যিলহজ মাস ও কোরবানী
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.
وَ الْفَجْرِ ۙ﴿۱﴾ وَ لَیَالٍ عَشْرٍ ﴿۲﴾ وَّ الشَّفْعِ وَ الْوَتْرِ ۙ ﴿۳﴾
তরজমা ও তাফসীর : কসম ফজরের ওয়াক্তের। এবং যিলহজের দশ রাতের। অর্থাৎ এ দশ রাত অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ। এবং জোড় ও বেজোড়ের। জোড় দ্বারা উদ্দেশ্য দশ তারিখ আর বেজোড় দ্বারা নয় তারিখ। (হাদীস শরীফে এমনই বর্ণিত হয়েছে)—বয়ানুল কোরআন : ৯২/১২
ফায়েদা : দুররে মানসুরে একাধিক সনদে বর্ণিত আছে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এ আয়াতে وَ لَیَالٍ عَشْرٍ দ্বারা যিলহজের দশ দিন উদ্দেশ্য। বিত্র বা বেজোড় দ্বারা আরাফার দিন (অর্থাৎ যিলহজের নয় তারিখ) উদ্দেশ্য। আর জোড় দ্বারা উদ্দেশ্য দশ তারিখ।—খুতুবাতুল আহকাম : ১৪৬
এক. হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যিলহজের দশ দিন ব্যতীত এমন আর কোনো দিন নেই যাতে ইবাদত করা আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক পছন্দনীয়। এর একদিনের রোযা এক বছর রোযা রাখার সমান। এর এক রাত্রি জাগরণ শবে কদরের সমান।—তিরমিযী; ইবনে মাজাহ
দুই. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে যিলহজের দশ দিনের চাইতে উত্তম কোনো দিন নেই এবং অন্য কোনো দিনে আমল করা, এই দশ দিনে আমল করার চাইতে উত্তম নয়। সুতরাং এই দিনগুলিতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার পড়ো। কারণ তা তাহলীল, তাকবীর ও আল্লাহর যিকির করার দিন।—দুররে মানসূর, বাইহাকীর সূত্রে; খুতুবাতুল আহকাম ১৪৬ খুতবা নম্বর ৫০
ফায়েদা : এই দশ দিনের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমরা সংক্ষেপের জন্য এই কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছি। এগুলো থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে, যিলহজের এক তারিখ থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত সব রকমের ইবাদত করার চেষ্টা করা উচিত। এবং যতদূর সম্ভব এই দিনগুলোতে রোযা রাখা এবং রাত জেগে ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে নয় তারিখের দিন রোযার ফযীলত বেশি।—আহকামে হজ সুন্নতে ইবরাহীমসহ : ৪৯১
দুই ঈদের রাতের ফযীলত
ফায়েদা : এ ব্যাপারে ইখতেলাফ আছে, যিলহজের দশ দিন বেশি উত্তম নাকি রমযানের শেষ দশ দিন? শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. বলেন, গ্রহণযোগ্য মত হলো, যিলহজের দশ দিনের দিন উত্তম আর রমযানের শেষ দশকের রাত উত্তম। আল্লাহই ভালো জানেন।
একটি হাদীস আছে, যাতে যিলহজের দশ তারিখ রাত্রিজাগরণের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের (অর্থাৎ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) রাতে সওয়াবের আশায় জাগ্রত থাকে, তার অন্তর সেদিন সজীব থাকবে, যেদিন সবার অন্তর মরে যাবে। (তারগীব, ইবনে মাজাহর সূত্রে)—আহকামে হজ সুন্নতে ইবরাহীমসহ : ৪৯১
তাকবীর ও তাশরীক
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে যিলহজের দশ দিনের চাইতে উত্তম কোনো দিন নেই এবং অন্য কোনো দিনে আমল করা, এই দশ দিনে আমল করার চাইতে উত্তম নয়। সুতরাং এই দিনগুলিতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার পড়ো। কারণ তা তাহলীল, তাকবীর ও আল্লাহর যিকির করার দিন।—দুররে মানসূর বাইহাকী সূত্রে
ফায়েদা : এমনিতে তো যিলহজের প্রথম দশ দিনের প্রতিদিনই বেশি বেশি তাকবীর ও তাহলীল পাঠ করা উত্তম। এই হাদীসে যেমন বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু নয় তারিখ ফজর থেকে তেরো তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি নামাযের পর উচ্চৈঃস্বরে একবার তাকবীর পাঠ করা ওয়াজিব। আসারুস সুনানে মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বার সূত্রে হযরত আলী রাযি. থেকে এ আমল বর্ণিত হয়েছে।
সুনানে বায়হাকীতে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিন (নয় যিলহজ) ফজর থেকে আইয়ামে তাশরীকের (অর্থাৎ তেরো যিলহজ) আসর পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।
মাসআলা : যিলহজের নয় তারিখ ফজর থেকে তেরো তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি নামাযের পর (যারা শহরে জামাতের সাথে নামায আদায় করবে মুকিম অবস্থায়, তাদের জন্য) একবার উচ্চৈঃস্বরে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। মুসাফির, নারী ও একাকী নামায আদায়কারী ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব নয়। কিন্তু অনেক ওলামায়ে কেরাম তাদের জন্যও ওয়াজিব বলেন। তাই তাদেরও পড়ে নেওয়া ভালো। সেই তাকবীর হলো :
اَللهُ اَكْبَرُ اَللهُ اَكْبَرُ لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ اَللهُ اَكْبَرُ وَلِلهِ الْحَمْدُ.
আরাফার দিন অথার্ৎ নয় যিলহজের রোযা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আরাফার রোযা, হাজার রোযার সমান।
এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আরাফার রোযা রাখল তার ধারাবাহিক দুই বছরের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (তারগীব, আবু ইয়ালার সূত্রে)
অর্থাৎ এক বছর অতীতের আর সামনের এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। হাদীসে যেমন বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি আল্লাহ তাআলার কাছে আশা রাখি যে আরাফার (অর্থাৎ যিলহজের নয় তারিখ) রোযা অতীতের এক বছর এবং আগত এক বছরের জন্য (গোনাহের) কাফ্ফারা হয়ে যায়।
মাসআলা : যিলহজের নয় তারিখে রোযা রাখার অনেক সওয়াব। এর মাধ্যমে অতীতের এক বছর এবং আগত এক বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। আর মাসের শুরু থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত সব দিন রোযা রাখলে তো আরও ভালো।
ফায়েদা : যিলহজের দশ তারিখ থেকে তেরো তারিখ পর্যন্ত চারদিন রোযা রাখা হারাম। তাই রোযার ফযীলত শুধু নয় তারিখ পর্যন্ত।
হাজীদের জন্য আরাফার রোযা
প্রশ্ন : আরাফার দিনের (নয় যিলহজের) রোযা হাজীদের জন্য জায়েয নাকি নাজায়েয? হাদীস থেকে তো প্রমাণিত হয়, আরাফার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রাখেননি। তিরমিযীতে যেমন বর্ণিত হয়েছে। আবার ওলামায়ে কেরামের অনেকে জায়েয বলেন। এখানে সঠিক কোনটি?
উত্তর : আরাফার দিনের রোযা হাজীদের জন্য দুর্বলতার কারণ হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে মুস্তাহাব হবে। মাকরুহ হবে না। আর দুর্বলতার আশঙ্কা থাকলে মাকরুহ হবে।
যিলহজ মাসে আইয়ামে বীযের রোযা
প্রশ্ন : এক ব্যক্তি প্রতি মাসের তেরো চৌদ্দ এবং পনেরো তারিখ আইয়ামে বীযের রোযা রাখে (যেভাবে রাখা সুন্নত)। কিন্তু কোরবানী ঈদের তেরো তারিখ যেহেতু রোযা হারাম, তাই সে চৌদ্দ পনেরো ও ষোলো তারিখ রোযা রাখবে? নাকি রাখবে না? এতে তো আইয়ামে বীয বা মাসের মধ্যবর্তী দিন আর বাকি থাকে না।
উত্তর : এ মাসে আইয়ামে বীযের রোযা হয় না। পরিবর্তন করে ষোলো তারিখ রাখা হোক আর পরেই রাখা হোক।
কিছু লোকের জন্য কোরবানী করা জায়েয নয়
কিছু লোক এমন হয় যাদের কিছুই থাকে না, অথবা তার কাছে যা আছে তার চাইতে বেশি তার ওপর মানুষের হক পাওনা থাকে, যা আদায় করা তার জন্য বড় ফরয। (অর্থাৎ এই ঋণ তার আগে পরিশোধ করা জরুরি।)। কিন্তু সে লোক এ সবকিছু পেছনে রেখে, কেবল গর্ব করার উদ্দেশ্যে বা আগে থেকে চলে আসছে (অথার্ৎ সব সময় তার ঘরে কোরবানী হয়) এ জন্য কোরবানী করে। আর তার কাছে টাকা—পয়সা না থাকলে ঋণ করে দেয়।
কাউকে দেখা যায়, মৃতদের নামে একাধিক অংশ নিধার্রণ করে আর জীবিতদের হক আদায় করে না। অথচ ১০০ টাকা ঋণ আদায় করা নিঃসন্দেহে সে পরিমাণ দিয়ে কোরবানীতে অংশ নেওয়া থেকে অনেক উত্তম।
হ্যাঁ, যদি কারও হক নষ্ট না হয় এবং গর্ব করার (ও লোক দেখানোর) জন্য না হয়, তবে নফল কোরবানী করা মুস্তাহাব এবং মহব্বতের দলিল, এতে কোনো সন্দেহ নাই। অনুরূপ সাধারণ মৃতদের পক্ষ থেকে বা নিজেদের বুযুর্গানে দীনের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পক্ষ থেকে কোরবানী করা সবচাইতে পছন্দনীয় মুস্তাহাব (অথার্ৎ মুস্তাহাব কাজসমূহের মাঝে সবচেয়ে উত্তম ও পছন্দনীয় কাজ)। আর এটা তাদের হকেরও দাবি। কিন্তু উপকার তখনই কাম্য যখন তাতে কোনো ক্ষতি না হয়। (নফল কোরবানী করা উপকারী, আর হক আদায় না করা ক্ষতি) ।—ইসলাহে ইনকিলাব ১ : ১৬৭
যুক্তির আলোকে কোরবানী
আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাসী কোনো জাতি কখনো এ কথা বলে না, তিনি জুলুম করেন। বরং খোদাকে রহমান ও রহীম পরম দয়াবান বিশ্বাস করে। এখন যদি আমরা আল্লাহ তাআলার কাজের প্রতি লক্ষ করি, আকাশে বাজ, শিকরা, শকুন, শ্যেন ইত্যাদি শিকারি পাখি ওড়ে। এগুলো অন্যান্য পাখিরই মাংস খায়। ঘাস এবং অনেক ভালো ভালো ফল বা অন্যান্য খাবার খায় না।
অনুরূপ দেখুন, পানিতে কত রক্তপিপাসু প্রাণী আছে। কুমির ও বড় মাছগুলো, পানিতে থাকা অন্যান্য ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে খেয়ে ফেলে। বরং কিছু মাছ উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুতে শিকার করতে যায়। মাকড়সা মশা মাছি শিকার করে। চিতাবাঘ বানর মেরে খায়। জঙ্গলে বাঘ, নেকড়ে চিতা ইত্যাদি প্রাণীর খাবারের কথা তো সবাই জানে। বিড়াল কীভাবে ইঁদুর শিকার করে মেরে ফেলে। দেখো, উড়ন্ত পোকা আগুনে পড়ে গেলে তার কী হয়।
এখন বলো, জগতের এ দৃশ্য (আল্লাহ তাআলার এ কুদরতি নেযাম) দেখার পর কি কেউ বলতে পারে, জবাইয়ের সাধারণভাবে প্রচলিত এ নিয়ম জুলুম? কখনো না। তাহলে মানুষের পশু জবাইকে জুলুম বলার মানে কী? মানুষের শরীরে যে উকুন বা জীবাণু সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে কি নির্দ্বিধায় ধ্বংস ও মেরে ফেলা হয়। এটাকে কি তাহলে জুলুম বলা যায়? যখন এটাকে জুলুম বলা যায় না যে বড় বা উত্তম কিছুর জন্য ছোট কিছুকে মেরে ফেলা, ধ্বংস করে দেওয়া বৈধ, তাহলে পশু জবাইয়ের ওপর কীভাবে আপত্তি করা যেতে পারে?
বরং ভেবে দেখুন এবং মৃত্যুর ফেরেশতার কথা চিন্তা করুন, কীভাবে নবী রাসূল, বাদশাহ, বাচ্চা, ধনী, গরিব, আমীর, ব্যবসায়ী সবার জান কবজ করছেন এবং পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছেন। যদি আমরা পশুগুলোকে ঈদুল আযহায় এ কথা বলে জবাই নাও করি, জবাই করা নিষ্ঠুরতা বলে, তাহলে কি আল্লাহ এগুলোকে চিরদিন জীবিত রেখে দেবেন? তাদের ব্যাপারে আল্লাহ হুকুম করবেন, এরা যেন না মরে?
এই ভূমিকার পর বলতে চাই, পশু জবাই করা নিষ্ঠুরতা হলে আল্লাহ তাআলা শিকারি ও মাংসাশি কোনো প্রাণী সৃষ্টি করতেন না।
অনুরূপ এগুলোকে জবাই না করা হলে অসুস্থ হয়ে মারা যাবে। ভেবে দেখুন, এভাবে মরতে সেগুলোর কতটা কষ্ট হবে।
আল্লাহর নিয়মে আমরা দেখি, সব জিনিসই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর কোনো সীমা নেই। মনে করেন, যদি বটগাছের প্রতিটি বীজ সংরক্ষণ করে রাখা হয়, তাহলে পৃথিবী বটগাছে ভরে যাবে। অন্য কিছুর জায়গাই থাকবে না। কিন্তু দেখুন, প্রতিটি প্রাণী এর ফল খাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, এই সীমাহীন বৃদ্ধিকে আটকে রাখাও আল্লাহ তাআলারই ইচ্ছা। যদি সব গরু লালনপালন করতে থাকা হয়, তাহলে একসময় পুরো পৃথিবীও এর চারণভূমি হিসেবে যথেষ্ট হবে না। অবশেষে সেগুলোকে ক্ষুধা—তৃষ্ণায় মরতে হবে। আল্লাহ তাআলার ব্যবস্থাপনাই যেহেতু এমন, তাই পশু জবাই করা তার অপছন্দের কাজ কীভাবে হতে পারে।—আল মাসালিহুল আকলিয়া লিল আহকামিন নাকলিয়া : ১৬৭
কোরবানী অযৌক্তিক হওয়ার দাবি এবং এর জবাব
যদি কেউ বলে, কোরবানী একটি অযৌক্তিক কাজ। কারণ, কোরবানীর মাধ্যমে আল্লাহ খরচ করান তো ঠিকই কিন্তু তা তো আর নেন না। তাহলে আসলে কী চান? কেন এই খরচ করতে বলেন? এর উদ্দেশ্য কী? যদি তোমরা বলো, গোশত খাওয়ানো উদ্দেশ্য, তাহলে মিনা আর মক্কা মুকাররামায় হাজার হাজার পশু জবাই করা হয়, যার গোশত কেউ খায় না। সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। এটা যুক্তিবিরোধী কাজ।
এর জবাব হলো—অশ্লীল মনে হলেও বোঝানোর জন্য বলা—কোনো কিছু আপনার বুঝে না আসা অযৌক্তিক হওয়ার দলিল হলে আপনি যেভাবে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাও অযৌক্তিক হবে। এটা এভাবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, একটা বাচ্চা নির্বাচন করা হবে। তাকে একটি কক্ষে লালনপালন করা হবে। তাকে কখনো জানানো হবে না, মানুষের জন্ম কীভাবে হয়। এভাবে তার বিশ বছর হয়ে গেলে হঠাৎ একদিন তাকে বলা হবে, মানুষ এভাবে জন্মগ্রহণ করে। কোনোভাবেই এটা তার কাছে যৌক্তিক মনে হবে না। আমরা যেহেতু দিন—রাত শুনে এবং দেখে আসছি, তাই এভাবে জন্মগ্রহণকে আমাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হয় না। তো জনাব, আমরা যখন থেকে জন্ম নিয়েছি, তখন থেকে সবকিছুই অযৌক্তিক। আমাদের শুধু খাওয়া—দাওয়া আর অর্থ উপার্জন তো এমন, যখন কেউ কোনো ক্ষুধার্তকে জিজ্ঞেস করে, দুইয়ে দুইয়ে কত? সে বলে চারটি রুটি। এমনই আমাদের আকলও শুধু এটুকুই, খাও দাও আর গল্প করো। তো বুদ্ধির এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে কীভাবে শরীয়তের গূঢ় রহস্য বুঝে আসবে!
ঠিক এমনই কোরবানীর হেকমত আমাদের বুঝে না এলে তা অস্বীকারযোগ্য হয় কীভাবে? এ জন্য আমাদের দায়িত্ব নয় এর হেকমত বর্ণনা করা। তবুও বাড়তি হিসেবে বলে দিই।—তারগীবুল উযহিয়া : ১২৮
কোরবানী কি অযৌক্তিক?
যারা কোরবানীকে অযৌক্তিক বলে, তারা শুনে রাখুক, পুরা পৃথিবীজুড়ে কোরবানীর রীতি প্রচলিত। সব জাতির ইতিহাস থেকেও এ কথা স্পষ্ট প্রমাণিত, বড় কিছুর জন্য ছোট কিছু কোরবানী করা হয়। আর এটা একেবারে ক্ষুদ্র জিনিস থেকে শুরু করে বিরাট জিনিস পর্যন্ত সবকিছুর ক্ষেত্রেই হয়।
আমরা ছোটবেলায় এ কথা শুনেছিলাম, সাপে কাটলে সে আঙুল কেটে ফেলে দিতে হয়। যেন বাকি পুরো শরীরে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে। অর্থাৎ একটি আঙুলকে পুরো শরীরের জন্য কোরবানী করা হলো।
অনুরূপ আমরা দেখি, আমাদের কোনো বন্ধু এলে তার খুশির জন্য আমাদের কাছে যা আছে তা কুরবান করতে হয়। ঘি, আটা, গোশত ইত্যাদি মূল্যবান জিনিস সেই প্রিয় মানুষের সামনে কিছুই না।
আরও প্রিয় কেউ হলে মুরগি এমনকি ভেড়া—বকরিও কোরবান করা হয়। এর চাইতেও বেশি উট গরু পর্যন্ত মেহমানের জন্য কোরবানী করা হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা দেখি, যারা প্রাণী হত্যা মহাপাপ বলে তারাও তাদের জখমের হাজার হাজার লাখ লাখ জীবাণু মেরে ফেলে এবং সেগুলোকে নিজের জন্য কোরবান করে।
আরেকটু সামনে গেলে আমরা দেখতে পাই, কম মর্যাদার লোকদেরকে দামি মানুষের জন্য কোরবান করা হয়। যেমন, মেথর। অন্যদের জন্য ঈদের দিনই হোক; তাদেরকে সে কাজই করতে হয়। বরং এমন দিনগুলোতে অন্য মানুষের আরামের জন্য তাদেরকে আরও জোর দেওয়া হয়, রাস্তায় কোনো ময়লা যেন না থাকে। এভাবে নীচুশ্রেণির লোককে তার আনন্দ কোরবান করতে হয় উঁচুশ্রেণির লোকের আনন্দের জন্য। কিছু গো—রক্ষক খুব জোর দিয়ে বলে, লাদাখে তো গরুর দুধও মানুষ পান করে না। কারণ তা বাছুরের হক। কিন্তু এখানকার হিন্দুরা গরুকে ধেঁাকা দিয়ে দুধ দোহন করে নেয়। এর ওপর গরু ও গরুর বাচ্চা দিয়ে কঠিন কাজ করিয়ে নেয়। এমনকি নিজেদের কাজের জন্য এগুলোকে মেরে বাধ্য করে। এটাও এক ধরনের কোরবানী।
সাধারণ সেপাই তার অফিসারের জন্য, অফিসার তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের জন্য আর সে ঊর্ধ্বতন অফিসার বাদশাহর জন্য কোরবান হয়। তো আল্লাহ তাআলাও প্রাকৃতিক নিয়মই বহাল রেখেছেন এবং এ কোরবানীতে শিখিয়েছেন, বড় কিছুর জন্য ছোট জিনিস কোরবান করতে হয়।—আল মাসালিহুল আকলিয়া লিল আহকামিন নাকলিয়া : ১৬৪
কোরবানী আল্লাহর হুকুম, আল্লাহর চাইতে বেশি দয়া দেখাতে যেয়ো না
এটাও মনে রাখা উচিত, প্রতিটি বিষয়ে পরিমিতি কাম্য। কোনো কিছু যতক্ষণ পরিমিতির সীমা না ছাড়ায় , সেটা ঠিকঠাক থাকে। যেখানেই এ সীমা ছাড়িয়ে যায়, সেখানেই তা নষ্ট এবং ক্ষতিকর হয়ে যায়। তাই দয়াও যদি পরিমিতির সীমা অতিক্রম না করে, তো ঠিক আছে। কোনো ক্ষতি নেই। দেখুন, যদি সব জায়গায় দয়া দেখানো হয়, হিন্দুরা যেমন দাবি করে, তখন তা আর পরিমিত থাকে না। ইফরাত (জুলুম) হয়ে যায়। কিছু লোক সাপ—বিচ্ছুও মারে না। এর ফলাফল এই দাঁড়াবে, সৃষ্টির সেরা মানুষের ওপর জুলুম করা হবে আর অন্যান্য যা কিছু সৃষ্টির নিম্নশ্রেণির অথার্ৎ সাপ—বিচ্ছু ইত্যাদির ওপর দয়া করা হবে। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং এর পক্ষে কোনো দলীল নেই।
কোরবানীকে জুলুম ও নিষ্ঠুরতা বলার অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ রহীম ও দয়ালু নন আর মানুষ এমন দয়ালু যারা কোরবানীকে দয়া—মায়ার সম্পূর্ণ বিপরীত মনে করে। তো যেন মানুষের দয়া আল্লাহ তাআলার চাইতে বেশি। নাউযু বিল্লাহ।
মোটকথা, যখন আল্লাহ তাআলাই সব প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। সেগুলোর হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেগুলোর প্রতি রহম করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার এরপরও সেগুলোর কোরবানীর হুকুম দিয়েছেন, তো বোঝা গেল কোরবানী রহম ও দয়ার পরিপন্থী নয়। কোরবানী নিষ্ঠুরতা হলে আল্লাহ তাআলা, যিনি সবচাইতে বড় দয়াবান, তিনি কীভাবে এর হুকুম করতেন। কিন্তু যখন আল্লাহ তাআলাই কোরবানীর হুকুম দিয়েছেন, এখন একে নিষ্ঠুরতা বলা তো যেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলাকেই বে—রহম বলা।
তা ছাড়া সর্বশেষ কথা হলো, আমাদের কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুম মানা। ওজর আপত্তি করার কী অর্থ? আমি যে কোরবানীর ওপর আপত্তিকারীদের জবাব দিলাম, এটা শুধু মানুষের ওপর ইহসান করে। কারণ, অনেক মুসলমান যারা জানে না, তারা এতে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এটা তাদের ঈমানীশক্তি দুর্বল হওয়ার প্রমাণ। নাহয় যদি জাহেল মুসলমানও পাক্কা মুসলমান হয়, তো কেয়ামত পর্যন্ত কোনো দার্শনিকের বাবাও তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। কারণ, তার তো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর প্রতি মহব্বত থাকবে। তার কাছে তো সকল প্রশ্নের একই জবাব হবে, ‘আরে আহাম্মক, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো শুধু নিজেদের পশুকে কোরবানী দিতে বলেছেন। আল্লাহর কসম, যদি নিজেদের স্ত্রী—সন্তানকেও জবাই করতে বলতেন, আমরা তাও করতাম।’ —সুন্নতে ইবরাহীম : ৬১
কোরবানীর পশু জবাইয়ে কষ্ট পায় না
কোনো পশুকে জবাই করলে এতটা কষ্ট হয় না যতটা ভাবা হয়। অথার্ৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর চাইতে বেশি নয়। বরং কম হয়। এটা তো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিকভাবেই বোঝা যায় যে, এতে কষ্ট এতটা কম হয় যা না হওয়ার মতো। কারণ, প্রেমিকের জন্য প্রেমাস্পদের সামনে মাথা পেতে দেওয়ার চাইতে এবং তার নামে কোরবান হওয়ার চাইতে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে। আর আল্লাহ তাআলাকে তো সবকিছুই মহব্বত করে। কেন করবে না! যখন খোদার কাছে যা প্রিয়, তা সবার কাছে প্রিয় হয়। এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ রেখে এ কথাও বলা যায়, ঈদের সকালে কোরবানীর পশু যেন বলতে থাকে :
سر بوقت صبح کے اپنا اس کے زیر پایہ ہے
کیا نصیب اللہ اکبر لوٹنے کی جائے ہے
সকালবেলা আমার মাথা তার পদতলে
কী সৌভাগ্য! আল্লাহু আকবার নিবেদনের কী উত্তম স্থান।
যখন পশু এ কথা জানতে পারে, তাকে আল্লাহর নাম জবাই করা হবে, সে খুশিতে পাগল হয়ে যায়। এ কারণেই তাকে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হয়। যেন সে পশু আত্মহারা হয়ে যায় এবং কোনো কষ্ট টের না পায়। তো এর একটি নজিরও আছে, শহীদরা আল্লাহর নামে প্রাণ বিলিয়ে দিতে আনন্দ পায়। তাদের কোনো কষ্ট হয় না। হ্যাঁ, পশু কথা না বলতে পারায় সে আনন্দ প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু শহীদদের আনন্দ তো স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের সামনে ঢালের মতো বুক পেতে দাঁড়িয়ে যাওয়া, নির্দ্বিধায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, এসব তো সবাই দেখতে পায়। এটা তো শাহাদাতের ভূমিকা মাত্র, যাতে মুজাহিদদের আনন্দ প্রকাশ পেতে থাকে।
বাকি খোদ শাহাদাতের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, শহীদের মৃত্যুর সময় পিঁপড়া কামড় দেওয়ার মতো কষ্ট হয়। তো এভাবেই এই পশুগুলোও কোরবানীতে কষ্ট পায় না। বরং যেহেতু সেগুলো আল্লাহর নামে কোরবান হতে চায়, তারা বরং এ কোরবানীতে শান্তি অনুভব করে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোরবানীকে নিষ্ঠুরতা মনে করে কোরবানী করা ছেড়ে দেয়, সে মূর্খ।—সুন্নাতে ইবরাহীম : ৫৮
দয়া দুই প্রকার
দয়াও দুই প্রকার :
এক হলো অযৌক্তিক দয়া। যেমন, কোনো বাচ্চা মকতব বা স্কুলে যেতে চাচ্ছে না। মকতবে তার একা লাগে, সে কাঁদে। তো মা তার পক্ষ নিচ্ছে এবং বলছে, ঠিক আছে, যেতে চাচ্ছে না যখন না যাক। স্কুলে গেলে বাচ্চা কষ্ট পাবে।
আরেক প্রকার দয়া হয় যৌক্তিক। যেমন, বাবার মায়া। বাবা বাচ্চার এ জিদ দেখে দুইটা থাপ্পড় মেরে তাকে হাত ধরে স্কুলে দিয়ে আসে। দেখতে তো এটাকে নিষ্ঠুরতা মনে হয়। কিন্তু মূলত মায়ের বাচ্চার কথা শোনা, যেন সে কষ্ট না পায়, এটাই তার জন্য জুলুম। কারণ, এর ফলাফল বাচ্চার আজীবন মূর্খতা। যা লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আর বাবার মারটাই আসলে তার প্রতি দয়া। কারণ, এর ফলাফর তার জন্য ভালো। মায়ের এই দয়া হলো, সেই বুড়ির ঘটনার মতো। যার ঘরে একটি শাহি বাজপাখি চলে আসে। সে মহিলা দেখল, পাখিটির ঠোঁট অনেক লম্বা। বুড়ি বলল, হায় হায়! এটা খাবার খুঁটে খুঁটে কীভাবে খাবে। মনে হয় তোর মা মরে গেছে। তাই কেউ আর তোর ঠোঁট কেটে দেয়নি। এ জন্যই তোর ঠোঁট এত লম্বা হয়ে গেছে। বুড়ি কাঁচি নিয়ে পাখিটির ঠোঁট কেটে দিল। এরপর দেখল নখগুলোও অনেক বড় বড়। কিছু নখও কেটে দেওয়া উচিত। অথার্ৎ তাকে একেবারে অকেজো করে দিল। সেটি আর কোনো কাজেরই রইল না। ভ্রান্ত লোকেরা এই মহিলার মতোই দয়ালু, তারা পশু জবাই না করাকে দয়া ভেবে বসেছে।—আয—যহায়া সুন্নতে ইবরাহিমসহ : ১৪৯
—আহকামে কোরবানী আকল ওয়া নকল কী রৌশনী মেঁ থেকে অনুবাদ,
মাওলানা মুরতাজা মাহদী