে এসে আমাকে জানাল, আমার বাবা এসেছেন। আমি আব্বার কাছে ছুটে গেলাম। আব্বাকে দেখে আমার ভেতরে কোথাও মোচড় দিয়ে উঠেছে। আব্বা শান্ত কণ্ঠে বললেন, তোর মা অসুস্থ, তোকে দেখতে চাচ্ছে, তুই আমার সঙ্গে বাসায় চল। আব্বার কথায় আমার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। সব অভিমান ভুলে আব্বার সঙ্গে রওয়ানা করি। সারা পথ আমি কাঁদতে চাইনি। কিন্তু কেন যেন গাড়িতে সেদিন চোখের পানিতে আমার জামা ভিজে গিয়েছিল। সেদিনের সেই মনের অবস্থা আমি কোনোদিন কাউকে বুঝাতে পারব না।
তোমাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসি। আমার পেছনে তোমার ভাই। আমি ইবরাহীমকে পেছন দিয়ে দাঁড়াই, পাছে সে আমার চোখের পানি দেখে ফেলে। একটু পর… এইতো মিনিট পনের, একটি শিশুর চিৎকার শুনতে পাই। ঠিক তখন সেদিনের সেই মনের অনুভূতি আমার ভেতরে আবার ফিরে আসে। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি, কারণ, কখনো কখনো চোখের পানি কোনো বাধাই মানে না। আমার শুধু ভাবনা হচ্ছিল, তুমি ভালো আছো তো?
আরও মিনিট পাঁচেক পর, সাদা এপ্রোন পরিহিতা কয়েক জন একটি ছোট্ট ফুটন্ত গোলাপ নিয়ে আমাদের কেবিনে প্রবেশ করেন। আমি দুহাত বাড়িয়ে দেই। তারা আমার হাতে তুলে দেন একটি জান্নাতী শিশু। আমি আমার ‘মা’কে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি।
বাইরে প্রচণ্ড শীত। আমাদের কেবিনের জানালাগুলো নামেই জানালা। কয়েক জায়গায় কাঁচই বসানো হয়নি। পর্দা দিয়ে ফাঁকা অংশ ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। খোলা অংশ দিয়ে বাতাস ঢুকছে। পর্দার কারণে সরাসরি আঘাত করতে পারছে না ঠিক, তবে পুরো কামরাকে ফ্রিজের নরমাল টেম্পারেচারের মতো করে রেখেছে। বাতাসের হালকা ঝাঁপটা এসে শরীরে সুচের মতো বিঁধছে। এই ঠাণ্ডা বাতাসকে আড়াল করে আমি আমার আম্মুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দুআ করি,
تَقَبَّلَكِ رَبُّكِ بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَكِ نَبَاتًا حَسَنًا
বাবার বুকের উষ্ণতায় মা আমার নিশ্চিন্ত বোধ করে। তখন আমার মুখে ছিল দুআ, কোলে ছিল আমাদের জুমানা আর ভেতরে ছিল, বিশ্বাস করো, তোমার ভাবনা।
এক একটা মুহূর্ত, আমার কাছে মনে হচ্ছিল এক একটা যুগ। তোমাকে আনা হচ্ছে না। আমার ভয় ভয় করছে, তুমি ভালো আছো তো? শিশুর কানে আযান দিতে হবে, আযান দেওয়া সুন্নত। তুমি আমাকে জোর দিয়ে এ বিষয়টি স্মরণ রাখতে বলেছিলে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার কিছুই মনে ছিল না। পেছন থেকে ইবরাহীম বলল, ‘ভাই, আযান দিতে হবে।’ আমি সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাকে আযান দিতে বলি। সে আমাকে দিতে বলে। আমার চোখে পানি, কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। কোনোভাবে তাকে বলি, তুমি দাও। আল্লাহর রহমত, ইবরাহীম বুঝতে পেরেছে। আমাদের মায়ের কানে তার মামা আযান—ইকামত দিয়েছে।
আরও আধা ঘণ্টা পর তারা তোমাকে নিয়ে এসেছে। তুমি আমার দিকে, আমাদের জুমানার দিকে তাকিয়ে ছিলে। আমি অন্য দিকে ফিরে ছিলাম। কারণ, চোখের পানি আমি কাউকে দেখাতে চাইনি। আমার কোলে ছিল জুমানা, কিন্তু আমার মন—প্রাণ পড়ে ছিল তোমার কাছে। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ যদি জুমানাকে একটু কোলে নিত, আমি তোমাকে দেখতে পারতাম। তোমার কপালে একটু হাত বুলাতে পারতাম।
জুমানা খেতে চাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদছে। ওকে কোলে নিয়ে হাঁটলে ঘুমায়, বিছানায় শুইয়ে দিলে জেগে যায়, কান্না শুরু করে দেয়। কী পবিত্র মুখ আমাদের মায়ের, দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আমার মন ভালো হচ্ছে না। বারবার শুধু তোমার কথা মনে হচ্ছে। তোমাকে দেখতে, তোমার কপালে হাত ছেঁায়াতে ইচ্ছে করছে। জুমানাকে রেখে তোমার কাছে যেতে পারছি না। আমার অস্থির লাগছে। এ সময় তুমি বললে, ‘ভাইয়াকে আসতে বলি?’ আমি তোমার করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে ‘না’ বলতে পারিনি।
একজন মানুষ একজন মানুষের জন্য এবং একজন ভাই একজন ভাইয়ের জন্য যতটুকু করতে পারে সালাহউদ্দীন আমার জন্য তারচেয়ে বেশি করেছে। এ সময় কোনো একজন অভিভাবক নারীর বড় প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে, কেউই থাকতে পারেননি। এই কঠিন মুহূর্তে আমার বিশ্বাস ছিল, আল্লাহর সাহায্য বেশি হবে এবং বাস্তবে এমনই হয়েছে। অনেকে বলেছে, স্মরণকালে সেই রাতের মতো শীত কেউ দেখেনি। শীতের প্রচণ্ডতায় আমি—তুমি কেঁপেছি, কেঁপে কেঁপে উঠেছি। চারদিকে বাচ্চাদের নিউমোনিয়াসহ কত ব্যাধি; কিন্তু আমাদের জুমানা, আলহামদুলিল্লাহ, পূর্ণ সুস্থ আছে, অথচ সেই রাতে তাকে আবৃত করার মতো পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রও ছিল না।
সালাহউদ্দীনের বাবা কাঁথা—কাপড় নিয়ে এসেছেন। রাত দেড়টায় ‘৮০ টাকা বাস ভাড়ার পথ’ পাড়ি দিয়ে সালাহউদ্দীনের স্ত্রী এবং শাশুড়ি এসেছেন। তুমি বলো, আমার জীবনে এমন আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ কে কবে করেছে? আমি হলে এ সাহস দেখাতে পারতাম? তুমি এভাবে কোথাও যেতে? আমাদের পরিচিত কেউ এমন আখলাক দেখাতে পারবে?
তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। শুধু এতটুকু বলি, আমার সঙ্গে, আমার পরিবারের সঙ্গে এবং আমাদের জুমানার সঙ্গে সালাহউদ্দীন ও তার পরিবার গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যখন যেখানে আমাদের জুমানার জন্মকথা আলোচিত হবে, সেখানে নিঃসন্দেহে সালাহউদ্দীন ও তার পরিবারের কথা আলোচিত হবে। আল্লাহ তাআলা তাকে ও তার পরিবারকে ভরপুর প্রতিদান দান করুন। আমীন।
রাত দেড়টায় তারা এসেছেন। জুমানাকে তাদের কাছে দিয়ে আমি এশার নামায পড়তে বেরিয়েছি। নামাযের পর ইবরাহীমকে বললাম একটু ঘুমিয়ে নিতে। ইবরাহীম শোয়নি। আমি শুয়েছিলাম। যখন চোখটা লেগে এসেছে এমন সময় তোমার ফোন পেয়ে জেগে উঠেছি। আবার জুমানাকে কোলে নিয়েছি। এভাবে আমার সারারাত কেটেছে। আর তুমি? একটু পানির জন্য একটু পাশ ফিরার জন্য তোমার সে কী আকুতি! আহ কী কষ্ট! শেষরাতে পাশ ফিরতে পেরে মনে হলো, তোমার ভেতর প্রাণ ফিরে এসেছে। একটু পানির জন্য এভাবে ছটফট করতে আমি কাউকে দেখিনি। সেদিন সকালে আমার হাতে তুমি কয়েক ফেঁাটা পানি পান করেছিলে। পরে বলেছ, জীবনে এত সুস্বাদু পানি তুমি কখনো পান করোনি। তুমি কি জানো, তোমার এই অভিব্যক্তিতে কী ফুটে উঠেছে? সত্যই, পৃথিবীতে কোনো সন্তানের পক্ষে কখনোই মায়ের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়।
হাসপাতালে আমরা তিন দিনের মতো ছিলাম। এ তিনদিন আনন্দ—বেদনার কত কিছুই না ঘটেছে! তুমি অনেক কিছু ভুলতে পারবে না, আমিও পারবো না অনেক কিছু ভুলতে। কিন্তু দুটি ঘটনা আমাদের দুজনকে বেশ নাড়া দিয়েছে।
আমার আব্বা অসুস্থতা ও চোখের পীড়া সত্ত্বেও নাতনিকে হাসপাতালে দেখতে এসেছেন। তোমার জন্য রান্না করে এনেছেন ভাত ও কবুতর ভুনা। তুমি বলেছ, এত মজার কবুতর রান্না তুমি কখনো খাওনি। তোমার কোল থেকে জুমানাকে নিয়ে যখন আব্বার কোলে দিয়েছি তখন আব্বাকে তুমি খেয়াল করেছিলে? আব্বা কী বলেছিলেন তুমি শুনেছিলে? আমার মনে হয়েছে, অনেকদিন আব্বার এমন আনন্দমাখা মুখ আমি দেখিনি। মনে হয়েছে, বৃদ্ধ বয়সে আব্বা একজন খেলার সাথী পেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আব্বাকে আফিয়াত দান করুন। রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি সগীরা। আমীন।
এবার দ্বিতীয় ঘটনাটি বলি। মাসখানিক আগে আমার সিমকার্ডটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে সিমে যাদের নম্বর ছিল সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। পরিচিত কাউকে—যে সুসংবাদ দিব, সে উপায় ছিল না। আমার কয়েকজন আসাতেযায়ে কেরামের নম্বরও সেখানে ছিল। জুমানার জন্মের তৃতীয় দিন আমার মোবাইলে একটি কল আসে। আমি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি। আমার প্রিয় একজন উস্তায কল করেছেন। প্রথমে হুযুর স্বভাবমতো স্নেহসুলভ কিছু কথা বলেছেন। সবশেষে বলেছেন, ‘গতকাল তোমার কাছে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নম্বর না থাকায় আসতে পারিনি। আজ ইনশাআল্লাহ আসব।’
আমি আমার আসাতেযায়ে কেরামের মুখে তাঁদের আসাতেযায়ে কেরামের অনেক মধুর গল্প শুনেছি। কিন্তু সেদিন আমার মনে হয়েছে, আমার মতো এমন ঘটনা আর কারও জীবনে ঘটেনি। হুযুর সেদিন সন্ধ্যার পর হাসপাতালে এসেছেন। আমাকে কাছে নিয়ে বসেছেন। জুমানাকে কোলে নিয়ে ‘তাহনীক’ করেছেন। সেদিন সন্ধ্যায় হুযুর আমাকে যে নসীহতগুলো করেছেন, আমার মনে হয়েছে, এত সুন্দর নসীহত এ জীবনে আমাকে কেউ করেনি। এ সময় আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সান্ত্বনা ও সাহস। হুযুরের কাছ থেকে দুটোই আমি পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। হুযুর নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি যখন বিয়ে করি তখন আমার বেতন ছয় হাজার টাকা। মসজিদ তখনও কনফার্ম হয়নি। তখনও আল্লাহ তাআলা আমাকে সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করিয়েছেন। এখন আব্বা—আম্মাসহ আমার পরিবারের সদস্য আটজন। প্রতি মাসে এখন কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় আল্লাহ তাআলা জানেন। এখনও আল্লাহ তাআলা সবকিছু ব্যবস্থা করছেন এবং সম্মানের সঙ্গে চালাচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ।’
এরপর হুযুর যায়েদ মাযাহেরী সাহেবের সূত্রে বলেছেন, ‘হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ বান্ধাভী রহ. বলতেন, বর্তমান সময়ে আল্লাহর ওলী হলেন ঐ ব্যক্তি, হুকুকুল্লাহ ও হুকুকুল ইবাদ সাধ্যমতো আদায় করার পর যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে :
এক. তার ঘরে অভাব—অনটন থাকবে। সংসার চলতে কিছুটা টানাটানি থাকবে।
দুই. কোনো না কোনো পেরেশানি থাকবে।
তিন. কিছু মানুষ তার সমালোচনা করবে।
এরপর হুযুর আমার সামনে এক অভাবনীয় প্রস্তাব পেশ করেন। বললেন, ‘তুমি চাইলে আমার বাসায় থাকতে পারো। আমার বাসায় রুম চারটি। তিনটি আমরা ব্যবহার করি। একটি মেহমানদের জন্য খালি আছে। তুমি থাকলে ইনশাআল্লাহ, কোনো সমস্যা হবে না।’
এ সময় এমন প্রস্তাব আমার জন্য কত বড় নেয়ামত ছিল তা জানেন শুধু আমার আল্লাহ। কিন্তু হুযুর আসার আগেই আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। হুযুরের সামনে আমি অবস্থা তুলে ধরি। তখন হুযুর বলেছেন, ‘ঠিক আছে, অন্য কোনো সময় ঢাকা আসলে প্রয়োজন হলে আমাকে জানিয়ো।’
আমার জীবনের অল্পকিছু সুখকর মুহূর্তের একটি সেদিনের সেই সন্ধ্যা। একদিন আমার জীবন—প্রদীপ নিভু নিভু হবে, আমার মনে হয়, তখনও এই সন্ধ্যার কথা আমি ভুলব না। যিনি আমাকে এমন সুন্দর একটি সন্ধ্যা উপহার দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর জীবনে এমন সন্ধ্যার সমাবেশ ঘটান। আমীন।
তা’লীম ও তরবিয়তের অঙ্গনে আমি আমার দুজন উস্তাদের মতো হতে চেয়েছি। এখন বললে হয়ত অবাস্তব শোনাবে, কিন্তু কথাটা বাস্তব, আমার প্রিয় সেই দুজন উস্তাদের একজন তিনি। অথচ হুযুরের কাছে আমি মাত্র একটি কিতাব পড়েছি। তা—ও মি’য়ারি কোনো কিতাব নয়। যার আখলাক এত সুন্দর তিনি একটি কিতাব পড়িয়েও হতে পারেন প্রিয় উস্তাদ, হতে পারেন স্বপ্নের ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাআলা হুযুরকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন। আমাকেও হুযুরের মতো আখলাকী উস্তাদ বানিয়ে দিন। আমীন।
আমার একজন মুহসিন উস্তাদ ও মুরুব্বি আছেন। আমার জীবনের হাসি—কান্নার গল্পগুলো হুযুর জানেন সবার আগে। জুমানা যখন আমার কোলে স্থির হয়েছে তখনই হুযুরকে জানিয়েছি। হুযুর বলেছেন, পারলে আসবেন। আমার বিশ্বাস ছিল, হুযুর আসবেন এবং তাহনীকের আমলটি হুযুরের মাধ্যমে করাব। কিন্তু আল্লাহ তাআলার ফায়সালা ছিল ভিন্ন। অসুস্থতার কারণে হুযুর হাসপাতালে আসতে পারেননি। আল্লাহ তাআলা হুযুরকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন।
আমার ভাই বলেছিলেন, টাকার প্রয়োজন হলে তাকে জানানোর জন্য। আল্লাহ তাআলার রহমতে সেই প্রয়োজন হয়নি। সাত দিনের দিন আকীকা করতে হলে ঋণ নিতে হবে। ভাবলাম, ভাইয়াকে জানাই। তখন তিনি বললেন, ‘এখন হাতে টাকা নেই। কিছুদিন পরে করলে দিতে পারবেন।’ সত্যিই তখন তার হাতে টাকা ছিল না। ইমার্জেন্সি হলে হয়ত কারও থেকে নিয়ে দিতেন।
এসময় আল্লাহ তাআলার রহমত নেমে এলো অন্য এক পথে। আমার মুহসিন উস্তাদ ছয়দিনের দিন সন্ধ্যায় ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘আমি এখন কোথায়? আমার হাতে টাকা আছে কি না?’
আমি বললাম, ‘হাতে ১৪ শ টাকা ছিল। এখন বাজারে এসেছি। টাকা হাজারের নিচে নেমে আসবে।’
হুযুর বললেন, ‘তোমার ঋণ আছে কত?
বললাম, ‘২০ হাজারের মতো।’ হুযুর বললেন, ‘দেখি কিছু পাঠানো যায় কি না।’
এর কিছুক্ষণ পর আমার বিকাশ একাউন্টে ১০ হাজার টাকা যুক্ত হয়। আল্লাহ তাআলা হুযুরকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন।
সঙ্গিনী! তুমি বলেছিলে, ‘বাচ্চা হওয়ার পর আপনি আমাকে কী দেবেন?’
আমি বলেছিলাম, ‘আমার সাধ্যের মধ্যে তুমি যা চাইবে তা—ই দেব। তুমি কী চাও?’
তুমি বলেছিলে, ‘আমি কিছু চাই না। আপনিই আমার সব পাওয়া।’
তুমি কি জানো, এ লেখাটি আমি কেন লিখেছি? শুধুই তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য। এ লেখায় আমি কিছু কথা বলতে চেয়েছি, সেই কথাগুলোই তোমাকে দেওয়া আমার এবারের উপহার। আমি দুআ করি, আমাদের জুমানা হোক তোমার মতো কোমল হৃদয় এবং উত্তম আখলাকের অধিকারিণী। পৃথিবীতে ভালো মেয়ে হতে পারে, অনেক ভালো মেয়েও হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তুমি অদ্বিতীয়া। তুমি জানো, আমি মিথ্যা বলতে পারি না। আমার এ কথাটুকু বিশ্বাস করো, আমি মন থেকেই বলছি, তুমি অদ্বিতীয়া; তোমার কোনো দ্বিতীয়া নেই। আল্লাহ তাআলা আমরণ আমাদের একসঙ্গে রাখুন। ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। আমাদের দান করুন সুখময় জীবন—ইহকালেও, পরকালেও। আমীন।
—আবু জুমানা