শাইখুল হাদীস ড. আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহ.
মাওলানা হেদায়েতুল হক
১৭ যিলকদ ১৪৪২ হি. মোতাবেক ৩০ জুন ২০২১ ঈসায়ী বুধবার দুপুরে আপন প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন হযরত মাওলানা ড. আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহ.। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। দায়িত্ব পালন শেষে আপন নীড়ে ফিরে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।
কবি বলেছেন,
ہزاروں سال نر گس اپنی بے نوری پہ روتی ہے / بڑی مشکل سے چمن میں پیدا ہوتا ہے دیدہ ور
নার্গিস ফুলের গাছ হাজার বছর ধরে নিজের বন্ধ্যাত্বের জন্য কাঁদে। / তারপর গিয়ে বড় কষ্টে বাগান আলোকিত করে একদিন ফুল ফোটে।
বিন্নূরী টাউনের চার বছরে অনেক দুআর মজলিসে উস্তাদে মুহতারামের মুখে এই কবিতাটি শুনেছি। বড়দের ইন্তেকালের পর তাঁদের স্মরণে উস্তাদজী এই কবিতাটি পড়তেন। আজ উস্তাদজী নিজেই এই কবিতার বাস্তবতা। তাঁর স্মরণে বারবার আজ কবিতাটি মনে পড়ছে। তিনিও তাঁদেরই একজন ছিলেন, যার মতো মানুষ তৈরি হতে বহু বছর লেগে যায়। যে মানুষের জন্য পৃথিবী বছরের পর বছর কাঁদে।
ড. আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহ. ১০ নভেম্বর ১৯৩৫ ঈসায়ী শুক্রবার এবোটাবাদের কোকাল এলাকার এক সম্ভ্রান্ত দীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বংশগতভাবে তিনি আব্বাসী। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরব থেকে আফগানিস্তান এবং সেখান থেকে বর্তমান পাকিস্তানের এবোটাবাদে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। মেট্টিক পাস করে তিনি মাদরাসায় ভর্তি হন। মাদরাসার প্রাথমিক শিক্ষা নিজ এলাকায় সম্পন্ন করেন। ১৯৫২ সালে করাচী গমন করেন। কয়েক বছর দারুল উলুম করাচীতে অধ্যয়ন করেন। তারপর মাদরাসা আরাবিয়্যাহ নিউটাউনে (বর্তমান নাম জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়্যাহ আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নূরী টাউন) মেশকাত জামাতে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালে বিন্নূরী টাউন থেকে দাওরা সমাপ্ত করেন। তিনি ছিলেন বিন্নূরী টাউনের শুরুর দিকের ছাত্র। মুহাদ্দিসুল আসর আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নূরী রহ. (১৩২৬ হি.—১৩৯৭ হি.) ছাড়াও তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদগণের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা আব্দুল হক নাফে কাকাখিল রহ., মাওলানা আব্দুর রশীদ নুমানী রহ. (১৩৩৩—১৪২০ হি.), মাওলানা সাহবান মাহমুদ রহ., মুফতী ওলী হাসান টোংকী রহ. (১৯২৪—১৯৯৫ ঈসায়ী), মাওলানা বাদীউযযামান রহ. প্রমুখ।
বিন্নূরী টাউনে পড়াকালে হযরত বিন্নূরী রহ.—এর সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক হয়। হযরত বিন্নূরী রহ. তাঁকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। সব সময় নিজের সঙ্গে রাখতেন। তিনিও শায়খের খেদমতে নিজেকে উজাড় করে দেন। উস্তাদজী বলতেন, আমি আমার শায়খ বিন্নূরী রহ.—এর পায়ের কাছে বসে যত উপকৃত হয়েছি, আর কোথাও গিয়ে ততটা উপকৃত হতে পারিনি। দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করার পর হযরত বিন্নূরী রহ. তাঁকে বিন্নূরী টাউনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৯৬২ সালে শায়খের পরামর্শে তিনি জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারা চলে যান। সেখানে কুল্লিয়্যাতুশ শরীআহ সমাপ্ত করেন। তারপর করাচী ফিরে পুনরায় বিন্নূরী টাউনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়ে যান। শিক্ষকতার পাশাপাশি করাচী সরকারি ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী ভাষায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। অবশেষে শায়খের পরামর্শে ১৯৭২ সালে পিএইচডি করতে মিশরের আল—আযহারে গমন করেন। তাঁর পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. ইমামুল ফিকহিল ইরাকী। উস্তাদ আবু যুহরা রহ. (মৃত্যু : ১৯৭৪ ঈসায়ী)—এর অধীনে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
হযরত বিন্নূরী রহ.—এর পাশাপাশি শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. (১৩১৫—১৪০২ হি.) এবং ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ. এর সঙ্গেও তাঁর ইসলাহী সম্পর্ক ছিল। হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানুভী শহীদ রহ. (১৯৩২—২০০০ ঈসায়ী) এবং মাওলানা সরফরায খান সফদর রহ. (১৯১৪—২০০৯ ঈসায়ী)—এর খেলাফত ও ইজাযতপ্রাপ্ত ছিলেন। শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. (১৩৩৬—১৪১৭ হি.), শায়েখ আওয়ামা দা. বা., ড. বাশশার আওয়াদ মারূফ দা. বা.—সহ আরবের অনেক মাশায়েখের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। আকাবিরদের আস্থা ও স্নেহে তিনি সিক্ত ছিলেন। আরব—আজমের ওলামাগণ তাঁকে ভালোবাসতেন।
দাম্পত্যজীবনে তিনি চার ছেলে ও এক মেয়ের জনক ছিলেন। স্ত্রী—সন্তানের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল অনুকরণীয়। একদিন দরসে এক হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেন, ‘হাদীস থেকে বোঝা গেল, শরীয়তের সীমারেখার ভেতরে থেকে স্ত্রীর বৈধ বিনোদনের ব্যবস্থা করা, স্ত্রীর খুশির জন্য কখনো কখনো নিরাপদ এলাকায় পর্দার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো দূষণীয় নয়, বরং কাম্য। আমাদের এক ছাত্র, বিন্নূরী টাউনের ফাযেল ষোলো বছর যাবৎ পরিবার নিয়ে এই বন্দর নগরী করাচী শহরে থাকে। অথচ সমুদ্র সৈকত কী জিনিস, তার স্ত্রী আজও চোখে দেখেনি। সূফীরা, শোনো, এমন রসকষহীন বুযুর্গী শরীয়তে কাম্য নয়।’ আদর করে উস্তাদজী ছাত্রদেরকে ‘সূফী’ বলে ডাকতেন। সে ডাকেও যেন মধু মেশানো ছিল। আমাদের জন্য তা অনেক প্রিয় সম্বোধন ছিল।
ড. আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহ.—এর কর্মজীবন ছিল অনন্য উপমা। একজন ব্যক্তি একটি জাতির কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে ডক্টর হাবীবুল্লাহ মুখতার শহীদ রহ.—এর শাহাদাতের পর থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়্যা বিন্নূরী টাউন করাচীর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৪ সালে মুফতী নিযামুদ্দীন শামযায়ী শহীদ রহ.—এর শাহাদাতের পর বিন্নূরী টাউনের শাইখুল হাদীস মনোনীত হন। ২০১৭ সালে হযরত মাওলানা সলীমুল্লাহ খান রহ.—এর ইন্তেকালের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ ঈসায়ী থেকে আজীবন আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াতের আমীর ছিলেন। আকাবিরের রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ‘ইকরা রওযাতুল আতফাল ট্রাস্টে’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিন্নূরী টাউন থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা মাহনামা বায়্যিনাতের প্রধান সম্পাদক ছিলেন।
ড. আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার রহ. অসংখ্য দীনি প্রতিষ্ঠান ও ওলামায়ে কেরামের মুরুব্বী ছিলেন। মুসলিম জাতির একজন নিষ্ঠাবান অভিভাবক ছিলেন। সন্তানের কাছে তিনি একজন আদর্শ পিতা, স্ত্রীর কাছে একজন আদর্শ স্বামী ছিলেন। সহকর্মীদের কাছে তিনি একজন মুখলিস বন্ধু, অধীনদের কাছে একজন স্নেহশীল অভিভাবক আর আমাদের কাছে তিনি একজন প্রিয় উস্তাদ ছিলেন।
ছাত্র হিসেবে আমি তাঁর কিছুই নই, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তিনি আমার গর্ব, আমার অহংকার। তাঁর কাছে পড়ে শেখার মতো অনেক কিছু ছিল, আর তাঁকে দেখে শেখার মতো বিষয় ছিল আরও অনেক বেশি। তাঁর কথা, তাঁর চলা, মানুষের সঙ্গে তাঁর আচরণ সবই ছিল অনুকরণীয়। বিনয়ী, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও সদালাপী মানুষ ছিলেন। নববী চরিত্রের তিনি উজ্জ্বল এক উপমা ছিলেন। তাঁকে দেখে, তাঁর পথপানে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে অনেককে আমি দেখেছি। শেষযুগে তিনি ছিলেন প্রথম যুগের উপমা।
খাদেম বাজার থেকে ফল কিনে এনেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যাগ নেওয়ার সময় তিনি খাদেমের হাতে কিছু ফল তুলে দিয়েছেন। এই দৃশ্য আমি অধম একাধিকবার দেখেছি। বাচ্চারা দেখা করতে এলে পকেট থেকে টফি—চকলেট বের করে তাদের হাতে দিয়েছেন। যেদিন নিউটাউন থেকে দেশে ফিরব, উস্তাদজীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। কর্মজীবনের জন্য অতি মূল্যবান কিছু নসীহত করলেন। বিদায়ের সময় এক হাজার রুপির একটি খাম হাতে দিয়ে বললেন, এই টাকাগুলো পথে খরচ করবে। যুগপৎ উস্তাদের তরবিয়ত ও পিতার স্নেহ তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছি।
অভাবী কাউকে পেলে খামে ভরে চুপিচুপি সম্মানজনকভাবে তাকে দান করেছেন। মেহমান এলে বিদায়ের সময় নিজের পক্ষ থেকে হাদিয়া পেশ করেছেন। দীনি কাজে অকাতরে দান করেছেন। শায়েখের মতো তিনিও দুনিয়াবিমুখতা ও অমুখাপেক্ষিতার বিরল দৃষ্টান্ত ছিলেন। অল্পেতুষ্টি তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ছিল। সাদা—সিধা সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অধীনদের বেতন—ভাতা আদায়ে কোনো কার্পণ্য করতেন না। তবে নিজে মাদরাসা থেকে কোনো বেতন—ভাতা গ্রহণ করতেন না। সম্পদ সঞ্চয় করা তাঁর স্বভাব—বিরোধী ছিল। শেষদিন পর্যন্ত মাদরাসার কোয়ার্টারে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। দীনের খেদমত করতে পারাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। পার্থিব বিনিময়ের জন্য তিনি কোনো কাজ করতেন না।
২০০৪ সালে স্ট্রোক করার পর থেকে একা চলতে পারতেন না। এক হাতে লাঠি, অপর হাতে কারও সাহায্য নিতে হয়েছে। কখনো সুযোগ পেলে আমরা তাঁর হাত ধরে ধন্য হওয়ার চেষ্টা করেছি। হাত ছাড়ার সময় কোনোদিন তিনি ‘জাযাকাল্লাহ’ বলতে ভুলেননি। অসুস্থ হয়েও কোনোদিন দায়িত্বে অবহেলা করেননি। জুমা ও জামাতে কখনো অনুপস্থিত থাকতেন না। দরসে যেমন নিয়মিত উপস্থিত হতেন, অফিসের কাজেও তিনি কখনো অলসতা করেননি। বিন্নূরী টাউন তাঁর কাছে তাঁর শায়েখের আমানত ছিল। আজীবন এই আমানতে কোনো খেয়ানত হতে দেননি।
বুখারী শরীফের দরসে তিনি যেমন জ্ঞানগর্ভ তাকরীর পেশ করতেন, তার চেয়ে বেশি অধিক সুন্নাহ অনুসরণের প্রেরণা জোগাতেন। বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, اليَدُ العُلْيَا خَيْرٌ مِنَ اليَدِ السُّفْلَى (দাতার হাত গ্রহীতার হাত অপেক্ষা উত্তম)। উস্তাদজী যেদিন এ হাদীসের দরস দিয়েছেন, দেওয়া—নেওয়ার তফাৎ সেদিন নতুন করে বুঝেছি।
হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
بَايَعْتُ رَسُولَ اللّূهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى إِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেছি সালাত কায়েম করার, যাকাত দেওয়ার এবং সকল মুসলিমের কল্যাণ কামনা করার।
এই হাদীসের দরস প্রদানের সময় মুসলমানের কল্যাণকামনার যে স্পৃহা মনে সৃষ্টি হয়েছিল আজও তা অনুভব করি। তাঁর কথাগুলো হৃদয়ের গহীন থেকে উৎসারিত হতো এবং অন্যান্য হৃদয়কে স্পর্শ করত।
ইবাদত—বন্দেগী ও কর্মব্যস্ততা থেকে যেটুকু সুযোগ পেতেন কিতাব মুতালাআ করে কাটাতেন। অবসর পেলে লেখালিখি করতেন। তাঁর রচিত আত তরীকাতুল আসরিয়্যাহ ফী তাআল্লুমিল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ পাকিস্তানের বেফাকুল মাদারিসের সিলেবাসভুক্ত। বইটি শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, আরব আমিরাতেও অনেক প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়। মৌলিক রচনা ও অনুবাদকর্ম মিলে ডজনের অধিক আরবী—উর্দু গ্রন্থ তিনি রেখে গেছেন। এর বাইরেও আরবী—উদুর্তে তাঁর অনেক ছোট প্রবন্ধ রয়েছে। আরব—আজমের মধ্যে তিনি দোভাষীর কাজ করেছেন। আকাবিরগণের চিন্তাধারা, তাঁদের কর্ম আরব মাশায়েখগণের সামনে তুলে ধরেছেন। ড. বাশশার আওয়াদ মারূফ তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
যতদিন ছিলেন দীনের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে বেঁচে ছিলেন। নম্র—ভদ্র বিনয়ী এই মানুষটি কখনো বাতিলের সামনে নত হননি। দীনের ব্যাপারে কারও সঙ্গে আপস করেননি। নিজেকে তিনি ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। জামিয়া হাফসা ও লাল মসজিদের ঘটনায় তাঁর ভূমিকা ছিল অতি প্রশংসনীয়। তিনি ঘরে বসে নেতৃত্ব দেননি, মৃত্যুর মুখে নিজেকে সর্বাগ্রে রেখেছেন। নেতৃত্ব থেকে তিনি সর্বদা দূরে থাকতে চেয়েছেন, কিন্তু রবের পক্ষ থেকে বারবার তাঁর কাঁধে দায়িত্ব ও নেতৃত্ব অর্পিত হয়েছে। দেশ—বিদেশে ঘুরে মানুষকে দীনের প্রতি আহ্বান করেছেন। দীনের দরদ ও দিলের ব্যথা নিয়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। দেশ—মহাদেশ ঘুরে ঘুরে তিনি সবাইকে এক উম্মাহ হওয়ার প্রতি আহ্বান করেছেন।
সম্ভবত ২০১০/২০১২ সালে শেষবারের মতো উস্তাদজী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। মাদরাসা মুঈনুল ইসলাম বসুন্ধরায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। অনেকদিন পর কিছু সময় তাঁর স্নেহের পরশ পেয়েছিলাম। একটা অজানা আতঙ্ক তখনও ছিল, এই বুঝি শেষ দেখা। উস্তাদজীর খুব কাছের খাদেম ছিলেন মুফতী রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশি। ওই সফরে তিনি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিদায়ের সময় উস্তাদজী পকেটে হাত দিলেন, যা ছিল সবটুকু প্রিয় খাদেমের হাতে তুলে দিয়েছেন।
অর্পিত দায়িত্ব পালন করে ৮৬ বছর বয়সে তিনি আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জান্নাতের পথে তিনি যাত্রা করেছেন। জানাযায় অংশগ্রহণের সৌভাগ্য এই অভাগার হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাঁর জানাযার দৃশ্য ছিল অন্যরকম। সকলেই ছিল ব্যথিত, অশ্রম্নসিক্ত। যতদূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। কে জানে, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছিল জানাযার সারি। এরা সবাই কি এই জমিনের অধিবাসী, নাকি ওপর থেকে কেউ নেমে এসেছিল? সাদ ইবনে মুআয রাযি.—এর জানাযায় অংশগ্রহণকারীগণ কি আবারও নেমে এসেছিল? ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর এমন জানাযা দেখেই হয়তো খলীফা হারুনুর রশীদ বলেছিলেন, আমি কীসের বাদশা, আসল বাদশাহ তো তিনি। তিনি ইমাম আবু ইউসুফ নন, তবে দুজনের জানাযায় অনেক মিল ছিল।
বিন্নূরী টাউনের অনেক মজলিসে উস্তাদজীর মুখে শুনে শুনে আরও একটি হাদীস মুখস্থ হয়েছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ العِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ العِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ العِلْمَ بِقَبْضِ العُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا، فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا.
আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তর থেকে ইলম বের করে উঠিয়ে নেবেন না; বরং আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তিনি ইলম উঠিয়ে নেবেন। যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট রাখবেন না তখন লোকেরা জাহেলদেরকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। তাদের কাছে (দীনি বিষয়ে) জিজ্ঞাসা করা হবে, তারা না জেনেই ফত্ওয়া দেবে। ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ হবে, অন্যকেও গোমরাহ করবে।— সহীহ বুখারী, হাদীস : ১০০
উস্তাদজী চলে গেছেন। ইলমে নববীর বাহকগণ একে একে বিদায় নিচ্ছেন। জাহেল ধর্মীয় নেতাদের আবির্ভাব হচ্ছে। দেশে—বিদেশে সবখানে শুধুই শূন্যতা। জানি না, এই শূন্যতা কবে পূরণ হবে? একজন আহমদ শফী, একজন পালনপুরী, একজন আব্দুর রাযযাক ইস্কান্দার, চাটগামী আর বাবুনগরী এই ক্রান্তিকালে উম্মাহর কত প্রয়োজন!
হে আল্লাহ, আমাদেরকে সবরে জামীল দান করুন। অসহায় জাতিকে উত্তম বিকল্প দান করুন।