প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

শিক্ষিত সমাজের একাংশের ধমীর্য় জ্ঞানের অভাব

শিক্ষিত সমাজের একাংশের ধমীর্য় জ্ঞানের অভাব

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী


বাংলাদেশের আধুনিক সমাজে ধমীর্য় জ্ঞান না থাকা এখন আর কোনো লজ্জার বিষয় নয়। একসময় প্রাথমিক ধমীর্য় জ্ঞান না থাকলে মানুষ লজ্জিত হতো। কালেমা, কালাম, নামায, দুআ বা সাধারণ ধমীর্য় রীতি—নীতি, আদব—কায়দা না জানলে মানুষ সমাজে হেয় হয়ে থাকত। অনেক ক্ষেত্রে নিজেকে গুটিয়ে রাখত। বর্তমানে এমনটি আর নেই। ধমীর্য় জ্ঞান না থাকলেই বরং মানুষ বেশি আধুনিক হয়। নিজেকে প্রগতিশীল মনে করে। উন্নত মানুষ মানেই নামায—বন্দেগী সঠিকভাবে জানবে না। এমনকি সমাজের উচ্চ শ্রেণি হওয়ার নমুনা হচ্ছে যার ধমীর্য় জ্ঞান ও আচরণ ভুলে ভরা। বেশি প্রগতিবাদী ও আধুনিক মানুষ সে—ই যার ইসলামী প্রতিক ও পরিচয় যত বেশি ত্রুটিপূর্ণ ও কম। সমাজে এই মানসিকতা একটি জাতির অধঃপতনের দৃষ্টান্ত। অথচ এই সমাজই অশিক্ষিত মানুষকে ঘৃণা করে। মানসম্পন্ন ডিগ্রিধারী না হলে গুণী মানুষকে অবহেলা করে। সশিক্ষিত যোগ্য ও জ্ঞানী মানুষকেও পাত্তা দেয় না। সাধারণ পড়ালেখা না থাকলে কিংবা কথাবার্তা ও আচরণে শিক্ষিতের মতো মনে না হলে তারা মানুষকে লজ্জা দেয়। লেখা বা কথা বলা অশুদ্ধ হলে সমাজে মানুষ হেয় হয়। কিন্তু ধমীর্য় শিক্ষার বেলা ঠিক তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়।

গত ১১ এপ্রিল ২০২৩ বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। তিনি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবী একজন কর্মবীর ছিলেন। তার জীবনের আদর্শ, বিশ^াস ও চেতনা নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। কারণ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশে^ একটা আদর্শিক সংকট চলছে। শিক্ষিত মুসলমানদের অনেকেই আদর্শ হিসাবে এককভাবে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে অনুসরণ করতে প্রস্তুত নয়। তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থ ও রাজনীতিতে পশ্চিমাদের আদর্শ অনুসরণ করে থাকে। আমরা জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে এখানে আলোচনা করব না। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এ ঘটনায় উঠে আসা কিছু সামাজিক চিত্র। যা বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের একাংশের বেশ অন্ধকার একটা দিক তুলে ধরতে সক্ষম।

প্রথমেই ধরা যাক, সুন্নতের অনুসরণ না করে একাধিক জানাযার ফ্যাশন। যা এখন বাংলাদেশে একটি ধমীর্য় বিধানের তুলনায় নিছক সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। একটু পরিচিত ও অধিক সংশ্লিষ্ট লোক হলে তো আর কথাই নেই। তার একাধিক বা চার—পাঁচটি জানাযা হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ শরীয়তের এ বিধানটি ফরযে কেফায়া। কিছু লোক একবার জানাযা পড়লে বাকি সব মুসলমানের কাঁধ থেকে এ দায়টুকু নেমে যায়। কেউই জানাযা না পড়লে সমাজের সবাই গোনাহগার হয়।

ডাক্তার সাহেবেরও একাধিক জানাযা হয়েছে। একটি জানাযায় দেশের নানা পর্যায়ের বিশিষ্টজনেরা অংশগ্রহণ করেন। দেশের কয়েক জন প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখা গেছে তারা পরস্পরকে দেখে দেখে নামাযের অনুশীলন করছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম বষীর্য়ান বুদ্ধিজীবী এক শিক্ষককে ঈদের নামাযের মতো জানাযার ইমাম সাহেবের প্রতি তাকবীরে হাত তুলতে দেখা গেছে। অথচ তিনি লক্ষ করছিলেন যে স্বয়ং ইমাম সাহেবই জানাযায় বার বার হাত তুলছেন না। পাশের মুসল্লীরাও না। তার দেখাদেখি তারই পাশের এক ভদ্রলোক এভাবেই প্রতি তাকবীরে হাত তুলছিলেন। তিনিও দেশের প্রথম কাতারের একজন বষীর্য়ান বুদ্ধিজীবী। অবশ্য তারা দুজনই জানাযায় হাত তোলার বিষয়ে সংশয়িত ছিলেন এবং একে অপরের দিকে, কখনো ইমাম সাহেব ও অন্য মুসল্লীদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। ঠিক করণীয় নির্ধারণ করতে না পেরে উভয়েই লাজুক ভঙ্গিতে শেষ দুই তাকবীরে হাত না তোলা দলের পক্ষে চলে যান।

জানাযার দৃশ্যটি ভিডিও আকারে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসায় দেশবাসী সেটি দেখার সুযোগ পায়। দুঃখ লাগে এসব বিশিষ্টজন দুনিয়ার লাইনে বড় বড় ডিগ্রিধারী হয়েছেন কিন্তু মুসলমান হিসাবে নিজেদের অপরিহার্য দীনি শিক্ষাটুকু অর্জন বা চর্চা করেননি। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কেউ এসব দৃশ্য দেখার পর বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের এই অংশটিকে কার্যত ধর্মহীন না বলে উপায় আছে কি? ধর্মহীন সেক্যুলার সমাজ যাদের স্বপ্ন তাদের আশা পূরণ হতে আর কিছু বাকি আছে কি?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আরেকটি জানাযা হয় তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানেও ছিল ব্যাপক অজ্ঞতা ও অনিয়ম। জানাযায় প্রথম কাতারে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুয়েকজন মহিলাকেও জানাযা পড়তে দেখা যায়। অথচ তারা সামান্য দূরে দর্শনার্থীদের সাথে অপেক্ষায় থাকতে পারতেন। একান্ত যদি জানাযায় শরিক হওয়ার ইচ্ছাই থাকত তাহলে নারীদের স্থানে তাদের মতো করে জানাযা পড়ে নিতেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ দেখতে পেল শরীয়তের ধার না ধেরে যে যা ইচ্ছা তা—ই করে গেছেন।

ডাক্তার সাহেবের পরিবারের কিছু সদস্য ও আত্মীয়—স্বজন এমন সব আচরণ ও উক্তি করেছেন, যার সাথে শরীয়তের কোনো মিল নেই। এমনকি বাংলাদেশের সমাজেও এসব চলে না। তার লাশ দাফন করা হবে, না মেডিকেল কলেজে দান করা হবে, এ নিয়ে দীর্ঘ সময় আত্মীয়—স্বজন ও পরিবারের মধ্যে বাহাস চলে। শেষ পর্যন্ত পরিবারের তরফ থেকে বলা হয়, আমাদের ইচ্ছা ছিল তার লাশ দান করার, কিন্তু সামাজিক কারণে আমরা দাফন করার দিকেই মত দিয়েছি। তাছাড়া আরেকটি কারণ হিসাবে তারা বলেন, দেশের কোনো মেডিকেল কলেজ তার লাশ নিতে এজন্য রাজি হচ্ছে না যে, তার মতো শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তির দেহে কেউ ছুরি চালাতে সম্মত হবে না। তাই তার লাশ কেউ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসছে না।

যারা ঢালাওভাবে নিজেদের মরদেহ দান করার পক্ষে ক্যাম্পেইন করেন, তাদের জন্য এখানে একটি বাস্তব শিক্ষা রয়েছে। ইসলাম এজন্যই মরণোত্তর দেহ দানকে সমর্থন করে না। কারণ প্রতিটি মুমিনের দেহের প্রতি ইসলাম দয়ার্দ্র। ঈমানদার নারী—পুরুষ মাত্রের প্রতিই ইসলাম শ্রদ্ধা ও সম্মানের আচরণ করার পক্ষে। এখানে লাশ দাফনের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া, মৃতদেহটি দান করে দেওয়ার পক্ষেই মত ও পছন্দ প্রকাশ করা এবং সামাজিক কারণে দাফনে সম্মত হওয়া থেকে তার আত্মীয়—পরিজনের ধমীর্য় ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ডাক্তার চৌধুরীর বিভিন্ন শোকসভায় দেশের সেরা নাগরিকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু এই সেরাদের ধমীর্য় শিক্ষা, জ্ঞান ও আচার—আচরণ ছিল আরও বেশি হতাশাজনক। জানাযা তো সবকটি ছিল লক্কর—ঝক্কর মার্কা। আর শোকসভাগুলোও ছিল ঈমানী দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোই ধ্বংসস্তূপ। এক আলোচনার শেষে তারা দুআও করেছেন। কিন্তু সেখানে ন্যূনতম ধমীর্য় শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তিকেও দেখা যায়নি। সম্পূর্ণ অজ্ঞান, অশিক্ষা ও অস্থিরতায় পূর্ণ এক ব্যক্তি আবল—তাবল কিছু আওড়ে গেছেন, যা আরবী দুআ—কালাম, খুতবা ও কিছু আয়াতের সাথে নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। পরকাল বিষয়ে অস্পষ্ট ভাবধারা থেকে বর্ণিত সব অবহেলা ও উদাসীনতার জন্ম। যেসব বিষয়কে তারা জরুরি মনে করেছেন সেসব অনেক বিষয়েই তারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। আর যেসব বিষয় গুরুত্ব পায়নি সেসব ক্ষেত্রে তারা যারপরনাই দুর্বল।

শোকসভায় এক আলোচক বলেছেন, ‘ডাক্তার সাহেব মান্না দে’র গান শুনতে খুবই পছন্দ করতেন। এক ক্যাসেট বার বার বাজাতে থাকতেন। তাই জীবন—মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার নিকটজন তার কানের কাছে মান্না দে’র গান গেয়ে শুনিয়েছেন। যেন তিনি তার পছন্দের গানের কলি শুনে স্বস্তি পান।’ এটি তাদের পারিবারিক অভিরুচি অথবা তারা যে সোসাইটিতে সীমাবদ্ধ তার কালচার। তবে এমন মুহূর্তে মুমিনদের প্রতি ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে, পবিত্র কোরআন, বিশেষ করে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা। ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যু শয্যাশায়ী ব্যক্তির কাছে গিয়ে কালেমার তালকীন করা। যা বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি মানুষ পালন করার চেষ্টা করে। ১০০ জন মুসলমানের মধ্যে হয়তো পাঁচ ভাগই ধমীর্য় এ বিধান থেকে দূরে সরে গিয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের প্রসূতিকে হাসপাতালে ভর্তি করে নর্মাল বা সিজারে বাচ্চা হওয়ার পর পারিপাশি^র্ক কারণে শিশুর কানে আযান—ইকামত দেওয়া থেকে বঞ্চিত করছেন। ঘরে—বাড়িতে সন্তান জন্মের পরও এ বিষয়ে ইদানীং বেশ অবহেলা দেখা যায়। অথচ ঈমান, ইসলাম ও শরীয়তের এসব রীতি, বিধান ও কালচার ছিল বাংলাদেশের মূল ভাবসম্পদ। সমাজের সকল স্তরে এসব বিষয়ের প্রসার ও পরিপালনে আলেম—ওলামাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। সমাজের উচ্চ পর্যায়ে দীনি শিক্ষা ও সাধারণ জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি করাও তাদেরই ধমীর্য় দায়িত্ব। সবাই সচেতন হলে ধর্মহীনতার অন্ধকার থেকে জাতি রক্ষা পাবে। মুসলিম সমাজ তাদের আলোকিত বোধ, বিশ^াস ও জীবনাচার থেকে বঞ্চিত হবে না। ধর্মহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে না।

লেখক, মহাপরিচালক, বেফাক

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন